২২. বটতলার থিয়েটার

বটতলার থিয়েটার

প্রথম প্রস্তাব

একতলা—বেলতলা থেকে সমস্ত গাছতলা ঘুরে শেষকালে একটা সময় যেন বটতলার সাগরসঙ্গমে কলকাতার সংস্কৃতিগঙ্গার গতিধারার স্বাভাবিক মিলন হয়। বাংলা ছাপাখানা ও ছাপা সাহিত্যের তা—ই হয়েছিল। কবি, আখড়াই, খেউড়, হাফ—আখড়াইও বাঁধা বটতলার বুকে যেরকম সুললিত কণ্ঠে ঝঙ্কৃত হয়ে উঠেছিল, সেরকম আর কোনো বেলতলায় বা পিপুলতলায় হয়নি। কলকাতা কালচারের আদিপর্বে ধনিক বাবুপ্রধান সুতানুটির স্বাভাবিক চিন ছিল অত্যন্ত বেশি। সেই টানে কলকাতার থিয়েটারও ওইদিকে এগিয়ে গেছে এবং বটতলার বুকে তার বিকাশ হয়েছে।

কবি, খেউড়, আখড়াই, বাইনাচ, ভাঁড়নাচ ইত্যাদি বাৎসরিক পূজা—পার্বণ উৎসব—অনুষ্ঠানে বাবুদের হলঘরে ও নাচঘরে ক্রমে আধা—থিয়েটারের রূপ নিয়েছে। রাসলীলায়, রথযাত্রায়, দোলযাত্রায় ও দুর্গোৎসবে এই নাচ—গানের আসর সরগরম হয়ে উঠেছে। প্রেরণাটা প্রধানত এসেছে কৃষ্ণনগর থেকে। নদিয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রর উৎসব—অনুষ্ঠানই হল তার আদর্শ। ব্রিটিশ আমলের বাঙালি বড়লোকেরা কলকাতার উৎসবাদিতে অপরিমিত ব্যয় করতে থাকেন, অনেকটা মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রর অনুকরণে। শোভাবাজারের রাজবাড়ি, ঠাকুরবাড়ি, সিংহবাড়ি, মল্লিকবাড়ি, দে—সরকারের বাড়ি, ভূ—কৈলাস বাড়িতে তখন পাল্লা দিয়ে পুজো, বিয়ে, শ্রাদ্ধ, গৃহপ্রবেশ ইত্যাদি হত। এইসব মহাবাবুদের বাড়ির বৈঠকখানা, বাগানবাড়ি, হলঘর, পূজামণ্ডপ, নাচঘর এইভাবে প্রায় রঙ্গালয় হয়ে উঠল। ১৮২৩ সালে দ্বারকানাথ ঠাকুর যে গৃহপ্রবেশের উৎসব করেন তাতে দেশি গান ও ইংরেজি বাদ্য—নৃত্য হয়। কলকাতার সমস্ত সম্ভ্রান্ত সাহেব ও বাঙালিবাবু উপস্থিত থাকেন। নৃত্য—গীতাদির শেষে ভাঁড়েরা সং সেজে আমোদ করেন এবং তার মধ্যে একজন গোরুর বেশ ধারণ করে হাম্বা—হাম্বা রব করে যখন ঘাস চর্বণ করতে থাকেন, তখন উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এই ভাঁড়ামিকে আমরা আধুনিক রঙ্গালয়ের প্রসববেদনা বলতে পারি। যাত্রাগানের যুগের ‘সভামণ্ডল’ ও ‘রঙ্গভূমি’ দুইই তখন বাবুদের হলঘরে ও নাচঘরে স্থানান্তরিত হয়েছে। শখের নাট্যশালা ও রঙ্গালয় তারই পল্লবিত রূপ ছাড়া আর কিছু নয়।

কৃষ্ণনগরের ঢেউ কলকাতায় এসেছিল, আগেই বলেছি। অস্তমিত নদিয়া কালচারের সঙ্গে উদীয়মান কলকাতা কালচারের এক বিচিত্র সংমিশ্রণ হয়েছিল। দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়ের রচনা থেকে কৃষ্ণনগরের কোর্ট—কালচারের একটু আভাস দিচ্ছি :

‘এক রাত্রিতে রাজবাটীতে এক অপূর্ব রূপসি ও অসাধারণ সুকণ্ঠা তরফাওয়ালির নৃত্য—গীতে সকলেই বিমোহিত হইলেন। কেহ প্রস্তাব করিলেন যে, এই রমণী সুন্দর খেমটা নাচিতে পারে। তখন সুরাপানে সকলেরই হৃদয় প্রফুল্ল ছিল, সুতরাং সুন্দরী যখন পেশোয়ার ছাড়িয়া একখানি কালোপেড়ে সূক্ষ্ম ধুতি পরিয়া গৃহে প্রবেশ করিল যেন স্বর্গবিদ্যাধরী অবতীর্ণা হইলেন দর্শকবৃন্দের ঢুলুঢুলু নয়নে এইরূপ দৃষ্ট হইল। নিমন্ত্রিত মহাশয়দিগের মধ্যে কী প্রধান, কী বিজ্ঞ, কী পদস্থ প্রায় সকলেই তাহার নৃত্যে বিমোহিত হইলেন। প্রথমে কয়েক অবিজ্ঞ যুবা আপন আপন চরণ নিজ বশে রাখিতে পারিলেন না। তাঁহারা ওই সঙ্গে নৃত্য আরম্ভ করিলেন। প্রাচীন ও পদস্থ একজনও দণ্ডায়মান হইলেন। এক বিজ্ঞবর প্রথমাবধি গম্ভীরভাবে ছিলেন, তাঁহার পদ শেষে অস্থির হইয়া উঠিল। তিনি উক্ত প্রাচীনকে নাচাইবার ছলে আপনি নাচিতে লাগিলেন।’

এরপর শোভাবাজারের রাজবাড়ির দুর্গোৎসবের একটা বর্ণনা না দিলে কলকাতা ও কৃষ্ণনগরের ‘কালচারাল কোলাকুলি’র স্বরূপ বোঝা যাচ্ছে না। প্রত্যক্ষদর্শী পাদরি ওয়ার্ড সাহেবের বিবরণ থেকে তুলে দিচ্ছি। পাদরি ওয়ার্ড লিখেছেন : ‘১৮০৬ সালে শোভাবাজারের রাজবাড়ির দুর্গোৎসবে আমি উপস্থিত ছিলাম। চারমহলা প্রাসাদের মাঝখানে উৎসব—প্রাঙ্গণ, সামনে পূজামণ্ডপ। পুবদিকের একখানা ঘরে মদ ও সাহেবি খানার আয়োজন, আমন্ত্রিত সাহেবসুবোদের জন্য। ঘরের সামনে দুইজন পর্তুগিজ খানসামা অভ্যর্থনার জন্য মোতায়েন রয়েছে। ঠিক তার উল্টোদিকে পূজামণ্ডপে প্রতিমা প্রতিষ্ঠিত। দুইপাশের ঘরে আমন্ত্রিত এ দেশি অতিথিরা উপস্থিত রয়েছেন। মধ্যে হিন্দু নর্তকীদের নৃত্য—গীত চলছে, চারদিক ঘিরে সাহেব অতিথিরা কৌচে বসে তন্ময় হয়ে দেখছেন। মধ্যে মধ্যে মুসলমান বাইজিরা হিন্দুস্থানি গান গেয়ে, বিসদৃশ অঙ্গভঙ্গি ও রঙ্গতামাশা করে সকলকে আপ্যায়ন করছে। রাত দুটো আন্দাজ বাইজি ও নাচওয়ালিরা চলে গেল, সাহেব অতিথিরাও সকলে চলে গেলেন, কেবল আমরা কয়েকজন রইলাম। পূজামণ্ডপে আলো ছাড়া আর সব আলো নিভে গেল। বাইরের দরজা খুলে দেওয়া হল। তখন হুড়মুড় করে একদল লোক ভিতরে ঢুকল, বিচিত্র তাদের পোশাক, হাবভাব, মাথায় লম্বা লম্বা পাউরুটির মতন টুপি। অশ্লীল গান গেয়ে, নৃত্য ও অঙ্গভঙ্গি করে তারা আমোদ করতে লাগল। এরকম বীভৎস দৃশ্য আমি জীবনে কখনও দেখিনি, বিশেষ করে পূজামণ্ডপে যে এইরকম খিস্তিখেউড় ও বেলেল্লাগিরি চলতে পারে তা আমার কল্পনাতীত ছিল…।’

নৃত্য—গীত, রঙ্গ ও ভঙ্গিমা, যা দিয়ে রঙ্গাভিনয়, শেষ পর্যন্ত এই হল তার পরিণতি। রঙ্গালয়ের আগের কথা। কবিগান ও যাত্রাগানেরও রূপ বদলাতে লাগল। ইংরেজদের থিয়েটারে এবং বড়বাবুদের নাচঘরে ও পূজামণ্ডপে তার ককটেল—রূপ দেখে এ দেশি যাত্রা ও কবিগান চরম বিকৃতির পঙ্ককুণ্ডে হাবুডুবু খেয়ে বিলুপ্তির পথে এগিয়ে গেল। কতশত এ দেশি লোকপ্রতিভা, লোককবি ও লোকশিল্পী যে কলকাতার হঠাৎ—বড়লোকদের নব্য ‘ক্যালকাটা কালচার’—এর তীব্র ঝাঁঝ সহ্য করতে না পেরে একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে গেল, তার ঠিক নেই। শুধু বাংলার পটুয়ারাই যে কালীঘাটে এসে তাদের কবর রচনা করেছিল তা নয়। বাংলার শত শত লোককবি ও শিল্পী শোভাবাজারে, চোরবাগানে, পাথুরিয়াঘাটায় ও বটতলায় এসে অকাল অপমৃত্যু বরণ করেছে। তাদের কোনো ইতিহাস লেখা নেই। নিকি বাইজিদের হাজার টাকা মাইনে হল, ইংরেজদের থিয়েটারের অধ্যক্ষ, অভিনেতা—অভিনেত্রীরা উচ্চবেতনে অভিনয়শিক্ষক নিযুক্ত হলেন এবং শিশুরাম, গোবিন্দ, পরমানন্দ, বদন, কৃষ্ণকমল, প্রেমানন্দ অধিকারী ও গোপাল উড়েদের বংশধরেরা একেবারে উচ্ছন্নে গেল।

যাত্রার রূপ বদলাচ্ছিল দ্রুতগতিতে। কৃষ্ণ—যাত্রা ও বিদ্যাসুন্দর—যাত্রার রূপ ঢেলে সাজা হচ্ছিল। আদিরস ও ভাঁড়ামির মাত্রাধিক্যে যাত্রাগান যে পরিমাণ গেঁজিয়ে উঠেছিল তা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। শিক্ষিত বাবুরাই নতুন নতুন যাত্রার দলের অধিকারী হচ্ছিলেন। গোপাল উড়ে ও বদন অধিকারীদের পসার কমে যাচ্ছিল। ইংরেজদের থিয়েটার থেকে দেশি যাত্রাগানে স্ত্রীলোক অভিনেত্রীর আবির্ভাব হল। জোড়াসাঁকোর রামচাঁদ মুখুজ্জে যে ‘নন্দবিদায়’ যাত্রা করলেন, তাতে ত্রয়োদশী ছিদামের নাচ—গানে সকলে মোহিত হয়ে গেল। গোপাল উড়েরা টেক্কা দিতে পারল না বাবুদের যাত্রার দলের সঙ্গে। এমনকি বিদ্যাসুন্দর—যাত্রার মধ্যে যথেষ্ট আদিরসের মাত্রা চড়িয়েও টেক্কা দেওয়া সম্ভব হল না। বাবুদের মন উঠল না তাতে। কেন উঠল না, তা এ দেশি যাত্রার অধিকারীরা বুঝেও বুঝতে পারলেন না। রুশ ব্যবসায়ী লেবেডেফ বুঝতে পেরেছিলেন। তাই ১৭৯৫ সালে লেবেডেফ যে রঙ্গাভিনয়ের আয়োজন করেন তাতে বাঙালি গোলোকনাথ দাসের সাহায্যে ইংরেজি নাটক বাংলায় অনুবাদ করান, বিদ্যাসুন্দরের গান ইংরেজি সুরে রচনা করেন এবং এ দেশি স্ত্রীলোকদেরও অভিনয়ের জন্য সংগ্রহ করেন। লেবেডেফ যা করতে পারলেন, শিশুরাম অধিকারীর শিষ্য—প্রশিষ্যরা তা পারলেন না।

বিদ্যাসুন্দর—যাত্রার স্বর্ণযুগ তখন, তার সমাদরও তখন সবচেয়ে বেশি। রুশবাসী লেবেডেফ পর্যন্ত তা বুঝতে পেরেছিলেন, তাই ডোমতলায় তিনি যে রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠা করেন, সেখানে বিদ্যাসুন্দরও গীত হয়। কিন্তু—

সুন্দরীর করে ধরি সুন্দর বিনয় করি

কহে শুন শুন প্রাণেশ্বরী।

আজি দিনে দুপ্রহরে দেখিলাম সরোবরে

কমলিনী বান্ধিয়াছে করী।।

—এসব অভিনয় আর কিশোর—বালকদের মুখে শুনে বাবুদের ভাল লাগে না। তাই শখের বিদ্যাসুন্দর—যাত্রায় স্ত্রীলোকের অভিনয় শুরু হল।

শ্যামবাজারের নবীনচন্দ্র বসু এক নাট্যশালা স্থাপন করে ‘বিদ্যাসুন্দর’ নাটক অভিনয় করেন। নবীনবাবুর বাড়িতেই এই অভিনয় হয়। ১৮৩৫ সালের কথা। শ্যামবাজারে আগে যেখানে ট্রাম—কোম্পানির আস্তাবল (ঘোড়ার ট্রামের আসলে) ছিল, সেখানে ছিল নবীনবাবুর বাড়ি। তখনও রঙ্গমঞ্চ বা দৃশ্যপট ইত্যাদির ব্যবস্থা হয়নি। নাটকের দৃশ্যাবলি বাড়ির বিভিন্ন স্থানে প্রকৃত সাজসজ্জাদি দিয়ে সাজানো হয়। এক ঘর থেকে অন্য ঘরে মাটি খুঁড়ে সুড়ঙ্গ করা হয়। বীরসিংহের দরবার হয় নবীনবাবুর বৃহৎ বৈঠকখানায়। বকুলতলার পুষ্করিণীর দৃশ্য বাড়ির উদ্যানের পুষ্করিণীর তীরে সাজানো হয়। উদ্যানের একপাশে মালিনীর কুটির তৈরি হয়। এক স্থানে এক দৃশ্যের অভিনয় দেখে দর্শকরা অন্য স্থানে দৃশ্য দেখতে উঠে যেতেন। প্রথম ‘বিদ্যাসুন্দর’ অভিনয় এইভাবে দর্শকরা ছুটোছুটি করে দেখেন। বিদ্যার ভূমিকায় ষোড়শবর্ষীয়া রাধামণি দাসী ও তার সখীর ভূমিকায় রাজকুমারীর অভিনয়, অঙ্গভঙ্গি, নৃত্য—গীত দেখে সকলেই মুগ্ধ হন। অভিনয়ের ব্যয়নির্বাহার্থ নবীনবাবু প্রায় দুই লক্ষ টাকা খরচ করেন। তার জন্য ‘খাতাবাড়ি’ নামে ইংরেজটোলার এক বাড়ি তাঁকে বিক্রি করতে হয়। এখন যে বাড়িতে ‘মিলিটারি অ্যাকাউন্টস’—এর আপিস, তাকেই সেকালের খাতাবাড়ি বলা হত।

এইভাবে বাঙালির উদযোগে প্রথম বাংলা নাটক অভিনয়ের সূত্রপাত হয়। ইংরেজি থিয়েটার ও যাত্রাগানের সংমিশ্রণে বাংলা রঙ্গাভিনয়ের এক নতুন ধারার প্রবর্তন হয়। বাঙালির রঙ্গালয় তখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি, সাধারণ জাতীয় রঙ্গালয় তো নয়ই।

.

দ্বিতীয় প্রস্তাব

 With fire in their eyes and love on their lips

And passion in each of their elegant skips,

As breathless as angles, as wicked as devils,

Performed at these highly indelicate revels.

—‘Lays of Ind’

বাবুদের বাড়ি বাইনাচ আর ভাঁড়নাচ দেখে ইংরেজ কবি ‘দ্য নটি নাচ’ কবিতা লিখে ফেললেন। নাচানাচির পর্বও ক্রমে শেষ হয়ে এল। সুপ্রিমকোর্টের মামলা—মকদ্দমা ও পুজো—বিয়ে—অন্নপ্রাশন—শ্রাদ্ধে অপরিমিত ব্যয় করে বাঙালি হঠাৎ—নবাবরা প্রায় নিলামে ওঠার উপক্রম হলেন। তা ছাড়া বাবুদের বংশলোচনদের কিঞ্চিৎ জ্ঞানবৃদ্ধিও হতে থাকল। ধনক্ষয়টা যে প্রায় বর্বরের মতন হচ্ছে তা তাঁরা কিছু ‘লেটে’ হলেও শেষ পর্যন্ত বুঝলেন। রঙ্গালয়ের ইতিহাসের প্রথম একশো বছর আমাদের সাবালক হতে—হতেই কেটে গেল।

গুণতে গেলে একশো বছরই প্রায় বলতে হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে প্রায় ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত। ১৭৫৬ সালের কিছু আগে ইংরেজদের প্রথম থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতায়। সেই সময় থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত ‘দি চৌরঙ্গি থিয়েটার’, ‘দি ক্যালকাটা থিয়েটার’, ‘সাঁ সোচি থিয়েটার’ ইত্যাদি একাধিক ইংরেজি রঙ্গালয় কলকাতায় স্থাপিত হয়। এই সময় অনেক ইংরেজ অভিনেতা—অভিনেত্রী, মঞ্চাধ্যক্ষ ও প্রযোজক কলকাতায় আসেন এবং তাঁদের অভিনয় দেখে বাবুরা রঙ্গালয়ের দিকে আকৃষ্ট হন। তার থেকেই সেইদিন বাবুদের শখের থিয়েটারের উৎপত্তি হয় বলা চলে। বোধহয় চৌরঙ্গি থিয়েটার (১৮১৩—৩৯), ক্যালকাটা থিয়েটার ও সাঁ সোচি থিয়েটারের প্রভাবেই বাঙালি বড়বাবুরা শখের নাট্যশালা খুলতে অনুপ্রাণিত হন। বাঙালি প্রতিষ্ঠিত প্রথম থিয়েটার হল প্রসন্নকুমার ঠাকুরের ‘হিন্দু থিয়েটার’ (১৮১৩ সাল) এবং তাতে প্রথম অভিনয় হয় শেক্সপিয়রের ‘জুলিয়াস সীজার’—এর অংশ ও উইলসন অনূদিত ভবভূতির ‘উত্তররামচরিত’। অভিনয় দেখে একজন ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ পত্রিকায় বেশ একখানি মজার চিঠি লেখেন। তাঁর চিঠির বক্তব্য আমি কিঞ্চিৎ মার্জিত ভাষায় উদ্ধৃত করছি :

‘রাঢ়দেশের ক্ষুদ্র লোকের সন্তানেরা কালীয়দমন, রামযাত্রা, কৃষ্ণযাত্রা, চণ্ডীযাত্রা ইত্যাদি করত। এখন ভদ্রলোকের সন্তানেরা ওই ব্যবসা আরম্ভ করলেন। সুখের কথা এঁরা ধনীর সন্তান, প্রতিপদে এঁদের পেলা দিতে হবে না। যাত্রার ছোকরারা সর্বদাই টাকাপয়সা চাইত, পয়সা—সিকি—আধুলি না পেলে দর্শকদের কাছে এসে নান রকমের রঙ্গভঙ্গি করত। নিস্তার পাবার জন্য কিছু তাদের নিতেই হত। এখন আর সে আপদ রইল না। ধনীর দুলালরা নিজেদের অর্থ ব্যয় করে নানা রকমের বেশভূষা প্রস্তুত করেছেন। ইংরেজ শিক্ষক রেখে অভিনয় অভ্যাস করেছেন। আমাদের দেশীয় অধিকারীরা কেবল একরকম বেশ করে অভিনয় করেন। থরকাটা প্রেমচাঁদ অধিকারী শুধু কতকগুলি বাইআনা বেশের সৃষ্টি করেছেন। তার চেয়ে ইংরেজ অধিকারীদের বেশভূষার সজ্জা হাজারগুণ ভাল। যেমন সং, তেমন অভিনয় এবং ঠিক অবিকল সেইরকম পোশাক।’

এই চিঠির উপর মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। ইংরেজদের থিয়েটার থেকেই বাঙালিবাবুরা শখের থিয়েটারের প্রেরণা পান এবং ইংরেজ অধিকারীর তালিমেই বাঙালির শখের থিয়েটার গড়ে ওঠে। শিল্প—বাণিজ্য যেমন একটা বিশেষ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে, থিয়েটারও তেমনি গড়ে ওঠে কলকাতা শহরে। প্রথম যুগের রঙ্গালয়কেন্দ্র ছিল চৌরঙ্গি—পার্ক স্ট্রিট থেকে চীনাবাজার—লালবাজার পর্যন্ত। সেটা ইংরেজি থিয়েটারের যুগ এবং চৌরঙ্গি থেকে চীনাবাজারের মধ্যেই প্রধানত তখন ইংরেজরা বাস করতেন। শখের থিয়েটারের যুগে কলকাতার থিয়েটার—অঞ্চল ক্রমে উত্তরদিকে স্থানান্তরিত হত থাকে, কারণ কলকাতায় শৌখিন বড়বাবুদের প্রধান বসবাসকেন্দ্র উত্তর কলকাতা। শখের থিয়েটার থেকে সাধারণ রঙ্গালয় পর্যন্ত থিয়েটারের অগ্রগতি উত্তর কলকাতাতেই হয়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত উত্তর কলকাতাতেই শহরের প্রধান রঙ্গালয়কেন্দ্র হয়ে আছে। দক্ষিণ কলকাতার থিয়েটার শুধু যে ভাল চলে না তা নয়, যেন ভাল মানায়ও না। উত্তর কলকাতার কালচার প্রথম ইংরেজ যুগের ও শেষ নবাবি আমলের বড়লোক বাঙালির কালচার; দক্ষিণ কলকাতার কালচার তার পরবর্তী যুগের ইংরেজি—শিক্ষিত চাকুরিজীবী বাঙালি মধ্যবিত্তের কালচার। তাই দক্ষিণ কলকাতায় ‘থিয়েট্রিক্যাল পার্টি’ ও ‘ড্রামাটিক ক্লাব’ পর্যন্ত বিকাশ সম্ভব হয়েছে, উত্তর কলকাতার মতন শখের নাট্যশালা থেকে সাধারণ রঙ্গালয় পর্যন্ত থিয়েটারের বিকাশ বা পরিণতি সম্ভব হয়নি।

বাঙালির নতুন থিয়েটার ক্রমে সেই বটতলাভিমুখী হল। একতলা বেলতলা থেকে সেই বটতলা। ছাত্ররাও ইংরেজি অভিনয় আরম্ভ করল, শেক্সপিয়রের নাটক। ১৮৫১ সালে বটতলার ‘ডেভিড হেয়ার অ্যাকাডেমি’ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৮৫৩ সালে তার ছাত্ররা শেক্সপিয়রের ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিস’ অভিনয় করে। দেখাদেখি ‘ওরিয়েন্টাল সেমিনারির’ ছাত্ররাও অভিনয় করতে আরম্ভ করে—ওই শেক্সপিয়রের নাটক এবং ওই বটতলায়। বাঁধা বটতলার পাশে এক বৃহৎ বাড়িতে ওরিয়েন্টাল সেমিনারি ছিল এবং সেই বাড়িতে ছাত্ররা ‘ওথেলো’ অভিনয় করল। কলকাতা মাদ্রাসার ইংরেজি বিভাগের প্রধান শিক্ষক, সাঁ সোচি থিয়েটারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মিঃ ক্লিঙ্গার ছাত্রদের অভিনয়শিক্ষা দেন। স্কুলের ছাত্রদের এই নাট্যশালা পরে পূর্ণাঙ্গ নাট্যশালায় পরিণত হয়—নাম হয় ‘ওরিয়েন্টাল থিয়েটার’। মিঃ ক্লিঙ্গার ছাড়াও এলিস নামে এক ইংরেজ মহিলা এখানে অভিনয়শিক্ষা দেন। গড়ের মাঠের কাছে কোথাও এলিসের একটি রঙ্গালয় ছিল বলে মনে হয়, কারণ ‘সংবাদ প্রভাকর’ থেকে জানা যায় যে, ‘মিস ইলিসের গড়ের মাঠের নৃত্যাগার পবনঠাকুরের কৃপায় পতিত হইয়াছে। (১৮৫১, ২৬ এপ্রিল)। চৌরঙ্গি ও চীনাবাজারের ইংরেজ অধিকারীরা কীভাবে বটতলায় এসে বাঙালি থিয়েটারের অধিকারী ও অভিনেতাদের তালিম দিয়েছিলেন, তা এইসব বিবরণ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়। ইংরেজি অভিনয়ে বাঙালিরা যেন প্রথমে খানিকটা রিহার্সাল দিয়ে নিলেন, তারপর বাংলা অভিনয় আরম্ভ হল। প্রথমে ইংরেজি শিখে পরে বাংলা শেখা, অথবা প্রথমে ইংলন্ডের ইতিহাস মুখস্থ করে পরে বাংলার ইতিহাস পড়ার মতন যেন থিয়েটারের ব্যাপারটাও অনেকটা হল। শেক্সপিয়রের নাটক অভিনয় করে এবং সংস্কৃত নাটক ইংরেজিতে তর্জমা করে বাঙালির নবযুগের থিয়েটারের সূত্রপাত হল। অভিনয়ের দীক্ষাগুরু হলেন ইংরেজরা। যাত্রার যুগের গোপাল উড়ে বা বদন অধিকারীর বদলে থিয়েটারের যুগে ক্লিঙ্গার, এলিস, রবার্টল, পার্কার প্রমুখ ইংরেজরাই অধিকারী হলেন। বাঁধা বটতলার আশপাশে ইংরেজ অধিকারী ও অভিনয়ের সযত্ন তালিমে বাঙালির থিয়েটার আরম্ভ হল, অবশ্য প্রধানত ইংরেজি থিয়েটার।

তারপর এল বাংলা নাট্যাভিনয়ের যুগ। সেই বটতলারই আশপাশে তার মহড়া চলতে লাগল। লেবেডেফ অবশ্য ১৭৯৫ সালে প্রথম বাংলা নাট্যশালা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন কিন্তু পণ্ডিত গোলোকনাথ দাসের সাহায্য নিয়ে বা স্ত্রীলোক অভিনেত্রী জুটিয়েও তাঁর চেষ্টা সার্থক হয়নি। তার কারণ বাংলা ‘বিদ্যাসুন্দর’—এর ইংরেজি সুর রচনা, এসব ইংরেজি ‘ডিজগাইজ’—এর বাংলা তর্জমা, কোনোটাই আসল বাংলা অভিনয় নয়। সংস্কৃত নাটক বাংলায় রূপান্তরিত করে বাংলা নাটকের অভিনয় শুরু হয় ১৮৫৭ সালে—সিমলায় সাতুবাবুদের বাড়িতে। তার অল্পদিন পরে ১৮৫৮ সালেই চড়কডাঙায় রামজয় বসাকের বাড়িতে প্রথম বাংলা সামাজিক নাটক ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’র অভিনয় হয়। এই অভিনয়ে মহেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় কুলাচার্য সেজেছিলেন। চড়কাডাঙা রোডে (বর্তমানে টেগোর কাসল রোড) রামজয় বসাকের বাড়ির উঠানে স্টেজ বাঁধা হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া রেল কোম্পানির এজেন্টের অফিসের বড়বাবু রাজেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রঙ্গমঞ্চ প্রস্তুত করেন। রাজেনবাবু ও জগৎ দুর্লভবাবু দিব্যি ভুঁড়ি নিয়ে মাথায় লম্বা টিকি ঝুলিয়ে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত সাজেন। রাজেনবাবুর হাতে একটি শামুকের নস্যাধারও ছিল। তাঁরা দু’জনে যখন তর্কাতর্কি করতেন তখন শ্রোতারা হেসে গড়াগড়ি যেত। পরে বড়বাজারের গদাধর শেঠের বাড়ি এই নাটকের আরও অভিনয় হয়। অভিনয় দেখে উৎফুল্ল হয়ে একজন ‘সভ্যতা—পথের পথিক’, ‘সংবাদ প্রভাবকর’ পত্রিকায় লেখেন (১৮৫৮, ২৫ মার্চ) :

বঙ্গদেশে আজকাল বড় ধূমধাম

যেথা সেথা শুনা যায় অভিনয় নাম।।

বঙ্গদেশে রঙ্গবিদ্যা হোতেছে প্রকাশ।

সকলে উৎসাহ করে এই মম আশ।

নাটক লইয়া সবে রঙ্গরসে থাক।

কালিদাস হোয়ে সবে কালীনাম ডাক।।

ক্রমে বেলগাছিয়া নাট্যশালা, বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চ, পাথুরিয়াঘাটা বঙ্গ নাট্যালয়, শোভাবাজার প্রাইভেট থিয়েট্রিক্যাল সোসাইটি, জোড়াসাঁকো নাট্যশালা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং নাটুকে রামনারায়ণের পর মাইকেল মধুসূদন ও দীনবন্ধু মিত্রর মতন নাট্য—প্রতিভার আবির্ভাব হয়। বাংলা নাটক, বাংলা অভিনয় ও বাংলা থিয়েটারের দ্রুত বিকাশ হতে থাকে। এর মধ্যে অবশ্য নতুন রুচিসম্পন্ন শিক্ষিত বাঙালি দর্শকগোষ্ঠীও তৈরি হয়েছে এবং রঙ্গালয়ের প্রয়োজনীয়তাও তাঁরা বোধ করেছেন। কিন্তু প্রাইভেট রঙ্গালয়ে সেই প্রয়োজন মিটছে না। বাংলায় সাধারণ রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার সময় হয়েছে। ১৮৬০ সালে আহিরিটোলার রাধামাধব হালদার ও যোগীন্দ্রনাথ ‘দ্য ক্যালকাটা পাবলিক থিয়েটার’ নাম দিয়ে সাধারণ রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ব্যর্থ হলেও সেটা সাময়িক, কারণ ক্ষেত্র তৈরি, অর্থাৎ বাংলা নাটক ও নাট্যকার তৈরি, বাঙালি অভিনেতা তৈরি এবং বাঙালি দর্শকরাও তৈরি। বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটার দীনবন্ধুর নাটক অভিনয় শুরু করেন—’সধবার একাদশী’, ‘লীলাবতী’। অভিনয়ের আশাতীত সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে সাধারণ রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠা পরিকল্পনা চলতে থাকে। ‘নীলদর্পণ’ নাটকের মহড়া আরম্ভ হয়। ১৮৭২ সালের কথা।

সেই বটতলা। ১৮৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর। ‘কলিকাতা ন্যাশনাল থিয়েট্রিক্যাল সোসাইটি’ নাম দিয়ে চিৎপুরে মধুসূদন সান্যালের বাড়ির বাইরের উঠানে মঞ্চ বেঁধে ‘নীলদর্পণ’ নাটকের অভিনয় হয়। এই হল বাঙালির সাধারণ রঙ্গালয়ের প্রথম অভিনয়। চৌরঙ্গি ও চীনাবাজারে ছিল ইংরেজের থিয়েটার। বটতলায় প্রথম ইংরেজের তালিমে বাঙালির শখের থিয়েটার আরম্ভ হল, শুধু শৌখিন ধনী বাবুদের নয়, স্কুল—কলেজের ছাত্রদেরও। বাঙালির থিয়েটার, কিন্তু ইংরেজি অভিনয়। তারপর তৃতীয় পর্বে বটতলায় সাধারণ রঙ্গালয়ের বিকাশ হল। সার্থক হল কলকাতার বটতলার জীবন। ‘কলকাতা কালচার’—এর একটা বিরাট অধ্যায় জুড়ে রইল বটতলা। এতদিন স্বতন্ত্র একটা ‘বটতলা কালচার’—এর যেন সার্থক পরিণতি হল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *