২২. মুনা অবাক

মুনা অবাক হয়ে বলল, আপনি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন?

মতিন বলল, জি।

মুনা বলল, Why me?

মতিন জবাব দিল না। মুনার হাতে ধবধবে সাদা রঙের সিগারেটের প্যাকেট। সিগারেটের নাম নিউ অর্লিন্স। মনে হচ্ছে মেয়েদের সিগারেট। মেয়েদের জন্যে প্রস্তুত সমস্ত পণ্যেই ডিজাইনের ব্যাপার থাকে। সিগারেটের প্যাকেটে বিশেষ ডিজাইন আছে। মুনার হাতের লাইটারটির রঙ টকটকে লাল। লাইটারের ডিজাইনও সুন্দর, ছোট্ট একটা কিউব। মুনা সিগারেট ধরাল। লাইটারে চাপ দেবার পর সুন্দর বাজনা বাজা শুরু হয়েছে। সামান্য সিগারেট ধরানোর মধ্যেও বিপুল আয়োজন।

মুনা বলল, আপনি আমার কাছে কেন এসেছেন এই প্রশ্নের জবাব দেন নি।

মতিন বলল, চোরাবালির জাপানি কিংবা রুশ প্রতিশব্দ জানতে এসেছি।

উত্তর শুনে মুনা চমকাল না। সে মনে হয় উদ্ভট কোনো উত্তর শুনবে তার জন্যে প্রস্তুত হয়েই ছিল। সে সিগারেটের ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, জাপানি প্রতিশব্দ আমি জানি না, তবে রুশটা জানি। রুশ ভাষায় চোরাবালি হচ্ছে–জিবুচি পেসুক।

মতিন ডায়েরি খুলে প্রতিশব্দ লিখতে লিখতে বলল, ধন্যবাদ।

মুনা বলল, চা খাবেন?

মতিন বলল, জি-না।

মুনা বলল, জাপানি ভাষার প্রতিশব্দ জানতে চাইলে জেনে দিতে পারি। দশ মিনিটের ব্যাপার।

মতিন বলল, একটা হলেই চলবে।

আপনি কি শুধু এটা জানার জন্যেই এসেছেন?

জি।

যা জানার জন্যে এসেছিলেন তা জানা হয়েছে, এখন চলে যাবেন?

জি। আপনি অনুমতি দিলে উঠব।

যখন এসেছিলেন তখন আমার অনুমতি নিয়ে আসেন নি। হুট করে এসেছেন। যাবার সময় অনুমতি চাচ্ছেন কেন?

ভদ্রতা।

আমার সিগারেট শেষ হোক, তারপর যাবেন।

জি আচ্ছা।

আপনি শুধুমাত্র চোরাবালির রুশ এবং জাপানি প্রতিশব্দ জানতে আমার কাছে এসেছেন, এটা বিশ্বাস হচ্ছে না

মতিন বলল, আমি সত্যি কথাই বলছি। আরেকটা প্রশ্ন ছিল, মানুষ কেন ভয় পায়? কেন আনন্দ পায়? আপাতত চোরাবালিই যথেষ্ট।

মুনা বলল, ধরে নিলাম আপনার চোরাবালির প্রতিশব্দ জানা খুবই প্রয়োজন। কিন্তু আমার কথা মনে হলো কেন? কেন আপনার ধারণা হলো আমি এই দুই ভাষা জানি? আমার চেহারায় কি রুশ ভাব আছে, না জাপানি ভাব আছে?

মতিন চুপ করে রইল।

মুনা বলল, তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আমি সময় নষ্ট করব না। কী জন্যে আপনি আমার কাছে এসেছেন জানতে চাচ্ছি না। আমার সিগারেটও শেষ হয়েছে। আপনি এখন যেতে পারেন।

মতিন উঠে দাঁড়াল। তার কাঁধে ঝুলানো কাপড়ের ব্যাগ থেকে–Autobiography of a Fictitious Poet বইটা বের করে মুনার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, আপনার জন্যে আমি আমার লেখা একটা বইয়ের অনুবাদ এনেছি। বইটা পেঙ্গুইন বের করেছে।

মুনা বিস্মিত গলায় বলল, পেঙ্গুইন বের করেছে?

মতিন বলল, জি।

আশ্চর্য ব্যাপার! ভোরবেলায় বেশ বড় চমক খেলাম। আপনাকে আমার কখনোই কোনো গুরুত্বপূর্ণ লেখক মনে হয় নি। লেখালেখি ফাজলামি মনে করে এমন একজন মনে হয়েছে।

আপনার ধারণা ঠিক আছে, আমি একজন ফাজিল লেখক।

আমার জন্যে বই এনেছেন, আমার নাম লিখে দেবেন না! লেখকের অটোগ্রাফসহ বই পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার।

ম্যাডাম, আপনার নাম লেখা আছে।

কই লক্ষ করি নি তো?

মুনা আগ্রহের সঙ্গে বই-এর পাতা উল্টে এক জায়গায় থমকে গেল। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা—

মুনাকে
যার সঙ্গে প্রায় রাতেই
গহীন এক জঙ্গলে দেখা হয়।
নদ্দিউ নতিম

মুনা গম্ভীর গলায় বলল, এই লেখাটার মানে কী? আপনি আমার সঙ্গে রহস্য করবেন না। স্পষ্টভাবে বলবেন। দাঁড়িয়ে থাকবেন না। বসুন। আমি চা। দিতে বলছি। চা খান। সিগারেট খান। তারপর পুরো বিষয়টা ব্যাখ্যা করুন। প্রথমে বলুন, রূপবতী মেয়ে দেখামাত্র তার প্রেমে পড়ার বদঅভ্যাস কি আপনার আছে?

মতিন বলল, আমার নেই, তবে নদ্দিউ নতিম সাহেবের আছে। উনি বিরাট প্রেমিক পুরুষ। একজীবনে তিনি অনেক মেয়ের প্রেমে পড়েছেন।

মুনা বলল, খুকখুক কাশি আমার সামনে কাশবেন না। আমার সঙ্গে ঝেড়ে কাশবেন।

মতিন বলল, জি আচ্ছা। চা দিতে বলুন। চা খেয়ে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে ঝেড়ে কাশব।

মতিন পরপর দুকাপ চা খেল। এক পিস কেক খেল। ঘরে তৈরি পনিরের সমুচা খেয়ে সিগারেট ধরাতে ধরাতে তার স্বপ্নের কথাটা বেশ গুছিয়ে বলল। মুনা একবারও তাকে থামাল না। কথার মাঝখানে কোনো ব্যাখ্যা চাইল না। মতিন কথা শেষ করে বলল, আপনার সঙ্গে গহীন জঙ্গলে আমার দেখা হয় কথাটা এইজন্যেই লিখেছি। আপনি কি আমার গল্পটা বিশ্বাস করেছেন?

মুনা বলল, বিশ্বাস করলাম। সর্বশেষ স্বপ্ন কবে দেখেছেন?

গতরাতে দেখেছি।

স্বপ্নে আমার পোশাক কী ছিল?

মতিন জবাব দিল না।

আপনার কি মনে আছে, কী পোশাক ছিল? না-কি মনে নেই?

আমার মনে আছে।

মুনা বলল, আপনার মনে আছে কিন্তু আপনি বলতে চাচ্ছেন না, তাই তো?

জি।

মুনা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে বিদায়। আমি আপনার বই পড়ে দেখব। বইটা যদি ভালো লাগে আপনাকে জানাব। আমার কাছ থেকে কোনো সাড়া না পেলে বুঝবেন বই আমার পছন্দ হয় নি।

জি আচ্ছা।

আপনার বান্ধবী নিশুকে নিয়ে মামলা চলছে। পত্রিকায় খুব লেখালেখি হচ্ছে। আমি কিছু কিছু পড়েছি। মামলার অবস্থা কী?

অবস্থা ভালো না।

আসামিরা সব ছাড়া পেয়ে যাবে?

জি।

রেপ কেইসের সমাপ্তি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এরকম হয়। আপনারা ভালো কোনো লইয়ার দিচ্ছেন না কেন? কমলের বাবাকে নিন।

উনি এ ধরনের মামলা করবেন না।

বলে দেখেছেন?

জি-না।

আমি কি বলে দেব?

মতিন বলল, আমার লেখা বইটা যদি আপনার পছন্দ হয় তাহলে আপনি বলে দেবেন, আর যদি পছন্দ না হয় তাহলে কিছু বলতে হবে না।

মুনা শান্ত গলায় বলল, It is a deal.

 

মতিন এখন যাচ্ছে আজহার উল্লাহর কাছে। তাঁকে একটা বই দেবে। আজ মতিনের বই বিতরণ দিবস। সেখান থেকে যাবে সালেহ ইমরানের কাছে। তাঁকে দেবে একটা। তাঁর পুত্র কমলকে দেবে একটা। তিনটা বই চলে যাচ্ছে। এক পরিবারের কাছে। মুনা পাচ্ছে একটা। পাঁচ বই পাঁচ জায়গায়। তার কাছে শূন্য। এই ভালো। এত কাল নদী কূলে যাহা লয়ে ছিনু ভুলে সকলি দিলাম তুলে থরে বিথরে–টাইপ ব্যবস্থা। বিথরে শব্দের মানে কী? ডিকশনারিতে কি এই শব্দ আছে? বিথারা বলে একটা শব্দ আছে। বিথর বলে কিছু কি আছে? নিশুকে জিজ্ঞেস করতে হবে।

আকাশ মেঘলা। আকাশ মেঘলা হলে হাঁটতে ভালো লাগে। মাথায় রোদ। কিংবা বৃষ্টি নিয়ে হাঁটা যায় না। তখন রিকশার খোঁজ পড়ে। মতিনের হাঁটতে ভালো লাগছে। রাস্তায় যানজট নেই। থাকলে ভালো হতো। যখন প্রচণ্ড যানজটে আন্ধা গিটু লেগে যায় তখন হাটতে বড়ই আরাম। মনে আলাদা। আনন্দ–তোমরা আটকা পড়ে গেছ, আমি মুক্ত বিহঙ্গ।

আজহার উল্লাহকে পাওয়া গেল না। অফিস থেকে জানা গেল তিনি গুরুতর অসুস্থ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তিনশ এগারো নম্বর কেবিনে আছেন। অবস্থা ভালো না। লোকজন চিনতে পারেন না।

ভরদুপুরে মতিন ঢাকা মেডিকেল কলেজে উপস্থিত হলো। আজহার উল্লাহ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। তার নাকে অক্সিজেনের নল। রোগীরা সাধারণত কাত হয়ে শুয়ে থাকে। তিনি সরলরেখার মতো সোজা হয়ে শুয়ে আছেন। তাঁর বিছানার চাদর সাদা। গায়ে যে চাদর দেয়া আছে তার রঙ গাঢ় সবুজ। মতিনের পায়ের শব্দে আজহার উল্লাহ চোখ মেললেন। ঘাড় ফিরিয়ে মতিনকে দেখলেন এবং অস্পষ্ট গলায় বললেন, কেমন আছ?

মতিন বলল, আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন?

আজহার উল্লাহ বললেন, কেন চিনব না! তুমি বিখ্যাত উজবেক মরমী কবি। নদ্দিউ নতিম। আমি পনেরো দিন ধরে হাসপাতালে পড়ে আছি। প্রতিদিন ভাবি, সবাই দেখতে এলো–উজবেক কবি কেন আসল না?

আপনি একা কেন?

কিছুক্ষণ আগেও আমার মেয়েটা আমার সঙ্গে ছিল। আজ তার ইউনিভার্সিটিতে খুবই জরুরি কাজ, প্রজেক্ট সাবমিশন। সে চলে আসবে।

মতিন আজহার উল্লাহর বিছানার পাশে বসতে বসতে বলল, শুনেছিলাম আপনার শরীর খুবই খারাপ। কাউকে চিনতে পারেন না।

আজ সকাল থেকে শরীরটা ভালো। নেভার আগে প্রদীপ জ্বলে উঠে। আমারটা জ্বলেছে। আমার সময় শেষ। উজবেক কবির মৃত্যু-বিষয়ক কোনো রচনা আছে?

আছে।

শোনাও তো!

শিশু পুত্র আঁখি মেলি হেরিল এ ধরা
শ্যামল, সুন্দর স্নিগ্ধ, গীত গন্ধ-ভরা;
বিশ্বজগতেরে ডাকি কহিল, হে প্রিয়
আমি যতকাল থাকি তুমিও থাকিয়ো।

আজহার উল্লাহ বললেন, মারহাবা। খুবই সুন্দর। শিশু তার চারপাশের জগতকে বলছে–আমি যতকাল থাকি তুমিও থাকিও। তাই তো থাকে। যখন কেউ চলে যায় জগৎ সংসারও চলে যায়। এটা নদ্দিউ নতিম সাহেবের লেখা?

মতিন বলল, জি-না স্যার। এটা রবীন্দ্রনাথের কবিতা। নদ্দিউ নতিম সাহেবের সমস্যা হচ্ছে অনেকের অনেক বিখ্যাত কবিতাকে উনি তার নিজের মনে করেন।

মতিন, তুমি দুপুরে আমার সঙ্গে খাবে। জি আচ্ছা।

হাসপাতালের খাবার না। আমার মেয়ে আমার জন্যে খাবার নিয়ে আসবে। দুজনের জন্যে খাবার আনবে, আমরা তিনজন ভাগ করে খাবো।

জি আচ্ছা।

মতিন!

জি স্যার।

আমার একটা ছেলে ছিল, আট বছর বয়সে ছেলেটা মারা যায়। সে বড় হলে তোমার মতো রূপবান হতো। তোমার চেহারা যে রাজপুত্রের মতো এটা নিশ্চয়ই তুমি জানো। আয়নায় মুখ দেখো না?

দেখি।

কলেজে বা ইউনিভার্সিটিতে তোমার বন্ধুরা তোমাকে কী ডাকত? প্রিন্স ডাকত না? আমাদের সময় সুন্দর ছেলের নাম হয়ে যেত প্রিন্স।

আমাকে সবাই ডাকত মাকাল বাবু।

মাকাল ডাকত? হা হা হা। এই নামটাও তো খারাপ না। মাকাল বাবু, এক কাজ কর। আমাকে ধরাধরি করে আধশোয়া করে দাও। হাসপাতালের কাউকে ডাক, নাক থেকে যেন যন্ত্রপাতি খুলে ফেলে।

শরীর ভালো লাগছে?

খুব ভালো লাগছে না, কিন্তু আমার স্বাভাবিকভাবে বসতে ইচ্ছা করছে। কথা বলতে ইচ্ছা করছে। আমি চাই আমার মেয়ে এই দৃশ্য দেখে চমকে উঠুক। একটা হাসির গল্প বলো তো।

হাসির গল্প?

হ্যাঁ জোকস। এখন তো খবরের কাগজে জোকস ছাপা হয়। কোনোটা পড়ে হাসি আসে না। তুমি একটা বলো যাতে হাসি আসে।

মতিন বলল, আপনার মন আজ ভালো, যে গল্পই শুনবেন আপনার হাসি আসবে।

একটা বলো দেখি হাসি আসে কি-না।

দাঁড়ান মনে করি।

হ্যাঁ, মনে পড়েছে। রাজনৈতিক জোকস। প্রেসিডেন্ট বুশকে নিয়ে রসিকতা। প্রেসিডেন্ট বুশ তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিসা রাইসকে বললেন, ইরাকের মানুষ মরল না বাঁচল এটা নিয়ে কারোরই কোনো মাথাব্যথা নেই। আগামী সাংবাদিক সম্মেলনে আমি এটা প্রমাণ করে দেব।

সাংবাদিক সম্মেলন শুরু হলো। জর্জ বুশ বললেন, আমি ঠিক করেছি ইরাকে সবকিছু নতুন করে হবে। প্রথমে আমি ইরাকের সব মানুষকে মেরে ফেলব। তারপর একটা রাজহাঁস মারব।

সব সাংবাদিক একসঙ্গে প্রশ্ন করল, রাজহাঁস কেন?

জর্জ বুশ কন্ডোলিসা রাইসের দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখলে তো ইরাকিদের নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। সবার মাথাব্যথা রাজহাঁস নিয়ে।

 

আজহার উল্লাহ সাহেবের মেয়ে মৃন্ময়ী দুপুর দুটায় টিফিন কেরিয়ার করে খাবার নিয়ে এসে কেবিনের দরজার পাশে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তার গুরুতর অসুস্থ বাবা বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছেন। তাঁর নাকে অক্সিজেনের নল লাগানো নেই। তার বাবার সামনে সিনেমার নায়কের মতো চেহারার এক যুবক। বসে আছে। দুজনেই গলা ছেড়ে হাসছে। এ-কী কাণ্ড!

আজহার উল্লাহ মেয়েকে দেখে হাসি থামিয়ে বললেন, মৃন্ময়ী মা, এ হলো। বিখ্যাত উজবেক কবি নদ্দিউ নতিম। তার আরেকটা নাম আছে, মাকাল বাবু। হা হা হা।

মতিন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। তার সামনে মায়া মায়া চেহারার শ্যামলা একটা মেয়ে। নাক চাপা। বড় বড় চোখ। চোখভর্তি বিস্ময়।

মৃন্ময়ী মতিনের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বলল, আপনার মন্ত্রটা কী বলুন তো? কোন মন্ত্র দিয়ে আপনি আমার বাবাকে ভালো করে ফেলেছেন? আপনি এত দেরিতে এসেছেন কেন? আগে আসতে পারলেন না?

আজহার উল্লাহ বললেন, উজবেকিস্তান থাকে। আসবে কী করে? হা হা হা।

মৃন্ময়ী বলল, বাবা, হাসি বন্ধ কর তো। তোমার হাসির ধরন ভালো লাগছে না।

তুই সুন্দর করে হেসে আমাদের দেখা। হা হা হা। কী বলো কবি সাহেব, ও হেসে দেখাক কী করে হাসতে হয়।

মতিন দুপুরে হাসপাতালে খাওয়া-দাওয়া করল। আজহার উল্লাহ সামান্য কিছু মুখে দিয়েই শুয়ে পড়লেন। তার জ্বর আসছে। জ্বর নিয়েই কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। মতিন মৃন্ময়ীর হাতে তার বইটা দিয়ে বলল, ঘুম ভাঙলে স্যারের হাতে দেবেন।

মৃন্ময়ী চোখ কপালে তুলে বলল, আপনার বই পেঙ্গুইন বের করেছে!

মতিন বলল, আমার বই না। নদ্দিউ নতিম সাহেবের বই। আমি কেউ না।

মৃন্ময়ী বলল, আবার কবে আসবেন?

জানি না।

বাবা যে আপনাকে কী পছন্দ করে! বাবা ঠিক করে রেখেছেন, সুস্থ হলেই তিনি আপনাকে নিয়ে তাঁর গ্রামের বাড়িতে যাবেন। আপনি কি যাবেন?

অবশ্যই যাব।

আপনি কাউকে না বলতে পারেন না। তাই না?

ঠিক বলেছেন। কাউকে না বলতে পারি না।

মৃন্ময়ী বলল, যারা কাউকে না বলতে পারে না তারা আবার কাউকে হ্যাঁও বলতে পারে না।

মতিন ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এই কথাও সত্যি। মৃন্ময়ী, যাই।

মৃন্ময়ী সামান্য চমকাল। কেন চমকাল সে নিজেই জানে না।

আজহার উল্লাহ সেদিনই রাত এগারোটায় মারা গেলেন। শ্বাসকষ্ট শুরু হবার আগ পর্যন্ত তার হাতে ছিল মতিনের বই। তিনি বই পড়তে পড়তে বেশ কয়েকবার বললেন–মারহাবা। মৃন্ময়ী বলল, বাবা, তোমার কষ্ট হচ্ছে। তুমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাক।

আজহার উল্লাহ বললেন, শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে না মতিনের সঙ্গে আবার দেখা হবে। যদি দেখা না হয় তুই আমার হয়ে মতিনের মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে দিবি। পারবি না?

মৃন্ময়ী বলল, পারব। অবশ্যই পারব।

আমার দেখা দশটা ভালো ছেলের মধ্যে সে একটা।

একবার তুমি বলেছিলে পাঁচটা ভালো ছেলের মধ্যে সে একটা।

তাহলে সেটাই ঠিক।

বাবা, আর কথা না। চুপ করে শুয়ে থাক।

আজহার উল্লাহ হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, দেখ তো কটা বাজে?

দশটা চল্লিশ।

মা, তুই আমার হাত ধরে বসে থাক। একটুও নড়বি না।

মৃন্ময়ী বাবার হাত ধরে বসে রইল।

আজহার উল্লাহ ভাগ্যবান একজন মানুষ। অতি প্রিয় একটি মুখের দিকে তাকিয়ে অজানার উদ্দেশে যাত্রার সৌভাগ্য বেশি মানুষের হয় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *