বকুলকে আজ তার শাশুড়ি দেখতে আসবেন।
এর মানে কি বোঝা যাচ্ছে না। জহিরের আত্মীয়-স্বজন এর আগে কয়েক দফায় তাকে দেখে গেছে। আংটি পরিয়ে দিয়েছে। বিয়ের তারিখ ঠিক করেছে। এরপর আবার মা আসছেন কেন? টিনা এসে বকুলকে খানিকটা ভয়ও পাইয়ে দিয়েছে। গম্ভীর হয়ে বলেছে, খুব ক্যাটক্যাটে মহিলা। স্কুল মাস্টারি করেছে। কিছুদিন তাই মেজাজ। এ রকম হয়েছে। কথাবার্তা সাবধানে বলবি। বেশি। কথা বলার দরকার নেই।
বকুল বলল, উনি কী বিয়েটা পছন্দ করছেন না?
না।
বুঝলে কি করে, তোমার সঙ্গে কথা হয়েছে?
না, জহির আমাকে কথায় কথায় বলল; তোর একটা ছবি দিয়েছিল। ভদ্রমহিলা ছবির দিকে না তাকিয়েই বললেন, মেয়ের নাক মোটা।
আমার নাক কি মোটা?
নাক ঠিকই আছে। বুদ্ধি মোটা।
বকুলের মন খারাপ হয়ে গেল। তার বুদ্ধি কম এটা সে নিজেও জানে। যাদের বুদ্ধি বেশি তারা পাটিগণিত ভাল জানে। সে একেবারেই জানে না। মেট্রিকে সে যদি ফেল করে পাটিগণিতের জন্যেই করবে।
ভদ্রমহিলার সন্ধ্যাবেলা আসার কথা। তিনি বিকেলে একা একা চলে এলেন। চল্লিশ-পয়তাল্লিাশ বছর বয়সী একজন মহিলা। লম্বা, ফর্সা, রোগা মাথা ভর্তি ঘন কালো চুল। পান খাবাব। কারণে ঠোট টকটকে লাল। সাদা সিন্ধের শাড়ি পরেছেন। শাড়ির ওপর নীলের ওপর সাদা কাজ করা একটা চাদর। তাকে দেখে মনেই হয় না তার এত বড় একটা ছেলে আছে। তিনি রিকশা থেকে নেমেই বললেন, খুব ফার্স ফর্সা শুনেছি, তুমি কিন্তু মা একটু কালো।
মুনা হেসে ফেলল।
আপনি ভুল মেয়েকে দেখেছেন। ফার্স মেয়ে ঘরে আছে। আমার নাম মুনা। আমি বকুলের মামাতো বোন।
ভদ্রমহিলা মোটেই অপ্রস্তুত হলেন না। আরো শক্ত করে মুনার হাত চেপে ধরলেন। মুনার মনে হল ইনি ইচ্ছে করেই ভুলটা করছেন। তিনি ভালই জানেন এই মেয়ে তার ছেলের পছন্দের মেয়ে নয়। ছবি দেখেছেন অন্যদের কাছে শুনেছেন।
মুন্না, তোমার নাম?
জি।
তোমার কথা আমি জহিরের কাছে শুনেছি।
কি শুনেছেন?
তুমি নাকি খুব শক্ত মেয়ে।
আপনার কাছে কি সে রকম মনে হচ্ছে? я
হ্যাঁ হচ্ছে। আমি নিজেও বেশ শক্ত মেয়ে। জহিরের চার বছর বয়সে তার বাবা মারা গেলেন। তারপর আমিই এদের এত দূর টেনে তুললাম। শক্ত মেয়ে না হলে কি এটা সম্ভব তুমিই বল।
বকুলকে দেখে তিনি তেমন কোন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন না। গল্প করতে লাগলেন শওকত সাহেবের সঙ্গে। ঘর-বাড়ির গল্প, জমিজমার গল্প। পঞ্চাশ বিঘা জমি আছে তার। জমির বিলিব্যবস্থা নিয়ে যে সব সমস্যা হচ্ছে তার গল্প। ঘুরে ঘুরে প্রতিটি ঘর দেখলেন।
কে কোথায় ঘুমায় আগ্রহ করে জানতে চাইলেন। শওকত সাহেবের স্ত্রীর বাধানো ছবি দেখে বললেন, বেয়ান সাহেব তো খুব সুন্দর ছিলেন। ছেলেমেয়েরা কেউ তাঁর মতো হয়নি।
মুনা এক ফাঁকে বলল, বকুলকে কি আপনার পছন্দ হয়েছে?
তিনি শীতল গলায় বললেন, আমার পছন্দ-অপছন্দের তো কোনো ব্যাপার না। জহির পছন্দ করেছে, বিয়ে হচ্ছে ওর পছন্দে।
তার মানে আপনার পছন্দ হয়নি?
না মা হয়নি। আমার দরকার ছিল তোমার মত একটা মেয়ে। শক্ত, তেজী। বকুল সে রকম না। কোনো একটা ঝামেলা হলেই এ মেয়ে ভেঙে পড়বে। আমার সংসার হচ্ছে মা ঝামেলার সংসার।
কিসের এত ঝামেলা আপনার?
আছে অনেক। বলব সবই।
বকুলের ভদ্রমহিলাকে ভাল লাগছে না। ইনি এত কথা বলছেন কেন? একজন বয়স্ক মানুষ বয়স্ক মানুষের মত থাকবেন। হড়বড় করে এত কথা বলবেন কেন? তাছাড়া উনার জমিজমার সমস্যা। সে সব পৃথিবী সুদ্ধ মানুষকে জানানোর দরকার কী? বকুল রান্নাঘরে চলে এল। মুনা খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করছে। সবই বাইরের খাবার। ঘরের বলতে পায়েস। সেটা এত মিষ্টি হয়েছে যে মুখে দেয়া যাচ্ছে না।
আপা!
বল।
ভদ্রমহিলাকে তোমার কেমন লাগছে?
ভালই।
এত সাজগোজ করেছেন কেন বল তো?
সাজগোজ কোথায় দেখলি?
আমার ভাল লাগছে না আপা। তার এই সমস্যা সেই সমস্যা। এ সব শুনতে কি কারো ভাল লাগে।
যা চা দিয়ে আয়।
আমি পারব না।
বাজে কথা বলবি না। নে ট্ৰে’টা ধর।
বকুল ট্রে নিয়ে মুখ কালো করে বের হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাবু এসে বলল, আপা, মামুন ভাই এসেছে। বসার ঘরে বসেছে। মুনা সহজ স্বরে বলল, গিয়ে বল ঘরে অনেক মেহমান অন্যদিন যেন আসে।
বাবু নিচু স্বরে বলল, এটা আমি বলতে পারব না আপা। বলতে হলে তুমি বলবে।
মামুন জড়সড় হয়ে বসে ছিল। তার হাতে এক হাঁড়ি দৈ। আসার পথে কি মনে করে সে এক হাঁড়ি দৈ কিনে ফেলেছে। এর জন্যে নিজেই সে খানিকটা বিব্রত বোধ করছে। মিষ্টি, দৈ এসব কিনে কারো বাড়ি যাওয়াটাই অস্বস্তিকর। নিজেকে কেমন জামাই জামাই মনে হয়। মুনা এসে ঢুকল। মামুন হাসতে চেষ্টা করল। হাসিটা ঠিক ফুটিল না। কোথায় যেন আটকে গেল।
তোমাদের বাড়িতে কি হচ্ছে? কেউ এসেছে নাকি?
ই। বকুলের বিয়ে হচ্ছে। ওর শ্বশুর বাড়ি থেকে এসেছে।
বকুলের বিয়ে হচ্ছে নাকি?
হুঁ।
এত তাড়াতাড়ি যে?
ডাল ছেলে পাওয়া গেছে বিয়ে দিয়ে দেয়া হচ্ছে।
এটা খারাপ না। একদিক দিয়ে ভালোই। আমি তাহলে বরং অন্যদিন আসি। কথা ছিল তোমার সঙ্গে।
কথা থাকলে এখনি বল। আবার আসার দরকার কি?
আর আসার দরকার নেই, কি বল তুমি?
একবার তো বলেছি তোমাকে।
শোন মুনা, ঠাণ্ডা মাথায় একটা কথা শোন। ঠাণ্ডা মাথায় কথা বল।
আমি যা বলছি ঠাণ্ডা মাথায় বলছি।
আচ্ছা ঠিক আছে, একটা কথা রাখ, তুমি বরং আরো মাসখানেক নিজের মতো থাক। মাসখানেক আমি তোমাকে বিরক্ত করব না।
ভাল।
গ্রামের বাড়িতে চলে যাচ্ছি। মাসখানেক ওখানে থাকব। চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি।
মুনা চুপ করে রইল। মামুন সিগারেট ধরাল একটা। নিচু গলায় বলল, বাসা যেটা নিয়েছিলাম সেটা থাকবে। ভাড়া দিয়ে যাব। তোমার রাগ ভাঙলে বিয়ে করে ঐ বাড়িতে গিয়ে উঠব। উঠি এখন?
এসেছ। যখন বসি। চা খেয়ে যাও।
আচ্ছা খেয়েই যাই। তোমাদের জন্যে দৈ এনেছিলাম। দৈটা নাও।
মুনা দৈ হাতে রান্নাঘরে চলে গেল। বাবুকে দিয়ে চা এবং পায়েস পাঠিয়ে দিল। মামুন চা খেয়ে বেশ খানেক সময় একা একা বসে রইল। একসময় বাবু ঢুকল। মামুন নড়েচড়ে বসল।
বাবু কেমন আছ?
ভাল আছি।
তোমার যে মাথাব্যথা হত। সেটা সেরে গেছে, না এখনো মাঝে মাঝে হয়?
হয় মাঝে মাঝে।
তুমি যেন কোন ক্লাসে পড়?
ক্লাস সেভেন।
বাহ ভাল তো। সাঁতার জানো তুমি?
না।
আমাদের গ্রামের বাড়িতে বিরাট পুকুর আছে। নিয়ে যাব তোমাকে। সাঁতার শিখিয়ে দেব, দুদিনে শিখিয়ে দেব।
বাবু কিছু বলল না। বকুলের শ্বশুর বাড়ির আরো কিছু লোকজন এল এ সময়। সবই মেয়ে মানুষ। এরা সরাসরি ভেতরে চলে গেলেন। বাবুও উঠে ভেতরে চলে গেল। মামুন থাকল। আরো খানিকক্ষণ। একটা টিকটিকি উঁকি দিচ্ছে।-কৌতূহলী হয়ে তাকে দেখছে। বিশাল তার সাইজ। সম্ভবত এটা তক্ষক।
বিদেয় নেবার আগে মুনাকে বলে যাওয়া দরকার কিন্তু মুনা আসছে না। হয়ত আর আসবে না। মেহমানদের নিয়ে ব্যস্ত। মামুনের মনে হল মুনার রাগ কিছুটা কমেছে। আজকের ব্যবহার তো খুব সহজ ও স্বাভাবিক। নিজ থেকেই চা খেয়ে যেতে বলল। রাগ কমে যাবে। নিশ্চয়ই কমবে। এক মাস দীর্ঘ সময়। আদর্শন কোন না কোন ভাবে মন দ্রবীভূত করায় একটা ভূমিকা নেবে।
মামুন বসেই রইল। কাউকে না বলে চলে যাওয়াটা ভাল দেখায় না। টিকটিকিটা এখনো তাকে দেখছে।