মধ্য গ্ৰীষ্মে শহর কলকাতায় বাস করা প্ৰায় অসহ্য হয়ে ওঠে, রোগভোগও এই সময় মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে খুব করে, সেইজন্য জনাব আবদুল লতীফ খান বাহাদুর কিছুদিনের জন্য তাঁর জমিদারি পরিদর্শনে যাবেন ঠিক করলেন। মুর্শিদাবাদে গঙ্গাতটে তাঁদের সুবৃহৎ প্রাসাদ আছে, যতই গ্ৰীষ্ম থাকুক। সন্ধ্যাকালে নদীব্যক্ষ থেকে ছুটে আসা শীতল সুবাতাস সেখানে প্ৰাণ জুড়িয়ে দেয়। তা ছাড়া, এই সময় আম কাঁঠাল ওঠে খুব, জমিদারিতে থাকলে সেগুলি টাটকা পাওয়া যায়। আবদুল লতীফ ভোজনরসিক, প্রতিটি ঋতুর ফলমূল তিনি পরিপাটিভাবে উপভোগ করেন।
খান বাহাদুরের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে অনেক উদ্যোগ আয়োজন লাগে। অন্দরমহলে তিন বেগম, তাঁদের লটবহরই তো অফুরন্ত, তা ছাড়া প্রচুর লোক-লস্কর ও খান বাহাদুরের নিজস্ব সরঞ্জাম। সপ্তাহখানেক ধরেই গোছগাছ চলছে। খান বাহাদুরের নিজস্ব পেয়ারের ভৃত্য মীর্জা খুশবখত্। কাজকর্মে অতি দক্ষ, তার মনিবের কখন কোন জিনিসের প্রয়োজন, সে সব তার নখদর্পণে। নবাব সব ব্যাপারে তার ওপরেই নির্ভর করেন।
যাত্রার দিন আসন্ন। একদিন বিকেলে নিদ্রাভঙ্গের পর জনাব আবদুল লতীফের মনে হলো, কী যেন একটা বাদ থেকে যাচ্ছে। কী যেন একটা ভুল হয়ে যাচ্ছে। অথচ কিছুতেই সেটা মনে পড়ছে না।
আবদুল লতীফ হাঁক দিলেন, মীর্জা! মীর্জা!
মীর্জা খুশবখত্ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ধূমায়িত আলবোলা নিয়ে উপস্থিত হলো। দিবানিদ্রার পর তার প্রভুর প্রথমেই এটা দরকার হয়।
আলবোলার নিলে টান দিয়ে লতীফ সাহেব বললেন, মীর্জা, সব ঠিকঠাক বন্দোবস্ত করেছিস?
মীর্জা সেলাম ঠুকে বললো, জী সরকার! কাল সুবে সুবে আমরা বেরিয়ে পড়বো!
—কোনো জিনিস। ভুল হয়নি তো?
—নেহি সরকার। বেগম সাহেবদের জন্য তিন তাঞ্জাম, আপনার ল্যাণ্ডো সব তৈয়ার।
—তবু কী যেন একটা গলত হয়ে যাচ্ছে।
—নেহি, সরকার। হ্যামিলটন কোমপানির কাছে খবর পাঠানো হয়েছিল, সে কোম্পানির লোক পাঁচ পেটি সরাব দিয়ে গেছে।
—সে তো বুঝলুম। আর কিছু ভুল হয়নি?
—আপনার চাগোশিয়া টোপী পসন্দ নয়, তাই পঞ্জাগোসিয়া টোপী বানানো হয়েছে। সে টোপী তো আপনি আজ সকালেই মাথায় পরে দেখে নিয়েছেন। প্রজাদের সামনে ঐ পাঞ্জাগোসিয়া মাথায় দিয়ে
—সে তো বুঝলুম। তবু যেন কী ভুল হয়ে যাচ্ছে!
—আপনি কনকওআ, আর পতংগ-এর কথা বলছেন তো? তা-ও নেওয়া হয়েছে। আসলি লক্ষ্ণৌয়ের চীজ। আপনি পতংগ ওড়াবেন আর প্রজাদের তাক লেগে যাবে। মুর্শিদাবাদে আগে কেউ কনকাওআ পতংগ দেখেনি!
—সে ঠিক আছে। আর কিছু ভুল হয়নি?
—নেহি সরকার। সব ঠিকঠাক আছে, কাল আমরা যাবো। শেখ ইমদাদ এ বাড়ি পাহারা দেবে।
—আর কিছু ভুল হয়নি, ঠিক বলছিস?
হঠাৎ মীর্জা খুশবখতের মুখখানি সাদা হয়ে গেল, দৃষ্টি একেবারে বিহ্বল। সে মাটিতে বসে পড়ে বললো, গোলামের গুস্তাকি মাফ করবেন, সরকার। এত বড় গলত কী করে হলো, আমি নিজেই জানি না। সব করেছি, শুধু ভকিল সাহেবকেই এখনো কোনো খবর দেওয়া হয়নি। আপনি এক দু-মাসের জন্য বাইরে থাকবেন, অথচ ভকিল সাহেব তা জানবেন না, এ কী হয়!
আবদুল লতীফ হুংকার দিয়ে বলে উঠলেন, তবে! বে-তমীজ! তোর গর্দান নেওয়া উচিত! ভকিল সাহেবের পরামর্শ না নিয়ে আমি এক পা চলি না, আর সেই তাঁকেই এখনো খবর দিসনি? আমি মনে না করিয়ে দিলে কী হতো?
মীর্জা মাটিতে শির ঠেকিয়ে অপরাধীর মতন বললো, জী সরকার, সত্যিই বড় ভুল হয়ে গেছে।
—যা, এখনি ভকিল সাহেবের কাছে এত্তেলা পাঠিয়ে দে!
খবর পেয়ে সেদিন সন্ধ্যার সময়েই এসে হাজির হলেন মুন্সী আমীর আলী। হাতে একটি রূপো বাঁধানো ছড়ি, মুখখানি রাগত।
বৈঠকখানা ঘরে বসে ছড়িখানা কোলের ওপর রেখে তিনি বললেন, লতীফ সাহেব, আমি জানতুম, তুমি দিলাদরিয়া ভোলাভালা লোক, কিন্তু তুমি যে এমন বেওকুফ তা জানা ছিল না।
প্রথমেই এমন কঠোর ধমক খেয়ে বেশ বিচলিত হয়ে পড়লেন লতীফ খাঁ। কাচুমাচু ভাবে বললেন, জনাব এমন কথা বললেন কেন? কী বেওকুফ করেছি। আমি?
আমীর আলী বললেন, বেওকুফী করোনি? একশোবার বেওকুফী! তুমি হুটু করে মুর্শিদাবাদ যাচ্ছে, দেশের অবস্থা জানো?
—দেশের কী অবস্থা? দেশেব যাই অবস্থা হোক, আমি নিজের জমিদারি দেখতে যেতে পারবো না?
—জমিদারি দেখতে যাবে? বেগম সাহেবদের সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে। আশা করি? তাঁদের ছেড়ে তো তুমি এক পাও নড়ো না! পাহারাদার বরকন্দাজ যাচ্ছে কজন?
আবদুল লতীফ হাঁক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মীর্জা! কতজন বীরকন্দাজের ব্যবস্থা করেছিস?
মীর্জা খুশবখত্ জানালো যে চল্লিশজন সশস্ত্ৰ বরকন্দাজ পাহারাদার হয়ে সঙ্গে যাবে, তাদের দশজনের কাছে বন্দুক আছে।
আবদুল লতীফ বললেন, গত বৎসর তিরিশজন বরকন্দাজ ছিল, এবার পাহারা আরও জোরদার করা হয়েছে।
মুন্সী আমীর আলী চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, যত বেশী বরকন্দাজ নেবে, ততই বেশী যে তোমার বিপদ, সেকথা বোঝার মতন বুদ্ধিও তোমার নেই, লতীফ খাঁ! মুসলমান এখন হাতিয়ার নিয়ে রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করতে পারে? তোমার চল্লিশজন বরকন্দাজকে হাতিয়ার নিয়ে লম্ফঝম্ফ করতে দেখলে গোরা সিপাহীরা তাদের একেবারে খতম করে দেবে, তোমার জেনানাদের বে-ইজত করবে, তাই তুমি চাও?
—এ কী কথা বলছেন, মুসী সাহেব? গোরা সিপাহীরা মারবে? বছর বছর খাজনার মোহর পৌঁছে দিই, তবু মারবে কেন?
—সাধে কি তোমায় বেওকুফ বলেছি? গদর শুরু হয়ে গেছে, শোনোনি? মুসলমান আর ইংরেজ এখন পরস্পরের দুশমন। একজন হাতিয়ারধারী মুসলমান দেখলেই ইংরেজ তাকে মনে করে বাগী সিপাহী। দিল্লী স্বাধীন হয়ে গেছে। সেখানে আর একজনও ফিরিঙ্গি নেই। দিল্লির লালকেল্লার মশানদে আবার বসেছেন স্বাধীন সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর। সারা হিন্দুস্তান জুড়ে লড়াই শুরু হয়ে গেছে, আর এখন তুমি আওরতদের নিয়ে মুর্শিদাবাদে চলেছে হাওয়া খেতে?
—মুন্সী সাহেব, আপনি বলছেন, সারা হিন্দুস্তানে আবার মুসলমান রাজ কায়েম হবে?
—আলবৎ হবে! ইংরেজ কতখানি ভয় পেয়ে গেছে তুমি জানো না? সব জায়গায় তারা পিছু হটছে। এই তো গত এতোয়ারের দিন কলকাতায় কী কাণ্ড হলো, তাও তুমি শোনোনি বোধহয়!
—বলুন, বলুন মুসী সাহেব, সব খুলে বলুন।
মুন্সী সাহেব সবিস্তারে মীরাটের ঘটনা, দিল্লি অভিযান এবং দিল্লি দখলের কাহিনী শোনাতে লাগলেন।
এই সময় অদূরে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে কান্নার আওয়াজ উঠতেই লতীফ খাঁ বিরক্ত বোধ করলেন। মীজাঁকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, কে কাঁদে রে এই অসময়ে?
মীর্জা বললো, সরকার, ওরা পাশের বস্তির বেহুদা ছেলেমেয়ে। এই সময় ওদের বাপ মা ওদের ক্ষুধার খাদ্য দিতে না পেরে পেটায়, তাই ওরা কাঁদে!
অসহিষ্ণুভাবে আবদুল লতীফ বললেন, তুই জানিস না, আমি কান্না সহ্য করতে পারি না! থামা ওদের! যা, বস্তির সব কটা লোককে একটা করে টাকা দিয়ে আয়। মুন্সী আমীর আলী আজ একটা বিরাট সুসংবাদ শুনিয়েছেন। শেখ ইমদাদ, কতুলু আর হেদায়েৎকে ডাক, তোরাও এসে শোন। তার আগে বস্তির সবাইকে টাকা দিয়ে বলবি মেঠাই কিনে খেতে। আর বলবি, এর পর আর কোনোদিন যেন না কাঁদে। মুসলমানের এখন কান্নার সময় নয়, সব মুসলমানকে ইমান রক্ষার জন্য এখন হাতিয়ার ধরতে হবে। দিল্লি এখন স্বাধীন!
মীর্জা সবিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলো, দিল্লি স্বাধীন? তার মানে কি, সরকার?
আবদুল লতীফ বললেন, আরো কমবখত, স্বাধীন মানে স্বাধীন। বাদশার মাথার ওপর এখন আর কোনো ইংরেজ নেই। বাদশাহ এখন আবার শাহেনশাহ। তোকে যা করতে বললাম, কর, যা, ছুটে যা!
মীর্জা চলে যাবার পর আবদুল লতীফ মুন্সী আমীর আলীর দু পা ছুঁয়ে কদমবুসী করে আনন্দাশ্ৰণু ঝড়িয়ে বললেন, আপনি আমায় আজ যে সংবাদ শোনালেন, তাতে আমার জীবন ধন্য হলো। এ দেশে আবার মুসলমানের গৌরব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আমীর আলী বললেন, এখনো পুরো হয়নি, হতে চলেছে।
—তবুদিল্লি তো আর ইংরেজের হাতে নেই। মুঘল বাদশা এখন আমাদের জান মালের মালেক। আজ যদি আমার মৃত্যুও হয়, তাও হবে আনন্দের।
—ঠিক বলছে কি, লতীফ সাহেব? তোমরা তো শুধু নিজেদের সুখ আর আরামের জন্যই সর্বক্ষণ মত্ত। মুসলমানের গৌরব উদ্ধারের জন্য কতখানি কী চেষ্টা করেছে এতদিন? এখন কিন্তু সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
—নিশ্চয়ই! আমি তৈয়ার। আপনি এতোয়ারের দিন কলকাতায় কী হয়েছিল বলছিলেন?
—সে কথাও তুমি শোনোনি? জানো, সিপাহীরা কখন কলকাতায় ধেয়ে আসবে, সেই ভয়ে কলকাতার সাহেবলেগ একেবারে ভীতু জানোয়ারের মতন ছটফট করছে! যতসব ডরপুক না-লায়েক ইংরেজ মাস্টন আর রডা কোম্পানি উজাড় করে বন্দুক পিস্তল কেনার ধুম লাগিয়েছে। আর কলুটোলার বানিয়া ইংরেজ কিংবা ইদুস পিদুস নামে যত সব হাফ-ফিরিঙ্গি জীবনে কখনো বন্দুক পিস্তল ছয়ে দেখেনি, তারাও এখন হাতিয়ার মক্সো করতে লেগেছে। ক্যানেং সাহেবকে ধরাকরা করে তারা গড়েছে এক ভলাণ্টিয়ার গার্ডস বাহিনী, সিপাহীরা এলে লড়বে। তা গত শনিবারের রাতে নাকি খবর এসেছিল যে পরদিন ব্যারাকপুর আর দমদমের সিপাহীরা কলকাতা আক্রমণ করবে। জেনারাল হিয়ারসি তো তড়িঘড়ি এতোয়ারের দিন সকালে সব সিপাহীর অস্ত্ৰ কেড়ে নিলো। কিন্তু তাতে কী, সেদিন বিকালে হুজুগ উঠলো যে সিপাহীরা ব্যারাকপুর কলকাতা থেকে শহর কলকাতার দিকে ধেয়ে আসছে। ব্যস তারপর কী শোরগোলি! জান মাল বাঁচাবার জন্য সব সাহেব লগালো দৌড়। কেউ গেল ফোর্ট উইলিয়ামে কেউ গেল জাহাজে, কেউ নৌকা নিয়েই বোধহয় বিলায়েত পাড়ি দিতে গেল। রাস্তাঘাট একেবারে ফস। যারা ভলাণ্টিয়ার্স গার্ডে যোগ দিয়ে লড়াই করবে বলেছিল, তারাই ভেগেছে সবচেয়ে আগে, লম্বা ছুটি লাগিয়েছে!
আবদুল লতীফ হো হো করে হেসে উঠলেন।
মুন্সী আমীর আলী বললেন, শুধু হাসিয়া কথা নয়, ভালো করে ভেবে দেখার কথা। এই টাউন কলকাতা হলো কোম্পানির রাজধানী। এখানে এই অবস্থা। হুজুগ শুনেই ইংরেজরা দৌড়োচ্ছে। দশ-কুড়ি হাজার সিপাহী সত্যি এলে এ শহর খুব সহজে দখল হয়ে যাবে। কলকাতা যদি দখল হয়, তা হলে ভেঙে পড়বে ইংরেজের রাজা। তখন হিন্দুস্তানের তেগ লণ্ডন পর্যন্ত পহুছিয়ে যাবে।
উৎসাহে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো লতীফ সাহেবের চক্ষু দুটি। আবেগের সঙ্গে বললেন, আসবে, সিপাহীরা কলকাতায় আসবে? আমি আজই মসজিদে গিয়ে দেয়া করবো।
মুন্সী আমীর আলী বললেন, শুধু দোয়া করলেই হবে না। নিজেদেরও কিছু মদত দিতে হবে।
—কিন্তু মুসী সাহেব, কলকাতার হিঁদুরা কি আমাদের দলে যোগ দেবে?
—যে সব হিন্দুরা দু পাত আংরেজি পড়েছে, তারা ইংরেজের পা-চাটা হয়েই থাকবে। ওরা যারা ডেপুটি, মুন্সেফীঁ কিংবা কুঠিওয়ালার নোকরির জন্য হন্যে হয়ে থাকে, তারা ইংরেজকে ছাড়বে না শেষ পর্যন্ত। তা বাঙালী হিঁদুরা থাকুক না ইংরেজদের দলে, তাতে কিছু যায় আসে না! ওরা কি লড়াই করতে জানে? কোনোদিন হাতিয়ার তুলে ধরতে শেখেনি। শুধু দুধ ঘি খায় আর লম্বা লম্বা বাত মারে। ওদের নিয়ে কোনো চিন্তা নেই।
—কিন্তু ওদের সংখ্যাই বেশী। কোম্পানির সরকারে ওরাই বড় বড় পদ নিয়ে বসে আছে এখন। ওরা লড়াই করতে জানে না ঠিকই, কিন্তু ষড়যন্ত্র করতে তো ভালোই জানে। যদি ইংরেজের সঙ্গে মিলে আমাদের বিরুদ্ধে লাগে?
—সেটা হবে ওদের নির্বুদ্ধিতা। এ গদরের আগুন ছড়িয়ে পড়বে সারা হিন্দুস্তানে। এতে যে যোগ দেবে না, সে মরবে। তবে, বাঙালী হিন্দুদের মধ্যেও অনেকের ইংরেজের ওপর ভক্তি চটে গেছে। প্রথম প্রথম তারা ভেবেছিল বুঝি, মুসলমানের বদলে ইংরেজের কাছ থেকেই তারা সুবিচার পাবে। এখন আর সকলের সে ভাব নেই। সেদিন আমি বিদ্যোৎসাহিনী পত্রিকা নামে একটি আখবর দেখলাম। আমার আদালতের দোস্তু বিধুশেখর মুখার্জিবাবুর এক দোস্তের ছেলে সে আখবরে একটা সন্দর্ভ লিখেছে। ছোঁকরা লিখেছে যে, এই ইংরেজের শাসনের চেয়ে আকবর বাদশাহের শাসন অনেক ভালো ছিল। আকবর বাদশার আমলে হিন্দু মুসলমান সকলেই গুণের অনুযায়ী কাজ পেত। আর এখন কোনো হিন্দু ইংরেজের চেয়েও বেশী পড়ালেখা জানলেও সে কোনো ইংরেজের চেয়ে বেশী বেতনের চাকরি পায় না।
—লিখেছে। এ কথা?
—হাঁ, লিখেছে। তা ছাড়া, সিপাহীদের মধ্যে বাঙালী হিন্দু নেই, কিন্তু অন্য হিন্দু সিপাহীরা গদরে যোগ দিয়েছে। ব্যারাকপুরে প্রথম যে সিপাহী ইংরেজকে তাক করে গোলি চালালো, সে তো হিন্দু, তার নাম মঙ্গল পাঁড়ে। কানপুরে ধুন্ধপথ নানাসাহেব বিদ্রোহী সিপাহীদের মদৎ দিচ্ছে। মুসলমান, হিন্দু সকলেরই দেশ এই হিন্দুস্তান। ইংরেজরা শোষণকারী দুশমন, তাদের হঠাতে হবে এ দেশ থেকে। তারপর একবার ইংরেজ ভাগলে সারে হিন্দুস্তানের বাদশা হবেন বাহাদুর শাহ, সমস্ত মুসলমানেরই আবার কদর বাড়বে।
—মুলী সাহেব, আপনি এত সব খবর জানলেন কোথা থেকে?
—তুমি তো কিছুই পড়ে না। বাংলা পড়ে না, কিন্তু ফাসীতে এক আখবর বেরোয় কলকাতা থেকে, তার নাম দূরবীন, সেটা তো অন্তত পড়ে দেখতে পারো! সেই দূরবীনে ছাপা হয়েছে বাগী সিপাহীদের এক ইস্তাহার। তাতে বলেছে, হিন্দু মুসলমানকে এক হয়ে দুশমন ইংরেজের বিরুদ্ধে জেহাদ করতে হবে। ইংরেজ হিন্দু মুসলমান সকলেরই ধর্ম কেড়ে নিতে চায়। হিন্দু কখনো মুসলমানের ধর্ম কাড়ে না, মুসলমানও হিন্দুর ধর্ম কাড়বে না।
—ইনসা আল্লা, এবার তবে ইংরেজের দিন শেষ। কিন্তু মুসী সাহেব, দিল্লির সিপাহীরা কতদিনে কলকাতায় এসে পৌঁহুছিবে?
—ওরা কেন আসবে? এখানকার সিপাহীদের দিয়েই কলকাতা দখল করাতে হবে। সিপাহীরা সব ফুসছে। একটা আগুনের ফুলকি পড়লেই সব দপ করে জ্বলে উঠবে। এখন দরকার শুধু একটিই। একজন সেনাপতি, যাঁর অধীনে থেকে সব সিপাহী লড়বে। সেরকম সেনাপতি কে হতে পারে?
–কে?
—আর পাঁচদিন পরই তেইশ তারিখ। জুন মাসের তেইশ তারিখ কী দিন জানো তো? ঐদিন পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজ ছিনিয়ে নিয়েছিল বাংলার মশনদ। সেইদিন মুর্শিদাবাদের নবাব যদি বিদ্রোহী ফৌজদের নিয়ে কলকাতা আক্ৰমণ করতেন, তা হলেই কি সবচেয়ে ভালো হতে না?
–নিশ্চয়ই।
—মুর্শিদাবাদের নবাবের কাছে খবর পাঠানো হয়েছিল গোপনে। তিনি রাজি হননি। একেবারে অপদার্থ একটি। তিনি বললেন, তিনি ইংরেজের নুন খেয়েছেন, কিছুতেই ইংরেজের বিরুদ্ধে যাবেন না! শুনছি, কোম্পানি নাকি ফৌজ পাঠিয়ে নবাবকে বন্দী করে আনবে। তা হলে বোঝে ব্যাপারটা!
—আর কেউ নেই?
—আর একজনই আছে, যাঁকে সবাই মানবে। তিনি হলেন আওধের রাজ্যহীন নবাব ওয়াজীর আলী শাহ।
—ঠিক বলেছেন।
—এই ওয়াজীর আলী শাহই সব বিদ্রোহী সিপাহীর নেতা হতে পারেন। চলো, কালই আমরা নবাবের সঙ্গে গিয়ে দেখা করি।