২২. দ্বারকানাথ আবার বিদেশে

দ্বারকানাথ আবার বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। স্বদেশে আর তাঁর মন টিকছিল না, জ্যেষ্ঠপুত্রের ব্যবহারে তিনি ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত। তাছাড়া এখানে তাঁর প্রাণের দোসর বলতে আর কেউ নেই। তাঁকে সকলে ভয় পায় বা শ্রদ্ধা করে, কেউ ভালোবাসে না। বাণিজ্যে ও জমিদারি পরিচালনায় কৃতিত্বে তিনি সকলকে ছাড়িয়ে গেছেন। উপার্জন করেছেন প্ৰভূত ধন-সম্পদ, কিন্তু এক সময় তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে ভাবলেন, কী লাভ এত পরিশ্রমে? তাঁর উত্তরাধিকারীরা যদি এ সব রক্ষা করতে না পারে বা না চায়, তাহলে তিনিই বা আর লক্ষ্মীর পিছনে ছোটাছুটি করে আয়ুক্ষয় করবেন কেন? বরং এবার দু হাতে ব্যয় করে যাবেন। ইওরোপে তাঁর অগাধ খাতির, রূপসী ললনারা তাঁকে ঘিরে থাকবে সেখানে। সেদেশের খাদ্য ও মদ্যও অতি উচ্চশ্রেণীর।

বিলাত যাত্রার সময় দ্বারকানাথ সঙ্গে প্রচুর ধনসম্পদ তো নিয়ে গেলেনই, তাছাড়া তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র দেবেন্দ্ৰকে কঠোর নির্দেশ দিয়ে গেলেন যেন তাঁকে হাতখরচ হিসাবে প্রতিমাসে একলক্ষ টাকা পাঠানো হয়। এবং এবার তিনি কতদিন থাকবেন, তার কোনো ঠিক নেই। একলক্ষ টাকা। অথাৎ যা দিয়ে পাঁচ হাজার ভরি সোনা ক্রয় করা যায়।

দ্বিতীয়বার প্রবাস যাত্রার আগে দ্বারকানাথের মনে সামান্য একটু সংশয় ছিল, এবারেও তিনি পূর্বেকার মতন সমাদর পাবেন তো? প্রথম পরিচয়ের বিস্ময় দ্বিতীয়বার অনেকটা কমে যায়। তাছাড়া, তিনি আগেরবার যখন এসেছিলেন, তখন ইওরোপের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা তাঁকেই প্রথম একজন হিন্দু বা ভারতীয় হিসেবে চাক্ষুষ দেখলেন। এক রূপকথার দেশ হিন্দুস্থান বা ভারতবর্ষ, সেখানকার মানুষকে দেখতে কেমন, এই কৌতূহলই ছিল প্রবল। এবারে ইওরোপে পৌঁছেই দ্বারকানাথ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার জন্য একেবারে বিলাসের স্রোত বইয়ে দিলেন।

দ্বারকানাথ সঙ্গে নিয়ে এসেছেন ছোটখাটো একটি দল। তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র নগেন্দ্রনাথ, তাঁর ভাগিনেয় নবীনচন্দ্র, একজন নিজস্ব ইংরেজ চিকিৎসক, একজন ইংরেজ একান্ত সচিব, কয়েকজন ভৃত্য কর্মচারী। এ ছাড়া মেডিক্যাল কলেজের দুজন ছাত্রকে তিনি উচ্চ শিক্ষালাভের সুযোগ দেবার জন্য তাদের পথ-খরচ এবং বিলাতে তাদের আহার, বাসস্থান ও শিক্ষার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, এসেছে সেই দুটি ছাত্র এবং সরকারী খরচে আরও দুটি ছাত্র। বিলেতে পৌঁছে তিনি প্রথমেই ঐ ছাত্রদের এবং তাঁর পুত্র ও ভাগিনেয়ের শিক্ষার ব্যবস্থা করে তাদের পৃথক পৃথক বাসা ভাড়া করে দিলেন। তারপর দায়িত্বমুক্ত হয়ে তিনি স্বেচ্ছামাগী হলেন।

