যোধপুর পার্ক বাস স্ট্যান্ডের কাছে সোমনাথের সঙ্গে এক ভদ্রলোকের দেখা হয়ে গেলো। ভদ্রলোক নিজেই পরিচয় দিলেন, “সোমনাথ না? তোমার বন্ধ, সুকুমারের বাবা আমি। বদ্ধ পাগল হয়ে গেছে সুকুমার। দিনরাত জেনারেল নলেজের কোশ্চেন বলে যাচ্ছে। বোনদের মাররোর করেছে দু-একদিন। দড়ি দিয়ে হাত-পা বেধে রাখতে হয়েছিল ক’দিন। মাথায় ইলেকট্রিক শক দিতে বলছে—কিন্তু এক-একবারে ষোলো টাকা খরচ।
“লুম্বিনী পার্ক হাসপাতালে কাউকে চেনো নাকি? ওখানে ফ্রি দ্যাখে শুনেছি। সুকুমারের বাবা বীরেনবাব জিজ্ঞেস করলেন। ভদ্রলোক রিটায়ার করেছেন। স্ত্রীর গরতর অসুখ—ওঁর আবার ফিটের রোগ আছে। মেয়েরাই সংসার চালাচ্ছে। মেজ মেয়ে একটা ছোটখাট কাজ পেয়েছে। না হলে কী যে হতো।
“আমি খোঁজ করে দেখবো,” এই বলে সোমনাথ গোলপার্কের দিকে হাঁটতে আরম্ভ করলো। বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়াতে ভালো লাগলো না।
তাহলে পৃথিবীটা ভালোই চলছে। শিল্প, সাহিত্য, সংগীত ও সংস্কৃতির কেন্দ্রমণি অসভ্য এই নগর কলকাতার চলমান জনস্রোতের দিকে তাকিয়ে আছে সোমনাথ। অভিজাত দক্ষিণ কলকাতার নতুন তৈরি উন্নাসিক প্রাসাদগুলো ভোরের সোনালী আলোয় ঝলমল করছে। চাকরি-চাকরি করে একটা নিরপরাধ সুস্থ ছেলে পাগল হয়ে গেলো—এই সসভ্য সমাজতান্ত্রিক সমাজে তার জন্যে কারও মনে কোনো দুঃখ নেই, কোনো চিন্তা নেই, কোনো লজ্জা নেই।
চোখের কোণে বোধহয় জল আসছিল সোমনাথের। নিষ্ঠুরভাবে নিজেকে সংযত করলো সোমনাথ। “আমাকে ক্ষমা কর, সুকুমার। আমি তোর জন্যে চোখের জল পর্যন্ত ফেলতে পারছি না। আমি নিজেকে বাঁচাবার জন্যে প্রাণপণে সাঁতার কাটছি। আমার ভয় হচ্ছে, তোর মতো আমিও বোধহয় ক্রমশ ড়ুবে যাচ্ছি।”
কে বলে সোমনাথের মনোবল নেই? সব মানসিক দুর্বলতাকে সে কেমন নির্মমভাবে মন থেকে সরিয়ে দিয়ে ব্যবসার কথা ভাবছে।
হীরালাল সাহার কাছ থেকে লাভের টাকা আদায় করতে যাওয়ার পথে একটা কাপড়ের দোকান সসামনাথের নজরে পড়লো। জন্মদিনে বউদিকে সে কিছু, দেবে বলে ঠিক করে রেখেছে। ওখান থেকে একটা তাঁতের শাড়ি কিনলো সোমনাথ। হীরালালবাবুর আগেকার দেড়শ’ টাকা পকেটে পকেটেই ঘুরছে। কী ভেবে আর একটা শাড়ি কিনলো সোমনাথ। বুলবুল হয়তো এতো কমদামী শাড়ি পরবেই না। লুকিয়ে বাপের বাড়ির ঝিকে দিয়ে দেবে। কিন্তু বড় বউদির যা স্বভাব, ওঁকে একলা দিলে নেবেনই না।
কাপড়ের দুটো প্যাকেট হাতে নিয়ে হীরালালবাবুর অফিসে যেতেই দুঃসংবাদ পেলো সোমনাথ। হীরালাল সাহা তাকে ড়ুবিয়েছেন। দ-হাজার টাকা বোধহয় জলে গেলো। কাতরভাবে সোমনাথ বললো, “হীরালালবাবু আপনার অনেক টাকা আছে। কিন্তু ঐ দু-হাজার টাকাই আমার যথাসর্বস্ব।”
হীরালালবাবু কোনো পাত্তাই দিলেন না। দেতো হাসিতে মুখ ভরিয়ে বললেন, “বিজনেসে যখন নেমেছেন, তখন ঝাকি তো নিতেই হবে। আমি তো মশাই আপনাকে ঠকাচ্ছি না। এলগিন রোডের বাড়িটা নিয়ে যে এমন ফাঁপরে পড়ে যাবো, কে জানতো? লরি নিয়ে ভাঙতে গিয়ে পরদিন শুনলাম কারা বাড়ি ভাঙা বন্ধ রাখবার জন্যে আদালতে ইনজাংশন দিয়েছে।”
কপালে হাত দিয়ে বসে রইলো সোমনাথ। হীরালালবাবু বললেন, “সামান্য দু-হাজার টাকার জন্যে আপনি যে বিধবাদের থেকেও ভেঙে পড়লেন। ইনজাংশন চিরকাল থাকবে না, বাড়িও ভাঙা হবে এবং টাকাও পাবেন। তবে সময় লাগবে।”
“কত সময়?” সোমনাথ করুণভাবে জিজ্ঞেস করলো।
সে-খবর হীরালালবাবও রাখেন না। আদালতের ব্যাপার তো! দুটো-তিনটে বছর কিছুই নয়।”