1 of 2

২২. দিন সাতেক বাদে সুস্থ হল অর্ক

 বাইশ

দিন সাতেক বাদে সুস্থ হল অর্ক। এই সাতদিনের প্রথম দুদিন ঠিক চেতনায় ছিল না। তারপরে এত দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে মাধবীলতার ঘর থেকে বের হওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়াল। এই সময়ে ছেলেকে একটু একটু করে অন্যরকম হয়ে যেতে দেখল সে। কথা যতটা সম্ভব কম বলে, আনমনে চেয়ে থাকে, বোঝা যায় কিছু ভাবছে এবং জিজ্ঞাসা করলে শুধু ম্লান হাসে। এর মধ্যে দুদিন বিলু এসেছিল ওকে ডাকতে। উঠে বাইরে যাওয়ার সামর্থ্য ছিল না। মাধবীলতাকে বলেছিল, ‘বলে দাও আমি ঘুমুচ্ছি, শরীর খারাপ।’

দ্বিতীয়দিন মাধবীলতা ঈষৎ চমকেছিল। বিলুকে আজ এড়িয়ে যাচ্ছে অর্ক সেটা বুঝে ধন্দে পড়েছিল। এড়িয়ে যাওয়ার কোন কারণ নেই। এখন সে বেশ স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারে, ঘরের ভেতর হাঁটাচলা ছাড়া কল-পায়খানায় যাচ্ছে। তাহলে? বিলুকে বিদায় করে মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কি ব্যাপার?’

অর্ক প্রশ্নটা যেন ধরতে পারেনি এমন ভঙ্গীতে তাকাল।

‘বন্ধুর সঙ্গে দেখা করছিস না কেন?’ বন্ধু শব্দটা ইচ্ছে করেই বেঁকিয়ে বলল সে।

‘ভাল লাগছে না।’ অর্ক চোখ বন্ধ করল।

‘তুই কি ভাবিস বল তো দিন রাত?’

‘কিছু না।’ অর্ক এড়িয়ে গেল।

এই ব্যাপারটা অস্বস্তিতে ফেলল মাধবীলতাকে। যে ছেলে দিনরাত বাইরে পড়ে থাকতো সে সুস্থ হয়েও ঘর ছেড়ে বের হচ্ছে না। দু’দুবার অসুস্থতার জন্যে স্কুল কামাই হয়ে গেছে, আগেও ঠিক মত যেত না হয়তো, এভাবে চলতে দেওয়া উচিত নয়। যদিও সুস্থ হবার পর অর্ক বইপত্তর নিয়েই পড়ে থাকে কিন্তু এটা ওর স্বাভাবিক জীবন নয়। এর মধ্যে বস্তিতে যে ঘটনাটা ঘটল তা নিয়েও ওকে একটুও চিন্তা করতে দেখল না মাধবীলতা। অনুপমাকে পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া যাচ্ছে না মানে নিরুদ্দেশ নয়, সে ইচ্ছে করেই চলে গেছে। কালীঘাটে বিয়ে সেরে সেই হকার ছেলেটির সঙ্গে উধাও হয়ে গিয়েছে। শুনে অর্ক হেসে বলল, ‘বেঁচে গেল।’

চমকে উঠেছিল মাধবীলতা। চোখাচোখি হয়েছিল অনিমেষের সঙ্গে। এত বড় সত্যি কথাটা ছেলের মুখ দিয়ে কি সহজে বেরিয়ে এল! শেষ পর্যন্ত তাকে মাধবীলতাই ঠেলেঠুলে বাইরে পাঠাল। স্কুলে যেতে হবে, ভদ্র বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে হবে এবং স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে হবে। ছেলের জন্যে ওর নিজেরও স্কুলে যাওয়া হয়নি অনেকদিন। এভাবে ছুটি পাওয়া আর সম্ভব নয়। অর্ক অবশ্য এখন বাধ্য হয়ে বেরুচ্ছে কিন্তু তার দিনরাতের সেই আড্ডাটা উধাও হয়ে গিয়েছে।

খুরকি এবং কিলার মৃত্যুর পর তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেন হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। অশ্লীল কথাবার্তা চিৎকার করে ক’দিন কেউ বলছে না। পেটো পড়েনি এই ক’দিন। শুধু রাত বিরেতে কয়েকটা বুড়ো মাতাল এখনও চেঁচায়। বিলু ছাড়া অনেককেই পুলিস তুলে নিয়ে গিয়েছিল। বেধড়ক পিটিয়ে জানতে চেয়েছিল খুরকি-কিলার সঙ্গে কি সম্পর্ক ছিল এদের। সতীশের কাছে ছুটে গিয়েছিল ওদের আত্মীয়রা। সতীশ কিন্তু সরাসরি না বলে দিয়েছে, ‘অসম্ভব। সমাজ বিরোধীদের আমি কখনই সমর্থন করব না। পার্টি এইসব ছেলেদের জন্যে ও সি-কে বলা পছন্দ করবে না। তাছাড়া দুটো সমাজবিরোধী মরেছে, দেশ বেঁচেছে। আপনাদের ছেলেরা দিনরাত লাল চোখে মাস্তানি করবে, ওদের ছাড়িয়ে আনলে সাধারণ মানুষ আমাদের বিরুদ্ধে যাবে।

সতীশ যে এরকম কথা বলবে তিন নম্বরের বাসিন্দারা ভাবতে পারেনি। চিরকাল যে পার্টি ক্ষমতায় থাকে তারাই থানা থেকে ছাড়িয়ে আনে। জানি ভোট দেওয়া, মাঝে মাঝে পোস্টার মারা থেকে অনেক কাজ এরা পাটির জন্যে চিরকালই করে আসে। আজ সতীশ এক কথায় বলে দিল সাহায্য করবে না! যাঁদের ছেলে তাঁদের লাগল কিন্তু তিন নম্বরের বেশীর ভাগ মানুষ খুশি হল। অবিনাশ একদিন সতীশকে একা পেয়ে বলেই ফেলল, ‘আচ্ছা সতীশ, ওদের আজীবন থানায় আটকে রাখা যায় না? কিংবা ধরো, হাত পা ভেঙ্গে ছেড়ে দিল—।’

সতীশ মাথা নেড়েছিল, ‘পাগল হয়েছেন! কোন আইনে ওসব করবে। তার চেয়ে আপনারা সবাই নাগরিক কমিটিতে আসুন। আমরা সবাই একজোট হলে ওরা চুপ করে যেতে বাধ্য হবে।’

অবিনাশ ঢোক গিলে বলেছিল, ‘নাগরিক কমিটি মানে তো তোমাদের পার্টি—!’

‘না কক্ষনো না।’ সতীশ প্রতিবাদ করেছিল, ‘এই এলাকার সমস্ত সুস্থ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে নিয়ে আগাদের নাগরিক কমিটি।’

অবিনাশ মাথা চুলকেছিল, ‘তোমাকে যে কথাটা বললাম তা যেন কাউকে বলে ফেল না!’ সতীশদের নাগরিক কমিটি যখন সমাজবিরোধীদের উৎখাতের জন্যে আলোচনা শুরু করেছে তখন নুকু ঘোষকে ঘন ঘন নিমুর চায়ের দোকানে আসতে দেখা গেল। সি পি এম ক্ষমতায় আসার পর নুকু ঘোষের আর পাত্তা পাওয়া যেত না খুব একটা। এবার এই ঘটনার পর জমিয়ে আড্ডা মারতে দেখা গেল তাকে। থানা থেকে ছাড়া পাওয়া ছেলেরা এখন নুকু ঘোষের সঙ্গে। আড্ডা মারে। কোয়াকে নুকু, ঘোষের ডান হাত বলছে সবাই। তারপরেই একটা কাণ্ড হয়ে গেল। নুকু ঘোষের নেতৃত্বে একটা মাঝারি মিছিল ঈশ্বরপুকুর লেনে শ্লোগান দিতে দিতে চারপাক খেল। মিছিলের প্রথমেই থানা ফেরত, ছেলেগুলো। তারপর যারা, তাদের চেনে না ঈশ্বরপুকুরের বাসিন্দারা। প্রত্যেকের চোয়াড়ে চেহারা, কারো কারো মুখে অতীতের কাটা দাগ। কোয়া চিৎকার করছিল, ‘পুলিসের কালো হাত ভেঙ্গে দাও, গুড়িয়ে দাও। প্রকৃত সমাজবিরোধী দূর হঠো হঠো। সমাজবিরোধী কারা—দেশের শত্রু যারা।’

আবহাওয়াটা আবার গরম হয়ে গেল। এবং দেখা গেল নাগরিক কমিটির সেই সক্রিয় ভাবটা কেমন যেন আচমকা থিতিয়ে এসেছে। সতীশকে কয়েকদিন একটু মনমরা হয়ে যাওয়া আসা করতে দেখা গেল। কানাঘুষায় শোনা গেল সতীশ নাকি এইভাবে থেমে যাওয়াটা সমর্থন করেনি। এই কারণে বেশ ঝামেলায় পড়েছে। সে নাকি সরাসরি বলেছিল, ‘এলাকার সমাজবিরোধীদের না সরাতে পারলে আমরা জনসমর্থন পাব না। আপনারা একটা জিনিস ভেবে দেখছেন না, আমরা এত বছর ক্ষমতায় আছি কিন্তু এখনও সাধারণ নাগরিকদের বিশ্বাস অর্জন করতে পারিনি। ভদ্রপল্লীতে প্রকাশ্যে চোলাই মদ বিক্রি হচ্ছে, সমাজবিরোধীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা খাচ্ছে এবং পুলিস জেনে শুনে চুপ করে রয়েছে। আমরা যদি এলাকার মানুষকে এর বিরুদ্ধে একত্রিত না করতে পারি তাহলে পার্টির পেছনে জনসমর্থন থাকবে কেন? পার্টির একজন নেতা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এলাকার মানুষ তাঁদের সমস্যা নিয়ে জোট বেঁধে এগিয়ে আসুন, আমরা তাঁদের সমর্থন করব। কোন ব্যক্তিবিশেষের অসুবিধে দেখার মত সময় পার্টির নেই।’

সতীশদা বোঝাতে চেয়েছিলেন, ‘চোলাই-এর দোকান যে বাড়ির সামনে হয়েছে অসুবিধে তাদেরই বেশী কিন্তু এটা সামাজিক অপরাধ। আমরা মার্কসিজমে বিশ্বাস করি কিন্তু জনসাধারণের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলি, এটা ঠিক নয়। সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করার দায়িত্ব আমাদের, কোন কালেই তারা নিজেরা সংগঠিত হয় না।

সতীশদার এই ভাষ্য নাকি ওপর তলার নেতাদের পছন্দ হয়নি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটা সামগ্রিক প্রতিবাদ কর কিন্তু সরাসরি খুঁচিও না—এই নীতি নাকি সতীশদাও পছন্দ করেন নি। অন্তরঙ্গদের বলেই ফেলেছিলেন, ‘এর চেয়ে পার্টি যদি বিরোধী দল হয়ে থাকতো তাহলে আমরা বেশী কাজ করতে পারতাম। শোনা যাচ্ছে, সতীশদার বিরুদ্ধে একটা ব্যবস্থা নেবার কথা উঠেছিল। কিন্তু এই এলাকায় সতীশদার কাজকর্ম এবং জনসংযোগের কথা ভেবে সেটা থেমে গেছে। এসব খবর চাপা থাকেনি। নুকু ঘোষের দল বুঝে গেছে যে সতীশকে একটু-আধটু আওয়াজ দিলে পার্টি খুব একটা প্রতিরোধ করবে না। একদিন রাত্রে কোয়া মাল খেয়ে সতীশদাকে ঝেড়ে খিস্তি করে গেল তিন নম্বরের সামনে দাঁড়িয়ে। খুরকি-কিলা মারা যাওয়ার পর সেই প্রথম প্রকাশ্যে খিস্তি করা হল। দল বেঁধে বেরিয়ে এসে মানুষ সেগুলো বেশ জম্পেশ করে শুনল। মাঝে মাঝে কেউ অবশ্য বলছিল, এই কোয়া বাড়ি যা। কিন্তু সেটা যেন কোয়ার উৎসাহ আরো বাড়িয়ে দেওয়ার জন্যে বলা। সেই সময় পুলিসের একটা জিপ ওখান দিয়ে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। কোয়ার তখন এমন অবস্থা যে পুলিসকেও চিনতে পারছে না। মজা-দেখার ভিড় হাওয়া হয়ে গেলেও কোয়া থামছিল না। ওকে সিপাইরা তুলে নিয়ে গেল থানায়। কিন্তু পরদিনই হাসতে হাসতে ফিরে এল পাড়ায়। পাড়ার লোক বুঝে গেল ব্যাপারটা। এখন কিছুদিন কোয়াই এখানকার রাজত্ব চালাবে।

স্কুল থেকে ফিরছিল অর্ক। মোড়ের মাথায় সতীশদার সঙ্গে দেখা। সতীশ ওকে দেখে যেন অবাক হল, ‘কি খবর তোমার, আজকাল পাড়ায় দেখতে পাই না।’

অর্ক এড়িয়ে যাবে ভেবেছিল, না পেরে বলল, ‘অসুখ করেছিল।’

‘হ্যাঁ, খুব খারাপ হয়ে গেছে চেহারা। বাড়ি থেকে বের হও না বুঝি?’

‘হ্যাঁ। আমি যাচ্ছি।’

‘না। দাঁড়াও। তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। সতীশদা চারপাশে তাকিয়ে বলল, ‘আচ্ছা চল, পার্টি অফিসে বসে কথা বলি।’

‘পার্টি অফিসে?’ অর্ক একটু অবাক এবং অস্বস্তি মেশানো গলায় বলল।

‘হ্যাঁ। তোমার আপত্তি আছে? কেউ নেই ওখানে এখন।’

অতএব সতীশদার সঙ্গে অর্ককে পার্টি অফিসে ঢুকতে হল। মিষ্টির দোকানের কারিগর ছাড়া এসময় কোন লোক ছিল না সেখানে। তাকে বিদায় করে সতীশদা ঢালাও সতরঞ্জির ওপর বাবু হয়ে বসে বলল, ‘তুমি এসব সমর্থন কর?’

‘কি সব?’

‘এই দিনরাত খিস্তি খেউড়, রকে বসে তাস খেলা আর মাল খাওয়া?’

‘না।’

‘কোয়া তোমার বন্ধু ছিল। তুমি জান কোয়া এখন নিজেকে পাড়ার মাস্তান ভাবছে?’

‘আমি এখন পাড়ার কোন খবর রাখি না।’

‘কেন?’

‘আমার এসব ভাল লাগে না।’

‘কিন্তু সামাজিক মানুষ হিসেবে তুমি দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পার না। সমাজ যেমন তোমাকে কিছু দেবে তেমনি তোমার কাছ থেকেও কিছু আশা করবে। আমি চাই তুমি এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করবে।’

‘কি করতে বলছেন আমাকে?’

‘বস্তির মানুষকে বোঝাবে যে এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করা দরকার। বলবে একজন অন্যায় করবে এবং দশজন তা মেনে নেবে না।’

হঠাৎ অর্কর মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘দূর, এসব কেউ শুনবে না।’

‘শুনবে না কেন?’

‘জ্ঞান দিলে মানুষ তা শুনতে চায় না। ভাবে বড় বড় কথা বলছে। যতক্ষণ তাদের খাওয়া পরায় হাত না পড়ছে ততক্ষণ এসবে পাবলিকের কিছু যায় আসবে না। তাছাড়া আপনাদের দেখলেই সবাই ভাবে ভোট চাইতে এসেছেন। এই যে আমাদের পাড়ার একটা মেয়ে হাওয়া হয়ে গেল, কেন গেল ভেবে দেখেছেন? আর একটা মেয়ে রোজ শরীর বিক্রি করতে যায়, কেন যায় তা আপনারা জানেন না? কি করেছেন তার?’

উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে গিয়ে অর্কর দুর্বলতা বেড়ে গেল। কপালে ঘাম জমছিল ওর। সতীশদা কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, ‘এই জন্যেই তো তোমার মত ছেলেকে আমাদের চাই। পার্টির ভেতরে থেকে পার্টির সমালোচনা করা দরকার। আমি চাই তুমি নিয়মিত পার্টি অফিসে আসবে।’

অর্ক মাথা নাড়ল, ‘আমার এসব ভাল লাগে না।’

‘কেন? তুমি গরীব পরিবারের ছেলে। দেশের আশীভাগ মানুষ ভাল করে খেতে পায় না, কেন তুমি তাদের পাশে দাঁড়াবে না?

অর্ক সতীশদার দিকে তাকাল, ‘তার জন্যে তো আপনারা আছেন।’

‘নিশ্চয়ই। কিন্তু আমরা কে? তোমরা আমাদের পাশে এসে না দাঁড়ালে আমরা কিছু করতে পারব? তুমি ভেবে দ্যাখো; এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে না।’

পার্টি অফিস থেকে বেরিয়ে আসা মাত্র বিলুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বিলুর চোখ কপালে উঠল, ‘আই বাপ গুরু, তুমি লালু হয়ে গেলে!’

‘লালু? হতভম্ব হয়ে গেল অর্ক।

‘তাই বলি! বেশ কিছুদিন তোমার পাত্তা নেই। বাড়িতে গেলে বলে অসুস্থ আর এদিকে তলায় তলায় জব্বর লাইন করে নিয়েছ। সাবাস।’ বিলু এগিয়ে এসে অর্কর কাঁধে হাত রাখল।

কেউ কাঁধে হাত দিলে বেশ অস্বস্তি হয় অর্কর। হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘কি আজেবাজে কথা বলছিস?’

‘আজেবাজে? চেপে গিয়ে কি হবে বল। আমরা হলাম জিগরি দোস্ত। ধান্দাটা কি? তুমি শালা সি পি এম হয়ে গেলে?’ বিলু অবিশ্বাসী হাসল।

‘কেন, সি পি এম হলে অন্যায়টা কি?’ অর্কর মনে হঠাৎ এক ধরনের প্রতিরোধ করার ইচ্ছে জন্মাল।

‘কি আর হবে। কোয়া ফক্কা হয়ে যাবে। তুমি তিন নম্বরের শের বনে যাবে। একটু লাইন টাইন জোরদার করতে পারলে বড় চিড়িয়া মারতে পার!’

‘আমি যদি সি পি এম হই তাহলে তিন নম্বরে খিস্তি করা চলবে না আর মাল খাওয়া বন্ধ করতে হবে। বুঝলি!’ অর্ক বিলুর দিকে তাকাল।

হাঁ হয়ে গেল বিলু, ‘যা ব্বাবা। তাহলে তুমি ফুটে যাবে গুরু। ও দুটোকে বাদ দিয়ে তিন নম্বরদুটো দিন থাকতে পারবে না। ওই যে দাড়িওয়ালা সাহেবটা, মোড়ের মাথায় ছবি আছে দেওয়ালে আঁকা, কি যেন নাম—?’

‘মার্কস।’

‘হ্যাঁ, ওই সাহেব এলেও পারত না। এসব করতে যেও না গুরু। সি পি এম হয়েছ, সরের ওপর ওপর হেঁটে বেড়াবে, দুধের মধ্যে ডুববে না।’

অর্ক হেসে বলল, ‘তুই তো দারুণ কথা বলতে পারিস।’ আর তখনই ওর নজরে পড়ল তিন নম্বরের সামনে দাঁড়িয়ে একজন বেঁটে মতন লোক এদিক ওদিকে তাকাচ্ছে। তারপরেই চিনতে পেরে সে বিলুকে বলল, ‘আমি যাচ্ছি পরে দেখা হবে।’

বিলু কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু অর্ক দাঁড়াল না। হন হন করে কাছে পৌঁছে একটু হেসে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি?’

পরমহংস ঘুরে দাঁড়িয়ে ওকে দেখে যেন মাটি পেল, ‘আরে এই যে, কেমন আছ?’ অর্ক গোলগাল মানুষটির দিকে স্মিত চোখে তাকাল। ওর হাবভাব, চেহারা এবং গায়ের রঙের মধ্যে বেশ বাঙালি বাঙালি ভাব আছে।

‘ভাল। আপনি কি আমাদের বাড়িতে এসেছেন?’

‘হ্যাঁ, আর কোন চুলোয় আসব? তোমার বাবা কেমন আছে?’

‘ভাল। আসুন।’ অর্ক পরমহংসকে নিয়ে গলির ভেতরে ঢুকল। মোক্ষবুড়ি সেই একই রকম ভঙ্গীতে পাথরের মত বসে আছে। কিলা মারা যাওয়ার পর থেকে জোর করে ঘরে নিয়ে না গেলে বুড়ি ওখান থেকে ওঠে না, কথাও বলে না। এক হাতে ধুতির কোঁচা তুলে সাবধানে পা ফেলে পরমহংস বলল, ‘বস্তিটা খুব ডেঞ্জারাস, না?’

‘মানে?’ অর্ক অবাক হয়ে ফিরে তাকাল।

‘সব ধরনের মানুষ থাকে এখানে মনে হচ্ছে।’

‘হ্যাঁ। এদিকে বাঙালি বেশী, ওপাশে বিহারীরা।’

‘এরকম একটা জায়গা খুঁজে পেলে কি করে?’

‘আমি তো ছোটবেলা থেকেই এখানে আছি।’

ওরা অনুদের বাড়ির পাশ ঘুরে আসতেই মাধবীলতার মুখোমুখি হয়ে পড়ল। মাধবীলতা তখন টিউশনি করতে বের হচ্ছিল। পরমহংসকে দেখে সমস্ত মুখ উদ্ভাসিত হল, ‘কি সৌভাগ্য আপনি, মনে ছিল তাহলে?’

খুব অপ্রস্তুত হয়েছে এমন ভান করে পরমহংস বলল, ‘এটা কি ঠিক হল? দশ নম্বর ব্যাটসম্যানকে বাম্পার দেওয়া নিষেধ, আইনে নেই।’ বুঝতে পারল না মাধবীলতা, ‘তার মানে?’

পরমহংস হেসে পাশ কাটালো কথাটার, ‘কর্তা কোথায়?’

‘ঘরে। আসুন আসুন।’ মাধবীলতা আবার দরজার দিকে ফিরে গেল।

‘আপনি কোথাও বের হচ্ছিলেন বলে মনে হচ্ছে? পরমহংস জিজ্ঞাসা করল। মাধবীলতা মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ, পড়াতে।’ তারপর দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, এই কে এসেছে দ্যাখো। ভেতর থেকে অনিমেষ চেঁচিয়ে বলল, ‘আয়।’

পরমহংস দরজায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করল। ওর মুখে একটা ছায়া নেমে আসছিল কিন্তু খুব দ্রুত সেটাকে সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘না দেখে ডাকলি?’

‘দেখার দরকার নেই। জীবনের মাঠে না নেমে খেলার সব পরিভাষা একমাত্র তোর মুখেই শুনে আসছি। অতএব ভুল হবার কথা নয়।’ অনিমেষ বাবু হয়ে বসে বইটাকে সরিয়ে রাখল এক পাশে।

‘আমি হলাম নন প্লেয়িং ক্যাপ্টেন।’ তারপর মাধবীলতার দিকে একটা ঢাউস প্যাকেট কাঁধের ব্যাগ থেকে বের করে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘সোজা অফিস থেকে আসছি, এগুলো বিতরণ করলে খিদেটা মেটে।’

মাধবীলতা রাগ করতে গিয়েও পারল না, ‘কেন আমরা বুঝি খাওয়াতে পারতাম না তাই হাতে করে প্যাকেট আনতে হল। গরীব, তবে এতটা বোধহয় নয়।’ পরমহংস অনিমেষের দিকে ঘুরে বলল, ‘ভাই, তোর বউ-এর মুখে খুব ধার তো! আমি কোথায় নতুন বউ-এর মুখ দেখব বলে প্যাকেটটা আনলাম, আরে বাবা খালি হাতে তো আসতে পারি না।’

মাধবীলতা প্রতিবাদ করতে গিয়ে হেসে ফেলল, ‘আপনি না, যাচ্ছেতাই।’

‘যা ইচ্ছে আমি তাই। গুড।’ প্যাকেটটা ধরিয়ে দিয়ে পরমহংস সোজা অনিমেষের পাশে খাটের ওপর গিয়ে বসল।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘কি খবর বল?’

‘আমার আবার খবর কি, খাচ্ছি দাচ্চি ঘুরে বেড়াচ্ছি। তোরা কেমন আছিস?’

‘আর বলবেন না।’ মাধবীলতা প্যাকেটটা খুলছিল, ‘এই যে শ্রীমান, আমাদের নাম ভুলিয়ে ছেড়েছিল। সাতদিন ধরে নড়তে পারি নি, এত অসুখ।’

‘কি হয়েছিল?’

‘ওইটেই ধরা যায় নি। সুস্থ শরীরে শুয়ে বলল, বমি পাচ্ছে। বমি করার চেষ্টা করেও হল না তেমন। ব্যাস, তারপর খুব জ্বর, বেহুঁশ হবার মত অবস্থা আর সারাক্ষণ ভুল বকে যাওয়া, বমি পচ্ছে বমি পাচ্ছে।’ মাধবীলতা প্যাকেটটা খুলে গালে হাত দিয়ে বলল, ‘হায়, এত কি এনেছেন?’

সেকথায় কান না দিয়ে পরমহংস তখন দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ানো অর্ককে বলল, ‘এমন কিছু দেখেছ যাতে বমি পায় মানুষের?’

অর্ক হেসে ফেলল। পরমহংসের বলার ধরনটাই ওকে হাসাল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে হল লোকটা খুব বুদ্ধিমান। অর্ক জবাব দিল না।

খাবার শেষ করে পরমহংস বলল, ‘আপনাকে তো বেরোতে হবে?’

‘একটু দেরি করে গেলে কোন অসুবিধে হবে না।’ মাধবীলতা চায়ের জল বসিয়ে জবাব দিল। অর্ক বইপত্র রেখে খাবার হাতে নিয়ে খাটের একপাশে বসেছিল। তার দিকে তাকিয়ে পরমহংস বলল, ‘নাও, এবার তৈরি হও’।

‘তৈরি? কিসের জন্যে?’ অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

‘বাসা বদল করতে হবে। তোমাদের জন্যে একটা ভাল আস্তানা পেয়েছি।’

পরমহংসের কথা শেষ হওয়ামাত্র মাধবীলতা উল্লসিত গলায় বলল, ‘সত্যি?’

‘ইয়েস ম্যাডাম। আমি ভাবতে পারছি না আপনারা কি করে এইরকম নরকে রয়েছেন। দুজন শিক্ষিত মানুষ কেন চিরকাল বস্তিতে পড়ে থাকবে?’ এই প্রথম পরমহংসকে সত্যি সত্যি উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। উত্তেজনাটা আন্তরিক।

অনিমেষ জবাব দিল, ‘তুই জানিস না সব ঘটনা তাই একথা বলছিস। আমার চিকিৎসার জন্যে ও শেষ হয়ে গিয়েছিল।’

‘তোর চিকিৎসা তো জেল থেকে বেরিয়ে আসার পরে শুরু হয়েছে। তার আগে? আপনি এই বস্তির খবর পেলেন কি করে তাই আমার মাথায় ঢুকছে না।’

মাধবীলতা নিচু গলায় বলল, ‘সে অনেক কথা। আমি আগে একটা বাড়িতে ওয়ানরুম ফ্ল্যাট নিয়ে ছিলাম। বলতে পারেন এখানে আসতে বাধ্য হয়েছি। এসে দেখলাম আর যাই হোক এখানে মানুষ অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলায় না। এটা আমার খুব জরুরী ছিল।’

পরমহংস বলল, ‘এসব আমার মাথায় ঢোকে না। যা হোক, এখানে আর আপনাদের থাকা চলবে না। আমি সব ব্যবস্থা করে এসেছি।’

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করেল, ‘কি ব্যবস্থা?’

‘শোভাবাজারে একটা বাড়ি পেয়েছি। দেড়খানা ঘর, রান্নাঘর তবে বাথরুমটা শেয়ার করতে হবে আর এক ভাড়াটের সঙ্গে। তারাও স্বামী স্ত্রী এবং কোন বাচ্চা নেই। আমার বাড়ি থেকে বেশী দূরেও নয়।’ পরমহংস জানাল।

‘সত্যি?’ মাধবীলতার মুখে খুশি ছড়িয়ে পড়ল।

‘যাচ্চলে। এটাকে কি আপনি ওয়াইড বল ভাবছেন নাকি?’

‘মানে?’ মাধবীলতা বুঝতে পারল না।

অনিমেষ হেসে বলল, ‘ওটা ক্রিকেটের পরিভাষা।’

মাধবীলতা চায়ের জল নামিয়ে বলল, ‘সত্যি আপনি পারেন। কিন্তু কত ভাড়া দিতে হবে তা বললেন না তো?’

‘একশ পঁচাত্তর।’

অনিমেষ এবং মাধবীলতা মুখ চাওয়াচায়ি করল। মাধবীলতার দম যেন বন্ধ এমন গলায় বলল, ‘আর?’

‘আর তিন মাসের অ্যাডভান্স, নো সেলামি। বাড়িওয়ালা আমার বিশেষ পরিচিত। এখন বল তোমরা কবে দেখতে যাবে। যা করবে এই সপ্তাহের মধ্যে করবে। অবশ্য করাকরির কিছু নেই, তোমাদের যেতেই হবে।’ পরমহংস দৃঢ় গলায় বলল।

অনিমেষ বলল, ‘সাতদিনের মধ্যে? আর একটু সময় পাওয়া যাবে না?’

‘কেন? সময়ের দরকার কি? পরমহংস খিঁচিয়ে উঠল, ‘বাড়ি আমি দেখেছি, অপছন্দ হবার কোন কারণ নেই। অন্য ভাড়াটে কোন ঝামেলা করবে না। সাতশ টাকা দিয়ে পজিশন নিয়ে নাও।

‘সাতশো?’ অনিমেষ মাধবীলতার দিকে তাকাল।

চায়ের কাপ পরমহংসের হাতে তুলে দিতে দিতে মাধবীলতা বলল, ‘ঠিক আছে। ওতে কোন অসুবিধে হবে না। আমি আর খোকা কাল বিকেলেই দেখতে যাব।’

পরমহংস চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, ‘আজ যেতে পারবেন?’

‘আজ? আমি তো টিউশনিতে যাব ভেবেছিলাম। না, কালই যাব।’

অনেক কামাই হয়ে গেছে ওর অসুখের জন্যে। ওঃ, সত্যি আপনি আমাদের খুব উপকার করলেন। এখন কলকাতার বুকের ওপর এই ভাড়ায় বাড়ি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।’ মাধবীলতা নিশ্চিন্ত গলায় বলল।

‘আপনি ভাগ্যবতী।’ পরমহংসের মুখ নির্বিকার।

মাধবীলতা হেসে ফেলল, ‘যা বলেছেন।’

এই বস্তি ছেড়ে চলে যেতে হবে। অর্ক বুঝতে পারছিল না সে খুশি হবে কিনা। মাধবীলতা পরমহংসকে বসতে বলে পড়াতে চলে গেছে। অনিমেষ আর পরমহংস গল্প করছিল। অর্ক মুখ হাত পা ধোওয়ার জন্যে কলতলায় আসতেই থমকে দাঁড়াল। বলল, ‘কি চাই?’

‘তৃষ্ণাদি তোমাকে ডেকেছে।’

‘কেন? আমার সঙ্গে কি দরকার?’

‘আমি জানি না।’

‘আমি যাব না। আমার সময় নেই।’

‘ঠিক আছে, বলে দেব।’ মেয়েটা চলে যাচ্ছিল অর্ক পিছু ডাকল, ‘শোন। একটু দাঁড়া।’

প্রায় দৌড়ে ঘরে ফিরে এল অর্ক। পরমহংস এবং অনিমেষ ওর দিকে একবার তাকিয়ে আবার কথা বলতে লাগল। নিজের বই-এর তাক থেকে সেই কলমটা বের করে সে বাইরে চলে এল। তারপর ঝুমকির হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘এটা ওকে ফিরিয়ে দিবি।’

‘কি এটা?’

‘ছুরি। আমি ওটা না বলে এনেছিলাম। এখন আর দরকার নেই।’ কথাটা শেষ করে অর্ক মুখে জলের ছিটে দিল আঁজলা করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *