আমি এবং আনিস সাবেত মহসিন হলের ছাদে পা ঝুলিয়ে বসে আছি। ছাদে রেলিং নেই। দমকা বাতাস দিলে নিচে পড়ে যাব। এই নিয়ে আমাদের তেমন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হচ্ছে না। নিজেদের খুব এলোমেলো লাগছে। এলোমেলো যে লাগছে তার প্রমাণ আমাদের কথাবার্তা। কথাবার্তার নমুনা
আনিস : হুমায়ুন, লাফ দিতে পারবে?
আমি : পারব।
আনিস : তুমি পারবে না, আমি পারব।
আমি : লাফ দিয়ে দেখান যে আপনি পারবেন।
আনিস : দু’জন একসঙ্গে লাফ দিলে কেমন হয়?
আমি : ভালো হয়।
আনিস : তোমাকে লাফ দিতে হবে না। তুমি ওয়ান টু থ্রি বলো।
আনিস সাবেত উঠে দাঁড়ালেন। তাকে দাঁড়াতে দেখেও আমার কোনো ভাবান্তর হলো না। আমি ওয়ান টু থ্রি না বলা পর্যন্ত তিনি লাফ দেবেন না, এটা নিশ্চিত। তিনি আবার বসলেন। আমি বললাম, চলুন ঘরে যাই। আনিস সাবেত বললেন, তুমি যাও। আমি সারা রাত ছাদে বসে থাকব।
আমি নিজের ঘরে চলে এলাম। আনিস ভাই ছাদে বসে রইলেন।
আনিস সাবেত ছিলেন অত্যন্ত রাজনীতি সচেতন মানুষ। মিটিং মিছিল কোনো কিছুই বাদ নেই। লন্ডনপ্রবাসী পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্রনেতা তারিক আলি যখন ঢাকায় আসেন, তখন আনিস সাবেত ফুলের মালা নিয়ে এয়ারপোর্টে যান
তাকে অভ্যর্থনা জানাতে।
রাজনীতির মাতাল হাওয়া দেখে আনিস সাবেত ভেঙে পড়েছিলেন। কোনো কিছুই তখন কাজ করছে না।
গোলটেবিল বৈঠকের ফলাফল শূন্য।
সম্মিলিত বিরোধী দলের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছে আওয়ামী লীগ। কী কারণ তা স্পষ্ট না।
ছাত্র সংগঠনগুলির ভেতর নানা ঝামেলা, অবিশ্বাস, নেতৃত্বের লড়াই।
মাওলানা ভাসানী হঠাৎ লাহোরে যাবার জন্যে বিমানে উঠলেন। কেন এই সময় তাঁর লাহোর যাত্রা কেউ জানে না। তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তান সফরে যাচ্ছেন।
শোনা যাচ্ছে শিগগিরই আরেক যুদ্ধ হবে ভারতের বিরুদ্ধে। ভারত শায়েস্তা হলেই পূর্বপাকিস্তান ঠান্ডা হবে। এবার যুদ্ধ করতে সমস্যা নেই। পাকিস্তানের বন্ধুরাষ্ট্র মহান চীন। পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের প্রকাশ্য এবং গোপন দু’ধরনের সামরিক চুক্তি নাকি আছে। এই আঁতাতের প্রধান কারিগর নাকি মাওলানা ভাসানী।
দেশ চরম অনিশ্চয়তায়। অনিশ্চয়তার ছাপ ভয়ঙ্করভাবে পড়েছে আনিস সাবেতের ওপর। তার কাজকর্ম অপ্রকৃতস্থ মানুষের মতো।
রাত তিনটার দিকে আমি আবার ছাদে গেলাম। আনিস সাবেত বললেন, অদ্ভুত কাণ্ড। আমি জেগে থেকেই একটা স্বপ্ন দেখে ফেলেছি।
আমি বললাম, কী স্বপ্ন দেখেছেন?
পাশে এসে বসো। বলব। স্বপ্ন বলা শেষ করে হয় আমি ছাদ থেকে লাফ দেব নয়তো তোমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলব।
আনিস ভাই, ঘরে চলুন। আপনাকে চা বানিয়ে খাওয়াব। হিটারের তার কেটে গেছে, আপনাকে শুধু তার ঠিক করে দিতে হবে।
আনিস ভাই চিন্তিত গলায় বললেন, হিটারের তার কেটে গেছে আমাকে বলবে না? আশ্চর্য!
তিনি উঠে দাঁড়ালেন। ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাঁটা ধরলেন। যেন হিটারের তার কেটে যাওয়া ভয়ঙ্কর কোনো ঘটনা। এখনই ঠিক করতে হবে।
তার ঠিক হলো। আমরা চা খেলাম। আনিস ভাই তার স্বপ্ন বললেন। তিনি স্বপ্নে দেখেছেন, পূর্বপাকিস্তান স্বাধীন হয়েছে। সবাই মহাসুখে আছে। শুধু তিনি নেই।
তাঁর স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। সবাই মহাসুখে না থাকলেও দেশ স্বাধীন হয়েছে।
স্বাধীন দেশে বাস করার আনন্দ আনিস ভাই পাননি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই তিনি Ph.D করার জন্যে কানাডা গিয়েছিলেন। সেখানেই ক্যান্সারে মারা যান।
থাক এই প্রসঙ্গ। নাদিয়ার অদ্ভুত চিঠির কথাটা বলি। রেজিষ্ট্রি করা একটা চিঠি নাদিয়ার কাছ থেকে পেয়েছি। চিঠি না বলে সংবাদ বলা উচিত। সংবাদের শিরোনাম—
বিবাহ বিলাস
ফেব্রুয়ারি মাসের পঁচিশ তারিখ আমার বিয়ে।
পাত্র : হাসান রাজা চৌধুরী।
পাত্রের রূপ বিচার : কন্দর্প কান্তি (কন্দর্প কান্তির মানে জানো? না জানলে ডিকশনারি দেখো।)
পাত্রের গুণ বিচার ; একটি খুন করেছেন। একটি যখন করেছেন, আরও করার সম্ভাবনা আছে।
পাত্রের অর্থ বিচার : তার বিষয়আশয় কুবেরের মতো। (কুবের কে জানো না? অর্থের দেবতা।)
পাত্ৰ-বিষয়ে ঠাট্টা করছি না। যা লিখেছি সবই সত্যি। জেনেশুনে এমন কাজ কেন করছি জানো? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্যে করছি তিনি জেনেশুনে বিষ পান করতে বলেছেন। তার মতো মহাপুরুষের কথা অগ্রাহ্য করি কীভাবে?
যাই হোক, তুমি বিয়েতে আসবে। সব বন্ধুবান্ধব নিয়ে আসবে। আমাদের অতিবাড়ির পুরোটা তোমার এবং তোমার বন্ধুদের জন্যে ছেড়ে দেব।
বজরা নিয়ে তোমরা ব্রহ্মপুত্রে নৌবিহার করবে। পাখি শিকার করতে চাইলে তোমাদের নিয়ে যাব ভাটিপাড়ায় আমার শ্বশুরবাড়িতে। ওই বাড়িটার নাম—কইতরবাড়ি। কইতর কী জানো তো? কইতর হচ্ছে কবুতর।
রাগ করো না, তোমাকে একটা কথা বলি। তুমি হাত দেখতে জানো না। আমার প্রসঙ্গে যা যা বলেছ তার কোনোটাই সত্য হয়নি। কাজেই হাত দেখা হাত দেখা খেলা আর খেলবে না। এখন থেকে মন দেখা খেলা খেলবে। মনে করো কেউ তোমাকে বলল, আপনি হাত দেখতে পারেন? তুমি বলবে, হাত দেখতে পারি না তবে মন দেখতে পারি।
ভালো কথা, আমি দাদিজান হাজেরা বিবিকে নিয়ে ৭৮ পৃষ্ঠা লিখেছি। দাদি অতি নোংরা যেসব কথা বলেন তাও লিখেছি। পড়ে দেখতে চাও? না, পড়তে দেব না। নোংরা
অংশগুলি না থাকলে পড়তে দিতাম।
ইতি
নাদিয়া, দিয়া, তোজল্লী।