২২. শারমিনের গায়ে-হলুদ

আগামীকাল শারমিনের গায়ে-হলুদ।

শারমিন আয়নার সামনে অনেকক্ষণ ধরেই বসে আছে। অয়নায় নিজেকে চেনা যাচ্ছে না। কোথায় যেন পড়েছিল, বিয়ের ঠিক আগে আগে সব মেয়েই অচেনা হয়ে যায়। তাদের চোখ হয় আরো কালো। চেহারায় সম্পূৰ্ণ ভিন্ন ধরনের ঔওফুল্য আসে। বিয়ে হবে-হবে মেয়েরা বারবার আয়নায় নিজেদের দেখে। কথাটা আংশিক সত্যি।। শারমিন আয়নায় নিজেকে চিনতে পারছে না, তবে আয়নার সামনে বসে থাকতে ও ভালো লাগছে না।

জামিলার মা এসে বলল, আপনারে ডাকে?

কে ডাকে?

বড়ো সাহেব।

বল, আসছি।

শারমিন নড়ল না। যেভাবে বসে ছিল ঠিক সেভাবেই বসে রইল। বাড়িভতি মানুষ! কিছুক্ষণ আগেই দুটি মেয়ে বারান্দায় ছোটাছুটি করছিল। শারমিন শেষ পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছে, তোমরা নিচে যাও কিংবা ছাদে যাও, আমার মাথা ধরেছে। বাবার উপর রাগ লাগছে খানিকটা। এক মাস আগে থেকে লোকজন দিয়ে বাড়ি ভর্তি করবার কোনো দরকার ছিল না। এবং এদের কাণ্ডজ্ঞানও নেই, এত দিন আগে কেউ আসে। অন্যের বাড়ি?

আফা।

শারমিন বিরক্ত মুখে তাকাল। জামিলার মা আবার এসেছে। তার মুখ হাসি-হাসি। ঠোঁট লাল টুকটুক করছে। গায়ের লালপেড়ে সাদা শাড়িটিও নতুন। বিয়ে উপলক্ষে সবাই নতুন শাড়ি পেয়েছে। দুটি করে শাড়ি। একটি সাধারণ লালপেড়ে সাদা শাড়ি, অন্যটি দামী শাড়ি।

আফা, আপনেরে ডাকে।

বলছি তো যাব।

বড়োসাবোচা লইয়া বইস্যা আছে।

শারমিন উঠে দাঁড়াল। এমন বিরক্তি লাগছে! শুধু বিরক্তি নয়, মাথাও ধরেছে। তীব্র ও তীক্ষ্ণ ব্যথা। চারটা প্যারাসিটামল খাওয়া হয়েছে ছ ঘণ্টার মধ্যে। যন্ত্রণা ভোঁতা হয়ে এসেছে, কিন্তু তবু মাঝে মাঝে চিড়িক দিয়ে উঠছে।

রহমান সাহেব চায়ের পট নিয়ে হাসিমুখে বসে আছেন। শারমিনকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, এমন একটা সাধারণ শাড়ি পরে ঘুরছি কেন মা?

শারমিন জবাব দিল না।

নাও, চা নাও।

চা খেতে ইচ্ছা করছে না।

ইচ্ছা না করলেও খাও! বাবাকে কম্প্যানি দাও! এখন তো আর আগের মতো তোমাকে পাব না।

পাবে, সব সময়ই পাবে। আমি সব সময় তোমার মেয়েই থাকব বাবা।

বলতে বলতে শারমিনের গলা ভারি হয়ে এল। রহমান সাহেব দেখলেন, শারমিন কাঁদছে। তিনি কী বলবেন ভেবে পেলেন না। বাবার কাছে মেয়ের বিয়ে কোনো আনন্দের ব্যাপার নয়। বিয়ের দিনটি হচ্ছে বাবা-মার জীবনের গভীরতম বিষাদের দিন। এই বিষাদ ভোলবার জন্যেই আনন্দ ও উল্লাসের একটা ভান করা হয়। রহমান সাহেব গাঢ় স্বরে বললেন, মা-মনি, চা খাও।

শারমিন পেয়ালা হাতে নিয়ে চুমুক দিতেই টুপ করে এক ফোঁটা চোখের জল পড়ল কাঁপে। রহমান সাহেব দৃশ্যটি দেখলেন। তাঁর নিজেরও ইচ্ছা করল। ছুটে কোথায়ও পালিয়ে যেতে। মানুষের বেশির ভাগ ইচ্ছাই অপূর্ণ থাকে। ছুটে যেতে ইচ্ছা করলেও ছুটে যাওয়া যাবে না। তাঁকে বসে থাকতে হবে এখানেই।

শারমিন।

বল বাবা।

তোমাকে না জানিয়ে একটা কাজ করেছি। মা।

শারমিন তাকাল।

পুলিশের ব্যাণ্ড পার্টি আনিয়েছি। গ্রাম থেকে অনেকেই এসেছে, ওরা খুশি হবে। ব্যাণ্ড পার্টির অনেক কায়দা কানুন আছে তো। এক জন ব্যাণ্ড মাস্টার থাকে, সে রুপো-বাঁধানো লাঠি নাড়াচাড়া করে। আমার নিজেরই দেখতে এমন চমৎকার লাগে!

রহমান সাহেব হাসলেন। হাসল শারমিনও।

ওরা কখন আসবে?

আজ বিকেলে আসবে। আবার কালও আসবে। কেমন হবে বল তো মা?

ভালোই হবে।

মোতারের সাহেব বলছিলেন ব্যাণ্ড না এনে সানাইয়ের ব্যবস্থা করতে। একটা স্টেজের মতো থাকবে, সেখানে বসে বসে সানাই বাজাবে। কাউকে সে-রকম পাওয়া গেল না। তা ছাড়া সানাই বড়ো মন খারাপ করিয়ে দেয়। মেয়ে বিয়ে এমনিতেই বাবা-মার জন্যে যথেষ্ট মন খারাপ করার মতো ব্যাপার, সেটাকে আর বাড়ানো ঠিক না, কী বল মা?

শারমিন জবাব দিল না। রহমান সাহেব সিগারেট ধরালেন। কয়েক দিন ধরেই তিনি খুব সিগারেট খাচ্ছেন। প্রায় চেইন ক্ষোকার হয়ে গেছেন!

শারমিন বলল, আমি এখন উঠি বাবা?

এখনই উঠবে কী, বস একটু।

ভালো লাগছে না। বাবা। জ্বর-জ্বর লাগছে।

তিনি মেয়ের হাত ধরলেন। জ্বর নেই, গা ঠাণ্ডা হয়ে আছে।

শারমিন।

কি বাবা?

তিনি খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বললেন, একটা কথার ঠিক জবাব দাও তো মা। তাকাও আমার চোখের দিকে। তাকাও, তারপর বল!

শারমিন তাকাল তার বাবার চোখের দিকে। রহমান সাহেব থেমে থেমে বললেন, সাব্রিরিকে কি তোমার পছন্দ হচ্ছে না?

পছন্দ হবে না কেন? তাঁকে পছন্দ না করার মতো কিছু নেই।

আমিও তাই বলি। জমিলার মা বলল, তুমি গতকাল সারা রাত ঘুমেও নি। বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছিলো।

ঘুম আসতে একটু দেরি হয়েছে। যা গরম!

আমাকে ডাকলে না কেন?

তোমাকে ডাকলে কী হত?

দুজনে মিলে গল্প করতাম।

আজ যদি ঘুম না আসে তোমাকে ডাকব। বাবা, এখন যাই?

আচ্ছা, যাও। জমিলার মা বলছিল, ছেলেপুলেরা নাকি তোমাকে খুব বিরক্ত করছে। বারান্দায় ছোটাছুটি করছে।

না, তেমন কিছুনা।

শারমিন নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে শুয়ে রইল। এবং এক সময় ঘুমিয়েও পড়ল। জামিলার মা তাকে জাগাল না। দুপুরে খাবার সময় রহমান সাহেব বললেন, ওর ঘুম ভাঙানোর দরকার নেই, ঘুমুক।

 

পুলিশের ব্যাণ্ড পার্টি চলে এল তিনটায়। শারমিনের ঘুম ভাঙল ব্যাণ্ডের শব্দে। তারা বাজাচ্ছে আনন্দের গান, উৎসবের গান। কিন্তু তবু কেন বারবার চোখ ভিজে উঠছে? কেন বারবার মনে হচ্ছে চারপোশ অসম্ভব ফাঁকা। কোথাও কেউ নেই। কেন এত কষ্ট হচ্ছে?

দরজায় টুকটুক আওয়াজ হল। শারমিন ক্লান্ত গলায় বলল, কে?

আফা আমি।

কী চাও?

আপনার সাথে দেখা করতে আইছে।

কে?

ঐ দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক, রফিক সাব।

শারমিন চুপ করে রইল। তার এক বার ইচ্ছা হল বলে-ওকে চলে যেতে বল। কিন্তু সে কিছুই বলল না। জামিলার মা দ্বিতীয় বার ডাকল, ও আফু, আফা। শারমিন তারও জবাব দিল না। কিন্তু জামিলার মা নেমে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই সেও নিচে নেমে এল।

ব্যাণ্ড পাটির চারদিকে সবাই ভিড় করে আছে। রহমান সাহেবও এতক্ষণ ছিলেন। একটু আগেই গাড়ি নিয়ে বের হয়েছেন। বলে গেছেন শারমিন ঘুম থেকে উঠেই যেন কাপড় পরে তৈরি থাকে। সন্ধ্যার পর তাকে নিয়ে বেরুবেন।

রফিক ব্যাণ্ড পাটির বাজনা শুনছে খুব উৎসাহ নিয়ে। তার মুখ হাসি-হাসি। শারমিনকে আসতে দেখে সে এগিয়ে গেল।

শারমিন বল তো, কি গান বাজছে?

জানি না।

কাম সেপ্টেম্বর। আমার খুব প্রিয় গান।

তাই নাকি?

হুঁ! দারুণ মিউজিক। তোমার ভালো লাগছে না?

লাগছে।

আজ তোমার বাবার সঙ্গে দেখা হল। আমি নিজেই এগিয়ে গিয়ে পরিচয় দিলাম।

কী পরিচয় দিলে?

নিজের তো কোনো পরিচয় নেই। তোমার পরিচয়েই পরিচয় দিলাম। বললাম, আমি আপনার মেয়ে শারমিনের সঙ্গে পড়তাম।

শারমিন তাকিয়ে আছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। রফিক হাসতে হাসতে বলল, একবার ভাবছিলাম বলি, আমি শারমিনের বন্ধু।

বললে না কেন?

সাহস হল না। যদি রেগে যান। উৎসবের দিনে তোমাকে এমন পেত্নীর মতো লাগছে কেন?

পেত্নীর মতো লাগছে?

হুঁ। চুলে চিরুণি পড়ে নি। চোখ লাল এবং বেছে বেছে সবচে ময়লা শাড়িটাই আজ পরেছ। আচ্ছা, তোমার কি একটাও ভালো শাড়ি নেই?

শারমিন বলল, তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাজনা শোন। আমি এক্ষুণি আসছি। কাপড় বদলে আসছি। তোমার হাতে কি কোনো কাজ আছে?

না। কেন?

তোমাকে নিয়ে যাব এক জায়গায়।

কোথায়?

বলছি, বাস তুমি। চা খাবে?

হ্যাঁ, খাব। চায়ের সঙ্গে আর কিছু আছে?

দেখি আছে কিনা।

ঝাল কিছু। নো সুইটস।

শারমিন অতি দ্রুত কাপড় বদলাল। পাতলা একটা চেইন পরল গলায়। হালকা নীল রঙের একটা শাড়ি পরল। একটা হ্যাণ্ডব্যাগ নিল হাতে।

জামিলার মা বলল, যান কই আফা?

একটা কাজে যাচ্ছি। ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বল। ইয়াসিন আছে। না?

জ্বি আছে।

কোন সময় আইবেন আফা?

শারমিন তার জবাব দিল না! নেমে এল নিচে। তার মুখ অস্বাভাবিক বিবর্ণ।। যেন খুব বড়ো ধরনের কোনো একটা অসুখ থেকে সে উঠেছে। রফিকের মনে হল, শারমিন যেন ঠিকমতো হাঁটতেও পারছে না।

না, আমার শরীর ভালোই আছে। চল তুমি।

চা খাই নি তো এখনো, চা আসে নি।

চা পরে খাবে।

রফিক অবাক হয়ে উঠে দাঁড়াল। সে কিছুই বুঝতে পারছে না; ব্যাণ্ড বাজছে। দলটিকে ঘিরে ছোট ছোট ছেলেমেয়ের হৈচৈ করছে। ওদের আনন্দের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। ইলেকট্রিশিয়ানরা ব্যস্ত আলোকসজ্জা নিয়ে। আলোকসজ্জা শুরু হবে। আজ সন্ধ্যা থেকে।

 

গাড়ি পুরানো ঢাকা ছাড়িয়ে আসার পরপরই রফিক লক্ষ করল, শারমিন কাঁদছে। অত্যন্ত অস্বস্তিকর অবস্থা। কোথায় তারা যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, কে জানে? দ্রাইভার নিজেও বেশ কয়েক বার তাকাল পেছনের দিকে। রফিকের সিগারেট ধরাবার ইচ্ছা হচ্ছে, কিন্তু কেন জানি ধরাতেও সাহস পাচ্ছে না।

রাফিক।

বল।

কটা বাজে দেখ তো?

চারটা দশ। কোথায় যাচ্ছি। আমরা?

শারমিন শান্তস্বরে বলল, আমি এখন তোমাকে কয়েকটা কথা বলব। তুমি শুধু শুনে যাবে, কোনো প্রশ্ন করবে না। ড্রাইভার সাহেব।

জ্বি আপা।

আপনি গাড়ি একটু আস্তে চালান।

জ্বি আচ্ছা।

কথাবার্তা যা শুনবেন, নিজের মধ্যে রাখবেন।

জ্বি আচ্ছা!

শারমিন ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলল। রফিক অপেক্ষা করতে লাগল।

রাফিক।

বল শুনছি।

তুমি কি আমাকে বিয়ে করতে রাজি আছ?

রফিক কোনো জবাব দিতে পারল না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। শারমিন নিচু গলায় বলল, আমি খুব বড়ো ধরনের কনফিউশনে ভুগছি। কী করব কিছু বুঝতে পারছি না।

কনফিউশন হবার কারণ কী?

কারণ কী, তুমি ভালো করেই জান। কেন তুমি বারবার এসেছ আমার কাছে?

বলতে বলতে শারমিন ফুঁপিয়ে উঠল।

সাব্বির ভাইকে বিয়ে করতে আমি রাজি না, এই কথাটা আমি কিছুতেই বাবাকে বলতে পারব না। আমি আমার বাবাকে যে কী পরিমাণ ভালোবাসি, তা একমাত্র আমিই জানি। অন্য কেউ জানে না।

রফিক সিগারেটের জন্যে পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিল। সিগারেট নেই! হাত পড়ল দশ টাকার একটি ময়লা নোটে, এই টাকাটাই তার সম্বল।

শারমিন মৃদুস্বরে বলল, আমাকে নিয়ে তোমাদের বাড়িতে যাবার সাহস কি তোমার আছে।

আছে!

রফিক শান্তস্বরে বলল, তোমার বাবাকে গিয়ে সব কিছু খুলে বললে 6<भনা ३३?

আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

তোমাকে বলতে হবে না। আমি বলব।

না।

শারমিন শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে বসে রইল। রফিক বলল, ড্রাইভার সাহেব, আপনার কাছে সিগারেট আছে? ড্রাইভার সিগারেট দিল। নিচু গলায় বলল, এখন কোন দিকে যাইবেন?

রফিক বলল, খুব স্পিডে একটু ঘুরে বেড়ান, আমার মাথাটা ঠাণ্ডা হোক। কোথায় যাব এখনো জানি না।

রফিক আড়চোখে তাকাল শারমিনের দিকে। সে শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে বসে আছে চুপচাপ। রফিকের ইচ্ছা করল, আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে বলে, এই মেয়েটিকে পৃথিবীর কেউ আমার কাছ থেকে সরিয়ে নিতে পারবে না। এ একান্তই আমার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *