মাধুরী বৌ বললো, কী যে বলো ভাই! তুমি ইচ্ছে করে আমাকে ভুলে গেছো, এই রুপ ভাববো আমি? জানি তুমি কতো ব্যস্ত মানুষ?
তারপর সেহে বললো, তুমি আমাদের মেয়েদের গৌরব। কতো নামডাক তোমার, কত ভক্ত তোমার। তার মধ্যে আমিও একজন।
বকুল ওর নিরাভরণ এক হাত মুঠোয় চেপে চুপ করে বসেছিল, আস্তে তাতে একটু চাপ দিয়ে বললো, অনেকের মধ্যে একজন মাত্র, এই কথাটা তোমার সম্পর্কে বোল না।
মাধুরী চুপ করে রইল।
বকুল তাকিয়ে দেখল ঘরটার দিকে। আশ্চর্য, বকূলের ছেলেবেলায় বকুল এই ঘরটার যা সাজসজ্জা দেখেছে, এখনো অবিকল তাই রয়েছে। সেই একদিকের দেয়ালে দুদিকে দুটো থামের মতো মেহগনি পালিশের স্ট্যাণ্ডের ওপর লম্বা একখানা আরশি দাঁড় করানো। সেই ঘরে ঢুকেই সামনের দেয়ালের উঁচুতে একটা হরিণের শিঙের ব্র্যাকেটের ওপর পেতলের লক্ষ্মীমূর্তি, সেই সারা দেওয়াল জুড়ে ফটোর মালা, সেই আরশির স্ট্যাণ্ডটার মতই মোটা মোটা বাজুদার উঁচু পালঙ্ক, তার ওধারে মাথাভরা উঁচু আলনা, তার কোলে একটা সরু-সরু পায়া ছোট্ট টেবিলে দু’চারটে বই, এধারের দেয়ালে টানা লম্বা বেঞ্চের ওপর সারি সারি ট্রাঙ্ক, বাক্স, হাতৰাষ্ট্র।
শুধু সব কিছুতে সময়ের ধুলোয় ধূসর বিবর্ণ ছাপ।
আরশির কাঁচে গোল গোল কালো দাগ, ফটোগুলি মলিন হলুদ, ট্রাঙ্ক বাক্সর ঢাকনিগুলো জীর্ণ, আর দেয়ালগুলো বালি-ঝরা স্যাৎসেঁতে বোবা-বোবা।
চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন শুধু আলনাটার। তখন ওই আলনার গায়ে ঝোলানো থাকতো চওড়া-চওড়া পাড়ের হাতে কোচানো শাড়ি, আর লম্বা লম্বা সেমিজ। এখন সে আলনায় কুলছে পাট করা ধোয়া থান, আর সাদা ফর্সা সায়া ব্লাউজ।
এ ঘরটা নির্মলের মার ঘর ছিল। বাড়ির মধ্যে এই ঘরটাতেই বকুলের অবারিত অধিকার ছিল। নির্মলের মা পশম বুনতেন। বকুল বসে বসে দেখতো আর বলতো, বাবাঃ, ওই সরু সরু দুটো কাঠি দিয়ে এইটুকুন এইটুকুন ঘর তুলে বড়ো বড়ো জিনিস তৈরী! দেখলেই আমার মাথা ঝিমঝিম করে, তার শিখবো কি!
নির্মলের মা হাসতেন। বলতেন, শিখলে দেখবি নেশা লেগে যাবে।
তাহলে বাবা শিখেই কাজ নেই আমার।
নির্মলের মা বলতেন, না শিখলে বিয়ে হবে না। মিষ্টি হাসি, মিষ্টি কথা, মিষ্টি মানুষ।
বড়ো জায়ের ভয়ে সদা সন্ত্রস্ত। সুবিধে পেলেই এই ঘরটির মধ্যেই যেন আত্মগোপন করে থাকতেন।
মাধুরী-বৌও কি তিনতলার এই ঘরটা নিজের জন্যে বেছে নিয়েছে পৃথিবী থেকে আত্মগোপন করে থাকবার জন্যে? কিন্তু আজকের পৃথিবী কি কাউকে নিজের মধ্যে নিমগ্ন থাকতে দেয়? লুকিয়ে থাকা নিজস্ব কোটর যদি কোথাও থাকে, তার ওপর আঘাত হেনে হেনে। পেড়ে না ফেলে ছাড়ে?
বকুল যেন অবাক হয়ে ঘরটার পুরনো চেহারাটা দেখছিল। বকুলদের বাড়িতে ঘর-দালান গলা-দরজাগুলো ছাড়া আর কোথাও কিছু আছে যাতে বকুলের মার হাতের স্পর্শ আছে!
আস্তে বললো, ঘরটার কোনোখানে কিছু বদলাওনি, নড়াওনি! অবিকল রয়েছে সব! কী আশ্চর্য!
মাধুরী বিষণ্ণ একটু হেসে বললো, জিনিসপত্র নাড়িয়ে আর কী নতুনত্ব আনবো ভাই, জীবনটাই যখন অনড় হয়ে বসে আছে!
বকুল ঘাড় নীচু করে বসেছিল।
বকুল এবার সোজা হয়ে বসে বললো, অনড় হয়ে থাকতে পারছো কই! জীবনের মূল শেকড় ধরে তো নাড়া দিচ্ছে আজকের যুগ!
তা দিচ্ছে বটে–মাধুরী বললো, শুনেছো তাহলে?
শুনলাম ছোড়দার মুখে, বকুল বললো, শুনে বিশ্বাস করতে দেরি লাগলো। ছেলেটার। বয়েস হিসেব করতে গিয়ে সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছিল।
তোমার কি, আমারই গুলিয়ে যাচ্ছে! মনে হচ্ছে, সত্যিই কি ওর তের বছর বয়েস!
বকুল একটু চুপ করে থাকে বলে, এখন আছে কেমন?
ডাক্তার তো বলছে সারতে সময় লাগবে। আর চিরকালের মতই অকর্মণ্য হয়ে গেল। ডান হাত তো উড়েই গেছে। গলাটা বুজে গেল বলেই বোধ করি চুপ করে গেল মাধুরী।
কোনো কথা খুঁজে না পেয়েই বোধ করি বকুল বললো, দেখতে যাও?
মাধুরী জানলার বাইর চোখ ফেলেছিল, বললো, একদিনই দেখতে যেতে দিয়েছিল। পুলিসের হেপাজতে তো? ওর মা-বাপও তাই! একদিনের জন্য এসেই চলে গেল। বললো, দেখতেই যখন দেবে না! আর
কেমন একটু হেসে থেমে বললো মাধুরী, আর বললো, সেরে উঠে যাবজ্জীবন জেল খাটুক এই আমাদের প্রার্থনা।
বকুল মাধুরীর মুখের দিকে চেয়ে দেখল।
কেউ যদি এখন মাধুরীকে দেখিয়ে বলে, একদা এ স্বর্ণ-গৌরাঙ্গী সুন্দরী ছিল, এর হাসি দেখলে মনে হতে মাধুরী নাম সার্থক, তাহলে লোকে হেসে উঠবে। অতো ফর্সা রং যে এতো কালো হয়ে যেতে পারে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত। পুড়ে যাওয়ার মত সেই জ্বলে যাওয়া রঙের মুখের দিকে তাকিয়েই থাকে বকুল। মাধুরীর সামনের চুলে কালোর চেয়ে সাদার ভাগ বেশী। মাধুরীর শীর্ণ গালে পেশীর রেখা।
অথচ বকুল প্রায় ঠিকঠাকই আছে।
বকুলের নিজের মেজদিই বলে গেছে-থাকবে না কেন বাবা! শশুরবাড়ির গঞ্জনা খেতে হয়নি, সংসার-জ্বালা পোহাতে হয়নি, আমাদের মতন দু’বছর অন্তর আঁতুড়ঘরে ঢুকতে হয়নি, যেমন ঝিউড়ি মেয়ে ছিল তেমনিই রয়ে গেছে। নইলে বকুলই মার পেটের মধ্যে নিরেস ছিল।
তার মানে বুকুলের মার পেটের সরেস চেহারার সন্তানরা ওই সব জ্বালায় বদলে গেছে। কিন্তু মাধুরী-বৌ?
মাধুরী-বৌয়ের তো ওসব কিছু না।
মাধুরী-বৌ বরের সঙ্গে বাসায়-বাসায় ঘুরেছে, শ্বশুরবাড়ির গঞ্জনা কাকে বলে জানেনি। মাধুরী সেই কোন্ অতীতকালে দু’বার আঁতুড়ঘরে গিয়েছিল, আর যায়নি, তবে?
যখন মাঝে মাঝে ছুটিছাটায় আসতো নির্মল, তখন মাধুরী কেমন দেখতে ছিল মনে আনতে চেষ্টা করে বকুল।
কিন্তু তখন কি মাধুরীর দিকে চোখ থাকতো বকুলের?
তবু ভেবে মনে আনলো, সেই স্বর্ণচাপা রংটাই মনে পড়লো, অথচ এখন রংজ্বলা মাধুরীকে বকুলের থেকে ময়লা লাগছে।
বকুল মনে মনে বললো, আমি তোমার কাছে মাথা হেঁট করছি। তোমার ভালবাসায় সর্বস্ব সমর্পণ ছিল।
বকুল ওই ক্ষুব্ধ হাসির ছাপ লাগা মলিন মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বললো, মাও বললো এই কথা?
মা-ই বেশী করে বললো। তার সঙ্গে অবশ্য আমাকেও অনেক কিছু বললো। মাধুরী শীর্ণ মুখে আর একবার তেমনি হেসে বললো, বলতেই পারে। বিশ্বাস করে আমার কাছে ছেলে রেখে দিয়েছিল–
আর একটু চুপ করে থেকে বললো, ভগবানের সহস্র নামের মধ্যে দর্পহারী নামটাই প্রধান নাম, বুঝলে বকুল! মনে মনে দর্প ছিল বৈকি। দর্প করেই তো ভেবেছিলাম, ঘুষখোর বাবা তার লোভী মার কাছে থেকে ছেলেটা খারাপ হয়ে যাবে। আমার কাছে নিয়ে গিয়ে রাখি ওদের আওতামুক্ত করে। ধারণা ছিল না জগৎ-সংসারে আরো কতো আওতা আছে!
কিন্তু শেষের কথাগুলো কি চমকে-ওঠা বকুলের কানে ঢুকেছিল?
ঘুষখোর বাবা এই শব্দটুকুই যেন বকুলের অনুভূতিটাকে ঝাঁপসা করে দিয়েছিল। ঘুষখোর! নির্মলের ছেলে ঘুষখোর!
বকুল একটু পরে বলে, তোমার ছোট ছেলে?
ছোট? সে তো অনেকদিনই নিজেকে সকলের আওতামুক্ত করে স্বাধীনতার সুখের স্বাদ নিচ্ছে। ময়ূরভঞ্জে চাকরি করে, সেখানেই বিয়ে-টিয়ে করেছে, আসে না–
মাধুরী-বৌয়ের ছেলেরা এমন উল্টোপাল্টা হলো কেন?
মনে মনেই প্রশ্ন করেছিল বকুল! তবু মাধুরী উত্তরটা দিলো, বললো, আমাদের অক্ষমতা। ছেলেদের ঠিকমত বুঝতে পারিনি। লেখাপড়া শেখানোটাই মানুষ করার একমাত্র উপায় বলে ভেবেছি। সেই ভাবনাটা যে ঠিক হয়নি সে-কথা যখন বুঝতে পারলাম তখন আর চারা নেই। ..তোমার নির্মলদা মানুষটা ছিলেন বড়ো বেশী ভালোমানুষ, আর আমি?
মাধুরী আবার একটু ব্যঙ্গমাধানো ক্ষুব্ধ হাসি হাসলো, আমি একেবারে স্রেফ হিন্দু নারী। পতি ছাড়া অন্য চিন্তা নেই–অতএব চোখ-কান বন্ধ করে শুধু চুপ করে গেল।
বকুল কিন্তু ওই জীবনে বিধ্বস্ত মুখটার মধ্য থেকেও একটা আশ্চর্য উজ্জ্বল আলোর আভাস দেখতে পেলো। বকুলের মনে হলো বিধ্বস্ত, কিন্তু ব্যর্থ নয়।
মাধুরী তারপর বললো, কিন্তু ওসব তো সাধারণ ঘটনা, জানা জগতের কথা–এই তেরো বছরের ছেলেটাই আমায় তাজ্জব করে দিয়েছে। বড়ো বড়ো কথা বলত ইদানীং। জেঠিমার যে ওই ভাইপোরা আছেন সারা বাড়িটা জুড়ে, তাদেরই কার একজনের ছেলের সঙ্গে খুব মেলামেশা ছিল। দুজনে খুব কথাবার্তা বলতো, কানে আসতো। ছেলেমানুষের মুখে পাকা কথা শুনে হাসি পেতে। বলতো, এই বুর্জোয়া সমাজের মৃত্যুদিন আসছে, ওরা নিজেরাই নিজেদের কবর রচনা করেছে, নিজেদের চিতা বানিয়েছে।…বলতো, বিপ্লব আসছে, তাকে রোখবার ক্ষমতা অতিবড় শাসকেরও নেই। আরো কত কী-ই বলতো ভাই দুজনে ওদের দালানে বসে। চোখে ঠুলি বেঁধে বসে থাকলেই কড়া রোদকে অস্বীকার করা যায় না, রোদ তার নিজের কাজ করে, চামড়া পোড়ায়। জেঠিমার ভাইপোর ছেলেটা তো কত বড়ো, তবু বুবুন যেন তার সমান সমান এইভাবে আড্ডা দিতো…আমি ভাবতাম বুবুন ওই শোনা কথাগুলো আওড়াচ্ছে, হাসি পেতো। বলতাম, বুবুন, বুর্জোয়া বানান জানিস? বলতাম, বুবুন, দেশে বিপ্লবের রক্তগঙ্গা বওয়াবার ভারটা তাহলে তোরাই নিয়েছিস? তুই আর তোর ওই পন্টুদা?…ও এই ঠাট্টায় লজ্জা পেত না, কেমন একরকম অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকাতে।…ক্রমে ক্রমে সেই চোখে ফুটে উঠতে দেখলাম অবজ্ঞা, ঘৃণা, বিদ্বেষ আর নিষ্ঠুরতা। তবু তখনো তার গুরুত্ব বুঝতে পারিনি ভাই। বরং মাঝে মাঝেই বলেছি, তোর ওই পন্টুদার সঙ্গে মেশাটা কমা দিকি! ও তোর বয়সী নাকি? যতো রাজ্যের পাকা কথা তোর মাথায় ভরছে!…ক্রমশ দেখলাম ওদের। সেই আড্ডা-আলোচনাটা কমে গেল, পন্টুকে তো বাড়িতে দেখতেই পাওয়া যায় না। বুবুনও যথাসময়ে খেয়ে ইস্কুলে যায়। ইস্কুল থেকে ফিরতে অবশ্য দেরি হতো বিস্তর, রাগ করলে বলতো, কাজ ছিলো।…যদি রেগে বলতাম, তুই এতোটুকু ছেলে, তোর আবার কাজ কি? অবজ্ঞার দৃষ্টি হেনে বলতো, বোঝবার ক্ষমতা নেই। জানো তো শুধু সুশীল সুবোধ বালকদের খাইয়ে খাইয়ে মোটা করতে! তবু তোমায় বলবো কি বকুল, ধারণা করতে পারিনি বুবুন ইস্কুলে যায় না, ইস্কুলের মাইনেটা নিয়ে পার্টিকে চাদা দেয়,.বোমা তৈরীতে যোগ দেয়। বরং ভেবেছিলুম পন্টুর প্রভাবমুক্ত হয়েছে বোধ হয়! কে ভেবেছে পন্টু ওকে গ্রাস করেছে!…
থামলো মাধুরী! নিরাভরণ হাতটা তুলে কপালে উড়ে আসা একটা মাছি তাড়ালো।
তারপর আস্তে বললো, শুধু আমার বুবুনই নয় বকুল, দেশ জুড়ে হাজার হাজার বুবুন এইভাবে প্রতিনিয়ত গ্রাসিত হচ্ছে। কিন্তু এর মূলে হয়তো আরো গভীর কারণ আছে। আজকের ছেলেমেয়েদের সব চেয়ে বড়ো যন্ত্রণা তারা শ্রদ্ধা করবার মত লোক পাচ্ছে না। ওদের মনের নাগাল পায়, এমন মা-বাপ পাচ্ছে না। ওদেরকে ভালবাসার বন্ধনে বাঁধতে পারে, এমন ভালবাসার দেখা পাচ্ছে না। আমরা আমাদের নিজের মনের মত করে ভালবাসতে জানি, ওদের মনের মত করে নয়।.. হয়তো আগের যুগ ওতেই সন্তুষ্ট থাকতো, এ যুগের মন-মেজাজ দৃষ্টিভঙ্গী আলাদা, কারণ যে কারণেই হোক এদের চোখ কান বড় অল্প বয়সেই খুলে গেছে। এরা তাই “লোভ”কে লোভ বলে বুঝতে শিখেছে, দুর্নীতিকে দুর্নীতি বলে চিনতে শিখেছে। তাই এদের সবচেয়ে নিকটজনদের ওপরই সব চেয়ে ঘৃণা।
তুমি তো খুব ভাবো, আস্তে বলে বকুল।
মাধুরী বোধ করি এতোক্ষণ একটা আবেগের ভরেই এতগুলো কথা বলে চলছিল, হঠাৎ লজ্জা পায়। লজ্জার হাসি হেসেই বলে, এতো কাল এতো সব কিছুই ভাবিনি বকুল। যেদিন বুবুনের বোমা বানানোর খবর পেলাম, খবর পেলাম চিরদিনের মতো অকর্মণ্য হয়ে যাওয়ার, তখন থেকে ভাবতে শিখেছি। ভাবতে ভাবতেই যেন চোখ খুলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। বুঝতে পারছি–ওদের মধ্যেকার ভালোবাসতে না পারার ভার, শ্রদ্ধা করতে না পারার ভার, চোখ খুলে যাওয়া মনের জ্বালার ভার ওদের মধ্যে সব কিছু ধ্বংস করবার আগুন জ্বালিয়েছে। নইলে অতটুকু একটা ছেলের মধ্যে এতো ঘৃণা এতো অবজ্ঞা আসে কোথা থেকে? যেদিন দেখতে গিয়েছিলাম, বলো কী জানো?–কী দেখতে এলে? যেমন কর্ম তেমনি ফল? ভাবো, তবু জেনে রাখো যে হাতটা আস্ত আছে, সেই হাতটা দিয়েই আবার ওই কাজই করবো দেখো। সেই অবধি ভেবেই চলেছি। আর ভাবছি আমাদের বুদ্ধিহীনতা, আমাদের অন্ধতা, আর আমাদের আপাত-জীবনের প্রতি লোভই আমাদের এই ভাঙনের পথে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। মাধুরীবৌ আবার একটু লজ্জার হাসি হাসলো, বললো, এই দ্যাখো থামবো ভেবেও আবার বড়ো বড়ো কথা বলে চলেছি। আসল কথা, এমন একটি বড়োসড়ো লেখিকাকে দেখেই জিভ খুলে গেছে। সত্যি ভাই, কথা বলতে পাওয়াও যে একটা বড়ো পাওয়া, সেটা যত দিন যাচ্ছে তো টের পাচ্ছি। তোমার সঙ্গে কথা কয়ে অনেকদিন পরে যেন বাচলাম।
বকুলের বার বার ইচ্ছে হচ্ছিল একবার জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছিল নির্মলদার? কিন্তু কিছুতেই ওই নামটা উচ্চারণ করতে পারলো না।
যেন ওই উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে একটি পবিত্র বস্তুর শুচিতা নষ্ট হয়ে যাবে, যেন একটি গভীর গম্ভীর সঙ্গীত হালকা হয়ে যাবে।
মাধুরী বললো, এতোক্ষণ শুধু নিজের কথাই সাতকাহন করলাম, তোমার কথা একটু বলল শুনি।
আমার আবার কথা কী? বকুল ঈষৎ হেসে বলে, আমার তো আর ছেলে বৌ নাতি নাতনী নেই যে তাদের নিয়ে কিছু কথা জমে আছে!
তোমার তো শত শত ছেলেমেয়ে, তাদের সুখদুঃখ ভাঙাগড়ার সংসারটি নিয়ে তুমি তো সদা ব্যস্ত বাবা!
তা বটে।
এত অদ্ভুত ভালো লেখো কী করে বল তো? মাধুরী হাসে, আমি তো ভেবেই পাই না, কী করে এমন করে ঠিক মনের কথাটি বুঝতে পারো। তোমার লেখার এমন গুণ যেন প্রত্যেকটি মানুষের জীবনের সঙ্গে চিন্তার সঙ্গে মিলে যায়। পড়লে মনে হয় যেন আমার কথা। ভেবেই লিখেছে। এতে প্লটই যে কোথায় পাও বাবা, ভেবে অবাক লাগে।
এ কথার আর উত্তর কি? চুপ করে থাকে বকুল।
কেমন করে বোঝাবে লেখার মধ্যে প্লটটাই সর্বাপেক্ষা গৌণ। ওটার মধ্যে আশ্চর্যের কিছু নেই। তবু কেউ যখন বলে ভাল লাগে, তখনই একটা চরিতার্থতার স্বাদ না এসে পারে না। অনেক শুনেছে বকুল এ কথা। সব সময়ই শোনে তবুনতুন করে একটা সার্থকতার সুখ পেলো। আস্তে বললো, পড়োটড়ো?
ও বাবা! পড়বো না? ওই নিয়েই তো বেঁচে আছি। মাঝে মাঝে তাই মনে হয়, যদি বই জিনিসটা না থাকতো, কী উপায়ে দিনগুলো কাটাতাম।
এই সামান্য কথাটুকুর মধ্য দিয়েই একটা শূন্য হৃদয়ের দুঃসহ ধরা পড়লো। নিজের উপর ধিক্কার এলো বকুলের।
বকুলের এতো কাছাকাছি থেকে এইভাবে দুঃসহ শূন্যতার বোঝা নিয়ে পড়ে আছে মাধুরী, অথচ বকুল কোনোদিন তার সন্ধান নেয়নি। বকুল ভালবেসে নিজের দু’খানা বই নিয়ে এসে বলেনি, মাধুরী-বৌ, তুমি গল্পের বই ভালেবাসো
তবু বর্তমানের সমস্যাটা ওই শূন্যতার থেকে অনেক বাস্তব।
বুবুনের ব্যাপারে কী ভাবছে মাধুরী সেটাই জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল বকুল, বাড়ি থেকে ওদের ঝি এলো ডাকতে, পিসিমা, আপনাকে একজন মেয়ে এসে খুঁজছে।
মুল বিরক্ত গলায় বলে, আশ্চর্য! একটু এসেছি, এর মধ্যেই– কী নাম? কোথা থেকে এসেছ?
ঝি সুবাসিনী বললো, কী জানি বাবা, কী যেন বললো!