২২. শুদ্ধতম মানুষ হতে চাই

শুভ্ৰ তোর না-কি শরীর খুব খারাপ?

জাহানারা ছেলের ঘরে ঢুকে হাহাকারের মতো প্রশ্নটা করলেন। শুভ্ৰ দেয়ালের দিকে মুখ দিয়ে শুয়েছিল। মার দিকে ফিরুল। হাসল। বালিশের পাশে রাখা চশমা চোখে দিতে দিতে বলল, শরীর সামান্য খারাপ।

জাহানারা হাত বাড়িয়ে ছেলের কপাল স্পর্শ করলেন। গা জুরে পুড়ে যাচ্ছে। জুরের ঘোরে শুভ্রর মুখ লালচে হয়ে আছে। শরীর সামান্য কাঁপছে। জাহানারা বললেন, তোর গা তো পুড়ে যাচ্ছে রে।

শুভ্ৰ বলল, গা পুড়ে যাওয়াইতো ভাল মা। অনেক ধাতু আছে আগুনে পুড়িয়ে শুদ্ধ করা হয়। আমাকেও করা হচ্ছে। তুমি এমন অস্থির হয়ে না। কোনো ছুটাছুটি না, ডাক্তার ডাকাডাকি না। তুমি চুপ করে আমার পাশে বসে থাক।

ডাক্তার ডাকব না? তুই এইসব কী বলছিস?

জ্বরটা আমার ভাল লাগছে। কেমন যেন ঘোরের মতো হয়েছে। চোখ বন্ধ করলে মনে হয় খাটটা দুলছে, আবার চোখ খুললে দেখি সব ঠিক আছে। জড়ানো গলায় কথা বলছি। নিজের জড়ানো গলার স্বর শুনতেও ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে অচেনা একজন কেউ কথা বলছে। মা দাঁড়িয়ে থেকে না। বস।

জাহানারা বসলেন। শুভ্ৰ তার হাত ধরে ফেলে ছেলেমানুষী গলায় বলল, তোমাকে এ্যাৱেষ্ট করে ফেললাম। এখন আর যেতে পারবে না।

সন্ধ্যা মিলিয়েছে। শুভ্রর ঘরে টেবিলের ওপর টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। ঘরের দুটো জানালাই বন্ধ। ঘরের ভেতর কেমন দমবন্ধ গুমটি ভাব। মাথার ওপর ফ্যান অবশ্য ঘুরছে। ফ্যানের বাতাসে গুমটি দূর হচ্ছে না। জাহানারা বললেন, হাতটা ছাড়, আমি থার্মোমিটার এনে জ্বরটা দেখি।

জ্বর দেখতে হবে না। তুমি চুপ করে বসে থাক। আমার জ্বর কত আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি- একশ তিন-এর সামান্য বেশি। ছোটবেলায় যখন আমার জ্বর আসতো তুমি আমার মাথার কাছে বসে গুটুর গুটুর করে নানান গল্প করতে। আমার খুবই ভাল লাগতো। জ্বর হবার জন্যে মনে মনে অপেক্ষা করতাম।

কী অদ্ভুত কথা বলছিস? জ্বর না হলে আমি বুঝি গল্প বলতাম না? শুভ্রর সম্ভবত নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সে বড় বড় শ্বাস নিয়ে সহজ হল। জাহানার শাড়ির আঁচলে চোখ মুছছেন। তাঁর ফোঁপানির শব্দ আসছে।

বলতে। কিন্তু আমার জ্বরের সময় তোমার গল্পগুলো হতো অন্য রকম। খুব মায়া নিয়ে গল্প বলতে।

জাহানারা ধরা গলায় বললেন, বেটারে আমি যখন তোর সঙ্গে কথা বলি মায়া নিয়েই বলি। আমার মনে হয় না পৃথিবীর কোনো মা তার ছেলের সঙ্গে এতো মায়া নিয়ে কথা বলে। তুই কি আমার কথা বিশ্বাস করছিস না?

করছি।

জাহানারা শুভ্রর কপালে হাত দিলেন। শুভ্র বলল, ইস তোমার হাতটা কী ঠাণ্ডা!

তুই চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাক। আমি তোর কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।

শুধু হাত বুলিয়ে দিলে হবে না গল্প বলতে হবে।

আমার দূরসম্পর্কের এক খালার গল্প শুনবি?

যাকে জীনে ধরে সুপারি গাছের মাথায় বসিয়ে রেখেছিল। এই গল্প দশবার করে শুনে ফেলেছ- অন্য গল্প বল।

শুভ্ৰ চোখ বন্ধ করে আছে। জাহানারা গল্প মনে করার চেষ্টা করছেন। মজার কোনো গল্পই মনে পড়ছে না।

তার ভাগ্যটাই এমন। প্রয়োজনের সময় কিছু মনে পড়ে না। ছেলেটার শরীর খারাপ। অগ্রহ করে গল্প শুনতে চাচ্ছে অথচ কোনো গল্প মনে আসছে না। বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলা যাবে না। শুভ্ৰ ধরে ফেলবে।

শুভ্ৰ কত হয়ে মার দিকে তাকাল। জাহানারা বললেন, মাথায় জলপট্টি দিতে দিতে গল্প বলি?

শুভ্ৰ বলল, না। তুমি নড়বে না। মা শোন, আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন এক বুড়ো ভদ্রলোক আমাকে মজার মজার গল্প বলতেন।

কার কথা বলছিস?

বাবার অফিসে কাজ করতেন। তুমি তখন খুব অসুস্থ। ভদ্রলোকের দায়িত্ব ছিল আমাকে স্কুল থেকে অফিসে নিয়ে আসা। আমরা রিকশা করে আসতাম। সারাপথ তিনি গল্প করতেন।

ও।

ভদ্রলোককে তুমি চিনতে পারছ?

না, আমি কীভাবে চিনব? তোর বাবার অফিসের কাউকে আমি চিনি না।

শুভ্ৰ চোখ বন্ধ করে খুবই শান্ত গলায় বলল, ঐ বুড়ো ভদ্রলোক একবার আমাকে আমাদের ভয়ঙ্কর বাড়িগুলিতে নিয়ে গিয়েছিলেন। খারাপ মেয়েগুলির কাছে।

জাহানারা আতঙ্কিত গলায় বললেন, তুই কী বলছিস! কী সর্বনাশের কথা!

শুভ্ৰ শান্ত স্বরে বলল, খারাপ বাড়ির খুব রূপবতী একটা মেয়ে তখন আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কান্নাকাটি করে। ঐ মেয়েটার কিছুই আমার মনে নেই। শুধু তার গায়ের গন্ধ মনে আছে।

জাহানারা বললেন, এইসব কথা আমাকে তখন বলিস নি কেন?

শুভ্ৰ হালকা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বুড়ো ভদ্রলোক কাউকে কিছু বলতে নিষেধ করেছিলেন। ঐ বুড়ো মানুষটাকে আমি অসম্ভব পছন্দ করতাম। তাঁর নিষেধ আগ্রাহ্য করার প্রশ্নই উঠে না। মা শোন, তখন আমি ছোট ছিলাম। কিছুই বুঝতাম না। এখনো যে খুব বেশি বুঝি তা না। তবে এখন দুই-এ দুই-এ চার মেলাতে পারি। এখন জানি আমার জন্ম হয়েছিল ঐ ভয়ঙ্কর বাড়িগুলির একটিতে। ঐ রূপবতী মেয়েটি ছিল আমার মা। বুড়ো ভদ্রলোক কিছুক্ষণের জন্যে আমাকে আমার মার কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন।

জাহানারা কাঁদো কাদো গলায় বললেন, তুই যা ভাবছিস সব মিথ্যে। আমি তোকে পেটে ধরেছি। তুই আমার সন্তান। ছেলে। সবাই এটা জানে।

শুভ্র সহজ গলায় বলল, মা আমি অবশ্যই তোমার সন্তান। সন্তান হতে হলে পেটে ধরতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমি হলাম মূর্তিমান পাপ। এই পাপকে তুমি গভীর মমতায় বুকে তুলে নিয়েছ। তুমি আমার কাছে পৃথিবীর শুদ্ধতম রমণী। আমি যদি আরো একশবার পৃথিবীতে জন্মাই এবং আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, শুভ্ৰ তুমি কোথায় জন্ম নিতে চাও? আমি অবশ্যই বলব আমি যেখানেই জন্মাই না কেন আমাকে কোনো-না-কোনো সময় যেন আমার মার কোলে পৌঁছে দেয়া হয়। সেই মা তুমি।

জাহানারার শরীর কাঁপছে। তিনি চোখে অন্ধকার দেখছেন। শুভ্ৰ মার দিকে আরেকটু ঘেঁসে এসে বলল, সত্যিকার ভালবাসা মানুষকে পবিত্র করে। তোমার ভালবাসায় আমি পবিত্র হয়েছি। বাবাকে তুমি কখনোই ভালবাসতে পার নি বলে বাবাকে পবিত্র করতে পার নি। তুমি ইচ্ছা করলেই পারতে।

শুভ্ৰ চুপ করে থাক।

আমার কথা বলতে ইচ্ছা করছে। জ্বরের সময় মানুষ ঘোরের মধ্যে চলে যায়। তখন প্রচুর কথা বলতে ইচ্ছা করে। আমারও তাই হয়েছে। জ্বরটা মাথায় ঢুকে পড়েছে।

জাহানারা ছেলের মাথায় হাত রেখে চমকে উঠলেন। জ্বর দ্রুত বাড়ছে। শরীর দিয়ে তাপ বের হচ্ছে।

শুভ্ৰ বলল, ভয়ঙ্কর বাড়িগুলিতে আমি যাই। চুপচাপ বসে থাকি। কী অদ্ভুত যে আমার লাগে! এইখানে আমার জন্ম। কী আশ্চর্য!

শুভ্ৰ, অন্য কথা বল।

অন্য কী কথা? সুন্দর কিছু? যার জন্ম হয়েছে অসুন্দরে সে সুন্দর কিছু কীভাবে বলবো? তাছাড়া আজ আমার মনটাও খারাপ।

মন খারাপ কেন?

আসমানী বলে একটা মেয়ে ছিল। খারাপ মেয়ে। মেয়েটার অসম্ভব বুদ্ধি। মেয়েটা মারা গেছে।

কীভাবে মারা গেছে?

মারা গেছে এটাই মূল কথা। কীভাবে মারা গেছে সেটা মোটেই গুরুত্বপূর্ণনা। শুনেছি বিষ খেয়ে মারা গেছে। আবার কেউ কেউ বলছে তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। ঐসব জায়গায় জন্ম যেমন গুরুত্বহীন মৃত্যুও গুরুত্বহীন।

গুরুত্বহীন হলে তুই মন খারাপ করছিস কেন?

গুরুত্বহীন কেন এটা ভেবেই মন খারাপ করছি। তবে এই মন খারাপ বেশিক্ষণ থাকবে না। রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে যদি নোংরা কিছুর উপর পা পড়ে তখন সারা শরীর ঘিনীঘিন করতে থাকে। নোংরাটা ধুয়ে ফেলতেই ঘিনঘিনে ভাব দূর হয়ে যায়। কিন্তু মা রাস্তার ঐ নোংরাটা কিন্তু দূর হয় না। থেকেই যায়।

শুভ্ৰ, তোর জ্বর খুব বেড়েছে। একজন ডাক্তারকে খবর দেই?

দাও। আর শোন মা, বিনুকে একটু পাঠাও।

জাহানারা ছেলের ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে আবার কেন জানি শান্তি শান্তিও লাগছে। তাঁর বুকের উপর ভয়ঙ্কর একটা পাথর চেপে বসে ছিল। মনে হচ্ছে সেই পাথরটা নেই।

 

বিনুকে ঘরে ঢুকতে দেখেই শুভ্র বলল, বিনু তুমি কেমন আছ?

বিনু বলল, ভাল। শুভ্র বলল, আমি ভাল নেই। আমার খুব জ্বর। তুমি আমার সামনের এই চেয়ারটায় বস।

বিনু বসল।

শুভ্ৰ জড়ানো গলায় বলল, বিনু তুমি একবার বলেছিলে না আমি নিম্নশ্রেণীর মানুষ? তোমার কথা ঠিক না। আমি জন্মসূত্রে নিম্নশ্রেণীর তো বটেই কিন্তু আমাকে বদলে ফেলা হয়েছে। নিজেকে আমি শুদ্ধ ও পবিত্র মানুষ বলে মনে করছি।

বলতে বলতে শুভ্ৰ উঠে বসতে চেষ্টা করল। পারল না। বিছানায় শুয়ে হাঁপাতে লাগল।

বিনু শান্ত গলায় বলল, আপনি এত অস্থির হচ্ছেন কেন? আপনি নিজেকে যা মনে করেন। আপনি তাই। আপনি কী তা বের করা একমাত্র আপনার পক্ষেই সম্ভব।

বিনু আমি ঠিক করেছি একটা আশ্ৰম দেব! দুঃখী মেয়েরা যাদের কোথাও যাবার জায়গা নেই তারা এসে এই আশ্রমে আশ্রয় নেবে। আমি খুব খুশি হব। তুমি যদি এই আশ্রমটা তৈরির ব্যাপারে আমাকে সাহায্য কর। আমার বুদ্ধি কম। কাজেই আমাকে সাহায্য করার জন্যে খুব বুদ্ধিমান কিছু মানুষ দরকার।

আপনার কোনো সাহায্য লাগবে না। আপনি একাই পারবেন।

না, পারব না। বিনু মন দিয়ে শোন— আমি কয়েকদিন হল চোখে কিছুই দেখছি না। তুমি হয়ত লক্ষ কর নি। আমি এখন সারাক্ষণ চশমার কাচ ঘষাঘষি করি। মনে মনে ভাবি— চশমার কাচ পরিষ্কার করে কিছু হবে। আমি ডাক্তারের কাছেও গিয়েছিলাম। আমি যা আশঙ্কা করছিলাম ডাক্তারও তাই বললেন।

বিনু তাকিয়ে আছে। তার চোখে গভীর বিষাদ এবং গভীর বিস্ময়।

শুভ্র সহজ গলায় বলল, আমি এমনভাবে চলাফেরা করছি যেন কেউ কিছু বুঝতে না পারে, বিশেষ করে মা। উনি সব সহ্য করতে পারবেন; আমি চোখে দেখতে পারছি না, এটা সহ্য করতে পারবেন না। বিনু, আশ্রম তৈরিতে তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে?

করব।

বিনু তোমাকে একটা কথা বলতে ইচ্ছা করছে! কথাটা হল— আমি প্রতিরাতে ঘুমুতে যাবার আগে কিছুক্ষণ ক্যাসেটে তোমার রেকর্ড করা হাসি শুনতাম। না শুনলে আমার ঘুম হত না। এমন কোনো রাত নেই যে তোমার হাসি আমি শুনি নি।

কাল রাতে শুনেন নি।

হ্যাঁ ঠিক বলেছ। কালরাতে শুনি নি। আমার এই ব্যাপারটা তুমি জানতে?

আপনার সবকিছুই আমি জানি।

বিনু এগিয়ে এসে শুভ্রর কপালে হাত রাখল। এবং হাত সরিয়ে নিল না। শুভ্র মনে মনে বলল— মার ভালবাসায় আমি এতদূর এসেছি। এখন নিজেকে সমর্পণ করলাম তোমার কাছে। তুমি তোমার ভালবাসা দিয়ে আমাকে পবিত্র করা। আমি শুদ্ধতম মানুষ হতে চাই।

1 Comment
Collapse Comments
হামিদুল August 26, 2021 at 4:17 pm

one of the best suvro..

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *