রীনা ভালো আছে কি না
রীনা ভালো আছে কি না তা সে এখনো বুঝতে পারছে না। দিনের বেলায় সে বেশ ভালোই তাকে। দিনটা শুরু হয় ব্যস্ততার ভেতর শেষও হয় ব্যস্ততার ভেতর। সন্ধ্যার পর থেকে কিছু করার থাকে না। বুকে হাঁপ ধরার মতো হয়। সে বসে থাকে টিভির সামানে। টিভিতে ক্ৰমাগত হিন্দি গানের নাচ হতে থাকে। নাচের মুদ্রা কুৎসিত। নাচের সঙ্গে যে গান হয়। সেই গানের সুর একই রকম। তারপরেও নাচ ছাড়া আর কিছু দেখার নেই। কারণ গৃহকর্তা মনসুর সাহেব এই অনুষ্ঠানটাই দেখেন। রীনা এ বাড়িতে আছে আশ্ৰিতের মতো। একজন আশ্ৰিতের ইচ্ছা-অনিচ্ছা থাকতে পারে না।
শ্যামলী রিং রোডের এই বাড়ি রানার বান্ধবী আফরোজার। আফরোজা রীনার সঙ্গে এক সঙ্গে স্কুলে পড়েছে। পাস করার পর আর কোনো যোগাযোগ ছিল না। দশ বছর পর আবার যোগাযোগ হয়েছে। কাকতলীয়ভাবেই হয়েছে। আফরোজা স্কুলে থাকতেও হড়বড় করে কথা বলত–এখনো হড়বড় করেই বলে। সে রীনাকে জড়িয়ে ধরে হড়বড় করে যে কথা বলল তা হচ্ছে–তুই পাগলির মতো এইসব কী বলছিস? স্বামীকে ছেড়ে চলে এসেছিস। চাকরি খুঁজছিস। আমি তোর জন্যে চাকরি কোথায় পাব? কাকে আমি চিনি? তবে চাকরি দিতে না পারলেও তোকে থাকতে দিতে পারব। চলে আয় আমার বাড়িতে। রিং রোডে একটা ফ্ল্যাট কিনেছি। চার বেডরুমের ফ্ল্যাট। একটা গেষ্টরুম খালি পড়ে থাকে। ওইখানে থাকবি।
রীনা বলল, তোর হাসবেন্ড কিছু বলবে না?
কিছুই বলবে না। আমার হাসবেন্ড হচ্ছে টবের গাছের মতো। কথাবার্তা কিছুই বলে না। সন্ধ্যাবেলা টিভির সামনে বসে। মাঝখানে একবার ভাত খাওয়ার জন্যে ওঠে। বারটা বাজলে ঘুমোতে যায়।
উনি করেন কী?
ব্যবসা পাতি করে। কী ব্যবসা তাও জানি না। ও কী করে না করে তা নিয়ে ভাবতে হবে না–তুই আয় তো। কথা-বালিশ নিয়ে উঠে আয়।
রীনা রিং রোডে আফরোজার ফ্ল্যাটবাড়িতে গিয়ে উঠল। সুন্দর গোছানো ফ্ল্যাট। দামি হোটেলের মতো সব কিছু ঝকঝকি করছে। যে গেষ্টরুমে রীনাকে থাকতে দেয়া হয়েছে সেখানেও এসি আছে। মেঝেতে দামি কাপেট। আফরোজা বলল, গরম লাগলে এসি ছাড়বি। কোনো রকম কিন্টামি করবি না। নিজের বাড়ি মনে করে থাকবি। পরের বাড়িতে আছিস বলেই যে কিছু কর্ম করবি–চা বানাবি, রান্না করবি তাও না। তিনটা কাজের মানুষ। কাজ না করে করে ওদের হাতে পায়ে জং ধরে গেছে। রীনা বলল, তোর ছেলেপুলে কী?
ছেলেপুলে কিছু নেই। আমার নাকি কী সব সমস্যা আছে। ও বলছিল টেসটিউব বেবি নিতে। শুনেই আমার ঘেন্না লাগল। টেস্টটিউব অদল বদল হয়ে যাবে–কার না কার দিয়ে দেবে। ছিঃ। তারপরও কোলকাতা গিয়ে দু’মাস ছিলাম। লাভের মধ্যে লাভ হয়েছে–ডাক্তাররা খোঁচাখুঁচি করে যন্ত্রণার চূড়ান্ত করেছে। বাচ্চাকাচ্চা ছাড়া আমি ভালোই আছি। পালক নেবার কথা মাঝে মাঝে ভাবি। দেখা যাক। আমার এত গরজ নেই।
আফরোজার স্বামীর নাম নুরউদ্দিন। থলথলে ধরনের শরীর। দেখেই মনে হয় এই মানুষটার জন্ম হয়েছে আরাম করার জন্যে। ফ্ল্যাটে যখন থাকে বেশিরভাগ সময় চেয়ারে পা তুলে বসেই থাকে। হয় খবরের কাগজের দিকে তাকিয়ে থাকে নয়তো টিভির দিকে তাকিয়ে থাকে। হাঁটা চলা করতে মনে হয় কষ্ট হয়।
আফরোজা রীনাকে তার স্বামীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল-এ হচ্ছে স্কুল জীবনে আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড–রীনা। রীনা আমাদের ফ্ল্যাটে কিছুদিন থাকবে। কতদিন এটা বোঝা যাচ্ছে না। মাসখানেকও হতে পারে-আবার বছরখানেকও হতে পারে। বুঝতে পারছি?
নুরুউদ্দিন বলল, হুঁ।
আফরোজা বলল, রানার দিকে তাকিয়ে হুঁ বল। অন্য দিকে তাকিয়ে ই বলছি কেন? আরেকটা কথা শোন–তুমি তোমার পরিচিত সবাইকে বলে দেবে রীনার জন্যে যেন একটা চাকরির খোঁজ করে। ও বি.এ. পাস করেছে। সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছে। অতি সুইট মেয়ে।
আচ্ছা।
বান্ধবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম ওর সঙ্গে দুটা কথা বল। ভদ্রতাও তোমাকে শিখিয়ে দিতে হবে? বেচারি মনে করবে কী?
নুরউদ্দিন রীনার দিকে তাকিয়ে বলল, ভাবি দাঁড়িয়ে আছেন কেন বসুন।
আফরোজা বিরক্ত গলায় বলল, ভাবি ডাকছ কেন? তুমি নাম ধরে ডাকবে। বয়সে তুমি আমার দশ বছরের বড়। রীনার চেয়েও দশ বছরের বড়। নাম ধরে ডাকবে কোনো অসুবিধা নেই।
আচ্ছা।
ওর নাম কী জান?
না।
ওর নাম রীনা।
ও আচ্ছা রীনা।
তুমি রীনার জন্যে একটা চাকরি যোগাড় করে দেবে।
আচ্ছা।
রীনা লক্ষ করল মানুষটা আসলেই টবের গাছের মতো। ফ্ল্যাটে যখন থাকে বসে বসেই সময় কাটিয়ে দেয়। নিজের কথা বলে না। অন্যের কথা শোনার আগ্রহও তার নেই। মাঝে মাঝে রীনার মনে হয়–আফরোজা যে তাকে ফ্ল্যাটবাড়িতে এনে তুলেছে। সে তার নিজের গরজেই এনে তুলেছে। আফরোজার কথা বলার মানুষ দরকার। মুখ সেলাই করে দুজন মানুষ দিনের পর দিন পাশাপাশি বাস করতে পারে না। রীনার মাঝে মাঝেই মনে হয়-সংসারে ছেলেপুলে থাকাটা যে কত দরকার তা মানুষকে চোখে আঙুল দিয়ে বোঝানোর জন্যে আল্লাহ এই সংসারটা তৈরি করেছেন।
তবে কথা না বললেও রীনার নুরউদ্দিনকে পছন্দ হয়েছে। পুরুষদের স্বভাবই হচ্ছে প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে আশপাশের মেয়েদের শরীরেব ওপর চোখ বুলিয়ে নেয়া। এই মানুষটি তা থেকে মুক্ত। তার ভদ্রতাবোধও ভালো। মানুষটা টিভি সেটের সামনে বসে থাকে খালি গায়ে। রটনা ঘরে এলে পাশে খুলে রাখা পাঞ্জাবিটা চট করে গায়ে দেয়। রীনা বলেছে-আপনার যদি খালি গায়ে থাকতে আরাম লাগে আপনি সেইভাবে থাকুন। আমি কিছু মনে করব না। নুরুউদ্দিন খালি গা হয় নি। তাছাড়া রীনাকে সে রীনা নামেও ডাকছে না। ভাবিই ডাকছে। এটিও রীনার পছন্দ হয়েছে। বান্ধবীর স্বামী তাকে নাম ধরে ডাকবে এটা ভাবতে তার ভালো লাগে না।
নুরুউদিনের যে ব্যাপারটা রীনার খারাপ লাগে তা হচ্ছে ভদ্রলোকের মদ্যপানের অভ্যাস আছে। সবদিন না–মাঝে মাঝে। প্রথম দিন মদ্যপানের দৃশ্য দেখে আতঙ্কে রীনার হাতপা নীল হয়ে যাবার উপক্রম হলো। মদ্যপানের ব্যাপােটা বড় বড় হোটেলে হয়, এবং অপরিচিত লোেকরা মদ্যপান করে—এই ছিল তার ধারণা। পরিচিত একজন মানুষ চেয়ারে পা তুলে মদ খাবে এই দৃশ্য রানার কল্পনাতেও ছিল না। আফরোজা এই দৃশ্য দেখেও কিছু বলছে না। এতেই বীনা খুব অবাক হচ্ছে। সে বলেই ফেলল, আফরোজা তুই কিছু বলছিস না?
আফরোজা বলল, কী বলব?
উনি যে ড্রিংক করছেন।
বদ অভ্যাস করে ফেলেছে, বলে কী হবে। শুরুতে বলেছি কাজ হয় নি–এখন আর বলি-টালি না। তাছাড়া কোনো সমস্যা করে না। নিজের মনে খায়। মদে। ওর কিছু হয় না। টাল না হয়ে পুরো এক বোতল ভদকা সে খেতে পারে।
টাল না হয়ে মানে কী?
টাল হলো–মাতাল। মদভর্তি চৌবাচ্চায়। ওকে ডুবিয়ে দে ও চৌবাচ্চার সব মদ খেয়ে বের হয়ে এসে বলবে–ভাত দাও। ক্ষিধে হয়েছে।
কী আছে। এর মধ্যে যে উনি এত আগ্রহ করে খাচ্ছেন?
কিছুই নেই। তিতকুট একটা জিনিস, খেলে মাথা ঘোরে।
তুই খেয়ে দেখেছিস?
হুঁ। একবার রাগ করে খেয়েছিলাম–অতি অতি অতি কুৎসিত। তুই একবার খেয়ে দেখিস।
সর্বনাশ!
সর্বনাশের আবার কী? ছেলেরা খেতে পারলে আমাদের খেতে অসুবিধা কী।
মদ্যপানের পর নুরউদ্দিনের তেমন কোনো পরিবর্তন রীনার চোখে পড়ে নি। শুধু একটা পরিবর্তন হয়–টুকটাক দু-একটা কথা বলে। প্রশ্ন করলে উত্তর দেয়। যেমন একদিন রীনা বলল, আপনি যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নাচ দেখেন আপনার ভালো লাগে?
নুরউদ্দিন গ্লাসে হালকা চুমুক দিয়ে বলল, না। মনে হয় একদল ছেলেমেয়ে পিটি করছে।
ভালো লাগে না তো দেখেন কেন?
কিছু করার নেই। এইজন্যে দেখি। দেখিও ঠিক না, তাকিয়ে থাকা আর দেখা এক না।
গল্পের বইটই আপনি পড়েন না?
কলেজ জীবনে দু-একটা পড়েছি। এখন আর পড়ি না।
পড়েন না কেন?
সব বই তো একই রকম–একটা পড়লেই সব পড়া হয়। একটা ছেলে থাকবে, একটা মেয়ে থাকবে। তাদের প্রেম হবে। তারপর হয় তাদের বিয়ে হবে নয়। বিয়ে হবে না। এই তো ব্যাপার।
আপনার বন্ধুবান্ধব খুব কম?
হুঁ। বন্ধু কম, শক্রও কম। যাদের বন্ধু বেশি তাদের শত্ৰুও বেশি! যাদের কোনো বন্ধু নেই, তাদের কোনো শক্ৰও নেই।
রীনার চাকরি নুরউদ্দিনই যোগাড় করে দিল। এক কথায়— মাসে ছ হাজার টাকা বেতনের চাকরি তো সহজ ব্যাপার না। রীনার বিস্ময়ের সীমা রইল না। যে লোকটার প্রধান কাজ সন্ধার পর থেকে টিভির সামনে বসে মদ্যপান করা সে এক কথায় চাকরির ব্যবস্থা করতে পারে এটা রীনা ভাবে নি। হাসান বছরের পর বছর ঘুরে চাকুরি পায় নি। তার সে দশ দিনের মাথায় চাকরি পেয়ে গেল। থলথলে শরীরে খালি গায়ে মানুষটার ক্ষমতা অবশ্যই আছে।
চাকরি রীনার ভালো লাগছে। সুন্দর ছিমছাম অফিস। ভালো ব্যবসা হচ্ছে। অফিসের লোকজনদের মুখ দেখেই তা বোঝা যায়। সবার ভেতরই ব্যস্ততা। রীনার বসকেও তার পছন্দ হয়েছে। স্মার্ট মানুষ। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স। টকটকে লাল গেঞ্জি গায়ে দিয়ে একদিন অফিসে এসেছিলেন। তাকে পচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়েসী। যুবকের মতো লাগছিল। ভদ্রলোকের কথাবার্তা মার্জিত। অফিসের বসরা সব সময় গোমড়া মুখে থাকেন। ভদ্রলোকের মুখে গোমড়া না–কথায় কথায় রসিকতা করেন। রসিকতা যখন করেন–এমন গভীর ভঙ্গিতে করেন যে প্রথম কিছুক্ষণ বোঝাই যায় না–রসিকতা।
প্রথম দিন রীনা তার সঙ্গে দেখা করতে গেল। দরজায় পেতলের দুটা অক্ষর A.H. –আজিজুর হকের আদ্যক্ষর। নামের বদলে কেউ শুধু আদ্যক্ষর দরজায় লাগিয়ে রাখতে পারে রীনা ভাবে নি। সে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল। ভদ্রলোক বললেন, রীনা কী খবর?
রীনা বলল, জ্বি স্যার ভালো।
কাজ বুঝে নিয়েছেন?
জ্বি।
আপনার কাজটা কী বলুন তো?
রীনা হকচাকিয়ে গেল। তাকে রিসিপশনে বসতে বলা হয়েছে। এর বেশিকিছু বলা হয় নি। ভদ্রলোককে সেটা বলা কি ঠিক হবে? রীনা ইতস্তত করতে লাগল। হক সাহেব বললেন, ওরা আপনাকে কী করতে বলেছে, আমি জানি না। আপনার প্রধান কাজ হচ্ছে রোজ একবার এসে আমার সঙ্গে খানিকক্ষণ হাসিমুখে গল্প করা। অফিসের বেশিরভাগ মানুষ গোমড়া মুখে বসে থাকে। আমার অসহ্য লাগে।
রীনা খানিকটা হকচাকিয়ে গেল। ভদ্রলোকের এ জাতীয় কথা বলার মানে কী? মেয়ে কর্মচারীদের সঙ্গে অফিস বসদের নানান ধরনের গল্প শোনা যায়। এর রকমই কি? উনি কি অন্য কিছু বলার চেষ্টা করছেন?
রীনা।
জ্বি।
আমার কথা শুনে মোটেই ঘাবড়াবেন না। রসিকতা করছি। তবে আমি সত্যি সতি্যু হাসিমুখ দেখতে পছন্দ করি। নকল হাসিতেও আমার আপত্তি নেই। সত্যি কান্নার চেয়েও নকল হাসি আমার কাছে অনেক ভালো। ঠিকমতো কাজ শিখুন। আমি আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি–মেয়েরা যখন অফিসে কাজ করতে আসে তখন তারা হয় দারুণ কাজের হয়, নয়তো নিতান্তই অকাজের হয়। মাঝামাঝি কিছু মেয়েদের মধ্যে দেখা যায় না, শুধু পুরুষদের মধ্যেই দেখা যায়। আমি কর্মী মহিলা চাই। গল্পবাজ মহিলা না যাদের প্রধান কাজ ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে লিপষ্টিক বের করে ঠোঁটে ঘষা। প্রথম দিনে অনেক কথা বলে ফেললাম—আর না।
রীনা প্ৰথম কাজ শুরু করেছিল রিসিপশনে–এখন তাকে দেয়া হয়েছে ফরেন করেসপনডেন্স ডেস্কে। যে বুড়ো ভদ্রলোকের কাছে তাকে কাজ শিখতে হচ্ছে তিনি খিটখিটে এবং বদমেজাজি। কথায় কথায় তিনি রীনাকে ধমক দেন। তবে প্ৰায় প্রতিদিনই বলেন–তোমার মাথা পরিষ্কার। অন্যরা যে কাজ এক বছরে শিখেছে তুমি তা শিখেছ এক মাসে।
এই জাতীয় কথা শুনতে আনন্দ লাগে। বুড়ো ভদ্রলোক রীনাকে শুধু যে আনন্দ দেবার জন্যে এই কথাগুলো বলছেন–তা যে না, রীনা নিজেও তা বুঝতে পারে। কাজ করতে তার ভালো লাগে। হক সাহেব তাকে ডেকে নিয়ে একদিন বললেন, আপনার কাজের খুব সুনাম শুনি। আপনি স্পোকেন ইংরেজি কেমন জানেন?
রীনা বলল, ভালো জানি না স্যার।
ভিসিআরে বেশি বেশি ইংরেজি ছবি দেখে স্পোকেন ইংলিশ বানিয়ে নিন। আপনাকে আমরা আমাদের লন্ডন অফিসে পাঠিয়ে দেব। দেশের বাইরে যেতে আপত্তি নেই তো?
জ্বি না স্যার।
আপনার পারিবারিক আনফরচুনেট অবস্থার কথা আমাকে বলা হয়েছে। পারিবারিক বিধিনিষেধ নেই তো?
জ্বি না।
ভালো করে ভেবে বলুন। সব ঠিকঠাক করে আপনার বাইরে যাবার ব্যবস্থা হলো হলো–তারপর আপনি বেঁকে বসলেন বা আপনার স্বামী বেঁকে বসলেন। এমন হবে না।
জ্বি না।
হুট করে কিছু বলতে হবে না। আপনি সপ্তাহখানিক ভাবুন। তারপর বলুন।
রীনা এক সপ্তাহ ভেবেছে। কখনো তার কাছে মনে হয়েছে–না সম্ভব না। দেশে সে আছে বলেই অন্তত সপ্তাহে একবার সে টগর-পলাশকে দেখতে পারছে। আবার কখনো মনে হয়েছে–সব ছেড়েছুড়ে দূরে চলে যেতে। একবার মনে হলো তারেক যদি শোনে সে লণ্ডন চলে যাচ্ছে তাহলে সে কী বলবে? টেলিফোনে আলাপ করবে না সরাসরি তার অফিসে চলে যাবে? অফিসে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? তারেক যদি ভাবে সে আসলে এসেছে ঘরে ফিরে যেতে? ভাবলে ভাবুক। যদি সে সত্যি সত্যি লন্ডনে চলে যায়–যাবার আগে একবার দেখা করাও তো উচিত।
বুধবার দুপুরবেলা রীনা তারেকের অফিসে উপস্থিত হলো। তারেক লাঞ্চ সেরে পান চিবোচ্চিল, রীনাকে দেখে বিস্মিত-অবাক কিছুই হলো না। স্বাভাবিক গলায় বলল, রীনা কী খবর?
রীনা বলল, ভালো।
আজ আমার ব্যাডলাক, সকালে এসে দেখ ফ্যান নষ্ট। সকাল থেকে গরমে সিদ্ধ হচ্ছি। মিস্ত্ৰি আনতে লোক গেছে। এগারটার সময় গেছে–এখন দুটা। মিস্ত্রিও নেই, লোকও নেই। নো ম্যাংগো, নো গানিব্যাগ। আমিও নেই ছালাও নেই।
রীনা বলল, তুমি কেমন আছ?
ভালো।
বাসার খবর কী?
বাসার খবরও ভালো। পলাশ গতকাল রেলিঙের ওপর পড়ে একটা দাঁত ভেঙে ফেলেছে। রক্তটক্ত কিছু বের হয় নি। কট করে দাঁতের একটা কণা ভেঙে গেল।
তোমার চাকরি কেমন চলছে?
ভালো।
প্রথম প্ৰথম চাকরি খুব ভালো লাগে। কিছুদিন পর আর ভালো লাগে না। আমার তো রোজ সকালে অফিসে এসে একবার করে ইচ্ছা করে ফাইল টাইল সব জ্বলিয়ে দিয়ে হাঁটা ধরি।
কোন দিকে হাঁটা ধরতে ইচ্ছে করে, চিটাগাঙের দিকে?
হাঁটা ধরতে ইচ্ছে করে এই পর্যন্তই। তুমি চা খাবে?
না।
পান খাবে? মিষ্টিজর্দা দেয়া পান আছে। দুপুরে খাবার পর একটা পান খেতে ভালো লাগে৷ পান হচ্ছে পিত্তনাশক এবং হজম সহায়ক।
রীনা অবাক হয়ে তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে। কী আশ্চৰ্য–দু’মাস পর দেখা–মানুষটা কত সহজেই না কথা বলছে। যেন কিছু যায় আসে না। রীনা বলল, আমাদের অফিসের একটা ব্ৰাঞ্চ আছে লন্ডনে। আমাকে খুব সম্ভব সেখানে পাঠাবে।
কবে?
জানি না কবে।
বেতন কত দেবে? দেশে যে বেতন দেবে বাইরে সে বেতন দিলে তো হবে না। ফরেন করেন্সিতে বেতন হওয়া উচিত।
উচিত হলে নিশ্চয়ই ফরেন কারেন্সিতে বেতন দেবে। তোমার ওই মেয়ের খবর কী?
লাবণীর কথা বলছ? ভালোই আছে। গত সপ্তাহে চিটাগাং গিয়েছিলাম–ওদের কক্সবাজার ঘুরিয়ে নিয়ে এসেছি। লাবণীর মেয়েটা আগে সমুদ্র দেখে নি। এই প্ৰথম দেখল। খুব খুশি।
তুমি এইভাবে ঘোরাফেরা করছি লোকজনের চোখে লাগছে–তুমি মেয়েটাকে বিয়ে করে ফেল না কেন?
তারেক বিস্মিত হয়ে বলল, এক বউ থাকতে আরেক বউ ঘরে আনব কীভাবে?
আইনে বাধা আছে?
ইসলামি আইনে বাধা নেই–কিন্তু দেশে তো পুরোপুরি ইসলামী আইন নেই—
থাকলে তোমার সুবিধা হতো। তাই না?
তারেক সিগারেট ধরাল। রীনার কান্না পাচ্ছে। এখানে আসা তার উচিত হয় নি। মানুষটার সঙ্গে তার বাসায় চলে যেতে ইচ্ছা করছে। একবার যদি সে বলত–রীনা তুমি চল আমার সঙ্গে–সে নিশ্চয়ই যেত। রীনা ক্লান্ত গলায় বলল, যাই কেমন?
দাঁড়াও পিয়নকে সঙ্গে দিয়ে দিচ্ছি। রিকশা ঠিক করে দেবে। দুপুরবেলায় রিকশা-বেবিট্যাক্সি কিছুই পাওয়া যায় না।
রীনা বলল, রিকশা লাগবে না।
অফিস থেকে বের হয়ে রীনার ইচ্ছা করল আবার তারেকের সঙ্গে দুটা কথা বলতে ওকে খুব রোগ লাগছে। ওর কি ঘুম হচ্ছে না?