আগের বার এসে তিনি সাহেব জাতিরা কী কী বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করেছে এবং শিল্পে-বাণিজ্যে কোন কোন অভিনব পন্থা অবলম্বন করে তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানিবার চেষ্টা করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল তাঁর স্বদেশেও সে-সব পন্থা প্রয়োগ করবেন। কিন্তু এবারে দ্বারকানাথ স্বদেশের উন্নতি কিংবা নিজ পরিবারের সম্পদ বৃদ্ধির ব্যাপারে উদাসীন। এখন তিনি নৃত্য, গীত, ভোজের আসর কিংবা থিয়েটার, অপেরা সম্পর্কে বেশী আগ্ৰহী। রানী ও রানীর স্বামীর (বিলাত এমনই দেশ, যেখানে রানীর স্বামী সব সময় রাজা হন না) জন্য তিনি স্বর্ণনির্মিত বহুমূল্য সব উপহার নিয়ে এসেছিলেন, রানী ও যুবরাজ সেগুলি পেয়ে অতিশয় উৎফুল্ল হলেন। রাজপ্রাসাদে দ্বারকানাথের ঘন ঘন ডাক পড়তে লাগলো। তাছাড়াও প্রখ্যাত সব ডিউক ও ডাচেস এবং লর্ড ও লেডিগণ পরিবৃত হয়ে তিনি থাকেন প্রায় সর্বদা। কেউ তাঁকে নিমন্ত্রণ করলে তিনিও সমান বা তার চেয়ে বেশী জাঁকজমকের সঙ্গে তাঁদের পালটা নিমন্ত্রণ করেন। মাঝে মাঝে তিনি প্রখ্যাত সব সাহিত্যিক এবং শিল্পীদের ডেকে আসর জমান নিজের গৃহে। তিনি চান, ইংলণ্ডের লোক বুকুক পরাজিত জাতির প্রতিনিধি হয়েও একজন ভারতবাসী তাদের সমকক্ষ হতে পারে সব দিক দিয়ে।

ব্রিটিশ পালামেন্টের অধিবেশন দেখে দ্বারকানাথের মনে একটি নতুন চিন্তা এলো। ব্রিটিশ প্রজাদের নিবাচিত প্রতিনিধিরাই পালামেন্টের আসন অলস্কৃত করেন। তাহলে ভারতীয়রাই বা কেন সেই নিবচিনে অংশ গ্ৰহণ করতে পারবে না? আর ভারতীয়দের মধ্যে দ্বারকানাথের চেয়ে শ্রেষ্ঠ প্ৰতিনিধি কে হতে পারে? পালামেন্টের আসন পেলে দ্বারকানাথের বিলাতে অবস্থান স্থায়ী হতে পারে।

এক নৈশভোজের নিমন্ত্রণের কথা স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য ইংলণ্ডের প্রধানমন্ত্রী একদিন নিজে এলেন দ্বারকানাথের বাসভবনে। তখন কথা প্রসঙ্গে দ্বারকানাথ পালামেন্টে ভারতীয়দের প্রতিনিধিত্বের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করলেন। অস্বস্তিতে পড়লেন প্রধানমন্ত্রী। এই মহামান্য অতিথির মনে আঘাত লাগবে এমন কোনো কথা তিনি বলতে পারেন না। প্ৰকারান্তরে তিনি জানালেন যে সেখানে কোনো অ-ব্রিটিশের নিবাচিত হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। দ্বারকানাথ চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বললেন, তিনি যে কোনো স্থান থেকেই নিবাচনে দাঁড়িয়ে জয়ী হতে পারবেন! প্ৰধানমন্ত্রীকে তখন বলতেই হলো যে, ধরা যাক যদি সেরকমই হয়, তবুও কোনো হিন্দুর পক্ষে পালামেন্টে শপথ গ্রহণ করা সম্ভব নয়। খৃষ্টান ছাড়া আর কারুর সে অধিকার নেই।

দ্বারকানাথ প্রশ্ন করলেন, হিন্দু খৃষ্টানে তফাৎ কী? হিন্দুও একমাত্র এক পরমেশ্বরের ভজনা করে, খৃষ্টানেও কি তা করে না? হিন্দু ও খৃষ্টানে তো ধর্মবিশ্বাসের কোনো সংঘর্ষ নেই, তবে তারা পাশাপাশি কেন বসতে পারবে না পার্লামেণ্টে?

প্রধানমন্ত্রী বললেন, খৃষ্টধর্মের প্রতিষ্ঠাতা যীশুকে কি আপনারা ঈশ্বরের পুত্র বলে মানেন? যারা তা মানে না, তাদের আমরা বিপথগামী বলে মনে করি।

আলোচনা অপ্ৰিয় দিকে মোড় নিচ্ছে বলে উভয়েই এক সময়ে থেমে গেলেন। কিন্তু দ্বারকানাথের মনে বিক্ষোভ রয়েই গেল। এই ঘটনার পর থেকে তাঁর মনে খৃষ্টীয় ধর্ম সম্পর্কে একটা বিরূপতার ভাব জমতে লাগলো ধীরে ধীরে। দেশে থাকতে তিনি ব্ৰাহ্মণদের ছুৎমার্গ ও কুসংস্কার দেখে দেখে বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। এবার তিনি পাদ্রীদের নাম দিলেন। কালো কোট পরা বিলাতী ব্ৰাহ্মণ। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ঘেঁটে ঘেঁটে যখনই তিনি পাদ্রীদের কোনো পদস্থলিন বা লজ্জাজনক ব্যবহারের কাহিনী দেখেন অমনি সেগুলি কেটে কেটে গদ দিয়ে সেঁটে রাখতে লাগলেন একটা খাতায়। তাঁর কোনো ইওরোপীয় বন্ধু বা অতিথি খৃষ্টধর্মের প্রশংসায় বাড়াবাড়ি শুরু করলেই তিনি সেই খাতাটি খুলে দেখান।

 

মাঝখানে কিছুদিন দ্বারকানাথ ঘুরে এলেন ফ্রান্সে। ফরাসী দেশের সম্রাট লুই ফিলিপ প্ৰায় তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধু হয়ে পড়েছেন। ভাসাঁইয়ের রাজপ্রাসাদের অন্তঃপুরেও দ্বারকানাথের গতিবিধি, সম্রাটের পত্নী ও ভগিনীর সঙ্গে এর আগে আর কোনো বহিরাগত কথাবার্তা বলার সম্মান অর্জন করেননি, একমাত্র দ্বারকানাথ ছাড়া। দ্বারকানাথের অঙ্গে দেশীয় পোশাক এবং একটি বহুমূল্য কাশ্মিরী শাল, তা দেখে মহিলারা মুগ্ধ। এ রকম বাহারী জিনিস তারা আগে কখনো দেখেনি।

ফরাসী দেশে এক সান্ধ্য সম্মিলনীর আয়োজন করে দ্বারকানাথ সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন। সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী সমেত ফরাসী দেশের শ্রেষ্ঠ অভিজাতদের নিমন্ত্রণ করলেন সেদিন। তিনি বিশেষ করে অনুরোধ করলেন সকলেই যেন তাঁদের স্ত্রী বা প্ৰেয়সীদের নিয়ে আসেন। একটি বিরাট হলঘরে বসেছে সেই সান্ধ্যভোজের আসর। সেই হলঘরের সব দেয়াল বহুমূল্য সব কাশ্মিরী শালে মোড়া। অতিথিরা, বিশেষত রমণীরা সেই কারুকার্যখচিত শালগুলি থেকে চোখ ফেরাতে পারছেন না। শাল অঙ্গে জড়ানো এখন ফরাসীদেশে একটি দারুণ ফ্যাসানন্দস্তুর ব্যাপার। কিন্তু এমন চমৎকার কাশ্মীরী শাল ফরাসিনীরাও দেখেননি। কোনো নীলনয়না সুন্দরী দেয়ালের কোনো কাশ্মিরী শালের সামনে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেই দ্বারকানাথ এসে বলছেন, মহাশয়া, এই শালটি আপনাকে উপহার দিয়া আমি ধন্য হতে পারি কি? তারপরই তিনি দেয়াল থেকে সেই শালটি খুলে নিয়ে বিস্ময়াপ্লুত সেই রমণীর শরীরে নিজের হাতে জড়িয়ে দিলেন। ক্রমে ক্রমে সব কটি শালই এইভাবে বিলি হয়ে গেল। এমন নিমন্ত্রণ উৎসব বহুকাল কেউ প্যারিসে দেখেননি।

প্যারিসে অবস্থানকালেই দ্বারকানাথের সঙ্গে পরিচয় হলো ম্যাক্সমুলারের। দ্বারকানাথের পুত্ৰ দেবেন্দ্রর চেয়েও ম্যাক্সমুলার বছর ছয়েকের ছোট। এই যুবকটি তখন জার্মানির লাইপৎসিগ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি-এইচ ডি করে ফ্রান্সে এসে অধ্যাপক বুন্টুফের কাছে সংস্কৃত অধ্যয়ন করছেন। সেই বুৰ্গফই একদিন ম্যাক্সমুলারকে নিয়ে এলেন দ্বারকানাথের কাছে। দ্বারকানাথ নিজে সংস্কৃত অবশ্য ভালো জানেন না, কিন্তু অধ্যাপক বুর্ণফ এবং ম্যাক্সমুলার সংস্কৃত শিক্ষার সূত্রে ভারতবর্ষ সম্পর্কে এমন সব কথা বলেন, যার সঙ্গে প্রকৃত ভারতবর্ষের সাদৃশ্য খুব কম—এ সব শুনে দ্বারকানাথ কৌতুক বোধ করেন। ম্যাক্সমুলার নামের যুবকটির কৌতূহলের আতিশয্য দেখে দ্বারকানাথ তাকে বললেন, যেদিন খুশী সকালবেলা সে তাঁর কাছে আসতে পারে। ম্যাক্সমুলার প্রায় নিয়মিতই আসতে লাগলেন। সংস্কৃত ভাষা ভালোভাবে না জানলেও পারিবারিক সূত্রে দ্বারকানাথ সংস্কৃত সাহিত্য ও ভারতীয় ঐতিহ্য সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত। তাঁর মুখ থেকে সেই সব কথা ম্যাক্সমুলার গোগ্রাসে গেলেন। ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে এই জামান যুবকটির আগ্ৰহ অসীম।

দ্বারকানাথ এই সময় গান-বাজনার চাচায়ও মেতে উঠেছেন। ফরাসী ও ইতালীয় অপেরাগীতি তিনি অনুকরণ করতে পারেন অনবদ্যভাবে। তাঁর কণ্ঠস্বর জোরালো। মাঝে মাঝে সেই সব গান তিনি গেয়ে উঠলে ম্যাক্সমুলার শোনেন মুগ্ধভাবে। কখনো কখনো ম্যাক্সমুলার ওঁর গানের সঙ্গে পিয়ানো বাজান। খুব একটা চচাঁ না করলেও দ্বারকানাথের কণ্ঠে বেশ সুর আছে। একদিন ম্যাক্সমুলার দ্বারকানাথকে অনুরোধ করলেন একটি ভারতবর্ষীয় মার্গ সঙ্গীত শোনাবার জন্য। ভারতীয় প্রিন্স বললেন, ও গান বিদেশীরা বুঝবে না। তবু ম্যাক্সমুলার বারবার পেড়াপীড়ি করায় তিনি একটি গান গাইলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কী, এর মর্ম বুঝিলে কিছু?

ম্যাক্সমুলার অকপটে স্বীকার করলেন যে, ঐ গানে তিনি কোনো রস পাননি, ওটি কোনো গান বলিয়া মনে হয় না। সুর তালি লয় কিছুই নেই।

অমনি চটে উঠলেন দ্বারকানাথ। রুক্ষ স্বরে বললেন, এই তোমাদের এক দোষ। তোমরা সহজে কোনো নতুন জিনিস গ্রহণ করিতে পারো না। কোনো জিনিস। যদি প্রথমবারই তোমাদের মনোরঞ্জন করিতে না পারে, অমনি তোমরা তার প্রতি বিরূপ হও। আমি যখন প্রথম ইতালীয় গীতবাদ্য শুনি,। তখন মনে হইয়াছিল উহা বিড়ালের চ্যাঁচামেচি। ধৈর্য ধারণ করিয়া আমি তাহার রস গ্রহণ করিতে শিখিয়াছি। তোমরা মনে করো আমাদের ধর্ম ধর্মই নয়, আমাদের কাব্য কাব্যই নয়, আমাদের দর্শন দর্শনই নয়, যেহেতু তোমরা তা বোঝে না।

ম্যাক্সমুলার চুপসে গেলেন একেবারে। ইদানীং দ্বারকানাথের মেজাজ প্রায়ই ভালো থাকে না। দেশ থেকে টাকা আসতে সামান্য দেরি হলে, তিনি জ্যেষ্ঠপুত্ৰকে তীব্র ভর্ৎসনা করে চিঠি লেখেন। দেবেন্দ্রকে তিনি জানিয়ে দেন, তিনি ভালোই বুঝতে পেরেছেন যে দেবেন্দ্ৰ যে পথে চলেছে, তাতে বিষয়সম্পত্তি কিছুই রক্ষা করতে পারবে না।

এদিকে সত্যিই সেইপ্ৰকার ব্যাপার চলছে। পিতা বিদেশবাসী হবার পর দেবেন্দ্ৰ বিষয়কর্ম থেকে মন একেবারেই সরিয়ে ফেলেছেন যেন। সর্বক্ষণ তিনি ধর্ম সাধনায় ও ধর্ম বিস্তারের জন্য উন্মুখ। ইতিমধ্যেই দীক্ষিত ব্ৰাহ্মর সংখ্যা পাঁচশত ছড়িয়ে গেছে, এখন শহর ছেড়ে গ্রামাঞ্চলেও এই নব ধর্ম প্রচারের আয়োজন চলছে।

একদিন সকালে দেবেন্দ্র তাঁদের বাহির বাটিতে বসে সংবাদপত্র পাঠ করছেন, এমন সময় তাঁদের হাউসের সরকার রাজেন্দ্ৰনাথ এসে তাঁর কাছে কেঁদে পড়লো। কাঁদতে কাঁদতে সে বললো, দেশে এত বড় অবিচার সংঘটিত হচ্ছে, অথচ তার প্রতিকার করার কেউ কি নেই?

কাগজ মুড়ে রেখে দেবেন্দ্র বললেন, কান্না থামাও, আগে বৃত্তান্তটি কি তা খুলে বলো!

রাজেন্দ্রনাথ যে কাহিনীটি বললো, তা এই :

গত রবিবার রাজেন্দ্রনাথের স্ত্রী এবং তার ছোট ভাই উমেশচন্দ্রের স্ত্রী এক পালকিতে চেপে কোথাও নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাচ্ছিল এমন সময় তার ছোট ভাই উমেশচন্দ্ৰ পালকি থামিয়ে জোর করে নিজের স্ত্রীকে নামিয়ে নিয়ে যায় এবং উভয়ে খৃষ্টান হবার নিমিত্ত পাদ্রী ডফ সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করে। উমেশচন্দ্রের বয়স চোদ্দ এবং তারপত্নীর বয়েস এগারো, উভয়েই নাবালক-নাবালিকা। সুতরাং স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হবার অধিকার তাদের নেই। উমেশচন্দ্রের পিতা ডফ সাহেবের কাছে গিয়ে অনুনয় বিনয় করলেন, পুত্র ও পুত্রবধূকে ফিরিয়ে দেবার জন্য। ডফ সাহেব তা শুনলেন না। তখন সুগ্ৰীমকোটে নালিশ করা হলো, সুগ্ৰীমকোর্ট অচিরাৎ রায় দিয়ে দিল যে ছেলে যখন বাপের কাছে ফিরে যেতে চায় না, তখন আদালত সেখানে জবরদস্তি করবে। কেন?

তখন রাজেন্দ্র এবং তার পিতা ডফ সাহেবের কাছে অনুরোধ করে বললো, তারা আবার আদালতে নালিশ আনবে, সেই বিচার সমাপ্ত হবার আগে পর্যন্ত যেন ডফ সাহেব উমেশচন্দ্র ও তাঁর স্ত্রীকে খৃষ্টান না করেন। ডফ সাহেব সে কথায় কৰ্ণপাত করলেন না। গতকল্য সন্ধ্যাবেলা ডফ সাহেব ওদের দুজনকে খৃষ্টধর্মে দীক্ষা দিয়ে ফেলেছেন।

ঘটনাটি শুনে দারুণ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন দেবেন্দ্র। আদালত এমত প্রকার রায় দিয়েছে? নাবালক-নাবালিকাকেও জোর করে ধর্মান্তরিত করা যাবে। এ তো স্পষ্ট পক্ষপাতিত্ব। এই কি ব্রিটিশ ন্যায়-এর উদাহরণ?

তিনি তাঁর কর্মচারী ও বয়স্য অক্ষয় দত্তকে ডেকে বললেন, আপনি এক্ষণেই এর বিরুদ্ধে কলম ধারণ করুন। অন্তঃপুরের স্ত্রীলোকেরাও এইভাবে ক্ৰমে ক্ৰমে স্বধৰ্ম ছেড়ে পরধর্ম গ্রহণ করবে? এই সাংঘাতিক ঘটনা প্ৰত্যক্ষ করেও কি আমাদের চৈতন্য হবে না!

দেবেন্দ্র নিজে গাড়ি নিয়ে শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বাড়ি বাড়ি ঘুরতে লাগলেন। তাঁদের বোঝাতে লাগলেন যে, পাস্ত্রীরা বিনা পয়সায় লেখাপড়া শেখাবার প্রলোভন দেখিয়ে ছোট ছোট বালকদের নিজেদের বিদ্যালয়ে ভর্তি করাচ্ছে এবং তারপরই প্রথম সুযোগে তাদের খৃষ্টান করে নিচ্ছে। হাজার হাজার ছেলে এইভাবে খৃষ্টান হচ্ছে। এইভাবে চললে যে এদেশের সবাই খৃষ্টান হয়ে যাবে! পাদ্রীদের সংস্পর্শ থেকে এখনি ছেলেদের সরিয়ে আনা দরকার।

সম্ভ্রান্তদের মধ্যে অনেকেই দেবেন্দ্রকে সুনজরে দেখেন না। ব্ৰাহ্মধর্ম প্রচার করে তিনি সনাতন হিন্দুধর্মকে আঘাত করার চেষ্টা করছেন বলে মনে করেন অনেকে। রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের শিরোমণি রাধাকান্ত দেব ব্ৰহ্মসভার বিরুদ্ধে একটি ধর্মসভা স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু তিনিও দেবেন্দ্রর এই ব্যাকুলতা দেখে তাঁর সঙ্গে একমত হলেন। উচ্চ ইংরেজি শিক্ষিতদের মধ্যে দু-একজন শুধু প্রশ্ন তুললেন, খৃষ্টান ধর্ম প্রসারে আপত্তি করার নৈতিক ভিত্তি কী? খৃষ্টান ধর্মও তো একটি মহান ধর্ম। ধর্মবিশ্বাসে প্রতিটি মানুষ স্বাধীন, সুতরাং কেউ যদি হিন্দুধর্মের বদলে খৃষ্টধর্ম বরণ করতে চায়, তাহলে তাকে বাধা দেওয়া হবে কেন?

দেবেন্দ্র বললেন, খৃষ্টধর্ম যে মহান তা আমি অবশ্য জানি। ধর্মবিশ্বাসে মানুষ স্বাধীন একথাও ঠিক। কিন্তু প্ৰধানত খৃষ্টান হয় কাহাদের সন্তানেরা? খৃষ্টান হয়। গ্রামের দরিদ্র মানুষ অথবা শহরের নব্য শিক্ষিত যুবকেরা। গ্রামের মানুষ খৃষ্টান হয় নানা প্রকার প্রলোভনে। আর শহরের যুবকেরা হিন্দুশাস্ত্র সম্পর্কে কিছুই জানে না। তাহাদিগকে খৃষ্টান করা সহজ কাজ বটে, কিন্তু উচিত কাজ কিনা সেটাই প্রশ্নের বিষয়। পাদ্রীরা বেদান্তধর্ম সম্পর্কে নানা রকম গালাগালি করে এবং লোকের মনে ভুল ধারণা সৃষ্টি করায়। সেইজন্যই আমি বলি, হিন্দুধর্ম ও খৃষ্টধর্মের মতামতগুলির সম্যক জ্ঞান দেশময় বিস্তারিত হোক। তারপর দুই ধর্মমত তীল করে কেউ যদি একটিকে অন্যটির চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে বেছে নেয়, তবে তো ভয়ের কোনো কারণ নেই।

দেবেন্দ্রর ব্যাকুলতা ও জোরালো যুক্তি শুনে সকলেই উপলব্ধি করলেন বিষয়টির গুরুত্ব। এইভাবে ভালো ভালো পরিবারের যুবকেরা, এমনকি নাবালক নাবালিকারাও যদি মোহে পড়ে খৃষ্টান হয়, তাহলে হিন্দুসমাজে ভাঙন রোধ করা যাবে কী প্রকারে? ঠিক হলো, পাদ্রীদের বিদ্যালয়ে যেমন ছেলেরা পড়তে পারে, সেই রকম হিন্দু হিতার্থী বিদ্যালয় নামে একটি পাঠশালা খোলা হবে, সেখানেও বালকরা বিনাবেতনে পড়বে। বালিকাদের জন্যও একটি পাঠশালার কথা অনেকের মনে গুঞ্জরিত হচ্ছে, এর আগে দু-একবার চেষ্টা করেও সুফল পাওয়া যায়নি, কিন্তু আশা ছাড়েননি অনেকে।

শিমুলিয়াতে এক প্রকাশ্য সভায় এই স্কুল খোলার প্রস্তাবে একদিনে চাঁদ উঠে গেল চল্লিশ হাজার টাকা। এমনকি অন্তঃপুরের মহিলারাও এর জন্য তাঁদের দান পাঠিয়ে দিলেন। দেবেন্দ্রর একটি বড় রকমের জয় হলো।

 

পত্রিকা পরিচালনা ও ধর্মবিস্তার নিয়ে দেবেন্দ্র বেশ কয়েক বৎসর মত্ত হয়েছিলেন। অন্য কোনো দিকে মন দেবার সময় পাননি। নিজ পরিবারের লোকজনের সঙ্গেও প্রায় যোগাযোগ শূন্য। শরীর ক্লান্ত। এইজন্য কিছুদিনের জন্য দেবেন্দ্ৰ গেলেন নদীপথে পরিভ্রমণে। শ্রাবণ মাসের ঘোর বিষয়ে তাঁর পত্নী সারদা দেবী এবং তিন শিশু পুত্ৰ দ্বিজেন্দ্ৰ, সত্যেন্দ্র ও হেমেন্দ্ৰকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। সঙ্গে আরও রইলেন রাজনারায়ণ বসু। রাজনারায়ণ সদ্য ব্ৰাহ্ম হয়েছে এবং দেবেন্দ্রর বিশেষ প্রিয়পাত্র। ইংরেজি ভাষায় সুপণ্ডিত এই রকম একজন সঙ্গীর প্রয়োজন খুব অনুভব করছিলেন দেবেন্দ্র। অক্ষয়কুমার দত্ত ও রাজনারায়ণ বসু, এই দুজন যথাক্রমে বাংলা ও ইংরেজিতে দেবেন্দ্রর মতামত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্ৰকাশ করতে পারেন।

একটি প্রকাণ্ড পিনিসে পত্নী ও পুত্রদের রেখে আর একটি ছোট বোটে দেবেন্দ্র রয়েছেন রাজনারায়ণের সঙ্গে। সারাদিনে দুইজনে নানা প্রকার বিশ্রাম্ভালাপ হয়, সন্ধ্যার পর রাজনারায়ণ সেই সব কথা ও সারাদিনের ঘটনা লিপিবদ্ধ করে রাখেন। তারপর আহারের সময় দুজন কিঞ্চিৎ সুরা পান করতে করতে সেগুলি নিয়ে আলোচনায় মেতে ওঠেন আবার।

পরপর কয়েকটি দিন কাটলো। নবদ্বীপ ও পাটুলি ছাড়িয়ে চলেছে নৌকাদ্বয়। তখন সন্ধ্যা প্রায় হয় হয়। দেবেন্দ্র রাজনারায়ণকে বললেন, এবার তোমার দিনলিপি লিখে লও বরং। রাজনারায়ণ বললো, এখনো বেলা শেষ হয়নি, এর মধ্যে আরও কত কাণ্ড-কারখানা হতে পারে কে জানে!

বলতে বলতেই প্ৰায় দেখা গেল আকাশের পশ্চিম কোণ থেকে একখণ্ড জমাট কালো মেঘ ডানা মেলে হু হু করে এগিয়ে আসছে। এখনি ঝড় উঠতে পারে ভেবে দেবেন্দ্র বললেন, ঝড়ের সময় ছোট বোটে থাকা ভালো নয়, চলো আমরা পিনিসে যাই। মাঝিরা বোটটিকে পিনিসের গায়ে লাগাবার চেষ্টা করতে লাগলো, এমন সময় এক ভয়ঙ্কর দমকা হাওয়া উঠে পিনিসের মাস্তুলের এক অংশ ভেঙে তার পাল ও দড়িদড়া সমেত জড়িয়ে বোটের ছাদের ওপর পড়লো। বাকি পালে তীরের মতন ছুটলো পিনিস এবং বোটটাকেও সঙ্গে টেনে নিয়ে দ্রুত চললো। অতবড় পিনিস অথাৎ বজরার টানে কাৎ হয়ে গেল ছোট বোটটি, এখুনি দড়িদড়া ছাড়াতে না পারলে ভয়ঙ্কর বিপদ। দড়িদড়া কেটে ফেলবার জন্য দা খোঁজা হতে লাগলো, কিন্তু ঐ হুড়োহুড়ির মধ্যে দা পাওয়া যায় না। একজন মাঝি লাগি দিয়ে গুণ ছাড়াতে যেতেই সে লাগি পড়লো দেবেন্দ্রর নাকের ওপর, দরদর ধারায় রক্ত বেরুতে লাগলো।

এই সময় বার্তাস একটু থেমেই আবার প্রবলতর হলো। ভয়ার্ত মাঝিরা চিৎকার করে উঠলো, ওরে, আবার তাই রে, আবার তাই রে! বোট একদিকে সম্পূর্ণ কাৎ হয়ে গেছে, আর দু-এক মুহূর্তের মধ্যেই ড়ুবে যাবে। দেবেন্দ্ৰ স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। সামনে নিশ্চিত মৃত্যুকে দেখছেন।

কোনোক্রমে একটা দা খুঁজে পেয়ে মাঝিরা কচকচ করে কাটতে লাগলো দড়ি। শেষ দড়িটি কাটা হবার সঙ্গে সঙ্গে বোটটি পিনিসকে ছেড়ে তীরবেগে গিয়ে পাড়ের বালিয়াড়ির ওপর আছড়ে পড়লো। দেবেন্দ্র ও রাজনারায়ণ লাফিয়ে পড়লেন নীচে এবং একটুর জন্য বেঁচে গেলেন।

ইতিমধ্যে ঝড়ে ও অন্ধকারে কোনোদিকে কিছু দেখা যায় না। দেবেন্দ্রর স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে পিনিস কোনদিকে ছুটে গেল বোঝার উপায় নেই। এরই মধ্যে ছোট একটি ডিঙি নৌকে এসে ভিড়লো সেখানে। নিশ্চিত বোম্বেটের নৌকো ভেবে সবাই ভয়ার্তভাবে চেঁচিয়ে উঠলো, কে ও? কে ও?

সেই নৌকো থেকে এক ব্যক্তি সত্বর লাফিয়ে পড়ে ছুটে এলো দেবেন্দ্রর দিকে। তার কণ্ঠস্বর শুনেই দেবেন্দ্ৰ চিনতে পারলেন। সে ব্যক্তি তাঁদের বাড়ির স্বরূপ খানসামা। সে একটি জরুরী বার্তাবহ পত্র নিয়ে এসেছে।

অন্ধকারে পড়বার উপায় নেই। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই বিদ্যুতের ঝিকিমিকি আলোয় দেবেন্দ্ৰ কোনোক্রমে খানিকটা পাঠোদ্ধার করলেন।

চিঠিতে আছে, ইংলণ্ড হইতে দুঃখের সংবাদ। দ্বারকানাথ আর নাই!

দেবেন্দ্ৰ মাটিতে পড়ে যাচ্ছিলেন, রাজনারায়ণ তাঁকে জড়িয়ে ধরলো। অল্পকালের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিলেন দেবেন্দ্র। পিতৃশোকের চেয়েও তিনি অন্য বিষয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন বেশী। অবিলম্বে কলকাতায় না। ফিরলে বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে দারুণ গোলযোগ উপস্থিত হবে। তিনি অতি সম্প্রতি জেনেছেন যে, গত কয়েক বৎসরে দ্বারকানাথ বাজারে এক কোটি টাকা দেনা করেছেন, এবার পাওনাদারগণ তাঁদের পরিবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।

 

পরদিনই সেই ঝড়-জলের মধ্যেই বিপদের ঝুঁকি নিয়ে দেবেন্দ্র রওনা হলেন কলকাতার দিকে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কোনোক্রমে পলতায় পৌঁছে, সেখানে ডাঙায় নেমে পেয়ে গেলেন অশ্বশকিট। সেই দুযোগের মধ্যেই গাড়ি হাঁকিয়ে রাত দুপুরে পৌঁছোলেন কলকাতায়। সেদিনের সেই ঝড় যেন তাঁদের পারিবারিক বিপর্যয়ের রূপক।

পাওনাদারেরা ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতন শ্রাদ্ধের দিন পর্যন্ত আশেপাশে ঘুরতে লাগলো। দেবেন্দ্ৰ সকলকে জানিয়ে দিয়েছেন যে অশৌচদশায় তিনি টাকা পয়সা সংক্রান্ত কোনো আলোচনাই করবেন।

কিন্তু এর আগেই দারুণ মতান্তর দেখা গেল শ্ৰাদ্ধপ্রণালী নিয়ে। দেবেন্দ্রর ছোটকাকা রমানাথ ঠাকুর বললেন, দেখো, ব্ৰহ্ম ব্ৰহ্ম করে এ সময় কোনো গোলমাল তুলো না। দাদার বড় নাম।

দেবেন্দ্ৰ বললেন, তা কি করে হয়! আমার ধর্মব্ৰতের বিরুদ্ধে তো কোনো কাজ আমি করতে পারি না। আমি শ্ৰাদ্ধ করবো উপনিষদের মতে। শালগ্রাম শিলা আমি মানি না। পাথরের নুড়িকে আমি নারায়ণ বলে পূজা করতে পারবো না।

রাজা রাধাকান্ত দেব বললেন, সে হবে না, সে হবে না। তুমি অমন করলে শ্ৰাদ্ধ বিধিপূর্বক হবে না। তোমার পিতার পারলৌকিক কার্য অসম্পূর্ণ থাকবে।

দেবেন্দ্র তখন তাঁর মেজ ভাই গিরীন্দ্রকে জিজ্ঞেস করলেন তাঁর মত। গিরীন্দ্ৰ দাদার অনুবতী। দাদার সঙ্গে তিনিও ব্ৰাহ্মধর্ম গ্ৰহণ করেছেন। কিন্তু এখন তিনিও বললেন, আমরা যদি এমন করি, তাহলে সকলে আমাদিগকে ত্যাগ করবে, সকলে বিপক্ষে যাবে।

দেবেন্দ্র বিস্মিত, বিমূঢ় বোধ করলেন। সকলেই তাঁর মতের বিরোধী। এ দেশে ধর্ম আর সামাজিক প্রথা যেন পৃথক ব্যাপার। যারা ব্ৰহ্মধর্মে দীক্ষা নিয়েছে, তারাও সামাজিক প্রথা অমান্য করতে ভয় পায়।

দেবেন্দ্র তখন নির্জনে বসে প্রশ্ন করতে লাগলেন নিজের বিবেককে। বারবার একই উত্তর পেলেন। লোকভয়, সামাজিক শিষ্টাচারের চেয়েও নিজের ধর্মবিশ্বাস অনেক বড়। এর মধ্যে তিনি একদিন স্বপ্নে দেখলেন তাঁর পরলোকগত জননীকে। তিনি যেন জীবন্ত হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, তোকে বড় দেখবার ইচ্ছা হয়েছিল। তুই নাকি ব্ৰহ্মজ্ঞানী হয়েছিস? এর দ্বারা আমাদের কুল পবিত্র হয়েছে, তোর জননী কৃতাৰ্থ হয়েছে। সারা শরীরে আনন্দ প্রবাহ নিয়ে জেগে উঠলেন দেবেন্দ্ৰ।

 

শ্রাদ্ধের দিন বাড়ির পশ্চিম প্রাঙ্গণে মস্ত এক চালা তৈরি হয়েছে। দানসাগরের সোনা রূপার ষোড়শোপচারে ভরে গেছে সেই চালা। মাঝখানে পুরোহিত, আত্মীয়-পরিজন সকলে শালগ্রাম শিলা স্থাপন করে বসে আছেন দেবেন্দ্রর অপেক্ষায়।

দীর্ঘকায় গৌরবর্ণ দেবেন্দ্ৰ পট্টবস্ত্ৰ পরিধান করে গম্ভীরভাবে প্ৰবেশ করলেন সেখানে। উপনিষদের একটি শ্লোক উচ্চারণ করে সমগ্ৰ দানসামগ্ৰী উৎসর্গ করে তিনি আবার পেছন ফিরলেন। আত্মীয়বন্ধুরা তাঁকে ডাকতে লাগলো যজ্ঞের আসনে এসে বসবার জন্য। দ্বারকানাথের তিনি জ্যেষ্ঠপুত্র, তাঁকে বাদ দিয়ে যজ্ঞ শুরু হতে পারে না। কিন্তু তিনি ভ্রূক্ষেপ করলেন না, সোজা উঠে গেলেন তিনতলায়।

একটু পরে তিনি শুনতে পেলেন তাঁর ভাই গিরীন্দ্রনাথ তাঁর হয়ে শ্রাদ্ধের মন্ত্র পাঠ করে চলেছেন।

দেবেন্দ্ৰ মনে মনে বললেন, জ্ঞাতি বন্ধুরা আমায় ত্যাগ করে করুক, কিন্তু ঈশ্বর আমাকে আরও গ্ৰহণ করলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *