বিলু এসে বলল, আনিস সাহেব। আপনাকে বাবা একটু ডাকছেন। আনিস লিখছিল। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। বিলু বলল, আপনি আপনার কাজ সেরে আসুন। এমন জরুরি কিছু নয়।
আনিস বলল, আমার কাজটাও তেমন জরুরি কিছু না। পত্রিকায় দেখলাম আপনাদের মেডিকেল কলেজ খুলে যাচ্ছে।
হ্যাঁ খুলছে। অল্প কিছুদিন ক্লাস হবে। আবার বন্ধ হয়ে যাবে।
আপনার, মনে হচ্ছে যাবার খুব একটা ইচ্ছা নেই?
না নেই। তাছাড়া বাসায় এলে আর কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না।
আপনার পুত্ৰ-কন্যা কোথায়?
ওরা খাটের নিচে।
ওখানে কি করছে?
জানি না। নতুন কোন খেলা বের করেছে বোধ হয়।
বিলু নিচু হয়ে দেখতে চেষ্টা করল। টগরের হাতে কাচি। সে কাটাকুটি করছে বলে মনে হয়। চোখে চোখ পড়তেই টগরের ইশারায় বিলুকে চুপচাপ থাকতে বলল।
বিলু আনিসের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি চলে যান। আমি ওদের সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প করি।
গল্প করতে হলে খাটের নিচে যেতে হবে। ওরা সেখান থেকে বেরুবে বলে মনে হয় না।
আনিস সার্ট গায়ে দিয়ে নিচে নেমে গেল।
সোবাহান শাহেবের শরীর বিশেষ ভাল নয়। তিনি চুপচাপ শুয়ে আছেন। আনিসকে দেখে উঠে বসলেন। আনিস বলল, কেমন আছেন স্যার?
ভাল। তুমি কেমন?
আমিও ভাল।
বস। ঐ চেয়ারটায় বস। মনটা একটু অস্থির হয়ে আছে।
কেন বলুন তো?
তিনদিন হয়ে গেল ফরিদ বাড়ি থেকে বের হয়েছে আরতো ফেরার নাম নেই। কোন সমস্যায় পড়েছ কিনা কে জানে। বোকের মাথায় বের করে দিলাম। ভেবেছিলাম এক দুদিন বাইরে থাকলে বুঝবে পৃথিবীটা কেমন জায়গা। এক ধরনের রিয়েলাইজেশন হবে।
আপনি চিন্তা করবেন না। চিন্তার কিছু নেই। তেমন কোন সমস্য হলে মামা চলে আসবেন।
তাও ঠিক। কোথায় আছে জানতে পারলে মনটা শান্ত হত।
আপনি বললে আমি খুঁজে বের করতে পারি।
বিশ লক্ষ মানুষ এই শহরে বাস করে। এর মধ্যে তুমি এদের কোথায় খুঁজবে?
আনি হাসতে হাসতে বলল, ঠিকানাহীন মানুষদের থাকার জায়গা কিন্তু খুব সীমিত। ওরা সাধারণত লঞ্চ টার্মিনালে, বাস টার্মিনালে কিংবা স্টেশনে থাকে। এই তিনটার মধ্যে ষ্টেশন সবচেয়ে ভাল। আমার ধারণা ষ্টেশনে গভীর রাতে গেলেই তাদের পাওয়া যাবে। যদি বলেন আজ রাতে যাব।
আমাকে কি নিয়ে যেতে পারবে?
নিশ্চয়ই পারব। তবে আপনার যাবার দরকার দেখছি না।
আমি যেতে চাই আনিস। ঠিকানাহীন মানুষ কিভাবে থাকে দেখতে চাই।
আপনার দেখতে ভাল লাগবে না। তাছাড়া আপনার শরীরটাও ভাল নেই।
আমার শরীর ঠিকই আছে। তুমি আমাকে নিয়ে চল।
জ্বি আচ্ছা।
তোমাকে আর একটা কাজ দিতে চাই। বলতে সংকোচ বোধ করছি।
দয়া করে কোন রকম সংকোচ বোধ করবেন না।
বিলুর মেডিকেল কলেজ খুলেছে। তুমি ওকে একটু বরিশাল দিয়ে আসতে পারবে?
নিশ্চয়ই পারব। অবশ্যি এর মধ্যে যদি কাদের চলে আসে তাহলে ও নিয়ে যাবে। এই কাজটা সাধারণত কাদেরই করে।
স্টীমারের টিকিট কাটা হয়েছে?
না—এই কাজটাও তোমাকেই করতে হবে। আমি খুবই অস্বস্থি বোধ করছি।
আনিস হাসল। সোবাহান সাহেব বললেন, তোমার উপর আমার কোন অধিকার নেই। তবু কেন জানি মনে হয় অনেক খানি অধিকার আছে।
আপনার যদি এরকম মনে হয়ে থাকে তাহলে ঠিকই মনে হয়েছে। স্নেহের অধিকারের চেয়ে বড় অধিকার আর কি হতে পারে বলুন? সেই অধিকার আপনার ভাল মতাই আছে।
সোবাহান সাহেব হাসলেন।
আনিস বলল, আমি উঠি?
সোবাহান সাহেব বললেন- না না বস। তোমার সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছে। তুমি কিছু বল, আমি শুনি।
কি বলব?
যা ইচ্ছা বল। টগর নিশার মার কথা বল। বৌমার কথাতো জানি না। জানতে ইচ্ছে করে।
আনিস কিছু বলল না। তার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে সোবাহান সাহেব বললেন, আচ্ছা থাক, ঐ প্রসঙ্গ থাক। আনিস ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল।
সেই নিঃশ্বাসে গাঢ় হতাশা মাখা ছিল। সোবাহান সাহেবের মনটা খারাপ হয়ে গেল।
আনিস বলল, স্যার উঠি?
আচ্ছা। আচ্ছা।
রাত বারোটার দিকে আমি আপনাকে নিয়ে যাব।
আনিস চলে গেল। সোবাহান সাহেবের আবারো মনে হল, কি চমৎকার একটি ছেলে। শান্ত, বুদ্ধিমান, হৃদয়বান। পৃথিবীতে এ রকম ছেলের সংখ্যা এত কম কেন ভেবে তাঁর একটু মন খারাপও হল।
আনিস সোবাহান সাহেবকে নিয়ে বের হয়েছে।
রাত প্ৰায় বারটা, রাস্তাঘাট নির্জন। আনিস বলল, স্যার আমরা কি রিকশা নেব? না-কি হাঁটবেন?
সোবাহান সাহেব বললেন, চল হাঁটি। হাঁটতে ভাল লাগছে। কোনদিকে আমরা যাচ্ছি?
কমলাপুর রেল স্টেশনের দিকে!
চল।
কমলাপুর রেল স্টেশনের যে দৃশ্য সোবাহান সাহেব দেখলেন তাঁর জন্যে তিনি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না। অসংখ্য মানুষ বিভিন্ন যায়গায় শুয়ে আছে। অতি বৃদ্ধও যেমন আছে, শিশুও আছে। এই তাদের ঘর বাড়ি।
একটা মেয়ের বাচ্চা হয়েছে। বাচ্চার বয়স সাতদিনও হবে না। বাচ্চটি উয়া উয়া করে কাঁদছে। মা তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। সম্ভবত মার শরীর ভাল না। মুখ ফুলে আছে। চোখ রক্তবর্ণ।
সোবাহান সাহেব বললেন, এইসব কি দেখছি আনিস?
রাতের ঢাকা শহর দেখছেন।
আগে কখনো দেখিনি কেন?
আগেও দেখেছেন— লক্ষ্য করেন নি। আমাদের বেশির ভাগ দেখাই খুব ভাসা ভাসা। দেখে একটু খারাপ লাগে, তারপর ভুলে যাই।
আমি ওদের কিছু সাহায্য করতে চাই।
অল্প কিছু টাকা পয়সায় ওদের কোন সাহায্য হবে না।
জানি। তবু সাহায্য করতে চাই। ঐ যে বাচ্চটা কাঁদছে তার মাকে তুমি এই একশটাকা দিয়ে আস।
আনিস টাকা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল। মেয়েটি টাকা রাখল। কিন্তু কোন রকম উচ্ছ্বাস দেখাল না। যেন এটা তার পাওনা টাকা। অনেক দিন পর পাওয়া গেছে।
সোবাহান সাহেব বললেন, আমার আর হাঁটাহাঁটি করতে ভাল লাগছে না আনিস।
ওদের খুঁজবেন না?
না।
রিকশায় ফেরার পথে সোবাহান সাহেব বললেন, আমি একটা ব্যাপার কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না— আমাদের এই অবস্থা কেন? চিন্তা করে দেখ জাপানিদের সঙ্গে আমাদের কত মিল- ওরাও ছোটখাট ধরনের মানুষ, আমরাও ছোটখাট। ওরা ভাত খায় আমরাও ভাত খাই। ওদের কোন খনিজ সম্পদ প্রায় নেই, আমাদেরও নেই। ওদের কৃষিযোগ্য জমি যতটুকু , আমাদের তার চেয়েও বেশি। ওদের জনসংখ্যার সমস্যা আছে, আমাদেরও আছে। অথচ ওরা আজ কোথায়, আমরা কোথায়? আমার মনটা এত খারাপ হয়েছে যে, তোমাকে বুঝাতে পারছি না।
আমি বুঝতে পারছি স্যার।
মনটা খারাপ হয়েছে। খুবই খারাপ হয়েছে।
রাতে সোবাহান সাহেব ঘুমুতে পারল না। নতুন একটি খাতায় ভাসমান জনগুষ্ঠি এবং আমরা এই শিরোনামে প্ৰবন্ধ লিখতে চেষ্টা করলেন। দুলাইনের বেশি লিখতে পারলেন না। এক সঙ্গে অনেক কিছু মাথায় আসছে। কোনটা ফেলে কোনটা লিখবেন তাই বুঝতে পারছেন না।