দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
শ্যামাই পেড়েছিলেন কথাটা। নইলে কারও মাথাতেই যেত না হয়ত। বলাইয়ের নিজেরও না। তিনিই একে-ওকে বলে মেয়ে ঠিক করেছিলেন। পাড়ারই মেয়ে বলতে গেলে। এ পাড়াতে নতুন এসেছে ওরা। বাড়ি করে উঠে এসেছে নিড়ের দিক থেকে। মেয়েটাও একেবারে ফেলনা নয়, পরিপূর্ণ সংসার ওদের, পাঁচ ভাইয়ের বোন। তার মধ্যে তিন ভাই-ই–সামান্য সামান্য হ’লেও–রোজগার করে। মেয়েও শ্যামবর্ণের ওপর মন্দ দেখতে নয়, তেরো-চোদ্দ বছর বয়স, বলাইয়ের সঙ্গে মানাবেও দিব্যি।
এ-সম্বন্ধ পেয়ে খুশিই হয়েছিলেন তিনি। ছোট মেয়ে, সহজে পোষ মানবে–নিজের মতো করে গড়ে নিতে পারবেন। আরও ভেবেছিলেন–যার কোন আয়ই নেই, এক পয়সা রোজগার করে না, সে অন্তত তেজ দেখিয়ে বৌকে নিয়ে আলাদা হতে পারবে না।
বেশ ভেবেচিন্তে হিসেব করেই এ কাজে এগিয়েছিলেন। মেয়ে তারা সহজে দিতে চায় নি। জরদ্গব মূর্খ ছেলে, তার হাতে তাদের একটা বোন–তুলে দিতে যাবে কোন দুঃখে? শ্যামাই সেখানে বসে পাঁচজনকে সাক্ষী রেখে বলেছিলেন, বিয়ে হ’লেই তিনি তাঁর যথাসর্বস্ব বলাইয়ের নামে উইল করে দেবেন। বাড়ি তাঁর–ইচ্ছে হ’লে ওরা দলিল দেখে আসতে পারে–তাঁর স্বোপার্জিত অর্থে কেনা। সুতরাং যথেচ্ছ দান-বিক্রয়ের অধিকার তাঁর আছে।
পাড়াতে এসে পর্যন্তই কঞ্জুষ সুদখোর বুড়ির ঐশ্বর্যের সম্ভব-অসম্ভব নানা কাহিনী শুনেছে তারা! এও শুনেছে যে ঐ মা-বাপ-মরা নাতিকে তিনিই বুকে করে মানুষ করেছেন। সুতরাং ওকে যথাসর্বস্ব দিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। ছেলের পৈতৃক বাড়ি-ঘরও আছে–বিনা মেরামতে বাড়িটা ভেঙ্গে গেছে, কিন্তু বাগান-পুকুর-জমি কোথায় যাবে! সব দিক বিবেচনা করে তারা রাজি হয়ে গিয়েছিল।
বিয়েও কতকটা বিয়ের মতোই হয়েছিল। হেম-কনকরাও এসেছিল। দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়ে গেছে। তাদেরও পীড়িত বিবেক সান্ত্বনা লাভ করেছিল। মা একা থাকেন– তাদের যখন কারও এসে থাকবার উপায় নেই-ই–তখন এছাড়া আর পথ কি? তাছাড়া– তারা ভেবেছিল–ঘাড়ে চাপ পড়লে যাহোক একটা রোজগারের চেষ্টাও করবে।
শ্যামাই খুশি হয়েছিলেন সব চেয়ে বেশি।
কিন্তু বিয়ের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মোহ ভঙ্গ হ’ল তাঁর। বৌ ছেলেমোনুষ কিন্তু মনের মতো করে গড়ে নেবার মতো মানুষ নয়। যেমন জেদ তার তেমনই তেজ। বিয়ের আটটা দিন কোনমতে মুখ বুজে ছিল, মাসখানেক পরে ঘর করতে এসেই নিজ মূর্তি ধরল। প্রথম দিন বাসন মাজার কথা বলতেই সোজাসুজি বলে দিল, ‘বাসন-টাসন মাজতে পারব না আমি, ওসব আমার অব্যেস নেই, হাতে লাগে।’
অগত্যা তাকে রান্নাঘরে লাগালেন শ্যামা। কিন্তু সেখানেও হুলস্থুল বেধে গেল। পাঁচ ছটাক তেলে পনেরো দিন রান্না হয় তাঁর–মালতী এক বেলাতেই তার অর্ধেক খরচ করে ফেলল। তাছাড়াও ফেলে-ছড়িয়ে একাকার কাণ্ড। শ্যামা ঠাকরুন ব্যাপার দেখে বকে চেঁচিয়ে কেঁদে-কেটে হাট বসিয়ে ফেললেন একেবারে। মালতী কিন্তু গ্রাহ্যও করল না। বরং বেশ স্পষ্ট ভাষাতেই জানিয়ে দিল, ‘ওসব ডেয়ো-ডোকলার মতো রান্না আমার দ্বারা পোষাবে না। যে পারে সে করুক : ‘
পরের দিন রান্নায় না দিয়ে অন্য কাজে টানবার চেষ্টা করলেন শ্যামা, ‘নাবৌ একবার আমার সঙ্গে বাগানে চল্ তো ভাই, হাতাপিতি করে পাতাগুলো কুড়িয়ে আনি।’
কিন্তু প্রস্তাব মাত্র বেঁকে দাঁড়াল নাবৌ, কেন, আমরা কি ভিখিরী যে পাতা কুড়িয়ে খেতে হবে? ঘরে দালানে গুচ্ছের পাতা রয়েছে সাপ-বিছের বাসা হয়ে…ঐগুলোই বরং লোক ডাকিয়ে ফেলিয়ে দিন!’
আরও খানিকটা চেঁচামেচি করলেন ওর দিদিশাশুড়ী, কিন্তু মালতী গিয়ে পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল। ওঁর অনুযোগ অভিযোগ বকুনির কোন জবাব দেওয়াও প্রয়োজন বোধ করল না।
তবু খুব সহজে হাল ছাড়েন নি শ্যামা। আর দুদিন থাক, যখন বুঝবে যে এই ঘর করা ছাড়া গতি নেই তখন আপনিই ঠাণ্ডা হবে–ভেবে মনকে প্রবোধ দিয়েছিলেন। মিষ্টি কথা আদর করে কাছে টানবারও চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দুদিন না যেতেই জ্ঞান-নেত্র তাঁর ভাল করে উন্মীলিত হ’ল। বুঝলেন এ-মেয়ে সেই ভবীদেরই একজন, যাকে কোন পরিমাণ তেলসিঁদুরেই ভোলানো যায় না। বসে বসেই খাচ্ছে এসে পর্যন্ত। কিন্তু তাতেও সে তুষ্ট নয়। সে শুধু বসে খেতেই চায় না, ভাল খেতেও চায়। দু-একদিন সামান্য সামান্য নাক- তোলার পর একদিন সটান ভাতের থালা সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘রোজ রোজ এই থোরসড়সড়ি আর শুষুনি শাকের ঝোল দিয়ে খেতে পারব না আমি। রাত্তিরেও শুকনো কড়কড়ি ভাত খাওয়া আমার পোষাবে না, এই সাফ্ বলে দিলুম।’
ইঁঃকণ্ঠে একটা বিচিত্র সুর বার করেন শ্যামা, তাঁর আর সহ্য হয় না, ‘খেতে পারব না! নবাবনন্দিনী এলেন একেবারে! তোর দাদারা কটা মাছের মুড়ো রোজ খাওয়াত শুনি!’
‘মুড়ো না খাওয়াক–ডাল তরকারী তো দিত। আর অমন ঠাণ্ডা কড়কড়ি ভাতও খেতে হ’ত না।’
‘যা যা–তাই খেগে যা সেখানে। আমার কাছে ওসব নবাবী চলবে না।’
‘কেন যাব! বসিয়ে খাওয়াবে বলে কি তারা বিয়ে দিয়েছে। তোমরা আমাকে খাওয়াতে বাধ্য!’
‘খাওয়াতে হবে বলে কি কালিয়া-পোলাও খাওয়াতে হবে নাকি! যা জুটবে তাই খাওয়াব!’
‘যা জোটে তাও তো খাওয়াও না। ছিষ্টি বেচে দাও কেন! বাড়িতে যা হয় তাও তো রাঁধতে পারো। অত পয়সার আহিঙ্কে কেন! এত পয়সা কে খাবে তোমার। কার জন্যে তাংড়াও? ম’লে তো আমরাই খাব, না হয় জ্যান্তেই খেলুম কিছু!
শ্যামা এবার ক্ষেপে যান একেবারে, ‘য়্যা, যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা! বসে বসে আমার মরণ টাকছ হারামজাদী!…এক পয়সা দোব না তোদের। পথের ভিখারীকে দিয়ে যাব তবু তোদের দোব না!’
‘ইস! দেবে না বৈকি! সকলের সামনে সত্যি করেছিলে মনে নেই? পাঁচ ভাইয়ের বোন আমি, তাদের সঙ্গে চালাকি করেছ শুনলে তারা তোমাকে জ্যান্তে পুঁতবে এই বলে দিলুম। টাকা পাব বলেই তো তোমার ঐ মুখু নাতির হাতে দিয়েছে–নইলে এই পাত্তরে কেউ মেয়ে দেয়!’
এরপর শ্যামা যা কাণ্ড করেন তা ঐন্দ্রিলাকেও হার মানিয়ে দেয়। মালতীও দমবার মেয়ে নয়–ভাতসুদ্ধ থালা উঠোনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে চলে যায় সে। ফলে শ্যামা আরও চিৎকার করতে থাকেন, মাথা খোঁড়েন, ডাক ছেড়ে কাঁদতে বসেন। কিন্তু তাতে মালতীর কোন ক্ষতি-বৃদ্ধি হয় না। সে সারাদিন না খেয়ে পড়ে থাকে, রাত্রে বলাই কাছে টানতে গেলে তাকে কড়া কড়া কথা শুনিয়ে দেয়।
ফলে বলাইয়েরও ধৈর্যচ্যুতি হয়। সে মানসিক গঠনের দিক থেকে দেখতে গেলে, জন্তুর মতোই বড় হয়ে উঠছে শুধু। জৈব প্রবৃত্তিগুলো সেই ছাঁচেই ঢালা। বেশিক্ষণ মিনতি করা তার ধাতে পোষাল না, সেই ঠাঁই ঠাঁই করে গোটাকতক চড় কষিয়ে দিল মালতাঁকে মালতীও তার হাতের ওপরে প্রচণ্ড এক কামড় দিয়ে রক্ত বার করে দিল, তারপর ঘরের এবং বাড়ির দোর খুলে সেই অন্ধকার রাত্রেই একছুটে বাপের বাড়ি চলে গেল।
ওর দাদারা অবশ্য তিরস্কার করল খুব। বলল, ‘এতগুলো টাকা, বুড়ি আর কদিন, কটা মাস মানিয়ে চলতে পারলি না?
দুষ্টু ঘোড়ার মতো ঘাড় বাঁকিয়ে মালতী বলল, ‘অমন পয়সার মুখে আগুন! না খেয়ে যদি মরেই গেলুম তো পয়সা ভোগ করবে কে’?
পরের দিনই সকালে ওর বড়দা ওকে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে চাইলেন, বুঝিয়ে বলতে গেলেন ওর ভবিষ্যতের কথা, কিন্তু মালতী বলল, ‘আমি আজই তাহ’লে ওদের ঐ পুকুরের জলে ডুবে মরব–মরব মরব মরব, এই তিন সত্যি করলুম। পুবের সুয্যি পশ্চিমে উঠলেও আমার কথার নড়চড় হবে না।’
কথাটা শ্যামার কানে উঠতে তিনি বললেন, ‘ভালই হ’ল আমাকে আর খ্যাংরা মেরে তাড়াতে হ’ল না।…এক মাসের মধ্যে যদি নাতির আর একটা বিয়ে না দিই তো কি বলেছি!’
কিন্তু বলাই সেই এক মাসের ভরসাতেও থাকতে পারল না। যে বাঘ নররক্তের স্বাদ পেয়েছে, বেশিদিন নররক্ত না পেলে সে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ওর কর্মহীন জীবনে–পশুধর্মের তাগিদটাই সর্বপেক্ষা প্রবল। সে কোনমতে পাঁচ-ছটা দিন কাটাবার পর আর ধৈর্য ধারণ করতে পারল না। দিদিমাকে না জানিয়েই সোজা শ্বশুরবাড়ি চলে গেল।
শালাদের তরফ থেকে অবশ্যই অভ্যর্থনার কোন ত্রুটি হ’ল না কিন্তু মালতী কঠিন হয়ে রইল। তার এক প্রতিজ্ঞা, বলাই যদি ও-বাড়ির সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করে চাকরি– বাকরির চেষ্টা করে, মানুষের মতো নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করে–তবেই মালতী তার ঘর করবে, নইলে এইখানেই ইতি।
বলাই অবাক হয়ে গেল প্রথমটায়। ওর সম্বন্ধে এ আশা কেউ করে তা ওর ধারণার অগোচর। সে অনেক অনুনয় বিনয় করল, পায়ে হাতে ধরতে গেল–কিন্তু মালতী ছিলে- ছেঁড়া ধনুকের মতোই অনমনীয় কঠিন হয়ে রইল। শেষে বলাই বলল, ‘আমাকে কে কাজ দেবে? আমি তো কিছুই জানি না।’
‘সে আমরা বুঝব। তুমি রাজি আছ কি-না তাই বলো।’
রাজি না হয়ে বলাইয়ের উপায় ছিল না।
মালতী তাকে পৈতে হাতে নিয়ে দিব্যি গালিয়ে তবে ছাড়ল। বলাই আর সেদিন ও- বাড়ি ফিরল না। পরের দিনও না–আর কোনদিনই না। শ্বশুরবাড়িতেই বসবাস করতে লাগল পাকাপাকি ভাবে।
শ্যামা প্রথম দিনটা একটু উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। যে কখনও বাড়ি ছেড়ে বাগানে পর্যন্ত বেরোয় না, তার এ অন্তর্ধান চিন্তার কথা বৈকি!
কিন্তু সারারাত জেগে বসে থাকার পর ভোরবেলা যখন খবর পেলেন (একই পাড়ায় দুই বাড়ি–খবর পাওয়ার বিশেষ কোন অসুবিধা নেই) যে বলাই শ্বশুরবাড়ি গিয়ে উঠেছে এবং সেখানেই রাত্রিবাস করেছে, তখন কোন চেঁচামেচি করলেন না, কোন গালমন্দ ও দিলেন না, শুধু তাঁর মুখের রেখাগুলো আগেকার মতোই কঠিন হয়ে উঠল।
এইটেই তাঁর চরিত্রের স্বধর্ম–এ ক’দিন যে চেঁচামেচি গালিগালাজ করেছেন সেটা তাঁর বয়োধর্ম-জনিত বিচ্যুতি। সে ক্ষণিকের দুর্বলতা চলে গেছে, বিভ্রান্তিমূলক হয়ে তিনি স্ব-স্বভাবে ফিরে এসেছেন আবার। খবরটা যে এনেছিল তাকে খুব শান্ত-কণ্ঠেই বললেন, ‘বাঁচা গেল দুগ্গার মা। এবার নিশ্চিন্তি হলাম একেবারে। সব বন্ধনই তো খসে গিয়েছে, ঐটে শুধু পায়ের বেড়ির মতো আটকে বসে ছিল। তা আপনি আপনি যে খসে গেল, লাথি ছুঁড়ে জোর ক’রে খসাতে হ’ল না–সেই ভাল। নিঃশ্বেস ফেলে বাঁচলুম।’…
শালাদের চেষ্টায় দিন পাঁচেক পরেই শিবপুরের দিকে কোথায় এক মারোয়াড়ীর কারখানায় চাকরি হয়ে গেল বলাইয়ের। ছোট কারখানা, খাটুনি বেশি মাইনে কম। যতদিন না কাজ শেখে ভাল করে–মাত্র একটাকা রোজ, তাও ছুটির মাইনে নেই। ’আনস্কিল্ড্ লেবার’ ঠিকে হিসেবে নেওয়া হয়েছে–ওদের নাকি রবিবারের ছুটিও পাওনা হয় না। রোজ পাঁচ ছ’মাইল হেঁটে যাতায়াত–লোহাপেটা কাজ, সর্বপ্রকার কর্মে অনভ্যস্ত বলাই পারে না, তার চোখে জল এসে যায় কাজ করতে করতে–রাত্রে ফিরে মড়ার মতো এলিয়ে পড়ে তবু মালতীর দয়া হয় না। সে বলে, ‘এক টাকাটা আড়াই টাকা হতে বেশি দেরি হবে না। আর খাটুনি? প্রথম প্রথম অমন কষ্ট সকলকারই হয়–দু’দিনেই সয়ে যাবে। পুরুষমানুষ খাটবে না তো কি?’
তারপর চুপি চুপি বলে, ‘ভাবছ কেন, বুড়ি কি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে? এতদিন তবু ভাবছিল তুমিই খেতে না পেয়ে ফিরে যাবে। এবার চাকরি করার খবর পেয়েছে, কেঁদে এসে পড়ল বলে– দুচারদিনের মধ্যেই। আসুক না, ওর কাছ থেকে মোটামুটি কিছু টাকা বার ক’রে নিয়ে এপাড়ায় তোমাকে একটা দোকান করে দেব। বুঝলে বোকারাম?’
কথাটা বলাইয়েরও মনে লাগে। মনে হয় এই রকম হওয়াই স্বাভাবিক। এক-ফোঁটা মেয়ের বুদ্ধি দেখে প্রশংসায় তার দৃষ্টি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
.
কিন্তু দেখা গেল বলাই বা মালতী কেউ কিছুমাত্র চিনতে পারে নি শ্যামাকে। শ্যামা কেঁদে এসে পড়লেন না–দু’চারদিনে তো নয়ই–দু’চার মাসেও না। এদিকে বলাইয়ের পক্ষে সে চাকরি রাখা সম্ভব হ’ল না। কোনমতে একটা সপ্তাহ বেরিয়েছিল, তারপর আর কিছুতেই গেল না। মুখ গোঁজ ক’রে বলল, ‘ও ভূতের খাটুনি আমার দ্বারা হবে না। আমি মরে যাব। তার চেয়ে তোমরা আমাকে এখানেই কেটে ফেল, সেও আমার ভাল!’
শালাদের উপদেশ অনুরোধ যুক্তি, মালতীর শাসন–কোনটাতেই কোন ফল হ’ল না। মালতী কথা কইল না দু’দিন, ওর ঘরে শুতে গেল না। তবুও বলাই চুপ ক’রে বসে রইল ঘরে। মালতী রাগ করে বলল, ‘ওকে খেতে দিও না। কাজে না গেলে খাওয়া নেই। দেখি উপোস ক’রে কতদিন থাকতে পারে, যেমন কে তেমনি’
কিন্তু শালাশালাজদের পক্ষে তা সম্ভব নয়। একে জামাই তায় ব্রাহ্মণ, উপবাসী অভুক্ত পড়ে থাকবে বাড়ির মধ্যে আর তাঁরা খেয়ে বসে থাকবেন? শেষে শালারাই উদ্যোগী হয়ে একজনকে মধ্যস্থ ক’রে পাঠালেন শ্যামার কাছে। যা হবার হয়ে গেছে, হাজার হোক বালক তো বলতে গেলে–তিনি ওকে মাপ করুন, কিছু টাকা দিয়ে বরং একটা দোকান ক’রে দিন, দু’পয়সা রোজগার করতে শিখুক! এখানেই এসে থাকবে, বৌও মাপ চাইবে তাঁর কাছে।
শ্যামা বললেন, ‘দিতে হয়–আমাকে ছেড়ে যাদের মুরুব্বির ধরতে গেছে–তারাই দিক। আমি এক আধলা দেব না। আমি জানি আমার সে নাতি মরে গেছে। সে পরিচয় ধরে যদি কেউ এবাড়ি ঢোকার চেষ্টা করে মুড়ি-খ্যাংরা মেরে তাড়াব।’
তখন অনেক মাথা ঘামিয়ে অনেক শলা-পরামর্শ ক’রে স্থির হ’ল যে বলাইয়ের পৈতৃক সম্পত্তি বেচিয়ে সেই টাকায় ওকে একটা ছোটখাটো মুদির দোকান করে দেওয়া হবে। ও সম্পত্তি থেকেই বা লাভ কি, পাঁচভূতে লুটে খাচ্ছে, বাড়ির জানালা-কপাটগুলো পর্যন্ত খুলে নিয়ে যাচ্ছে পাড়ার লোকে। মালতীর বড়দা তবু একবার বললেন, ‘জমিগুলো বেচে দাও বরং, ভিটেটা থাকুক, সারিয়ে সুরিয়ে নিয়ে ওরাই গিয়ে বসবাস করতে পারবে।’ মালতী রাজি হ’ল না তাতে। সে একবার এর মধ্যে গিয়ে দেখে এসেছে সে বাড়িঘর। সে বললে, ‘হ্যাঁ,–তা আর নয়। ঐ নিবান্দাপুরীতে আমি একা গিয়ে বাস করি আর চোর-ডাকাতে গলাটা কেটে দিয়ে যাক। চোর-ডাকাতে না কাটলেও ভূতে ঘাড় মটকাবে এটা তো ঠিক। সেই বুড়ি, ওর ঠাকুমা না কে, সে ঐ বাড়িতে পেত্নী হয়ে আছে, পাড়াসুদ্ধ সবাই দেখেছে। ওকে যদি দোকান ক’রে দাও, ও তো সে কোন্ ভোরে বেরিয়ে আসবে আর রাত-দুপুরে ফিরবে, আমি একলা ঐ হানাবাড়িতে কার ভরসায় থাকব শুনি?’
সুতরাং সবসুদ্ধই বেচে দেওয়া হ’ল। জলের দামেই একরকম। পাশের বাড়ির দত্তরা কিনলেন। অন্য লোককে বেচলে হয়ত আরও কিছু দাম পাওয়া যেত, কিন্তু কাগজপত্র কোথায় কি আছে, জমির সীমানা চৌহদ্দি কি, কেউ জানে না। পাঁচ ভূতে চেপে বসে আছে দখল ক’রে অনেক জায়গা। মামলা-মোকদ্দমার ফের, বেশি দাম দিয়ে বাইরের লোক কিনবে কেন? তবু যা পাওয়া গেল সেই টাকার মধ্যে থেকেই মালতীর বড়দা তাঁদেরই জমিতে নিজস্ব মাটির ঘর একখানা তুলে দিলেন, আর বাকি টাকাতে এই পাড়াতেই একটা মুদির দোকান খুলে বসল বলাই।
বলা বাহুল্যে সে দোকান মাস চার-পাঁচের বেশি টেকে নি। যে কিছুই জানে না সংসারের, তার পক্ষে ব্যবসা করা সম্ভব নয়। হিসেব করে দামটা পর্যন্ত নিতে পারত না বলাই। দুনিয়াসুদ্ধ লোককে বাকি দিয়ে বসে রইল, সে-টাকার কিছুই আদায় হ’ল না! সুতরাং আবারও যে তিমিরে সেই তিমিরে। এদিকে ততদিনে মালতীর একটি মেয়ে হয়েছে। দাদারা চিরকাল বোনের সংসার টানতে পারবেন না–আকারে ইঙ্গিতে ভাল ক’রেই জানিয়ে দিলেন এবার। দাদাদের যদি বা বোন সম্বন্ধে দুর্বলতা ছিল, বৌদিদের ছিল না। বড় বৌদি তো স্পষ্ট বললেন একদিন, ‘ভাবিতে উচিত ছিল প্রতিজ্ঞা যখন! তেজ দেখিয়ে যখন বেরিয়ে এসেছিল, তখন হুঁশ ছিল না?…যার তেজে তেজ মেয়েমানুষের সে মানুষটা কেমন তা ভেবে দেখা উচিত ছিল। ছেলেমানুষ! ছেলেমানুষ তো ছেলেমানুষের মতো থাকে না কেন! দাদাদের কথা শোনা উচিত ছিল না তখন?…বুড়ি দিদিশাশুড়ী, অন্যায় দেখেছে বকেছে–তাতেই আর ঘর করা চলল না?…আমরা শ্বশুরঘর করতে এসে কি রকম উঠতে-লাথি বসতে-ঝাটা খেয়েছি–চোখে দ্যাখে নি?’
.
এবার মালতী সত্যিই চোখে অন্ধকার দেখল। পাঁচ ভাইয়ের একমাত্র বোন–এই আশ্বাসেই এতদিন এত জোর দেখিয়েছে, সেই ভাইরা এভাবে সমস্ত দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে দেবে তা ভাবে নি কোনদিন। মুখে যাই বলুক, সত্যি সত্যিই কিছু না খেয়ে থাকা যায় না।
অবশেষে তারই তাড়নায় বলাই এসে একদিন শ্যামার পায়ে ধরতে গেল, ‘আমাকে মাপ করো, আমি না বুঝে অন্যায় ক’রে ফেলেছি!’
শ্যামা হাসলেন একটু। সে হাসি দেখে–কিছু না বুঝেও বলাই শিউরে উঠল। এমন নিরানন্দ কঠিন হাসি সে আর কখনও দেখে নি। শ্যামা বললেন, ‘মাপ করেছি আমি অনেকদিনই। তবে যদি মনে করে থাকো যে দয়া ক’।ে এসে মাপ চাইলেই আমি গলে যাব আর এরে-বেরে তোমাকে আর তোমার মাগকে ঘরে তুলব–সেটা তোমার মস্ত ভুল। আর না। আর কোনদিনই না। চৌকাঠ যেদিন ডিঙ্গিয়েছ সেইদিন থেকেই সব সম্পর্ক চুকে-বুকে গেছে। নিজে বিষয় বেচ্ছে, আলাদা ঘরও তুলেছ শুনেছি–নিজের সংসার নিজেই চালাও যেমন ক’রে পারো। কোন সহায় সম্বলই ছিল না আমার, মেয়েছেলে হয়ে যদি এতগুলো ছেলেমেয়ে মানুষ করতে পেরে থাকি, তুমি ব্যাটাছেলে হয়ে পারবে না?’
এই শেষ আশা ছিল বলাইয়ের, খুবই একটা ভরসা ছিল। মালতীও বুঝিয়েছিল তাই, কেঁদে গিয়ে পায়ে পড়লে ফেলতে পারবে না কিছুতেই। কিন্তু এতকাল এই মানুষের সঙ্গে ঘর করেছে বলাই, যত মূর্খই হোক, শ্যামার ভাবভঙ্গী ভাল ক’রেই চেনে। তাঁর মুখের রেখায় এবং গলার আওয়াজে বুঝল যে খুব সহজে কিছু হবে না এখানে। তার মনে হ’ল সত্যি-সত্যিই বুঝি তার পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে যাচ্ছে, অতল অন্ধকার ছাড়া আর কোনদিকে কিছু নেই। সে কেঁদে ফেলল এবার, দিদিমার পা দুটো চেপে ধরে বলল, তবে আমার কি হবে, কোথায় দাঁড়াব?’
আস্তে আস্তে পা ছাড়িয়ে নিয়ে শ্যামা বললেন, ‘এখানে আর কিছু হবে না তা আমি পরিষ্কারই বলে দিচ্ছি। তোমায় ও বৌকে আমি এবাড়ির বেড়া পেরোতে দেব না। ওদের ছেড়ে তুমি থাকতেও পারবে না। যদি বা জায়গা দিই দু’চারদিন পরেই তুমি আবার পালাবে। এবার হয়ত কিছু হাতিয়ে পালাবে। সুতরাং সেও আমি রাখব না। খেটে খাওয়াও তোমার দ্বারা হবে না। যা হবে তা বলে দিচ্ছি–তুমি ভিক্ষে ধরো!’
প্রথমটা বুঝতেই পারে নি বলাই। খানিকক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে বসে ছিল শ্যামার মুখের দিকে। তারপর বিহ্বল ভাবে কথাটার পুনরাবৃত্তি করেছিল শুধু।’ভিক্ষে ধরব? মানে ভিক্ষে করব আমি?’
‘আর কি করবে বলো? কি জান! লেখাপড়া শেখো নি যে আপিসে চাকরি করবে, গতর নেই যে কারখানায় গিয়ে লোহা পিটবে কিম্বা মোট বইবে–তাও তো বেয়েচেয়ে দেখেছ শুনেছি, বুদ্ধির জোরও এমন নেই যে ব্যবসা ক’রে খেতে পারবে। সে যারা পারে তারা দু’টাকা একটাকা পুঁজি নিয়েও নিদেন রাস্তার ধারে বসে তেলেভাজা ভেজে সংসার চালায়। ওর কোনটাই তোমার দ্বারা হবে না। যা হবে, যা পারবে তাই বললুম, এখন শোনা না শোনা তোমার মর্জি। বামুনের ছেলে ছেঁড়া জামার মধ্যে দিয়ে পৈতে দেখিয়ে রেলগাড়িতে ভিক্ষে ক’রে বেড়াও, তোফা চলে যাবে। ঐ ক’রে শুনেছি কত লোক দু-পাঁচ হাজার টাকা জমিয়ে ফেলেছে।’
তবু বলাই তখন উঠতে পারে নি। অত সহজে হাল ছাড়লে তার চলবে না বুঝেই আবারও পায়ে ধরতে গিছল, ‘এবারটির মতো আমাকে মাপ করো, বাড়িতে থাকতে না দাও–কিছু টাকা ধার দাও, আর একবার চেষ্টা করি দোকান করবার!
‘বেশ তো, সে তো ভাল কথা। উত্তম কথা। কী গয়না আনবে আনো, কত টাকা চাই তাও বলো। সুদ কিছু চড়াই লাগবে। সেই মতো সোনা হাতে রাখব আমি। বুঝে-সুঝে সোনা এনো!’
‘সোনা–?’ বিহ্বলভাবে বলে, ‘সোনা কোথায় পাবো?
‘তবে কি তোমাকে শুধু হাতে টাকা দেব ভেবেছ? কেন, টাকা রাখার আমার জায়গা নেই? কারবার ক’রে তুমি আমার দেনা শোধ করবে সেই ভরসায় টাকা ধার দেব তোমাকে এখনও সেরকম ভীমরতি আমাকে ধরে নি।
তারপরই নিজ মূর্তি ধরেন, ‘সরে পড়ো দিকি বাছা, মিছে বকিও না বসে বসে। আমার এখন ঢের কাজ আছে। উঠে পড়ো, গুটি-গুটি পথ দ্যাখো!’
সেই শেষ। বলাই আর আসে নি। আসতে সাহস হয় নি তার। মালতী রেগে বলেছিল, ‘তুমি মনিষ্যি না কি? হাতটা মুচড়ে ধরলে ঐ বুড়ির দম্ভয্যি থাকত কোথায় তাই শুনি! কেড়ে-বিগড়ে নিয়ে আসতে পারলে না কিছু টাকা? নিজের নাতিকে পুলিশে দিতে তো পারত না!’
‘হ্যাঁ, তবেই চিনেছ ওকে। ও সব পারে। জেলে দিয়ে ছাড়ত আমাকে তা’হলে। ওসব আমি পারব না। ও যা পাজি, নিজে মরে গিয়ে খুনের দায়ে আমাকে ফাঁসি দেওয়াতে পারে।’
সম্ভাবনাটা মনে করেও যেন শিউরে ওঠে বলাই।
তারপর দুজনেই চুপ করে থাকে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নেমে আসে একটা অসহনীয় নীরবতা। সেদিন আর কারুরই কিছু খাওয়া হয় না। স্ত্রীর কঠিন মুখভাবের দিকে চেয়ে কিছু বলতে সাহস হয় না বলাইয়ের–আস্তে আস্তে গিয়ে শুয়ে পড়ে।
কিন্তু আর কিছুই পারে না। তার ভাগ্যের সঙ্গে নির্বুদ্ধিতা জড়িয়ে তার এই সর্বনাশটা করল–এটুকু বোঝে, শুধু তার কি প্রতিকার ভেবে পায় না। এদিক ওদিক থেকে–বড় মাসীর বাড়ি থেকেই বেশির ভাগ–দু-টাকা এক টাকা চেয়ে আনে। বড় মামাকে চিঠি লেখে–কিন্তু কোথাও থেকে এমন কিছুই পায় না–যাতে দু এক দিনের বেশি সংসার চলে। সুতরাং দিদিমার উপদেশ শোনা ছাড়া কোন উপায়ও থাকে না কিছু।
।।২।।
ঐন্দ্রিলা খুব সহজে মেয়ের বাড়ি আসতে চায় নি। সে জানত যে সীতার এখানে এসে ওঠা মানে একটা পেট চালাবার বাড়তি খরচ তার ঘাড়ে চাপানো তো বটেই– সামান্য যেটুকু আয়ের পথ ছিল সেটুকুও বন্ধ হয়ে যাওয়া। বলতে গেলে যে পরের দোরে ঝাঁট দিয়ে পরের কন্না ক’রে পেট চালায়, ভিখিরীর মতো সতীন-পোদের পুরনো কাপড় চেয়ে নিয়ে লজ্জা নিবারণ করে, তার মাথার ওপর এই বোঝা চাপাতে ইতস্তত করেছে সে শেষ দিন পর্যন্ত। কিন্তু ক্রমশ আর উপায় রইল না। বহু দোর ঝাঁট দিয়েছে সে-ও। বহুদূর ঘুরেছে এই ক বছরে। চেনা জানা–তাদের চেনা তাদের চেনা, এই ভাবে শেকলের গ্রন্থি ধরে ধরে সম্ভব অসম্ভব যত যোগাযোগ করতে পেরেছে–সব জায়গাতেই সে কিছুদিন কিছুদিন কাজ করেছে। বোধ করি তার দুষ্টগ্রহের জন্যই টিকতে পারে নি কোথাও। এক এক জায়গা থেকে এক এক কারণে চলে আসতে হয়েছে। কিছুদিন পর পরই অসহায়ভাবে পথে এসে দাঁড়াতে হয়েছে। কেউই তাকে বেশিদিন সহ্য করতে পারে নি, কেউই তাকে ধরে রাখতে চায় নি।
কেবল একজন ছাড়া।
সেই তাঁর কাছেও গিয়েছিল সে। বছর খানেক পরেই গিয়েছিল। সে সময়টায় মাসখানেকেরও ওপর কোন চাকরি ছিল না, পুরনো মনি বাড়ি ঘুরে ঘুরে শুধু সামান্য পুঁজিই শেষ হয়ে গিয়েছিল– চাকরি বা চাকরির আশ্বাস মেলে নি কোথাও। তার মধ্যেই শুনতে পেল–নাতির টাইফয়েডের মতো হয়েছে, পয়সার অভাবে কোন চিকিৎসাই হয় নি, পাড়ার কোন্ ভদ্রলোক বই দেখে কী ওষুধ দেন হোমিওপাথী গুলি–তারই ভরসায় পড়ে আছে। এ খবর পেয়ে আর থাকতে পারে নি–লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে সমস্ত প্রতিজ্ঞা বিসর্জন দিয়ে কোলাঘাটের গাড়িতেই চড়ে বসেছিল আবার।
কিন্তু তাতেও কোন ফল হয় নি। শুধু ধার-ক’রে আনা গাড়ি-ভাড়াটাই খরচ সার হয়েছিল। গোরুর গাড়িতে করে বেলা দুটো নাগাদ অস্নাত অভুক্ত অবস্থায় সেই বাড়ির সামনে নেমে দেখেছিল কতকগুলো অপরিচিত ছেলেমেয়ে বাড়ির সামনে খেলা করছে। আগে ভেবেছিল–ডাক্তারবাবুর নাতিরা কেউ হবে। কিন্তু তারপরই মনে পড়েছিল, তাঁর ছেলে বা মেয়ে কারুরই সন্তানসংখ্যা খুব বেশি নয়। তাছাড়া তাদের এমন দীন বেশভূষা হবে না।…তখনই বুকের মধ্যেটা হিম হয়ে এসেছিল, তার ওপর যখন একটি আধ-ময়লা কাপড় পরা কালোমতো মধ্যবয়সী স্ত্রীলোক বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তুমি কে গা বাছা, তোমাকে চিনতে পারলুম না তো?’ তখন বেশ কিছুক্ষণ সে কোন উত্তর দিতে পারে নি। তারপর অনেক কষ্টে শুধু প্রশ্ন করেছিল, ‘ডাক্তারবাবু? এখানে যে এক ডাক্তারবাবু ছিলেন-’
‘ওমা, তিনি তো কবে মারা গেছেন! তাঁরই ছেলের কাছ থেকে তো এই বাড়ি আমরা কিনেছি। তা সেও তো আজ আট ন মাস হয়ে গেল। তুমি তাঁর কে হও গা বাছা? এত দূরে গাড়ি ভাড়া ক’রে একেবারে এসে হাজির হয়েছ অথচ এতদিনের মধ্যেও খবরটা পাও নি!
উত্তর দেওয়া কঠিন। সে সন্ধিগ্ধ দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে আরও কঠিন মনে হয়েছিল ঐন্দ্রিলার। কোনমতে থতিয়ে থতিয়ে বলেছিল, ‘আমি অনেকদিন বিদেশে ছিলুম, শরীরও ভাল ছিল না, চিঠিপত্তর লিখতে পারি নি, আমাকেও কেউ লেখে নি।’
ভাগ্যিস ঠিক সেই সময়ই মঙ্গলা এসে পড়েছিল। সেদিন হাটবার, সে হাটে যাচ্ছিল। অনেকটা দূর চলেও গিয়েছিল। সেইখান থেকেই গোরুর গাড়ি থামতে দেখে পিছন ফিরেছিল–কতকটা অলস কৌতূহলেই। কিন্তু তারপরই চিনতে পেরেছিল ঐন্দ্রিলাকে। সে পড়ি কি মরি ছুটেছিল আলের পথ ধরে, হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলেছিল, ‘ওমা, বামুনদি যে এতকাল পরে! কোত্থেকে এলে গা এমন ভাবে! বেশ মানুষ যা হোক বাপু! কী খোঁজাটাই না খুঁজেছি। এতদিন পরে মনে পড়ল আমাদের কথা! চলো চলো আমার ঘরে বসবে চলো–’
সে ভদ্রমহিলার সন্দেহ তবু যায় নি। তিনি বলেছিলেন, ‘তুই এঁকে চিনিস তাহলে? কে রে মঙ্গলা? ডাক্তারবাবুর কে হন?’
‘ওমা–চিনি না! ডাক্তারবাবুর অসুখের সময় এসে কী কন্নাটা করেছিলেন। ডাক্তারবাবুর নিজের মেয়ের মতোই।’
এই সামান্য মিথ্যা কথাটুকুর জন্যে মঙ্গলার কাছে যৎপরোনাস্তি কৃতজ্ঞতা বোধ করে ঐন্দ্রিলা। যদিও সে মিথ্যার অলীক স্বর্গটুকু বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। সে মহিলা আবারও বলেন, তবু রক্ষে!…আমি বলি সেই শেষের দিকে নাকি ডাক্তারবাবুর কে-এক ঢেনি জুটেছিল–তিনিই বুঝি এলেন এতকাল পরে সোহাগ কাড়াতে!’
মঙ্গলা আর দাঁড়াতে দেয় নি ঐন্দ্রিলাকে, হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল নিজের ঘরে। বলেছিল, ‘ওসব এঁটো কথায় কান দিও না বামুনদি। ডাক্তারবাবু তো মরলেন এখানে একা, মরবার সময় সেই আমি যা-ই ছিলুম তাই তবু মুখে একটু জল পড়েছিল। কিন্তুক মরবার পর শোক করার নাম ক’রে বিষয় সামলাতে এসে পাড়া ঘরে বাপের ছেরাদ্দ সপিণ্ডিকরণের কিছু আর বাকি রেখে যায় নি তো ছেলেমেয়েরা। ধন্যি তোমাদের ভদ্দরনোকদের ঘরের কাণ্ডকারখানা। আমরা ছোটনোক বটে, তবু সত্যি হ’লেও বাপমায়ের নামে এমন কুচ্ছো আমরা মুখে আনতে পারি না–বিশেষ তেনারা গত হবার পর। ছি ছি!
মঙ্গলাই যাহোক ক’রে একটু খাওয়ার যোগাড়ও ক’রে দিয়েছিল। বলেছিল, নিজেই দুটো ফুটিয়ে মুখে দাও যেমন ক’রে হোক। মুখ তো শুকিয়ে আমসি পারা হয়ে উঠেছে ঘরে মিষ্টিফিষ্টি কিছু নেই, থাকার মধ্যে মুড়ি আর গুড়। তা বাপু সে আর তোমাদের খেয়ে কাজ নেই–আমাদের তো আর তত এঁটোকাটার বিচের নেই, জেনেশুনে বামুনের বিধবাকে ওসব খাওয়াতে পারব না। এ নতুন হাঁড়ি, নতুন ইঁট পেতে দিয়েছি–দুটো সেদ্ধপক্ক ক’রে নাও, আমি চট্ ক’রে ওদের বাড়ি থেকে একটুকু নুন তেল চেয়ে এনে দিচ্ছি।’
এত হাঙ্গামা তখন করার ইচ্ছা ছিল না, নিতান্ত নিরুপায় হয়েই করতে হয়েছিল। কিছু না খেলে আবার ফিরে যাওয়া পর্যন্ত শরীর বইবে না বলেই। খাওয়া কেন-মুখে জল দিতে ও ইচ্ছে করছিল না তার। দেহ মন দুইই ভেঙ্গে পড়েছে এক দিক্চিহ্নহীন হতাশায়। কিন্তু সেটাও বড় কথা নয়, নিজের এই অদূর এবং অন্ধকার ভবিষ্যতের চিন্তা ছাপিয়েও যেটা মনের মধ্যে বড় হয়ে উঠেছে–সেটা হচ্ছে নিরতিশয় আত্মগ্লানি। অমন দেবতার মতো মানুষটাকে বুঝি সে-ই মেরে ফেলল। তিনি কিছুই চান নি তার কাছে, উপকারের কোন মূল্যই দাবি করেন নি। শেষকাল অবধি ভিক্ষার মতো করে চেয়েছিলেন, সে শুধু কাছে থাকুক। তার জন্যে ছেলেমেয়ে আত্মীয়স্বজন, এমন কি মানসম্ভ্রম, দুর্নামের ভয়ও ত্যাগ করেছিলেন। দিনরাত পরিশ্রম করে, রাত জেগে, রাশি টাকা খরচ করে যমের মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছিলেন। এতখানি স্নেহের কী মূল্যই সে দিল!…একটা মিথ্যা দম্ভ–সতীত্বের একটা অকারণ আস্ফালন দেখাতে গিয়ে তাঁর বুকে সে চরম শেল হানল। আস্ফালন ছাড়া কী বলবে সে, তিনি যা মানুষ ছিলেন–আর কোনদিন কোন দুর্বলতা প্রকাশ করতেন না, বুক ফাটলেও মুখ ফুটত না। ঐন্দ্রিলা স্বেচ্ছায় এগিয়ে গেলেও তিনি পিছিয়ে যেতেন। সেটুকু ঐন্দ্রিলা বুঝেছিল, চিনেছিল তাঁকে। অথচ আজ এখানে থাকলে সীতারও কোন অভাব থাকত না, নাতিটাও মানুষ হ’তে পারত। তিনি তো সীতাকে এখানেই আনিয়ে নিতে বলেছিলেন, জমিজমা বাড়িঘর সব লিখে দিতে চেয়েছিলেন!
মঙ্গলা বললে, ‘তুমি চলে যাবার পর, তুমি বললে বিশ্বাস করবে না বামুনদি, মানুষটা যেন আস্তে আস্তে শুকিয়ে মরে গেল। খুব একটা ঘা খেয়েছিল ভেতরে ভেতরে। খাওয়া- দাওয়া তো ছেড়ে দিলে একেবারে। আমাদের পেড়াপীড়িতে শুধু বসত একবার থালার সামনে ঐ পর্যন্ত। তাই কি দিনেরাতে দুবার বসানো যেত! যা করে ঐ একবার দিনান্তরে…কোথাও যেত না, শুধু চুপ ক’রে বসে থাকত বিছানার ওপরে। ঘরের বাইরেই বেরোতে চাইত না। অত সাধের ডাক্তারি, তা-ই ছেড়ে দিলে। লোক হাতে পায়ে ধরত এসে, হেজ্জা-হিজ্জি করত। তা ঐ এক কথা, আমার শরীর ভাল নেই, আমি পারব না আর। আমাকে ছেড়ে দাও তোমরা–আমি মরে গেছি ধ’রে নাও।…ঐ হালচাল দেখেই আমি বুঝেছিলুম যে বেশিদিন আর নয়, দিন থাকতেই বলেছিলুম ছেলেমেয়েদের খবর দিই, তারা এসে পড়ুক। তা বলে, না–কিছুতেই না। যতদিন আমার জ্ঞান থাকবে ততদিন দরকার নেই। তারা সুখে থাক, শান্তিতে থাক। তুই পারবি নি আমার মুখে একটু জল দিতে এ কটা দিন? আমি বলি, তা পারব নি কেন, তবু ছেলে বলে একটা কথা। তা তার জবাবে বলে, ঐ টেবুলের ওপর পোস্টকাট লেখা আছে, যেদিন আমার বাক্যি হরে যাবে, আর চোখ খুলতে পারব নি, সেইদিন ঐ পোস্টকাটখানা ডাকে দিস।…তাই দিয়েছিলুম, কিন্তুক ওমা, সে ছেলেমেয়ে–জামাই, সেই শালা বাবু এসে আমার ওপর কী টাইশ। কেন আগে খবর দেওয়া হয় নি! পেরথমে কোন জবাব দিই নি–শেষে আর থাকতে পারলুম নি, বললুম–তোমরা কে বাপু, তোমাদের তো দেখি নি কোন দিন, চিনিও নি। যাকে চিনতুম, যাকে দেখেছি এতকাল তারই হুকুম তামিল করেছি। বলেছিল একশোবার, বাক্যি হরে গেলে চিঠি দিস, তাই দিইছি।…আর আমি তো বাছা তোমাদের ভিটেবাড়ির পেরজা নই, আমাকে চোখ রাঙ্গাচ্ছ কিসের জন্যে তাই শুনি! আমি তোমাদের কাছে অত কৈফেয়ৎ দিতেই বা যাব কেন?…বাপের ওপর যদি এতই টান–এতকালের মধ্যে খবর নাও নি কেন বাছা কোনদিন? কৈ, কখনও তো একবার উঁকি মেরেও উদ্দিশ নিতে দেখি নি!…এমনি খুব ঝাঁ ঝাঁ করে উঠতে তবে চুপ ক’রে গেল–’
শুনতে শুনতে ঐন্দ্রিলার বজ্রাহতের মতো শুকিয়ে যাওয়া চোখেও যেন ভাদ্রের বন্যা নামে। আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে ছেলেমানুষের মতো। অনেকক্ষণ পরে, খানিকটা সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘তারা–তারা এসে আর দেখতে পায় নি বুঝি?’
না। সেইরকমই ইচ্ছে ছিল যে তেনার। পই পই করে বলে রেখেছিল।…ওরা এসে পৌঁছল যখন, তখন দুপহরের বাসি মড়া হয়ে গেছে। আমাকে বলে রেখেছিল যখন বুঝবি আর বেশি দেরি নেই, তখন তুই-ই একটু মুখে জল দিস আর ভগবানের নাম শোনাস। ভয় পাস নি, লজ্জা করিস নি–তুই-ই আমার যথার্থ মেয়ে। তা আমি শুনিয়েও ছিলুম! যতক্ষণ শ্বাস ছিল ততক্ষণ ভগবানের নাম করিছি বসে বসে।’
তারপর একটু থেমে, একটু ইতস্তত ক’রে বলেছিল, ‘বাক্যি হরে যাবার একদিন না দুদিন আগে আমাকে বলছে কি, মরবার আগে যদি আর একবার তাকে দেখতে পেতুম তো কোন দুঃখু থাকত না রে। একবার যদি ভুল ক’রেও এসে পড়ত!…বড্ড ইচ্ছে ছিল–। এই অবধি বলে আর রা কাড়ে নি, চুপ ক’রে গিয়েছিল। তবে নাকি কথাটা বলতে বলতে, থেমে যাবার পরও অনেকক্ষণ পজ্জন্ত–হাতের সেই বড় শীল-আংটিটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল কেবল।…একবার খুলেও ফেললে হাত থেকে, আবার কী মনে ক’রে পরে নিলে। তা আমার কেমন পেত্যয় হ’ল, আংটিটাই বোধহয় তোমাকে দেবার ইচ্ছে ছিল, লজ্জায় মুখ ফুটে বলতে পারল নি। তাই পরানটা যেমনি বেরিয়ে গেল অমনি আমি সেটা খুলে নিজের ঘরে রেখে গেলুম। যদি কোন দিন এসে পড়ো কি ঠিকানা পাই–এই ভরসায়। তা যাই হোক, এসেও গেলে তো বাপু, তেনারই টানে বোধ হয়।…এখন মনে হচ্ছে ভালই করেছিলুম, ওদের হাতে পড়লে আর উপুড়-হাত করত নি। এই তাই কথা তুলেছিল একবার, হাতে আংটির দাগ রয়েছে–সে আংটি কোথায় গেল? নিহাৎ সকালে আমার রণচণ্ডী মূর্তি দেখেছিল–বেশি ঘাঁটাতে সাহস করলে নি। চামার, সব চামার।…এখানে সাতখানা গেরামের লোক বাবুকে দেবতার মতো মান্যি করত, এতক্কাল কাটল এখানে–তা এখানে ছেরাদ্দ না শান্তি না কিচ্ছু না, একটা কাঁধকাট পজ্জন্ত খাওয়ালে নি। তাড়াহুড়ো করে মালপত্তর আদ্দেক বেঁধে সরে পড়ল। বাড়ি-জমিও সব ঐখেনে বসে বেচেছে, এদিক মাড়ায় নি।…ছেদ্দা তো সব কত–ব্যাটা ব্যাটার বৌ তো জুতো খটখটিয়ে এল জুতো খটখটিয়ে চলে গেল–নিতান্ত শ্মশানে গিয়ে জুতোটা একবার খুলেছেল এই যা। তাও বোধহয় সে জুতো নষ্ট হয়ে যাবার ভয়েই–’
আরও বহু কথা বলেছিল মঙ্গলা। সেসব কথা ঐন্দ্রিলা শোনেও নি ভাল করে। শুনতে পারে নি। দু চোখের জলে তার দৃষ্টিই শুধু ঝাপসা হয়ে যায় নি–কানও যেন আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। ঝাপসা আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল তার ভবিষ্যৎ বর্তমানও–তার সমগ্র চৈতন্য, সমস্ত জীবন। তারই অদৃষ্ট আর তারই দুর্বুদ্ধি নইলে অমন মানুষের অমন মতিভ্রম হবে কেন, আর সে-ই বা অত তেজ দেখিয়ে অত তাড়াতাড়ি চলে যাবে কেন। এখানে আর দুটো মাস থাকলে তার কী এমন ক্ষতি কী এমন অধঃপতন হ’ত। অথচ তা থাকলে আজ তার ভাবনা কী? যা-খুশি সে আদায় ক’রে নিতে পারত–চিরজীবনের মতো মেয়ের আর তার হিল্লে হয়ে যেত। এমন ক’রে আর পরের দোরে লাথিঝাঁটা খেয়ে ঘুরে বেড়াতে হত না তাকে। এখন আর কিছুই রইল না। আশা ভরসা সহায় অবলম্বন–আপনজন বলতে কেউ কোথাও রইল না আর! এতদিনের জীবনে স্বামী ছাড়া আর যে একমাত্র হিতাকাঙ্ক্ষী পেয়েছিল সে–তাকে নিজে হাতেই মেরে ফেললে। দুঃখের শেষ তার হবে না ইহজীবনে কোনদিন–তা সে খুবই বুঝেছে কিন্তু এ অনুশোচনারই কি শেষ হবে?
.
সেইদিনই সেখান থেকে চলে এসেছিল ঐন্দ্রিলা কোনমতে একটু কিছু মুখে দিয়েই। মঙ্গলা বলেছিল দুটো চারটে দিন তার ওখানেই থেকে আসতে, সে প্রবৃত্তি আর তার হয় নি! যেখানে সে সর্বময়ী কর্ত্রী ছিল সেখানে দীনদুঃখিনী আশ্রয়হীনার মতো দাসীর ঘরে মাথা গুঁজে থাকতে ইচ্ছা করে নি তার! তা ছাড়া ফেরার গাড়ি-ভাড়া তার কাছে পুরো নেই, সেটাও লজ্জাঘেন্নার মাথা খেয়ে মঙ্গলার কাছ থেকেই চেয়ে নিতে হবে যখন- তখন আবার কদিন তার ঘাড়ে চেপে ‘ভূজ্জিধ্বংসে’ লাভ কি? দেওয়ারই সম্পর্ক বরং তার, সেখানে হাত পেতে সামান্য কিছু নেওয়াও অপমানের। সে অপমান যত কম সইতে হয় ততই ভাল।
তারপরও বহুদিন বহু জায়গায় ঘুরেছে। বেশ ক বছরই। কোথাও বাসা বাঁধতে পারে নি আর। কোথাও কিছু সুবিধা হয় নি। একান্ত অসময়ে ডাক্তার-বাবুর প্রায় বারো আনা ওজনের আংটিটা হাতে এসে পড়েছিল। তাঁর সে শেষ স্মৃতিচিহ্ন, তাঁর পরম স্নেহের এবং বোধ করি ঐকান্তিক প্রেমের নিদর্শন সেই উপহার-সেটা দুদিনও কাছে রাখতে পারে নি ঐন্দ্রিলা। কলকাতায় ফিরেই বেচতে হয়েছে, নইলে হয়ত নাতিটাকে বাঁচানো যেত না। মেয়েকে পনেরোটা টাকা পাঠিয়েও নিজের হাতে কিছু ছিল- তাইতেই কটা দিন তবু এদিক ওদিক ঘুরে আশ্রয়ের চেষ্টা করতে পেরেছিল। মানুষটা মরেও তার চরম দুঃসময়ে একান্ত কাজে লাগল।
কিন্তু সে টাকাও গোনা-গাঁথা। একদিন তাও ফুরোল আবার। অথচ কোন ব্যবস্থাই কোথাও করে উঠতে পারল না। চাকরি দু-একটা যে না পেলে তা নয়–কিন্তু দু-মাস চার মাসের বেশি রাখতে পারলে না কোনটাই। এতদিন শত্রুতা করেছে গ্রহ, তার ভাগ্য। এবার শরীরও পিছনে লাগল! হয়ত ঐ বিরূপ গ্রহেরই চরম মার। কিন্তু সে মার আর ঠেকাতে পারল না কিছুতেই। শরীর আর বইল না একেবারেই। নানা রোগে ধরেছে, তার মধ্যে পেটের গোলমালটাই প্রধান। এর শুরুও আজ নয়-ভাল হজম হচ্ছে না দীর্ঘদিন ধরেই, এবার সে গোলমাল প্রবল আকার ধারণ করল। হাতে পা ফুলতে লাগল, পেটটা বড় হয়ে উঠল। অর্থাৎ উদুরীর লক্ষণ। শেষ যেখানে চাকরি পেয়েছিল–জয়নগরে, সেখানে মনিবরা বেগতিক দেখে হঠাৎ একখানা রিকশা ডেকে মালপত্র চাপিয়ে ওকেও তাতে তুলে দিলে। রিকশাওয়ালাকে ভাড়া আগাম দিয়ে বলে দিলে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসতে। এত দ্রুত এবং এত আচমকা ঘটল ব্যাপারটা যে ঐন্দ্রিলা রীতিমতো হকচকিয়ে গিয়ে হ্যাঁ-না কিছু বলতেই পারল না। অভিভূতের মতোই গাড়িতে গিয়ে উঠল। অবশ্য আগেকার মতো ঝগড়া করার শক্তিও ছিল না তার, গলার শির ফুলিয়ে চেঁচিয়ে গাল-মন্দ দিয়ে পাড়া মাথায় করবে–সে ক্ষমতা একেবারেই চলে গেছে ভুগে ভুগে। তাছাড়া এটা সেও বুঝল যে, ওদের বিশেষ দোষও নেই। পয়সা খরচ করে লোক রাখে লোকে দরকারের জন্যেই, অথচ ঐন্দ্রিলা এই চাকরিতে ঢুকে পর্যন্তই সন্ধ্যার দিকে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ছে, বাড়ির লোককে রেঁধে নিতে হচ্ছে প্রায় সম্পূর্ণই। সকালেও অসুবিধা কম নয়, এখানে অফিসের ভাত দিতে হয় ভোরবেলা-সাতটার গাড়ি না ধরলে অফিস করা যায় না-কিন্তু সেও পেরে ওঠে না সে। বাড়ির পুরুষরাই যদি নিত্য ভাতে ভাত খেয়ে অফিসে যায় তো রাঁধুনী রেখে লাভ কি ….
ওখান থেকে প্রায় রিক্ত-হস্তে ধুঁকতে ধুঁকতে যখন মেয়ের বাড়ি এসে দাঁড়াল ঐন্দ্রিলা, তখন তার অবস্থা দেখে সীতা চীৎকার করে উঠল। কী মড়ার দশা হয়েছে তার অমন সুন্দরী মায়ের। অমন যে রঙ, তাও যেন পুড়ে তামার বর্ণ হয়ে গেছে। হাত পা নলি-নলি অথচ হাত-পায়ের পাতাগুলো ফুলো ফুলো পেটটা ঢাক। মেঘের মতো এক ঢাল চুল- সামনের দিকে তার আর কিছুই প্রায় অবশিষ্ট নেই-সব চুল উঠে টাক পড়ে গেছে, পেকেও গেছে অর্ধেক।
কেঁদে ফেলল ঐন্দ্রিলাও। মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, তোর কাছেই মরতে এলুম রে এবার, যা হয় ক’রে একটু ঠাঁই দে-নইলে কি সত্যি সত্যিই রাস্তায় পড়ে মরব?’
‘ছি ছি, অমন কথা বলতে নেই। চুপ করো, চুপ করো। চলো, ঘরে গিয়ে একটু বসবে চলো আগে।’ তখনকার মতো সান্ত্বনা দিয়ে নিজের ঘরে এনে তুলল বটে। কিন্তু মনের মধ্যে বিশেষ বল পেল না সীতা। তার অবস্থা আগেকার চেয়েও একটু অসহায় হয়ে উঠেছে। সতীন-পোরা যখন সবাই এক সংসারে ছিল, তখন ভূতের মতো খেটে, বৌদের মন যুগিয়ে নিজের অবস্থা অনেকটা স্থিতিস্থাপক করে নিয়েছিল, যা হোক এতটু আধিপত্যের মতোও হয়েছিল। এখন তারা সব ভিন্ন হয়ে গেছে, পৃথক পৃথক সংসার। একজনের ভাগে পড়া ছাড়া উপায় নেই। অনেক ভেবে সে মেজ সতীন-পোটিকেই বেছে নিয়েছিল। তার সংসার কম কিন্তু বৌটিও তেমনি অকর্মণ্য। তার তরফেই আগ্রহ বেশি ছিল। কিন্তু যেখানে ত্রিশ-বত্রিশজনের পাতা পড়ে, সেখানে দুটো লোকের খাওয়া কেউ টেরও পায় না, পাঁচ-ছনের মধ্যে দুজন অনেক খানি। তাদের খরচটা চোখে দেখতে পাওয়া যায়। কাজেই বেশ একটু সংকুচিত হয়ে থাকতে হয় সীতাদের। অবশ্য ছেলের পড়াশুনা বা কাপড়জামা বাবদ অন্য সতীন পোরাও কিছু কিছু সাহায্য করে-তবে তা নিয়মিত কিছু নয়, পাঁচবার চাইলে একবার পাওয়া যায়। তার ওপর ভরসা নেই কোন। এক্ষেত্রে আশ্রিতের সংখ্যা দুজনের সঙ্গে আরও একজন যুক্ত হলে এরা কি বলবে-সবসুদ্ধই খোয়াতে হবে কিনা, তা নিয়ে দুশ্চিন্তার অবধি রইল না সীতার।
প্রথম দু-চার দিন অবশ্য কিছুই বলেন নি কেউ, বরং বড় সতীন-পো উদ্যোগী হয়ে পাড়ার এক ভদ্রলোককে ধরে একটু হোমিওপাথী ওষুধের ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন। পুরনো চাল মানকচু প্রভৃতি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন পথ্যের জন্যে, নিজের সংসার থেকে।
কিন্তু পাঁচ সাত দিন পরে দেখা গেল মেজবৌয়ের মুখ ভার-ভার। আরও দুদিন পরে মেজকর্তা কার্তিক সীতাকে ডেকে মার কুশল প্রশ্ন করে উপদেশ দিলেন, ‘বৌমা, এসব চিকিচ্ছেয় কিছু হবে না, দিদিমাকে যদি বাঁচাতে চাও তো তাঁর মায়ের কাছে পাঠিয়ে দাও যেমন করেই হোক। ওখানে কাছাকাছি বড় হাসপাতাল আছে– নিয়ে গিয়ে ফেলতে পারলে নিশ্চিন্তি, ওষুধপত্তর সবই পাবে, পাস করা ডাক্তার আছে-কোন ভাবনাই থাকবে না। এখানে এমনভাবে ফেলে রাখলে বাঁচবেন না উনি। এ তো মনে হচ্ছে পুরোনো উদুরী- ভাল রকম চিকিচ্ছের দরকার।’
ইঙ্গিতটা স্পষ্ট, না বোঝবার কোন কারণ নেই। কিন্তু বুঝেই বা উপায় কি? দুশ্চিন্তায় যেন নিমেষে ঘেমে উঠল সীতা, মাথা হেঁট করে জড়িয়ে জড়িয়ে বলল, ‘মা যে যেতে চায় না সেখানে মোটে, তাছাড়া মামারাও তো কেউ নেই, সঙ্গে করে হাসপাতালে নিয়েই বা যাবে কে? দিদ্মা সেসব পারবে না।’
কার্তিক ভ্রূ কুঁচকে জবাব দেয়, ‘তোমার দিদ্মা তো এধারে ডোকলা সেধে সেধে এ- গ্রাম ও-গ্রাম করে ঘুরে বেড়ান-সুদের তাগাদা দিয়ে দিয়ে। তোমার মা-ই বলেছেন সে- কথা। পোদড়া, শালিমার, শিবপুর পর্যন্ত হেঁটে পাড়ি দেন। মেয়েকে মৌড়ীর হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারবেন না? তাছাড়া তোমার একটা বোনপোও তো থাকে না ওখানে?’
‘তার কথা ছেড়ে দিন-সে এক জন্তু! সে বাড়ি থেকে বেরোয়ই না সাতজন্মে!‘তবু ওখানে পাঠালে, তোমার দিমার ঘাড়ে নিয়ে গিয়ে ফেললে কি আর একটা উপায় তিনি করবেন না হাজার হোক পেটের মেয়ে তো!’
হাত-পা হিম হয়ে আসে। বড় বেশি স্পষ্ট-ইঙ্গিতটা। বেশি দিন না বোঝার ভান করলে হয়ত আরও বেশি কিছু বুঝতে হবে। সকলকেই পথে বসতে হবে হয়ত। সে আর কথা বাড়ায় না। দিদ্মা যে কী রকম মা তাও-বৃথা জেনেই আর বোঝাবার চেষ্টা করে না। বরং আস্তে আস্তে ভয়ে ভয়ে মার কাছে কথাটা পাড়তে যায়।
কিন্তু সেখানেও কোনও সুবিধা হয় না। ঐন্দ্রিলা কথাটা শুনেই আবার কাঁদতে শুরু করে, ‘সেবার বাইরের বাগান থেকেই তাড়িয়ে দিয়েছিল, এবার এ মূর্তিতে গিয়ে দাঁড়ালে বেড়ার আগড়টাই খুলতে দেবে না। রাস্তা থেকে খ্যাংরা মেরে বিদেয় করবে! সেবার খ্যাংরা দেখিয়েছিল-এবার মারবে সত্যি সত্যিই।….তবু তখন খাটবার গতর ছিল। বসে খাওয়াবে আবার চিকিচ্ছে করাবে মা? সেদিন পূবের সূর্য্যি পশ্চিমে উঠবে।…তার চেয়ে সোজা-ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে খালধারে বসিয়ে দে, একেবারে এগিয়ে থাকি। ফেলতেও আর লোক ডাকতে হবে না তোদের, রাশ জ্বালাতেও হবে না-জ্যান্তই শ্যাল-কুকুরে খেয়ে যাবে!’
এর মধ্যে যে প্রচ্ছন্ন অভিযোগ ছিল তা কাঁটার মতোই বেঁধে সীতাকে। তারও চোখে জল এসে যায়। সে যে কত অসহায় ও অক্ষম, তা বুঝেও বোঝে না মা। অসুখ হলে মানুষ একটু অবুঝ হয়ে পড়ে ঠিকই–তবু চোখে যা দেখেছে, যা দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার, তাও বুঝতে চায় না কেন?
কিন্তু অভিমানেরও অবসর নেই সীতার। খানিকটা পরে তাই আবারও পূর্ব কথার সূত্র ধরতে হয় তাকে। বলে, ‘আচ্ছা, দিনকতক বড় মাসিমার কাছে গিয়ে থাকলে কি হয়? হাসপাতাল তো ওদের বাড়ির কাছেই-কেউ না কেউ নিয়ে যেতে পারবে। বড় মেসোমশাইও তো বসে থাকেন আজকাল-?’
কথাটা বলে ফেলে উৎকণ্ঠায় কণ্টকিত হয়ে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকে সে।
ঐন্দ্রিলা তখনই কোন জবাব দেয় না-কিন্তু আস্তে আস্তে শান্ত হয় একটু। চোখের জল মুছে বলে, ‘কুটুম-বাড়িতে এমন মড়ার দশা গলগ্রহ হয়ে দাঁড়াতে পারব না–সে মাথা কাটা যাবে বড্ড। তুই না হয় একটা কাজ কর বরং–তুই-ই একবার যা। ন্যাড়া ধনা শুনছি কিছু রোজগার করছে এখন, মেজকর্তার দুই ছেলেও আপিসে ঢুকেছে, কান্নাকাটি করলে সবাই কিছু কিছু দেবে। আর যদি মেজকর্তা নিজে থেকে যেতে বলে তো কথাই নেই। সে তবু একটু মান থাকে।’
প্রস্তাবটা সীতার মোটেই ভাল লাগে না। সে চিরকাল ভীতু-মুখচোরা-লাজুক প্রকৃতির মানুষ। নিজের শরীরের ওপর দিয়ে সমস্ত কষ্ট সহ্য করতে রাজি আছে সে কিন্তু বাইরের কারুর কাছে হাত পাততে, কি ইনিয়ে-বিনিয়ে ভিক্ষা করতে তার মাথায় বাজ পড়ে যেন।
সে খানিকটা চুপ থেকে বলে, ‘তুমি যেভাবে একে-ওকে ধরে রাঁধুনীর কাজ যোগাড় করো, সেইভাবে আমাকে একটা যোগাড় করে দাও না। তুমি না হয় এখানে থাকতে-? ছেলেটাকে দেখতে পারতে-’?
‘তুই কি পাগল হয়েছিস’ এক কথায় প্রস্তাবটাকে উড়িয়ে দেয় ঐন্দ্রিলা, কত নশো পঞ্চাশ পাবি তাতে? খাওয়া-পরা বড়জোর দশটা কি বারোটা টাকা। তাতে এখানে আমাদের দুটো প্রাণীর চলে কখনও? এদের রান্না না করলে এরা বসিয়ে খাওয়াবে কেন? তুই গতর খাটাচ্ছিস তাই আমাদের খেতে দিচ্ছে। এ-ই তো বলতে গেলে রাঁধুনীর কাজ তুই গেলে কি আমি তোর কাজ সাপ্টে করতে পারব? তার আদ্দেকও তো পারব না। আর কাজ না পেলে, ওরা বসিয়ে খাওয়াবে নাকি দু’-দুটো লোককে
কথাটা মর্মান্তিকভাবেই সত্য। এবং সেজন্যে খুব দোষও দেয়া যায় না ওদের। জিনিসপত্রের দাম আগুন হয়ে উঠেছে–এখনও বেড়েই চলেছে দিন দিন। কোনকালে যে আবার কমবে, তা মনে হয় না। ওদের চাষের ফসল ঘরে ওঠে বলেই অত টের পায় না এখনও–তবু যা দু-একটা জিনিস কিনতে হয়, তাতেই জিভ বেরিয়ে যায়। দুটো পেট যদি বসিয়েই খাওয়াবে তো এখনই–এক সপ্তাহ না যেতে যেতে–নোটিশ দেবে কেন? দশ- বারো টাকা সে যদি পাঠায়ও, তাতেই বা কি হবে, দুটো লোকের কি খরচা পোষাবে ….
অগত্যা চোখের জল চোখে মেরে দুরু দুরু বক্ষে বড়মাসীর বাড়িই যেতে হয় একদিন।
অবস্থা সকলের সামনেই খুলে বলে। চোখের জলও চেষ্টা করে ফেলতে হয় না, আপনিই পড়ে। নিজের এই অসহায় অবস্থা, এই দুরবস্থার কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ে আরও অনেক বেশি। অনেক অপ্রকাশিত নিরুদ্ধ বেদনা কণ্ঠে পথ না পেয়ে চোখের আগল ঠেলে বেরিয়ে আসে। রুগ্ন অসমর্থ মা–এতকাল ধরে ওর জন্যে জীবনপাত করে আজ বলতে গেলে শেষ অবস্থায় ওর দোরে এসে দাঁড়িয়েছে–দুটো দিনও তাকে আশ্রয় দেবার ক্ষমতা নেই ওর। অথচ ওরই স্বামীর জমিজমার আয়ে অত বড় সংসারটা চলছে। চাকরি- বাকরি করে কেউ কেউ, কিন্তু সে আর কতটুকু, সমুদ্রের কাছে পাদ্যার্ঘ।
মহাশ্বেতা মেজকর্তার মুখের দিকে চায়। তার মুখও ক্ষণে আরক্ত, ক্ষণে বিবর্ণ হচ্ছে, তারও অবস্থা অমনিই অসহায় বুঝি তারও জোর করে কারও জন্য সুপারিশ করার সাহস নেই আর। এই যুদ্ধের বাজারে এত বড় সংসারটা বজায় দিয়ে যাচ্ছে মেজকর্তা–এই-ই ঢের। ফেলে নি সে কাউকে, কারুর পাত পাতাও বন্দ করে নি। যা হোক পরতেও দিচ্ছে– তা মোটা চটই হোক আর থলেই হোক। তবু ওরই দুটো ছেলে রোজগার করছে, মহার রোজগেরে ছেলে বলতে এখনও পর্যন্ত একটাই, শুধু ন্যাড়া। ধনার চাকরি গেছে এর মধ্যেই। সবচেয়ে ছোটটা এই সবে কোন্ এক কারখানায় ঢুকেছে। রোজগারের মতো রোজগার করতে এখনও তার ঢের দেরি। অথচ সংসার মহারই বড়। সে আবার কোন্ মুখে বোন-বোনঝির জন্যে সুপারিশ করবে?
মেজকর্তার মুখের দিকে চেয়ে থাকে প্রমীলাও। তার চোখে ভ্রূকুটি। বোধহয় নির্বোধ স্বামীর বদান্যতাকে তার ভয়। কিন্তু অম্বিকাপদ কারও দিকে তাকায় না, চুপ করে বসে সব শোনে। তারপর সীতার অব্যক্ত ও অস্পস্ট প্রার্থনা স্পষ্ট বা ব্যক্ত হয়ে ওঠবার আগেই উঠে গিয়ে ঘর থেকে পাঁচটা টাকা এনে সীতার হাতে দেয়। বলে, ‘বাজারের যা হালচাল, দেখতেই তো পাচ্ছ। আমাকে বাধ্য হয়েই সবদিকে টেনেটুনে চলতে হচ্ছে, ক’দিন তাও চালাতে পারব কে জানে।… এর চেয়ে বেশি আর কিছু করবার ক্ষমতা নেই আমার। বরং মাঝেমধ্যে যদি খুব ঠেকে পড়ো কখনও তো একখানা চিঠি দিও–এত খরচ করে সাত দেশ ভেঙ্গে আসবার দরকার নেই। যা পারি এক টাকা দু’টাকা মনিঅর্ডার করে পাঠিয়ে দেব।’
সাফ সাফ পরিষ্কার কথা। কোন উত্তর-প্রত্যুত্তর বা ধরপাকড়ের রাস্তা থাকে না কোথাও। মাথা হেঁট করে টাকা কটা হাত পেতে নেয় সীতা–নিতেই হয়। চেষ্টা করেও চোখের জল বন্ধ করতে পারে না–গোপন করার চেষ্টা করে শুধু।
প্রমীলা বোধ করি স্বামীর বুদ্ধি-বিবেচনায় খুশী হয়েই ওকে ডেকে আরও দুটো টাকা দেয় নিজের সঞ্চয় থেকে। ছোটবৌ কিছুই করতে পারে না, তার হাতে কিছুই নেই। স্বামীর কাছ থেকে চেয়ে-চিন্তে বা জোর করে টাকা আদায় করার মানুষ সে নয়।… সে শুধু উঠে এসে পাশে বসে ওর পিঠে হাত বুলিয়ে নীরবে সান্ত্বনা দিতে থাকে।
মহাশ্বেতাও তার সর্বশেষ সামান্য পুঁজি থেকে একটা টাকা বার করে। আড়ালে ওর হাত ধরে কান্নাকাটি করে, ‘তুই মনে ভেবে রাখ্ মা তোর বড়মাসী মরে গেছে। আমার কাছে আর কোন আশা রাখিস নি। তোর মাকেও সেই কথা বলে দিস।…. আমার ক্ষমতা বলতে তো ও-ই–ঐ তো থুম হয়ে বসে আছে। পাখির আহার করে বলতে গেলে–পাছে এদের সংসারের ভার বলে মনে হয় ওর খাওয়াটা। সে কি আর শালীর হয়ে ভাইকে বলতে যাবে?…. কখনই বলবে না। সে সাহস আমারও নেই আর। এখন তো গুষ্টিসুদ্ধ ওদের হাততোলায় আছি। পারব না বলে ঝেড়ে ফেললেই হ’ল–সে ম্যাদের আর আপীল আদালত নেই। তখন পথে বেরোতে হবে ভিক্ষে করতে।’
ন্যাড়া শুধু ফেরবার বাস ভাড়াটা দিয়ে দেয় হিসেব করে। সে-ই তুলে দিতে এসেছিল বাসে। অপ্রস্তুতভাবে হেসে বলে, ‘বুঝতেই তো পারছিস–কীই বা রোজগার করি, এ কি আর বলবার মতো, না এ থেকে কিছু করা যায়। প্রথম মাসের মাইনে পেয়ে সবটাই মেজকাকে ধরে দিয়ে গিয়েছিলুম–মাইনে ওপরটাইম সব, পাইপয়সা হিসেবে করে; তা মেজকাও তো কম চালাক নয়, সবটাই ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ও তুই-ই রাখ, তোর টিফিন আছে, রেলের টিকিট আছে–এত হিসেব করে মনে করে আমি কি দিতে পারব, তুই বরং এক কাজ কর–একটা ভার নিয়ে নে, আমি নিশ্চিন্তি হই। সারা গুষ্টি বলছি না–তোদের ভাইবোন, বাপ-মা’র যা কাপড়-জামা-জুতো লাগে, তুই সেইটে চালা।’ খুবই লেহ্য কথা, নাই বা বলি কোন্ মুখে? টানছে তো কম না, দাদার বছর বছর ছেলে হওয়া– সে বেন তোলা থেকে দুধের খরচ, সবই তো সে যোগাচ্ছে। তবু সবকটা বাঁচে না তাই রক্ষে। আমারই তো দুটো, কম করে তিন পো দুধ লাগে রোজানি। সবই দিচ্ছে, কোনদিন না বলে নি।… আমি কোন্ লজ্জায় বলি এই সামান্য ভারটাও বইতে পারব না। অথচ এতগুলো লোকের কাপড়-জামা-জুতো–তাই কি কম? অবিশ্যি আমার ভায়েদের জামা-জুতো খুব লাগে না–কিন্তু তাহলেও যা লাগে, তাই কিনেই এক-এক মাসে একটা পয়সা বাঁচে না।’
বাড়ি ফিরে সীতা টাকা আটটা কার্তিকের হাতে দিতে সে আকাশ থেকে পড়ে, ‘এ আবার কি? এ টাকা কিসের’?
সতীন-পোদের চোখের দিকে চেয়ে কথা বলবার সাহস নেই সীতার আজও, সে মাথা হেঁট করেই জবাব দেয়, ‘বড়মাসীর কাছে গিছলুম, তাঁরাই দিলেন ওষুধপত্তরের জন্যে
‘তা আমাকে দিচ্ছ কেন বৌমা?’
‘আপনিই রাখুন। খরচপত্তর তো সব আপনিই করছেন–আমি আর আলাদা করে কী করব ও টাকায়?’
‘ও, সেদিন যে কথাটা বলেছিলুম, তাতে বুঝি মনে করলে তোমার মাকে আমি দুটি খেতে দিতেই কাতর, তাই খোরাকী ধরে দিলে চেয়েচিন্তে এনে?…. কালটাই এমনি বটে, ভাল কথা কাউকে বলতে নেই। বলে, যার জন্যে চুরি করি, সে-ই বলে চোর। আমি বলেছিলুম দিমার ভালর জন্যেই–এখানে পড়ে থেকে ঐ হোমোপাথীর গুলি খেয়ে কি আর উদুরী রোগ সারে?… তা যে যেমন বোঝ!
রাগ যথেষ্ট করল বটে কিন্তু টাকা-ক’টা শেষ পর্যন্ত ট্যাকেই পুরল কার্তিক।
।।৩।।
কিন্তু সেই হোমিওপাথী গুলির জোরেই হোক আর নিয়মিত সুপথ্য সেবনেই হোক– শেষ পর্যন্ত কতকটা সামলেই উঠল ঐন্দ্রিলা। নিজে নিজে কিছু না ধরেই উঠে হেঁটে বেড়াতে লাগল একটু, একটু রান্নাঘরে বসে এটা ওটা টুকটাক সাহায্যও করতে লাগল মেয়েকে। আরও কদিন পরে নিজে সেধে বড় নাকি গণেশের সংসারে এতটি বড়িও দিয়ে দিলে বসে বসে। এতাবৎ তার ‘পৈারের ভাত’ খাওয়ার পুরনো সরু, চাল এবং মানমণ্ড খাওয়ার কচু গণেশই সরবরাহ করেছে। সে কৃতজ্ঞতা তো ছিলই, অন্য একটা আশাও ছিল বোধ হয়।
কার্তিক সেই টাকা দেওয়ার ব্যাপারের পর থেকে আর মুখে কিছু বলে নি বটে কিন্তু তার, তার স্ত্রীর এমন কি তার ছেলে-মেয়েদেরও মুখভাব কি কথাবার্তা থেকে তাদের মনোভাব বুঝতে বাকি থাকত না সীতার। ঐন্দ্রিলার এখানে থাকটা যে একান্ত অবাঞ্ছিত– সে তথ্যটা ভাষা ছাড়া সর্বপ্রকারে ব্যক্ত হ’ত অহরহ। শুধু উপায় নেই বলেই–পিঠে কুলো ও কানে তুলো দেবার মতো ক’রে পড়ে থাকা। ঔদাসীন্য বা অজ্ঞাতার ভান করা ছাড়া উপায় ছিল না সীতারও। এখন মা একটু ভাল হ’তেই তাই সে মাকে চেপে ধরল, ‘এদের সংসারের তো খুব বেশি খাটুনি নেই, এদেরটা তুমি চালিয়ে নাও, আমাকে একটা কোথাও কাজকর্ম দেখে দাও। যা হোক দুটো পয়সা আসে বাইরে থেকে তবু।… বলতে নেই– খোকাও তো বড় হয়ে গেছে, মাকে ছেড়ে বেশ থাকতে পারবে।’
ঐন্দ্রিলা প্রথম দু-একদিন কথাটা উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল– বলেছিল, ‘দুটো দিন সবুর কর, আমিই চলে যাব কোথাও কাজ-কর্ম নিয়ে আবার।
কিন্তু তারপর, বোধ করি সে সম্ভাবনা সুদূরপরাহত বুঝেই–কী ভাবল, একদিন বড় নাতি গণেশকে একটু নিরিবিলি পেয়ে গিয়ে ধরল, ‘নাতি-ভাই, একটা কথা বলতে এলুম। খুবই জ্বালাতন করছি তোমাদের–কিন্তু আমারই বা আর কে আছে বলো তোমরা ছাড়া? যতদিন গায়ে জোর ছিল, গতর খাটাতে পেরেছি, ততদিন কাউকেই বিরক্ত করি নি। এখন নিতান্ত ভগবান মেরেছেন বলেই–’
বলতে বলতেই গলা বুজে এল, বাধ্য হয়েই থামতে হ’ল ওকে।
ততক্ষণে গণেশ শঙ্কিত হয়ে উঠেছে। আক্রমণটা কী ধরনের এবং কোন দিক দিয়ে আসবে শেষ পর্যন্ত বুঝতে না পেরেই আরও অস্বস্তি তার। কিন্তু ঐন্দ্রিলা বেশিক্ষণে উৎকণ্ঠায় রাখল না, একটু সামলে নিয়েই আবার শুরু করল, অনেক দিন তো মেজ নাতির ঘাড়ে চেপে খেলুম, আর ভাল দেখাচ্ছে না। এখন একটু তবু মানুষের মতো হয়েছি– এটা-ওটা কাজও করতে পারছি–তাই, তাই সীতি বলছিল যে তুমিই এদের সংসারটা একটু দ্যাখো, আমি বরং কোথাও বাইরে রান্নার কাজটাজ নিই।… আগে রাজি হই নি ভেবেছিলুম নিজেই যা পারি করব, ওকে আর এতটা মাথা হেঁট করতে দোব না, তাছাড়া এখনও ওর তো বিপদের বয়স যায় নি কিন্তু ভেবে-চিন্তে মনে হচ্ছে বাইরে কোথাও গিয়ে বড় সংসার সামলানো, সে আর আমার দ্বারা হয়ে উঠবে না। অথচ এধারেও, অন্য কোন পথও তো দেখছি না। তাই তোমাকে বলতে এলুম, কোথায় যাবে কার বাড়ি, কে কেমন লোক তা তো জানি না হাজার হোক তোমাদেরই বংশের বৌ–যদি তোমাদের জানাশুনো তেমন কোন বাড়ি থাকে ‘
কথাটা শেষ করতে দেয় না গণেশ, বলে ওঠে, ‘হ্যাঁ–তা আর নয়! স্যাই হোক আর যাই হোক, মা তো সম্পক্কে, আমি যাব তার জন্যে রাঁধুনীর-কাজ খুঁজতে! বেশ বুদ্ধি তো আপনার!’
তারপর একটু চুপ ক’রে থেকে অপেক্ষাকৃত শান্ত কণ্ঠে বলে, ‘কেন, কেতো কি কিছু বলেছে আপনাদের–!’
এতখানি জিভ কেটে ঐন্দ্রিলা তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, ‘না, না, ছিঃ ছিঃ! সে একটা কথাও বলে নি–কেন মিছে কথা বলব! তা নয়, কিন্তু আমার তো একটা বিবেচনা আছে ভাই। তার ওপর চাপটাও তো হচ্ছে খুব!’
এবার অনেকক্ষণ চুপ ক’রে থাকে গণেশ। তারপর বলে, ‘তা আমি, না হয় ভজা, বিশু, এরাও কিছু কিছু দিলুম। আপনাদের দুজনের মতো চাল-ডাল-কাপড়–এগুলো যদি আমরা ভার নিই, কেতোর ওপর খুব চাপ একটা পড়বে না!’
‘সে তো জানি ভাই। ভগবান তোমাকে রাজ্যেশ্বর করুন, বেটারা তোমার লক্ষপুষী হোক, ভাত এক মুঠো দিতে তুমি কাতর হবে না তা জানি। কিন্তু ধরো ভাতকাপড় ছাড়া আরও তো খরচ আছে। ছেলেটার লেখাপড়া আছে তো!’
এই অবধি বলে আবার চুপ ক’রে যায় ঐন্দ্রিলা। জিজ্ঞাসু উৎসুক চোখে চেয়ে থাকে গণেশের মুখের দিকে।
গণেশ কিন্তু তখনই কোন কথা বলে না। খানিক পরে শুধু বলে, ‘আচ্ছা ভেবে দেখি একটু। ওদের সঙ্গেও কথা বলি। তবে বৌমাকে ওসব যুক্তি করতে বারণ করুন, ওভাবে আমাদের মুখ ডোবানো চলবে না। আপনি করেন সে আলাদা কথা–কেউ অত খবর রাখে না–তাছাড়া বাবা রাঁধুনী বামনীর মেয়ে কিনে এনেছেন টাকা দিয়ে, তা জানেও অনেকে। কিন্তু বৌমার কথা আলাদা। মেয়ে যে ঘরেরই হোক, এখন আমাদের বাপের বৌ। আমাদের ইজ্জটাও তো ওঁর দেখা দরকার। ওসব করলে আর আমাদের সঙ্গে সম্পক্ক থাকবে না–বলে দেবেন!’
‘রাঁধুনী বামনীর মেয়ে’!…’মেয়ে যে ঘরেরই হোক’–!
কথাগুলো চাবুকের মতো এসে বাজে ঐন্দ্রিলার কানে। উত্তরও মুখের কাছে এসে ঠেলাঠেলি করে। এখনও, এই দুর্বল দেহেও, সে এর উপযুক্ত জবাব দিতে পারে। এমন উত্তর দিতে পারে যাতে এসব কথা আর মুখে না বেরোয় কোন দিন! কিন্তু তবু, প্রাণপণে উদ্যত রসনা সম্বরণই করে ঐন্দ্রিলা। গত ক বছরে সে অনেক শিখেছে। বিশেষ এই শেষ কটা বছরে। দরিদ্রকে নিঃস্বকে অনেক সহ্য করতে হয়! এই এখন শেষ এবং একমাত্র আশ্রয়, এটা নষ্ট করা চলবে না কিছুতেই। যতই ঝ্যাঁটালাথি মারুক–তিন তিনটে লোককে ভাত দিচ্ছে, কাপড় যোগাচ্ছে–মাথার ওপর একটা আচ্ছাদনও দিয়ে রেখেছে।
তবু, বহুক্ষণ পর্যন্ত কানের মধ্যেটা জ্বালা করতে থাকে যেন। মাধব ঘোষালের বিপুল সম্পত্তির কথা মনে পড়ে যায় অনেক দিন পরে। হরিনাথও তখনকার দিনে কম মাইনে পেত না। দুর্ভাগিনী সে–তার দৃষ্টি পড়েই সব ছারখার হয়ে গেল। মানুষ দুটোও গেল–আজ তারা বেঁচে থাকলে সে রাজরানী–আবার নিজের বুদ্ধির দোষে ন্যায্য পাওনাও হারিয়ে বসে রইল। এখনও তো সেই শত্তুররা ভোগ করছে, দেখে আসুক না–কী ছিল তার। ভোলার ভাগের গুলোও কিনে নিয়েছে শিবু, শিবু তো এখন রীতিমতো ধনী। ভোলা রেস খেলে শেষে মদ ধরে সব উড়িয়ে দিয়েছে তাই, নইলে সেও কিছু না ক’রে বসে খেতে পারত!
যাই বলুক আর যাই করুক– গণেশ কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটা সুব্যবস্থাই ক’রে দিল এইটেই আশা করেছিল ঐন্দ্রিলা, গণেশের কাছে গিয়ে সেদিন কথা পাড়ার কারণটাও এ- ই। সব ভাই মিলে বসে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বটে তবে প্রধান উদ্যোগী যে গণেশই, তাতে কোন সন্দেহ নেই। বাড়ির মধ্যে কথাবার্তা যা কিছু–এসব খবর চাপা থাকে না। গণেশের ছেলেরা পর্যন্ত আপত্তি করেছিল কিন্তু সে সব কোন কথায় কান দেয় নি সে। ভায়েদের বুঝিয়ে দিয়েছিল যে, যে রকম দিনকাল পড়ছে তাতে আজ হোক কাল হোক একটা রোজগারের চেষ্টা করতেই হবে সীতাদের। তাছাড়া এভাবে এখানেও চিরকাল রাঁধুনী বামনী করে রাখা ঠিক নয়। যতই হোক, তাদেরই বাবা, বাবা একটা অন্যায় কাজ করলেও মানিয়ে নিতে হয়। রাগের মাথায় তারা সম্পর্কটা উড়িয়ে দিয়েছে বটে কিন্তু কাজটা ভাল হয় নি খুব। ন্যায়তঃ ধর্মতঃ ওদের একটা ব্যবস্থা করতে তারা বাধ্য। এ নিয়ে পাড়ায় এখনও ঘোঁট হয় তা সে জানে। নিজের কানেই শুনেছে। তাদেরও তো বয়স হ’ল–এবার ভুলটা সংশোধন করাই ভাল।
খুব একটা হাতি-ঘোড়া কিছু নয়। খিড়কীর দিকে বাগানের উত্তর পুব কোণে কাঠা- তিনেক জমিতে একটা মাটির চালাঘর তুলে দেবে ওরা; সেই জমি আর এক বিঘে ধান- জমি– ওরা ক ভাই, নিজেদের ভাগ থেকেই হোক আর কিনেই হোক– লেখাপড়া ক’রে দেবে ওদের বৈমাত্র ভাই নিতাইয়ের নামে।
তবু এই খবরেই সীতার চোখে আনন্দে জল এসে গিয়েছিল; তুলসীতলায় গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে উপুড় হয়ে পড়ে থেকে ভগবানের কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল সে। এতদিন পরে কি দুঃখিনীর ওপর দয়া হ’ল তাঁর? ছোটই হোক আর মাটিরই হোক– নিজের ঘর যা-ই হোক, তার কাছে স্বর্গ। যত যৎসামান্যই হোক, একটু সম্পত্তিও সেটা নিতাইয়ের পৈতৃক সম্পত্তি।
কার্তিক খুঁতখুঁত্ করছিল খুবই, ‘এতও তো ওদের চলবে না, এসব নিয়ে থুয়েও যদি আমাদের নাম ডুবোতে বেরোয় বৌমা, তখন কী করবে? মাঝখান থেকে সম্মান যা যাবার তা তো যাবেই, সম্পত্তিটাও হাতছাড়া হয়ে যাবে।’
গণেশ মাথা নেড়ে বলেছিল, ‘না, তা যাবে না। খাওয়া-পরা তো চলছেই, তোর সংসারেই হোক আর আমার সংসারেই হোক– চলেও যাবে। নগদ টাকার যেটা দরকার সেটা ও থেকেই হবে খানিকটা। এর পরও বৌমা যে বাইরে কাজ নেবে তা মনে হয় না। সে প্রকৃতির মানুষ সে নয়। ঘর-বাড়ি জমির একটা টান আছে–ফেলে যাওয়াটা অত সহজ নয়।… আর সে যা-ই হোক, আমাদের কর্তব্য আমরা ক’রে গেলুম, তার ধর্মে যা হয় সে করবে। সামান্যই তো গেল–আমরা থাকতে থাকতে দিয়ে গেলুম সে-ই ভাল হ’ল। আমাদের গুণধররা কি দিতেন এর পর? কিন্তু ধর্মের চোখে দায়িত্বটা আমাদেরই থেকে যেত বরাবর।’
আরও একটা ভাল প্রস্তাব দিল গণেশ। ঐন্দ্রিলাকে ডেকে বলল, ‘দিদিমা, একটা কথা ভাবছিলুম। নিতাইয়ের যা পড়াশুনোর অবস্থা, ও যে কোন দিন পাস্টাস ক’রে কেষ্ট বিষ্টু হবে তা মনে হয় না। তার চেয়ে আমি বলি কি, এক কাজ করা যাক– আমাদের নীলু স্যাকরার ঘরে ওকে সাকরেদ ক’রে দিই, সোনা-রূপোর কাজ শিখুক। দুটো তিনটে বছর লেগে-পড়ে থেকে যদি কাজটা শিখে নিতে পারে তো ওর পয়সা খায় কে তখন!’
প্রথমটা শিউরে উঠেছিল ঐন্দ্রিলা, ‘বামুনের ছেলে স্যাকরার কাজ শিখবে?’
‘দেখুন গে যান বামুনের ছেলে জুতোর দোকান খুলে সত্তিক জাতের পায়ে হাত দিয়ে জুতো পরাচ্ছে!’ প্রায় খিঁচিয়ে উঠেছিল গণেশ, স্যাকরার কাজে দোষ কি? আমারই তো মামাতো ভায়রা তার ছেলেকে দিয়েছিল বৌবাজারের মিনেওলার কাছে কাজ শিখতে। এখন সে শুধু মিনের কাজ করেই ডাইনে বাঁয়ে দুহাতে রোজগার করছে। সোনা চেঁচে যা গুঁড়ো বেরোয়, তা যাদের কাজ তাদের বুঝিয়ে দিয়েও যেটুকু থাকে–নষ্ট বলে বুঝিয়ে দেয় স্যাকরাদের–তাইতেই বৌ মেয়ে বোনকে সোনায় মুড়ে দিয়েছে একেবারে, কলকাতায় সীতারাম ঘোষ স্ট্রীটে একটা বেনেটোলায় একটা দু’খানা বাড়ি কিনেছে আর বয়সই বা কি, ধরো চল্লিশও পেরোয় নি বোধ হয়।…. স্যাকরার কাজে পয়সা কম!– য্যামনে দিয়ে যাও পয়সা। যেতেও কাটে আসতেও কাটে। একই সোনা যতবার আসবে যাবে–বানির কথা ছেড়েই দাও, পানমরা খাদময়লা বাবদই এতটি ঘরে উঠবে। পুরনো সোনা কেনো গালাও–সেই সোনাতেই আবার গয়না গড়াও–পুরো গিনি সোনার দাম দিয়ে যাবে খদ্দের হাসিমুখে। অমন লাভের ব্যবসা আর আছে! আমাদের নীলুই কেন ধরুন না– ছেঁড়া কাপড়ে গেরো দিয়ে পরত, সেলাই করার ছুঁচ জুটত না। সে এখন তিনশো বিঘে জমির মালিক। ঐ অতবড় বাড়ি ফেঁদেছে বাজারের মোড়ে। তবু তো এই অজ পাড়াগাঁয়ে পড়ে আছে–শহর বাজারে থাকলে আজ ও বহু-লক্ষপতি!’
দীর্ঘ বক্তৃতা দেয় গণেশ, ঐন্দ্রিলাও অভিভূতের মতো শুনে যায়। গণেশ আবার বলে, ‘লেখাপড়া কি ওর হবে মনে করেন? এতখনি বয়স হয়ে গেল–এখনও হাই ইস্কুলে যেতে পারল না। কবে পাস করবে–করে আপনার দুঃখু ঘোচাবে! আর পাস করলেই যে চাকরি পাবে তার কোন ঠিক আছে? যুদ্ধের বাজারে তবু কাজকর্ম মিলছিল–এবার তো লড়াই থেমেছে–ছাঁটাইয়ের পালা শুরু হবে এবার। প্রথম লড়াইয়ের পর যা হয়েছিল, খুব মনে আছে আমার। একেবারে হাহাক্কার পড়ে গিয়েছিল। মার্কিন মুলুকে হাজারে হাজারে ছোকরা আপ্তঘাতী হয়েছিল কাজকর্ম যোগাড় করতে না পেরে!
যুক্তি অকাট্য। ক্রমশ ঐন্দ্রিলাও বোঝে। বলে, ‘তা দ্যাখো তোমরা ভাই–যা ভাল বোঝো।’…
সীতাকে বলতে সে তো রীতিমতো ব্যস্ত হয়ে উঠল। আরও পাঁচ ছ বছর কি আট বছর পরে ছেলে হয়ত পাস করবে কিম্বা তাও করবে না। সেই সুদূর এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে বসে থাকার আর ধৈর্য নেই তার। তার চেয়ে, দু বছর পরে যদি পাঁচটা টাকাও রোজগার করে আনতে পারে তো সে-ই তার ভাল। তবু ছেলের রোজগার, জোরের সঙ্গে সম্মানের সঙ্গে থাকতে পারবে সমাজে মাথা উঁচু করে। ভিক্ষার অন্ন খেয়ে তার অরুচি হয়ে গেছে। আর সে পারেও না, পরিশ্রমেরও শেষ সীমায় এসে পড়েছে এবার, শরীর আর বইতে চাইছে না।
আরও কদিন পরে–মনের মধ্যে সমস্ত উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনাগুলো তোলাপাড়া করে ঐন্দ্রিলারও ভাল লাগল কথাটা। মনে হ’ল বুঝি ঈশ্বরই এবার মুখ তুলে চেয়েছেন, নইলে ঐ গোঁয়ারগোবিন্দ ছোটলোকগুলোরই বা এমন সুবুদ্ধি হবে কেন। মাথাগোঁজার মতো নিজস্ব একটা ঘর, যা হয় একটু জমি, আবার ছেলের রোজগার,–এ তো সীতার ভাগ্যে মণি-কাঞ্চন যোগেরই মতো। এটুকু পেলেই সে খুশি, মনে করবে সৌভাগ্যের স্বর্গদ্বার খুলে গেছে তার সামনে।….
পুজো-সিন্নি দিয়ে যেদিন প্রথম নিজের ঘরে এসে উঠল সীতা সেদিন ঐন্দ্রিলা তাকে বলেছিল, ‘যাক্ বাবা–এবার আমি নিশ্চিন্তি, আমার এবার ছুটি। এখন যত তাড়াতাড়ি চোখ বুঝতে পারি ততই তোর মঙ্গল, একটা দায় নেবে যায় তোর মাথার ওপর থেকে আমার এই একটা পেট কমলে চাই কি ভরসা ক’রে ব্যাটার বে দিয়ে বৌ আনতে পারবি ঘরে। একনাগাড়ে তো খেটে গেলি জীবনভোর–বৌ আনলে তবু সুসার হবে খানিকটা, শিখিয়ে-পড়িয়ে নিলে বসে খেতে পারবি তার মাথায় সব চাপিয়ে দিয়ে।’
‘তবেই হয়েছে।’ হেসে জবাব দিয়েছিল সীতা, বহুদিন পরে তার মুখে হাসি ফুটেছিল সেদিন, ‘বসে খাবারই আমার বরাত দেখছ না! বরং তুমি বেঁচে থাকো–তবু একটু আহা- উঁহু করবার লোক থাকবে, আমার জন্যে ভাববার, আমার হয়ে টেনে কথা বলার থাকবে।… বসে খাবার সময় যদি সত্যিসত্যিই আমার আসে কোন দিন তো দেখো– সেইদিনই আমি পটল তুলব।’
কথাটা হাসতে হাসতেই বলেছিল সীতা। কে জানে সে সময় তার বিধাতাপুরুষ সেখানে উপস্থিত ছিলেন কিনা, একটু হেসেছিলেন কিনা! …
.
মুখে যাই বলুক, এ ঘরে এসে সীতার শুধু আনন্দ নয়, আশাও জেগেছিল একটু। ঘরটা যেন নানাদিক দিয়েই পয় ফলাচ্ছে মনে হয়; এবার হয়ত সত্যিই তার নিরন্ধ্র দুঃখের দিন কাটতে শুরু হ’ল। সব জিনিসেরই আয়-পয় আছে–এ তো নিজের বাস্তু জমি, ভিটে। ঘর করা নাকি অনেকের সয় না–মা বসুমতাঁকে আঘাত দিয়ে ভিদ গাড়া। অবশ্য এ মাটির ঘর, ভিদ গাড়ার কোন প্রশ্নই ওঠে নি–তবু ভয় একটু ছিল বৈকি মনে মনে। বিশেষ তার যা বরাত। কিন্তু এ ঘরে এসে ওঠবার পর অনেকগুলো সুবিধে হয়ে গেল।
নিতাই নিলুর ওখানে সাকরেদ হয়ে ঢুকেছে দু তিন মাস আগেই, গণেশ যখন কথাটা পেড়েছিল প্রায় তখনই। কিছু দেবার কথা নয়–খানিকটা অন্তত কাজ না শিখলে। এরাও তা আশা করে নি। দয়া ক’রে কাজ শেখাচ্ছে এই ঢের। আর সত্যিই, ওকে দিয়ে তার তেমন কোন উপকার হচ্ছে না এখন। কিন্তু হঠাৎ, এখানে আসার মাসখানেক পরেই, তার দু-টাকা ক’রে মাসে জলপানি বরাদ্দ ক’রে দিলে নীলু, নিজে থেকেই। বললে, ‘বামুনের ছেলে, সেই কোন সকালে দুটি ভাত খেয়ে আসে–সারাদিন পড়ে থাকে এখানে–কিছু না দিলে অধর্ম হবে যে!
কথাটা শুনে প্রথমে বিশ্বাসই হয়নি সীতার। ছেলের রোজগারে টাকা হাতে করবে সে! এক টাকাই হোক, দুটাকাই হোক–ভিক্ষার দান নয়, দয়ার দান নয়–দাসীবৃত্তিরও পুরস্কার নয়। ছেলের দশ আঙুলে খাটা কড়ি। আজন্ম যা দেখে আসছে–দয়া আর অবহেলা–এ তা নয়, তা থেকে কিছু স্বতন্ত্র। দুটাকা ভবিষ্যতের বহু টাকার অঙ্কুর। নূতন স্বর্ণালোকিত জীবনপথের দ্বার-উন্মোচন। খবরটা শুনে মনে হয়েছিল একবার অতর্কিতেই–এত সুখ তার কপালে সহ্য হবে না হয়ত!
এর মধ্যে আর একটু সুবিধা হয়ে গেল ওর। ক্রীতদাসীত্ব থেকে আপনিই মুক্ত হয়ে গেল–পুরোপুরি না হ’লেও আংশিক। ওর যখন ঘর উঠেছে তখনই কার্তিকের বড় ছেলের বিয়ে হয়। সে বৌ দেখতে খুব ভাল নয়, বয়সও ঢের–কিন্তু কাজের মেয়ে, শাশুড়ীর ঠিক উল্েেটা। ওদের আপনা-আপনির মধ্যেই, ঘরবর কতক জানাশুনোই, এখানে এর আগে একবার থেকে গেছে সে দুতিন দিন–কনে বৌ বলতে যা বোঝায় তা নয়। এবার এসেই সে রান্নাঘরে ঢুকল, হাঁড়ি-হেঁসেলের প্রধান ভারটা তুলে নিল। সুতরাং নিয়মিত দুবেলা রান্নার দায়িত্ব আর তার রইল না। অনেকখানি স্বাধীনতা পেল। খাটে ঠিকই–কিন্তু এক জায়গায় বাঁধা মাইনের ঝি কি রাঁধুনীর মতো নয়, আশ্রিত গলগ্রহের মতো নয়, এ খাটুনিতে সম্মান আছে কিছু। এখন সে সব সংসারেরই কিছু কিছু কাজ ক’রে দেয়। তাতে হয়ত আগের চেয়ে খাটুনি কিছু বেশিই হয়–তবু তার ভাল লাগে। এর ফলে সকলেই কিছু কিছু সাহায্য করে, কেউ চাল কেউ তেল কেউ কাপড়। কোন কোন দিন খেতেও বলে কেউ কেউ। বললে ওদের তিন পুরুষকেই বলে। আজকাল ঐন্দ্রিলাও ঘুরে ঘুরে এদের সংসারে অনেক কাজ ক’রে দেয়–আরও হয়ত দিতে পারে, সীতাই বেশি যেতে দিতে চায় না ওধারে। মার রসনা ও মেজাজ অনেকটা সংযত হয়েছে ঠিকই–কিন্তু স্বভাব এত সহজে যায় না, তা সীতা জানে। দুঃখের জীবনে তার বহু অভিজ্ঞতা লাভ হয়েছে, অনেক অল্প- বয়সেই। মানুষের মন বুঝতে শিখেছে সে অনেকের চেয়েই বেশি
আরও একটা সুযোগ ঘটে গেল তার অকস্মাৎ। মধ্যে মধ্যে সামান্য কিছু ক’রে নগদ উপার্জনের উপায় হয়ে গেল। এ অসম্মানের কিছু নয়। কোথাও নিচু হ’তে হবে না এর জন্যে। বরং সবদিক দিয়ে ভেবে দেখলে বেশ সম্মানেরই কাজ। কাজটা এলও সেধে, আপনা থেকেই। এখানকারই একটি মেয়ে, বনলতা নাম–কলকাতায় মামার বাড়িতে ছিল দীর্ঘকাল, নাকি তিনটে পাসও করেছে–কিছুদিন হ’ল দেশে এসে বসবাস করছে। বিয়ে-থা হয় নি কিন্তু সেজন্যে কুণ্ঠিতও নয়, দুঃখিতও নয়। সে-ই এসে বাড়ি বাড়ি আলাপ ক’রে গেছে, নইলে হয়ত কোনদিন তার সঙ্গে কথা বলবারও সাহস হ’ত না সীতার। জামাজুতো পরা লেখাপড়া জানা হালফ্যাশানের মেয়ে–তাদের সঙ্গে মিশবে এ তাদের ধারণাতেই আসে না।
বনলতা শুধু মিশলই না, বেশ ভাবও জমিয়ে নিল সীতার সঙ্গে। ’মামী’ ‘মামী’ করত, গ্রাম সম্পর্কে–মামীর মতোই মান্য করত, অন্তত বাহ্যিক ব্যবহারে। তার মতো সামান্য অবস্থার গরিব দুঃখী লোককে ঘেন্না করে না, ঘরে বসে গল্প ক’রে যায়–এতে সীতা তার কাছে কৃতজ্ঞও ছিল মনে মনে। বনলতাই কথাটা তুলল একদিন। মামী একটা কাজ করতে পরবে? তা’হলে কিছু নগদ পয়সা হাতে আসে খুব সহজে। কাজ অবশ্য কিছুই না–কী একটা রাজনৈতিক দল (এসব শব্দও সীতার অপরিচিত), কী যেন পার্টি না কি যেন বলে তাকে–তারা একটা মিছিল বার করবে; মিছিলটা বড় না হ’লে কারুর চোখে পড়ে না, অথচ তাদের দলে অত লোক নেই, সেই জন্যে তারা ঠিক করেছে বাইরে থেকে যদি কেউ তাদের মিছিলে যোগ দেয় তো যারা বেরোবে তাদের প্রত্যেককে দশ আনা পয়সা, গাড়িভাড়া আর একবেলার খাওয়া দেবে। মামী যাবে?
কথাটা বুঝতেই খানিক সময় লাগল সীতার। সে ভেবে পায় না যে তার কাজটা ঠিক কী। এত পয়সা কি কেউ অমনি দেয়? সে জিজ্ঞাসা করে, ‘তা সেখানে গিয়ে কী করতে হবে আমাকে?’
‘কিছুই করতে হবে না। ওমা, এ কি কারখানার চাকরি নাকি যে কিছু একটা করতে হবে! শুধু হেঁটে যাবেন তাদের সঙ্গে সঙ্গে–এই পর্যন্ত। মাঝে মাঝে তারা যখন একটা ধূয়ো ধরিয়ে দেবে–সকলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে সেই কথাটা বলবেন। তাও, যদি আপনার কষ্ট বোধ হয় তো চুপ ক’রে থাকবেন– শুধু গেলেই হবে।
দশ আনা পয়সা–গাড়িভাড়া, আবার খাওয়া। প্রলোভন বড়ই বেশি। খানিকটা ইতস্তত ক’রে কতকটা বিমূঢ়-ভাবেই যেন প্রশ্ন করল সীতা, ‘তা তাতে নিন্দে হবে না পাড়া-ঘরে? লোকে যদি কিছু মন্দ বলে–?’
‘মন্দ বলবে কেন! এ তো দেশের কাজ। আজকাল মেয়ে-পুরুষ মিলেই তো দেশের কাজ করে সব জায়গায়।… সরকার মানে গবর্মেন্ট অন্যায় কাজ করছে, সরকার চোর মিথ্যেবাদী পুঁজিবাদীদের দালাল–তাদের নিন্দে করতে, তাদের কাজের প্রতিবাদ করতেই আমরা বেরোই। এর মধ্যে খারাপ তো কিছু নেই। এ তো গৌরবের কাজ। কত বড় বড় নেতারা বেরোয় এই সব মিছিলে জানেন? কত মান্যগণ্য লোক–সরকারও তাদের সমীহ করে চলেন। তাদের পায়ের ধুলো নেবার জন্যে পথে কাড়াকাড়ি পড়ে যায় ছেলেদের মধ্যে। আর আমরাও তো আছি, আমাদের যদি নিন্দে না হয়, আপনার হবে কেন?…. দেখবেন কত তাবড় তাবড় বাড়ির মেয়েরা, যাদের সামনে দাঁড়াতেও আপনারা ভয় পান– তারা বেরিয়ে পড়েছে।…আর এখানেও তো নয়, বাসে ক’রে শহর-বাজারে যাবেন, সেখান থেকে হেঁটে যেতে হবে খানিকটা। সে ঢের দূর, এখানকার কেউ টেরই পাবে না হয়ত।’
নানাযুক্তিতে সে অভিভূত করে সীতাকে। শেষ পর্যন্ত কথা নিয়ে তবে ওঠে। এবং সেই কথা নেওয়ার অজুহাতেই পরের দিন যথাসময়ে এসে ওদের ঘরে হাজির হয় বনলতা। এক রকম জোর ক’রেই ধরে নিয়ে যায়। কালকের অর্ধসম্মতির আজ আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না সীতার মনে–এখন তো রীতিমতো ভয়ই করছে–তবু চক্ষুলজ্জাতে পড়েই যেতে হয়। সামান্য অনিচ্ছা প্রকাশ করতেই বনলতা যা কট্ট্ ক’রে কথা শুনিয়ে দিলে, তারপর আর ‘না’ বলবারসাহস হয় না।
অবশ্য কাজটা এমন কিছু নয়–সত্যিই। যেটুকু হাঁটতে হ’ল–সেটুকু সীতার কাছে কোন পরিশ্রমই নয়। এর চেয়ে ঢের কঠিন পরিশ্রমে সে অভ্যস্ত। ওদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে চেঁচাতেই যা একটু লজ্জা হয়েছিল প্রথম দিকটায় (বনলতা বলে ‘আওয়াজ তোলা’), কিন্তু ক্রমে তাও সয়ে গেল। সকলের সঙ্গে বলায় খুব একটা চেঁচাতেও হয় না। অবশ্য গাড়িভাড়া যে সকলের দিল ওরা তা মনে হ’ল না। হুড় হুড় ক’রে লোক সব উঠে পড়ল বাস্-এ, কে কার টিকিট নেয় আর কী করে। পাঁচ-ছ জনেরও টিকিট কেটেছে কিনা সন্দেহ–কন্ডাক্টরকে ভয় দেখাচ্ছিল–এসব জনতার ব্যাপার, বেশি গোলমাল করলে ভাল হবে না। সে মরুক গে, দিলেও ওর আঁচলে তো উঠত না;–যেটা নিয়ে তার মাথাব্যথা, সে দশ আনা পয়সাটা সে পেয়েছিল ঠিক ঠিক। অবশ্য সবাই নাকি পায় নি সেজন্যে কিছু কিছু অসন্তোষের গুঞ্জনও কানে এসেছিল–কিন্তু সেটা ঠিক কি দাঁড়াল শেষ পর্যন্ত তা সীতা জানে না। তার পয়সাটা বনলতা নিজে এনে তার হাতে দিয়েছিল। এটেই লাভ। নিখরচায় দশ আনা পয়সা পাওয়া। খাবারও দিয়েছিল, তবে সে খাবার খেতে পারে নি সীতা। রাস্তায় বসে শালপাতা পেতে রুটি আর ড ল খাওয়া তার দ্বারা হয়ে ওঠে নি। সে রুটিও এক একটা এক রকমের। নানান বাড়ি থেকে এসেছে নাকি, ক্ষমতা বুঝে কোন্ বাড়ি কখানা দেবে তার বরাত দেওয়া হয়েছিল। কেউ চল্লিশ কেউ পঞ্চাশখানা রুটি ক’রে দিয়েছে। ডালটা কেবল বান কেটে কাঠের জ্বালে এখানেই সেদ্ধ করা হয়েছে এক কড়া। সেদ্ধই–তাতে কেবল হলুদ গুঁড়ো আর একটু নুন পড়ল। সীতা দাঁড়িয়ে দঁড়িয়ে দেখল সে ডাল রান্নার ছিরি। না তেল না ঘি–না কোন সম্বরা। অবশ্য ভাল ক’রে রান্না হলেও সীতা খেতে পারত না। প্রবৃত্তি হ’ত না তার। বিধবার সংস্কারে বাধত। বনলতাও খুব একটা পীড়াপীড়ি করল না। শুধু মামী মুখে একটু জল পর্যন্ত দিলে না বলে আপসোস করতে লাগল।…
ফিরতেও বেশ রাত হ’ল সীতার। ক্লান্ত ক্ষুধার্ত অবস্থায় যখন বাড়ি এসে পৌঁছল তখন তার সেই অবসন্ন দৃষ্টি ও একান্ত শুষ্ক মুখের দিকে চেয়ে ঐন্দ্রিলা আগুন হয়ে উঠল একেবারে। ঝাঁ ঝাঁ করে বকলও খুব কানিক।
‘বলি তোর আক্কেলটা কি? কিসের জন্যে এমন খুন হ’তে গিয়েছিলি তাই শুনি? ভেবে মরছি আমি, চোদ্দবার ঘর বার করে করে আমার পায়ের দড়ি ছিঁড়ে গেল।.. সেই কোন্ সকাল নটা দশটায় বেরিয়েছে–ফিরল এই রাত এগারোটায়। ছেলেটা সুদ্ধ ভেবে অস্থির।… ভারী ঐ ক আনা পয়সার জন্যে প্রাণটা খোয়াবি নাকি?… কী ছিরি হয়েছে মুখচোখের, একবার কোন ঘরে গিয়ে আয়নায় দ্যাখ দিকি। মুখে যেন কে সাত বুরুল কালি মেড়ে দিয়েছ!….এরা বার বার জিজ্ঞোসা করে–কোথা গেল কোথা গেল, বড় নাতবৌয়ের পিঠের ব্যথা বেড়েছে, ওরা খোঁজ করছিল যদি ডাল ভাতটা ক’রে দিতে পারিস–তা কী যে বলি তারই ঠিক নেই। নিজেই গিয়ে যতটা পারি রান্না তুলে দিলুম, বললুম বনলতার সঙ্গে কোথায় গেছে, সেই ধরে নিয়ে গেছে কি কাজের জন্যে। কার্তিক বললে, ও মেয়েটা নাকি ভাল নয়, নানারকম ভুচুং দিয়ে মেয়েদের টেনে নিয়ে যায় বাজে কাজে। …আর কখনও ওর সঙ্গে যাবি নি বলে দিলুম। এবার এলে সোজা বলে দিবি– ভদ্রলোক গেরস্তঘরের মেয়ে আমি–ওসব আমার দ্বারা হবে না। দশ আনা পয়সার জন্যে কি যমের বাড়ি যেতে হবে নাকি?’
সেদিন এবং তার পরেও কদিন পর্যন্ত সীতারও সেই রকম মনোভাব ছিল। আর ওসবের মধ্যে যাবে না সে। ভাল লাগে না ওর– নিজেকে একেবারে বেমানান মনে হয়। ওসব তার মতো মুখ্যু পড়াগেঁয়ে মেয়ের জন্যে নয়। এসব কাজ কিছু বোঝেও না সে ভাল কি মন্দ–তাইতেই আরও অস্বস্তি বোধ করছে। আর দরকারই বা কি, এই ধরনের আটো ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ার!… রাস্তার ধারের বাড়িগুলো থেকে ভদ্রলোকরা যেভাবে চাইছিল তাদের দিকে, লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল সীতার।
কিন্তু দিনকতক পরে আবারও একদিন টেনে নিয়ে গেল বনলতা। এবার বরাদ্দ বারো আনা। মিছিল বেরোবে কলকাতায়, ট্রেনে ও বাসে যেতে হবে। তা হোক বনলতা নিজে এসে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যাবে রাত্রিবেলা, কোন ভাবনা নেই। আর খুব যদি লজ্জা করে তো মামী যেন মাথায় ঘোমটা দিয়ে থাকে। …..ঐন্দ্রিলাকেও নানা যুক্তিতে কাবু করল। পয়সারও খুব দরকার, সেইটেই বড় যুক্তি। জিনিসপত্র চেয়ে নেওয়া চলে, হাত পেতে নগদ পয়সা নেওয়া বড় লজ্জার। মধ্যে অনেক দুঃখ ক’রে বৌদিকে চিঠি লিখেছিল ঐন্দ্রিলা, কনক তার উত্তরে দুটি টাকা মনি আর্ডার ক’রে পাঠিয়েছে। লিখেছে যে ওর দাদা যে বৌয়ের হাতে কখনও হাত তুলে এক পয়সা দেয় না তা তো জানেই ও, মিছিমিছি তাকে বিব্রত করে কেন? হেমকে বলে বিস্তর কান্নাকাটি ক’রে এইটুকুর ব্যবস্থা করেছে সে, আর কিছু করতে পারল না। হেমেরও খুব টানাটানি চলছে। জিনিসের দাম বেড়েছে চারগুণ — মাইনে বাড়ে নি। সস্তায় রেশনটা পাচ্ছে–সেই তবু রক্ষে। ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে, খরচ কি কম। ফ্রিতে পড়ে, তবু বইখাতার খরচই কত। চাকরিও হেমের বেশি দিন নয় আর, এর পর যে কী করবে সেই ভেবে এখন থেকে ঘুম হয় না। এখন সন্ধ্যেয় ফিরে একটা দোকানে খাতা লিখে–পনেরো টাকা পায় হেম, সেই ভদ্রলোকই বলেছে চাকরি গেলে সে পুরো দিনের জন্যেই রাখবে, কিন্তু সে আর কতই বা মাইনে দেবে। ইত্যাদি–
এর পর বনলতার সঙ্গে যেতে বারণ করাও কঠিন বৈকি!
আরও দু-একদিন এই ভাবে বেরোতে হ’ল সীতাকে। কথাটা চাপাও রইল না বাড়িতে। কার্তিক বাঁকা হাসি হেসে গণেশকে বলল, ‘কালে কালে হ’ল কি! স্বাধীন ভারতে সবাই দেখছি ডবল প্রমোশন পেয়ে গেল। অমন বৌমা যে বৌমা, সাত চড়ে রা বেরোত না যার, সেও লীডার হয়ে গেল!’
কথাটা সীতার কানেও উঠল। ওঠবার মতো ক’রেই বলেছিল কার্তিক। লজ্জাও হ’ল একটু। তবু আরও খারাপ ভাবে যে নেয় নি এই ভাল। একেবারে সোজাসুজি বারণও করে নি। ভগবান বাঁচিয়ে দিয়েছেন বলতে হবে।….
এরই মধ্যে একদিন–দিনটা খুব মনে থাকবে ঐন্দ্রিলার, জীবনের শেষ দিন পর্যন্তও– সকাল থেকেই মন খারাপ ক’রে বসে ছিল সীতা গুম খেয়ে। মন খারাপের কারণ, হরির নোট দেবে বলে অনেক কাণ্ড ক’রেও পাঁচটা পয়সা যোগাড় করতে পারে নি। অবশ্য হাতে পয়সা ছিল না বলে যে পাঁচ পয়সার বাতাসা আসত না তা নয়, ছেলেকে পাঠিয়ে পাঁচুর দোকান থেকে আনানো যেত অনায়াসেই–অমন দু এক পয়সার জিনিস আনিয়েছেও সে বহুবার কিন্তু হরির নোট দেবে বলেই ধার করতে মন সরে নি। দেবতার পূজা ধার ক’রে দিতে নেই–তার স্বামী প্রায়ই বলতেন। অথচ ঘরদোর সব কুঁজেও তিনটের বেশি পয়সা বেরোয় নি। জমি পেয়েছে কিন্তু তার ধান তখনও ওঠার সময় হয় নি। সেই বা আর কত, এক বিঘেতে বড় জোর দশ মণ ধান হবে, ভাগের পর, অর্ধেক পাঁচ মণ পাবে সে। কিন্তু সে এখন সুদূরপরাহত। এখন এই অবস্থাটই প্রত্যক্ষ–দুটো ফুটো পয়সার জন্যে তার হরির নোট দেওয়া বন্ধ রইল। বৌদের কারও কাছে চাইলে পেত সে, দুটো চারটে কেন– চার আনা পয়সাও পেতে পারত। কিন্তু ঐ একই কারণে চাইল না। এ হরির নোটের উপলক্ষটা এমনই যে ভিক্ষে ক’রে বা ধার ক’রে দিতে মন উঠল না তার। বরং দুদিন পরেই দেবে, ছেলের জলপানির টাকাটা হাতে পেলেই–তবু এ হরির নোট ভিক্ষে ক’রে দেবে না সে কিছুতেই।
উপলক্ষটা সৌভাগ্যসূচকই–অকল্পিত অভাবনীয় সৌভাগ্য। কাল সন্ধ্যায় খবরটা দিয়েছে নিতাই। এ মাস থেকে তার জলপানি পাঁচ টাকা বরাদ্দ করে দিয়েছেন নীলু-কাকা। এই সামনের মাসেই সেই হারে পাবে সে। দু’ টাকা নয়–পুরো পাঁচটা টাকা। খবরটা নিয়ে প্রায় নাচতে-নাচতে এসেছিল নিতাই–খুশিতে ডিগবাজি খেতে খেতে। তার নম্র স্বভাবে, বাধ্য বিনত ব্যবহারে এবং কাজ শেখবার আগ্রহেই খুশি হয়েছে নীলু, সে কথা সে গণেশের কাছে বলেওছে এর মধ্যে একদিন। তাতে গণেশই শুনিয়ে দিয়েছিল নীলুকে, ‘কিছু তো কাজ হচ্ছেই ওকে দিয়ে, তা একটা চাকর রাখতে হ’লেও ধরো তোমার গে ওর চেয়ে বেশি খরচ হ’ত–আর এ তো ঘর ঝাঁট দেওয়া থেকে তোমার হুঁকোর জল পাল্টানো পর্যন্ত সবই করছে শুনতে পাই। দাও না কিছু বাড়িয়ে, বিধবাটার একটু সুসার হয়।’
এ বেতনবৃদ্ধি নিশ্চয় সেই কথারই ফল। তবু দু টাকা থেকে একেবারে পাঁচ টাকা হবে, আশা করে নি সীতা। এত তাড়াতাড়ি সুপারিশটা কাজে লাগবে তাও ভাবে নি। সব দিক দিয়েই অপ্রত্যাশিত সুখবর। সত্যিই বুঝি পাথরচাপা কপালের প্রণাম জানিয়েছিল মনে মনে–এ ঘরে উঠে আসারই ফল এটা, নতুন ঘর নতুন সৌভাগ্যরই সূচনা করেছে।
ধন্যবাদ দিয়েছিল ভগবানকে, যে ভগবানকে ধন্যবাদ দেবার কারণ এতাবৎ তার ঘটে নি কোনদিনই, নিতান্ত দেওয়া স্বভাব বলেই দিয়েছিল। বাস্তু দেবতাকেও প্রণাম জানিয়েছিল মনে মনে–এ ঘরে উঠে আসারই ফল এটা, নতুন ঘর নতুন সৌভাগ্যরই সূচনা করেছে।
সেই সময়েই সঙ্কল্প করেছিল সকালে উঠে পাঁচ পয়সার হরির নোট দেবে।
আজ না দিলে ক্ষতি নেই অবশ্য, বর্ধিত বেতনের টাকাটা থেকেই দেওয়া উচিত বরং–তবু মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল সীতার। কেন এমন হ’ল কে জানে, এমন তো বাধা পড়ে না কখনও। অনেকক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল। ভাত চড়াল না, রান্নার কোন যোগাড়ই করল না। শেষে ঐন্দ্রিলাই তাড়া দিল একসময়, ‘আ মর, থুম হয়ে বসে রইলি হাত পা গুটিয়ে, ছেলেটা খেয়ে যাবে কি? একে তো এই ভাত খেয়ে যায় বাড়ি থেকে, আবার সেই রাত্রে বাড়ি এসে ভাত খায়–এই এত বড় বেলা দাঁতে কুটো কাটে না একটা। তাও যদি দুটো পেটে না পড়ে তো ছেলেটা মরে যাবে যে।… ওঠ, ভাত চাপা।… আর এবার তো যা হয় ভগবান একটু মুখ তুলে চাইলেন–এবার থেকে ওকে একটা ক’রে পয়সা দিয়ে দিস রোজ–মুড়ি কিনে খাবে। এমনভাবে পিত্তি পড়া ঠিক নয়–বিশেষ ওদের কাঁচা বয়স।… শরীর ভেঙ্গে যাবে একেবারে।’
মার ধমকে সচেতন হয়ে উঠেছিল সীতা। সত্যিই তো, যে ছেলের জন্যে হরির নোট, সে-ই শেষে উপবাসী থাকবে নাকি সারাদিন? এত মন খারাপ করারই বা কি আছে। ভগবান কি আর তার অসহায় অবস্থা বুঝতে পারছেন না? সীতাও যেন নিজেকে ধমক দিয়েই সক্রিয় ক’রে তুলেছিল।
তারপর অবশ্য সবই যথানিয়মে চলেছিল। নিতাই ঠিক সময়েই খেয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। রান্নাতে বেশি দেরি হওয়ার কোন কারণ নেই, ডাল ভাতে আর ডুমুরের তরকারি–এই তো রান্না। কাঠের জ্বালে কতটুকুই বা সময় লাগে।
নিতাই খেয়ে বেরিয়ে গেলে সীতা এটা ওটা খুচরো কাজ সারছিল তার। স্নান ক’রে এসে ওদের সংসারে যাবে–কারও কোন কাজ আছে কিনা খবর নিতে। গণেশের শাশুড়ী এসে আছেন, ওখানে নিরামিষ হেঁশেলে রান্না বেশি। হয়ত সীতার জন্যে অপেক্ষাই ক’রে আছে গণেশের স্ত্রী। কিন্তু রেঁধে দিয়ে এলে লাভ বই লোকসান নেই, দুটো একটা তরকারী নিয়েও আসতে পারবে নিতাইয়ের জন্যে। ঐন্দ্রিলা স্নান সেরে পুজোয় বসেছে, সেও যাবে একটু পরে ওদিকে–ছোট গিন্নীর ডাল ভিজানো আছে, বড়ি দিয়ে দিতে হবে। ওদের এটা খাওয়ার সময় নয়। একবার খাওয়া–যত বেলা গেলে খায় ততই ভাল।
সীতা ঘর-বারান্দা নিকিয়ে স্নান করতে যাবে, এমন সময় ঝড়ের মতো বনলতা এসে হাজির। আজ একটা বিরাট ব্যাপার ক’রে তুলছে তারা, অনেক লোকের দরকার। আজ গেলে পুরো একটা টাকাই পাওয়া যাবে খরচ ছাড়া; তবে সময় মোটে নেই, কারণ যেতে হবে সেই বাগনানের দিকে, অনেক দূরে। বাস ট্রেন অনেক হাঙ্গামা। যেতে হ’লে এখনই বেরোতে হবে, পাঁচ মিনিটের মধ্যে রওনা না হ’লে গাড়ি ধরা যাবে না।
ঐন্দ্রিলা হাঁ হাঁ ক’রে উঠেছিল ‘সারা দিনের ফের, অতদূর যাওয়া–ফিরতেই কোন্ না বেশি রাত হবে–রান্না ভাত দুটি মুখে দিয়ে যা। একটা জল খাওয়া নেই কিছু না, রাত্রিরে একগাল মুড়ি চিবিয়ে থাকা–দিনান্তরে দুটো ভাতও যদি না পেটে পড়ে, তা’হলে বাঁচবি কী ক’রে?
কিন্তু ভাত খওয়ার আগে স্নান সারা আছে, আহ্নিকপূজো আছে–খুব তাড়াতাড়ি সারলেও আধ ঘণ্টা। বনলতা হাত-ঘড়িটা দেখিয়ে বলেছিল, উঁহু, অত সময় নেই। আজ তাহ’লে থাক–আমি একাই যাচ্ছি। তবে আজ গেলে ভাল হ’ত। আমি না হয় ওদের বলে কয়ে আরও কিছু বেশি পয়সা পাইয়ে দিতুম, পথে কোথাও বসে একটু জলটল খেয়ে নিতে পারতেন, কী চাটি মুড়ি।’
বলতে বলতেই সে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল–অর্থাৎ চলে যাবার ভূমিকা। সীতা যেতে দেয় নি একটা টাকার প্রলোভন ত্যাগ করা আজ তার পক্ষে দুঃসাধ্য। সকালের হতাশা এখনও সম্পূর্ণ মুছে যায় নি মন থেকে। তাছাড়া, তার মন বলে–এ সুযোগও ভগবানেরই দেওয়া, এও তার আসন্ন সুসময়েরই একটা লক্ষণ।
সে তিনচার মিনিটের মধ্যেই তৈরি হয়ে নিয়েছিল। মাকে বুঝিয়েছিল যে, একদিন না খেলে মানুষ মরে যায় না। একাদশী তো মাসে দুটো করতে হয়–না হয় আরও একদিন করল। একটু গুড় গালে দিয়ে জল খেয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল বনলতার সঙ্গে।…
অপরাহ্ন পেরিয়ে গেল। সন্ধ্যাও পার হয়ে গেল এক সময়ে। গভীর রাত হ’ল ক্রমশ পাড়াঘর নিষুতি হয়ে এল। যুগলবাবু রাত দশটার সময় প্রত্যহ মদ খেয়ে মাতলামি করতে করতে যান এই পাড়া দিয়ে, তিনিও চলে গেলেন। কিন্তু তবু, সীতার দেখা নেই। সকালের ভাত জল দিয়ে রেখেছিল ঐন্দ্রিলা। সেই ভাতই নিতাইকে দিল। চাল ধুয়ে ঠিক ক’রে রেখেছে– সীতা এলেই পাতা-লতা জ্বেলে চড়িয়ে দেবে। যে লোক বাইরে তার জন্যে ভাত রেঁধে রাখতে নেই–অকল্যেণ হয়, নইলে ফুটিয়েই রাখত গরম ভাত দুটি।… কিন্তু আর কখন আসবে সে?
ঐন্দ্রিলা আর থাকতে না পেরে গণেশের কাছে গিয়ে কেঁদে পড়ল। গণেশ অনেক বাঁকা এবং কটু কথা শোনাল, কিন্তু বেরিয়েও পড়ল একটা ছেলেকে ডেকে আলো এবং লাঠি নিয়ে। তাতেও খবর বিশেষ পাওয়া গেল না, বনলতা সুকুমার–যারা ও দলের পাণ্ডা এখানকার, তারা কেউই ফেরে নি। ওধারে হয়ত ঠিক সময় গাড়ি ধরতে পারে নি কিম্বা এদিকেরই–তাই ফিরতে পারে নি কেউ। ঘুরে এসে এই আশ্বাসই দিয়েছিল গণেশ।
একেবারে সকালবেলা সুকুমার এসে খবরটা দিল। কাল ওখানে ওটা ঠিক ঠিক সাধারণ প্রতিবাদ মিছিল নয়–আর একটু গুরুতর ব্যাপার ছিল। হাঙ্গামা প্রবল হয়ে ওঠায় পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়–আর তার ফলেই,–একটা গুলি ছিটকে এসে লেগে সীতা মারা গেছে। লাশ পুলিশের জিম্মায় আছে এখনও। ওঁরা কি কেউ যেতে চান?
।।৪।।
ভগবানের এই শেষ চরম মার– এই এত বড় আঘাতটাও ঐন্দ্রিলাকে একা সহ্য করতে হ’ল–নিদারুণ দুঃসময়েও কেউ কাছে এসে দাঁড়াল না। খবর গিয়েছিল সব জায়গাতেই। কিন্তু কেউই আসতে পারে নি। এসেছিল একমাত্র বুড়ো–মহার বড় ছেলে। সে আসা আর না আসা দুই-ই সমান।
শ্যামা খবরটা শুনে দুঃখিত হয়েছিলেন খুবই। নাতনী বলে নয়, সীতাকে তাঁর স্বভাবের জন্যেই ভালবাসতেন। তাহলেও–তাঁর আসা সম্ভব নয়। জীবনে কোন দিন জামাইবাড়ি যান নি তিনি–জামাইবাড়ি যাবার তো প্রশ্নই ওঠে না। তাছাড়া সামর্থ্যও এসেছে কমে। সব চেয়ে বড় কথা–এখন বাড়ি-ঘর ছেড়ে এক বেলার বেশি থাকা সম্ভব নয় কোথাও।
দুঃখ হয়েছিল ঠিকই–তবে যে খবরটা দিতে এসেছিল তাকে কথাও শোনাতে ছাড়েন নি! মেয়ে তাঁর নির্বোধ–নাতনী আরও নির্বোধ হবে সেইটেই স্বাভাবিক। আর মরতে বোকারাই মরে চিরকাল। গেরস্ত ঘরের মেয়ে-ছেলে, বামুনের বিধবা–ও সব ধিঙ্গীপনা করতে যাওয়াই বা কেন! ঐন্দ্রিলার কি এতখানি বয়সেও এতটুকু আক্কেল হ’ল না! সে কী বলে এ সব বরদাস্ত করেছে! সে বারণ করতে পারে নি? যেমন এই বেহায়াপনায় প্রশ্রয় দিয়েছে–তেমনি মরুক এখন আজীবন কপাল চাপড়ে। স্বাধীন হয়েছেন সব, স্বাধীন জেনানা। মদ্দদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে লীডারি করবেন। ….সরকারের সঙ্গে লড়বেন। রাজত্ব উল্টে যাবে তাদের একেবারে, কতক-গুলো পাড়াগেঁয়ে মেড়ার ঐদুটো বুকনিতে। হাত্তোর বুদিদ্ধ রে! বোকা, বোকা। মেয়েটা তাঁর চিরকাল বোকা। ঐ নাতনীকে তাঁরা এতটুকু থেকে মানুষ করেছেন–একটা তুচ্ছ কারণে তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে রাক্ষসের ঘরে তুলে দিয়ে এল। সেই বোকামির ফল জীবন- ভোর ভোগ করছেন নিজে–নিজের মেয়েও। কথায় বলে না, যে মরবে আপনার দোষে, কী করবে তার হরিহর দাসে! তা ওদেরও হয়েছে সেই দশা!
বিস্তর কথা শুনিয়ে–ঘরে কিছুই নেই, ছেলেটিকে কিছুই খাওয়াতে পারলেন না বলে বিস্তর দুঃখ প্রকাশ ক’রে–একটা টাকা বার ক’রে দিয়েছিলেন। তিনি গরিব মানুষ, এর বেশি আর তাঁর সামর্থ্য নেই, ঐন্দ্রিলা তো জানেই তার মায়ের অবস্থা। পরের টাকা সুদে খাঁটিয়ে দেন–লোকে ভাবে না জানি কত বড় মহাজন…সে সঙ্গতি থাকলে মেয়েকে পরের বাড়ি রাঁধুনীগিরি করতে দেবেন কেন?….
হেমও আসতে পারে নি। কারণ ঠিক সেই সময়েই কনক গুরুতর পীড়িত, শয্যাগত হয়ে পড়েছিল। যার কখনও অসুখ করে না বিশেষ, তার একটু কিছু হলেই লোকে অঘটন ভাবে, অসুবিধাতেও পড়ে। এ তো টাইফয়েড, সত্যি সত্যিই সাংঘাতিক অসুখ। বাড়িতে দেখবার বা করবার লোক নেই বলে রেলের হাসপাতালে দিয়েছে, কিন্তু তাতে দায় বেড়েছে আরও। নিজের ছেলে-মেয়ে আছে। তাদের খাওয়া-দাওয়া সব দেখতে হচ্ছে হেমকেই। রান্না সে কোন দিনই করে নি, করতে পারেও না–তবু যা হোক আধসেদ্ধ-পোড়া– নামিয়ে দিতে হচ্ছে। বিকেলে বাজার থেকে রুটি করিয়ে আনে, কোন্ দোকানীকে চারটে পয়সা আর আটা দিয়ে। কিন্তু তারও ঝঞ্ঝাট আছে–তার সঙ্গে আছে হাসপাতালে ছুটোছুটি। কাজেই আর এক পাও কোথাও নড়া সম্ভব নয়।
আর–হেম কথাটা লিখেও ছিল ঐন্দ্রিলাকে–এসেই বা কি করবে। মরা তো আর বাঁচাতে পারবে না। চিঠি আসতে আসতেই তো তিন দিন কেটে গেছে–অপঘাত মৃত্যু, শ্রাদ্ধ-শান্তি যা হবার তা এর মধ্যে হয়ে গেছে নিশ্চয়। শোকের প্রথম প্রচণ্ড দুঃসহতাও কেটে এসেছে অনেকটা। এখন গিয়ে লাভ কি? নাবালকের ভার নেবার সাধ্য তার নেই যখন, তখন না যাওয়াই ভাল। আপন নিয়মে যা হচ্ছে তাই হোক। যারা এতকাল দেখেছে তারাই দেখবে নিশ্চয়। …
গোবিন্দদের বাড়িও খবর পাঠিয়েছিল ঐন্দ্রিলা। পাড়ার একটি ছেলে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই এসব খবর দেবার ভার নিয়েছিল। নিজে গাড়িভাড়া খরচ করে ক’রে ঘুরেছিল, যদিও ফল কিছুই হয় নি। অনর্থক তার এই ক্ষতি করার জন্যে ঐন্দ্রিলা লজ্জাই বোধ করেছিল পরে।
রানী-বৌদি মরবার পর ওদের কোন খবরই পায় নি দীর্ঘকাল। বড়মাসীর মৃত্যুসংবাদটাও এখানে এসে শুনেছে এবার। বড় দুঃখে শেষ জীবনটা গেছে কমলার। পক্ষাঘাতের মতো সব অঙ্গ পড়ে গিয়েছিল, ইদানীং উঠতে পারতেন না একেবারেই। ফলে অনেক সময় ময়লা মেখেই পড়ে থাকতেন। গোবিন্দর নতুন বৌ এ সব পারত না–মন ও ছিল না তার। একে তো শ্বশুরবাড়ি পা দেওয়া থেকেই জুতোসেলাই চণ্ডীপাঠ খাটুনি শুরু হয়েছে, তার ওপর শয্যাশায়ী রুগীর সেবা–অত সে পারে না। আগে নাতনীরাই দেখত; কিন্তু গোবিন্দ নিজের বিয়ের পরেই এই পক্ষের সম্বন্ধীর সঙ্গে পরিবর্ত করে বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল, সে শ্বশুরবাড়িতেই থাকে বেশির ভাগ। ছোট মেয়েটাকে তার দিদিমা এসে নিয়ে গিয়েছেন এই বিয়ের পর, গোবিন্দ আর চাড় করে ফিরিয়ে আনে নি। তার ফলে, মুখে জল দেবারই কেউ ছিল না বলতে গেলে, সেদিক দিয়ে মরেই বেঁচেছেন কমলা। হঠাৎ রাত্রে ঘুমের মধ্যেই একদিন প্রাণটা বেরিয়ে গেছে। একেবারে শেষ হবার সময়টায় আর কষ্ট পান নি বিশেষ।
তবু, গোবিন্দ ছিল বাড়িতে যখন খবরটা যায়। শুনলও সব, তবে তারও আর কিছু করার উপায় ছিল না। চাকরি তার নামমাত্রে ঠেকেছে এখন। সেও সব দিন যায় না, মাইনেও তাঁরা পুরো দেন না, পাঁচ-দশ করে সপ্তাহে সপ্তাহে কিছু কিছু আদায় হয়। এ ধরনের প্রেস আরও সব হয়েছে, তাদের যন্ত্রপাতি সাজ-সরঞ্জাম অনেক ভাল–তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা না করে বরং কারবার গুটিয়ে আনছে মালিকপক্ষ। মধ্যে থিয়েটার লাইনে দু- এক টাকা বাড়তি রোজগার হচ্ছিল, সাজিয়ে দেওয়া, রং করে দেওয়া এইসব করে চার-পাঁচ টাকা করে পেত, এখন তাও হয় না। শরীরের জন্যে পেরে ওঠে না। খুবই দুরবস্থার দিন কাটছে তার। সে স্পষ্টই বলে দিল, ‘যাওয়া তো উচিত ছিল ভাই এখনই, আমাদেরই তো গিয়ে দাঁড়ানো কর্তব্য–কিন্তু ভগবান মেরেছেন, এখন গাড়িভাড়ার পয়সাটাই যোগাড় করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। আর অত বড় বিপদে শুধু শুধু গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখা করে এসে তো কোন লাভ নেই….’
বাকি থাকে কান্তি। তাকে খবরই পাঠানো গেল না। তার ঠিকানাই জানে না কেউ। সুতরাং আত্মীয় বলতে কেউই এল না। কেউ এসে একবার একটা সান্ত্বনাও দিল না। নিজের শ্বশুরবাড়িতে খবর দেয় নি ঐন্দ্রিলা, ঘেন্নাতেই দেয় নি। তারাও কেউ আসে নি। যা করলে সীতার সতীনপোরাই বরং। যা হয় একটু শুদ্ধ হবার ব্যবস্থাও করে দিলে ছেলেটার। নিয়মমতো যেটুকু যা করা দরকার সবই হ’ল। মায় দ্বাদশটি ব্রাহ্মণ খাওয়াবারও আয়োজন করে দিল।
ওরাই ঐন্দ্রিলাকে ভরসা দিল। বলল, ‘আপনিই থাকুন এখানে–ওর অভিভাবক হয়ে। যতদিন না ওর নিজের পেট চালাবার মতো সামর্থ্য হয়, ততদিন আমরা কিছু কিছু দেব। ঐ জমিটা আছে, ওর আয়ে ঘরের মেরামত, খাজনা, এগুলো চলে যাবে মনে হয়। তাছাড়া ওর জলপানি তো রইলই, আরও বাড়বে নিশ্চয়–যত দিন যাবে।… আপনিই বা এই বয়সে এই শরীরে কোথায় যাবেন? আপনি গেলে ছেলেটাকেই বা কে দেখবে। যতদিন বাঁচবেন, ও আপনারই দায়। আপনাকেই দেখতে হবে।’
বুক ভেঙ্গে যাবারই কথা। মনে হয় নি ঐন্দ্রিলার যে সে আর কোনদিন উঠতে পারবে, আর কোনদিন স্বাভাবিকভাবে ঘর-সংসার টানতে পারবে। বিশেষ এই ঘর–এই সংসার। তবু উঠতেই হ’ল শেষ পর্যন্ত, রান্না-খাওয়া, ঘর-সংসারের অন্য সব কাজই শুরু করতে হ’ল। ঐ ছেলেটার মুখ চেয়েই বুক বাঁধতে হ’ল ওকে–মেয়েরই গুঁড়োটুকু। যদি বাঁচে, যদি কোনদিন বিয়ে-থা করে মানুষের মতো ঘরগেরস্থালি পেতে বসতে পারে তো তার নাম থাকবে। তারও, ওরও! ঐ দৌহিত্রটুকুই ওরও ভরসা, জলপিণ্ডের স্থল। অবশ্য বাঁচবে সে ভরসা আর করে না সে। দিদিমা বলতেন যে আঁটকুড়ো হয় তার পৌত্তুরটি আগে মরে, ভগবান যে নমুনা দেখিয়েছেন ওর ভাগ্যের, তাতে এই শেষ জলপিণ্ডটুকুর ব্যবস্থাও রাখবেন কিনা সন্দেহ। উঠন্তি মূলো পত্তনেই চেনা যায়, তার অদৃষ্টও সেই শুরু থেকেই বুঝে নিয়েছে ঐন্দ্রিলা। আশা আর রাখবে না, পরের বাড়ির কাজ করার মতোই করে যাবে। চাকরি যতদিন থাকে। গেলেও হা-হুঁতাশ করবে না। পথেই নেমে আসবে আবার।
।।৫।।
সব চেয়ে যার ভরসা করেছিল ঐন্দ্রিলা, সেই অভয়পদও এল না। ওরা কেউই আসে নি–এক বুড়ো ছাড়া। বুড়োর হাত হিয়েই মেজকর্তা দশটা টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিল।
অভয়পদর আর আসা হবেও না কোনদিন। কোথাও আর যেতে পারবে না সে। যে অভয়পদকে সে চিনত–তারা সবাই চিনত, সে আর নেই। সেই প্রাক্তন খোলসটার মধ্যে থেকে পরিচিত মানুষটা কবেই যেন বিদায় নিয়েছে। খোলস যেটা পড়ে আছে, সেটাও যেন রক্ত-মাংসের কিছু নয়–পাথর। পাথরের মতোই স্থাণু ও জড়।
অনেকদিন ধরে স্থির নির্বাক হয়ে বসে আছে অভয়পদ। বসে থেকে থেকে আরও স্থির আরও নির্বাক হয়ে গেছে সে। চাকরি যাবার পর প্রথম প্রথম বাগানের কাজ করত এটা-ওটা, সারাদিন বাগানেই থাকত প্রায়। এখন সেটুকুও আর পারে না। শরীরে কুলোয় না আর। অতিরিক্ত শীর্ণ হেয়ে গেছে সে, শীর্ণ আর দুর্বল। সেখানেও তার এক নতুন পরীক্ষা, না খাওয়ার পরীক্ষা। একটা মানুষ কত কম খেয়ে বেচে থাকতে পারে–সেইটেই যেন পরখ করে দেখতে চায় সে। দিনান্তে একবার, তাও পাখির আহার করে। শুধু ভাতের সামনে বসে মাত্র। সেটাও যে বন্ধ করে নি–বোধহয় চেঁচামেচি গোলমাল করবে এরা, অনুরোধ উপরোধ কান্নাকাটি করবে–এই ভয়েই। নিজের সর্বপ্রকার ব্যয় কমিয়ে ফেলার সঙ্কল্প তার। দীর্ঘ দশাসই পুরুষ, পাঁচহাত ধুতি পরা কোনক্রমেই সম্ভব নয় তাই সে চেষ্টা করে না, কিন্তু সাতহাতীর বড় সে আনতে দেয় না। জামা বাড়িতে অবশ্য কখনই গায়ে দেয় না–খুব শীত পড়লে পুরনো অফিস যাবার কোটগুলো বার করে পরে। সেগুলোও সে বরাবর কিনত রেলের বাবুদের কাছ থেকে, বেশির ভাগই আধপুরনো। রাত্রে কাঁথা গায়ে দিয়ে কাটে বরাবরই। এখনও তাই। তফাতের মধ্যে খুঁজে খুঁজে ছেঁড়া কাঁথাগুলো এনে গায়ে দেয়।
কাঠের বেঞ্চে শোওয়াও বহুকালের অভ্যাস। ইদানীং সেখানে যা কেবল একটু উন্নতি হয়েছে শীর্ণ কঙ্কালসার হয়ে গেছে না খেয়ে খেয়ে–হাড়গুলো উঁচু হয়ে ঠেলে উঠেছে সর্বাঙ্গে। সেই অবস্থায় কঠিন অনাবৃত কাঠের ওপর শুয়ে গাময় ঘা হতে শুরু হয়েছিল। সে ঘায়ের সঙ্গে এ শোওয়ার কোন সম্পর্ক আছে, সেটা কেউই বুঝতে পারে নি। মহাশ্বেতাও না। লক্ষ করেছিল অম্বিকাই। ঘায়ের জায়গাগুলো মিলিয়ে দেখেছিল–উঁচু-হয়ে-ওঠা হাড়ের জায়গাগুলোর সঙ্গে। সে-ই ধুনুরী ডাকিয়ে বেঞ্চের মাপে একটা সরু তোশক করিয়ে দিয়েছে। তৈরি করিয়ে নিজের হাতে পেতে দিয়ে দাদাকে বলে গেছে, ‘এর ওপর শুয়ো যেন। আমি তোশক করিয়েছি, এ সরু তোশক আর কোন কাজে লাগবে না।… শুধু শুধু কতকগুলো ঘা-নিয়ে জ্বালাতন হয়েই বা লাভ কি!’
আর কিছু বলে নি অম্বিকা। কোন ভাইয়েরই বেশি কথা বলা অভ্যাস নেই। কিন্তু সেই দুটি কথাতেই কাজ হয়েছে। মহাশ্বেতারা ভেবেছিল–এতকাল পরে কিছুতেই বিছানাতে শুতে রাজি হবে না সে–কিন্তু অভয় একটু ইতস্তত করে শুয়েই পড়েছে শেষ পর্যন্ত। তারপরও আর কোন আপত্তি ওঠে নি। নতুন ব্যবস্থাকে সে মেনে নিয়েছে।
তবে–তফাৎটা কি সে বুঝতে পারে? সে কি অনুভব করে শয্যার এই অভিনব (তার কাছে) কোমলত্ব। এ একটা অদ্ভুত অবস্থা অভয়পদর। এরা সবাই লক্ষ করেছে–সে চেয়ে থাকে কিন্তু তার নজরে যেন কিছু পড়ে না। রকেই বসে থাকে বেশির ভাগ–ওর সামনে দিয়েই গরু-ছাগল এসে গাছপালা খেয়ে গেলেও কিছু বলে না। একটা শব্দ পর্যন্তও করে না তাড়াবার জন্যে। সাধারণভাবে কেউ কোন প্রশ্ন করলে উত্তর পায় না। অনেকক্ষণ ধরে সামনে এসে কেউ দাঁড়িয়ে থাকলেও হুঁশ হয় না তার।
এ নিয়ে নানান রকম কানাঘুষো হয় বাড়িতে বা জ্ঞাতিমহলে। বেভুল হয়ে আসছে ক্রমশ’, ‘ভীমরতি অবস্থা’, ‘আর দেরি নেই বেশি’–এ সব কথাও কানে যায় মহাশ্বেতার। শোনে আর আড়ালে চোখের জল মোছে। শুধু ভয় নয়–অনুতাপেরও জল এটা। মনে কোনে একটা সন্দেহ দেখা দিয়েছে যে বোধহয় তার গঞ্জনাতেই মানুষটা তিলে তিলে নিজেকে শেষ করে আনছে, ‘ওপোস করে শুকিয়ে মরতে চাইছে।’ টাকাটা যাবার পর দিনকতক প্রায় দিবারাত্র স্বামীকে কটু-কাটব্য করত, কেঁদেকেটে চেঁচিয়ে মাথা খুঁড়ে অভয়পদকে উত্ত্যক্ত-উদ্ভ্রান্ত করে তুলত। এরা সবাই অনেক নিষেধ করেছে তখন, বলেছে, ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা দিও না অমন করে–শেষে কি মানুষটা আত্মঘাতী হবে?’ কিন্তু তখন কারও কথা শোনে নি টাকার শোকে যেন পাগল হয়ে গিয়েছিল, আর সেই ক্ষতির জন্যে নিজের অতিরিক্ত লোভ নয়– স্বামীকেই দায়ী করত সে।
কিন্তু ইদানীং অভয়পদর এই স্তম্ভিত অবস্থা দেখে তার যেন চৈতন্য ফিরেছে কতকটা। এবার সে ভয় পেয়েই চুপ করেছে। আসলে অভয়পদের জন্যে যে চিন্তার কিছু আছে, তার জন্যেও যে কোন দিন উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠবার কারণ ঘটতে পারে, সেটাই ভাবে নি কেউ। তার স্ত্রীও না। কিন্তু এখন নিজের আসন্ন সর্বনাশের চেহারাটা স্পষ্ট না হলেও–আবছামতো দেখতে পেয়েছে সে। যতই যা হোক–তবু ঐ মানুষটা যতক্ষণ বেঁচে আছে ততক্ষণই তার জোর, তার যতকিছু, ‘দম্ভজ্যি’–ও না থাকলে তো পথের ভিখিরী। এধারে যতই বোকা হোক–এতবড় ক্ষতিটা বোঝার মতো সাংসারিক জ্ঞান তার আছে।
তাছাড়াও বোধ হয় কিছু আছে–নিজের স্থুল লাভ-লোকসানের প্রশ্নটা ছাড়াও।
ওরা যে স্বামী-স্ত্রী, পৃথিবীতে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মানুষ দুজন, সবচেয়ে আপন পরস্পরের, এটা ওরা ভুলেই গিয়েছিল দীর্ঘদিন ধরে। অথবা, সেটা ভাবার কোন অবসর বা অজুহাত মেলে নি ওদের জীবনে। তবু কোথায় সূক্ষ্ম অন্তঃ-সলিলা ফল্গুধারার মতো সে বোধটা ছিলই–জীবনের সঙ্গে প্রাণের সঙ্গে জড়িয়ে। ছিল বলেই নতুন করে সে অস্তিত্বটাকে খুঁজে পেয়েছে মহাশ্বেতা। আর সেই সচেতনতার সঙ্গে সঙ্গে প্রাণের সমস্ত আকুলতা উদ্বেগ ও মমতায় টান পড়েছে তার।
তার অমন সুন্দর স্বামী– মহাদেবের মতো।
অমন দেবতার মতো স্বভাব তার। নিস্পৃহ, নিরহঙ্কার নিরাসক্ত। সকল প্রকার মানবিক ভাবাবেগের ঊধের্ব। অথচ দয়ামায়ায় পূর্ণ–সে পরিচয় মহাশ্বেতা তো কতবারই পেয়েছে। যে যেখানে আছে মহাশ্বেতার আত্মীয়, সকলেই এ মানুষটার কাছে উপকৃত। তাকে কোন দুঃখ স্পর্শ করে না কিন্তু পরের দুঃখ সম্বন্ধে সে এতটুকু উদাসীন নয়। বহু ভাগ্যে এমন স্বামী মেলে, আর বহু জন্মের পাপে এমন স্বামী পেয়েও ক্ষোয়াতে হয়। ….
আরও ভয় ধরিয়ে দিয়েছে মহাশ্বেতাকে তার জ্যাঠতুতো বড় জা। সে বলেছে, ‘সংসার থেকে ছেলেপুলে থেকে যখন একেবারে সরে যায় মানুষ, তার মনের নেপ্চোটা চলে যায়– তখন আর তাকে ধরে রাখা যয় না। সন্ন্যিসী হয় সে এক রকম, ঘরে থেকে মনটা এমনভাবে ঘর-সংসার থেকে সরে যাওয়া ভাল না। মায়ার টান গেলে আত্মা আর থাকবে কেন? টানটাই তো ধরে রাখে গা।’
বড় ভয় ধরেছে মহাশ্বেতার কথাটা শোনবার পর থেকে। টানটা ফিরিয়ে আনার জন্য উঠে-পড়ে লেগেওছিল কিছুদিন। কিন্তু কী করলে সেটা ফিরে আসে, ঠিক কী করা উচিত তা ভেবে পায় না। মধ্যে, তরলারই পরামর্শে খুব সটেপটে ধরেছিল সে স্বামীকে, ‘তুমি বাপু মন্তরটা নিয়ে নাও। মন্তর নিয়ে জপ আহ্নিক করতে থাকলে মনটা ভাল হবে।’
ওদের কুলগুরু আছেন, এরা বাড়ি সুদ্ধ বড়রা সবাই দীক্ষাও নিয়েছে, অভয়ের অনুমতি নিয়ে মহাশ্বেতাও নিয়েছিল। কেবল অভয় নিজেই নেয় নি। তখন সবাই খুব জেদ করাতে বলেছিল ‘ভগবানকে ডাকব তার জন্যে আর একটা মানুষকে সুপারিশ ধরার কি দরকার? তাঁকে ডাকার ইচ্ছে যদি মন থেকে না জাগে তো হাজার মন্তর নিলেও তাঁকে ডাকা হবে না। এই যে সকাল বেলা গিয়ে রোজ আহ্নিকে বসো–ভগবানের কথা কতটুকু ভাব বলো তো!’
তখন তবু যুক্তি দিত। এখন কথাই বার করা যায় না। বার বার বলার পর একটি সংক্ষিপ্ত উত্তর পাওয়া গিয়েছিল, ‘ও আমার ভাল লাগে না।’…
আরও নানা উপায়ে সংসারের দিকে স্বামীর মন ফেরাবার চেষ্টা করেছে মহাশ্বেতা, মায়ার টানকে প্রবল করে তুলতে চেয়েছে। ছোট একটা নাতিকে এনে কোলের কাছে কখনও বা কোলের ওপর বসিয়ে দিয়েছে, নাতি-নাতনীদের পাঠিয়েছে কাছে বসে গল্পগুজব করতে, তাদের দিয়ে খাবার করে পাঠিয়ে দিয়েছে–শিখিয়ে দিয়েছে, জোর করে আবদার করে খাওয়াবি, একটু কিছু খাওয়াতে পারলে একটা পয়সা দেব, কিন্তু কোনটাতেই কোন ফল হয় নি। তার সেই নির্লিপ্ত নিরাসক্তি, জীবন সম্বন্ধে নিতান্ত নিরুৎসুকতা তাকে যেন বর্মের মতোই আচ্ছাদিত করে রেখেছে, সে বর্ম ভেদ করা যায় না কোন অস্ত্রেই।
অথচ এটাকে বিষাদ বলে ভাববার কোন কারণ নেই। আগে বরং একটা হতাশা একটা দুঃখের ছায়া তার মুখে দেখা যেত–এখন সেটাও নেই। আগেকার ভাবলেশহীন মুখভাবই ফিরে এসেছে আবার বরং যেন আরও ভাবলেশহীন, আরও পাথরের মতো হয়ে উঠেছে মুখটা। মানুষটাই যেন পাথর হয়ে গেছে–ভিতরে-বাইরে। পাথরের মতোই নিশ্চল পাথরের মতোই প্রাণস্পন্দনহীন। অমনি পাথর হয়ে গেছে বুঝি মনটাও, কোন কিছু ভাববার অভ্যাস ফেলেছে হারিয়ে।
.
কিন্তু তা নয়। এরা বুঝতে পারে না। ভাবেই সে বেশি আজকাল। সে ভাবনা বড় বেশি মনের গভীরে, আর সে ভাবনাতে একেবারে ডুবে তলিয়ে গেছে বলেই সেটা চোখে পড়ে না।
চিন্তা নয় এটা–ভাবনাই। সমস্ত মানসিক সত্তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এটা। এই থেকেই তার আত্মা আনন্দ-রস আহরণ করে। এটা তার ভাবনা-বিলাস।
বাইরে যতটা নিষ্ক্রিয় সে ভেতরে ততটাই সক্রিয়। মনের প্রত্যন্ত প্রদেশে সে তার পূর্ব জীবনের রোমন্থন করে। করেই যায় বার বার। কর্মজীবনের আদ্যোপান্ত ইতিহাসটাকে মানস-জগতে পুনরজ্জীবিত করে তুলতে চেষ্টা করে। বারবার একই জীবনযাপন করতে চায় সে। করেও। সেই জীবনেই সে বেঁচে আছে সেইখানেই তার অস্তিত্ব। বাইরের জগতে সে মৃত–তাই অমন স্থাণু
সে জীবনটা চলচ্চিত্রের মতো অভিনীত হতে থাকে তার মনের পর্দায়। উপন্যাসের মতো মনের পাতায় লিখে যায় সে। তা নিয়ে তার যত্ন ও উৎকণ্ঠারও অবধি নেই। প্রতিটি অনুচ্ছেদ ঠিক সন তারিখ ধরে ধরে–পারম্পর্য বজায় রেখে সাজানো প্রয়োজন। এদিক ওদিক–আগুপিছু না হয়ে যায়। এক এক সময় সংশয় জাগে–ভুল হচ্ছে না তো? যত্ন করেই আবার সেটা সংশোধন করে। মনে করে করে মিলিয়ে নেয় অন্য ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেঃ
শশীবাবু যেবার রিটায়ার করল সেইবারই লং সাহেব নতুন এল বিলেত থেকে। শশীবাবুর সে কী আপসোস, এই নতুন সাহেবটা কেমন তা নেড়ে চেড়ে দেখা হ’ল না। শশীবাবুর জীবনে ঐ একটিই ধ্রুব চিন্তা ছিল–আনন্দ বলুন, বিশ্রাম বলুন আর শখই বলুন–সাহেবদের কী করে বোকা বানাবেন। তাদের কত বুদ্ধি–যে বিদ্যে-বুদ্ধির অহঙ্কারে বেটারা ওঁদের থেকে অত বেশি মাইনে নেয়–সে বুদ্ধির দৌড় কতটা তাদের বুঝিয়ে দেবেন আচ্ছা করে। তাদের নাকের জলে চোখের জলে করাবেন। …করাতেনও, ওঃ সেবারে হাচিনস সাহেবকে কী জব্দটা না করলেন, সেই আসাম রেলের ঠিকের ব্যাপারে। ….আচ্ছা, শশীবাবু রিটায়ার করলেন সেটা কোন সাল? উনিশশো নয় হবে–না দশ? না না, শশীবাবু তো রিটায়ার করলেন তাঁর বড় জামাইটি মারা যাবার পর, সেই শোকেই কতকটা। যুদ্ধে গিয়েই তো মারা গেল সে জামাই, ফরাসী মুলুকে কোথায় যেন ম’ল– লাশটা জ্বালানোও হ’ল না। এঁরা কুশের পুতুল দাহ করে শ্রাদ্ধশান্তি করলেন। তা হ’লে–দশ কি করে হবে? চোদ্দ সালের আগে তো হ’তে পারে না। অথচ লং সাহেব যেন এসেই সদ্য-মরে-যাওয়া রাজা সপ্তম এডোয়ার্ডের জন্যে শোক সভা করলেন না? –আসার বোধ হয় সাত-আট-দিনের মধ্যেই সভাটা করা হ’ল। শশীবাবু রিটায়ার করার সময় কে এলেন তাহলে–ম্যাকডুগাল কি? না, ম্যাকডুগাল এল অনেক পরে। ম্যাকডুগাল একেবারেই ম্যানেজার হয়ে এসেছিল। তার জন্যে হঠাৎ বড় করে একটা সভা ডাকা হ’ল অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে। সেই প্রথম ও রকম সভা হ’ল ওদের।
ম্যাকডুগালের সে সভাটার কথাও বেশ মনে আছে অভয়পদর। গঙ্গার ধারে সামিয়ানা খাঁটিয়ে খুব জোর সভা হয়েছিল। ঠিক ছিল সামিয়ানার নিচে শুধু বাবুরা বসবেন। কারখানা মিস্ত্রীরা–তখনকার দিনে কুলীই বলা হ’ত সকলকে–আর তার মতো যে সব কর্মচারী, না বাবু না কুলী তারাও সামিয়ানার বাইরে ঘিরে দাঁড়াবে। শীতকাল সেটা, বেলা দুটোয় সভা–কোন অসুবিধেই হবে না। বড়দিনের মুখটাতেই সভা ডাকা হয়েছিল, বেশ মনে আছে অভয়পদর।… সেও ছিল দাঁড়ানোর দলে–দাঁড়িয়েই ছিল এক কোণে–হঠাৎ ডানকান সাহেবের নজর পড়ে গেল। ডানকান ট্যাস সাহেব ছিলেন কিন্তু কে বলবে পাকা সাহেব নন। আর তেমনি মেজাজও ছিল, বড় বড় সাহেবদের যেমন দিলদরিয়া মেজাজ হয়–সব দিকে নজর, সকলের ওপর সমান দৃষ্টি। ডানকানই অভয়পদের ওপরওলা লাহিড়ীবাবুকে বললেন, ‘ওকে ভেতরে এনে বসাও অভিকে–(ডানকান অভয় উচ্চারণ করতে পারতেন না–বলতেন অভি), ও কেরানীর অনেক ওপরে, আধা-ইঞ্জিনীয়ার বলতে পার ওকে।
ওঃ, সে কী চোখ টাটিয়েছিল সেদিন সকলকার। কেরানীবাবুরাও, ম্যাকডুগালকে দেখবে কি–উটে ওকেই দেখেছে শুধু। সভার পর খাওয়ার সময়ও–মিস্ত্রীদের সব হাতে হাতে দেওয়া হ’ল কমলালেবু আর কেক, অভয়পদ বাবুদের সঙ্গে মাটির সরা পেল। কেক কমলালেবু ছাড়াও তাতে একটা করে সিঙ্গাড়া আর কি যেন–হ্যাঁ, ভূষণবাবু খইচুর আনিয়েছিলেন ধনেখালি থেকে–সেই খইচুর ছিল। অভয়পদ খায় নি সে-সব, কোনকালেই আপিসে কিছু খেত না–সরাসুদ্ধ ঝাড়নে বেঁধে বাড়ি এনেছিল। তা নিয়ে কত হাসাহাসি, বাবুরা টিটকিরি দিয়েছিল, বাবুর খানা কি কুলীর পেটে সহ্য হয়!…. অথচ, অভয় হলপ করে বলতে পারে, বাবুরা সবাই কিছু কিছু পকেটে করে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল। একটা নিয়ে লুকিয়ে রেখে আর একটা সরা নেবার জন্যে বাবুরা যে কাণ্ড করেছিল– কেউ তিন-চারটে নিয়েছে– সে উঞ্ছবৃত্তি অভয় কোনকালে করতে পারবে না, করেও নি সে। ….
সেই কেক নিয়েই তো সেবার কী গণ্ডগোলটা না হ’ল। অভয় কেকটা নিয়ে গিয়ে মাকে খেতে দিয়েছিল। সে কথাটা কেমন করে যেন চাউর হয়ে যায় পাড়ায়-পাড়ায়, রায়েরা মজুমদাররা–তার সঙ্গে ওদের জ্ঞাতিরা মিলে সে কি ঘোঁট সকাল সন্ধ্যে কী সমাচার, না অভয় ডিম দেওয়া কেক খাইয়েছে ব্রাহ্মণের বিধবাকে। কথাটা ক্ষীরোদার কানে পৌঁছতে তিনি শুষ্ক মুখে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘হ্যাঁ রে, ওরা যা বলছে–সত্যি? অভয় তার জবাবে মিথ্যেই বলেছিল, ‘তুমি ক্ষেপেছ! এসব কেকে আবার ডিম দিচ্ছে! ডিম অত সস্তা কি না!’ বাইরে থেকে শুনে চোখ বড় বড় করে মহাশ্বেতাও স্বামীকে বলতে গিয়েছিল, ‘এটা তুমি কি করলে! ছি ছি,–এর তুল্য পাপ আছে। মাকেও নরকে মজালে, নিজেও মজলে।’ খুব উত্ত্যক্ত করে তুলতে তাকে বলেছিল, ‘বেশ করেছি খাইয়েছি। পাপ হয় আমার হবে, সে আমি বুঝব। মার আবার পাপ কি, মা তো অজাতে খেয়েছে।’
আজও সে জন্যে দুঃখিত বা অনুতপ্ত নয় সে। মা কতদিন তাকে বলেছেন তার আগে, ‘হ্যাঁ রে, কেক আবার কি মিষ্টি রে?’ ‘কেক কেমন খেতে রে?’ ‘সায়েরা যখন খায় তখন নিশ্চয়ই খুব ভাল মিষ্টি। তা সন্দেশের চেয়ে ভাল? তোরা তো খেয়েছিস?’ এত করে বলার মানেই তাঁর মহাপ্রাণী খেতে চেয়েছিল। সে খাওয়ানোতে কোন দোষ আছে বলে মনে করে না অভয়পদ।….
ঐ ম্যাকডুগালই আবার যখন চলে গেল–বিলেতেই আর একটা কি বড় কাজ পেয়ে, তখনও খুব ধুমধাম করে ফেয়ারওয়েল দেওয়া হয়েছিল তাকে। সেবার তো অভয়পদর আরও খাতির। সাহেবদের মহাজন সে, খাতক সাহেবরাই তাকে নিয়ে গিয়ে সামনে বসিয়ে দিয়েছিল।… উঃ, ব্যাটারা কি ঘা-ই দিয়ে গেল! হাসি, খাতির, কাঁধে হাত রাখা, তার আড়ালে কী শয়তানিই ছিল ব্যাটাদের মনে। পঙ্কজবাবু বলতেন ঠিক কথাই–’সাদা চামড়াকে কখনও বিশ্বাস করবে না। ওরা মিছরীর ছুরি!
থাক সে কথা। অভয়পদরই অদৃষ্ট। নইলে সব সাহেব কিছু সমান নয়। সেই যে হাওড়ার পুলের প্ল্যানটা বুঝিয়ে দিয়েছিল সে–সে সময়, সত্যিই যখন জলের মতো বুঝিয়ে দিলে, তখন ওদের এখানকার বড় সাহেব যিনি ছিলেন এগিয়ে এসে প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে ওর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেছিলেন। বিলেত যাবার সময় নিজের গায়ের গরম কোটটাই দিয়ে গিয়েছিলেন–উপহার। সে কোট আজও খোকা–মানে দুর্গা গায়ে দিচ্ছে। বিলেত গিয়েও দু-তিন বছর পর পর বড়দিনে কার্ড পাঠিয়েছিল অভয়কে মনে করে করে। না, সবাই অকৃতজ্ঞ নয়, একজন দুজনের জন্যে সব সাদা চামড়াকে গাল দেবে না সে।….
এমনিই স্মৃতি রোমন্থন করে যায় সে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ঠায় একভাবে বসে থাকে এক জায়গায়। অনেকক্ষণ পর পর চোখের পাতা পড়ে শুধু, সেইটুকু থেকেই প্রাণস্পন্দন টের পাওয়া যায়। বাকিটা পাথরে মতোই স্থির অনড় হয়ে থাকে। সাদা দাড়ি-গোঁফে সাদা চুলে ফর্সা রং-এ শ্বেত পাথরে মূর্তির মতোই মনে হয় তাকে। পাড়ার লোক অনেকে দূর থেকে ওকে দেখায়–জীবিত মানুষ কেমন নিশ্চল হয়ে বসে থাকতে পারে। মন শুধু কাজ করে যায়, দ্রুত নয়–তাড়াহুড়ো নেই কোথাও আর–আস্তে আস্তে সময় নিয়ে সে স্মৃতির আলপনা এঁকে যায়। জাল বুনে যায় ক্রুশকাঠির বোনার মতো। আলপনা একবার শেষ হ’লে মুছে ফেলে, আবার শুরু করে গোড়া থেকে। কুশের চেন–খোলে আর বোনে। সেখানে যেমন তাড়াও নেই তেমনি বিশ্রামও নেই। গভীর থেকে গভীরে ডুবে যায় হয়ত — তবু ঐটুই তার জীবন, ঐখানেই এখনও সে কর্মঠ আছে।
তার এ ভাবনা-বিলাসের খবর তার বাড়ির লোক কেউ রাখে না। এ তার গোপন সঞ্চয় যেন, কৃপণের মতো নিজেই নাড়ে-চাড়ে, সযত্নে অন্যের থেকে আড়াল করে রাখে। দৈবাৎ কখনও এ রহস্যটা ধরা পড়ে যায়। হয়ত অনেকক্ষণ ধরে মহাশ্বেতা কিছু বলছে, আগে খেয়ালই করে নি, যখন খেয়াল হল তখন, তার দিকে না চেয়েই উত্তর দিল, ‘ও তিনটে কয়েল বাদ। ওগুলোতে কি দোষ আছে, গ্রেগরী সাহেব দিতে বারণ করেছে!’
কিম্বা দুর্গাপদ এসে হয়ত কোন চমকপ্রদ খবর দিল–বেশ চেঁচিয়েই বলে সে ‘দাদার এই অর্ধতন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থা থেকে জাগিয়ে তুলতে–কিন্তু তাতেও শুনল, হ্যাঁ, শুনেছি। শশীবাবু বলেছে আমাকে।’ নাতি এসে গলা জড়িয়ে ওর মুখটা নিজের দিকে ফেরাবার চেষ্টা করছে হয়ত–দাদু বলে উঠল, ‘কোটটা–কোটটা আগে সেলাই করে দিতে বল তোর মাকে।’
অবশ্য এগুলো দৈবাৎই। তবু সকলেই শুনেছে এক আধবার। এরা বলে, ‘ভুল বকছে।’ বলে, ‘এই রকমই হয়। ক্রমশ সব গুলিয়ে যায় মাথার মধ্যে।’ একমাত্র তরলাই বাড়ির মধ্যে যা ধরতে পারে এর রহস্যটা। বলে, ‘না দিদি, ভুল-বকা নয় ওসব। আমার মনে হয়, উনি দিন-রাত বসে বসে কেবল আফিসের ভাবনাই ভাবেন। সেই সব আগেকার কথা–বোধ হয় সেই কথা তুলে কেউ গল্প করলে উনি অনেকটা চাঙ্গা হ’তে পারেন। অনেক দিন তো কাটালেন ওখানে ঐ কথাই ভাল লাগে।’
কিন্তু তরলার কথায় কেউ কান দেয় না। মহাশ্বেতা তো নয়ই–সংসারের কথা ছাড়া অন্য কোন কথা এত গভীরভাবে ভাবতে পারে কেউ তা তার ধারণাতেও আসে না।
প্রদীপের শিখা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে ক্রমশই–তবু তা যে খুব তাড়া- তাড়ি নিভবে কেউ ভাবে নি। এইভাবেই আরও দু-চার বছর চলবে, সকলেই আশা করেছিল। এদের দেহের গঠনই ভিন্ন, সাধারণ মানুষের থেকে অনেক বেশি মজবুত অনেক বেশি ঘাতসহ। বোধহয় এটা পেয়েছে ওরা মায়ের কাছ থেকে, তিনি আজও বেঁচে আছেন এবং জরা-জনিত দুর্বলতা ছাড়া অন্য কোনও কঠিন ব্যাধি কিছু তাঁর নেই। কিম্বা দুঃখে- কষ্টে পোড় খেয়ে খেয়েই ক্রমশ মজবুত হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে অভয়পদর দেহ যে সাধারণ রক্ত-মাংসের, কালের স্বাভাবিক ক্ষয়ক্ষতি অন্য মানুষের মতো তাকেও ক্ষইয়ে আনতে পারবে, এটা কেউ ভাবতে পারত না ঠিক। তার কারণও ছিল। এ বাড়ির কেউই কখনও অভয়পদকে বিশেষ অসুস্থ হতে দেখে নি বরং দেখেছে বারো মাস তিনশো পঁয়ষট্টি দিন কঠোর পরিশ্রম করতে–কী আফিসে কী বাড়িতে। বিশ্রাম শব্দটার সঙ্গেই তার পরিচয় নেই, দৈনিক পাঁচ ঘণ্টার বেশি সে ঘুমোয় না, শোয় নিরাবরণ কাঠের বেঞ্চিতে। বিলাস তো নয়ই, আরামও তার সয় না। তার রক্তে অনন্ত প্রাণধারা প্রবাহিত, তার অস্থিতে অমিতবীর্য কাঠিন্য। সে যে এখন বসে থাকে–নিতান্ত ইচ্ছা করেই–এও তার এক রকমের তপস্যা, কষ্টসহিষ্ণুতার একটা পরীক্ষা। নইলে ইচ্ছে করলেই, আজও সে ঘুরে-ফিরে আবার আগেকার মতো কাজকর্ম করতে পারে নিশ্চয়। তার এ কর্মবিমুখতার মূলে দৈহিক কারণ নেই ততটা–যতটা মানসিক কারণ আছে।
হয়ত তাই। কিন্তু দেহের ওপর মনের প্রভাব যে অনেকখানি সেটা এদের জানা ছিল না তেমন। বেঁচে থাকার আগ্রহ ও ইচ্ছা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার লৌহকঠিন দেহেও যে ক্ষয় ধরেছে সেটা বুঝতে পারে নি। তাই, প্রথম যেদিন ছটা বেজে যাবার পরও অভয়পদ চোখ বুঝে বিছানাতেই শুয়ে রইল, সেদিন প্রথম দিকটায় উদ্বেগের চেয়ে বিস্ময়ই বোধ করেছিল সকলে বেশি।
তবুও সোজাসুজি এসে স্বামীর গায়ে হাত দিয়ে ঠেলতে সাহস হ’ল না মহাশ্বেতার, ছুটে গেল সে মেজকর্তার কাছেই। অম্বিকা সারা রাত ঘুমোয় না, সে সন্ধ্যা থেকে বসে গেলাস গোলাস চা খায় আর ভূতের মতো সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে পাহারা দেয়। ভোরের দিকে মেয়েরা উঠলে সে নিশ্চিন্ত হয়, সেই সময়ই চোখের পাতা দুটোও বুজে আসে তন্দ্রায়। পাঁচটা থেকে নটা পর্যন্ত ঘুমোয় একটানা। কেউ ডাকলেও সাড় আসে না সহজে। কিন্তু আজ কথাটা শোনা মাত্র তার সমস্ত জড়তা কেটে গেল, তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এল মহাশ্বেতার সঙ্গে সঙ্গে। খবরটা শুনে মুখ তো বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিলই, মহার মনে হ’ল তার পা দুটোও অল্প অল্প কাঁপছে। সম্ভবত কাঁচা ঘুম ভাঙ্গার জন্যেই, মহা মনে মনে ভাবল।
অনেক ডাকাডাকিতে অতিকষ্টে চোখ খুলল অভয়পদ; মনে হ’ল চোখ মেলে চাইতে তার কষ্টই হচ্ছে রীতিমতো। চোখের পাতাগুলো যেন অবশ হয়ে এসেছে চেষ্টা করেও চাইতে পারছে না।
অনেকক্ষণ সময় লাগল তার ভাল করে চেয়ে দেখতে। অবশ্য চোখ খোলার পর বেশ স্থিরভাবেই চেয়ে রইল সে ভায়ের দিকে, তারপর অতি ক্ষীণ কিন্তু স্পষ্ট কণ্ঠে বলল, ‘আর না, আর উঠব না আমি। এই শেষ।’
মুখের কাছে ঝুঁকে ছিল মহাশ্বেতা, কথাগুলো সেও শুনতে পেয়েছিল। সে ডুকরে কেঁদে উঠল। বোধ করি সেই শব্দেই–ঈষৎ ভ্রূকুটি করল অভয়। অম্বিকাপদ বলল, কেঁদো না–একটু দ্যাখো, আমি ডাক্তার ডাকতে পাঠাচ্ছি–’
‘উঁহু। আবার কথা কয়ে উঠল অভয়, ‘ডাক্তার নয়। তুমি বসো। জীবনে কোন দিন ওষুধ খাই নি–যাবার সময় আর কেন? লাভও নেই কিছু।’
এইটুকু বলতেই বোধহয় অনেকখানি আয়াস করতে হয়েছিল, ক্লান্তিতে চোখ বুজল আবার। অম্বিকাপদ দাদাকে চেনে, বোধ করি একমাত্র সে-ই চেনে। সে আর ব্যস্ত হ’ল না–বেঞ্চির কাছে মেঝেতেই শান্তভাবে বসল।
মহাশ্বেতার কান্নায় বাড়িসুদ্ধ প্রায় সবাই ছুটে এসেছে তখন। দুর্গাপদ জিজ্ঞাসুনেত্রে চাইল অম্বিকার দিকে, অর্থাৎ ডাক্তার ডাকবে কিনা। অম্বিকা ঘাড় নেড়ে নিষেধ করল। তারপর বহুক্ষণ সেই নিস্পন্দ মানুষটার কাছ থেকে কোন সাড়া আসে কিনা দেখে বলল, ‘একটু দুধ আনতে বলি। একটু দুধ খাও–মুখ ধোওয়া পরে হবে খন।
‘না।’ চোখ না চেয়েই উত্তর দেয় অভয়পদ, ‘কী লাভ?’
‘না খেয়েই বা লাভ কি? এদের মনে শুধু শুধু কষ্ট দেওয়া–। আর খেলেও তো কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না তোমার।
একটুখানি চুপ করে থেকে অভয়পদ উত্তর দিল, ‘খেতে কষ্ট হবে। বোধহয় গিলতে পারব না কিছু। দরকারও তো নেই–’
আরও খানিক পরে আর একবার চোখ খুলল। চারিদিকে তাকাল একবার। সবাইকে যেন দেখে নিল ভাল করে। তারপর আবার ধীরে ধীরে বুজে এল চোখের পাতা দুটো। বলল, ‘ওদের এখন যেতে বলো অম্বিকা, এখনই আমি মরছি না। হয়ত আজও মরবো না.. ওঠার আমার শেষ হয়ে গেছে, সেইটেই বলছিলুম। …
দুপুরের দিকে আর একবার চোখ খুলল সে। তখন শুধু মহাশ্বেতা বসেছিল কাছে। অনেকক্ষণ স্থিরভাবে স্ত্রীর মুখের দিকে চেয়ে থাকবার পর আস্তে আস্তে বলল, কতকটা যেন আপন মনেই, ‘বড়’ তাড়াতাড়ি এসে পড়ল শেষটা। আমিও বুঝতে পারি নি। বুঝতে পারলে হামাগুড়ি দিয়ে দিয়েও খালধারে গিয়ে পড়ে থাকতুম। জন্মে কখনও গাড়ি-পাল্কী চড়ি নি–মরার পর লোকের কাঁধে চড়তে হবে–ভাবেতেই কষ্ট হচ্ছে!’
বলে হাসলও একটু। বহুদিন পরে সে হাসি বড় করুণ দেখাল ওর মুখে।
সকালে বিস্তর কেঁদেছিল মহাশ্বেতা, আছাড়ি-পিছাড়ি করে কেঁদেছিল–এখান থেকে সরে রান্নাঘরের দাওয়ায় পড়ে। কিন্তু এখন অনেকটা শান্ত হয়ে গেছে সে। তরলাই তাকে বুঝিয়েছে, ‘দিদি কাঁদবার সময় ঢের পাবেন, জীবনভোরই তো তোলা রইল কান্না–। এখন একটু শক্ত হোন। শেষ সময়টা কাছে থাকুন, যতটা পারেন সেবা ক’রে নিন। নইলে এর পর আপসোসের শেষ থাকবে না।’
মহাশ্বেতাও বুঝেছে কথাটা। তরলার বুদ্ধিসুদ্ধির ওপর তার চিরদিনের বিশ্বাস, ঠিকই বলেছে বৌটা। খুব ভেবেচিন্তে বলে–একেবারে নিয্যস্ খাঁটি কথা। সে জোর করে মনকে শক্ত করেছে। শুধু খাওয়ার সময়টাই আর একবার ভেঙ্গে পড়েছিল। আগে অতটা বুঝতে পারে নি। সকাল করেই খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল মেজবৌ, জোর করে হাত ধরে ওকে এনে বসিয়েছিল আসনে। মহাশ্বেতা প্রথমটা যেতেই চায় নি–’খাওয়ায় ইচ্ছে নেই আমার একদম, সত্যি বলছি। মুখেই দিতে ইচ্ছে করছে না কিছু। আর সে তখন তোদের সঙ্গে না হয় বসব। এখন বুড়ো মাগী আমাকে সাততাড়াতাড়ি খেতে দেবার দরকার কি?’ প্রমীলা বুঝিয়ে দিয়েছিল, খৈতে তো হবেই, পোড়ার পেট সব্বকাল আছে আর সব্বকাল থাকবে। কাজটা সেরে নিয়ে বটঠাকুরের কাছে একটু স্থির হয়ে বসো। দরকার কিছু না পড়ুক, চোখ খুলে তোমাকে দেখতে পেলেও ওঁর শান্তি হবে।
আর কোন প্রতিবাদ করে নি মহাশ্বেতা কিন্তু প্রমীলা ভাতের থালা এসে ধরে দিতে, চমকে উঠেছিল। আজকাল মাছতো তাদের বাড়ি ঢোকেই না। জিনিসপত্তরের দাম আগুন, দু’টাকা-আড়াই টাকা সেরের কম মাছ নেই বাজারে–এ রাবণের গুষ্টিকে এক টুকরো করে দিতে গেলেও তো দুসের মাছ লাগে। পুকুর থেকে না ধরানো হলো বা ছোটকর্তা ছিপ ফেলে না ধরলে আর মাছ পাতে পড়ে না। কিন্তু আর যাই হোক–আজ কেউ মাছ ধরতে যায় নি–এই বিপদের মধ্যে। অথচ পাতে এত রকম মাছ এল কোথা থেকে? যে যে মাছগুলো মহাশ্বেতার প্রিয়, তার সবগুলিই আছে, পার্শে, বাটা, চিংড়ি–’এত মাছ এল কোথা থেকে রে? কেউ পাঠিয়েছে?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল মহাশ্বেতা।
এক মুহূর্ত দেরি হয়েছিল উত্তর দিতে। প্রমীলা যেন কথা খুঁজে পায় নি সেই নিমেষকাল সময়। চোখের পাতা সামান্য একটু অবনত হয়েছিল তার। কিন্তু তা-ই যথেষ্ট। মহাশ্বেতারও বুঝতে বাকি থাকে নি ইঙ্গিতটা। চেঁচিয়ে কেঁদে উঠেছিল সে, আছড়ে পড়েছিল থালার পাশে।
ব্যাকুল হয়ে প্রমীলা একেবারে কোলের মধ্যে তুলে নিয়েছিল ওর মাথাটা, ‘চুপ চুপ, ও দিদি, এখনও যে মানুষটা বেঁচে। ভাতের থালার সামনে বসে ঠিক দুপুরে কাঁদলে অকল্যাণ হবে যে! চুপ করো, চুপ করো, আমার মাথা খাও!’
চুপ করেছিল একটু পরেই কিন্তু খেতে পারে নি। নিতান্ত অকল্যাণের ভয়েই প্রমীলা তরলার পীড়াপীড়িতে একটু মাছ ভাত তুলে মুখে ঠেকিয়েছিল একবার–নিয়মরক্ষার মতো।…
কিন্তু কাঁদে নি আর। এখনও বিশেষ কান্নাকাটি করল না। একটা কথা বলার জন্য বহুদিন ধরে ছটফট করছে সে–অনভ্যাসে লজ্জায় বলতে পারে নি। আজও সকাল থেকে কথাটা বলতে চেষ্টা করেছে বহুবার। এখন বলতে না পারলে আর বলাই হবে না কোনদিন। এ-ই শেষ সুযোগ বোধহয়। সে স্বামীর পায়ে একটা হাত রেখে সেই কথাটাই বলল, ‘আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, অনেক বাক্যি যন্ত্রণা অনেক গাল-মন্দ করেছি– আমার পাপের শেষ নেই। তোমার কাছে আজ ঘাট মানছি, তুমি মাপ করো আমাকে।
‘পাপ! আমারই পাপের কি শেষ আছে বড়বৌ!’ হঠাৎ যেন অভয়পদ তার কণ্ঠে খানিকটা জোর ফিরে পায়, ‘তোমার ওপর ছেলেদের ওপর চিরদিন অবিচার করেছি। আমিই তাদের সংসারে এনেছি–অথচ কোনদিন মানুষ করার চেষ্টা করি নি–অদৃষ্টের ওপর বরাত দিয়ে বসে ছিলুম। কিন্তু অদৃষ্টের ওপর সে বিশ্বাসও তো ছিল না, সেও তো মিথ্যে– নইলে এত হাঁকড়-পাকড় করে অধম্ম করে পয়সা রোজগার করতে যাব কেন, আর তুমিই বা এমন করে সর্বস্ব খোয়াবে কেন? আমি ঠগ বড়বৌ, আমি চোর জোচ্চোর মিথ্যেবাদী! সকলকে ঠকিয়েছি,–তোমাকে, ছেলেদের, জগৎ-সংসরকে ঠিকয়েছি,–নিজেকেও ঠকিয়েছি সেইসঙ্গে চিরদিন। আমার অন্যায়ের সীমা-পরিসীমা নেই। পারো তো তুমিই আমাকে মাপ করো।
জীবনে এত কথা তার স্বামী বোধহয় কোনদিন বলে নি তাকে, এমন নিনু হয়ে তো নয়ই। অত বড় শক্ত মানুষটার এই দুর্গতি দেখে আবারও চোখে জল এসে যায় মহাশ্বেতার। কথাগুলো সব বোঝে না সে– আকুতি ও আকুলতাটা বোঝে।
অভয়পদরও অত্যধিক মানসিক উত্তেজনার প্রবল প্রতিক্রিয়া হয়। চোখ বুজে হাঁপাতে থাকে সে। সে হাঁপানোর ধরন দেখে–বিশেষত আজ সকাল থেকে যে ক্ষীণ নিঃশ্বাস পড়ছিল, তারপর এই ঘন ঘন সশব্দ নিঃশ্বাসে মহাশ্বেতার ভয় হয় বুঝি শ্বাসই উঠছে।
কিন্তু সে ভয় পেয়েছে তা চোখ বুজেও বুঝতে আরে অভয়পদ। অতি কষ্টে একটা আঙ্গুল তুলে ওকে আশ্বস্ত করে। ইঙ্গিতে বুকটা দেখিয়ে দেয়। চিরদিন সমস্ত ভয়ে এই স্বামীই ওকে অভয় ও আশ্বাস দিয়ে এসেছে–আজও সে অভ্যাস যায় নি তার। এক সঙ্গে ভিড় করে সেই ছেলেবেলা থেকে আজ পর্যন্ত দীর্ঘ দাম্পত্যজীবনে ইতিহাস মনের সামনে এসে দাঁড়ায় মহাশ্বেতার। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই উদ্গত অশ্রু দমন করে কাছে সরে আসে সে, আস্তে আস্তে বুকে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। ….
সত্যিই কঙ্কালসার হয়ে গেছে হাড়-পাঁজরের খাঁজে যেন বিলুপ্ত হয়ে গেছে চামড়াটা। অমন বলিষ্ঠ মানুষটার এই পরিণতি! অভাগী রাক্ষসী সে, তার জন্যেই বোধ হয় এই হাল হ’ল। তারই দুর্বার লোভ–সেই সেই লোভই তাকে পিশাচী করে তুলেছিল। অগ্র-পশ্চাৎ ভাল-মন্দ কিছু ভাবে নি সে, ছিন্নমস্তার মতো নিজেই নিজের রক্তপান করেছে–মনের আনন্দে নিজের মহাসর্বনাশের সৌধ রচনা করেছে।
আবারও দু-চোখ জ্বালা করে জল ভরে আসে চোখে। এবার আর দমনও করতে পারে না তা–শুধু প্রাণপণে নিজের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে শব্দটা নিবারণ করে।
খানিকটা পরে দুজনেই সামলে ওঠে একটু। মহাশ্বেতা প্রায় চুপি চুপি প্রশ্ন করে, ‘প্রাচিত্তির করাবে একটা? ও বাড়ির মেজদি বলছিল–এ সময়, এ সময় নাকি করতে হয়।
‘না। প্রাচিত্তির অনেকদিন ধরেই হচ্ছে–তোমরা টের পাও নি। তুষানলে ধিকিধিকি পুড়লেও এর চেয়ে বেশি হ’ত না। ওসব লোক দেখানো প্রাচিত্তিরে আমার আর কি করবে?’
একটু পরে আবারও বলে আরও চুপি চুপি, ভগবানকে নিত্য ডেকেছি, বলেছি যদি আমার প্রাচিত্তির শেষ হয়ে থাকে তো এবার আমাকে নিয়ে নাও। কারুর সেবা না আমাকে নিতে হয় –গুয়ে-মুতে না পড়ে থাকি। মনে হচ্ছে তিনি মুখ তুলে চেয়েছেন এবার, প্রাচিত্তির শেষ হয়েছে।’
বিকেলে আবার অম্বিকাপদ কাছে এসে বসল। দুর্গাপদও। অম্বিকা চুপ করে মাটির দিকে চেয়ে বসে রইল–দুর্গাপদ দাদার পায়েহাত বুলোতে লাগল। অভয়পদ চোখ খোলে না, কিন্তু ওদের উপস্থিতি অজানা থাকে না, সেটা টের পায় ওরা।
মিনিট কতক পরে অম্বিকা বলে, কিছুই তো খাবে না বলছ, তা অন্য কোন ইচ্ছে- টিচ্ছে যদি থাকে–
এবার উত্তর দেয় অভয়। আরও ক্ষীণ হয়ে এসেছে কণ্ঠ, একটু যেন জড়িয়েও এসেছে। তবু বুঝতে পারে এরা। অভয় বলে, ‘ইচ্ছে।…. যা আছে তা আর মেটানো হয়ে উঠবে না। পরবে না তোমরা। বহুদিন থেকেই মনে ইচ্ছে ছিল, একবার আপিসের সেই জায়গাটা ঘুরে আসি।’
দুর্গাপদ বলে, ‘কিন্তু সে আপিস তো সেখানে নেই দীর্ঘকাল। ভেঙ্গে-চুরে সমতল হয়ে গেছে। সে তো অনেক দিন নেই বড়দা
‘জানি।’ শ্রান্তভাবে উত্তর দেয়, ‘সেই জায়গাটা– ‘
আর কিছু বলে না। সম্ভব নয়, তা এরাও বোঝে। তাই চুপ করে থাকে দুজনেই।
আরও খানিক পরে অম্বিকা বলে, ‘আমাকে কিছু বলতে চাও। কোন ভার দিয়ে যাবে?’
‘না। তোমাকে জানি, তুমি যত দিন বাঁচবে বড়বৌ আর ছেলেদের তুমি দেখবে। তারপর–ওদের অদৃষ্ট। কোন দিনই ওদের কথা ভাবি নি, আজই বা নতুন করে ভাবতে বসব কেন?’
‘আত্মীয়দের কাউকে দেখবে? খবর দেব?’
‘না না।’ এই অবস্থাতেও যেন চমকে ওঠে অভয়পদ, আমাকে চুপি চুপি যেতে দাও। শান্তিতে। কেউ না, কাউকেই দেখতে চাই না।’
এরপর যেন একেবারেই চুপ করে সে। দুর্গা কী সব প্রশ্ন করে, রাত্রে মহাশ্বেতা তড়িৎ সবাই এসে একটু দুধ খাবার জন্যে পেড়াপীড়ি করে–কিন্তু অভয় আর কথা কয় না, মুখও খোলে না। একেবারে নিথর হয়ে পড়ে থাকে।
শেষরাত্রের দিকে শ্বাস ওঠার লক্ষণ টের পাওয়া যায়।
টের পায় প্রমীলাই প্রথম। সে-ই ছুটে গিয়ে অম্বিকাকে ডেকে আনে। ছেলেদের ডেকে তোলে ঘুম থেকে। সবাই এসে ঘিরে দাঁড়ায়–কেবল ক্ষীরোদা ছাড়া। তাঁকে কেউ এ খবর জানায়ও নি।
এবার সবাই মিলে ধরাধরি করে নামানো হয় বেঞ্চির ওপর থেকে। তেশূন্যে মরতে নেই। মাটিতে শোয়ানোই নিয়ম। সাবধানেই তোলে কিন্তু তাও বোধ হয় টের পায় অভয়পদ। কে একজন ঠাকুরঘর থেকে চরণ-তুলসী এনে কপালে বুকে রাখে। অম্বিকা কাছে বসে গীতা পাঠ করে। দুর্গা বুড়োকে বলে তারক-ব্রহ্ম নাম শোনাতে। পাশে দাঁড়িয়ে বলে বলে দেয় সে-ই। ধনা ফোঁটা ফোঁটা করে চরণামৃত দেয় মুখে।
একেবারে ভোরবেলা হঠাৎ যেন চোখের পাতা দুটো নড়ে একু, ঠোঁটটাও ঈষৎ কাঁপতে থাকে। অম্বিকা হ্যারিকেনের আলোতেই তা লক্ষ করে। কানের কাছে মুখ এনে বলে, কিছু বলবে দাদা? কাউক কিছু বলতে চাও? বৌদিকে ডাকব?
‘গায়ত্রী–গায়ত্রীটা ভুলে গেলুম যে। বেঁচে থাকতেই–’
খুব আস্তে আস্তে বলে, শোনাই যায় না এমন ক্ষীণ স্বরে। যে দু-তিনজন ঝুঁকে পড়েছিল মুখের ওপর, তারাই শুনতে পেল। তাও কথাটা শেষ হ’ল না যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল–তেমনি হঠাৎই বন্ধ হয়ে গেল।
অম্বিকা জোরে জোরে গায়ত্রী মন্ত্র শোনাতে লাগল। শুনতে শুনতে সেই মৃত্যুপথযাত্রীর বিবর্ণ মুখও যেন উজ্জ্বল ও প্রসন্ন হয়ে উঠল। মনে হ’ল সে বুঝতে পারছে মন্ত্রটা, মনেও পড়েছে বোধ হয়। হয়ত নিজেও মনে মনে সে মন্ত্র উচ্চারণ করার চেষ্টা করছে।
কিন্তু সে দু-তিন মিনিটের বেশি নয়। তারপরই মাথাটা একদিকে কাৎ হয়ে হেলে পড়ল, দু-একবার পড়ে যাওয়া বদ্ধ ঠোঁট নড়ে ফুঁ ফু করে শ্বাস বেরিয়ে এল। তারপর সব স্থির হয়ে গেল।
কিছুই রইল না আর। কেবল প্রথম ঊষার ক্ষীণ আলোয় মনে হ’ল কিছু পূর্বের সেই প্রসন্ন দীপ্তিটা এখনও মুদিত দুই চোখের কোণে ও বদ্ধ ওষ্ঠের রেখায় লেগে আছে। মৃত্যুর কালিমা সে প্রসন্নতা নষ্ট করতে পরে নি।….
ক্ষীরোদার ভাল ঘুম হয় না আজকাল, মাঝে মাঝে তন্দ্রার মতো আসে শুধু। তেমনিই একটা আচ্ছন্নতা এসেছিল ভোরের দিকে। অকস্মাৎ প্রবল কান্নার রোল কানে যেতে চমকে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন তিনি। বুকের মধ্যেটা আকুলি-বিকুলি করে উঠল ভয়ে। দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই, নিচে নামতেও পারবেন না, শুধু সেইখানে বসেই অসহায় আকুল কণ্ঠে বার বার প্রশ্ন করতে লাগলেন, ‘হ্যাঁরে–ওরে অ অম্বিকা, অ দুগ!–ওরে অ ছেলেরা–এ কান্না কাদের বাড়ি উঠল রে। ওরে কে গেল রে এমন ভোরবেলা? আমার বাড়িতে কেউ গেল না তো? আমারই কোন সব্বনাশ হ’ল নাকি রে? আমার ছেলেগুলো আছে তো সব? আমার বড়ছেলে, আমার অভয় ভাল আছে তো রে?… ওরে তোরা কেউ আমাকে খবরটা দিয়ে যা না রে। আমি যে আর ভাবতে পারছি না।… ওরে অ ছেলেরা, বুড়ো, হাবলা, তোরা একটিবার কেউ আয় না রে–’
কাউকে দেখা যায় না, কোন সংবাদই পান না তিনি। অথর্ব বৃদ্ধার ব্যাকুল আহ্বানে কেউ ছুটে এসে ওপরে আসে না। সম্ভবত শুনতেও পায় না কেউ। তাঁর আর্ত আহ্বান ও কাতর প্রশ্ন শূন্য ঘরের চারটে দেওয়ালে ব্যর্থ মাথা কুটে যেন তাঁর কাছেই ফিরে আসে আবার। ক্রমশ খুঁৎ-ঋৎ করে কাঁদতে শুরু করেন তিনিও। কাঁদেন নিজের জন্যেই। সবাই তাঁকে অযত্ন অবহেলা অগ্রাহ্য করছে–সেইজন্যে। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন একটু পরে। শ্রান্তি থেকেই আচ্ছন্ন ভাবটা আসে আবার, একটু তন্দ্রার মতো বোধ হয়–ঘুমিয়েই পড়েন শেষ পর্যন্ত।
নিচের কান্নার রোলও তখন কিছুটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। ক্ষীরোদার ঘুমের বিশেষ ব্যাঘাত হয় না।