২২. মেডিক্যাল রুমে ঢুকেছিলেন ভার্গিস

বাইশ

ঝড়ের মত মেডিক্যাল রুমে ঢুকেছিলেন ভার্গিস। ততক্ষণে দুজন ডাক্তার কাজ শুরু করে দিয়েছেন। ভার্গিস কিছুক্ষণ আকাশলালকে দেখলেন। এখনও প্রাণ আছে তো শরীরে?

ভার্গিসকে দেখে একজন ডাক্তার এগিয়ে গেলেন, “মারাত্মক ধরনের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। একটু আগে সেটা বন্ধ হয়ে গেল। আমরা চেষ্টা করেছি কিন্তু— ।’

‘মাই গড!’ ভার্গিস বিড়বিড় করলেন। তারপর আবেদন করলেন, ‘ডক্টর। সেভ হিম। ওকে বাঁচান। লোকটার বেঁচে থাকার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।’

‘সরি স্যার। আমাদের আর কিছু করার নেই।’

‘আপনি সিওর,?’

‘হ্যাঁ। হার্ট অনেকক্ষণ বন্ধ হয়ে গেছে। পালস পাওয়া যাচ্ছে না।’

ঝড়ের মত এসেছিলেন। এবার যেন পা সরতে চাইছিল না। আকাশলালের দিকে তাকাতে নিজের জন্যে কষ্ট হল। লোকটা মরে গিয়েও তাকে হারিয়ে দিল। এখন চোখের পাতা বন্ধ, নিঃসাড় শুয়ে আছে। ধীরে ধীরে বাইরে বেরুতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন ভার্গিস, ‘ডাক্তার, আমি না বলা পর্যন্ত কেউ যেন এই খবরটা জানতে না পারে।’

‘আমরা আরও কিছুক্ষণ ওয়াচ করব। তারপর— !’

‘ওয়াচ করবেন মানে? মারা যাওয়ার পর ওয়াচ করে কী লাভ?’ ভার্গিস ঘুরে দাঁড়ালেন।

‘একটু সতর্কতা। হার্ট অ্যাটাকড্‌ কেসে কখনও কখনও মির‍্যাক্‌ল হয়।’

‘প্রে, প্রে ডক্টর।’

‘হ্যাঁ, এখন ওর জন্যে প্রার্থনা করা ছাড়া কোনও পথ নেই।’

‘ওর জন্যে নয়, আমার জন্যে।’ ভার্গিস বেরিয়ে গেলেন।

নিজের ঘরে পৌঁছাতে অনেকসময় লেগে গেল যেন। ধপ করে শরীরটাকে চেয়ারে ছেড়ে দিলেন। খবরটা জানানো দরকার। কাকে জানাবেন? ম্যাডাম না মিনিস্টার। আইনমাফিক চললে মিনিস্টারকেই জানানো দরকার। যে লোকটাকে কাল সকালে তিনি উৎখাত করতেন এখন তাঁকেই সব নিবেদন করতে হবে। না। ম্যাডাম তাঁর প্রতি অনেক অনুগ্রহ দেখিয়েছেন।

ভার্গিস নিজস্ব টেলিফোনের নম্বর ঘোরালেন। কয়েক মুহূর্ত। তারপর টেলিফোন বাজল। কয়েক মুহূর্ত। যে ধরল সে জানাল ম্যাডাম এখন যোগা করছেন। রিসিভার নামিয়ে রাখলেন ডার্গিস। আশ্চর্য! ভদ্রমহিলার ব্যাপার স্যাপার দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। এবার তাঁর নিজের টেলিফোন বেজে উঠতেই ভার্গিসের হাত এগিয়ে গেল, ‘হ্যালো!’

‘ভার্গিস!’

‘ইয়েস স্যার?’

