২২. শের শাহ কাজীর দুর্গ

শের শাহ কাজীর দুর্গ পরিদর্শনে গিয়েছেন। দুর্গপ্রাচীরের কামানগুলির অবস্থা কী দেখছেন। হঠাৎ একটি গোলাভরা কামান বিস্ফোরিত হলো। শের শাহ্ লুটিয়ে পড়লেন। মৃত্যুর আগে কিছুক্ষণের জন্যে তাঁর জ্ঞান ফিরল। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, আমি মারা যাচ্ছি। দিল্লীর সিংহাসন আমি প্রথম পুত্ৰ জালাল খাঁ’র জন্যে নির্ধারণ করেছি। পুত্ৰ জালাল খাঁ সিংহের মতো সাহসী। একমাত্র সে-ই পারবে মোঘলদের হাত থেকে সিংহাসন রক্ষা করতে। আমার মন বলছে হুমায়ূন হারানো সিংহাসন পেতে ফিরে আসবেন।

জালাল খাঁ ইসলাম শাহ নাম নিয়ে দিল্লীর সিংহাসনে বসলেন।

ইসলাম শাহ্ কাব্যানুরাগী মানুষ ছিলেন। নিজে শের লিখতে পারতেন না, যারা পারত। তাদের প্রতি তার ভালোবাসার সীমা ছিল না। মানুষ হিসেবে তার অন্য গুণাবলিও ছিল। মদ্যপান বা কোনো নেশাজাতীয় বস্তুর প্রতি তাঁর কোনো আকর্ষণ ছিল না।

শের শাহ সম্পূর্ণ হিন্দুস্থানের রাস্তাঘাট বানানোর যে কাজ শুরু করেছিলেন, ইসলাম শাহ সেই কাজ শেষ করতে চেয়েছিলেন।

দিল্লীর মানুষজন ইসলাম শাহকে পছন্দ করত।

 

মুণ্ডিত মস্তক শ্মশ্রুবিহীন মীর্জা কামরান দিল্লীর সম্রাট ইসলাম শাহ’র সামনে বসে আছেন। কামরানকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। ইসলাম শাহ রসিকতা করে বললেন, আপনাদের মহিলারাও কি আপনার মতো মাথার চুল কামিয়ে ফেলে?

কামরান সঙ্গে সঙ্গে বললেন, না। তারা আপনাদের মতো বিশাল গোফ রাখে।

ইসলাম শাহহাসতে হাসতে বললেন, আপনার রসবোধ দেখে মুগ্ধ হলাম। আপনি চমৎকার শের লেখেন জানতাম। রসিকতা করতে পারেন জানতাম না। আপনার একটি শের শোনান।

কামরান আবৃত্তি করলেন—

গর্দিশে গরদূনে গরদ না রা দর্গ কর্দ
বর সরে আহলে তমৗজা ওয়া নাকি সারা মর্দ কর্দ
(ললাটের এমনই লিখন যে সে শ্রেষ্ঠ জনকে মাটিতে মেশায়, যোগ্যদের মাথার উপর অযোগ্যদের বসায়)

ইসলাম শাহ্ গম্ভীর হয়ে বললেন, আপনি কি আমার প্রতি ইঙ্গিত করছেন?

কামরান বললেন, না। রসিকতা করলাম। একটু আগে আপনি আমার রসবোধের প্রশংসা করেছেন বলেই শেরের মাধ্যমে রসিকতা। আপনি নিজে খুব ভালো করে জানেন যোগ্যরাই থাকে। অযোগ্যরা ধুলায় মিশে যায়।

ইসলাম শাহ বললেন, আপনি নিজেকে কী ভাবেন? যোগ্য না অযোগ্য?

কামরান বললেন, সময় ঠিক করে দেবে আমি যোগ্য না অযোগ্য। তবে হুমায়ূন অযোগ্য তাতে সন্দেহ নাই।

ইসলাম শাহ্ বললেন, কান্দাহার যুদ্ধে আপনি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিলেন।

আমি বিভ্রান্ত ছিলাম। পারস্য-সম্রাট হুমায়ূনকে আমার হাতে তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। পারস্যবাহিনীকে দেখে আমি ভেবেছি তারা হুমায়ূনকে বন্দি করে নিয়ে আসছে।

কাবুলের যুদ্ধেও আপনি পরাজিত হয়েছেন।

এখানে আমার হিসাবে কিছু ভুল হয়ে গিয়েছিল। অতীতে দেখেছি যে-কোনো যুদ্ধে জয় লাভের পর হুমায়ূন পানাহারের উৎসব বসান। দিনের পর দিন উৎসব চলতে থাকে। আমি কল্পনাও করি নাই হুমায়ূন তৎক্ষণাৎ কাবুলের দিকে যাত্রা করবেন। আমি দুর্গ গোছানোর সময় পাই নাই।

ইসলাম শাহ্ বললেন, আমার কাছে কী চান?

ধার হিসাবে অর্থ চাই। চড়া সুদ দিতে আমি প্রস্তুত। সৈন্য সংগ্ৰহ করে আমি আবার কাবুল জয় করব। আমি কি অর্থ পেতে পারি?

ইসলাম শাহ বললেন, অবশ্যই অর্থ পেতে পারেন। ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ লেগে থাকলে আমার সুবিধা। আপনারা কামড়াকামড়ি করতে থাকবেন, আমি নির্বিয়ে সিংহাসনে বসে থাকব।

মীর্জা কামরান আগ্রহের সঙ্গে বললেন, কী পরিমাণ অর্থ সাহায্য আমি পেতে পারি?

ইসলাম শাহ্ হাই তুলতে তুলতে বললেন, পাঁচটি তাম্র মুদ্রা দিতে পারি। এতে চলবে?

মীর্জা কামরান হতভম্ভ হয়ে তাকিয়ে আছেন। ইসলাম শাহ্‌ বললেন, এতক্ষণ আপনি রসিকতা করছিলেন। এখন আমি রসিকতা করলাম।

কামরান বললেন, আপনি আমাকে কোনো সাহায্য করছেন না?

ইসলাম শাহ্ বললেন, আপনি যদি সম্পূর্ণ নিজের অর্থে এবং নিজের সামর্থে আবার কাবুল জয় করতে পারেন তবেই বুঝব আপনি যোগ্য। তখন সাহায্য করব। তার আগে না।

মীর্জা কামরান হনহন করে দরবার ত্যাগ করলেন। দরবারের অমাত্যরা ফিসফিস করে বলতে লাগলেন, ময়ুর! ময়ুর!

কোনো এক বিচিত্র কারণে কামরানের দরবারে ঢোকা এবং বেরুবার সময় তারা ‘ময়ূর, ময়ূর’ করেন।

 

বৈরাম খাঁ পারস্য সেনাবাহিনীর ওপর যথেষ্ট বিরক্ত। তারা শানশওকত এবং জৌলুস প্রদর্শনে যতটা উৎসাহী যুদ্ধে ততটা না। তাদের হাতের তরবারির ওজন অনেক বেশি। ওজনের কারণে তরবারি চালানোর ক্ষিপ্ৰতা তাদের নেই। কম ওজনের তরবারি দেওয়া হয়েছিল। ফলাফল আরও খারাপ। অনভ্যস্ততার কারণে হালকা তলোয়ার এরা চালাতেই পারে না।

সবচেয়ে বড় সমস্যা হস্তীবাহিনীর ভয়ে তারা ভীত। হিন্দুস্থানের যুদ্ধে হস্তীবাহিনী থাকবেই—এই সত্যটা পারস্যবাহিনীর মাথায় এখনো ঢোকে নি।

হুমায়ূন জানিয়েছেন, পারস্যবাহিনীর এখন আর তাঁর প্রয়োজন নেই। তারা যেন পারস্যে চলে যায়।

পারস্যবাহিনীর প্রধান বিনয়ের সঙ্গে জানিয়েছেন, তারা পারস্য ফিরে যেতে আগ্রহী না। বাকি জীবন তারা হুমায়ূনের সেবা করবে। তারা ফিরে যেতে চাচ্ছে না কেন তাও পরিষ্কার না।

 

হুমায়ূনের রাজকীয় কাফেলা এখন আছে ‘পাঞ্জশীরে’। জায়গাটা অতীব মনোরম। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা। ফলের বাগান। সবুজ মাঠ। ছোট ছোট টিলা। বনের ভেতর দিয়ে পাহাড়ি যে নদী গিয়েছে, তার জল কাকের চোখের মতো স্বচ্ছ। হুমায়ূনকে বেশির ভাগ সময় দেখা যায়। নদীর উপরের বড় পাথরের চাইয়ে বসে আছেন। হাতে মীর্জা কামরানের লাইব্রেরির কোনো একটা বই। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর বই পড়তেই এখন তিনি আগ্রহী। পারস্যে তিনি মানমন্দির দেখে এসেছেন। রাজ্য ফিরে পেলে পারস্যের মতো একটি মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করা তার গোপন বাসনা। আকাশে শুক্র গ্রহ দেখা গেলে ফজরের নামাজের সময় হয়। যখন গ্রহটি আর দেখা যায় না, তখন ফজরের নামাজের সময় শেষ। এই তথ্য তিনি পারস্য মানমন্দির থেকে জেনে এসেছেন। বিষয়টি এখনো পরীক্ষা করা হয় নি।

হুমায়ূন পাঠে মগ্ন। তার দুটি পা পানি স্পর্শ করে আছে। পানি শীতল। মাঝে মাঝেই তাকে পা পানি থেকে তুলতে হচ্ছে। হুমায়ূনের আনন্দময় সময়ে জওহর আবতাবচি দুঃসংবাদ নিয়ে উপস্থিত হলো।

মীর্জা কামরান আবার কাবুল দখল করেছেন এবং নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছেন।

হুমায়ূন বই বন্ধ করতে করতে বললেন, আফসোস। বৈরাম খাঁকে ডেকে নিয়ে আসো।

জওহর ছুটে যেতে গিয়ে পাথরে ধাক্কা খেয়ে পানিতে পড়ে গেল। হুমায়ূন তাকে টেনে তুলতে তুলতে বললেন, কোরান শরিফের একটি আয়াতে বলা হয়েছে হে মানব সম্প্রদায়! তোমাদের বড়ই তাড়াহুড়া। জওহর-তাড়াহুড়ার কিছু নেই। যা নিয়তিতে নির্ধারিত তা-ই হবে। তাড়াহুড়া করে কিছু হবে না।

 

পাশাপাশি দুটা পাথর। একটিতে হুমায়ূন বসেছেন, অন্যটিতে বৈরাম খাঁ। বৈরাম খাঁকে অত্যন্ত চিন্তিত দেখাচ্ছে। এত চিন্তিত তাকে সচরাচর দেখা যায় না। চিন্তার প্রধান কারণ হামিদা বানু এবং তাঁর শিশুপুত্ৰ আকবর কামরানের হাতে আটক হয়েছেন। এই খবর হুমায়ূন জানেন না। হামিদা বানু এবং আকবর ছিলেন কান্দাহার দুর্গে। কান্দাহার থেকে তারা কেন কাবুলে গেলেন, কখন গেলেন তা বৈরাম খাঁ জানেন না।

হুমায়ূন বললেন, আপনি এত চিন্তিত হবেন না। আমার ভাই আকবরের কোনো ক্ষতি করবে না। এটা তৈমুর বংশের ধারা।

জাহাঁপনা, বংশের ধারা সবসময় কাজ করে না।

আমার ভাইদের ক্ষেত্রে করবে।

বৈরাম খাঁ বললেন, আমি এই মুহুর্তেই রওনা হব। আপনি এখানেই থাকবেন। জায়গাটা আপনার পছন্দ হয়েছে। আপনি বিশ্রাম করুন। আপনার বিশ্রাম প্রয়োজন। সেনাবাহিনীর একটা বড় অংশকে রেখে যাচ্ছি। আপনার নিরাপত্তার জন্যে আপনি নিজেই যথেষ্ট। তারপরেও মীর্জা হিন্দাল থাকবেন।

হুমায়ূন বললেন, বৈরাম খাঁ, আমি আপনার সঙ্গে যাব। এখন পর্যন্ত এমন কোনো যুদ্ধ হয় নি যেখানে আমি যুদ্ধ পরিচালনা করি নি।

বৈরাম খাঁ বললেন, আপনি এখানেই থাকবেন। ভবিষ্যতে অনেক যুদ্ধ হবে। কোনোটাতেই আপনাকে অংশগ্রহণ করতে হবে না। যা করতে আপনার পছন্দ। আপনি তা-ই করবেন। বই পড়বেন, ছবি আঁকবেন, গান শুনবেন। এখন আপনার অনুমতি পেলে আমি যুদ্ধযাত্রা করি?

সম্রাট হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।

 

মীর্জা কামরানের বিশেষ দূত এসেছে ইসলাম শাহ’র কাছে। দূতের কাছে পত্রে কামরান লিখেছেন–

হাস্য পরিহাসে পটু
দিল্লীর সিংহাসনের মালিক
ইসলাম শাহ্
জনাব,

আপনার সাহায্য এবং মূল্যবান পরামর্শ ছাড়াই আমি কাবুল দখল করেছি। আগের ভুল এ দফায় করি নাই। দুর্গ দুর্ভেদ্য। হুমায়ূনের অপদাৰ্থ পারস্যসৈনিকরা কিছুই করতে পারবে না।

কাবুল দখল করলে আপনি আমাকে সাহায্য করবেন বলেছিলেন। এখন সাহায্য করুন।

আপনার জন্যে একটি শের পাঠালাম। কাবুল দুর্গ দখলের পরপর এই শেরটি আপনাতেই আমার মাথায় আসে

রাজ্য হলো এমন এক রূপসী তরুণী
যার ঠোঁটে চুমু খেতে হলে
সুতীক্ষ্ণ তরবারির প্রয়োজন হয়।

হুমায়ূন। এখন কোথায় আছেন আমি জানি। আপনার সাহায্য পেলেই তাকে শিকল পরিয়ে আপনার সামনে উপস্থিত করব। আপনি তাঁর সঙ্গে রঙ্গ-রসিকতা কিংবা কাব্য আলোচনা করতে পারেন। হুমায়ূন কাব্য আলোচনায় বিশেষ পারদর্শী।
ইতি
মীর্জা কামরান

ইসলাম শাহ্‌ মীর্যা কামরানের দূতের হাতে পাঁচটি তাম্রমুদ্রা দিয়ে দিলেন।

 

মীর্জা কামরান দুর্গ রক্ষায় নতুন পরিকল্পনা করেছেন। দুর্গের ভেতর শুধু কামানচিন্দের রাখা হয়েছে। তারা দুর্গপ্রাচীরের চারদিকেই কামান বসিয়েছে।

কামরানের মূল সৈন্যবাহিনী দুর্গের বাইরে গোপনে অবস্থান করছে। বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্বয়ং মীর্জা কামরান।

বৈরাম খাঁ ঘোড়সোয়ার বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসছেন—এই খবর পাওয়া গেছে। বৈরাম খাঁ দুৰ্গ আক্রমণের পর কামান দাগা শুরু হবে। দুর্গের ভেতর থেকে গোলাবর্ষণ বন্ধ হওয়ামাত্র মীর্জা কামরান পেছন থেকে আক্রমণ করবেন। তাঁর মূল লক্ষ্য থাকবে হুমায়ূনকে হত্যা করা। গত কয়েকবারের যুদ্ধে দেখা গেছে, বৈরাম খাঁ’র প্রধান চেষ্টা থাকে হুমায়ূনকে মূল যুদ্ধের বাইরে রাখা। এবারও তাই হবে। হুমায়ূন থাকবেন কামানের গোলার সীমানার বাইরে। পেছন থেকে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়া সহজ হবে।

যুদ্ধ এবং প্রেমে কোনোকিছুই পরিকল্পনামতো হয় না। বৈরাম খাঁ সঙ্গে হুমায়ূনকে আনেন নি। এবং তিনি দুর্গ আক্রমণ করলেন না। কামানের গোলার সীমানার বাইরে অবস্থান নিলেন। নিজের কামানগুলি দুর্গ বরাবর তাক না করে তার সৈন্যদলের পেছনে বসালেন যেন শক্ৰ পেছন থেকে আসতে না পারে। দুৰ্গ লক্ষ্য করে কামান দাগাও যাচ্ছে না। শিশু আকবর সেখানে আছে, গোলার আঘাতে তার ক্ষতি হতে পারে।

মীর্জা কামরান দ্রুত নতুন পরিকল্পনা করলেন। তিনি হুমায়ূন যেখানে আছেন সেখানে চলে যাবেন। বৈরাম খাঁ দুর্গ জয়ে ব্যস্ত থাকবে, তিনি ঝাঁপিয়ে পড়বেন হুমায়ূনের শিবিরে।

বৈরাম খাঁ ফজর ওয়াক্তে তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই দুর্গ দখল করলেন। সেদিন ছিল শুক্রবার। মসজিদে হুমায়ূনের নামে খুৎবা পাঠের শেষে শিশু আকবর এবং হামিদা বানুকে নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন।

 

রাতের প্রথম প্রহর। তাঁবুর বাইরে হুমায়ূন গালিচা পেতে বসেছেন। আফিম সেবন করবেন, তার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। হুমায়ূনের মন খানিকটা বিক্ষিপ্ত। কাবুল জয়ের কোনো খবর এখনো তার কাছে পৌঁছায় নি। এই মুহুর্তে তিনি জোনাকি দেখছেন। এই অঞ্চলের মতো জোনাকি আর কোথাও তিনি দেখেন নি। শত শত জোনাকি দল বেঁধে ঘুরছে। বিশেষ বিশেষ মুহুর্তে সবাই একসঙ্গে আলো নিভিয়ে দিচ্ছে। তখন মনে হয় কোনো জোনাকি নেই। আবার তারা আলো জ্বালাচ্ছে।

জোনাকি পোকা অনুসরণ করতে গিয়ে নতুন খাটানো ছোট্ট একটা তাঁবুর দিকে হুমায়ূনের চোখ গেল। বিশেষত্বহীন তাঁবু, কিন্তু ছয়জন সৈনিক তাঁবুটি পাহারা দিচ্ছে। তিনি জওহরকে বললেন, তাঁবুটা করি?

জওর বলল, বৈরাম খাঁ’র।

তাঁবুর চারদিকে পাহারা কেন?

জানি না জাহাঁপনা।

অনুসন্ধান করো।

আপনার অনুমতি ছাড়াই আমি অনুসন্ধানের চেষ্টা চালিয়েছিলাম। সৈনিকরা আমাকে তাঁবুর কাছে যেতে দেয় নাই।

হুমায়ূন উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর রহস্য ভেদ করে তিনি আফিন নিয়ে বসবেন। তাঁকে খানিকটা চিন্তিত মনে হলো।

হুমায়ূন বললেন, তাঁবুর ভেতর কী?

সৈনিকরা বলল, তাঁবুর ভেতর একজন কেউ আছে। সে কে আমরা জানি না জাহাঁপনা। বৈরাম খাঁ তাকে তাঁবুতে রেখেছেন। আমাদের ওপর নির্দেশ সে যেন পালিয়ে যেতে না পারে এবং কেউ যেন তাঁবুতে ঢুকতে না পারে। গেলেন। অবিকল তার মতো দেখতে এবং তার সাজ পোশাকে একজন কে তাঁবুর ভেতরে চারপাই-এ বসে আছে। সে সম্রাটকে দেখে উঠে দাঁড়াল এবং কুর্ণিশ করল। হুমায়ূন বলল, তুমি কে?

জাহাঁপনা আমি একজন তুর্ক। আমার নাম হামজা।

তুমি দেখতে অবিকল আমার মতো এটা জানো?

জানি জাহাঁপনা। এই জন্যেই আমাকে আটকে রাখা হয়েছে।

তুমি দেখতে আমার মতো এটা কোনো অপরাধ হতে পারে না। ঘটনা আমাকে খুলে বলো।

জাহাঁপনা, আমি দুসরা হুমায়ূন। যদি কোনো দুৰ্ঘটনায় আপনার প্রাণহানি হয়, তখন আমাকে দেখিয়ে বলা হবে হুমায়ূন জীবিত। সৈন্যদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি যাতে না হয় সেই ব্যবস্থা।

তোমার পেশা কী?

জাহাঁপনা, আমি একজন মুচি। পাদুকা সেলাই করি।

আরেকজন পাদুকা সেলাই করে। কী আশ্চর্য! তুমি আজ রাতে আমার সঙ্গে খানা খাবে।

জাহাঁপনা, এই তাঁবুর বাইরে যাওয়ার আমার হুকুম নাই।

তোমার জন্মতারিখ কী?

আমার মতো মানুষদের জন্মতারিখ কেউ রাখে না জাহাঁপনা।

বিবাহ করেছ?

জি জাহাঁপনা।

স্ত্রীর নাম কী?

যদি গোস্তাকি না নেন। তাহলেই স্ত্রীর নাম বলতে পারি।

গোস্তাকি নেব না।

আমার স্ত্রীর নাম হামিদা।

হুমায়ূন বিড়বিড় করে যে শের আবৃত্তি করলেন তার অর্থ–

বিশ্বের বিপুল রহস্যের আমরা যেটুকু জানি
তাও রহস্যে ঢাকা।।

নিজ তাঁবুতে ফিরে তেমন কোনো কারণ ছাড়াই হুমায়ূন অসুস্থ হয়ে পড়লেন। প্রবল জ্বরে তাঁর শরীর কাঁপতে লাগল। বিকারের ঘোরে বারবার ডাকতে লাগলেন, আকিকা বেগম! তুমি কোথায়? আকিকা!

 

সবাই যখন হুমায়ূনকে নিয়ে ব্যস্ত ঠিক তখনই মীর্জা কামরান তাঁর বাহিনী নিয়ে উপস্থিত হলেন। অতর্কিত আক্রমণে হুমায়ূনের বাহিনী হকচকিয়ে গেল। মীর্জা কামরান ব্যূহের ভেতর ঢুকে পড়ল। যে-কোনো মুহূর্তে হুমায়ূনের তাঁবু আক্রান্ত হবে এমন অবস্থা।

হুমায়ূনকে রক্ষার জন্যে মীর্জা হিন্দাল এগিয়ে গেলেন। মীর্জা কামরান যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেলেন, তবে একা গেলেন না। তাঁর ছোটভাইয়ের প্ৰাণ সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। মীর্জা হিন্দাল যুদ্ধে নিহত হলেন।

বৈরাম খাঁ শিশু আকবর, তার মা হামিদা বানু এবং হুমায়ূন-মাতা মাহিম বেগমকে নিয়ে ফিরলেন পরদিন ভোরে।

বৈরাম খাঁ’র মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। হুমায়ূন অচেতন, মীর্জা হিন্দল নিহত। সৈন্যবাহিনী লণ্ডভণ্ড।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *