২২. মা

২২
আজাদেরা চলে আসে ৩৯ মগবাজারের বাসায় ৷ হাজি মনিরুদ্দিন ভিলায় ৷ এ কথা উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার মুক্তিযোদ্ধাদের শিরদাঁড়া দিয়ে বরফের সাপ নেমে যায় ৷ কারণ এই বাসার দেয়ালে এখনও লেগে আছে গুলির সীসা ৷ এই বাসাতেই আজাদেরা ছিল একাত্তরে, এখানেই আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়েছিল বহু মুক্তিযোদ্ধা, এখানে রাখা হয়েছিল অনেক অস্ত্রপাতি-গোলাবারুদ ৷ এই বাসা থেকেই আজাদ গিয়েছিল যুদ্ধে ৷ এখান থেকেই ২৯শে আগস্ট ১৯৭১ দিবাগত রাতে, অর্থাৎ ৩০শে আগস্টের প্রথম প্রহরে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় আজাদকে ৷ এরপর আজাদ আর কোনো দিন ফিরে আসেনি ৷
মগবাজারের দিনগুলোর কথা জায়েদ কিংবা টগর ভুলতে পারে না, পারবেও না ৷ কারণ এই বাসাতেই তারা গুলিবিদ্ধ হয়েছিল, সারা রাত নাকি পড়ে ছিল রক্তশয্যায়, অচেতন ৷ জায়েদের হাতের তালু আবার ঘামতে থাকে, শরীরে বোধ হতে থাকে উত্তাপ ৷
কিন্তু মগবাজারে তাদের দিনগুলো আনন্দপূর্ণই ছিল ৷ আজাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পরীক্ষা দিচ্ছে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে ৷ পাশাপাশি চেষ্টা করছে ব্যবসাপাতি করবার, সংসারটার হাল ধরবার ৷ ফলে তাদের সুদিন ফিরে আসছে, এ রকম একটা ধারণা তাদের হচ্ছিল ৷
আজাদের মাও যেন এ রকম একটা সুদিনের অপেক্ষাতেই ১০টা বছর ধরে কষ্ট আর সংগ্রাম করে আসছেন ৷ তখন জায়েদের একটা দৈনন্দিন কাজ ছিল কাওরানবাজারে সকালবেলায় গিয়ে বড় বড় পাবদা মাছ কিনে আনা ৷ পাবদা মাছ খুব প্রিয় ছিল আজাদের ৷ তা এ বাজার করার কাজটা তখন জায়েদ আনন্দের সঙ্গেই করত ৷ তার তো বেশি দরকার ছিল না, কোনোমতে তিনটা টাকা সরাতে পারলেই একটা রিয়ার স্টলের টিকেট জোগাড় হয়ে যেত ৷ এরই মধ্যে জায়েদের এসএসসি পরীক্ষা হয়ে গেছে, সে পাসও করেছে ৷ ফলে এখন হাতে তার প্রচুর সময় ৷ ছবি দেখাটা সে সময়ের একটা উত্তম ব্যবহার বলে সে গণ্য করত ৷ তবে আরেকটা মজার উপদ্রব ঢাকা শহরে তখন দেখা দিয়েছিল ৷ টেলিভিশন ৷ তাদের বাসায় টেলিভিশন ছিল না ৷ কিন্তু পাশের বাড়িঅলা কুলি খানের একটা টিভিসেট ছিল বটে ৷ তাদের ঘরে টিভি দেখা হতো সন্ধ্যায়, রাতে ৷ জানালা খোলা থাকত ৷ দু বাড়ির মধ্যে একটা অভিন্ন প্রাচীর ৷ সেটায় বসলে ভেতরের টেলিভিশন বেশ আরাম করেই দেখা যেত ৷ সত্য বটে, কুলি খানের দুই মেয়ে ছিল, কিন্তু তাদের দিকে জায়েদের কোনো নজর ছিল না ৷ একদিন সন্ধ্যায় জায়েদ মগ্ন হয়ে টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখছে তার পাঁচিল-আসনে বসে, অনায়াসে, আয়েশ করেই ৷ হঠাৎই একটা লাঠির বাড়ি এসে পড়ে তার পায়ের কাছে দেয়ালের গায়ে ৷ সে তাড়াতাড়ি সরে যায় খানিক ৷ তখনই হুঙ্কার ৷ জায়েদ দেখতে পায় কুলি খানের টাক বারান্দা থেকে আসা আলোয় চকচক করে উঠছে, কুলি খানের হাতের লাঠি আবার দুলে উঠলে জানালা দিয়ে আসা টেলিভিশনের আলোয় সেটা একটা লাঠির একাধিক সচল প্রতিচ্ছবি তৈরি করে তার দিকেই এগিয়ে আসে, কর্তব্য স্থির করতে জায়েদের সময় লাগে না, সে লাফ দিয়ে দেয়ালের এপারে নেমে আসে, কিন্তু আসার আগে তার কাঁধে লাঠির একটা বাড়ি পড়েই যায় ৷ কুলি খানের সরোষ হুঙ্কার চলে আরো খানিকক্ষণ ৷ আজাদ বাসায় ছিল ৷ সে এগিয়ে আসে ৷
জায়েদ তাড়াতাড়ি অন্তর্ধান করার সুযোগ খোঁজে ৷
‘কী হয়েছে রে জায়েদ, মেয়ে দেখতে উঠেছিলি ?’ আজাদ বলে ৷
‘না দাদা, টিভি দেখতে উঠছিলাম ৷’
‘টিভির জন্যে বাড়ি মেরেছে ৷ ছোটলোক আছে তো ৷ চল ৷’
‘কই যাইবেন ?’
‘বায়তুল মোকাররম ৷ এখন খোলা আছে ? না বন্ধ হয়ে গেছে ?’
‘৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে তো!’
‘তাহলে এখনই চল বায়তুল মোকাররমে যাই ৷ টিভি কিনে আনি ৷’
সে রাতেই তারা বায়তুল মোকাররমের টেলিভিশনের দোকানে যায় ৷ বেশির ভাগ দোকান তখন বন্ধ হয়ে গেছে ৷ একটা দুটো খোলা আছে ৷ জায়েদ বলে, ‘দাদা, কালকা আসি ৷ বাইছা ঘুইরা দামাদামি কইরা কিনি ৷’
‘না ৷ আজকেই কিনতে হবে ৷’ আজাদ বলে ৷
তারা একটা স্যানিও ব্লাক অ্যান্ড হোয়াইট টেলিভিশন সেট কেনে, দাম পড়ে ৯৭০ টাকা ৷
বাসায় ফিরে আসার পর টিভিযন্ত্রটা রাতেই সেট করা হয় ৷ সেট করা হয় কুলি খানের বাড়ির দিকের রুমটায় ৷ জানালা খুলে সাউন্ড বাড়িয়ে অন করা হয় টিভি ৷
সেই থেকে এই বাসায় টিভি চলে ৷ জায়েদের খুব প্রিয় অনুষ্ঠান ত্রিরত্ন ৷ হাসির অনুষ্ঠান ৷ ওটা শুরু হলেই আজাদ হাঁক পাড়ে, ‘জায়েদ চলে আয় ৷’ আর আজাদের প্রিয় অনুষ্ঠান লুসি শো ৷
কিন্তু এক রাতে টিভিতে তার প্রিয় অনুষ্ঠান দেখতে বসে জায়েদ রীতিমতো ক্ষেপে যায় ৷ অনুষ্ঠান বন্ধ করে হচ্ছে হাম্দ আর নাত ৷ তারপর দেশাত্মবোধক গান ৷ জায়েদ বসেই থাকে ৷ এরপর যদি ত্রিরত্ন হয় ? না, হয় না ৷ তার বদলে পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত-পাক সাদ জমিন সাদ বাদ… ব্যাপার কী ?
ব্যাপার কিছুই নয় ৷ নতুন সামরিক আইন প্রশাসক এখন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন ৷ কেমন লাগে ? দিন-দুই তিন আগে, ২৪শে মার্চ ১৯৬৯, আইয়ুব খান বিদায় নিয়েছে ৷ এসেছে ইয়াহিয়া খান ৷ ঢাকার লোকদের মধ্যে অবশ্য তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া নাই ৷ আইয়ুব খান যাওয়ায় লোকে খানিকটা খুশি ৷ জায়েদ তো আর রাজনীতি বোঝে না ৷ সে বোঝে টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের ভালো-মন্দ ৷ হাসির নাটক না হয়ে এই শালা মিলিটারি জেনারেলের ইংরেজি বক্তৃতা কে শোনে ?
সে রাগে গজর-গজর করতে থাকে ৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *