বঙ্গীয় ভদ্রমহিলা : উন্নত জাতের নারী উৎপাদন
উনিশ শতকেব। বাঙলা দেখতে পায় এক অভিনব জাতের নারীর উদ্ভব, যার সাথে মিল নেই তার আগের নারীদের। বাঙলার নারী আগের হাজার বছর ধরে ছিলো গাঢ় অন্ধকারে; তার নিজের কোনো সত্তা ছিলো না, স্বাধীনতার কথা সে কখনো শোনে নি, তার কোনো স্বপ্ন ছিলো কিনা তা কেউ জানে না। পুরুষ তাকে পশুর থেকেও নিকৃষ্টরূপে বঁচিয়ে রেখেছে, আগুনে পুড়েছে, ইচ্ছেমতো গ্ৰহণ করেছে ও ছেড়েছে, তাকে অবরোধের কারাগারে আটকে রেখেছে। উনিশ শতকে পিঞ্জরাবদ্ধ পাখি ছিলো নারীর জনপ্ৰিয়তম রূপক, তবে আবহমান বাঙালি নাৰী পিঞ্জর বা ‘সোনার খাচা’য় পোষা ময়না ছিলো না; সে ছিলো পশুর থেকেও নিকৃষ্ট, পশুকেও মূল্যবান গণ্য করেছে বাঙালি পুরুষ কিন্তু নারীকে কখনো মূল্যবান মনে করে নি। তার জন্ম ছিলো বাঙালি পুরুষতন্ত্রের জন্যে বিভীষিকা, তার মৃত্যু ছিলো তৃপ্তিকর। তার সাথে পুরুষ কখনো আন্তরিক সম্পর্কে আসে নি, তার শরীরকেও কখনো পরিতৃপ্ত করে নি ব’লেই মনে হয়, যদিও তার ‘মদন আট গুণ’ বলে তাকে ধিক্কার দিয়েছে। শতাব্দীপরম্পরায় বাঙালির জন্ম হয়েছে পুরুষের ক্ষণিক উত্তেজনায়, অক্রিয় নারীদেহ ক্ষণিক পীড়নের ফলে। উনিশশতকের আগের বাঙালি নারী সম্পূর্ণ মুখাবয়বহীন, পুরুষতন্ত্রের যুপকাঠে রক্তাক্ত উৎসৰ্গিত একটি প্রাণী নারী। এ-অঞ্চলেব দুটি সম্প্রদায়, হিন্দু ও মুসলমান, প্রবল পিতৃতান্ত্রিক; উনিশশতক পর্যন্ত তার বাস করেছে গভীর মধ্যযুগীয়তার মধ্যে, এখনো তারা সম্পূর্ণ উঠে আসে নি ওই মধ্যযুগ থেকে বরং সেখানে ফেরার জন্যে তারা আজ খুবই ব্যগ্ৰ। ঐতিহাসিকভাবে এ-অঞ্চলে অধিকাংশ পুরুষেরই কোনো স্বতন্ত্র সত্তা ছিলো না, তারাই ছিলো মুষ্টিমেয় সমাজপতির প্রচণ্ড পীড়নের শিকার; তাই নারীর দুরবস্থা ছিলো এখানে শোচনীয়তম। তারা ক্রীতদাসের ক্রীতদাসী ছিলো না, তারা ছিলো পশুর অধীনে পশুতর নারী।
উনিশশতকে উৎপন্ন হয় এক নতুন জাতের ন্যায়ী, যার সাথে মিল নেই তার পূর্বপ্রজাতির। যে-প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন হয় তারা, তার নাম শিক্ষা। শিক্ষার ফলে উৎপন্ন অভিনব নারীদের বোঝানোর জন্যে দরকার পড়ে অভিনব শব্দ, তাদের জন্যে ইংরেজির অনুকরণে তৈরি করা হয় এক অভিনব শব্দ; ভদ্রমহিলা। উনিশশতকে তারা ছিলো সমগ্র বাঙালি নারীসমুদ্রে ক্ষুদ্র বিন্দুর মতো, আঙুলে গোণা যেতো তাদের, সমকালের অধিকাংশের সাথে তাদের লিঙ্গগত মিল ছাড়া আর বেশি মিল ছিলো না। আজো যেমন ভদ্রমহিলাব সমগ্র বাঙালি নারীসমাজের একটি ছোটো সুবিধাভোগী অংশ, তারাও ছিলো তেমনই। সমাজে তারা দেখা দিয়েছিলো এক নতুন প্রপঞ্চরূপে, সমাজ তাদের চেয়েছে এবং চায় নি, আজো যেমন সমাজ তাদের চায় ও চায় না। এ-ভদ্রমহিলারা হয়ে আছে বাঙালি নারীসমাজের এক বিচ্ছিন্ন অংশ, পুরুষতন্ত্রের স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন। ওই নারীরা ছিলো শিক্ষা নামের অভিনব প্রক্রিয়ার অভিনব উৎপাদন। শিক্ষায় সাথে বাঙালি নারীর কোনো সম্পর্ক ছিলো না। উনিশ শতকের আগে, যদিও ইতিহাসে মেলে হুটী বিদ্যালঙ্কার বা চন্দ্রাবতীর মতো দু-একটি নাম। হিন্দু সংহিতা লিখে তার শিক্ষা নিষিদ্ধ ক’রে দিয়েছিলো, মুসলমানও তাই করেছিলো; মুসলমানের অবস্থা ছিলো আরো নিকৃষ্ট। উনিশ শতকে কিছু নারী হঠাৎ আলো দেখতে পায়। তারা সবাই ব্ৰাহ্ম, দেশি খ্রিস্টান, ও হিন্দুসম্প্রদায়ের, সমাজের উঁচু ও উচ্চবিত্ত শ্রেণীর। ওই আলো, শিক্ষা, তাদের বদলে দিয়েছিলো; এমন নারী দেখা দিয়েছিলো বাঙলায়, যা আগে কখনো দেখা যায় নি। কিন্তু তারা ছিলো পুরুষতন্ত্রেরই পরিকল্পনা অনুসারে প্রস্তুত। তারা নিজেরা স্থির করে নি। তারা কী হবে, নিজেদের জীবন কীভাবে গড়ে তুলবে, তারা নিজেরা চায় নি নিজেদের স্বাধীনতা স্বায়ত্তশাসন; তারা উৎপাদিত হয়। পুরুষতন্ত্রের শিক্ষাকলে পুরুষতন্ত্রের জীবনপরিকল্পনা অনুসারে। তবু তারা অভিনব, কিন্তু অসম্পূর্ণ।
উনিশ শতকে, যেমন আজো, পুরুষ নারীকে শিক্ষা দিতে চেয়েছে ও দিচ্ছে নিজেরই স্বার্থে নিজেরই সুবিধার জন্যে; নারীর স্বার্থে নয়। তারা চেযেছে সমাজের সব কিছু থাকবে অক্ষুণু, অটুট থাকবে শোষণের সমস্ত ব্যবস্থা, পুরুষ থাকবে প্ৰভু নারী থাকবে তার অধীন, কিন্তু নারী কিছুটা শিক্ষা পাবে। শিখবে লেখাপড়া, পাশও করবে, কিন্তু থাকবে প্রথাগত পদানত নারী। পুরুষ চেয়েছে নারী তার ভূমিকা পালন করে যাবে মনুসংহিতানুসারে; এবং হবে সহচরী, উন্নত জাতের শয্যাসঙ্গিনী, প্রসবকারিণী, ধাত্রী; হবে শিক্ষিত পরিচারিকা। তারা চেয়েছে ভিক্টোরীয় নারীরূপে দেখা দেবে সীতাসাবিত্রী; তারা চেয়েছে শিক্ষিত সতী ও পতিব্ৰতা। উনিশ শতকি পুরুষতন্ত্র শিক্ষার ক্ষেত্রে লিঙ্গবাদ পুবোপুরি বজায় রেখে সূচনা করেছিলো স্ত্রীশিক্ষার; নািসর স্বাধীনতা স্বায়ত্তশাসন তাদের লক্ষ্য ছিলো না, বরং সাবধান থেকেছে যাতে স্বাধীনতা স্বায়ত্তশাসনের মতো। আপত্তিকর ব্যাপারগুলোতে উৎসাহী না হয়ে ওঠে নারীরা। হাজার বছর ধরে পুরুষতন্ত্রে দীক্ষিত নারীরাও দিয়েছে। পুরুষতন্ত্রের কাম্য অনুকূল সাড়া, তারাও সাধারণত জয়গান গেয়েছে প্রথাবা; বিদ্রোহ সাধারণত তাদের স্বভাবে ছিলো না। পুরুষতািন্ত্র তাদের জন্যে যত্নের সাথে শিক্ষক বেছেছে, তাদের জন্যে এমন পাঠ্যবই লিখতে চেয়েছে যাতে নারী হয়ে ওঠে নারী, যদিও ঠিক মতো লিখতে পারে নি; পুরুষতন্ত্র লক্ষ্য রাখার চেষ্টা করেছে যাতে শিক্ষা ভূমিকা বদলে দিয়ে নারীকে পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী করে না তোলে। তারা চেয়েছে শিক্ষিত নারীসম্বলিত প্রথাগত বা প্ৰাচীন ভারতবর্ষ। তারা উৎপাদন করতে চেয়েছে বাহ্যিকভাবে উন্নত জাতের নারী, যারা পুরুষের সেবা করবে উন্নতভাবে, প্রমোদ যোগাবে উন্নতভাবে, গর্ভবতী হবে ও সন্তান লালন করবে উন্নতভাবে, কিন্তু থেকে যাবে। পুরোনো নারী, রমণী, অবলা, বামা, সতী, ও পুরুষাশ্ৰিত। বাঙলায় নারীশিক্ষা প্রথম থেকেই নারীকে নষ্ট ক’রে দেয়, তার বিকাশের পথ দেয় বন্ধ করে; তাই দেড় শো বছরের নারীশিক্ষা শুধু উন্নত জাতের নারী উৎপাদন ক’রে নিঃশেষ হয়, ব্যর্থ হয় নারীকে মুক্ত বা স্বাধীন করতে।
উন্নত জাতের বাঙালি নারী, যার নাম দেয়া হয়েছে ভদ্রমহিলা, উৎপাদনের স্বপ্ন বাঙালি পুরুষ প্রথম দেখে নি, দেখে বিদেশিরা। রামমোহন উনিশশতকের তৃতীয় দশকে নারীকে বাঁচান। শ্মশানের গ্রাস থেকে, বিদ্যাসাগর দু-দশক পর বিধবাকে দেন আইনসম্মত সংসার, কিন্তু নারীকে শিক্ষা দেয়ার উদ্যোগ তাঁরা নেন নি। বাঙলায় উন্নত জাতের, ভিক্টোরীয়, নারীর স্বপ্ন দেখে প্রথম ইংরেজ ধর্মপ্রচারকেরা, প্রথম বালিকা বিদ্যালয়ও স্থাপন করে তারাই। বাঙালির প্রথম প্রয়াস ছিলো। ওই উদ্যোগ ব্যৰ্থ ক’রে দেয়া, স্বপ্ন বার বার ভেঙে দেয়া। ওই ইংরেজ ধর্ম ও শিক্ষাপ্রচারকেরাও প্ৰগতিশীল গোত্রের ছিলো না, তারা বিশ্বাস করতো না। নারীমুক্তিতে; তারা বিশ্বাস করতো কিঞ্চিৎ শিক্ষায়। নারীশিক্ষার সঙ্গে এদেশে বিদেশি ও দেশি যারা প্রথম জড়িত ছিলো, তারা ছিলো ভিক্টোরীয়; ভিক্টোরীয় যুগের সমস্ত কুসংস্কারে তারা ছিলো আচ্ছন্ন, যদিও ভিক্টোরীয় কুসংস্কারকেই তারা মনে করতো সভ্যতা। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙলায় যখন নারীশিক্ষা একটু ব্যাপকভাবে শুরু হয়, তখন নারীপুরষ সম্পর্কে ভিক্টোরীয় জনপ্রিয় ধারণা ছিলো যে নারী ও পুরুষ পৃথক ও পরিপূরক: নারীর স্থান গৃহ, পুরুষের স্থান বাইর। টেনিসনের প্রন্সেস (১৮৪৭), রাসকিনের সিসেম অ্যান্ড লিলিজ-এ (১৮৬৫) প্রস্তাবিত হয় যে- পৃথক এলাকা তত্ত্ব বা পরিপূরকতত্ত্ব, তাই গ্ৰহণ করেছিলো তারা, মিলের দি সাবজেকশন অফ উইমেন-এ (১৮৬৯) নারীর যে-অধিকার দাবি করা হয়, তা ছিলো তাদের কাছে ভীতিকর। টেনিসন, রাসকিন ও ভিক্টোরীয়রা চেয়েছিলেন নারী কিছুটা শিক্ষা পাবে, যা হবে মূলত নিরর্থক, হবে পুরুষের আকর্ষণীয় সহচরী। নারী কিছুটা অগভীর ব্যবহারিক জ্ঞান আয়ত্ত করবে, কিন্তু তার জ্ঞান কাজে খাটাতে পারবে না, সে হবে স্বামীর সুখকর সেবিকা ও বিনোদসঙ্গিনী। নারী হবে পুরুষের বাইবেলি ‘হেল্পমিট’ বা দাসী। উনিশ শতকের নারীদের জন্যে ও নারীদের সম্পাদিত পত্রিকাগুলোর নাম বেশ তাৎপৰ্যপূর্ণ: বামবোধিনী পত্রিকা (১৮৬৩), অবলাবান্ধব। (১৮৬৯), বঙ্গমহিলা (১৮৭৫), ভারতী (১৮৭৭), পরিচািরকা (১৮৭৮), পাক-প্ৰণালী (১৮৮৩), গাৰ্হস্থ্য (১৮৮৪), মহিলা-বান্ধব (১৮৮৭), দাসী (১৮৯৭), মহিলা (১৮৯৭), অন্তঃপুর (১৮৯৮)। পরিচারিকা, আর দাসীধর্মী নামেই জানিয়ে দিয়েছে নারী আসলে কী?
যে-ব্রাহ্মরা এদেশে প্রবল উৎসাহের সাথে এগিয়ে গিয়েছিলো নারীশিক্ষার দিকে, তারা ছিলো বাইবেলি সহচরীতত্ত্বের অনুরাগী, আর দেশি খ্রিস্টানবা তো ধর্মীয় কারণেই ছিলো তার অনুরাগী। বাঙালি পুরুষ সহস্ৰক ধ’রে নিরক্ষর নারীর আত্মোৎসর্গপরায়ণতা, ত্যাগ, সতীত্ব, পাতিব্ৰত্য উপভোগ করেছে, উনিশশতকে তারা উপভোগ করতে চায় শিক্ষিত সতীত্ব, মাতৃত্ব, পাতিব্ৰত্য, আত্মোৎসর্গপরায়ণতা। রাসকিন-টেনিসনি পৃথক এলাক্যতত্ত্ব ছিলো নারীর জন্যে কারুকাজকরা নতুন শেকল, নারীর জীবন ব্যর্থ ক’রে দেয়ার ভিক্টোরীয় চক্রান্ত দ্ৰ নারীর শত্রুমিত্ৰ’]। তাই উনিশ শতকের বাঙলায় নারীশিক্ষার যে-ধারা প্রবর্তিত হয়, তা উৎপাদন করেছে এক ধরনের উন্নত জাতের নারী, যাব পবিত্র কাজ পুরুষতন্ত্রের সেবা করা। তখন বাঙলায় নারী বোঝানোর জন্যে পিতৃতান্ত্রিক শব্দ ছিলো স্ত্রীলোক’, ‘মাগীও ছিলো বহুলপ্রচলিত; কিন্তু এ-নতুন জাতের নারীর জন্যে ভিক্টোরীয় আদলে তৈরি করা হয় একটি নতুন শব্দ; ভদ্রমহিলা। ‘মহিলা’ শব্দও তাদের জন্যে যথেষ্ট মনে হয় নি, কেননা শব্দটি সম্ভবত তৈরি করেছিলো ভিক্টোরীয় ভাবাদর্শদীক্ষিত পিউরিটান ব্ৰাহ্মরা, যদিও মহিলা’র অর্থই ‘ভদ্র বা সম্রােন্ত নারী’। রাসকিন বিলেতি নারীদের কপটভাবে তোষণের জন্যে প্রস্তাব করেছিলেন ‘লেডি’ শব্দটি, যার অর্থ তিনি করেছিলেন ‘ব্রেড-গিভার’, যার কাজ দীনদক্ষিণা করা বা ভিক্ষা দেয়া। ওই ‘লেডি’র বাঙলাই হয় ‘ভদ্রমহিলা’ : ব্যাকরণিক ও প্রজাতিগতভাবে এক অভিনব নারী, কিন্তু মৰ্মমূলে প্রথাগত।
বাঙলায় সুযোগসুবিধা চিরকালই প্ৰাপ্য একমুঠো মানুষের, শিক্ষার সুযোগও পেয়েছিলো একমুঠো নারী। মুসলমানেরা তখন শিক্ষা থেকে সম্পূর্ণ দূরে ছিলো; আর এ-দেশের অধিকাংশ যারা, সে-দরিদ্রদের শিক্ষা কেনো জীবনেরই অধিকার নেই, তাই তারা শিক্ষা থেকে সব সময়ই বহু দূরে। মুসলমানদের মধ্যে যারা উচ্চবিত্ত ছিলো, তারা অধিকাংশই বাঙালি ছিলো না; আর বাঙালি মুসলমান মাত্রই ছিলো দরিদ্র, এবং সমগ্র মুসলমান সমাজ ছিলো মধ্যযুগাচ্ছন্ন। শিক্ষালাভের সুযোগ ছিলো। উচ্চবিত্ত উচ্চবর্ণের হিন্দুদের, ব্ৰাহ্মদের, ও দেশি খ্রিস্টানদেব। অধিকাংশ সামন্ত হিন্দু ওই সুযোগের বিরুদ্ধে চক্রান্ত ক’রে থেকেছে৷ অন্ধকারে, ব্ৰাহ্ম ও দেশি খ্রিস্টানরা সুযোগ নিতে চেয়েছে প্ৰাণপণে। তখনও দেশ জুড়ে জমাট মধ্যযুগ, কুসংস্কারের অপ্রতিহত আধিপত্য; নারী সম্পূর্ণরূপে নিশূপ। বাঙলার পুরুষতন্ত্র নারীকে মুখ খুলতে দেয় নি আবহমান কাল ধ’রে, নারী তার কথা বলে নি কখনো, সে হয়ে উঠেছিলো অবলা ও নির্বাক। নারী জানতো লেখাপড়া শেখার অর্থ বিধবা হওয়া, নারী জানতো কালিকলমের সংস্পর্শ তার জীবনকে শোচনীয় ক’রে তুলবে; তাই নারীর বুকে শিক্ষার জন্যে আকুলতা জাগার কথা নয়; তবুও আকুলতা জেগেছে, কিন্তু নারী তা প্ৰকাশ করতে পারে নি। উনিশশতকের নারীদের আত্মজীবনীতে মাঝেমাঝে প্রকাশ পেয়েছে লেখাপড়ার জন্যে লোকোত্তর আকুলতা, রাসসুন্দর দিয়েছেন যার অবিস্মরণীয় বর্ণনা, সে-আকুলতা নিশ্চয়ই জন্ম নিয়েছে অজস্র নারীর বুকে; কিন্তু তা কখনো প্ৰকাশ পায় নি।
উনিশশতকে নারীশিক্ষার কথা প্ৰথম বলে বিদেশি পুরুষেরা, পরে দেশি পুরুষেরা: নারীরা নয়। বলার কোনো উপায় ছিলো না, বলার মতো কোনো মানুষ ছিলো না। বাঙলার দরিদ্র নারীরা চিরকাল বাইরে বেরিয়েছে, বাইরের কাজ করেছে, তারা স্বাধীনতার আগুনের মধ্যে জুলেছে; কিন্তু উচ্চবর্ণের সামন্ত পরিবারের নারীরা বন্দী থেকেছে৷ অবরোধে। ভারতবর্ষে অবরোধ নিয়ে এসেছিলো মুসলমানেরা, এবং হিন্দুরা ওই অবরোধে মুসলমানদের মতোই অবরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো। অবরোধের শিকার ছিলো উচ্চবিত্ত উচ্চবর্ণের নারীরা। ওই অবরুদ্ধ নারীদের বোঝানোর জন্যে বেশ কিছু শব্দ মেলে বাঙলায় : অন্তঃপুরিকা, পুরনারী, পুরলক্ষ্মী, পুরাঙ্গনা, পৌরস্ত্রী, পুরস্ত্রী, পুরমহিলা, পুরবালা, পুরবাসিনী, অন্তঃপুরবাসিনী, পৌরাঙ্গনা, অসূৰ্যসম্পশ্য। পাথরখণ্ডের মতো এ-শব্দগুলোই বুঝিয়ে দেয় কেমন শক্ত দেয়াল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছিলো বাঙলার উচ্চবিত্ত উচ্চবর্ণের নারীদের। একটি সামন্ত জমিদার বা ধনী গৃহস্থের বাড়ির বর্ণনা দেয়া যাক। ওই বাড়িটি বিশাল; ওই গৃহের সম্মুখভাগের বড়ো অংশ জুড়ে সদরমহল, এবং পেছনের দিকে অল্পজায়গা জুড়ে অন্তঃপুর বা অন্দরমহল বা জেনানা, যেখানে বন্দী থাকতো নারীরা। অন্দরমহলটি হতো অন্ধকার, অস্বাস্থ্যকর, যাতে ধুকে ধুকে বাঁচতো উচ্চবর্ণের নারীরা। তাদের জীবনে কোনো আলো ছিলো না, জীবন ছিলো না। বাড়ির কর্তাও দিনের বেলা অন্দরমহলে ঢুকতে পারতো না; রাতে হয়তো কখনো এসে আকস্মিকভাবে মিলিত হতো স্ত্রীর দেহের সাথে। সামন্ত প্ৰভুদের অবশ্য স্ত্রীসহবাসের বিশেষ শারীরিক প্রয়োজন পড়তো না, বাগানবাড়িতে ও পতিতাপল্লীতে তাদের প্রয়োজন মিটাতো, তবু তারা উত্তরাধিকার সৃষ্টির গভীর আগ্রহেই মিলিত হতো স্ত্রীদের শরীরের সাথে। উনিশ শতকের আগে বাঙলায় স্বামীস্ত্রীর মধ্যে কোনো মানবিক সম্পর্ক ছিলো না, উচ্চবিত্তের পুরুষ পতিতার সাথে যতোটা সময় কাটাতো স্ত্রীর সাথে তার একাংশও কাটাতো না; মানসিক সম্পর্কের কথা ছিলো অজানা, শারীরিক সম্পর্ক ছিলো খণ্ড উত্তেজনার। তাই নারীর কথা কেউ শুনতে পায় নি, নারী কারো কাছে নিজের কথা বলে নি। দরিদ্র নারীরা ভাত নিয়ে চিরকাল চিৎকার করেছে, জীবনের কথা বলার অধিকার তাদের ছিলো না। পুরুষই চিরকাল বলেছে নারীর কথা, উনিশশতকে নারীর কথা বলে, আর নারীর জন্যে জীবনপরিকল্পনা করে পুরুষই।
১৮১৭তে যেদিন হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়, সেদিনই অনিবাৰ্য হয়ে ওঠে নারীশিক্ষা। ওই কলেজ যে-অভিনব পুরুষ সৃষ্টির ভার নেয়, তার জন্যে যে অপরিহার্য হয়ে উঠবে। অভিনব ধরনের নারী, তা হয়তো সেদিন কেউ ভাবে নি, কিন্তু সেদিনই হয় নারীশিক্ষার বীজ বোনা। নারীশিক্ষা এদেশে নারীর জন্যে হয় নি, হয়েছে পুরুষের জন্যে; নারীশিক্ষার উদ্দেশ্য ছিলো নারী শিক্ষিত হবে, তার ফল ভোগ করবে। পুরুষ। ১৮১৮তে চুচুড়ায় এক ইংরেজ ধর্মপ্রচারক প্ৰতিষ্ঠা করেন। এদেশের প্রথম বালিকা বিদ্যালয় সম্ভবত ক্রাইষ্টের করুণা নারীজাতির কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যে, কিন্তু তার করুণা পাওয়ার জন্যে বিশেষ কারো আগ্রহ জাগে নি। মেরি অ্যান কুক ১৮২৩ থেকে কয়েক বছরের মধ্যে স্থাপন করেন বেশ কিছু বালিকা বিদ্যালয়, কিন্তু সেগুলো সফল হয় নি; কেননা হিন্দু কলেজের ছাত্ররা তখনো নিজেদের চাহিদা জানায় নি। তখনো সৃষ্টি হয় নি লেখাপড়াজানা মেয়ের জন্যে যুবকদের বুকে আবেগ, বা শিক্ষিত বউবাজার। কিন্তু ১৮৩০-এর দশকেই দেখা দেয় এক অভিনব ব্যাপার, স্বামীরা বাড়িতে লেখাপড়া শেখাতে শুরু করে স্ত্রীদের। স্পষ্ট হয়ে ওঠে একটি সত্য যে হিন্দু কলেজে অভিনব পুরুষ তৈরি হয়েছে, তার জন্যে দরকার অভিনব নারী। ১৮৩৮–এই সমাচাব দীপাণ-এ চিঠি বেরোয়; দিবসীয় মানসিক ও শারীরিক পরিশ্রমের পর পুরুষের যে সান্তনা ও সাহায্যের আবশ্যকতা তাহা কি তিনি ঐ অজ্ঞান স্ত্রীর নিকটে পাইতে পরিবেন?’ তিরিশের দশক থেকে ফল ফলতে শুরু করে হিন্দু কলেজের; তখন যারা ওই কলেজে পড়তে, বা পড়া শেষ করেছে তাদের পক্ষে পিতামহীকে নিয়ে জীবন কাটানো সম্ভব ছিলো না। তাই তরুণ স্বামীরা নিজেদের চাহিদা অনুসারে ঢালাই করতে শুরু করে স্ত্রীদের, নিজেরাই প্ৰস্তুত করতে শুরু করে স্বপ্নের স্ত্রী। শুরু হয় বঙ্গীয় হাওয়া উপাখ্যান; ব্রাহ্ম-হিন্দু আদমেরা পাঁজরের অস্থির বদলে পুস্তক দিয়ে সষ্টি করতে থাকে ব্রাহ্ম-হিন্দু হাওয়া। নিজের স্বার্থে নিজের উপভোগের জন্যে।
তরুণ স্বামীরা দেখা দেয় শিক্ষকরূপে, এবং তিরিশের দশক থেকে কয়েক দশক ধ’রে বাড়িতে স্বামীর কাছে লেখাপড়া শেখে অনেকেই: শেখে বেশ ভালো লেখাপড়া। কৈলাসবাসিনী দেবী, দ্রবময়ী, বামাসুন্দরী, কুমুদিনী, নিস্তারিণী দেবী, জ্ঞানদানন্দিনী ও আরো কজন গৃহশিক্ষিত নারী এখন বিখ্যাত। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রথম ভারতবষীয় আইসিএস, যেভাবে স্ত্রীকে শিক্ষিত ক’রে তোলেন, তা নিজের জন্যে উপযুক্ত স্ত্রী সৃষ্টির অনন্য উদাহরণ হয়ে আছে! সত্যেন্দ্রনাথের উদ্যম, উদ্দীপনা ও প্রগতিশীলতাকে স্বীকার না ক’রে পারা যায় না, কিন্তু ওই রীতিতে শিক্ষিত নারী সৃষ্টিই বাঙলায় নারীশিক্ষার এক মৌল দুর্বলতা। স্বামী শিক্ষিত মানুষ সৃষ্টি করে না, সৃষ্টি করে শিক্ষিত স্ত্রী; গড়ে নেয় নিজের মতো ক’রে, স্ত্রী হয় স্বামীর ব্যবহারের সুখকর সামগ্ৰী। জ্ঞান্দোনন্দিনী যদি অন্য কারো হাতে পড়তেন, তাহলে হয়তো অশিক্ষিতই থাকতেন; বা কোনো উকিলের স্ত্রী হ’লে তিনি হতেন উকিলের স্ত্রী। এতে নারীর মুক্তি ঘটে না, ব্যক্তিগতভাবেও নয়, শ্রেণীগতভাবে তো নয়ই। মুক্তি না ঘটলেও কিছুটা মুক্তি ঘটেছে অবশ্যই, তাতে ব্যক্তিগতভাবে উপকার হয়েছে অনেকের; কিন্তু বাঙালি নারীর তাতে বিশেষ উপকার হয় নি।
১৮৪৯ সালে জে ই ডি বেথুন বা বিটন কলকাতায় স্থাপন করেন ভিক্টোরিয়া গার্লস স্কুল, পরে শার নাম হয় বেথুন বালিকা বিদ্যালয়। এ-বিদ্যালয় থেকেই শুরু হয় বাঙালি নারীদের ধারাবাহিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, ইংরেজের উদ্যোগে, ও বিদ্যাসাগরের মতো দেশি উৎসাহীদের সহযোগিতায়। দেশি বুড়োদের নারীশিক্ষায় উৎসাহ থাকার কথা ছিলো না, কেননা ওই শিক্ষার ফল তারা ভোগ করতে না; তাই তারা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় নি; রক্ষণশীল রাধাকান্ত দেবের উৎসাহে গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কার লিখেছিলেন স্ত্রীশিক্ষাবিধায়ক (১৮২২); রাধাকান্ত নারী শিক্ষায় উৎসাহী ছিলেন, কিন্তুদের নিজের কন্যাদের শিক্ষায় উৎসাহী ছিলেন না; যেমন অনেক পরে রবীন্দ্রনাথও নিজের কন্যাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেন নি। বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উৎসাহ ছিলো বিদেশিদেব, তারা জীবনে মহৎ কিছু করতে চেয়েছিলো, আর ছিলো তরুণ শিক্ষিতদের, কেননা তারা স্ত্রী হিশেবে পেতে চেয়েছে শিক্ষিত নারী। তরুণদের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গতি ছিলো না, তাই বিদেশিরাই ছিলো বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতা। বিদেশিরা চেয়েছিলো ভিক্টোরীয় নারী তৈরি করতে, তরুণীরা চেয়েছিলো শিক্ষিত বা আধুনিকা স্ত্রী। ১৮৭০-এর দশকে লেখাপড়াজানা বউর প্রবল চাহিদা সৃষ্টি হয়ে যায়, তাই দিকে দিকে ব্যাঙের ছাতায় মতো বালিকা বিদ্যালয় দেখা দিতে থাকে, যেগুলোর লক্ষ্য মেয়েদের বিয়ের বাজারে আকর্ষণীয় ক’রে তোলা। ওই সব বিদ্যালয় টেকে নি। জ্ঞানাঙ্কুর ১৮৭৫ সালেই জানায় যে ‘এক্ষণকার যুবকেরা শিক্ষিত স্ত্রী চাহেন, কেনই বা না চাহিবেন? যুবকদের লেখাপড়া শিখাইলে স্ত্রীদিগকে অবশ্যই লেখাপড়া শিখাইতে হইবে…আরো কিছু দিন পরে, উচ্চ ও মধ্যবিত্ত সমাজে অশিক্ষিত স্ত্রীলোকদিগের বিবাহ হওয়া ভার হইয়া উঠিবে। [উদ্ধৃত গোলাম মুরশিদ (১৯৮৫, ৩২)। তখন পর্যন্ত একটি বাঙালি মেয়েও প্রবেশিকা পাশ করে নি, কিন্তু শিক্ষিত স্ত্রীর বাজার তৈরি হয়ে গেছে, বউ হওয়ার জন্যেই দরকার পড়ে ক খ গ ঘ এ বি সি ডি লেখাপড়া। শিক্ষিত বাউর বিবোধীরও অভাব ছিলো না। চন্দ্ৰশেখর মুখোপাধ্যায় জ্ঞানাঙ্কুর-এ ১৮৭৩-এ লিখেছিলেন, ‘বিদ্যাবতী স্ত্রীলোকের সংসৰ্গ অপেক্ষা নরকবাস বরং ভাল।’ প্রথম যে-বাঙালি মেয়েটি প্রবেশিকা বা এন্ট্রান্স আর্টস পাশ করেন, তিনি দেশি খ্রিস্টান চন্দ্ৰমুখী বসু। দেরাদুন বিদ্যালয় থেকে ১৮৭৬-এ তিনি পাশ করেন। তাঁর দু-বছর পর ১৮৭৮-এ প্রবেশিকা পরীক্ষা দেন কাদম্বিনী বসু ব্ৰাহ্মা, যিনি এক নম্বরের জন্যে প্রথম বিভাগ পান নি। ১৮৮০তে চন্দ্ৰমুখী ও কাদম্বিনী ফাষ্ট্র আর্টস পরীক্ষা দেন, দুজনেই বিএ পাশ করেন। ১৮৮৩তে। চন্দ্ৰমুখী ১৮৮৪ তে এমএ পাশ করেন, কাদম্বিনী চিকিৎসাবিদ্যায় ভর্তি হন। বিদ্যাসাগর চন্দ্ৰমুখীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে শেক্সপিয়রের রচনাবলি উপহার দেন। ১৯০০ সালের মধ্যে ২৭জন নারী বিএ পাশ করেন। শিক্ষা খুব এগোয় নি, কিন্তু তখন আলোড়ন তৈরি হয়েছে বিপুল।
বাঙলায় নারীশিক্ষার উদ্দেশ্য ছিলো আকর্ষণীয় সহচরী, সুগৃহিণী, সুমাতা উৎপাদন করা। এর কোনোটিই শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য নয়। আগের নারীরা অশিক্ষিত ছিলো, কিন্তু তারা যে সুগৃহিণী ও সুমাতা ছিলো না, তা নয়; তারা খুবই উৎকৃষ্ট ছিলো মা ও গৃহিণী হিশেবে। এ-বস্তু উৎপাদনের জন্যে মেঘনাদবধকাব্য, জ্যামিতি, বা শেক্সপিয়রের কবিতা লাগে না; কাউকে লেখাপড়া শিখিয়ে এমনভাবে গর্ভবতী করা সম্ভব নয় যে সে প্রসব করবে। কোনো রবীন্দ্রনাথ বা নিউটন। আদর্শ মাতার ধারণাও খুবই ভুল ছিলো, যেমন আছে আজো; তখন অনেকেই কামনা করেছে শিক্ষা এমন মা উৎপাদন করবে, যারা দলে দলে প্রসব করবে। নেপোলিয়ন বা জর্জ ওয়াশিংটন বা গারিবান্ডি! যে-মা নেপোলিয়ন বা হিটলার প্রসব করতে পারে, তার সম্পর্কে তো আগে থেকেই সাবধান হওয়া দরকার। আসলে নারীশিক্ষার লক্ষ্য ছিলো আকর্ষণীয় সহচরী ও শয্যাসঙ্গিনী উ ২ৎপাদন। নারীর বিকাশ ঘটানো, তাকে স্বায়ত্তশাসিত মানুষরূপে বেড়ে উঠতে দেয়া এর লক্ষ্য ছিলো না; তাকে আর্থনীতিকভাবে স্বাধীন করা এর উদ্দেশ্য তো ছিলোই না, বরং এটাই অনেকের ভয় ছিলো যে নারী একদিন স্বাধীন হয়ে পড়তে পারে। তাই নারী যাতে স্বাধীন স্বনির্ভর না হতে পারে, নারীর জন্যে প্রস্তাবিত হয় ভিন্ন ধরনের শিক্ষা; ভূতা শিক্ষা নয়, নারীশিক্ষা, যাতে বিকশিত হবে নারীর নারীত্ব ও রমণীয়তা। নারীর পাঠক্রম নিয়ে শুরু হয় বড়ো বিতর্ক।
১৮৬০-এর দশকে প্রস্তাব করা হয যে নারীদের বিশেষভাবে দিতে হবে ঘরকন্না, রান্নাবান্না, শেলাই, শিশুপালন ইত্যাদি নারীসুলভ শিক্ষা। ভারতীয় মহাপুরুষেরা কপটতায়ও মহান হয়ে থাকেন। যেমন কেশবচন্দ্ৰ সেন বিলেতে নারীদের সম্পর্কে এতো মহৎ সব কথা বলেন যে অ্যানেট অ্যাক্রয়েড তাতে মুগ্ধ হয়ে নারীশিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে কলকাতায় এসে উপস্থিত হন; এসে দেখেন কেশব সেন নারীদের প্রথাগত নারী ক’রে রাখতেই চান। তাঁর প্রকাশ্য কলহ বাধে কেশব সেনের সাথে, কেননা কেশব সেন চান ‘ভদ্রমহিলা’, অ্যাক্রয়েড চান ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারী দ্ৰ বোর্থউইক (১৯৮৪, ৫৮-৫৯)। কেশব সেন চেয়েছিলেন নারী শিখবে রমণীয় শিক্ষা:- তারা জ্যামিতি, দর্শন, অঙ্ক প্রভৃতি পুরুষালি বিষয় পড়বে না, শিখবে শেলাই, রান্না, শিশুপালন; শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর অনুরাগীরা অবশ্য দাবি করেছেন যে নারীরা পড়বে সব কিছুই। রাজনারায়ণ বসু (১৮৭৪, ৪৭) বলেছেন, ‘হয় স্ত্রীদিগের রীতিমত শিক্ষা দেও, নতুবা শিক্ষা দেওয়ায় কাজ নাই।’ দেড় দশক পরে ইন্ডিয়ান ক্রিস্টান হেরাল্ড (১৮৮২) উগ্রতার সঙ্গেই নারীদের নারী বানিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দিতে চায় : ‘ভারত চায় যে তার পুত্ররা হবে পুত্র এবং কন্যারা হবে কন্যা, পুত্র নয়’ [উদ্ধৃত বোর্থউইক (১৯৮৪, ৯৮)। ভারতকন্যা বানানোর জন্যে তাদের কী পড়াতে হবে? পড়াতে হবে গাৰ্হস্থ্য অর্থনীতি, অঙ্কন, সঙ্গীত, রান্না, শেলাই ও স্বাস্থ্যবিধি, যা আসলে কোনো শিক্ষাই নয়।
পুরুষ চেয়েছে শিক্ষিত স্ত্রী, আর নারী শিক্ষিত হতে চেয়েছে ভালো বর পাওয়ার জন্যে : বাঙলায় নারীশিক্ষার এ-মহান উদ্দেশ্য আজো পুরোপুরি বজায় রযেছে। পিতৃতন্ত্র নারীর সমস্ত পথ বন্ধ করে খোলা রেখেছে একটি পথ, সেটি বিয়ে; তাকে দিয়েছে একটি পেশা, সেটি বিয়ে। উৎকৃষ্ট পেশায় নিয়োজিত হওয়ার যোগ্যতার থেকেও এ-অঞ্চলে কঠিন একটি ভালো বিয়ে; এবং বিয়েই যেহেতু নারীর নিয়তি, তাই শিক্ষা হয়ে ওঠে নারীর নিয়তিউন্নয়নের হাতিয়ার। তবে একমাত্র শিক্ষাই ভালো বিয়ের সোনার চাবি নয়। নারীর জন্যে, শিক্ষা নারীর জন্যে শুরু থেকেই হয়ে ওঠে প্ৰসাধন : তাকে ভালো বংশের হতে হবে, তার বাপের সমৃদ্ধ অর্থকোষ থাকতে হবে, তার রূপ থাকতে হবে, তারপর থাকতে হবে শিক্ষা। শিক্ষা হচ্ছে অতিরিক্ত যোগ্যতা, এবং কখনো কখনো অযোগ্যতা। নারীশিক্ষার শুরু থেকেই বাঙলায় শিক্ষা নারীর জন্যে বিয়ের অতিরিক্ত যোগ্যতা হয়ে আছে; এবং এজন্যেই নারীশিক্ষা অনেকটা ব্যর্থ হয়ে গেছে। ওই সময়, যেমন এখনো, যারা শিক্ষাকে নিয়েছিলো বিয়ের সিড়িরূপে, যারা আসলে জ্ঞানের দিকে এগোয়ই নি, তারা প্ৰায্য সবাই সুয়োগ পেলেই বিয়ে বসে শিক্ষার আশুউদ্দেশ্যকে সফল করেছে। কিন্তু যারা শিক্ষাকে নিয়েছিলেন গুরুত্বের সাথে, বিয়ে হয়ে ওঠে তাদের জন্যে সংকট। তারা অনেকে বিয়েই করেন নি, বা করেছেন বেশ দেরিতে, এবং কেউ কেউ বিয়ে ক’রে নষ্ট করেছেন জীবন।
প্রথম এমএ চন্দ্ৰমুখী বসু একচল্লিশ বছর বয়সে বিয়ে করেন বিপত্নীক কেশবানন্দকে, তার বোন বিধুমুখী, প্রথম দুই মহিলা এমবির একজন, অবিবাহিত থাকেন আজীবন। ভার্জিনিয়া মেরি মিত্র, প্রথম দুজন মহিলা এমবির একজন, যিনি অধিকার করেছিলেন প্রথম স্থান, উনচল্লিশ বছর বয়সে বিয়ে করেন এক চিকিৎসককে। ভার্জিনিয়া নিজে ছিলেন সুচিকিৎসক, কিন্তু বিয়ের পর চিকিৎসা ছেড়ে হয়ে ওঠেন স্বামীর রোগীদের সেবিকা। কামিনী সেন (রায়) বিয়ে করেন তিরিশ বছর বয়সে। এর আগেই কবি হিশেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি, বিয়ের পর কল্যাণী স্ত্রী হওয়ার তার সাধ জাগে, কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়ে বলেন যে সংসারই তার কবিতা। তবে কবিতাও প্রতিশোধ নিতে দেরি করে নি: অনতিবিলম্বেই বিধবা হয়ে কামিনী রায় ফিরে আসেন কবিতায়। বিয়ে তাকে অপমৃত্যু দিয়েছিলো, কবিতা আজো তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তার বোন যামিনী সেন চিকিৎসক হয়েছিলেন, বিলেত থেকে ডিপ্লোমা নিয়েছিলেন, বুঝেছিলেন সংসার কাকে বলে; তাই বিয়েই করেন নি।
জগদীশচন্দ্র বসুর অনুজা হেমপ্ৰভা বসু এমএ, রাজনারায়ণ বসুর কন্যা লজ্জাবতী বসু বিএ, রাধারাণী লাহিড়ী বিএ, সুরবালা ঘোষ বিএ বিয়ে করেন নি। তারা অস্বীকার করেছিলেন পুরুষতন্ত্রকে, এবং পুরুষতন্ত্র আজো তাদের দেখে সন্দেহের চোখে। বিয়ের পায়ে অনেকেই, নারীশিক্ষার সূচনায়ই, উৎসর্গ ক’রে দেন শিক্ষাকে। সরলা দাস প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন প্রবেশিকার জন্যে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার পরীক্ষার অনুমতিও মিলেছিলো, কিন্তু এক ডাক্তারের সাথে বিয়ে হবে ব’লে তিনি পরীক্ষা দেন নি। হেমন্তকুমারীও একই কারণে প্ৰবেশিকা পরীক্ষা দেন নি। সবলা সেনের ইচ্ছে ছিলো বিএ পাশ ক’রে কোনো পেশায় ঢুকবেন, কিন্তু এক ব্যারিস্টারের বউ হওয়ার পর সংসারের পেশায় এতো সুখ পান যে আর কোনো পেশার কথা ভাবতে পারেন নি। শিশিরকুমারী বাগচী ১৮৯৮-এ বিএ পাশ ক’রে কিছু দিন শিক্ষকতা করেন, কিন্তু বিয়ের পর করেন সুখের সংসার } শিবনাথ শাস্ত্রীর মেয়ে হেমলতা ১৮৯৩-এ বিয়ের পর ছেড়ে দেন একটি ভালো চাকুরি। তাই লেখাপড়া হয়ে থাকে বিয়ের সিঁড়ি, প্রধান পেশা থাকে বিয়ে ও সংসার। বাঙালি নারী আজো বহন করছে। এ-সুখকর অভিশাপ।
কেউ বিএ পাশ করে যদি বাসায় বসে থাকে, বা হয় সুগৃহিণী বা সুমাতা, তবে তা হচ্ছে শিক্ষার অপচয়, এবং ক্ষতিকর। শিক্ষিত সুগৃহিণী, যে কোনো পেশায় জড়িত নয়, তার পক্ষে পরগাছা হয়ে ওঠা ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকে না। নারীশিক্ষা, পুরুষতন্ত্রের পরিকল্পনা অনুসারে, বাঙলায় সৃষ্টি করেছে পরগাছার জঙ্গল। প্রথম দুজন নারী স্নাতক বেরোতে না বেরোতেই নিউ ডিস্পেন্সেশন (৮ জুলাই ১৮৮৩) লেখে উদ্ধৃত বোর্থউইক (১৯৮৪, ৩১০)] :
‘স্নাতক পরীক্ষার জন্যে ছাত্রীদেব ভর্তি করার বিশ্ববিদ্যালয়েব নীতির বিরুদ্ধে যাই বলা হোক না। কেনো, সত্য আমাদের মেনে নিতেই হবে, এবং তা হচ্ছে যে এর মাঝেই আমরা কয়েকজন নারী-বিএ পেয়েছি। আমরা তাদের নিয়ে কী করবো? যদি তাদের শুধু তাদের ডিগ্রি নিয়ে থাকতে দিই, তবে তাঁরা শিক্ষক হিশেবে পচবেন এবং অহমিকায় নষ্ট হওয়া ছাড়া তাঁদের আর কোনো পথ থাকবে না। নারী স্নাতকদের শুধু ডিগ্রি দিয়ে বিদায় ক’রে দিলে তা সমাজের নৈতিকতা উন্নয়নে কতোটা কাজে আসবে, তা আমরা জানি না। জনস্বার্থে সর্বোৎকৃষ্ট নীতি হবে তাদের সদ্ব্যবহার করা।‘
কিন্তু শুরু থেকেই এর সদ্ব্যবহার হয় নি। প্রথম পর্যাযে যারা লেখাপড়া শিখেছিলেন, তারা ধনী পবিবারেরই ছিলেন; তাই তাদের জীবিকা অর্জনের সংগ্রামে নামতে হয় নি। বেশি। আর বিয়ে হয়ে গেলে তো চমৎকার। ছিলো প্ৰচণ্ড রক্ষণশীলতা, দু-এক দশক আগে পর্যন্ত নারীর কোনো পেশায় নিযুক্ত থাকাকে সমাজ ভালো চোখে দেখে নি। নারীরাও নষ্ট করেছে নিজেদের; একটা ভালো বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর তারা হারিয়ে ফেলে শিক্ষার সবটুকু, হয়ে ওঠে সচ্ছল স্বামীর অপদাৰ্থ শয্যাসঙ্গিনী। তারা অশিক্ষিত নামীর থেকেও অনেক অধম। উনিশশতকে, যেমন আজো, নারী যখন পেশা গ্ৰহণ করতে চেয়েছে, তখন সমাজ তার জন্যে রেখেছে দুটি নারীসুলভ পেশা : শিক্ষকতা, ও চিকিৎসা বা ধাত্রীবিদ্যা। আজো প্ৰধানত এ-দুটি পেশায় আটকে আছে নারী। ১৯০১-এ কলকাতায় বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন ৭২৫জন নারী দ্ৰ বোর্থউইক (১৯৮৪, ৩১°১) , তার মধ্যে অধ্যক্ষ, অধ্যাপক, শিক্ষকের পেশায় ৫৮৭ জন, প্ৰশাসন ও পরিদর্শন ৬জন, চিকিৎসায় ১২৪জন, চিত্রগ্রহণে ৪জন, লেখক, সম্পাদক, সাংবাদিক ৪জন। পেশা হিশেবে শিক্ষকতাকে প্রথম নিয়েছিলেন পাবনার বামাসুন্দরী দেবী। ১৮৬৩তে ২০ বা ২১ বছরের এ-তরুণী প্ৰতিষ্ঠা করেন একটি বালিকা বিদ্যালয়। ১৮৬০-এর দশকে ব্ৰাহ্ম মনোরমা মজুমদার বরিশালে নানা বৈরিতার মধ্যে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৮৭৮ সালে তিনি ঢাকা সরকারি বয়স্ক বালিকা বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় সহকারী শিক্ষক হিশেবে যোগ দেন। মাসে ৬০ টাকা বেতনে। যারা প্রথম চাকুরি নিয়েছিলেন তারা সাধারণত ছিলেন দেশি খ্রিস্টান ও হিন্দু বিধবা। খিস্টানদের কোনো সামাজিক বাধা ছিলো না, আর হিন্দু বিধবার ছিলো জীবিকার সমস্যা; তাই তারা পেশায় জড়িয়েছেন নিজেদের। ১৮৬৬ সালে রাধামণি দেবী মাসে ৩০ টাকা বেতনে শেরপুর বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকরূপে যোগ দেন। তিনি চশমা পরতেন, এটা ছিলো তার সম্পর্কে একটি উল্লেখযোগ্য তথ্য। রাধারানী লাহিড়ী বিএ। ১৮৮০তে মাসিক ৬০ টাকা বেতনে বেথুন বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শিক্ষক নিযুক্ত হন; ১৮৮৬তে তিনি হন মাসে ১০০ টাকা বেতনের সহকারী তত্ত্বাবধায়ক। তারা যে স্বাধীনতা ভোগ করেছিলেন বাঙালি নারী আগের হাজার বছরে তা ভোগ করে নি, কেননা তারা ছিলেন আর্থনীতিকভাবে স্বায়ত্তশাসিত।
চন্দ্ৰমুখী বসু, প্রথম নারী এমএ, ১৮৮৪ তে মাসিক ৭৫ টাকা বেতনে বেথুন বিদ্যালয়ের সহকারী তত্ত্বাবধায়ক হন; ১৮৮৬ সালে হন মাসিক ১৫০ টাকা বেতনের তত্ত্বাবধায়ক। চমৎকার বেতন! কেউ কেউ চাকুরির জন্যে নিজের এলাকা থেকে চ’লে যান সুদূরে : ১৮৯০-এ অবিবাহিত শরৎ চক্রবর্তী বিএ অমৃতসরে আলেকজান্দ্রা খ্রিস্টান বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে চলে যান; কামিনী বসু প্রধান শিক্ষিকা হয়ে চ’লে যান দেরাদুন বালিকা বিদ্যালয়ে। ১৮৯১-এ অঘোরকামিনী রায় প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্যে যান লক্ষ্মেী, ফিরে নিজেই স্থাপন করেন। বিদ্যালয়। কুমুদিনী খাস্তগীর ১৮৯৩-এ মহিশুরের মহারানী বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা নেন। সরলা দেবী ছিলেন। চাঞ্চল্যকরভাবে ব্যতিক্ৰম; তিনি ১৮৯৫-১৮৯৬ সালে চাকুরি নেন। হায়দ্রাবাদের মহারানীর সহকারীর মাসে অসাধারণ ৪৫০ টাকা বেতনে। তার চাকুরির প্রয়োজন ছিলো না, কিন্তু তিনি নরনারীর স্বায়ত্ত জীবিকা অর্জনে সমান দাবি প্রতিপন্ন করার জন্যেই চাকুরি নেন, ছেড়ে দেন অল্প পরেই দ্ৰ গোলাম মুরশিদ (১৯৮৩, ১০৪), বোর্থউইক (১৯৮৪, ৩১৭-৩২২)]। দেশি খ্রিস্টানরা লেখাপড়া শিখেছিলেন আগে, এবং লেখাপড়াকে কাজে লাগিয়েছিলেন নানা পেশায় নিযুক্ত হয়ে। ১৮৭৬-এ রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা, ইংরেজের বিধবা, মনোমোহিনী হুইলার ২০০ টাকা বেতন ও ৩০ টাকা। যাতায়াত ভাতায় নিযুক্ত হন বিদ্যালয় পরিদর্শক। এঁরাই রেখেছিলেন শিক্ষার মর্যাদা, শিক্ষিত সুগৃহিণীরা নয়।
চিকিৎসা, শিক্ষকতার মতোই, হয়ে দাঁড়িয়েছিলো অনেকটা নারীর পেশা। আর্থিক কারণে এটি শিক্ষকতার থেকে অনেক বেশি আকর্ষণীয়। অবরোধপ্রথা ছিলো নারী চিকিৎসকদের জন্যে আশীৰ্বাদ। নারীর চিকিৎসার জন্যে পুরুষ চিকিৎসক গ্রহণযোগ্য ছিলো না, তাই বেশ কজন নারী চিকিৎসক হয়েছিলেন, পেশায ভালোও করেছিলেন। তাঁদের পেশাগত বাধাবিপত্তির অভাব ছিলো না। কাদম্বিনী গাঙ্গুলি ১৮৮৬তে এলএমএস পাশ ক’রে হন বাঙলার প্রথম নারী চিকিৎসক। ১৮৮৮-তে তিনি লেডি ডাফরিন নারী হাসপাতালে ৩০০ টাকা বেতনে চিকিৎসক নিযুক্ত হন। প্রাইভেট চিকিৎসা, এবং নেপালে মহারাজার চাকুরি ক’রে তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন; এবং ১৮৯৩-এ উচ্চশিক্ষার জন্যে বিলেত যান। ফিরে আসেন এডিনবরা, ডাবলিন, গ্লাসগো থেকে নানা ডিগ্রি নিয়ে। যামিনী সেন ১৮৯৭-এ এলএমএস পাশ করেন, ১৮৯৯-এ নেপালে চাকুরি নেন। তিনিও বিদেশে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। নাৰী চিকিৎসকদের পেশা ছিলো বিপদসংস্কুল, বিশেষ ক’রে মফস্বলে তাদের মাঝেমাঝেই বিপদে পড়তে হতো। তাদের বিরুদ্ধে শহরেও কুৎসার শেষ ছিলো না। কাদম্বিনী গাঙ্গুলি যখন কলকাতায় চিকিৎসা শুরু করেন বঙ্গনিবাসী পত্রিকা সম্পাদকীয়তে তাকে অশ্লীলভাবে আক্রমণে করে। তিনিও মানহানির মামলা করেন, এবং ১৮৯১-এ সম্পাদক মহেন্দ্ৰ পালের এক বছর কারাদণ্ড হয়। অভদ্র মধ্যযুগীয় পুরুষতন্ত্রকে একটি ভালো শিক্ষা দিয়েছিলেন কাদম্বিনী। ১৯০২ সালে মালদায় ঘটে নারীচিকিৎসক হরণ ও শ্লীলতাহরণ। প্রমীলাবালা ছিলেন মালদায় নারীচিকিৎসক; সেখানকার লম্পট জমিদার মদনগোপাল তার স্ত্রীর চিকিৎসার নামে রাতের বেলা তাকে ডেকে পাঠায়। জমিদারের নীেকোয় নিয়ে তার শ্ৰীলতাহানি করা হয়। ওই সমাজ নারী ডাক্তার বেশি দিন সহ্য করে নি, কেননা তা পুরুষের অহমিকাকে ঘা দেয়; তাই দেখা যায় পুরুষেরা অল্পকালের মধ্যেই নারী ডাক্তারের বদলে চায় ধাত্রী। ডাক্তারকে ধাত্রী বানাতে না পারলে পুরুষতন্ত্রের মনে শান্তি থাকে না। কেশব সেন দাবি করেন যে তাদের নারী ডাক্তার দরকার নেই, দরকার ধাত্রী। ধাত্রী খুবই দরকার ছিলো সন্দেহ নেই; চিকিৎসার অভাবে নারী মরলে ক্ষতি ছিলো না, কিন্তু পুরুষের উত্তরাধিকারীকে প্রসব করানো ছিলো খুবই জরুরি।
বাঙালি নারীর জন্যে নারীকে লেখাপড়া শেখায় নি, শেখাতে বাধ্য হয়। পুরুষেরই জন্যে; কিন্তু নারীশিক্ষাবিরোধী প্রবণতা তার কখনোই কমে নি। তার মনের মধ্যে সব সময়ই কাজ ক’রে চলেছে। এ-বোধ যে এটা খর্ব করে পুরুষের প্রভূতু, শিক্ষায় নারী হয়ে ওঠে অসতী, শিক্ষিত নারী নষ্ট করে পরিবার। সতীত্বের চিন্তায় বড়ো উদ্বিগ্ন পুরুষযতন্ত্র, যদিও নারীর সতীত্ব নষ্ট করে পুরুষই। নারীশিক্ষার শুরুতেই ধৰ্মসভার মুখপত্ৰ সমাচারচন্দ্ৰিকা ভয় দেখায় যে বালিকাগণকে বিদ্যালয়ে পাঠাইলে ব্যভিচার সংগঠনের শঙ্কা আছে, কেননা বালিকাগণ কামাতুর পুরুষের দৃষ্টিপথে পড়িলে অসৎপুরুষেরা তাহাদিগকে বলাৎকার করিবে, অল্পবয়স্ক বলিয়া ছাড়িবে না, কারণ খাদ্য খাদক সম্পর্ক।…ধন্যবানদিগের কন্যারা পথিমধ্যে ভূত্য দ্বারা রক্ষিত হইয়া গমন করিলে তথাপি কীেমার হরণের ভয় আছে, কেননা রক্ষকেরাই স্বয়ং ভক্ষক হইবে।’ ৰূদ্ৰ শ্ৰীপান্থ (১৯৮৮, ২৩)]। এ-বৰ্ণনা যদি সত্য হয়, তাহলে বুঝতে হবে বাঙালি পুরুষ। আপাদমস্তক লম্পট। নারীশিক্ষা আজো বাঙালির বড়ো উদ্বেগ, যদি তা হয় প্রকৃত নারীশিক্ষা; ছদ্মনারীশিক্ষায় তার আপত্তি নেই। শিক্ষা যদি নারীকে স্বাধীন, স্বায়ত্তশাসিত, মুক্ত করে, তবে তা আপত্তিকর হিন্দু-মুসলমান-ব্ৰাহ্মর কাছে, কিন্তু তা যদি নারীকে উন্নত দাসী করে, তবে তা গ্রহণযোগ্য। নারীর প্রকৃত শিক্ষা এখানকার পুরুষ চায় নি, নারীও সাধারণত তা বুঝে উঠতে পারে নি। নারীশিক্ষা একই সাথে পুরুষের কাছে ছিলো বিষ ও অমৃত- আনন্দ ও উদ্বেগের ব্যাপার, যদি তা নারীকে পরিণত করে আবেদনময়ী পরিচারিকায়, তবে তা আনন্দদায়ক, যদি তা নারীকে মুক্ত করে, তবে তা উদ্বেগের কারণ।
উনিশ শতকে নারী যখন লেখাপড়া শিখতে শুরু করেছে, সমাজ তাকে দেখেছে গভীর সন্দেহের চোখে। তরুণেরা শিক্ষার পক্ষে থাকলেও মহাপুরুষদের অনেকেই ‘নবীনা’র সমালোচনায় থেকেছেন মুখর, যেমন বঙ্কিম। তখন ‘অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী’ বা আলেকজান্ডার পোপের ‘লিটল লানিং ইজ এ ডেঞ্জারাস থিং নারীশিক্ষার অপকারিতা প্রমাণের জন্যে ফিরেছে মুখেমুখে। অল্পবিদ্যা আসলেই ভয়ঙ্কর, কেননা তা আরো শেখার আগ্রহ জাগায়। বঙ্কিম প্রাচীনা ও নবীনা’ প্ৰবন্ধে প্রাচীনার গুণগানে মুখর থেকে দোষ ধরেছেন নবীনার; নবীনার বহু দোয্যের একটি হচ্ছে তারা একটু লেখাপড়া শিখেই ধর্মকে অবহেলা করতে শিখেছে। নিরপেক্ষ বিচারে বোঝা যায় তারা অল্প লেখাপড়া শিখে যতোটা বুঝেছিলো, বঙ্কিম অনেক লেখাপড়া শিখে মহাপুরুষ হওয়া সত্ত্বেও ততোটা বোঝেন নি: বোঝেন নি যে ধর্ম আসলেই গুরুত্বহীন। নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার বিস্ফোরণ ঘটতে দেরি হয় নি। ১৮৭০-এর দশকে প্রথম প্রবেশিকা পাশ মেয়েটি বেরোনোর আগেই প্রতিক্রিয়ার কলরোল শোনা যায়; এবং অচিরেই প্রহসনে প্রহসনে নারীশিক্ষার বদনাম রটাতে থাকে মঞ্চে মঞ্চে। লৈঙ্গিক রাজনীতিতে পুরুষতন্ত্রের শেষ অশ্ৰীল অস্ত্র হচ্ছে ব্যঙ্গবিদ্যুপ। পাশকরা ম্যাগ, কেয়াবাৎ মেয়ে, পরিণয়ে প্রগতি, মডেল ভগিনী, স্বাধীন জেনানা ধরনের অশ্লীল প্রহসনে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ দূষিত হয়ে ওঠে। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা। ১৮৭৮-এই লেখে, স্ত্রীশিক্ষার যে বিষময় ফল দাড়াইতেছে তাহা কেবল এই প্রণালীর দোষ।… যে সমস্ত পুস্তক পাঠ করিলে স্ত্রীজাতি উৎকৃষ্ট গৃহিণী ও মাতা হইতে পারে তাঁহাই তাহাদের বিশেষ পাঠ্য” [উদ্ধৃত গোলাম মুরশিদ (১৯৮৫, ৩৮)]। একটি মেয়েও তখনো প্রবেশিকা পাশ করে নি, কিন্তু শুরু হয়ে গেছে বিষময় ফল ফলা! পুরুষতন্ত্রের অভিযোগ তারা উৎকৃষ্ট মাতা ও গৃহিণী নয়; তারা আশা করেছিলো নারী শিক্ষিত হয়ে ঘরে ঘরে নেপোলিয়ন, জর্জ ওয়াশিংটন প্রসব করবে; পুত্রদের ক’রে তুলবে মহাপুরুষ, স্বামীদের করবে শিক্ষিত সেবা। কিন্তু দেখতে পায় স্বৰ্গে গোলমাল শুরু হয়ে গেছে, হাওয়া গন্ধম খেতে শুরু করেছে আদমের অনুমতি ছাড়াই।
১৮৮৫তে প্রতিষ্ঠিত হয় কংগ্রেস; ১৮৮৯ সালের দিকে কতিপয় নারী যোগ দেন। কংগ্রেসের বার্ষিক সম্মেলনে। দ্বারকানাথ গাঙ্গুলির উদ্যোগে ১৮৮৯ সালে বোম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দেন ছ-জন নারী, তাদের দুজন বাঙালি : একজন দ্বারকানাথের স্ত্রী কাদম্বিনী, আরেকজন জানকীনাথ ঘোষালের স্ত্রী স্বর্ণকুমারী দেবী। তারা যোগ দিয়েছিলেন স্ত্রী হিশেবে, ব্যক্তি হিশেবে নয়। নারীদের যোগ দেয়ার উদ্যোগ নেয়ায় কংগ্রেসিরা দ্বারকানাথকে উপহাসও করে। কংগ্রেসের ষষ্ঠ সম্মেলনে, কলকাতায়, যোগ দিয়েছিলেন মাত্র একটি নারী- স্বর্ণকুমারী দেবী। কিন্তু তিনি উপস্থিত থেকেও ছিলেন অস্তিত্বহীন। সম্মেলনে ধন্যবাদ প্রস্তাব ইংরেজিতে পড়েন। কাদম্বিনী গাঙ্গুলি, এবং দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সবার। অ্যানি বেসান্ট এ-ঘটনায় খুঁজে পান প্রতীকী তাৎপৰ্য; তিনি বলেন যে কাদম্বিনীর অংশগ্রহণ ‘এমন প্রতীক, যা বুঝিয়ে দেয় যে ভারতেব স্বাধীনতা উন্নীত করবে। ভারতের নারীজাতিকে’ দ্রা বোর্থউইক (১৯৮৪, ৩৪২)]। কিন্তু ১৮৯০-এর দশকে শুরু হয়ে যায় জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়াশীলতা, সমাজপতিরা বলতে থাকে যে গৃহই নারীর স্থান। এরপর কংগ্রেস নারীদের নানাভাবে ব্যবহার করেছে, তাদের দিয়ে চাঁদা সংগ্ৰহ করিয়েছে, মিছিল করিয়েছে, কারাগারে পাঠিয়েছে, দু-একটি নারীকে প্রচ্ছদ ক’রে তুলেছে, কিন্তু কংগ্রেসি রাজনীতিতে নারী হচ্ছে পুরুষের পরিচারিকা। পরে কিছু নারী ভয়াবহ উদ্যোগ নিয়েছেন, অংশ নিয়েছেন সন্ত্রাসবাদী শিহরণজাগানো ঘটনায়, জয় করেছেন জনচিত্ত, কিন্তু তারাও মুক্ত নারী ছিলেন না; তারাও ছিলেন পুরুষেরই পুতুল।
উনিশশতকে বাঙালি মুসলমান ভদ্রমহিলার উন্মেষ ঘটে নি, উন্নত জাতের নারী উৎপাদন করতে মুসলমান সম্প্রদাষকে অপেক্ষা করতে হয় বিশশতকের কয়েক দশক। রোকেয়ার বালিকা বিদ্যালয়ও বাঙালি মুসলমানের বিশেষ উপকারে আসে নি, কেননা ওটি আসলে ছিলো উর্দু বিদ্যালয়। ফজিলতুন্নেসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে এমএ পাশ করেন ১৯২৭-এ, তার পরীক্ষার ফল প্রায় জাতীয় উল্লাসে পরিণত হয়েছিলো; তবু পঞ্চাশ, এমনকি ষাটের দশকের আগে, উন্নত জাতের মুসলমান নারী উৎপাদনের কলটি ধারাবাহিকভাবে সক্রিয় থাকে নি। মুসলমান সমাজ ছিলো, এখনো আছে, হিন্দু ও ব্রাহ্ম সমাজের থেকে অনেক অনগ্রসর, নারীমুক্তির কথা এখনো তারা ভাবতে পারে না। বিয়েই ছিলো, আজো আছে, মুসলমান নারীশিক্ষার মূল উদ্দেশ্য: এবং এর ফলে মুসলমান নারীশিক্ষা প্রায় সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। এখন শুরু হয়েছে কূট প্রতিক্রিয়াশীলতা: আবার অদ্ভুত বোরখায় ঢেকে দেয়া হচ্ছে মুসলমান নারীর মুখমণ্ডল, এবং এভাবে চলতে থাকলে দু-এক দশকের মধ্যেই হয়তো মুসলমান নারী আবার বন্দী হয়ে পড়বে অবরোপে: বাস করবে। হারেমে। মুসলমান পিতৃতন্ত্র এখন দেখা দিচ্ছে উগ্র পিতৃতন্ত্ররূপে, নারী হয়ে উঠছে তার শিকার; অনতিবিলম্বেই মুসলমান নারীকে পুরোপুরি মধ্যযুগে পাঠিয়ে দেয়া হবে, এমন আভাস এখন চারপাশে। শিক্ষা এখন সংকট হয়ে উঠছে নারীর জন্যে; সমাজ শিক্ষিত নারীকে আর্থনীতিক নিশ্চয়তা দিচ্ছে না, কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীলতাবশত নষ্ট হচ্ছে শিক্ষিত নারীর প্রথাগত পেশা বা বিয়ের সুযোগ। নবমধ্যযুগীয় তরুণ তার পিতামহের মতো শিক্ষিত নারী এড়িয়ে স্ত্রী হিশেবে খুঁজছে কচি মেয়ে, যার শরীর তার চোখে বেশি আবেদনময়, এবং যার ওপর সে প্রভুত্ব করতে পারবে মধ্যযুগীয় পুরুষের মতো। উনিশ শতকে যে-ভদ্রমহিলা প্ৰজাতিটির উদ্ভব ঘটেছিলো বাঙলায়, মুসলমান পিতৃতন্ত্ৰ যেটিকে প্রতিহত করার চেষ্টা ক’রেও প্রতিরোধ করতে পারে নি, সেটি আজ বিপন্ন, শিগগিরই হয়ে উঠবে বিপন্নতর, কেননা প্ৰতিক্রিয়াশীলতার প্রথম শিকারই হয় নারী!