দিন কী খুব দ্রুত কাটে?
কারোর কারো হয়ত কাটে। কিন্তু ওসমান সাহেবের ধারণা তার দিন চলছে শামুকের মত।
এবং কখনো একেবারে চলছেই না, থেমে আছে।
কিন্তু আজ বীথির কথা শুনে তিনি চমকে উঠলেন। দ্বিতীয় বারের মত বললেন, বাবা মারা গেছেন এক বছর হয়েছে? বলেন কী?
বীথি হালকা স্বরে বলল, সময় খুব দ্রুত যায়। বলেই সে হাসল। সেই হাসি সে ধরে রাখল অনেকক্ষণ। কেউ কেউ দীর্ঘ সময় হাসি ধরে রাখে। কেউ কেউ ধরে রাখে বিষাদ। দু’টিই কঠিন কাজ। বীথি বলল, আপনি আসবেন আজ সন্ধ্যায়?
কী হবে সন্ধ্যায়?
তেমন কিছু না। একটা মিলাদ পড়বার ব্যবস্থা করেছি। অল্প কিছু লোকজনকে আসতে বলেছি।
আমি যাব। আপনার সমিতি কেমন চলছে?
ভালই, আপনি তো কোনোদিন দেখতে এলেন না।
আজই তো যাচ্ছি। আজ দেখব। সমিতির মেয়েরা সব ওখানেই থাকে তো?
সবাই থাকে না। কেউ কেউ থাকে। আমার মত যাদের কোথাও যাবার জায়গা নেই তারা থাকে।
বীথি আবার হাসল। ওসমান সাহেবের মনে হল এই মেয়েটিকে তিনি মোটেই জানেন না। কখনো ভাল ভাবে লক্ষ্য করেননি, কখনো ভাবেননি। এক ধরনের মানুষ থাকে যাদের দেখে মনে হয় এদের ভেতর তেমন কোনো রহস্য নেই। এদের লক্ষ্য করার কিছু নেই। বীথিকে কখনো সে দলে ফেলা যাবে না। একজন রূপবতী তরুণীকে কখনো সে দলে ফেলা যায় না। তবু তিনি বীথির প্রতি অনাগ্রহ বোধ করেছেন কেন? বাবার কারণে কী? বাবা যে জিনিসটা পছন্দ করবেন তাকে সেটি অপছন্দ করতে হবে এমন কিছু কী তাঁর মানসিকতায় ঢুকে গেছে?
বীথি বলল, কী ভাবছেন?
কিছু ভাবছি না।
বীথি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আপনার কাছে আমার একটি ক্ষমা প্রার্থনার ব্যাপার আছে। অনেকবার ভেবেছি ক্ষমা চাইতে আসব। কখনো ঠিক সাহস হয়নি।
ওসমান সাহেব বিস্মিত চোখে তাকালেন। বীথি বলল, স্যার আমাকে বাড়িটা লিখে দিয়েছিলেন কিন্তু আমার ধারণা ছিল এটা আমি কখনো পাব না। আপনার আপত্তি তুলবেন। কোর্টে গেলে আপনাদের আপত্তি টিকে যাবে। কিন্তু আপনি উল্টোটা করলেন। বাড়িটি পেতে যাতে কোনো অসুবিধা না হয় সেটা দেখলেন।
উল্টোটা করলাম বলেই কী আপনি ক্ষমা চাইতে এসেছেন?
না, সে জন্যে না। স্যার আমাকে বেশ কিছু নগদ টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। এটা আপনাদের কাছে গোপন করেছিলাম। ক্ষমা চাচ্ছি সে কারণেই।
বীথি সত্যি সত্যি নমস্কারের ভঙ্গিতে হাত জোড় করল। ওসমান সাহেব সিগারেট ধরালেন। সমস্ত ব্যাপারটার ভেতর একটা নাটকীয়তা আছে। নাটকীয়তা তাঁর পছন্দ নয়। বীথি বলল, কত টাকা তা তো জিজ্ঞেস করলেন না? আমার ধারণা ছিল লেখকদের কৌতূহল অনেক বেশি হয়।
আমি মিথ্যামিথ্যি লেখক। আমার কৌতূহল কম।
টাকাটা আমার খুব কাজে লেগেছে। সমিতিটা দাঁড় করিয়ে দিয়েছি। টাকা ছাড়া কিছুই করা যায় না। যেই টাকা হয়েছে আমনি আমার স্বপ্নটা সত্যি করে ফেলেছি।
বীথি উঠে দাঁড়াল। আত্মবিশ্বাস ভরপুর একজন তরুণী। চেহারায় অবশ্যি আগের কোমলতা নেই। একটা কাঠিন্য এসে গেছে কিন্তু তার জন্যে খারাপ লাগছে না। চেহারার সঙ্গে মানিয়ে গেছে। ওসমান সাহেবের মনে হল সব কিছুই মানুষের চেহারার সঙ্গে মানিয়ে যায়। যখন কেউ নতুন চশমা নেয়। সেই চশমা মানিয়ে যায়। যখন চুলে পাক ধরে সেই পাকা চুলও মানিয়ে যায়।
বীথি বিদায় নেবার সময় আরেকবার বলল, আপনি কিন্তু আসবেন। নটার সময় যাবার কথা। ওসমান সাহেব তার আগেই উপস্থিত হলেন। তার জন্যে, বড় ধরনের বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। তিনি নিজেদের পুরনো বাড়িটি চিনতে পারলেন না। সামনের বাগানে লম্বা গুদাম ঘরের মত একটা ঘর উঠেছে। দুপাশে অনেকখানি ফাঁকা জায়গা ছিল, সেখানেও টিনের শেড দেয়া একতলা দালান। তিনি হকচকিয়ে গেলেন। বীথি বলল, চিনতে পারছেন না, তাই না?
না, পারছি না।
গুদাম ঘরের মত যে লম্বা ঘরটি দেখছেন এটা আমাদের সিউইং সেকশন। তেত্ৰিশটা ইলেকট্রিক সেলাই মেশিন আছে।
বলেন কী?
দোতলার পুরো বাড়িটা হ্যাঁন্ডিক্রাফট সেকশন, মেয়েরা এখানে হাতের কাজ শেখে। আমাদের কিছু অবৈতনিক ইনস্ট্রাকটর আছেন। এখন একজন জাপানি ইনস্ট্রাকটর পেয়েছি, হিরোকো কাশুইয়া। সুন্দর বাংলা বলেন।
এতসব করলেন কিভাবে?
অনেকে সাহায্য করেছে। বিদেশী অর্গানাইজেশনগুলি সাহায্য করেছে। একটা বড় এমাউন্টের সরকারি সাহায্য পাওয়ার কথা। ওটা পেলে আমরা মীরপুরের মেয়েদের একটা হোস্টেল করব।
ওসমান সাহেবের বিস্ময়ের সীমা রইল না। বীথি গভীর আগ্রহে তাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব কিছু দেখাতে লাগল। সঙ্গে সমিতির কিছু মেয়েও আছে তাদের সবার বয়সই ত্ৰিশের নিচে। তারা ওসমান সাহেবকে দেখছে কৌতূহলের সঙ্গে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে নিচু গলায়। সবাই বেশ হাসিখুশি।
মিলাদে যাদের আসবার কথা ছিল, তারা কেউ এল না। সাতটার দিকে মিলিকে নিয়ে এল মতিয়ুর। তারও কিছু পর এলেন মগবাজারের সিদ্দিক সাহেব।
যে মৌলানা মিলাদ পড়াবেন তিনি ধাঁধায় পড়ে গেলেন। তিন জন পুরুষ মানুষকে নিয়ে তিনি সম্ভবত এর আগে মৃত্যুবার্ষিকীর মিলাদ পড়াননি। তিনি বিরক্ত গলায় সূরা বলতে লাগলেন এবং ঘড়ি দেখতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর পর বলতে লাগলেন, আর কতক্ষণ অপেক্ষা করব? বীথি প্রতিবারই বলতে লাগল আর কিছুক্ষণ দেখি। অনেকেই আসার কথা।
মিলিকে দেখে ওসমান সাহেব অবাক হলেন। ভয়ঙ্কর রোগা হয়ে গেছে। মাথাটা অস্বাভাবিক বড় লাগছে সেই কারণেই। মাথায় বাহারি একটি রুমাল। ওসমান সাহেব বললেন, মাথায় রুমাল কেন রে?
মিলি হাসিমুখে বলল, মাথা কামিয়ে ফেলেছি তো, সেই জন্যে রুমাল।
মাথা কামিয়ে ফেলেছি মানে? কী
সব কবিরাজী ওষুধ দেবে। মাথা না কামিয়ে দেয়া যায় না। প্রথমে আমি রাজি হই না। পরে ভাবলাম আমি পাগল মানুষ, মাথায় চুল থাকলেই কী না থাকলেই বা কী? মি
লি মাথার রুমাল খুলে ফেলে বলল, কেমন লাগছে আমাকে বলত?
ভালই লাগছে। কোজাকের মতো।
তোমার যদি মাথায় হাত বুলাতে ইচ্ছা করে হাত বুলাও।
হাত বুলাতে ইচ্ছা করবে। কেন?
ন্যাড়া মাথা দেখলে হাত বুলাতে ইচ্ছা করে না? মনে নাই পাশের বাসার খোকন যখন মাথা কামাল, তখন আমরা শুধু ওর মাথায় হাত বুলাতাম।
মিলি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল। ওসমান সাহেব মন খারাপ করে তাকিয়ে রইলেন। নরম স্বরে বললেন, মিলি, আমি গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কিছু দিন থাকব। তুই যাবি আমার সাথে?
যাব ভাইয়া।
তোর মেয়েকেও সঙ্গে নিবি।
ও খুব কাঁদবে তো। আমাকে চেনে না। ন্যাড়া মাথা দেখে ভয় পায়।
ভয় কেটে যাবে। ও তোর সঙ্গে যাবে, তুই ভাল হয়ে যাবি।
আমারও ভাল হতে ইচ্ছা করে। পাগল হয়ে থাকতে ভাল লাগে না।
ওসমান সাহেবের মনে হল এইসব কথাবার্তা তো পাগলের কথাবার্তা নয়। সুস্থ মানুষের কথাবার্তা। কিন্তু তবু সে সুস্থ নয়। এটা পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে।
মিলি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এই পাজী মেয়েটা ঘরবাড়ি কেমন বদলে ফেলেছে দেখেছ? গুদাম বানিয়ে ফেলেছে। বাড়ি দেখে আমি এমন অবাক হয়েছি, ইচ্ছা করছে মেয়েটিকে একটা চড় দিতে।
মিলি সারাক্ষণ বক বক করতে লাগল। একসময় মতিয়ুর এসে বলল, আর কত, চুপ কর তো। কনটিনিউয়াস কথা বলে যাচ্ছ।
মিলি করুণ মুখে বলল, পাগল মানুষ কী করব বল।
মতিয়ুর রাগী চোখে তাকিয়ে রইল।
ওসমান সাহেব খুবই মন খারাপ করে বাড়ি ফিরলেন। প্রায় সারা রাত তার ঘুম হল না। শেষ রাতের দিকে ভয়াবহ একটা দুঃস্বপ্ন দেখলেন। তার কেন জানি মনে হল তিনি নিজেও পাগল হয়ে যাবেন। জীবন এত জটিল কেন? অসংখ্যবার নিজেকে এই প্রশ্ন করলেন। তার নিজের একটি উপন্যাসের এক ছেলেও এই একই প্রশ্ন করেছিল। সে তার উত্তরও পেয়েছে। কিন্তু তার মনে হচ্ছে উত্তরটা ঠিক না। বিরাট একটা ফাকি আছে উত্তরে।