২২. সেন্ট মাংগোস হসপিটাল ফর ম্যাজিকাল ম্যালাডিস অ্যান্ড ইনজুরিস
হ্যারি ভাবতে পারছে না ওর চিরাচরিত বিরোধীনী প্রফেসর ম্যাকগোনাগল কেন ওকে সোজা ডাম্বলডোরের কাছে নিয়ে যেতে চাইছেন। তবুও ও তড়াক করে বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে কোনও রকমে ড্রেসিং গাউনটা গায়ে জড়িয়ে, চশমাটা নাকে লাগিয়ে দাঁড়ালো।
–রন তোমারও সঙ্গে যাওয়া দরকার, ম্যাকগোনাগল বললেন।
ওরা দুজনে প্রফেসর ম্যাকগোনাগলের সঙ্গে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ডিন, নেভিল আর সিমাসের সামনে দিয়ে ডরমেটরি ছেড়ে, কমনরুমের ঘোরানো সিঁড়ি পোর্ট্রেট হোল এবং চাঁদের আলোয় আলোকিত ফ্যাটলেডির করিডোর দিয়ে ডাম্বলডোরের অফিসের উদ্দেশ্যে চললো। চলতে চলতে হ্যারির মনে হলো মনের মধ্যে যে আতঙ্ক-উদবেগ জমাট বেঁধে রয়েছে যেকোনও সময়ে সেগুলো মুখ দিয়ে গলগল করে বেরিয়ে আসবে। ও তীব্র আর্তনাদ করতে করতে ডাম্বলডোরের কাছে ছুটে যেতে চাইলো। আশ্চর্য! ওদিকে মি. উইসলি রক্তাপ্লুত হয়ে অন্ধকার এক করিডোরে পড়ে রয়েছেন আর ওরা শান্ত-ধীর হয়ে হেঁটে চলেছে? আর ওর ধারালো ছুরির মতো দাঁতগুলো বিষেভরা হয়? মিসেস নরিসের সামনে দিয়ে যাবার সময় ল্যাম্পের মতো দুচোখের দৃষ্টিতে ওদের দেখে খুব আস্তে মুখ দিয়ে শব্দ করলেন। হিস; কিন্তু প্রফেসর ম্যাকগোনাগল বললেন শফটু। সঙ্গে সঙ্গে মিসেস নরিস অন্ধকারে ডুবে গেলেন। কয়েক মিনিট পর ওরা পাথরের তৈরি গারগয়েলের (বাঘের মুখাকৃতি বৃষ্টির জল নিষ্কাশনের পাইপে ব্যবহৃত হয়) সামনে ডাম্বলডোরের অফিসে যাবার দরজার মুখে দাঁড়ালো।
–ফিজিং হুইজবী, ম্যাকগোনাগল বললেন।
গারগয়েলের তুত হয়ে সামান্য সরে গেলো। সংলগ্ন বড় পাথরের দেওয়ালটা গরগর শব্দ করে দ্বিখণ্ডিত হতেই একটা পাথরের তৈরি সিঁড়ির (স্টেয়ার কেস) সামনে ওরা দাঁড়ালো। স্টেয়ার কেসটা এসক্যালেটরের মতো (যন্ত্রচালিত সিঁড়ি) উঠছে–নামছে। সেই চলমান সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা রাখতেই ওরা সর সর করে ওপোরে উঠতে লাগলো। ওদিকে শব্দ করে দ্বিখণ্ডিত পাথরের দেওয়াল জুড়ে গেলো। একটা ওক কাঠের চকচকে পালিশ করা দরজার কাছে এসক্যালেটর পৌঁছাতেই ওরা নেমে পড়লো। দরজা খোলার জন্য পেতলের চকচকে নকার, দেখতে অনেকটা গ্রিফিনর মতো।
মাঝ রাত পার হয়ে গেছে, তাহলেও হ্যারি বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে কথাবার্তা শুনতে পেলো। দুএকজনের নয়, মনে হলো ডাম্বলডোর অন্তত এক ডজন অতিথিদের সঙ্গে কথা বলছেন।
প্রফেসর ম্যাকগোনাগল তিনবার গ্রিফিন নারে বেশ জোরে আঘাত করতেই ঘরের ভেতরের শব্দ বন্ধ হয়ে গেলো। ঠিক যেনো হঠাৎ লোডশেডিং। বন্ধ দরজাটা আপনা-আপনি খুলে যেতেই প্রফেসর ম্যাকগোনাগল হ্যারি আর রনকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন।
ঘরটা আধো আলো আধো অন্ধকার! হ্যারি আগের মতই দেখলো টেবিলের ওপোর রাখা রূপোর যন্ত্রপাতিগুলো শব্দহীন, ঘুরছে আর দমকে দমকে ধোঁয়া। নিঃসৃত হচ্ছে (এর আগেও হ্যারি ওইরকমই দেখেছে)। দেওয়ালে ঝোলানো। অতীতের সব হেডমাস্টার–হেডমিস্ট্রেস ফ্রেমে বাঁধানো ফটোর মধ্যে বন্দি হয়ে নাক ডেকে চলেছেন মৃদু মৃদু। ঠিক দরজা বরাবর অতি সুন্দর লাল আর সোনালী রং-এর রাজহাঁসের আকারের মত একটা পাখি তার ডানার মধ্যে মুখ গুঁজে তার দাঁড়ে বসে তন্দ্রা যাচ্ছে।
–ওহো, প্রফেসর ম্যাকগোনাগল! আসুন আসুন। ডাম্বলডোর তার টেবিলের পিছনে বিরাট গদিমাড়া চেয়ারে বসে; টেবিলের দিকে সামান্য ঝুঁকে পড়েছেন। টেবিলের ওপোর গাদাগাদা ফাইল, কাগজপত্র। আলো বলতে বিরাট একটা মোমবাতি। সেই মোমবাতির আলোতে কাগজপত্র দেখছেন। পরনে তার অতি মূল্যবান লাল আর সোনালী সূতোতে এমব্রয়ডারি করা ড্রেসিংগাউন। গাউনের ওপোর চড়িয়েছেন দুগ্ধফেনিভ সাদা নাইটশার্ট; কিন্তু গভীর রাতেও বেশ দৃঢ়ভাবে কাজ করে চলেছেন। হালকা সবুজ রঙ-এর দুই চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ম্যাকাগোনাগলের দিকে তাকিয়ে বললেন, প্রফেসর ম্যাকগোনাগল পটার কী খুব খারাপ একটা নিশা স্বপ্ন দেখেছ? ও কি আপনাকে বলেছে।
-নিশাস্বপ্ন নয়, হ্যারি একটুও বিলম্ব না করে বললো।
প্রফেসর ম্যাকগোনাগল, হ্যারিপটারের মুখের দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে বললেন, হাঃ খুব ভাল। তাহলে যা ঘটেছে তুমি বলছো, সেটা হেডমাস্টারকে বলো।
–আ… আমি ঘুমোচ্ছিলাম, হ্যারি বললো। ওর চেহারা এবং উৎকণ্ঠিত মুখোভাব দেখে ডাম্বলডোরকে বিন্দুমাত্র বিচলিত না দেখে ও বেশ রেগে গেলো। ডাম্বলডোর যেমন মুখ নামিয়ে কাজ করছিলেন তেমনি করতে লাগলেন, হ্যারির দিকে তাকালেন না। কাজ বন্ধ রেখে দুহাতের আঙ্গুলগুলো ইন্টার্লকড করে বসে রইলেন। হ্যারি এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো, সাধারণ স্বপ্ন নয় আমি স্বচক্ষে দেখেছি ঘটনাটা, মি উইসলিকে একটা বিরাট সাপ কামড়ে দিয়েছে।
হ্যারির কথাগুলো ডাম্বলডোরের ঘরে প্রতিধ্বণিত হতে থাকে। ওর কথাগুলো যা ও বললো, তা অবাস্তব ও অদ্ভুত। ডাম্বলডোর একটু নড়েচড়ে বসলেন এবং ঘরের সিলিং-এর দিকে তাকালেন। রন, হ্যারি ডাম্বলডোরের দিকে তাকালো।
ডাম্বলডোর খুব শান্ত স্বরে প্রশ্ন করলেন হ্যারির দিকে দৃষ্টিপাত না করে, তুমি কেমন করে দেখলে?
–না, আমি ঠিক জানি না, (হ্যারি তখনও শান্ত হয়নি)। তাতে কি আসে যায়? কিন্তু আমি দেখেছি, আমার মাথার ভেতর সেই দৃশ্য ঘুরপাক খাচ্ছে, আমার মনে হয়…।
–তুমি আমাকে ভুল বুঝেছে পটার। ডাম্বলডোর একইরকমভাবে বসে, একইরকম সুরে বললেন, আমি বলছি জায়গাটা কোথায় ঘটেছে, তুমি সেই সময় কোথায় ছিলে?
হ্যারি অবুঝের মতো ডাম্বলডোরের দিকে তাকালো।
–সাপের প্রসঙ্গে যদি বলতে হয় তাহলে সেই সাপটা আমি। ঘরের সকলেই নির্বাক! ওর কথা শুনে।
রন ফ্যাকাসে মুখে দাঁড়িয়েছিলো। ডাম্বলডোর রনের দিকে তাকালেন, আর্থারের আঘাত কী খুব বেশি?
–হ্যাঁ, হ্যারি জোর দিয়ে বললো, মারাত্মক রকমভাবে সাপটা আর্থারকে কামড়ে দিয়েছে, শরীর থেকে রক্তপাত বন্ধ হচ্ছে না, বড় বড় দাঁত দিয়ে কামড়েছে। সব শোনার পরও ডাম্বলডোর অতি সাধারণভাবে নিচ্ছেন শুধু তাই নয়, একবার ভুলেও হ্যারির দিকে তাকাচ্ছেন না!
ডাম্বলডোর হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। হ্যারিও লাফিয়ে উঠলো। ডাম্বলডোর দেওয়ালের একটা পোর্ট্রেটের দিকে তাকিয়ে বললেন–এভার্ড? তারপর তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন, তুমিও ডিলিস?
একজন পাণ্ডুবর্ণ মুখের জাদুকর, মাথায় ছোট ছোট করে কাটা কালো চুল। আর একজন রূপালী ফ্রেমে আবদ্ধ অতি বৃদ্ধ এক জাদুকর। দুজনকে দেখে বোঝা যায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন, ডাম্বলডোরের কথা শুনে তাদের বন্ধ চোখ খুলে গেলো।
–তোমরা অবশ্যই শুনেছো?
–স্বভাবতই সব শুনেছি।
–শোনো, এভার্ড এবং ডিলিস, তুমি জানাবে ও ভুল লোক নয়। ভুল করবে।
কথাটা শুনে দুজনেই পাশে সরে গেলো। তারপর আর তাদের ফ্রেমের মধ্যে দেখতে পাওয়া গেলো না। একটা ফ্রেমে ব্র্যাকগ্রাউন্ড, অন্যটায় রয়েছে দুটো চেয়ারের ছবি।
হ্যারি দেখলো ফ্রেমের মধ্যে যেসব হেডমাস্টার হেডমিস্ট্রেস বসেছেন তারা কৌতূহলী দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
ডাম্বলডোর এবার মুখ তুলে রন, হ্যারি আর হারমিওনকে বললেন–এভারড আর ডিলিস হোগওয়ার্টসের খুবই বিশ্বস্ত। ও নামী হেড ছিলেন। তারপর, দাঁড়ে বসে ঝিমিয়ে থাকা সোনালী-লাল পাখির গায়ে হাত দিয়ে বললেন, ওরা দুজন এতো নামী হেড ছিলেন যে, হোগার্টস ছাড়া অন্য ম্যাজিক স্কুলেও ওদের পোর্ট্রেট আছে। ওরা বলতে পারবেন আসল ঘটনা কি! জায়গাটা কোথায়।
হ্যারি বললো, মি. উইসলি তো যেকোনও জায়গায় থাকতে পারেন।
–অনুগ্রহ করে তোমরা সবাই চেয়ারে বসো। প্রফেসর এভার্ড আর ডিলিস যেকোনও মুহূর্তে এখানে ফিরে আসবে। দয়া করে ওদের বসার জন্য আরও দুটো চেয়ার ঠিক করে রাখুন।
প্রফেসর ম্যাকগোনাগল জাদুদণ্ডটা ড্রেসিং গাউনের পকেট থেকে নিয়ে হাওয়াতে নাড়তেই তিনটে চেয়ার হাওয়াতে ভেসে এলো। তবে কাঠের সেই চেয়ারগুলো অতি সাধারণ। হ্যারির ওপোর ডাম্বলডোর ইতোমধ্যে ঐন্দ্রজালিক প্রভাব বিস্তার করেছেন। হ্যারি মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ারে বসে পড়লো। ডাম্বলডোর। তার প্রিয় ফকেসের ফুলো ফুলো সোনালী মাথায় মৃদু মৃদু চাপড় দিতে লাগলেন। ফকেসের (ফেনিক্স) ততক্ষণে ঘুম ভেঙে গেছে। ও মাথাটা উঁচু করে উজ্জ্বল দুই চোখে ডাম্বলডোরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
ডাম্বলডোর খুব চাপা গলায় বললেন–আমাদের একটা সতর্ক বার্তার দরকার হবে।
বলার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠলো। তারপর ওকে আর দেখা গেলো না।
তারপর ডাম্বলডোর টেবিলে রাখা একটা হালকা রূপোর ইনস্ট্রমেন্ট (হ্যারি এর আগে কখনোও ওইরকম বাজনা দেখেনি) নিজের ডেস্কের ওপোর রেখে তার ওপোর জাদুদণ্ড ঠেকালেন।
বাজনাটা তৎক্ষণাৎ বাজতে শুরু করে দিলো। তারই সঙ্গে ওপরে রাখা সরু পাইপ থেকে হালকা সবুজ ধোয়া বেরোতে লাগলো।
কিছুক্ষণ পর সেই হালকা সবুজ ধোয়া একটু একটু করে ঘন হয়ে সাপের মতো পাকাতে পাকাতে একটা সাপের মাথাতে রূপান্তরিত হলো। বিরাট তার মুখ গম্বর। হ্যারি সেই বিরাট আকারের সবুজ সাপের মুণ্ড দেখে হকচকিয়ে গেল। তাহলে কী ডাম্বলডোরের বাদ্যযন্ত্র ওর কথা স্বীকার করছে? ও ভাবলো ডাম্বলডোর নিশ্চয়ই এতক্ষণে ওর কথা বিশ্বাস করেছেন, আর মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকবেন না।
ডাম্বলডোর বিড় বিড় করে কিছু বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ হবেইতো খুবই স্বাভাবিক। (সম্ভবত: নিজেকে বললেন)। তখনও তার দৃষ্টি ধোঁয়ার বন্যায়, মুখে কণামাত্র আশ্চর্য হবার ছাপ নেই।
–তাহলে উপাদান বিভক্ত?
হ্যারি প্রশ্নের মাথা-মুণ্ড কিছু বুঝতে পারলো না।
ডাম্বলডোর সেই ইনস্ট্রমেন্টের ওপোর হাতের জাদুদণ্ড আবার ছোঁয়ালেন। ক্লিংক শব্দ হতেই সেই পাকানো পাকানো সবুজ ধোয়া ধীরে ধীরে কমতে শুরু করলো। তারপর শব্দ বন্ধ হয়ে যেতেই ধোয়ার সাপ নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর অদৃশ্য হয়ে গেলো।
হ্যারি ছটফট করতে লাগলো সেই অদ্ভুত রূপোর বাদ্যযন্ত্রটা কি তা জানার জন্য। কিন্তু কোনও প্রশ্ন করার আগেই ওরা যে ঘরে বসেছিলো তার দক্ষিণ দিকের ছাদে একটা মাঝারি আকারের শব্দ হলো। ও দেখলো জাদুকর এভার্ড হাফাতে হাঁফাতে নিজের প্রোট্রেট ফ্রেমে চলে গেলেন।
–ডাম্বলডোর!
খবর পেলেন? ডাম্বলডোর তৎক্ষণাৎ বললেন।
–আমি চিৎকার করে চললাম যতক্ষণ না কাউকে দৌড়াতে দৌড়াতে আসতে দেখলাম। যে জাদুকর খুঁজতে বেরিয়েছিলো সে পর্দার আড়াল থেকে বললো আমি নিচে কারুর পদশব্দ শুনতে পেলাম–তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওরা আমার চিৎকারের সত্যতার কারণ জানার জন্য নিচে নেমে যাচাই করতে গেলো। আপনি তো জানেন সেখানে কোনও পোর্ট্রেট নেই–লুকিয়ে তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করার। যাই হোক কিছুক্ষণ পরে ওরা সেই রক্তমাখা লোকটির দেহ নিয়ে গেলো। লোকটার অবস্থা দেখে মৃত কি জীবিত বুঝতে না পেরে ওরা চলে যাবার পর এলফ্রিডা ক্র্যাগেরের প্রোট্রেটে ঢুকে পড়লাম সম্যক ব্যাপারটা জানার জন্য।
–ঠিক করেছেন, ডাম্বলডোর বললেন (রন সামান্য কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ঘুরছিল) আমার মনে হয় ডিলিস ঠিকভাবে ওদের দেখেছে।
কয়েক মুহূর্ত পরে দ্বিতীয় জাদুকরী (তার পোর্ট্রেটে ফিরে চেয়ারে বসেছিলেন) বললেন, ওরা ওকে সেন্ট মাংগোস হাসপাতালে নিয়ে গেছে ডাম্বলডোর। তার অবস্থা খুব উদ্বেগজনক মনে হলো।
–আপনাদের ধন্যবাদ, ডাম্বলডোর বললেন। তারপর প্রফেসর ম্যাকগোনাগলের দিকে তাকালেন, মিনার্ভা, আমার মনে হয় উইসলির ছেলে মেয়েদের খবরটা দেওয়া দরকার।
–হ্যাঁ, হ্যাঁ তাতো নিশ্চয়ই…।
ম্যাকগোনাগল চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজার গোড়ায় গেলেন। হ্যারি আড়চোখে রনের দিকে তাকালো। রনের মুখ ভয়ঙ্কর আতঙ্কিত।
–হ্যাঁ, ডাম্বলডোর, মল্লির অবস্থা কী? প্রফেসর দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে বললেন।
ডাম্বলডোর তার প্রিয় পাখির দিকে তাকিয়ে বললেন, কাজ শেষ করে ফকেস সব খবরা-খবর দেবে। যা করবার তা আগেই মল্পি করেছে। ওর কাছে যে আজব ঘড়ি আছে পরিবারের ভালমন্দ জানবে ঘড়ির কাঁটা দেখে।
হ্যারি জানে সেই ঘড়িটার কাজ সময় নির্দেশ নয়, উইসলি পরিবারের লোকেরা কে কোথায় ও কেমন আছে জানানো। মি. উইসলির হাত নিশ্চয়ই মৃত্য পথের দিকে নির্দেশ দিচ্ছে। মিসেস উইসলি হয়তো ঘুমোচ্ছেন, ঘড়ি দেখার কারণ নেই।
হ্যারির মনে পড়ে গেলো গ্রীষ্মের ছুটিতে মি. উইসলির পরিবারে ওর ছুটি কাটানোর কথা। মিসেস উইসলির মি. উইসলির মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে কান্না, তার চোখের চশমা তির্যকভাবে পড়ে থাকা, মুখে রক্ত মাখামাখি, না না মি. উইসলি মরতে পারবেন না।
ডাম্বলডোর তখন একটা পুরনো কাবার্ড ঘাটাঘাটি করছিলেন। কাবার্ড থেকে অতি পুরনো কালো হয়ে যাওয়া কেটলি বার করে খুব যত্নসহকারে নিজের ডেস্কের ওপোর রাখলেন। তারপর নিজের জাদুদণ্ডটা তুলে বিড় বিড় করে বললেন, পোটার্স। পর মুহূর্তে কেটলিটা থরথরিয়ে উঠলো–উজ্জ্বল অদ্ভুত এক নীল আলোকে চকচক করতে লাগলো। তারপরই আবার আগের মতো মলীন-ম্লান হয়ে গেলো।
তারপর ডাম্বলডোর অন্য এক পোর্ট্রেটের কাছে দাঁড়ালেন। লম্বা তার মুখ, সুঁচালো দাঁড়ি। পরনে তার স্নিদারিনদের সবুজ আর রূপালী রং-এর পোশাক। দেখে মনে হয় অন্যদের চেয়ে আরও বেশি ঘুমে আচ্ছন্ন। এতে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন
যে ডাম্বলডোর বারবার ডাকার পর তার ঘুম ভাঙলো।
–ফিনিয়েস, ফিনিয়েস।
সারি সারি ঝোলানো পোট্রটের সকলেই জেগে উঠলো। ফ্রেমের মধ্যে ঘোরা ফেরা করতে লাগলেন তারা। চালাক চালাক মুখের জাদুকরের ঘুম ভাঙলেও নিদ্রাজড়িত নেত্রে তাকিয়ে রইলেন। বাকি সব পোর্ট্রেটের হেডমাস্টার হেডমিস্ট্রেস একসঙ্গে বলে উঠলেন
ফিনিয়েস ফিনিয়েস।
কপটভাবে চোখ বুজে থাকা আর হলো না ফিনিয়েসের। এক ঝটকা দিয়ে বন্ধ নেত্র খুললেন।
–কেউ কি আমায় ডাকছিলেন?
–ফিনিয়ে আপনি আবার আগের পোর্ট্রেটে ফিরে যান, আমার আর একটি খবর পাঠাবার আছে, ডাম্বলডোর বললেন।
–আমায় অন্য পোর্ট্রেটে যেতে হবে? সরু সরু গলায় খুব বড় দেখে একটা হাই তুলে বললেন (ওর চোখ ঘুরতে ঘুরতে তখন হ্যারির ওপোর পড়েছে) না ডাম্বলডোর, আজ রাতের বেলা আমি কোথাও যেতে পারবো না, বড় ক্লান্ত আমি।
ফিনিয়েসের গলার স্বর হ্যারির খুব চেনা চেনা মনে হলো। আগে যেনো কোথায় শুনেছে। কিন্তু আরও কিছু ভাবার আগেই দেওয়ালে টাঙানো পোট্রটগুলো প্রতিবাদের ঝড় তুললো একই সঙ্গে।
একজন মোটা চিৎকার করে বললেন, অবাধ্যতা স্যার। সেই জাদুকরের নাকটা লাল। তারপর হাতের বন্ধু মুঠি ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন–কর্তব্যের প্রতি চূড়ান্ত অবাধ্যতা!
এক জীর্ণ চেহারার জাদুকরী কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন, তোমরা বর্তমান হেডমাস্টারকে সাহায্য করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এটা ভুলো না। হ্যারি চিনতে পারলো আরম্যান্ডো ডিপারকে। উনি ডাম্বলডোরের আগে স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। তোমার লজ্জিত হওয়া উচিত ফিনিয়েস!
এক তীক্ষ্ণ দৃষ্টির জাদুকর তার মোটা জাদুদণ্ড উঁচু করে বললেন, আমি কি ওদের বিবেচনা বোধ ফিরিয়ে আনতে পারি ডাম্বলডোর?
ফিনিয়েস আরম্যান্ডোর হাতের দণ্ড দেখে সামান্য ভয় পেয়ে গেলেন। বললেন–ঠিক আছে, ঠিক আছে। মনে হয় এতক্ষণে আমার ছবি নষ্ট করে ফেলেছে।
ডাম্বলডোর বললেন, তোমার পোর্ট্রেট নষ্ট করতে হবে না, সিরিয়স তা জানে।
সিরিয়সের নাম আসতেই হ্যারির মনে পড়ে গেলো কোথায় ও ফিনিয়েসের গলা শুনেছে। ও হ্যাঁ গ্রিমন্ড প্লেসে ওর নির্জন ঘরে!
–মিসেস উইসলিকে তোমার এই খবরটা দিতে হবে যে আর্থার উইসলি মারাত্মকভাবে জখম হয়েছেন। তার ছেলেমেয়েরা, হ্যারিপটার শিগগিরই তার বাড়িতে যাচ্ছে। বুঝতে পেরেছেন যা বললাম?
–হ্যাঁ, হ্যাঁ বলেছেন খুব ভালভাবে বুঝতে পেরেছি। ওরা বাড়ি যাচ্ছে এই তো?
কথাটা বলে নিজের ফ্রেমের মধ্যে ঢুকেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন। ঠিক সেই সময়ে উদবিগ্ন মুখে ঘরে ঢুকলো ফ্রেড, জর্জ আর জিনি। ওরা তখনও রাতের পোশাক ছাড়েনি।
জিনি একটু ভীত মুখে বললো, হ্যারি কি সব শুনছি? প্রফেসর ম্যাকগোনাগল বলছেন, তুমি তাকে দেখেছো বাবা গুরুতর আহত হয়েছেন?
হ্যারি কিছু বলার আগেই ডাম্বলডোর বললেন–অর্ডার অফ ফনিক্সের কাজ করার সময় তোমাদের বাবা আহত হয়েছেন। ওকে চিকিৎসার জন্য সেন্ট মাংগোস হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এখন তোমাদের সিরিয়সের বাড়ি পাঠাচ্ছি। ওর বাড়িটা হাসপাতালের কাছেই ওখানে তোমাদের মা আশাকরি পৌঁছে গেছেন।
ফ্রেড খুব ঘাবড়ে গেছে, বললো–ওখানে আমরা কেমন করে যাবো? ফুঁ পাউডারে?
–না। ডাম্বলডোর বললেন–ফু পাউডার এখন নিরাপদ নয়। ওই নেটওয়ার্কে এখন ওরা অনর্গল নজর রাখছে। তোমাদের পোর্টকিতে যাওয়া নিরাপদের হবে। ডাম্বলডোর ডেস্কের ওপোর রাখা পুরনো কেটলিটার দিকে তাকালেন। আমরা ফিনিয়েস নিগেলাসের রিপোর্টের অপেক্ষা করছি। আমার মনে হয় তোমাদের এখন যাবার কোনও অসুবিধে নেই। মনে হয় কেউ ইন্টারসেপ্ট করবে না।
ঘরের মাঝখানে আলোর ঝলকানি হলো, দেখলো একটা সোনালী পালক ফরাসের ওপরে হাওয়াতে ভাসছে।
পালকটা হাতে ধরে ডাম্বলডোর বললেন–এটা ফকেসের সতর্ক বার্তা। প্রফেসর আমব্রিজের কানে গেছে তোমরা এখন তোমাদের ঘরে নেই। মিনার্ভা তুমি ওকে গিয়ে যে কোনও গল্প গুছিয়ে বলবে।
ততক্ষণে ম্যাকগোনাগল ঝড়ের বেগে আমব্রিজকে খবর দিতে গেছেন।
ডাম্বলডোরের পিছনে টাঙ্গানো পোট্রট থেকে ওরা ফিনিয়েসের গলা শুনতে পেলো উনি বলছেন, খুব আনন্দিত হবেন। আমার গ্রেট গ্রেট গ্র্যান্ডসনের সব সময় একটা কিম্ভূতকিমাকার টেস্ট ছিলো বাড়ির অতিথিদের সম্বন্ধে।
–আর দেরি কেরো না এদিকে এসো, ডাম্বলডোর হ্যারি আর উইসলিদের বললেন, ওরা কেউ জানার আগে বেরিয়ে পড়ো।
ডাম্বলডোর বললেন, আশাকরি তোমরা সকলেই পোর্ট কি সম্বন্ধে সম্পূর্ণভাবে ওয়াকিবহাল আছে। কথাটা শুনে ওরা পোর্টকিতে হাত দেবার জন্য এগিয়ে গেলো। আমি তিন গুণবো। এক… দুই…।
ডাম্বলডোর তিন গোনবার এক সেকেন্ড বা তারও আগে কাণ্ডটা ঘটলো। হ্যারি মুখ তুলে তার দিকে তাকালো। সকলেই খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়েছিলো। ডাম্বলডোর পোর্ট কি থেকে হ্যারির মুখের দিকে তাকালেন।
হ্যারির শুকিয়ে যাওয়া কাটা দাগে হঠাৎ অসম্ভব এক যন্ত্রণা শুরু হলো। ঠিক পুরনো কাটা জায়গাটা যেন ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। হ্যারির মনের ভেতর দারুণ এক ঘৃণার সঞ্চার হলো। এত শক্তিশালী সেই ঘৃণা যেন ও সকলকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেবে। যে ওর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাকে ও ধারালো দাঁত দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে দেবে।
তিন।
হ্যারি ওর নাভিকুণ্ডের কাছে প্রবল এক ধাক্কা অনুভব করার সঙ্গে সঙ্গে ওর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেলো। ওরা সকলে কেটলিতে হাত রেখে উত্তাল গতিতে উড়ে চললো। কেটলি ওদের আটকে রেখে সোঁ সোঁ করে উড়ছে। ওদের হাত আঠার মত আটকে রয়েছে কেটলিতে।
উড়তে উড়তে হঠাৎ ওরা সশব্দে শূন্য থেকে মাটির ওপর পড়লো। তারপরই খুব কাছ থেকে শুনতে পেলো আবার ফিরে যাও–পুঁচকে ছেলের দল। তোমাদের বাবা সত্যি মৃত্যু মুখে?
আউট! দ্বিতীয় গলা গর্জে উঠলো।
হ্যারি কোনও রকমে উঠে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকালো। দেখলো ওরা ১২ নং গ্রিমন্ড হাউজের অন্ধকার বেসমেন্টে রান্নাঘরে। ঘরে আলো বলতে আগুন আর একটা জ্বলন্ত মোমবাতি! ক্রেচার (এলফ) দরজা দিয়ে বেরিয়ে হলে গেলো। ও হ্যারিদের দিকে পরশ্রীকাতর দৃষ্টিতে তাকালো। সিরিয়সকে ওদের দিকে হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখা গেলো। ওর মুখে চোখে দারুণ চিন্তার ছাপ। এখনও পোশাক আশাক পরিবর্তন করেননি।
জিনি তখন ব্যথা পেতে মেঝেতে বসেছিলো। সিরিয়স হাত-বাড়িয়ে ওকে তুলে বললেন, কি সব ব্যাপার স্যাপার ঘটছে?
ফিনিয়েস নিগেলাস বললো–আর্থার সাংঘাতিকভাবে জখম হয়েছে।
ফ্রেড বললো, হ্যারিকে জিজ্ঞেস করুন।
জর্জ বললো, আমিও নিজের কানে শুনতে চাই।
জিনি আর দুই যমজ ভাই ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। বাইরে সিঁড়ির কাছে ক্রেচারের পদশব্দ আর শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না।
–হ্যারি বলতে শুরু করলো; ম্যাকগোনাগল আর ডাম্বলডোরকে ঘটনাটা বলার চেয়েও আরও খারাপ মনে হলো। আমি দেখেছিলাম, ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন নয় সত্যি। যা যা দেখেছে হুবহু বলে গেলো। সব কিছু বললেও ও যে সাপ হয়ে কামড়ে ছিলো সে কথা বললো না।
সিরিয়সের দিকে তাকিয়ে ফ্রেড বললো, মা এসে গেছেন?
সিরিয়স বললেন–খুব সম্ভব আসল ঘটনা তোমার মা জানেন না। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছিলো তোমাদের আমব্রিজের হস্তক্ষেপের আগে এখানে নিয়ে আসা আমার মনে হয় ডাম্বলডোর মল্লিকে সব জানাচ্ছেন।
জিনি বললো–এখন আমাদের হাসপাতালে যাওয়া দরকার। ও ভাইদের দিকে তাকালো। সেই সময় কারও ড্রেস হাসপাতালে যাবার উপযুক্ত নয়। ওদের পরণে পা-জামা।
সিরিয়স আপনি আমাদের আলখেল্লা বা ওই ধরনের কিছু দিতে পারেন?
–যাওয়ার কথা থাক। এখন তোমরা কেউ সেন্ট মাংগোস হাসপাতালে যেতে পারবে না, সিরিয়স বললেন।
–আমরা চাইলেই সেন্ট মাংগোস হাসপাতালে যেতে পারি–কারণ আহত হয়েছেন আমাদের বাবা। মুখে ফ্রেডের ক্রোধের চিহ্ন।
–আর্থারকে আক্রমণ করা হয়েছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যখন তার স্ত্রীকে এখনও খবরটুকু জানায়নি তখন তোমরা কেমন করে জানলে, ওরা যদি তোমাদের প্রশ্ন করে?
–তাতে কি আসে যায়? জর্জ রেগে গিয়ে বললো।
–আসে যায় বৈকি, কারণ আমরা কারও নজরে আনতে চাই না যে, হ্যারি হাজার মাইল দূরে কি ঘটছে তা জানতে পারে, পরিষ্কার করে দেখতে পায়। সিরিয়স বেশ রাগত স্বরে বললেন, তোমাদের কি ধারণা আছে মন্ত্রণালয় ওই খবর। পেলে কি সব করতে পারে?
ফ্রেড আর জর্জ চোখ মুখ এমন করে তাকালো যে মন্ত্রণালয় কি ভাববে, কি করবে, সে সম্বন্ধে ওদের কিছু আসে যায় না। রন তখনও মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
–জিনি বললো, স্কুল থেকেই যে কথাটা শুনেছি তার এমন কোনও মানে নেই। বাইরের কেউ তো বলতে পারে।
সিরিয়স বললেন, তারা কে? শোনো তোমাদের বাবা অর্ডার অফ ফনিক্সে কর্তব্যরত অবস্থায় সাংঘাতিকভাবে আঘাত পেয়েছেন। আর ব্যাপারটাও গোলমেলে, তার ছেলেমেয়েরা দুর্ঘটনার খবরটা বেশ পর মুহূর্তে জেনে গেলো সেটাও গোলমেলে। এমন সব আচরণ করলে ডাম্বলডোরের অর্ডারের প্রভূত ক্ষতি হবার সম্ভাবনা আছে।
–আপনার ওই ভোঁতা অর্ডারের (ডাম্বলডোরের হেড কোয়ার্টার) কোনও কেয়ার করি না। ফ্রেড বেশ জোরে জোরে বললো।
–ওদিকে আমাদের বাবা মৃত্যুশয্যায় আর আমরা ঠুনকো ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবো? জর্জ বললো।
–তোমাদের বাবা অর্ডারের ব্যাপারে যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। তোমরা আজেবাজে কথা বলে অর্ডারের সম্মানহানী করছে জানতে পারলে তিনি খুশি হবেন বলে মনে হয় না। এই ছেলে মানুষীর জন্যই তোমাদের অর্ডারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি জেনে রেখো। বুঝেছো? অনেক বড় জিনিস আছে। যার জন্য মৃত্যুবরণ করা যায়! সিরিয়স প্রচণ্ড রেগে গিয়ে কথাগুলো ওদের বললেন।
ফ্রেড খুব সহজভাবে বললো, চুপ করে থাকবেন, তা না হলে…।
সিরিয়সের মুখের রং একটু একটু করে বদলাতে লাগলো। ফ্রেডের দিকে এমনভাবে তাকালেন যে প্রচণ্ড মার খাবে তার হাতে। কিন্তু খুব সংযত হয়ে বললেন–আমি জানি তোমাদের মনের অবস্থা, তাহলেও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সেটা মেনে নিতে হবে। তোমাদের মা না আসা পর্যন্ত এখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে তোমাদের। কথাটা বুঝেছো?
ফ্রেড আর জর্জ তখনও রাগে যেন ফেটে পড়ছে। জিনি অবশ্য শান্ত হয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়লো। হ্যারি রনের দিকে তাকালো। ওর মনোভাব ঠিক বুঝতে পারলো না। ফ্রেড-জর্জ মিনিট খানেক সিরিয়সদের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
–খুব ভালো, খুব ভালো। গোমড়া মুখে বসে না থেকে একসঙ্গে জিনির পাশে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। অ্যাকিও বাটার বিয়র! সিরিয়স তার জাদুদণ্ডটা তুলতেই কম করে আধডজন বোতল ভাসতে ভাসতে এলো। সিরিয়স টেবিল থেকে খাবারের উচ্ছিষ্ট পরিষ্কার করে বোতলগুলো ওদের দুজনের সামনে রাখলেন।
হ্যারির তখন কিছুই ভাল লাগছে না। জর্জ-ফ্রেড-জিনি-রনের মানসিক ও দৈহিক কষ্টের কথা মনে হলো। তাই সিরিয়সের আনা বাটার-বিয়রের কোনো আকর্ষণ নেই ওর কাছে। যেনো মি. উইসলির দুর্ঘটনা-আঘাতের জন্য ও দায়ী।
তারপর ও নিজের মনকে শান্ত করতে আপন মনে বললো–বোকার মতো উল্টোপাল্টা কথা ভাববে না। তোমার কী ছুরির মতো ধারালো দাঁত আছে যে তা দিয়ে তুমি মি. উইসলিকে আক্রমণ করেছিলে?
হ্যারি বোতলের মুখ খুলে গেলাসে ঢাললো এবং যন্ত্র চালিতের মত খেতে লাগলো।
তারপর পোর্টকিতে হাত দেয়ার সময় ওর মনে হল ডাম্বলডোরের অফিসে আমি কেন ডাম্বলডোরকে আঘাত করতে উদ্যত হয়েছিলাম!
ও বেশ শব্দ করে শূন্য বোতলটা টেবিলে রেখে দিল। বোতলটা উল্টে গিয়ে টেবিলে গড়াগড়ি দিতে লাগলো। ওর দিকে কেউ তাকিয়ে আছে বলে ওর মনে হলো না। হঠাৎ ঘরের মাঝখানে আগুন জ্বলে উঠতে ওদের সামনে রাখা খাবারের থালা, প্লেট সবকিছু উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো সেই আগুনের আলোকে। ওরা ভয় পেয়ে সেদিকে তাকাতেই কিছু গোটানো পার্চমেন্ট ধপাস করে টেবিলের ওপোর পড়লো তারই সঙ্গে ফেনেক্স পাখির সোনালী রঙের বেশ লম্বা একটা পালক!
পার্চমেন্ট তুলে নিয়ে সিরিয়স বললেন, ফকাস! এতো ডাম্বলডোরের হাতের লেখা নয়, নিশ্চয়ই তোমাদের মা এখানে খবর পাঠিয়েছেন। এই নাও।
সিরিয়স চিঠিটা জর্জের হাতে দিলেন। জর্জ চিঠিটা খুলে পড়লো
তোমাদের ড্যাড এখনও জীবিত আছেন। আমি এখন সেন্ট মাংগোস হাসপাতালে যাচ্ছি। তোমরা যেখানে রয়েছে সেখানেই থাকবে। যত শিগগির পারি তোমাদের খবর পাঠাবো। -মা।
জর্জ টেবিলের দিকে তাকালো। বিড়বিড় করে বললো, ড্যাড মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন।
হ্যারির মনে হলো মি. উইসলি সত্যই মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন, ওদের খুব কাছেই রয়েছেন। রন তখনও ফ্যাকাসে মুখে বসে রয়েছে। মিসেস উইসলির চিঠির পেছনটা দেখলো। যদি কিছু ওকে লিখে থাকেন, ওদের সান্ত্বনা দিয়েছেন। ফ্রেড, জর্জের হাত থেকে একরকম ছোঁ মেরে নিয়ে মার চিঠিটা পড়তে লাগলো তারপর হ্যারির দিকে তাকালো। ওর মনে হলো নতুন বাটার বিয়রের বোতলটা ওর হাতে আগের মতোই কাঁপছে। ও বোতলটা খুব জোরে চেপে ধরলো। তারপরও ওর কাঁপা হাতের সঙ্গে বোতলও থর থর করে কাঁপতে লাগলো।
জীবনের একটানা এতো দীর্ঘ রাত্রি হ্যারি বসে বসে কাটিয়েছে বলে মনে করতে পারলো না। সিরিয়স অবশ্য একবার বলেছিলেন, জেগে থেকে কোনও লাভ নেই তোমরা শুয়ে পড়ো৷ কিন্তু উইসলিদের দৃষ্টিতে সেই অনুরোধের যথেষ্ট জবাব ছিলো। ওরা সকলেই টেবিল ঘিরে বসে রইলো। ওদের সামনে বিরাট মোমবাতি জ্বলছে, মাঝে মাঝে মোমবাতি ছোট হয়ে আসছে, বাতির তলাটা গলা মোমে ভর্তি হয়ে আসছে, তখন আবার নতুন বাতি লাগাচ্ছে। ওরা মাঝে মাঝে ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে সময় জানার জন্য; কিন্তু কথা বলছে না। যে কোনও মুহূর্তে ভাল অথবা মন্দ খবরের অপেক্ষা করছে। কিন্তু মিসেস উইসলি তো সেন্ট মাংগোস হাসপাতালে অনেকক্ষণ আগে এসে গেছেন। এখনও পর্যন্ত কোনও খবর দিচ্ছেন না কেন? ফ্রেড বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়লো। মাথাটা কাৎ হয়ে যাচ্ছে। পরক্ষণই জেগে থাকার চেষ্টা করছে। জিনি একটা চেয়ারে বেড়ালের মতো কুঁকড়ে শুয়ে আছে। চোখ দুটোই খোলা, ঘুম ওর আসছে না। রন টেবিলে হাতের ওপোর মাথা রেখে শুয়ে আছে। নিদ্রিত বা জাগ্রত বোঝার উপায় নেই। হ্যারি আর সিরিয়স প্রতীক্ষা করছে সংবাদের। দুজনেরই চোখে ঘুম নেই। অপেক্ষা… অপেক্ষা, একটা পরিবারের দুঃখের সঙ্গে ওদের দুজনকেই মিশিয়ে নিয়েছে।
সকাল দশটা বেজে পাঁচ মিনিটে (রনের ঘড়ির সময়) মিসেস উইসলি কিচেনের বন্ধ দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেন। রন, ফ্রেড, হ্যারি মিসেস উইসলির দিকে তাকালো। দারুণ বিষণ্ণ আর ভেঙে পড়েছেন। ওদের দিকে তাকিয়ে মিসেস উইসলি নিস্তেজভাবে হাসলেন।
দূর্বল ক্লান্ত স্বরে বললেন, উনি ভাল হয়ে উঠছেন। এখনও ঘুমাচ্ছেন। তোমরা একটু পরে দেখা করে এসো। বিল এখন ওদের পাশে বসে রয়েছে। সকালে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে।
ফ্রেড চোখের ওপোর হাত চাপা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। জর্জ আর জিনি উঠে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো। রন ম্লান হাসলে, হাত থেকে ছিটকে বাটার বিয়র পড়ে গেলো।
সিরিয়স লাফিয়ে উঠে বললেন–ব্রেকফাস্ট? আমাদের হাউজ এলফ ক্রেচারের পাত্তা নেই কেন? ক্রেচার, চোর!
কিন্তু ক্রেচারের কোনও সাড়া শব্দ ওরা কেউ শুনতে পেলো না।
–যাকগে, সিরিয়স বিড় বিড় করে বললেন। তারপর গুণতে লাগলেন এক, দুই, তিন… তাহলে সাত জন বেকন আর ডিম, সঙ্গে কিছু টোস্ট আর চা যথেষ্ট। কি বলো?
হ্যারি স্টোভের কাছে গিয়ে সিরিয়সকে সাহায্য করতে লাগলো। ও উইসলি পরিবারের আনন্দের সঙ্গে নিজেকে জড়াতে চাইলো না। একটু পরেই হয়তো মিসেস উইসলি ওর ভিশন সম্বন্ধে জানতে চাইবেন। হ্যারি কাবার্ড থেকে প্লেট হাতে করে দাঁড়াতেই মিসেস উইসলি ওর হাত থেকে ওগুলো নিয়ে টেবিলে রেখে ওকে কাছে টেনে এনে জড়িয়ে ধরলেন।
মিসেস উইসলি অশ্রুবিজড়িত কণ্ঠে বললেন–তুমি যদি আর্থারের অবস্থা দেখতে না পেতে তাহলে হয়তো আর্থার ঘণ্টার পর ঘণ্টা রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থেকে প্রাণ হারাতো। আর্থার বেঁচে গেছেন শুধু তোমার জন্য, তার জন্য আমার আন্তরিক ধন্যবাদ ও ভালোবাসা নিও হ্যারি। তুমি না বললে, ডাম্বলডোরের হয়তো জায়গাটা খুঁজতে অসুবিধে হতো।
তারপর, মিসেস উইসলি সিরিয়সকে তার ছেলে–মেয়েদের দেখাশুনো করার জন্য ধন্যবাদ দিলেন। সিরিয়স বললেন, আমার কর্তব্য আমি করেছি মিসেস উইসলি। যে কটা দিন আপনি হাসপাতালে ব্যস্ত থাকবেন, ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাবে। না, সে কটাদিন আমার কাছে থাকলে খুব খুশি হবো।
মিসেস উইসলি বললেন–সত্যি সিরিয়স আপনাকে ধন্যবাদ দেবার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। শুনছি, সামান্য সময় আর্থারকে রেখে হাসপাতাল থেকে ওকে ছুটি দিয়ে দেবে। ক্রিসমাসত আগত, আমরা এখানে সবাই মিলে এবছরের ক্রিসমাস পালন করবো। মিসেস উইসলি গায়ে এখোন জড়িয়ে ব্রেকফাস্ট বানাতে লাগলেন।
–হ্যারি বললো, সিরিয়স আপনার সঙ্গে কি দু একটি কথা বলতে পারি?
কথাটা বলে সিরিয়সকে সঙ্গে নিয়ে অন্ধকার প্যান্ট্রিতে গিয়ে যা যা দেখেছে। সব বললো। ও যে সাপ হয়ে আর্থারকে দংশন করেছিলো সে কথাটাও জানাতে ভুললো না।
–ডাম্বলডোর জানেন? তাকে বলেছো?
–হ্যাঁ বলেছি। তিনি অবশ্য আমাকে অদ্ভুত ব্যাপারটা সম্বন্ধে কিছু বলেননি। আমাকে তো তার ব্যাখ্যা দিলেন না ডাম্বলডোর, হ্যারি বললো।
–যদি প্রয়োজন হতো তাহলে অবশ্যই দিতেন। সিরিয়স বললেন।
হ্যারি বললো–সিরিয়স আমি বোধহয় পাগল হয়ে যাবো। পোর্টকিতে চাপার আগে ডাম্বলডোরের অফিসে মনে হয়েছিলো আমি যেন বড় বড় দাঁতওয়ালা সেই সাপ। বেশিক্ষণ না, দুএকমিনিট হবে। তখন আমার কপালের কাটা দাগ অসম্ভব চুলকোচ্ছিল। আমার মনে হয়েছিলো, আমি ডাম্বলডোরকে আক্রমণ করবো।
–ওটা তোমার সেই ভয়ঙ্কর স্বপ্নের রেশ। তুমি তখনও নিজেকেই সেই সাপ ভাবছিলে।
–না, না তা নয় সিরিয়স, হ্যারি প্রবলভাবে মাথা নাড়লো। মনে হয়েছিলো আমার শরীরের ভেতর একটা সাপ রয়েছে–কিছু একটা করতে চাইছিলো।
সিরিয়স বললেন, তোমার এখন বিশ্রাম দরকার হ্যারি। ব্রেকফাস্ট সেরে তুমি ঘুমিয়ে নাও। ভাগ্য ভাল, তুমি স্বপ্নের মধ্যে সব দেখতে পেয়েছিলে তা না হলে আর্থার হয়তো মারা যেতো।
সিরিয়স হ্যারির পিঠ চাপড়ে প্যান্ট্রি থেকে চলে গেলে হ্যারি একাই অন্ধকার প্যান্ট্রিতে দাঁড়িয়ে রইলো।
***
সকলেই ব্রেকফাস্ট সেরে যে যার নির্দিষ্ট ঘরে শুতে চলে গেলো। গরমের ছুটিতে যে ঘরে রনের সঙ্গে ও শেয়ার করেছিলো সেখানেই এবারও ব্যবস্থা করেছেন। মিসেস উইসলি। রনের খুব ঘুম পেয়েছিলো, বিছানায় শোওয়া মাত্র ঘুমিয়ে পড়লো। হ্যারি বুকে কম্বলটা টেনে খাটের লোহার বারে পিঠ ঠেকিয়ে বসে রইলো। আবার যদি সেই বীভৎস স্বপ্ন দেখে তারই ভয়? ইচ্ছে করেই নিজেকে আরামবিহীন করে রাখতে চাইলো। ওর আরও ভয়, যদি গতরাতের মতো আবার সাপে রূপান্ত রিত হয়ে রনকে আক্রমণ করে।
রন ঘুম থেকে উঠে দেখলো হ্যারি বসে রয়েছে। এমন এক মুখের ভাব যেন অনেক ঘুমিয়েছে। লাঞ্চ খাবার সময় ওদের ট্রাঙ্ক হোগার্টস থেকে এসে গেলো। ওরা সেন্ট মাংগোসে যাবার জন্য মাগলদের পোশাক পরে নিলো। একমাত্র হ্যারি ছাড়া সকলেই খুব খুশি। ওরা আলখেল্লা ছেড়ে জিন্স আর সুইটশার্টস পরেছে। ম্যাড আই মুডি আর টোংক এসে গেলেন ওদের লন্ডন শহরে নিয়ে যাবার জন্য। ম্যাড আই তার ম্যাজিক্যাল চোখ লুকিয়ে রাখার জন্য এমন এক চশমা পরেছেন যে বোঝার উপায় নেই। আন্ডার গ্রাউন্ড ট্রেনে লোকদের দৃষ্টি যাতে তার চুলের দিকে পড়ে তার দিকে খেয়াল রেখেছে টোংক।
হ্যারির মোটেই ইচ্ছে নেই টোংককে গতরাতের স্বপ্ন আর ওর ভিসনের কথা বলতে; কিন্তু টোংক বার বার ওকে একই প্রশ্ন করে চলেছে।
শহরে যাবার সময় টোংক ট্রেনে ওর পাশের সিটে বসে বললো, আচ্ছা তোমার শরীরে কি সীয়রদের (ভবিষ্যৎ দ্রষ্টার) রক্ত আছে?
–না নেই। হ্যারির প্রফেসর ট্রিলনীর কথা মনে করে, কেন যেন বেশ একটু বিশ্রী আর অপমানজনক মনে হলো।
-না, সে কি হে, আমার তো মনে হয় তুমি সত্যি করে ভবিষ্যৎবাণী করছো, ভবিষ্যতে কি হবে দেখছো না, তুমি বর্তমান দেখছে। সত্যি অদ্ভুত মনে হয়, তাই না? যদিও দরকারি…।
হ্যারি চুপ করে রইলো। পরের স্টেশন এসে পড়ার জন্য বেঁচে গেলো। বিরাট লন্ডন শহরের মধ্যস্থলে এসে পড়েছে ওরা। ট্রেন ছাড়বার পর ফ্রেড আর জর্জের মাঝখানে রইলো। টোংক ওদের পথ দেখিয়ে চললো। ওরা এসক্যালেটরের কাছে পৌঁছলো। মুডি সবার শেষে কাঠের পা নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলেছেন। মুখটা ঢাকার জন্য বাউলার হাট অনেকটা নামিয়ে দিয়েছেন। একটা হাতে কোটের বোম এমন করে ধরে রেখেছেন–যাতে কেউ ওর জাদুদণ্ড দেখতে না পায়। হ্যারি বেশ বুঝতে পারলো মুডির লুকোনো চোখ ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
একটা রাস্তায় সকলে দাঁড়ালো। বরফের ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। রাস্তার দুধারে সারি সারি দোকান। আসন্ন ক্রিসমাস উপলক্ষে দোকানপত্র সব জমজমাট করে সাজিয়েছে। মুডি হ্যারিকে সামান্য সামনে রেখে ঠিক ওর পেছনে পেছনে হাঁটতে লাগলেন। হ্যারি তার হ্যাট দিয়ে খানিকটা ঢেকে রাখা চোখে চতুর্দিক স্ক্যান করে চলেছেন। ঠিক হসপিট্যাল করবার মতো পরিবেশ এখানে না হলেও অবশেষে কর্তৃপক্ষ একটা জায়গা ম্যানেজ করেছে। অসুস্থ জাদুকররা এখানে আসে, চিকিৎসা করায়, সুস্থ হলেই আবার ভিড়ের সঙ্গে মিশে চলে যায়!
ভিড়ের ঠেলায় যাতে হ্যারি বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায়, তাই চলার সময় ওর কাধে একটা হাত রেখে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে লাগলেন মুডি।
–এই তো এসে গেছি, মুডি একটা লাল ইটের বড় বাড়ি দেখিয়ে বললেন। হ্যারি দেখলো অতি পুরনো ফ্যাশানের লাল ইটের তৈরি বাড়িতে বড় বড় করে সাইনবোর্ড লেখা পার্জ অ্যান্ড ডাউস লিমিটেড। সব দোকানের অবস্থা হতদৈন্য। উইন্ডো ডিসপ্লে করার জন্য কিছু ডামি ক্লিপ দিয়ে আটকানো রয়েছে। তাদের মাথার পরচুলা গুলো অতি জীর্ণ আর ধূলোভর্তি। কম করে সেগুলো দশ বছরের পুরনো ফ্যাশনের। অনেক দোকানের দরজা বন্ধ। সেখানে বড় বড় করে লেখা সংস্কার করার জন্য বন্ধ রহিল। হ্যারির পাশ থেকে এক মহিলা হাতে প্রাস্টিক ব্যাগ নিয়ে মন্তব্য করলেন, কোনো কালেই দোকানগুলো খোলা থাকে না, সংস্কার ও কোনও কালেই হবে না।
টোংক বললেন, ডান দিকে যেতে হবে।
টোংক একটা জানালাতে অতি জীর্ণ ধূলিধূসরিত ডামি দেখিয়ে বললেন, হ্যাঁ ঠিক আছে। সবাই একত্রে দাঁড়াও।
ওরা সকলেই টোংককে ঘিরে ধরলো। মুডি আবার হ্যারির পিঠে টোকা দিলেন এগিয়ে যাবার জন্য। টোংক একটা কাঁচের পাল্লার কাছে মুখ চেপে সেই কুৎসিৎ ডামির দিকে তাকালো। হ্যারি দেখলো টোংকের নিঃশ্বাসের বাষ্পে কাঁচটা সাদা হয়ে যাচ্ছে। টোংক বললো, উটচার আমরা এখানে আর্থার উইসলির সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
হ্যারি সবকিছু দেখতে দেখতে হকচকিয়ে গেলো, একটা পুরনো ডামি কি করে ওদের মি. উইসলির সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করে দেবে? তাছাড়া ওটাতো একটা জড় পদার্থ! টোংকের কথা শুনবে কেমন করে? ডামি মাথা নোয়ালো। আঙ্গুল তুলে ইশারা করলো ভেতরে আসার। টোংক মিসেস উইসলি আর জিনির কনুই ধরে গ্লাসের ভেতরে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেলো।
ফ্রেড, রন, জর্জ ঠিক সেইরকমভাবে ভেতরে ঢুকে ওদের পিছু পিছু চললো। বেশ ভিড় জাদুকর–জাদুকরীদের। সকলেই খুব ব্যস্ত। কে তারা, কোথা থেকে আসছে সেদিকে তাদের ভ্রূক্ষেপ নেই।
–চলো চলো, মুডি আবার হ্যারির পিঠে গোত্তা দিলেন। হ্যারির মনে হলো এক গাদা ঠাণ্ডা জলের মধ্যে পড়ে গেছে।
ওরা রিসেপসনের কাছে দাঁড়ালো। তার সামনে দেখলো ভাঙ্গা ভাঙ্গা কাঠের চেয়ারে অনেক জাদুকর–জাদুকরী বসে রয়েছে। ওদের মধ্যে অনেককেই অসুস্থ মনে হয় না। ওরা পুরনো উইচউইকলির পাতা উল্টে চলেছে। কেউ কেউ মনে হয় খুবই অসুস্থ। তাদের হাতে পায়ে প্লাস্টার, ব্যান্ডেজ ইত্যাদি দেওয়া।
সন্দেহ নেই হসপিটালের ভেতরে এসেছে। বাইরের চেয়ে ভেতরে বেশি গোলমাল। অনেক রোগী চেঁচাচ্ছে, কাতরাচ্ছে, অদ্ভুত অদ্ভুত নানা রকমের শব্দ করছে। একটি মিষ্টি চেহারার জাদুকরী প্রথম সারিতে বসে একটা পুরনো ডেলি প্রফেট হাতে নিয়ে পাখার মত হাওয়া খাওয়ার জন্য দোলাচ্ছে ওর মুখের সামনে। হ্যারি অসুস্থ মানুষদের দেখে অসম্ভব দমে গেলো।
কিছু জাদুকর-জাদুকরীরা লেবু–সবুজ রং-এর আলখেল্লা পরে হাতে ক্লিপবোর্ড নিয়ে রোগীদের বক্তব্য লিখে যাচ্ছে। হ্যারির নোট লেখা দেখে আমব্রিজের ক্লিপবোর্ডে নোট নেওয়ার দৃশ্য মনে পড়ে গেলো। ওদের বুকে আঁটা রয়েছে এমব্রেম একটি জাদুদণ্ড আর হাড় ক্রস করে রাখা।
ও খুব আস্তে রনকে জিজ্ঞেস করলো, ওরা ডাক্তার?
–ডাক্তার? রন একটু আশ্চর্য হয়ে বললো। ধাৎ ডাক্তার হবে কেন? এখানে মাগলরা কাজ করে। রোগ সারিয়ে দেয় হিলাররা।
মিসেস উইসলি রিসেপসনের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন, ওইদিকে চলো লাইন লাগাতে হবে। এনকোয়ারি লেখা বোর্ডের কাছে এক মোটা সোটা মহিলা বসেছিলো। তার পিছনের দেওয়ালে নোটিশ আর পোস্টারে ভর্তি, একটিতে লেখা:
পরিষ্কার পাত্রে পোসান ওষুধ রাখলে তা বিষে পরিণত হয় না এবং তা সেই প্রতিষেধক বিষয়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত যোগ্যতাসম্পন্ন হিলার চিকিৎসক দ্বারা অনুমোদিত হয়।
তারই তলায় এক জাদুকরীর পোর্ট্রেট। গলায় ঝুলছে লম্বা আংটির মালা। তাতে লেখা:
ডিলিস ডারওয়েন্ট
সেন্ট মাংগোস হিলার ১৭২২-১৭৪১
হেডমিসট্রেস অব হোগার্লস
স্কুল অব উইচক্র্যাফট অ্যান্ড উইজারড্রি
১৭৪১-১৭৬৮
পোর্ট্রেট থেকে উইসলি পরিবারের দিকে ডিলিস এমনভাবে তাকিয়ে রয়েছেন যেনো তিনি তাদের গুণে দেখছেন। হ্যারির দিকে চোখাচোখি হতেই তিনি মৃদু হেসে, তার পোর্ট্রেট থেকে একটু পাশে সরে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
এদিকে একজন অল্পবয়সী জাদুকর লম্বা লাইনের সর্ব প্রথমে দাঁড়িয়ে তার সামনে ডেস্কে বসে থাকা জাদুকরীকে ঝাঁকি দিয়ে তার শারিরীক ব্যথা বোঝাবার চেষ্টা করছে। এক জোড়া নতুন জুতো পরে পায়ে ব্যাথা হচ্ছে কেন তা জানাবার প্রচেষ্টা।
–আপনার স্পেল ড্যামেজ দরকার, ফোর্থ ফ্লোরে যান। নেক্সট…! উইসলি পরিবার এগিয়ে যেতেই হ্যারি ফ্লোর গাইড পড়লো।
আর্টিফেক্ট অ্যাকসিডেন্ট ……প্রথম তলা
(অস্ত্র, যন্ত্রাদি দ্বারা
দুর্ঘটনা)
কলড্রন বিস্ফোরণ, ওয়ান্ড
ব্যাকফায়ার, ঝাড়ু ভেঙে
পড়া ইত্যাদি।
ক্রিয়েচার–ইনডিউসড ইনজুরিস ……দ্বিতীয় তলা
(জীব, প্রাণীদের দ্বারা
দুর্ঘটনা)
দংশন, হুল ফোঁটান, পোড়া, মেরুদণ্ডে আঘাত
ম্যাজিকাল বাগস …তিন তলা
ছোঁয়াচে ব্যাধি যেমন–ড্রাগন পক্স, ভ্যানিশিং অসুস্থতা, গলগণ্ড ইত্যাদি
পোসান এবং প্ল্যান্ট পয়জনিং ………চারতলা
ফুসকুরি, চুলকানি এবং উদ্ভিদ দ্বারা বিষাক্ত হওয়া
স্পেল ড্যামেজ (মন্ত্র দ্বারা ক্ষতি) ……..পাঁচ
তলা
জাদুমন্ত্র ইত্যাদির ভুল প্রয়োগ
ভিজিটরস টি রুম/হসপিটাল শপ ………ছয় তলা
দর্শনার্থীর চায়ের দোকান, হাসপাতালের দোকান
যদি আপনার গন্তব্য স্থান সম্বন্ধে সঠিক ধারণা না থাকে, সাধারণভাবে কথা বলতে অসুবিধা হয় অথবা মনে রাখার অসুবিধা থাকে, যথা–কিসের জন্য এখানে এসেছেন, তাহলে কর্মরত স্বাগত জ্ঞাপন করার জাদুকর সানন্দচিত্তে আপনাকে সর্বোতোভাবে সাহায্য করবে।
এক অতি বৃদ্ধ, কুজ, কানে ট্রামপেট লাগানো জাদুকর ঠেলাঠেলি করে সামনে এসেছে। আমি এখানে ব্রডরিক বোডের সঙ্গে দ্যাখ্যা করতে এসেছি, সে কষ্ট সহকারে বললো।
–ওয়ার্ড নম্বর ফর্টি নাইন, কিন্তু আমার মনে হয় আপনি আপনার সময় অপব্যবহার করবেন। কর্মরত জাদুকর একরকম খারিজ করে বললো–উনি বলতে গেলে সম্পূর্ণভাবে স্কুলবুদ্ধি ব্যক্তি হয়ে গেছেন, এখনও নিজেকে মনে করেন তিনি একজন চায়ের পাত্র। নেক্সট!
তারপর দুএকজন ভিজিটরের পর মিসেস উইসলি ডেস্কের সামনে দাঁড়ালেন।
–হ্যালো, আমার স্বামী আর্থার উইসলি আজ সকালে সম্ভবত: নতুন এক ওয়ার্ডে বদলি হয়েছেন, দয়া করে কোথায় রয়েছেন বলবেন? মিসেস উইসলি বিনয়ের সঙ্গে বললেন।
সামনে রাখা একটা বড় লিস্ট দেখতে দেখতে রিসেপসনিস্ট বললো, আর্থার উইসলি? ও এইতো ফার্স্ট ফ্লোর, সেকেন্ড ডোর ডানদিকে ডাইলিলেওয়েলিন ওয়ার্ড!
–অশেষ ধন্যবাদ। মিসেস উইসলি বললেন, এসো তোমরা। ওরা বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরতে ঘুরতে হাতে লেখা সাইনবোর্ড হিলার ইনচার্জ, হিপোক্র্যাফট স্মেথউইচ, ট্রেনিং হিলার, অগাস্টাম পাই, ইত্যাদি দেখে দাঁড়ালো।
টোংক বললো–মল্পি আমরা বাইরে অপেক্ষা করি। আর্থার খুব সম্ভব বেশি ভিজিটরদের সঙ্গে দেখা করতে চাইবেন না, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আপনি প্রথমে।
ম্যাড আই ঘোৎ ঘোঁৎ করে টোংকের আইডিয়া সমর্থন করলেন। দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে চারদিক দেখতে লাগলেন ম্যাজিক্যাল চোখ দিয়ে। হ্যারিও চুপ করে দাঁড়ালো। মিসেস উইসলি ওর দিকে একটা হাত এগিয়ে দিয়ে বললেন, একি তুমি বাইরে থাকবে কেন? বোকা ছেলে, আর্থার তোমাকে দেখলে খুশি হবেন।
ওয়ার্ডের ঘরটা খুবই ছোট আর মলিন–নিপ্রভ বলা যায়। ঘরে একটি মাত্র ছোট জানালা তাও দরজার বিপরীতে উঁচুতে। সিলিং-এর মধ্যস্থলে রাখা ক্রিস্টাল বাবলস-এর উজ্জ্বলতা থেকে আলো আসছে। ওক কাঠ দিয়ে (প্যানেল কাঠের) বানানো দেওয়াল। সেখানে এক জায়গায় ঝুলছে একটি পোর্ট্রেট, এক বদমেজাজী চোখে তাকানো জাদুকরের। পোর্ট্রেটের তলায় লেখা
আরকোহার্ট ব্ল্যাকহ্যারো, ১৬১২-১৬৯৭
এনটেল–এক্সপেলিং কার্সের আবিষ্কারক
মাত্র তিনটি পেশেন্ট। ঘরের শেষ প্রান্তে ছোট জানালার ধারে মি. আর্থারের বেড। হ্যারি মি. উইসলিকে তিন চারটে বালিশ পিঠে ঠেকিয়ে বসে বসে ডেইলি প্রফেক্ট পড়তে দেখে স্বস্তি পেলো। সেই ছোট জানালা দিয়ে ঘরে সামান্য সূর্যের আলো আসছে। পদশব্দ শুনে আর্থার কাগজ থেকে মুখ তুলে ওদের দেখে খুবই আনন্দে উচ্ছ্বসিত হলেন।
ডেইলি প্রফেটটা ছুঁড়ে ফেলে উইসলি উজ্জ্বল মুখে বললেন, হ্যালো! বিল এতক্ষণ ছিলো, কাজে যেতে হবে, তাই এইমাত্র চলে গেলো, পরে তোমার সঙ্গে দেখা করবে বলেছে।
মিসেস উইসলি, মি. উইসলির মুখের দিকে ঝুঁকে পড়ে বললেন–এখন কেমন আছ? তোমার মুখটা সামান্য ফ্যাকাশে লাগছে।
আর্থার জিনির দিকে হাত বাড়ালেন। ওকে কাছে টানার জন্য বললেন, আমি এখন খুবই ভাল আছি, ওরা যদি ব্যান্ডেজ আজ খুলে দেয় তো আজই বাড়ি যেতে পারি।
ফ্রেড বললো, খুলছে না কেন ড্যাড? কথাটা শুনে আর্থার বললেন, যখনই ব্যান্ডেজ খুলতে যায় তখনই রক্তপাত শুরু হয়ে যায়। কথাটা বলে পাশে রাখা জাদুদণ্ড ঘুরিয়ে ছটা অতিরিক্ত চেয়ার বসার জন্য বলতেই এসে গেলো। ওরা বলছিলো, যে সাপটা কেটেছে তার দাঁতে অন্যজাতের বিষ আছে, তাছাড়া কাটাটাও একটু ভিন্ন। এরা বলছে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব হয় তত তাড়াতাড়ি কাটার বিষের প্রতিষেধক দেবে। আরও বলছে, আমার চাইতে আরও দুএকটা বা তারও বেশি সাপে কাটা রোগী এসেছিলো। এখন প্রতি একঘণ্টা অন্তর আমাকে ব্লাড রিপ্লেসিং পোসান ইনজেকসন দিয়ে চলেছে। কিন্তু কোণের দিকে ওই মানুষটি (তিনি হাত তুলে ওদের অভিবাদন জানালেন) কে ওয়্যারউলফ কামড়েছে, তাই খুবই দুর্বল দেখাচ্ছে। মনে হয় বেচারী বাঁচবে না, শুনছি কোনও প্রতিষেধক নেই?
মিসেস উইসলি ভয় বিস্ফোরিত নেত্রে চাপাগলায় বললেন–ওয়্যারউলফ! সাধারণ বেডে থাকলে তিনি ভাল হয়ে যাবেন? কোনও প্রাইভেট রুমে রাখলে তো পারে?
–এখনও পুরো দুটো সপ্তাহ বাকি আছে পূর্ণিমা হতে। হিলাররা আজ সকালে ওকে বলছিলো, ও শিগগিরই স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে। নাম না করে। আমি ওকে বলেছি, আমি একজন ওয়্যারউলফকে জানি যিনি তোমাকে ঠিক করে দিতে পারবেন, মি. উইসলি, মিসেস উইসলিকে খুব আস্তে বললেন।
জর্জ বললো–শুনে কী বললেন?
উইসলি দুঃখ ভরা কণ্ঠে বললেন, ও আমার কথা শুনে বললো তোমাকে আমি আর একটা কামড় দেবো।
তারপর দরজার ধাপে এক মহিলাকে দেখিয়ে বললেন, হিলারদের কিছুতেই বলছে না কিসে কামড়াচ্ছে তাকে। তো ওর কথা শুনে আমাদের মনে হয়, নিশ্চয়ই। কোনও কিছু বেআইনী জিনিস নাড়াচাড়া করার সময় দুর্ঘটনাটা হয়েছে। ড্রেসিং করার সময় দেখেছি ওর পা থেকে অনেকটা মাংস খুলে গেছে, লাল তাজা মাংস।
–এখন বলো বাবা, আসলে কি ঘটেছিলো? ফ্রেড একটা চেয়ার বেডের পাশে। টেনে এনে বললো।
–বাঃ এখনও তোমরা জানো না? মি. উইসলি কথা বলে, অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে হ্যারির দিকে তাকিয়ে হাসলেন, খুবই সাধারণ! আমি দিনের বেলায় ঝিমুচ্ছিলাম, আমার ওপোর কেউ অজান্তে অজ্ঞাতসারে লাফিয়ে পড়ে কেটেছে।
ফ্রেড, উইসলির পাশে পড়ে থাকা প্রফেটটা দেখে বললো, তোমাকে আক্রমণ করা সম্বন্ধে প্রফেটে কিছু লিখেছে?
মি. উইসলি চিবিয়ে হেসে বললেন, না, অবশ্যই না। মিনিস্ট্রি সর্ব সাধারণকে জানতে দিতে চায় না একটা নোংরা বড় সাপ আমাকে…।
–আর্থার? মিসেস উইসলি সতর্ক করে দিলেন।
হ্যারি মি. উইসলির ঢং দেখে বুঝতে পারলো আসল কথা বলতে চাইছেন ন।
–তখন তুমি কোথায় ছিলে বাবা? জর্জ জানতে চাইলো।
ছোট একটু হাসি মুখে টেনে এনে উইসলি বললেন, বলাটা আমার ব্যাপার। কথাটা বলে পাশে রাখা ডেইলি প্রফেট দেখতে দেখতে বললেন, তোমরা আসার আগে আমি উইসলি উইডারশিন্সের গ্রেফতারের কাহিনী পড়ছিলাম। তোমরা জানো উইসলি গত সামারে ভাঙাচোরা টয়লেটে ধরা পড়েছিলো? এবার একই ঘটনা! ওর হাতে ছিলো একটা জিংক্স সেটা ব্যাকফায়ার করেছিলো, ফার্টে দারুণ শব্দ করে। শব্দ শুনে সকলে টয়লেটে এসে দেখে ও অজ্ঞান (সেন্সলেস) হয়ে পড়ে রয়েছে। ওরা মাথা থেকে পা পর্যন্ত সব ভাঙা ইট কাঠ জমে রয়েছে।
–তুমি বলেছো, তুমি কর্মরত অবস্থায় ছিলে, তা তুমি কি কাজ করছিলে? ফ্রেড, ব্যাকফায়ারের কথা বাদ দিয়ে বললো।
–তোমার বাবার কথা কী তুমি শোননি? এখানে বসে উনি সে সম্বন্ধে কিছু বলতে চান না। ও হ্যাঁ তুমি উইসলি উইডারশিন্সের বাকি কাহিনী বলল, মিসেস উইসলি বললেন।
–সে কথা আমার কাছ থেকে জানতে চেও না। নানা রকম ফন্দি ফিকির করে টয়লেটের চার্জ পেয়েছিলো, তবে আমার ধারণা সোনা হাত বদলের ব্যাপার।
জর্জ খুব আস্তে বললো–তুমিতো সেই অস্ত্র পাহারায় ছিলে, তাই না? তাহলে তুমি জানো ইউ-নো-হু ওর পিছনে ছিলো?
–যাক ওসব কথা, মি. উইসলি বললেন। ওর গলার শব্দ বেশ উত্তেজিত। এইবার উইসলি বললেন, তারপর মাগলদের কাছে বিক্রির সময় ধরা পড়েছে। আমি অন্তত মনে করি না ও ছাড়া পেয়ে যাবে। প্রতিবেদনটা পড়ে মনে হয় দুজন মাগলও তাদের দুটো আঙ্গুল হারিয়ে এই হাসপাতালে আপৎকালীন হাড় রিগ্রোথ এবং মেমোরি মডিফিকেশন্সের ব্যাপারে ভর্তি হয়েছেন। আমি বলতে পারছিনে ওরা দুজন কোন ওয়ার্ডে রয়েছে।
এমনভাবে মি. উইসলি তাকালেন, যেন ওদের যেখানে চিকিৎসা হচ্ছে সেই ওয়ার্ডের সাইন পোস্টের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
ফ্রেড বললো, হ্যারি তুমি একবার বলেছিলে না, ইউ-নো–হুঁর কাছে বিরাট একটা সাপ আছে। সাপ আছে কথাটা বলে ও বাবার মুখের দিকে তাকালো। দেখতে চাইলো তার প্রতিক্রিয়া! যেদিন রাতে ও ফিরে এসেছিল তুমি ওর কাছে বিরাট মোটা একটা সাপ দেখেছিলে। তাই না হ্যারি?
–ব্যাস অনেক কথা হয়েছে। মিসেস উইসলি মাঝপথে ওদের থামিয়ে দিয়ে বললেন, ম্যাড আই আর টোংক বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। তারা তোমার সঙ্গে দেখা করতে চান আর্থার। এবার ছেলে–মেয়েরা তোমরা সবাই বাইরে অপেক্ষা করো, পরে একবার ঘরে এসে গুডবাই বলতে পারো, তুমিও যাও।
ওরা ঘরের বাইরে চলে গেলে মুডি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। ফ্রেড ভুরু কোচকালো।
–চমৎকার, ও পকেটে হাত পুরে বললো, বেশতো আমরা কিছু জানিও না।
–এটা খুঁজছো তাই না? জর্জ একটা লাল রঙের তার বার করে বললো।
–বাঃ তুমি দেখছি আমার মনের কথা বুঝতে পারো। ফ্রেড দাঁত বার করে হাসতে হাসতে বললো, দেখি সেন্ট মাংগোসের বন্ধ দরজার ঘরে কি গোপন কথাবার্তা চলছে।
ও আর জর্জ জড়ানো তার খুলে পাঁচটা ভাগ করে জিনির কানে একটা লাগিয়ে আর একটা হ্যারির হাতে দিতে গেলে হ্যারি নিতে ইতস্তত করলো।
হ্যারি তুমি কানে লাগাও! তুমি বাবার প্রাণ বাঁচিয়েছো। যদি কারও বাইরে থেকে আড়ি পাতার অধিকার থাকে তো সেটা তোমার, একমাত্র তোমার আছে।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও হ্যারি তারটা কানে লাগালো। ফ্রেড–জর্জও লাগালো। জিনির কানে হিয়ারিং এড তো আগেই লাগিয়ে দিয়েছে ফ্রেড।
ফ্রেড খুব আস্তে বললো–গুড, এইবার শোনোনা।
তারটা পাকানো ছিলো, জট খোলার সঙ্গে সঙ্গে একটা পোকার মতো ঘরের দরজার তলা দিয়ে ভেতরে চলে গেলো। প্রথম চোটে হ্যারি কিছু শুনতে পেলো না। পর মুহূর্তে তারের ভেতর দিয়ে টোংকর গলা শুনে লাফিয়ে উঠলো। এমন পরিষ্কার কণ্ঠস্বর, যেনো টোংক ওর পাশে দাঁড়িয়ে কথা কইছেন।
ওরা সমস্ত জায়গাটা তন্ন তন্ন করে খুঁজে সেই সাপটাকে দেখতে পেলো না। তোমাকে দংশন আর আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গে ও যেন হাওয়াতে মিশে গেলো আর্থার। কিন্তু ইউ-নো-হু একটা সাপকে বিশ্বাস করবেন, তাকে আনবেন এটা আশা করা যায় না। পারেন কী?
মুডি ঘোৎ ঘোঁৎ করে বললেন–মনে হয় সংবাদ নেবার জন্য সাপকে পাঠিয়েছিলেন। কারণ ইদানিং কারও ওপোর তার আস্থা নেই। আমার ধারণা ইউ নো-হুঁ কি করছে না করছে বা করবে তার একটা পরিস্কার ছবি চাইছে। আর্থার সেই সময়ে সেখানে না থাকলে জটার আরও বেশি সময় লাগতো চতুর্দিক দেখতে। তো পটার বলছে ও নাকি আদি অন্ত সব আগেই দেখেছে।
হ্যাঁ মিসেস আর্থার একটু বিচলিত কণ্ঠে বললেন, আপনারা আশাকরি জানেন, হ্যারি ওই রকম কিছু একটা দেখুক ডাম্বলডোর তার অপেক্ষা করছিলেন।
হ্যাঁ ঠিকই, মুডি বললেন, পটারের কথাবার্তার মধ্যে বাচ্চা ছেলের ভাব মনে হয় না?
মিসেস উইসলি বললেন, সকালে যখন আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন তখন তার কথা শুনে খুবই উদ্বিগ্ন মনে হয়েছিলো।
মুডি বললেন, অবশ্যই চিন্তিত ছিলেন। ছেলেটা ইউ-নো-হুর সাপ ওর ভেতরে অবস্থান করতে দেখেছে। অবশ্যই পটার ঠিক বুঝতে পারছে না তার সঠিক অর্থ কি। কিন্তু বাইরে থেকে ইউ-নো-হু ওকে গ্রাস করতে চাইছে সেটা বুঝতে পারছো?
হ্যারি একসটেন্ডেবল ইয়ার নিজের কান থেকে খুলে ফেললো। ওর বুকের ভেতরটায় হাতুড়ি পিটছে। খুব দ্রুত ওর মুখ গরম হয়ে গেলো। ও সকলের দিকে তাকালো। ওরাও সকলে তখন ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ওদের কান থেকে এখনও স্ট্রিংগুলো ঝুলছে। আতঙ্কে ওদের মুখ শুকিয়ে গেছে।