প্রবাস
প্রবাস ।। ধানশী ।।
ললিতার কথা শুনি, হাসি হাসি বিনোদিনী
কহিতে লাগিল ধনী রাই।
“আমারে ছাড়িয়া শ্যাম, মধু পুরে যাইবেন,
এ কথাত কভু শুনি নাই।।
হিয়ার মাঝারে মোর, এ ঘর মন্দিরে গো,
রতন পালঙ্ক বিছা আছে।
অনুরাগের তুলিকায়, বিছান হয়েছে তায়,
শ্যাম চাঁদ ঘুমায়ে রয়েছে।।
তোমরা যে বল শ্যাম, মধুপুরে যাইবেন,
কোন পথে বন্ধু পলাইবে।
এ বুক চিরিয়া যবে, বাহির করিয়া দিব,
তবে ত শ্যাম মধুপুরে যাবে?”
শুনিয়া রাইয়ের কথা, ললিতা চম্পকলতা,
মনে মনে ভাবিল বিস্ময়।
চণ্ডীদাসের মনে, হরষ হইল গো,
ঘুচে গেল মাথুরের ভয়।। *
——————-
প্রবাস লক্ষণ :—
“প্রিয়সী ছাড়িয়া প্রিয় দূর দেশে যায়।
তাহাকেই রীত এই প্রবাস কহয়।।”
—ভক্তমাল।
* পদসমুদ্র।
প্রবাস ।। ধানশী ।।
সখিরে মধুরা মণ্ডলে পিয়া।
আসি আসি বলি, পুন না আসিল,
কুলিশ-পাষাণ হিয়া।।
আসিবার আশে, লিখিনু দিবসে,
খোয়াইনু নখের ছন্দ।
উঠিতে বসিতে, পথ নিরখিতে,
দু’আঁখি হইল অন্ধ।।
এ ব্রজ মণ্ডলে, কেহ কি না বলে,
আসিবে কি নন্দ লাল?
মিছা পরিহার, ত্যজিয়া বিহার,
রহিব কতেক কাল?
চণ্ডীদাস কহে মিছা আসা আশে,
থাকিব কতেক দিন?
যে থাকে কপালে, করি একেকালে,
মিটাইব আখর তিন।।
——————–
প্রবাস ।। সুহই ।।
কানু অঙ্গ পরশে শীতল হ’ব কবে।
মদন দহন জ্বালা কবে সে ঘুচিবে?
বয়ানে বয়ান হরি কবে সে ধরিবে?
বয়ানে বয়ান দিলে হিয়া জুড়াইবে।।
কবে ধরি পয়োধর কবে সে চাপিবে?
দুখ দশা ঘুচি তবে সুখ উপজিবে।।
বাশুলী এমন দশা কবে সে করিবে?
চণ্ডীদাসের মনোদুঃখ তবে সে ঘুচিবে।।
——————
প্রবাস ।। সিন্ধুড়া ।।
পিয়া গেল দূর দেশ হম অভাগিনী।
শুনিতে না বাহিরায় এ পাপ পরাণি।।
পরশে সোঙরি মোর সদা মন ঝুরে।
এমন গুণের নিধি লয়ে গেল পরে।।
কাহারে কহিব সই আনি দিবে মোরে।
রতন ছাড়িয়া গেল ফেলিয়া পাথারে।।
চণ্ডীদাস কহে কেন এমতি করিবে।
কানু সে প্রাণের নিধি আপনি মিলিবে।। *
——————-
* পদসমুদ্র।
প্রবাস ।। সুহই ।।
অগৌর চন্দন চুয়া দিব কার গায়।
পিয়া বিনু হিয়া মোর ফাটিয়া যে যায়।।
তাম্বুল কর্পূর আদি দিব কার মুখে।
রজনী বঞ্চিব আমি কারে ল’য়া সুখে।।
কার অঙ্গ পরশে শীতল হবে দেহা।
কান্দিয়া গোঙাব কত না ছুটিল লেহা।।
কোন্ দেশে গেল পিয়া মোরে পরিহরি।
তুমি যদি বল সই বিষ খাইয়া মরি।।
পিয়ার চূড়ার ফুল গলায় গাঁথিয়া।
আনহ অনল সই মরিব পুড়িয়া।।
সে গুণ সোঙরি মোর পাঁজর খসি যায়।
দহনে দগধে মোর এ পাপ হিয়ায়।।
তোমরা চলিয়া যাহ আপনার ঘরে।
মরিব অনলে আমি যমুনার তীরে।।
চণ্ডীদাসে বলে কেন কহ হেন কথা।
শরীর ছাড়িলে প্রীতি রহিবেক কোথা।।*
——————-
* পদসমুদ্র।
প্রবাস ।। তুড়ি।।
অকথ্য বেদন সই কহা নাহি যায়।
যে করে কানুর নাম ধরে তার পায়।।
পায়ে ধরি কান্দে তার চিকুর গড়ি যায়।
সোণার পুতলি যেন ধূলায় লুটায়।।
পুছয়ে পিয়ার কথা ছল ছল আঁখি।
“তুমি কি দেখছ কালা কহনারে সখি।।”
চণ্ডীদাস কহে কান্দ কিসের লাগিয়া।
সে কালা রহেছে তোমার হৃদয়ে লাগিয়া।।*
——–
*পদসমুদ্র
প্রবাস ।। ধানশী ।।
কালি বলি কালা, গেল মধুপুরে,
সে কালের কত বাকি?
যৌবন সায়রে, সরিতেছে ভাঁটা,
তাহারে কেমনে রাখি?
জোয়ারের পানী, নারীর যৌবন,
গেলে না ফিরিবে আর।
জীবন থাকিলে, বঁধুরে পাইব,
যৌবন মিলন ভার।।
যৌবনের গাছে, না ফুটিতে ফুল,
ভ্রমরা উড়িয়া গেল।
এ ভরা যৌবন, বিফলে গোঙানু,
বঁধু ফিরে নাহি এল।।
যাও সহচরি, জানিয়া আসহ,
বঁধুয়া আসে না আসে।
নিঠুরের পাশ, আমি যাই চলি,
কহে দ্বিজ চণ্ডীদাসে।।
—————-
প্রবাস ।। সিন্ধুড়া ।।
সখিরে, বরষ বহিয়া গেল, বসন্ত আওল,
ফুটল মাধবী লতা।
কুহু কুহু করি, কোকিল কুহরে,
গুঞ্জরে ভ্রমরী যতা।।
আমার মাথার কেশ, সুচারু অঙ্গের বেশ,
পিয়া যদি মথুরা রহিল।
ইহ নব যৌবন, পরশ রতন ধন,
কাচের সমান ভেল।।
কোন্ সে নগরে, নাগর রহল,
নাগরী পাইয়া ভোর।
কোন গুণবতী, গুণেতে বেঁধেছে,
লুবধ ভ্রমর মোর।।
যাও সহচরি, মথুরা মণ্ডলে,
বলিও আমার কথা।
পিয়া এই দেশে, আসে বা না আসে,
জানিয়া আইস হেথা।।
বিধুমুখী বোলে, সহচরী চলে,
নিদয় নিঠুর পাশ।
সহচরী সনে, ভণয়ে ভর্ত্সয়ে,
কবি বড়ু চণ্ডীদাস।।
———————-
প্রবাস ।। কানড়া ।।
সখি, কহবি কানুর পায়।
সে সুখ সায়র, দৈবে শুকায়ল,
তিয়াষে পরাণ যায়।।
সখি ধরবি কানুর কর।
আপনা বলিয়া, বোল না তেজবি,
মাগিয়া লইবি বর।।
সখি, যতেক মনের সাধ।
শয়নে স্বপনে, করিনু ভাবনে,
বিহি সে করল বাদ।।
সখি, হাম সে অবলা তায়।
বিরহ আগুণ, হৃদয়ে দ্বিগুণ,
সহন নাহিক যায়।।
সখি, বুঝিয়া কানুর মন।
যেমন করিলে, আইসে, কইবে,
দ্বিজ চণ্ডীদাস ভণ।।
——————-
হৃদয়ে দ্বিগুণ – পাঠান্তর—“দহনে দ্বিগুণ”। – প, ক, ত।
আইসে কইবে – বিভিন্ন পাঠ—“আইসে সে জন”। – ঐ।