২২. মিলির বিয়ে

মিলির বিয়ে বেশ স্বাভাবিকভাবে হয়ে গেল। বাঙালী বিয়ে যেভাবে যেভাবে হওয়া উচিত সেভাবেই হল। গায়ে-হলুদে মাছ পাঠাল বরের বাড়ি থেকে। সেই মাছ সাইজে প্রকাণ্ড হল না। মাঝারি সাইজের কাতল। মিলির মামি বললেন, মনে হচ্ছে ফকিরের পুল। সরপুটি পাঠিয়ে দিয়েছে।

মিলির দুঃখে কান্না পেতে লাগল। এখনো বিয়ে হয়নি তারপরেও বরপক্ষের বিরুদ্ধে উচ্চারিত প্রতিটি বাক্য তার গায়ে লাগছে। তার কাছে মনে হচ্ছে মাছটা তো বেশ বড়ই লাগছে। এরচে বড় মাছের দরকার কি?

বিয়েতে আনা গয়নাগাটি নিয়ে খুব হাসোহাসি হতে লাগলো। মিলির দূর সম্পর্কের এক বোন গলার হারটা নিয়ে টেবিল ল্যাম্পের সামনে ধরে হাসতে হাসতে ভেঙে গড়িয়ে পড়ে গেল।

কি রকম পাতলা দেখেছ? গয়নার ভেতর দিয়ে লাইট পাস করছে।

মিলিকে মুখ হাসি হাসি করে রাখতে হচ্ছে, নয়ত সবাই ভাববে কথাগুলি সে গা পেতে নিচ্ছে। সে মুখ হাসি হাসি করে রাখল। তবে মনে মনে বলল, লাইট তোর মোটা মাথা দিয়ে পাস করছে–হাঁদিরাম কোথাকার।

বরকে নিয়েও অনেক হাসোহাসি হল। অপরিচিত সুন্দরমত একজন মহিলা বললেন, বর দেখেছি? হাত ভর্তি গরিলার মত লোম। এই ভদ্রলোকের শীতকালে কোন কৰ্ম্মবল লাগবে না। ন্যাচারেল উলেন কম্পবলে গড় অলমাইটি উনাকে ঢেকে দিয়েছেন। এই জাতীয় কুৎসিত কথাতেও মিলিকে অন্যদের মত হাসতে হল। সে লক্ষ্য করল, সবাই হাসছে, শুধু তার দুই ভাই মুখ কাল করে দাঁড়িয়ে আছে। সবচে তাকে যে ব্যাপারটা কষ্ট দিল তা হচ্ছে আতাহারের চোখে পানি ছল ছল করছে। ভাইয়া কখনো কাঁদে না। বাবার মৃত্যুর দিন সবাই হাউমাউ করে কেঁদেছে, ভাইয়া কাঁদেনি। মনে হচ্ছে আজ বোনের অপমানে সে কেঁদে ফেলবে।

মিলি মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগল। হে আল্লাহ! ভাইয়া যেন কেঁদে না ফেলে। ভাইয়া যেন কেঁদে না ফেলে। ভাইয়া কেঁদে ফেললে সে আর নিজেকে সামলাতে পারবে না। মিলি মনে মনে আতাহারের সঙ্গে কথা বলতে লাগল। তার মন বলছে, মনের কথাগুলি কোন না কোনভাবে ভাইয়ার কাছে পৌছে যাবে। মনে মনে কথা বলার এই কৌশল আল্লাহ মানুষকে যখন দিয়েছেন তখন কোন উদ্দেশ্য নিয়েই দিয়েছেন। শুধু শুধু তো দেননি। মিলি বলতে লাগল–