‘ইউ ইডিয়ট, তুমি আকাশলালকে মেরে ফেললে?’ মিনিস্টার চিৎকার করলেন।

‘আমি? আমি মেরে ফেলেছি?’ ভার্গিস হতভম্ব।

‘হু উইল বিলিভ ইউ? পুলিশ কাস্টডিতে কেউ মারা গেলে লোকে তাই ভাববে। তুমি এত কেয়ারলেস যে লোকটাকে মরে যেতে অ্যালাউ করলে!’

‘স্যার। কারও হার্ট অ্যাটাকড্‌ হলে— ।’

‘বললাম তো, লোকে বিশ্বাস করবে না। লোকটা সুস্থ শরীরে কয়েকঘন্টা আগে সবার সামনে দিয়ে হেঁটে এসে ধরা দিল। বিদেশি সাংবাদিকরাও দেখেছে। খবরটা প্রচারিত হওয়ামাত্র কী রিঅ্যাকশন হবে চিন্তা করেছ?’

‘না স্যার, এখনও সময় পাইনি।’

‘তা পাবে কেন? ওকে অ্যারেস্ট করে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছ।’ মিনিস্টার ব্যঙ্গ করামাত্র ভার্গিসের শরীর সোজা হল। লোকটা জানে নাকি সব খবর।

‘শোন ভার্গিস, বোর্ড মিটিং বসেছে। আকাশলালকে ধরার জন্যে আমি তোমার প্রশংসা করে বোর্ড-এর কাছে কিছু সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু এখন যে পরিস্থিতি দাঁড়াল তার জন্যে তোমাকে জবাবদিহি দিতে হবে। আকাশলালকে বিচার করে শাস্তি দিলে জনসাধারণ কিছু বলতে পারত না। এখন তো বিদ্রোহে ফেটে পড়তে পারে। তাছাড়া আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো কাজটা পছন্দ করবে না। কি করতে চাও?’

‘বুঝতে পারছি না। পোস্টমের্টম করে মৃত্যুর কারণ জেনে জনসাধারণকে জানালে কেমন হয়?’ ভার্গিসের প্রশ্নের উত্তর দিলেন না মিনিস্টার। লাইন কেটে দিলেন।

ভার্গিস অপারেটারকে হুকুম করলেন মেডিক্যাল ইউনিটের ডাক্তারকে ধরতে। ডাক্তার লাইনে আসামাত্র তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘কোনও চান্স আছে?’

‘আকাশলাল মারা গেছে। তবে— ।’

‘তবে কী?’

‘কিছুদিন আগে ওঁর বুকে অপারেশন হয়েছিল। হয়তো মাইনর কিছু কিন্তু ভদ্রলোক সুস্থ ছিলেন না এটা পরিষ্কার।’

‘সুস্থ ছিলেন না! কি ডাক্তারি করো, অ্যাঁ! অত লোকের সামনে মেজাজে হেঁটে এল যে তাকে অসুস্থ বলছ? ওর ডেথ সার্টিফিকেট পাঠিয়ে দাও।’

ভার্গিস এবার অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনারদের মিটিং-এ ডাকলেন। সবাই বসলে তিনি চুরুট ধরালেন, ‘আপনারা জানেন আমি আকাশলালকে গ্রেপ্তার করেছি। অর্থাৎ এ রাজ্যে আর কোন ঝামেলা হবে না। কিন্তু লোকটা এই ধাক্কা সামলাতে না পেরে হার্ট ফেল করে মারা গিয়েছে। মিনিস্টার মনে করছেন এর রি-অ্যাকশন খুব খারাপ হবে। আপনারা কী মনে করেন?’

প্রত্যেকে কথা খুঁজতে লাগল যেন। ভার্গিস কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে অসহিষ্ণু গলায় বললেন, ‘বলুন, বলুন, আমি আপনাদের মতামত চাই।’

সিনিয়র অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার বললেন, ‘ওকে ধরার জন্যে আজ গোলমাল হয়েছিল। পাবলিক ভাববে আমরা মেরে ফেলেছি। গোলমাল বাড়বেই।’

‘পাবলিক যদি না জানে?’

সবাই চমকে উঠল। ভার্গিস আবার বলল, ‘ডেডবডি লুকিয়ে ফেলা যেতে পারে। অবশ্য সাংবাদিকরা ছিঁড়ে খাবে আমাকে। কিন্তু পাবলিকের হাতে ডেডবডি দিতে চাইছি না আমি। ওতে আবেগ আরও বেড়ে যাবে।’

কনিষ্ঠ একজন অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার বললেন, ‘ওর এক কাকা বেঁচে আছে। তাঁকে ডেকে এনে কারফিউ থাকাকালীন সময়ে যদি কবর দেওয়া যায়— ।’

ভার্গিস বললেন, ‘গুড আইডিয়া। হিন্দু হলে চিতা জ্বালাতে হত। এটা আজ চুপচাপ সেরে ফেলা যাবে। লোক পাঠাও, ওর কাকাকে ডেকে আনো’

তরুণ অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার বলল, ‘স্যার। দিনের আলো ফোটার আগেই কাজটা করা উচিত এবং কালকের দিনটাতেও কারফিউ রাখুন।’

‘গুড।’

প্রবীণ বললেন, ‘কিন্তু জনসাধারণকে খবরটা একটু একটু করে দিলে ভাল হয়।’

‘যেমন?’

‘আজ টিভিতে অ্যানাউন্স করা যেতে পারে আকাশলালের হার্ট অ্যাটাকড হয়েছে। অবস্থা ভাল নয়। ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে রাখা হয়েছে ওকে!’

‘দ্যাটস স্পেলন্‌ডিড। তাই হবে। মিটিং শেষ।’

টুরিস্ট লজের ঘরে বসে দ্রুত রিপোর্ট টাইপ করছিল অনীকা তার ছোট্ট টাইপরাইটারে। ফিরে এসে ও কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করে জেনেছিল হেডকোয়ার্টার্সে গিয়ে কোনও কাজ হয়নি। ভার্গিস আকাশলালের সঙ্গে সাংবাদিকদের দেখা করতে দেয়নি। আত্মসমর্পণের ঘটনাটার নাটকীয় বর্ণনা শেষ করে সে জানলায় উঠে গেল। রাস্তা সুনসান। কারফিউ জারি হওয়া রাতের রাজপথে এখন একটা কুকুর পর্যন্ত নেই। মাঝে মাঝে পুলিশের গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। খবরটা ‘দরবার’ অফিসে পৌঁছাতে বেশি দূরে যেতে হবে না তাকে। টুরিস্ট লজের একজন কর্মচারী জানিয়েছে পাশেই একজনের ফ্যাক্স মেশিন আছে। লোকটার হাতে দিলে সে ওখান থেকে পাঠিয়ে দেবে। টিভি খুলল অনীকা। সিনেমা দেখানো হচ্ছে। ইংরেজি ছবি। হঠাৎ ছবি বন্ধ হল। ঘোষক জানাল, ‘আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে জানাচ্ছি যে বিদ্রোহী নেতা আকাশলালের শরীর গুরুতর অসুস্থ। তাঁর হৃদযন্ত্রে গোলমাল দেখা দিয়েছে। ডাক্তাররা চিকিৎসা করছেন। তাঁকে ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’

অনীকার কপালে ভাঁজ পড়ল। যে মেয়েটি আকাশলালদের পারিবারিক কবরখানায় গিয়েছিল সে কি জানত এরকমটা হবে। সম্ভাবনার কথা সে বৃদ্ধকে শুনিয়ে এসেছিল। কেউ অসুস্থ হবার আগে কবরের জমি যখন দেখতে যাওয়া হয়, তখন, তখন ব্যাপারটা সাজানো নয় তো?

শহর থেকে মাইল দশেক দূরে একটি ছোট্ট খামারবাড়ির সামনে মধ্যরাতে যে জিপটি থামল তা থেকে নেমে এল একজন পুলিশ অফিসার। তখন ঘড়িতে রাত বারোটা বেজে কুড়ি। চারধার সুনসান। ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামটিতে কুকুরেরাও ডাকছে না। বিশেষ একটি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অফিসার চারপাশে তাকিয়ে নিয়ে দরজায় শব্দ করল। তৃতীয় বারে ভেতর থেকে সাড়া এলে সে ঘোষণা করল, ‘দরজা খুলুন, পুলিশ।’

দরজা খুলল। এক বৃদ্ধা হ্যারিকেন হাতে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে। বোঝাই যায় একটু আগেও ঘুমোচ্ছিলেন। অফিসার জিজ্ঞাসা করল, ‘কর্তা কোথায়?’

‘ঘুমাচ্ছে। শরীরটা ভাল নেই। আবার কী হল?’ বৃদ্ধার কণ্ঠস্বরে ভয়।

‘ডেকে তুলুন। জরুরি দরকার না থাকলে আপনার চুপসে যাওয়া মুখ দেখতে আমি এত রাত্রে আসতাম না। যান, চটপট ডেকে তুলুন। কোনও রকম বাহানা করার চেষ্টা করবেন না।’

অফিসার যে গলায় কথা বলল তারপর বৃদ্ধার সাহস ছিল না দাঁড়িয়ে থাকার। ঠিক তিরিশ সেকেন্ড বাদে বৃদ্ধকে দেখা গেল হ্যারিকেন হাতে। পরনে ঘুমাবার পোশাক। খুব ভয়ার্ত গলায় তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হয়েছে?’

‘আপনার ভাইপোর নাম আকাশলাল?’

‘এই দুর্ভাগ্যের কথা তো সবাই জানে?’

‘হুম্‌। আপনাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে।’

সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধার গলা ভেসে এল পেছন থেকে, ‘সে কী! আমরা লিখিতভাবে ভার্গিস সাহেবকে জানিয়ে দিয়েছি আকাশলালের সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই। যদি তার কোনও খবর পাই সঙ্গে সঙ্গে এখানকার থানায় জানিয়ে দেব। মুশকিল হল, মড়াটা ভুলেও এদিকে আসে না। তা হলে ওঁকে আপনার সঙ্গে যেতে হবে কেন?’

‘প্রয়োজন আছে বলেই যেতে হবে।’ অফিসার ঘোষণা করল।

মিনিট তিরিশের মধ্যে বৃদ্ধকে হাজির করল অফিসার ভার্গিসের সামনে। ভার্গিস চুপচাপ চুরুট খাচ্ছিলেন। বৃদ্ধকে দেখে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘যাক, আপনি বাড়িতে ছিলেন দেখছি। শুনুন, আপনার ভাইপো মারা গিয়েছে।’

বৃদ্ধ চমকে উঠলেন, ‘সে কী!’

‘কেন? দুঃখ উথলে উঠছে নাকি?’

‘আজ্ঞে তা নয়। ওর তো অনেক আগেই মারা যাওয়া উচিত ছিল। তাই।’

‘হুম্‌। আপনি খুব সেয়ানা। আমি লক্ষ করেছি বুড়ো হলেই মানুষ খুব সেয়ানা এবং স্বার্থপর হয়ে যায়। যাকগে। আপনার ভাইপো হার্ট ফেল করেছে। আমরা মারিনি। ওকে স্পর্শ পর্যন্ত করিনি। লোকটা বিয়ে-থা করেনি। আত্মীয় বলতে আপনি। এখন বলুন, আপনি কি পোস্টমর্টেম করাতে চান?’ চুরুট খেতে খেতে ভার্গিস প্রশ্ন করল।

‘কেন? পোস্টমর্টেম তো সন্দেহজনক ক্ষেত্রে করা হয় বলে শুনেছি।’

‘আপনি মনে করতে পারেন আমরা ওকে বিষ খাইয়ে মেরেছি।’

‘ছিঃ। একথা মনে আসার আগে আমার মরণ ভাল। বিচার করলেই ওর যখন মৃত্যুদণ্ড হবে তখন খামোকা বিষ দিতে যাবেন কেন? না, না, পোস্টমর্টেম করার কোনও দরকার নেই। ওঃ এতদিনে দুশ্চিন্তামুক্ত হলাম।’

ভার্গিস বৃদ্ধের দিকে তাকালেন, ‘তুমি একটি খচ্চর বুড়ো।’

‘আজ্ঞে?’

‘শুনুন। পোস্টমর্টেম যদি না চান, একমাত্র আপনিই চাইতে পারেন, তা হলে ওর মৃতদেহের ব্যবস্থা করতে হয়। এই শহরের কবরখানায় আপনাদের পারিবারিক জায়গা আছে। তাই তো?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। তবে বেশি জায়গা অবশিষ্ট নেই।’

‘সেটা আপনাদের সমস্যা। যে জায়গা আছে সেখানেই আকাশলালকে কবর দিতে হবে। বোর্ড চাইছে পাবলিক জানার আগেই কাজটা হয়ে যাক। কিন্তু যদি আপনার এই ব্যাপারে কোনও আপত্তি থাকে তা হলে স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন।’

‘বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। ছেলেটা কিছু লোককে খেপিয়েছিল। তারা জানতে পারলে গোলমাল পাকাবে। এ সব আমার একদম পছন্দ হয় না। আপনারা বেশি দেরি করবেন না। যদি সম্ভব হয় আজ রাত্রেই ওকে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করুন।’

ভার্গিস অফিসারকে বললেন বৃদ্ধকে বাইরে নিয়ে যেতে। এবং সেই সময় তাঁর ব্যক্তিগত টেলিফোন বেজে উঠল। একটু শঙ্কিত হাতে রিসিভার তুললেন ভার্গিস, ‘হ্যালো। ভার্গিস বলছি।’

‘মিনিস্টার ফোন করেছিল?’ ম্যাডামের গলা।

ভার্গিস সোজা হয়ে বসলেন, ‘না ম্যাডাম।’

‘ও কাল সকালে ফোন করবে। একটু আগে বোর্ডের মিটিং হয়ে গেছে। বোর্ড মনে করছে চেষ্টা করলে আকাশলালকে বাঁচানো যেত। মিনিস্টার কিন্তু আপনার পক্ষে সওয়াল। করেননি।’

‘এটা হার্ট অ্যাটাক। আমি এক্ষেত্রে অসহায়।’

‘আমি সেটা বলেছি। এখন কারফিউ চলছে বলে পাবলিক ওপিনিয়ন পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু বোর্ড মনে করছে আগামী কাল শহরে গোলমাল হবেই। আপনি কিভাবে ব্যাপারটার মোকাবিলা করেন তার ওপর বোর্ড আপনার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবে।’ ম্যাডাম বললেন।

‘ম্যাডাম?’

‘আপনি এখন পর্যন্ত কী স্টেপ নিয়েছেন?’

‘আগামী কাল সারাদিন কারফিউ জারি করেছি যাতে কেউ রাস্তায় না নামতে পারে আকাশলালের একমাত্র আত্মীয়, ওর কাকাকে, তুলে এনেছি হেডকোয়ার্টার্সে। তিনি চান না পোস্টমর্টেম হোক এবং অবিলম্বে শেষ কাজ করার পক্ষপাতী।’ ভার্গিস সত্যি ঘটনাটা জানালেন।

‘বাঃ। টিভিকে বলুন লোকটাকে ইন্টারভিউ করতে। ও যদি ওদের কাছে একই কথা বলে তা হলে সেটা বারংবার টেলিকাস্ট করতে বলুন। তাতে পাবলিক হয়তো কিছুটা শান্ত হবে। আপনি বুঝতে পারছেন?’

‘ইয়েস ম্যাডাম।’

‘আকাশলালকে কোথায় রেখেছেন?’

‘মর্গে নিয়ে যেতে চাইনি। এখানকার ঠাণ্ডা ঘরেই আছে।’

‘বেশ। ওর পারলৌকিক কাজকর্মের ব্যবস্থা করুন।’ লাইন কেটে গেল।

ভার্গিস খুশি হলেন। যাক ম্যাডাম এখনও তাঁর পক্ষে আছেন। শালা মিনিস্টাররা ঠিক সময় বুঝে পেছনে লেগেছে। হ্যাঁ, আকাশলাল মরে গিয়ে কিছু ক্ষতি করে গেল। ব্যাটা বেঁচে থাকলে চাপ দিয়ে যেসব খবর বের করা যেত তা আর পাওয়া যাবে না। ব্যাটার কিছুদিন আগে অপারেশন হয়েছিল। করল কে? নিশ্চয়ই ইন্ডিয়ায় গিয়ে করিয়েছে। আর তারই ধকল সামলাতে পারল না।

দরজায় শব্দ হতে ভার্গিস বললেন, ‘কাম ইন।’

তরুণ অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার ঢুকল, ‘স্যার। ডেডবডির ছবি তোলা হয়ে গেছে।’

‘গুড। টিভিকে খবর দিয়েছেন?’

‘এখন তো কারফিউ চলছে— ’

চলুক। গাড়ি পাঠিয়ে ওদের তুলে আনুন। আমাদের ডাক্তার আর ওর কাকাকে ইন্টারভিউ করতে বলুন। এবং সেই ইন্টারভিউটা টেলিকাস্ট করতে বলুন। বুঝেছেন?’

‘হ্যাঁ স্যার।’

‘এসব ব্যাপার একঘণ্টার মধ্যেই হওয়া চাই। ইতিমধ্যে একজন পাদরিকে জোগাড় করুন। একঘণ্টার পর পাদরি আর ওর কাকাকে নিয়ে আপনি যাবেন কবরখানায়। মাটির তলায় ঢুকিয়ে দিয়ে আমাকে রিপোর্ট করবেন।’ ভার্গিস হাত নাড়লেন।

‘স্যার, জনসাধারণকে ডেডবডি দেখার সুযোগ দেবেন না?’

‘হোয়াট? আপনি কী ভেবেছেন? লোকটা কি জাতীয় নায়ক?’

‘না স্যার। আসলে, পাবলিক সেন্টিমেন্ট— ।’

‘তার জন্যে ওর কাকা আছে। আমরা চাইছি কাল সকালে ওর যেন কোনও হদিশ না থাকে। বেঁচে থেকে যা পারেনি মরে গিয়ে লোকটা পাবলিককে দিয়ে সেই বিপ্লব করিয়ে ফেলতে পারে তা জানেন?’

‘সরি স্যার, এটা মাথায় আসেনি।’

পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে টিভির লোকের অনুরোধে ভার্গিস ক্যামেরার সামনে গম্ভীর মুখে বসলেন। তার আগে একজন মেকআপ ম্যান তাঁর বিশাল মুখে পাউডারের পাফ বুলিয়ে দেওয়ায় তিনি একটু নার্ভাস। ইন্টারভিউ দুটো প্রচারিত হবার আগে কমিশনার অফ পুলিশ হিসেবে তাঁর বক্তব্য থাকা দরকার।

আধ ঘণ্টার মধ্যেই রাত দুপুরে বিশেষ বুলেটিন প্রচারিত হতে লাগল। প্রথমে অনেক বার ফ্ল্যাশ ফ্ল্যাশ বিজ্ঞপ্তির পর ভার্গিসের মুখ দেখা গেল, ‘আমাদের প্রিয় জনগণ। আপনারা জানেন দেশের নিরাপত্তা, শান্তি এবং সংহতি বিনষ্ট করার জন্যে আমরা বহুদিন ধরে আকাশলালকে খুঁজছিলাম। গত কয়েক বছরে সে এবং তার দলের লোকেরা দুশো বারোজন দেশপ্রেমিক পুলিশকে হত্যা করেছে। শেষ শিকার আমাদের জাতির গৌরব বাবু বসন্তলাল। আমরা চেয়েছিলাম আকাশলালকে গ্রেফতার করে আইনসঙ্গত ব্যবস্থা নিতে। বিচার চলার সময় সে তার বক্তব্য বলার সুযোগ পেত। এ দেশে কেউ যেমন আইনের ঊর্ধ্বে নয় তেমনি আইনের সাহায্য নিতে আমরা কাউকে বঞ্চিত করতেও পারি না। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের কথা, আজ যখন তাকে আমরা গ্রেফতার করতে পারলাম তখন সে যে অসুস্থ তা বুঝতে পারিনি। সে নিজেও তা প্রকাশ করেনি। গ্রেফতারের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করে তাকে বাঁচাতে পারেননি। একজন দেশদ্রোহীর মৃত্যু এভাবে হোক তা আমরা চাইনি। কিন্তু আমি সবিস্ময়ে আবিষ্কার করলাম আকাশলালের নিকটতম আত্মীয় ওর কাকা এই মৃত্যুতে একটুও বিস্মিত নন। বরং তিনি আফশোস করছেন তাঁর ভাইপোর কোনও শাস্তি হল না। মৃত্যু ওই বৃদ্ধের কাছে শাস্তি নয়। বন্ধুগণ, আকাশলালের মৃত্যু নিয়ে ব্যবসা করার লোকের কোনও অভাব নেই। তারা আপনাদের উত্তেজনা বাড়াবার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু আমি আশা করব দেশপ্রেমিক হিসেবে দেশদ্রোহীদের উসকানিতে আপনারা কান দেবেন না। নমস্কার।’

এরপরেই ডাক্তার এবং আকাশলালের কাকার ইন্টারভিউ প্রচারিত হল। সমস্ত দেশ জানল আকাশলাল নেই। ক্ষোভ দানা বাঁধার সুযোগ পেল না কারফিউ থাকায়! ডাক্তার অথবা সি পির বক্তব্য বিশ্বাস করতে না পারলেও আকাশলালের কাকার কথা উড়িয়ে দিতে পারছিল না বেশির ভাগ মানুষ।

ঘন ঘন টেলিকাস্ট হচ্ছিল সেই রাত্রে। জরুরি অবস্থা বলে টিভি প্রোগ্রাম বন্ধ করেনি। ভার্গিস খুব খুশি। নিজের চেহারাটাকে অবশ্য তাঁর ঠিক পছন্দ হয়নি।

রাত দুটোর পরে তিনটে বিশেষ গাড়ি বের হল হেডকোয়ার্টার্স থেকে। একটিতে তরুণ অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার এবং আকাশলালের কাকার সঙ্গে একজন পাদরি। দ্বিতীয় গাড়িতে আকাশলালের দেহ। তৃতীয়টিতে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত পুলিশবাহিনী। গাড়ি তিনটে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ভার্গিস টেলিফোন করেছিলেন মিনিস্টারকে। খুব সরল গলায় জিজ্ঞাসা করার চেষ্টা করেছিলেন, ‘ওর কাকা চাইছেন এখনই শেষকৃত্য করতে। আপনি কী বলেন?’

মিনিস্টার জবাব দিলেন, ‘দ্যাখো ভার্গিস, আমি বিশ্বাস করি তুমি যদি সেই সময়ে হেডকোয়াটার্সে থাকতে তা হলে আকাশলালের চিকিৎসা আরও আগে করা যেত। এখন যে সিদ্ধান্ত নিতে চাও নাও। তার ফল যদি খারাপ হয় তা হলে তোমাকেই জবাবদিহি করতে হবে। বুঝেছ?’

‘ইয়েস স্যার।’

‘দেন গো অ্যাহেড।’ মিনিস্টার টেলিফোন ছেড়ে দিয়েছিলেন। এখন মধ্যরাত। কোনওভাবেই রাস্তায় মানুষজন নেই। ভার্গিস শুতে গেলেন না। এই লোকটা যদি আজ মরে না যেত তা হলে এতক্ষণে তিনি মিনিস্টার হয়ে যেতেন। সেটা হবেন কি না তা নির্ভর করছে জনতা কী রকম প্রতিক্রিয়া দেখায় তার ওপরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *