মতিলাল দেখিলেন বাটী হইতে মা গেলেন, ভাই গেলেন, ভগিনী গেলেন। আপদের শান্তি ! এতদিনের পর নিষ্কন্টক হইল —ফেচ্ফেচানি একেবারে বন্ধ —এক চোখ রাঙানিতে কর্ম কেয়াল হইয়া উঠিল আর “প্রহারেণ ধনঞ্জয়ঃ” সে সব হল বটে কিন্তু শরার রুধির ফুরিয়ে এল —তার উপায় কি? বাবুয়ানার জোগাড় কিরূপে চলে? খুচরা মহাজন বেটাদের টাল্মাটাল আর করিতে পারা যায় না। উটনোওয়ালারাও উটনো বন্ধ করিয়াছে —এদিকে সামনে স্নানযাত্রা —বজরা ভাড়া করিতে আছে —খেমটাওয়ালীদের বায়না দিতে আছে —সন্দেশ মেঠাইয়ের ফরমাইশ দিতে আছে —চরস, গাঁজা ও মদও আনাইতে হইবে —তার আটখানার পাটখানাও হয় নাই। এই সকল চিন্তায় মতিলাল চিন্তিত আছেন এমতো সময়ে বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচা আসিয়া উপস্থিত হইল। দুই-একটা কথার পরে তাহারা জিজ্ঞাসা করিল —বড়োবাবু ! কিছু বিমর্ষ কেন? তোমাকে ম্লান দেখিলে যে আমরা ম্লান হই —তোমার যে বয়েস তাতে সর্বদা হাসিখুশি করিবে। গালে হাত কেন? ছি ! ভালো করিয়া বসো। মতিলাল এই মিষ্ট বাক্যে ভিজিয়া আপন মনের কথা সকল ব্যক্ত করিল। বাঞ্ছরাম বলিলেন —তার জন্যে এত ভাবনা কেন? আমরা কি ঘাস কাটছি? আজ একটা ভারি মতলব করিয়া আসিয়াছি —এক বৎসরের মধ্যে দেনা-টেনা সকল শোধ দিয়া পায়ের উপর পা দিয়া পুত্রপৌত্রক্রমে খুব বড়োমানুষি করিতে পারিবে। শাস্ত্রে বলে “বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মীঃ” —সৌদাগরিতেই লোক ফেঁপে উঠে —আমার দেখ্তা কত বেটা টেপাগোঁজা, নড়েভোলা, টয়েবাঁধা, বালতিপোতা, কারবারে হেপায় আণ্ডিল হইয়া গেল —এ সব দেখে কেবল চোখ টাটায় বই তো না! আমরা কেবল একটি কর্ম লয়ে ঘষ্টিঘর্ষণা করিতেছি —এ কি খাটো দুঃখ ! চন্ডীচরণ ঘুঁটে কুড়ায়, রামা চড়ে ঘোড়া।
মতিলাল। এ মতলব বড়ো ভালো —আমার অহরহ টাকার দরকার। সৌদাগরি কি বাজারে ফলে না আপিসে জন্মে? না মেঠাই-মণ্ডার দোকানে কিনিতে মেলে? একজন সাহেবের মুৎসুদ্দি না হইলে আমার কর্ম কাজ জমকাবে না।
বাঞ্ছরাম। বড়োবাবু ! তুমি কেবল গদিয়ান হইয়া থাকিবে, করাকর্মার ভার সব আমাদিগের উপর —আমাদিগের বটলর সাহেবের একজন দোস্ত জান সাহেব সম্প্রতি বিলাত হইতে আসিয়াছে —তাহাকেই খাড়া করিয়া তাহারই মৎসুদ্দি হইতে হইবে। সে লোকটি সৌদাগরি কর্মে ঘুন।
ঠকচাচা। মুইবি সাতে সাতে থাক্ব, মোকে আদালতে, মাল, ফৌজদারি, সৌদাগরি কোনো কাম ছাপা নাই। মোর শেনাবি এ সব ভালো সমজে। বাবু ! আপসোস এই যে মোর কারদানি এ নাগাদ নিদ যেতেচে —লেফিয়ে লেফিয়ে জাহের হল না। মুই চুপ করে থাকবার আদমি নয় দোশমন পেলে তেনাকে জেপ্টে, কেমড়ে মেটিতে পেটিয়ে দি —সৌদাগরি কাম পেলে মুই রোস্তম জালের মাফিক চলব।
মতিলাল। ঠকচাচা —শেনা কে ?
ঠকচাচা। শেনা তোমার ঠকচাচী —তেনার সেফত কি করব? তেনার সুরত জেলেখার মাফিক আর মালুম হয় ফেরেস্তার মাফিক বুজ-সমজ।
বাঞ্ছারাম। ও কথা এখন থাকুক। জান সাহেবকে দশ পনেরো হাজার টাকা সরবরাহ করিতে হইবে তাতে কিছুমাত্র জখম নাই। আমি স্থির করিয়াছি যে কোতলপুরের তালুকখানা বন্ধক দিলে ঐ টাকা পাওয়া যাইতে পারে— বন্ধকী লেখাপড়া আমাদিগের সাহেবের আপিসে করিয়া দিব —খরচ বড়ো হইবে না —আন্দাজ টাকা শ’চার-পাঁচের মধ্যে আর টাকা শ-পাঁচেক মহাজনের আমলা-ফামলাকে দিতে হইবে। সে বেটারা পুন্কে শত্রু —একটা খোঁচা দিলে কর্ম ভণ্ডুল করিতে পারে। সকল কর্মেরই অষ্টম-খষ্টম আগে মিটাইয়া নষ্ট কোষ্ঠী উদ্ধার করিতে হয়। আমি আর বড়ো বিলম্ব করিব না, ঠকচাচাকে লইয়া কলিকাতায় চলিলাম —আমার নানা বরাত —মাথায় আগুন জ্বল্ছে। বড়োবাবু ! তুমি তর্কসিদ্ধান্ত দাদার কাছে থেকে একটা ভালো দিন দেখে শীঘ্র দুর্গা দুর্গা বলিয়া যাত্রা করিয়া একেবারে আমার সোনাগাজির দরুন বাটীতে উঠিবে। কলিকাতায় কিছু দিন অবস্থিতি করিতে হইবে তার পর এই বৈদ্যবাটীর ঘাটেতে যখন চাঁদ সদাগরের মতন সাত জাঁহাজ ধন লইয়া ফিরিয়া আসিয়া দামামা বাজাইয়া উঠিবে তখন আবাল-বৃদ্ধ, যুবতী কুলকন্যা তোমার প্রত্যাগমনের কৌতুক দেখিয়া তোমাকে ধন্য ধন্য করিবে।
আহা ! এমন দিন যেন শীঘ্র উদয় হয় ! এই বলিয়া বাঞ্ছারাম ঠকচাচাকে লইয়া গমন করিলেন।
মতিলাল আপন সঙ্গীদিগকে উপরোক্ত সকল কথা আনুপূর্বিক বলিল। সঙ্গীরা শুনিয়া বগল বাজাইয়া নেচে উঠিল —তাহাদিগের রাতিব টানাটানির জন্য প্রায় বন্ধ। এক্ষণে সাবেক বরাদ্দ বহাল হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। তাড়াতাড়ি, হুড়াহুড়ি করিয়া মানগোবিন্দ এক চোঁচা দৌড়ে তর্কসিদ্ধান্তের টোলে উপস্থিত হইয়া হাঁপ ছাড়িতে লাগল। তর্কসিদ্ধান্ত বড়ো প্রাচীন, নস্য লইতেছেন —ফেঁচ্ ফেঁচ্ করিয়া হাঁচতেছেন —খক্ খক্ করিয়া কাশতেছেন —চারিদিকে শিষ্য —সম্মুখে কয়েকখানা তালপাতায় লেখা পুস্তক —চশমা নাকে দিয়ে এক একবার গ্রন্থ দেখিতেছেন, এক একবার ছাত্রদিগকে পাঠ বলিয়া দিতেছেন। বিচলির অভাবে গোরুর জাবনা দেওয়া হয় নাই —গোরু মধ্যে মধ্যে হাম্মা হাম্মা করিতেছে —ব্রাহ্মণী বাটীর ভিতর হইতে চিৎকার করিয়া বলিতেছেন —বুড়ো হইলেই বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ হয়, উনি রাতদিন পাঁজি-পুথি ঘাঁটবেন, ঘরকন্নার পানে একবার ফিরে দেখবেন না। এই কথা শিষ্যেরা শুনিয়া পরস্পর গা টেপাটেপি করিয়া চাওয়াচাওয়ি করিতেছে। তর্কসিদ্ধান্ত বিরক্ত হইয়া ব্রাহ্মণীকে থমাইবার জন্য লাঠি ধরিয়া সুড় সুড় করিয়া উঠিতেছেন এমন সময়ে মানগোবিন্দ ধরে বসিল —ওগো তর্কসিদ্ধান্ত খুড়ো ! আমরা সব সৌদাগরি করিতে যাব একটা ভালো দিন দেখে দেও।
তর্কসিদ্ধান্ত মুখ বিকটসিকট করিয়া গুমরে উঠিলেন —কচুপোড়া খাও —উঠছি আর অমনি পেচু ডাক্ছ আর কি সময় পাওনি? সৌদাগরি করতে যাবে ! তোর বাপের ভিটে নাশ হউক —তোদের আবার দিনক্ষণ কি রে ? বালাই বেরুলে সকলে হাঁপ ছেড়ে গঙ্গাস্নান করবে —যা বল্গে যা যে দিন তোরা এখান থেকে যাবি সেই দিনই শুভ।
মানগোবিন্দ মুখছোপ্পা খাইয়া আসিয়া বলিল যে কালই দিন ভালো, অমনি সাজ্ রে সাজ্ রে শব্দ হইতে লাগিল ও উদ্যোগ পর্বে ধুম বেধে গেল। কেহ সেতারার মেজ্রাপ হাতে দেয় —কেহ বাঁয়ার গাব আছে কি-না তাহা ধপ্ ধপ্ করিয়া পিটে দেখে —কেহ তবলায় চাঁটি দিয়া পরখ করে —কেহ কেহ ঢোলের কড়া টানে —কেহ বেহালায় রজন দিয়া ডাডা ডাডা করে —কেহ বোঁচকা-বুঁচকি বাঁধে —কেহ চরস-গাঁজা মায় ছুরি, কাঠ লইয়া পোঁটলা করে —কেহ ছর্রার গুলী চাটের সহিত সন্তর্পণে রাখে —কেহ পাকামালের ঘাট্তি তদারক করে। এইরূপে সারা দিন ও সারা রাত্রি ছট্ফটানি, ধড় ফড়ানি, আন, নিয়ে আয়, দেখ, শোন, ওরে, হেঁরে, সজ্জাগজ্জা, হোহাতে কেটে গেল।
গ্রামে ঢিঢিকার হইল বাবুরা সৌদাগরি করিতে চলিলেন। পর দিবস প্রভাতে যাবতীয় দোকানী, পসারী, ভিখিরী, কাঙালী ও অন্যান্য অনেকেই রাস্তায় চাহিয়ে আছে ইতিমধ্যে নববাবুরা মত্ত হস্তীর ন্যায় পৈয়িস্ পৈয়িস্ করত মস্ মস্ শব্দে ঘাটে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। অনেক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত আহ্ণিক করিতেছিলেন, গোলমাল শুনিয়া পশ্চাতে দৃষ্টিপাত করিয়া একেবারে জড়সড় হইলেন। তাঁহাদিগকে ভীত দেখিয়া নববাবুরা খিল্ খিল্ করিয়া হাসিতে হাসিতে গঙ্গামৃত্তিকা ঝামা ও থুৎকুড়ি গাত্রে বর্ষণ করিতে লাগিলেন। ব্রাহ্মণেরা ভগ্নাহ্ণিক হইয়া গোবিন্দ গোবিন্দ করিতে করিতে প্রস্থান করিলেন। নববাবুরা নৌকায় উঠিয়া সকলে চিৎকার স্বরে এক সখীসম্বাদ ধরিলেন —নৌকা ভাঁটার জোরে সাঁ সাঁ করিয়া যাইতেছে কিন্তু বাবুরা কেহই স্থির নহেন —এ ছাতের উপর যায় ও হাইল ধরে টানে —এ দাঁড় বহে ও চকমকি নিয়ে আগুন করে। কঞ্চিৎ দূর যাইতে যাইতে ধনামালার সহিত দেখা হইল —ধনামালা বড়ো মুখর —জিজ্ঞাসা করিল গ্রামটাকে তো পুড়িয়ে খাক করলে আবার গঙ্গাকে জ্বালাচ্ছ কেন? নববাবুরা রেগে বলিল —চুপ শূয়ার —তুই জানিস নে যে আমরা সব সৌদাগরি করতে যাচ্ছি? ধনা উত্তর করিল —যদি তোরা সৌদাগর হস্ তো সৌদাগরি কর্ম গলায় দড়ি দিয়া মরুক !