ভাইয়া তুই এমন মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বিয়ে হচ্ছে ভাগ্যের ব্যাপার। আল্লাহ পৃথিবীতে জোড়া মিলিয়ে মানুষ পাঠান। যার যেখানে বিয়ে হবার সেখানেই হয়। আমার এই মানুষটার সঙ্গে বিয়ে হবার ছিল বলেই হচ্ছে। মানুষটার গভর্তি গরিলার মত লােম থাকলেও কিছু করার নেই। মানুষের চেষ্টায় যদি কিছু হত তাহলে তো বড় আপু আমেরিকায় যে ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছিল তার সঙ্গেই বিয়ে হত। আমি তো রাজিই ছিলাম। ছেলেটা আমাকে দেখে পছন্দ করে গেছে। তারপর দুদিন পর অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে। আমাদের খবর দেবারও দরকার মনে করেনি। এই ছেলের গভর্তি লোম থাকুক বা না থাকুক, সে তো আমাকে এরকম অপমান করেনি। ভাইয়া, আমি এই ছেলেকে আমার সমস্ত ভালবাসা দিয়ে ভালবাসব। তুই দেখিস আমি কত সুখী হব। সুন্দর সুন্দর ছেলেমেয়ে হবে আমার। তুই যখন আমাকে দেখতে যাবি তখন তারা মামা মামা বলে তোর গায়ে ঝাপিয়ে পড়বে। তুই হাসতে হাসতে কপট বিরক্তিতে বলবি, মিলি, তোর বাচ্চাগুলি তো দুষ্টের শিরোমণি হয়েছে। না, তোদের বাসায় আর আসা যাবে না।

ভাইয়া, আমাদের সংসারটা ভেঙে গেছে। আমাদের খুব সুন্দর সংসার ছিল। বাবা গেলেন মরে। মার এখন আর কোন কুঁশি-জ্ঞান নেই। তুই আর ছোট ভাইয়া আশ্ৰিতের মত অন্যের বাড়িতে আছিস। আমি জানি, এইসব তোর গায়ে লাগে না। কোন কিছুই তোর গায়ে লাগে না। তুই ফুটপাতেও চাদর গায়ে দিয়ে জীবন পার করে দিতে পারবি। কিন্তু আমার খুব লাগে। আমি রাত-দিন কি প্রার্থনা করি জানিস? আমি রাত-দিন প্রার্থনা করি–যেন তোর একটা বিয়ে হয়। ভেঙে যাওয়া সংসার আবার জোড়া লাগে। কোন এক ছুটিছাটায় আমি আমার স্বামী এবং ছেলেমেয়ে নিয়ে তোর বাড়িতে উপস্থিত হব। আমরা খুব হৈ-চৈ করব। সেকেন্ড শোতে ভাবীকে নিয়ে আমি সেজোগুজে সিনেমা দেখতে যাব। আমার বরকে সঙ্গে নিতে হবে, নয়ত টিকিট কাটবে কে? তাছাড়া অতি রাতে আমরা দুজন মেয়ে মানুষ তো আর ফিরতে পারব না। তুই বাসায় বসে তোর ভাগ্নে-ভাগ্নিকে নিয়ে খেলবি। গল্প বলে ওদের ঘুম পাড়াবি?

 

বিয়ে হয়ে গেল। কনেকে স্বামীর হাতে তুলে দেবার একটা অনুষ্ঠান আছে। মিলির বড় মামা এই দায়িত্ব নিতে এগিয়ে এলেন। মিলি ক্ষীণ গলায় বলল, মামা, ভাইয়াকে আসতে বলুন। এই কাজটা ভাইয়া করুক। মিলির বড়মামা মিলির কথায় আহত হলেন, তবে আতাহারকে ডেকে নিয়ে এলেন। রাগী গলায় বললন, বোনের হাত ধর। হাত ধরে ছেলের হাতে তুলে দাও।

আতাহার মিলির হাত ধরল।

মিলির বড়মামা বললেন, হাত ধরে বেকুবের মত দাঁড়িয়ে আছ কেন? বল, আমার বোনকে আপনার হাতে তুলে দিলাম। তাকে সুখে রাখবেন।

আতাহার বলল, আমার বোনকে আমি আপনার হাতে তুলে দিলাম। তাকে আপনি সুখে রাখুন, বা না রাখুন সে আপনাকে সারাজীবন সুখে রাখবে।

মিলি দেখল, আল্লাহ তার প্রার্থনা শুনেননি। আতাহার কাঁদছে। ছোট বাচ্চাদের মত ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে।

মিলির ইচ্ছা করছে ভাইয়াকে বুকে চেপে ধরে বলে, কি করছিস তুই! কান্না বন্ধ করতো, কান্না বন্ধ করা।

সে কিছুই বলতে পারল না। অপরিচিত একটা ছেলের হাত ধরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

 

মিলি তার স্বামীর কর্মস্থল ঠাকুরগাঁয়ে চলে যাচ্ছে। মিলির স্বামী মোঃ জহির উদ্দিন ঠাকুরগাঁ পোস্টাপিসের পোস্টমাস্টার। মিলি ট্রেনে জানালার পাশে বসেছে। নতুন বউদের মাথাভর্তি ঘোমটা থাকার নিয়ম। মিলির মাথায় ঘোমটা নেই। সে জানোলা দিয়ে মুখ বের করে তাকিয়ে আছে। প্ল্যাটফরমে আতাহার ও ফরহাদ দাঁড়িয়ে আছে। ট্রেন ছাড়তে এখনো দেরি আছে। তারা ট্রেনের জানালার কাছে এসে গল্প করতে পারে, তা করছে না। চুপচাপ দূরে দাঁড়িয়ে আছে। নিজেদের মধ্যে গল্প করলেও হত। তাও করছে না। এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন কেউ কাউকে চেনে না। দুজন অপরিচিত মানুষ কি এমন ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়ে থাকে? আতাহারকে সাধারণ একটা শার্ট-পেন্টে কি সুন্দর লাগছে।! ফরহাদকে লাগছে না। সে এমন কুঁজা হয়ে আছে কেন? সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না?

জহির উদ্দিন জানালার কাছে এসে বলল, মিলি, ট্রেন লেট হবে। তুমি চা খাবে?

মিলির হাসি পেয়ে গেল। লোকটার কাণ্ডকারখানা দেখে কাল রাত থেকেই তার হাসি পাচ্ছে। কিভাবে সে স্ত্রীর সেবা করবে, যত্ন করবে তা নিয়ে অতি ব্যস্ত। ব্যস্ততোটা যে খুব হাস্যকর লাগছে তাও লোকটা বুঝতে পারছে না।

তাদের বাসর হয়েছে জহির উদ্দিনের খালাতো বোনের বাড়িতে। রাত একটার দিকে জহির ব্যস্ত হয়ে বলল, মিলি, তোমার কি মাথা ধরেছে? বলেই সে পাঞ্জাবির পকেট থেকে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট বের করল। তার স্ত্রীর মাথা ধরবে এই ভেবে লোকটা কি আগে থেকেই পাঞ্জাবির পকেট ভর্তি করে মাথাধরার অষুধ নিয়ে বসে ছিল?

মিলি বলল, মাথা ধরবে কেন?

তুমি ভুরু কুঁচকাচ্ছ এই জন্যে বললাম। সারাদিনের টেনশনে মাথা ধরা তো স্বাভাবিক। আমার কখনো মাথা ধরে না। সেই আমারই মাথা ধরে গেছে।

না, আমার মাথা ধরেনি।

রাতে ঘুমুতে যাবার সময় সে বলল, মিলি, তুমি খাটের কোনদিকে ঘুমুতে পছন্দ কর?

মিলি বলল, আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না।

অনেকে খাটের দেয়ালের দিকে শুতে পারে না–এ জন্যে জিজ্ঞেস করছি। আচ্ছা তুমি বরং বাইরের দিকে শোও–বাতাস বেশি পাবে। ফ্যানের হাওয়া গায়ে লাগবে।

মিলি মনে মনে হাসল। জহির উদ্দিন বলল, বাসররাতে নিয়ম হল সারারাত বাতি জ্বলিয়ে রাখা। তুমি কি এই নিয়মটার কথা জান?

জানি।

নিয়মটা কোথেকে এসেছে জান?

বেহুলাকে সাপে কাটার পর থেকে এসেছে।

ঠিক বলেছ তো। মিলি, আলো জ্বালা থাকলে কি তোমার অসুবিধা হয়?

আমার কোন কিছুতেই অসুবিধা হয় না।

বিসকিট খাবে মিলি?

আমি খবর নিয়েছি রাতে তুমি ভাল করে খাওনি। এই জন্যে বিসকিট এনে রেখেছি। খাবে? ভাল বিসকিট। দুটা বিসকিট খেয়ে একগ্লাস পানি খাও।

মিলির বিসকিট খাওয়ার কোন রকম ইচ্ছা ছিল না। শুধু লোকটার আগ্রহ দেখে বলল, আচ্ছা। বিসকিট এবং পানি খাওয়া হল।

জহির উদ্দিন বলল, তোমার ঠোঁটে বিসকিটের গুড়া লেগে আছে। দাঁড়াও মুছে দিচ্ছি। সে হাত দিয়ে মুছে দিল। মিলি মনে মনে হাসল। ঠোঁটে হাত দিতে ইচ্ছে করছে–হাত দিলেই হয়? এত ফন্দি কেন?

জহির উদ্দিন বলল, পান খাবে? পান খেলে মুখের মিষ্টি ভাবটা কাটা যাবে।

পানিও কি আপনার পাঞ্জাবির পকেটে?

না, ড্রয়ারে রেখেছি। স্টেডিয়াম থেকে এনেছি। স্টেডিয়ামে একটা পানের দোকান আছে–খুব ভাল পান বানায়।

দুজন দুটা পান খেল। মানুষটার চেহারা মিলির মোটেই ভাল লাগছিল না। কি রকম বিশাল গোলাকার একটা মুখ! ঠোঁটের নিচে ফিনফিনে গোঁফ। কানগুলি ছোট ছোট। দাঁত ছোট ছোট–হাসলে কালো মাড়ি বের হয়ে পড়ে। তারপরেও গভীর রাতে লোকটার খুশি খুশি মনে পান খাওয়া দেখতে দেখতে মিলির মনে হল–লোকটা তো দেখতে খারাপ না। চেহারার মধ্যে কোথায় যেন খানিকটা ভাল লুকিয়ে আছে। বিশাল শরীরের ভেতর লুকিয়ে আছে লাজুক ধরনের ছোট্ট একটা শিশু। মিলির ইচ্ছা করতে লাগল। সে তার হাত বাড়িয়ে দেয়। যেন লজ্জা ভেঙে লোকটা তার হাত ধরতে পারে। লোকটার লজ্জা আবার বেশি বেশি। এখনো স্ত্রীর হাত ধরেনি। শুধু একটা ফন্দি করে একবার ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়েছে।

এই যে এখন জানোলা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। চা খাবে কিনা মিলিকে জিজ্ঞেস করছে। লোকতার আসল উদ্দেশ্য জানালা ধরার অজুহাতে মিলিত হাত ছুঁয়ে দেয়া। মিলির দুটা হাতই জানালায়। মিলি বলল, আমি চা খাব না, তুমি দেখ, ভাইয়ারা খাবে কিনা।

কত সহজে মিলি ভোরবেলা থেকে মানুষটাকে তুমি ডাকছে। যতবারই ডাকছে ততবারই কি যেন দলা পাকিয়ে গলার কাছে উঠে আসতে চাচ্ছে। এর নাম কি ভালবাসা? এতদিন এই ভালবাসা কোথায় ছিল? এই ভালবাসার জন্ম কি শরীরে? দুটা শরীর পাশাপাশি এলেই কি এই ভালবাসা জন্মায়? তাহলে তো খুবই ভয়ংকর কথা। জহির উদ্দিন বলল, মিলি, এক কাজ করি, ছোট ভাইজানকে বলি আমাদের সঙ্গে যেতে। তুমি একা একা যাবে–তোমার খারাপ লাগবে। ছোট ভাইজান কয়েকদিন থেকে আসুক। বলব?

আচ্ছা বল।

উনি বোধহয় যেতে চাইবেন না।

বললেই ও যাবে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে না বললেও ট্রেন যখন ছাড়বে ও লাফ দিয়ে ট্রেনে উঠে পড়বে।

মিলি হাসছে। হাসতে হাসতেই মিলির মনে হল–

বাবার মৃত্যুর পর এমন আনন্দ নিয়ে সে আর হাসেনি। এই প্রথম হাসল। বাবা কি অনেক দূরের কোন ভুবন থেকে মিলির এই হাসি দেখছেন?

 

ফরহাদ গাড়িতে উঠে বসেছে। জহির গেছে। ফরহাদের জন্যে টিকিটের খোঁজে। আতাহার এখনো সেই আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। তাকে একেবারে গাছের মত লাগছে। গাছও মাঝে মধ্যে বাতাস পেলে ডালপালা নাড়ায়–এই মানুষটা তাও নাড়াচ্ছে না। দাঁড়িয়েই আছে। মিলি হাত ইশারা করে ভাইকে ডাকল। আতাহার এগিয়ে আসছে। মনে হচ্ছে নিতান্ত অনিচ্ছায় আসছে।

মিলি বলল, ভাইয়া, এত দূরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

আতাহার বলল, খুব কাছ থেকে কিছু দেখা যায় না রে মিলি। ভাল করে দেখতে হলে একটু দূরে যেতে হয়। দূরে দাঁড়িয়ে তোর আনন্দ দেখছি।

আনন্দ।

আনন্দ তো বটেই। আনন্দে তুই খাবি খাচ্ছিস। কাতলা মাছের মত স্বামী নিয়ে কোন মেয়েকে এত আনন্দিত হতে আমি প্রথম দেখলাম।

মিলি রাগ করল না। হেসে ফেলল। আতাহার বলল, বড়ভাই হিসেবে তোর বিয়েতে তোকে কিছু দিতে পারলাম না। একটা টাকা নেই পকেটে, কোখেকে দেব বল? যাই হোক, তোর জন্যে একটা জিনিস নিয়ে এসেছি। ট্রেন ঠিক যখন ছাড়বে তখন তোর হাতে দেব।

জিনিসটা কি?

তা বলা যাবে না।

ভাইয়া, তুই চাকরি-বাকরি কিছু করবি না?

করব না কেন? অবশ্যই করব। আজ থেকেই চাকরি খোজা শুরু করব।

মাকে রোজ দেখতে যাবি।

মাকে দেখতে যাওয়া অর্থহীন। কে তাকে দেখতে আসছে কে আসছে না, মা তা জানে না। কোম-তে থেকে কিছু বোঝা যায় না। আমার ধারণা, কোম—তে থেকে মা খুব কষ্ট পাচ্ছে। আমাদের উচিত মাকে সহজভাবে মরতে দেয়া।

এই ধরনের কথা মনেও আনবি না। আমি নিশ্চিত মা কোমা থেকে ফিরে আসবে। কিছুদিন আগে আমি স্বপ্ন দেখেছি–তোর বিয়ে হচ্ছে। মা তোর বৌকে হাত ধরে ঘরে নিয়ে যাচ্ছেন।

বউটা দেখতে কেমন?

দেখতে বেশি ভাল না। রোগা কালো, দাঁতগুলি উঁচু উঁচু…

আতাহার বিরক্ত গলায় বলল, স্বপ্নে একটা মেয়েকে দেখবি–তাকেও কুৎসিত দেখতে হবে? মেয়েদের ঈর্ষাবোধ এত প্রবল যে তারা স্বপ্নেও কোন সুন্দর মেয়ে দেখে না।

মিলি হাসি হাসি মুখে বলল, ভাইয়া স্বপ্ন কি আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে? আমি দেখিনি

অবশ্যই করে। এখন পর্যন্ত কোন অসুন্দর মেয়ে। SINIK স্বপ্নে বুকুতীর ভিড় কুকু স্বপ্নে

তুই কবি-মানুষ, তোর কথা আলাদা।

সেটাও একটা কথা।

ভাইয়া, একটা পান খাব। মিষ্টি পান। আশা করি একটা মিষ্টি পান কেনার মত টাকা তোর কাছে আছে।

তা আছে।

 

ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। মিলি উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, ভাইয়া, ট্রেন তো ছেড়ে দিচ্ছে। তুই আমার উপহার দিলি না? দে, কবিতাটা দে। তুই যে পকেটে করে কবিতা নিয়ে এসেছিস সেটা আমি জানি। আতাহার কাগজটা হাতে দিল। ট্রেনের গতি বাড়ছে–আতাহারের হাঁটার গতিও বাড়ছে। জহির উদ্দিন জানোলা দিয়ে গলা বের করে বলল, ভাইজান থামেন থামেন–একসিডেন্ট করবেন, একসিডেন্ট।

মিলি জলে ভেজা চোখ নিয়ে ভাইয়ের কবিতা পড়ছে। লেখাগুলি ঝাপসা লাগছে।

শোন মিলি!
দুঃখ তার বিষমাখা তীরে তোকে
বিঁধে বারংবার।
তবুও নিশ্চিত জানি, একদিন হবে তোর
সোনার সংসার।
উঠোনে পড়বে এসে একফালি রোদ,
তার পাশে শিশু গুটি কয়
তাহাদের ধুলোমাখা হাতে–ধরা দেবে
পৃথিবীর সকল বিস্ময়।

মিলি ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। জহির উদ্দিন বিব্রত মুখে স্ত্রীর পাশে বসে আছে। মিলির কান্নায় ট্রেনের যাত্রিরা কিছু মনে করছে না। স্বামীর বাড়িতে যাবার সময় সব মেয়েই কাঁদে। কাঁদাটাই স্বাভাবিক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *