২২. রহস্যময় প্রতি-পদার্থ
পল ডিরাককে নিয়ে একটা মজার গল্প প্রচলিত আছে। একবার তাকে একটা গণিতের সমস্যা দেয়া হলো, সমস্যাটা এরকম : তিনজন জেলে সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়েছে, মাছ ধরে যখন বাড়ি ফিরে যাবে তখন সমুদ্রে ঝড় ওঠে। জেলে তিনজন তখন রাত কাটানোর জন্যে একটা দ্বীপে আশ্রয় নিয়ে ঘুমিয়ে গেল। গভীর রাতে একজন জেলের ঘুম ভেঙে গেল, তখন ঝড় থেমে গেছে। সে ভাবল অন্য জেলেদের বিরক্ত না করে সে তার ভাগের মাছ নিয়ে বাড়ি চলে যাবে। মাছগুলো তিন ভাগে ভাগ করার পর সে দেখে একটা মাছ বাড়তি রয়ে গেছে। সে বাড়তি মাছটাকে সমুদ্রে ফেলে দিয়ে নিজের এক ভাগ নিয়ে বাড়ি চলে গেল। কিছুক্ষণ পর আরেকজন জেলে ঘুম থেকে উঠেছে, ঝড় থেমে গেছে তাই সেও ভাবল সে তার ভাগের মাছ নিয়ে চলে যাবে। তাই যে মাছগুলো রয়ে গেছে সে সেগুলোকে তিন ভাগ করে দেখে একটা মাছ বেশি। বাড়তি মাছটা সমুদ্রে ফেলে দিয়ে সে তার নিজের ভাগ নিয়ে চলে গেল। শেষ জেলেও এক সময় ঘুম থেকে উঠেছে, সেও দেখে উঠেছে ঝড় থেমে গেছে। কাজেই ও ঠিক করল নিজের ভাগের মাছ নিয়ে সে চলে যাবে। রয়ে যাওয়া মাছগুলোকে তিন ভাগ করে দেখে একটা মাছ বেশি। সেও বাকি মাছ সমুদ্রের পানিতে ফেলে দিয়ে নিজের ভাগটুকু নিয়ে চলে গেল। এটুকু হচ্ছে গণিতের সমস্যাটার বর্ণনা–এখন প্রশ্ন হচ্ছে সবচেয়ে কম কতগুলো মাছ হলে তিনজন জেলে এইভাবে মাছ ভাগ করে নিতে পারবে?
সমস্যাটা এমন কিছু কঠিন নয় যে কেউ একটু মাথা ঘামালে এর উত্তরটা বের করে ফেলতে পারবে। কথিত আছে পল ডিরাককে যখন এই সমস্যাটা দেয়া হলো তখন তিনি এক মুহূর্তও চিন্তা না করে বললেন, “-2টি (মাইনাস দুই) মাছ!” মাছ কেমন করে ‘মাইনাস’ হয় সেটা পরের ব্যাপার কিন্তু গণিতের দৃষ্টিকোণে এটি খাঁটি একটা সমাধান। প্রথম জেলে 2টি মাছ থেকে + 1টি মাছ পানিতে ফেলে দিল তাই তার হাতে থাকল-3টি মাছ। (-2=3+1) সে তিন ভাগে ভাগ করে তার ভাগ (-1টি মাছ) নিয়ে গেল, বাকি রইল 2টি মাছ! কাজেই পুরো প্রক্রিয়াটা আবার গোড়া থেকে শুরু করা সম্ভব। তিনজন জেলেই এটা করতে পারবে এবং শেষ পর্যন্ত ২টি মাছ রয়ে যাবে।
যিনি গণিতের এই সমস্যাটি দিয়েছিলেন তিনি মোটেও এই উত্তর আশা করেন নি (তিনি আশা করেছিলেন প্রচলিত উত্তরটি–সেটা হচ্ছে 25) কিন্তু আমরা এখন অনুমান করতে পারি কেমন করে পল ডিরাকের মাথায় এরকম একটা উত্তর খেলা করেছে। পল ডিরাক সবার আগে প্রতি-পদার্থের অস্তিত্বের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। প্রতি-পদার্থ অনেকটা নেগেটিভ সংখ্যার মতো, পজিটিভ সংখ্যার সাথে নেগেটিভ সংখ্যা যোগ করলে যেমন কিছুই থাকে না, ঠিক সেরকম পদার্থের সাথে প্রতি-পদার্থ মিলিত হলে দুটোই অদৃশ্য হয়ে যায়! থাকে শুধু শক্তি।
আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের একটা ভাষা হচ্ছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং যে কয়জন পদার্থবিজ্ঞানী প্রথম কোয়ান্টাম মেকানিক্স গড়ে তুলেছেন তার অন্যতম হচ্ছেন পল ডিরাক। তিনি ইলেকট্রনের জন্যে কোয়ান্টাম মেকানিক্স ব্যবহার করার সময় সেখানে আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি ব্যবহার করে 1931 সালে
প্রথমবার ইলেকট্রনের প্রতি-পদার্থ পজিট্রনের অস্তিত্বের কথা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। পরের বছরেই কার্ল এন্ডারসন পজিট্রন আবিষ্কার করে দেখালেন ডিরাকের অনুমান একশতভাগ সত্যি।
প্রতি-পদার্থ সম্ভবত প্রকৃতির সবচেয়ে রহস্যময় একটি বিষয়। আমাদের পরিচিত যে জগৎ সেগুলো তৈরি হয়েছে অণু-পরমাণু দিয়ে আর অণু-পরমাণু তৈরি হয়েছে ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন দিয়ে। কাজেই আমরা আমাদের চারপাশে যা কিছু দেখি তার সবকিছু ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন দিয়ে তৈরি বললে একটুও অত্যুক্তি হয় না। ইলেকট্রনের যেরকম প্রতি পদার্থ হচ্ছে পজিট্রন ঠিক সে রকম প্রোটন আর নিউট্রনেরও প্রতি-পদার্থ রয়েছে, বিজ্ঞানের ভাষায় তার নাম এন্টি-প্রোটন (anti-proton) এবং এন্টি-নিউট্রন (anti-neutron)। সব প্ৰতি পদার্থই সামনে এন্টি শব্দ বসিয়ে বোঝানো হয়, শুধু ইলেকট্রনের প্রতি-পদার্থের আলাদা একটা নাম আছে–পজিট্রন। কাজেই আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি একটি প্রোটন আর একটি পজিট্রন দিয়ে তৈরি হয় একটি এন্টিহাইড্রোজেন! ঠিক সেভাবে আমরা আমাদের চারপাশে যা কিছু দেখি তার সবকিছুরই “এন্টি” থাকা সম্ভব। পদার্থবিজ্ঞান সেটা মেনে নিয়েছে এবং ইলেকট্রন বিজ্ঞানীরা এক্সেলেটরে মোটামুটি নানারকম এন্টি-ম্যাটার (anti-matter) বা প্রতি-অণু প্রতি-পরমাণু তৈরি করে দেখিয়েছেন।
এবারে মনে হয় একটা বিষয় নিয়ে সময় একটু সতর্ক করে দেয়া ভালো, একটু আগে বলেছি আমাদের চারপাশে যা কিছু দেখি তার সবকিছুই তৈরি হয়েছে ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন দিয়ে কিন্তু আমরা যা কিছু দেখি শুধুমাত্র সেগুলো দিয়েই যে আমাদের জগৎ সেটি সত্যি নয়–অনেক কিছুই আছে যেগুলো আমরা আমাদের দৈনন্দিন জগতে দেখি না, কিন্তু সেগুলো খুব ভালোভাবে আছে, বিজ্ঞানীরা নানাভাবে সেগুলো খুঁজে বের করেছেন। এখন পর্যন্ত যে থিওরিটি সবচেয়ে ভালোভাবে কাজ করেছে সেটা অনুযায়ী আমাদের এই সৃষ্টি জগৎ বারোটি কণা (Particle এবং তাদের প্রতি কণা (anti-Particle) দিয়ে তৈরি (22.1 নং ছবি)। যারা পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করে না আমি আশা করি না তারা এই কণাগুলোর নাম মনে রাখার চেষ্টা করবে কিংবা তার গভীরে যাবার চেষ্টা করবে। বারোটি কণার দিকে একঝলক চোখ বুলিয়ে গেলেই যথেষ্ট। যারা একটু খুঁতখুঁতে তারা হয়তো ভুরু কুঁচকে বলবে, বলা হয়েছিল আমরা যা কিছু দেখি তার সবই ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন দিয়ে তৈরি। তালিকায় অনেক কষ্টে ইলেকট্রনকে খুঁজে পাওয়া গেল (লেপটনের নিচের সারিতে বাম দিকে) কিন্তু নিউট্রন, প্রোটন কোথায়? নিউট্রন, প্রোটন এখানে নেই কারণ এই তালিকায় শুধু মৌলিক কণাগুলো দেয়া হয়েছে–নিউট্রন, প্রোটন মৌলিক কণা নয়, সেগুলো তৈরি কোয়ার্ক দিয়ে। যেমন নিউট্রন তৈরি হয় একটি আপ কোয়ার্ক এবং দুটি ডাউন কোয়ার্ক দিয়ে (udd) ঠিক সে রকম প্রোটন তৈরি হয় দুটি আপ কোয়ার্ক আর একটি ডাউন কোয়ার্ক দিয়ে (udd)। কাজেই আমরা এবারে আরো সঠিকভাবে বলতে পারি আমাদের দৃশ্যমান জগৎ তৈরি হয়েছে তিনটি মৌলিক কণা দিয়ে, ইলেকট্রন, আপ কোয়ার্ক এবং ডাউন কোয়ার্ক দিয়ে!
যাই হোক, 22.1 নং ছবির বারোটি কণা এবং তাদের প্রতি-কণা দিয়ে সৃষ্টি জগতের সকল পদার্থ এবং প্রতি-পদার্থের একটা খুবই বড় বিশেষত্ব হচ্ছে যখন একই ধরনের পদার্থ এবং প্রতি-পদার্থ একে-অপরের সংস্পর্শে আসে সাথে সাথে একটা আরেকটাকে ধ্বংস করে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। সেই শক্তির পরিমাণ কত হবে সেটা আইনস্টাইনের বিখ্যাত E= mc^2 সূত্র দিয়ে খুব সহজেই বের করা যায়। এটি কোনো কল্পকাহিনী নয়, আমাদের চারপাশে সবসময়ই সেটা ঘটছে।
সৃষ্টি জগৎ যেহেতু বারোটি মৌলিক কণা এবং তাদের প্রতি কণা দিয়ে তৈরি হয়েছে কাজেই আমরা ধরে নিতে পারি এই জগতে আমরা যে রকম পদার্থ দেখতে পাব ঠিক সে রকম প্রতি-পদার্থও দেখতে পাব। কিন্তু এখানে একটি বড় রহস্য এখানে উন্মোচিত হয় নি। কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে আমাদের দৃশ্যমান সৃষ্টি জগৎ পুরোটাই তৈরি হয়েছে পদার্থ দিয়ে, এখানে কোনো প্রতি-পদার্থ নেই। এটা গোপনে কোথাও রয়ে গেছে, আমরা দেখতে পাচ্ছি না, তার কোনো সম্ভাবনা নেই, কারণ পদার্থ প্রতি-পদার্থ একে-অপরের সংস্পর্শে এলেই দুটোই ধ্বংস হয়ে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। কাজেই এটা কোনোভাবেই বিজ্ঞানীদের চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না।
এই সৃষ্টি জগৎ তৈরি হয়েছিল বিগ ব্যাং (Big Bang)-এর ভেতর দিয়ে, সেই বিগ ব্যাংয়ের পর সৃষ্টি জগতে কিন্তু সমান পরিমাণ পদার্থ এবং প্রতি-পদার্থ তৈরি হওয়ার কথা, সেই সমান পরিমাণ পদার্থ এবং প্রতি-পদার্থ একে-অপরকে ধ্বংস করে সৃষ্টি জগতে শুধু শক্তি থাকার কথা। এই গ্রহ-নক্ষত্র, গ্যালাক্সি কিছুই থাকার কথা নয়, থাকার কথা শুধু শক্তির–কিন্তু আমরা খুব ভালো করে জানি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে পদার্থ রয়ে গেছে, গ্রহ-নক্ষত্র, গ্যালাক্সি রয়ে গেছে। কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে প্রতি-পদার্থ পদার্থের কাছে হেরে গেছে এবং সৃষ্টি জগতের সকল প্রতি-পদার্থকে ধ্বংস করার পরও বাড়তি পদার্থ রয়ে গেছে যেটা দিয়ে আমাদের এই দৃশ্যমান জগৎ তৈরি হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখনো সঠিকভাবে জানেন না ঠিক কীভাবে ব্যাপারটা ঘটেছে। (CP Violation নামে কিছু ধারণা দিয়ে এটাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয় কিন্তু সেটা এখনো পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারে নি।)
পৃথিবীর সবাই ইতোমধ্যে নিশ্চয়ই LHC (Large Hadron Collider)-এর নাম শুনে গেছে। প্রায় পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা খরচ করে ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ডের। সীমানায় এটা তৈরি করা হয়েছে। বৃত্তাকার এই এক্সেলেরেটরের পরিসীমা 27 কিলোমিটার। আমরা জানি যার ভর আছে তার গতিবেগ কখনো আলোর বেগের সমান হতে পারে না, বড় জোর তার কাছাকাছি হতে পারে। এই এক্সেলেটরে প্রোটিনের গতিবেগ আলোর গতিবেগের 99.999999 (আটটা নয় পাশাপাশি!) শতাংশ। এটি মোটামুটিভাবে একটি অচিন্তনীয় ব্যাপার।
এল. এইচ. সি. পদার্থবিজ্ঞানের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অমীমাংসিত বিষয়ের উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে এবং পৃথিবীর পুরো বিজ্ঞানী সমাজ তার জন্যে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে। বিগ ব্যাংয়ের পর . কেমন করে পদার্থের পরিমাণ প্রতি-পদার্থ থেকে বেড়ে গেছে সেই প্রশ্নের উত্তরটিও এল, এইচ. সি. খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে।
এবারে পদার্থ এবং প্রতি-পদার্থের একটা অভূতপূর্ব বিশেষত্বের কথা বলে শেষ করা যাক। 22.3 নং ছবিতে দেখানো হয়েছে A এবং B বিন্দু থেকে যথাক্রমে একটি ইলেকট্রন এবং তার প্রতি-পদার্থ পজিট্রন রওনা দিয়ে C বিন্দুতে একে-অপরকে আঘাত করে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এই বিষয়টাকে আসলে সম্পূর্ণ অন্যভাবে বলা যায়। আমরা বলতে পারি A বিন্দু থেকে একটা ইলেকট্রন রওনা দিয়ে দিয়ে C বিন্দুতে এসে সময়ের উল্টো দিকে যাত্রা শুরু করে অতীতে B বিন্দুতে এসে হাজির হয়েছে! পদার্থবিজ্ঞানের চোখে দুটি হুবহু একই ব্যাপার।
অর্থাৎ প্রতি-পদার্থ হচ্ছে সময়ের উল্টো দিকে বহমান পদার্থ! এর পরেও কেউ কী অস্বীকার করতে পারবে পদার্থবিজ্ঞান থেকে রহস্যময় বিজ্ঞান আর কিছু নেই?