২২. ডিভোর্স হয় না বলেই ব্যভিচার বাড়ে

ডিভোর্স হয় না এদেশে। ডিভোর্স হওয়ার কোনও কারণ নেই। নারী পুরুষ যখন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয় তখন তাতে অলিখিত বা লিখিত যে শর্ত থাকে তা হল স্বামী উপার্জন করবে, বাড়ির সদস্যদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেবে, আর স্ত্রী স্বামীর আদেশ নিষেধ পালন করবে, স্বামীর শয্যাসঙ্গেী হবে, স্বামীর ঘরসংসার সামলাবে, স্বামীর সন্তান জন্ম দেবে, সেই সন্তান লালন পালন করবে। এটি একটি চুক্তি। এই শর্ত বা চুক্তিটি নারী পুরুষের প্রণয়ঘটিত বা অপ্রণয়ঘটিত যে কোনও বিয়েতেই থাকে। আস্ত একটি মানুষকে পুরুষরা নিজেদের আরাম আয়েশ ভোগ বিলাসের জন্য হাতের মুঠোয় পেয়ে যায়। স্ত্রী মানুষ বটে, তবে এই স্ত্রীর নিজস্ব কোনও বোধবুদ্ধি থাকা বারণ, স্ত্রীর কোনও নিজস্ব জীবন থাকা বারণ, স্বামী-সেবায় এবং স্বামীর সুখ-ভোগে নিজেকে বিসর্জন দিতে হবে স্ত্রীকে, মানুষ হলেও মানুষের জন্মসূত্রে প্রাপ্য স্বাধীনতা ও অধিকার থেকে স্ত্রীর নিজেকে বঙ্গিত রাখতে হবে। বিনে পয়সায় এমন চমৎকার দাসী পেয়ে যাওয়ার আরাম পুরুষেরা ছাড়বে কেন! তাই বিয়ে করার পর পুরুষের কোনও কারণ নেই ডিভোর্স করার। স্ত্রীকে শয্যাসঙ্গেী করতে যদি ইচ্ছে না হয় পুরুষের, তবেও কোনও অসুবিধে নেই, অন্য কোনও শয্যাসঙ্গেীর ব্যবস্থা করে নিতে পারে অনায়াসে, এতে তাদের কেউ বাধা দেয় না। স্ত্রীর বাইরে অন্য কোনও নারীর প্রতি আকর্ষণ পুরুষের জন্য আধুনিক হওয়ার শর্তের মতো। পুরুষের ডিভোর্স করবার দরকার হয় না। এক দাসীকে বাদ দিয়ে অন্য দাসী নেওয়ার খুব আকুলতা থাকার কোনও অর্থ হয় না। দাসী তো দাসীই। দাসীর মধ্যে প্রভুভক্তি বা পুরুষভক্তি থাকলেই যথেষ্ট। অত না পাল্টে বরং একজনকে — পুরোনোজনকে, যে এরমধ্যে ঘরসংসারের কাজ ভালো বুঝে নিয়েছে, তাকে রাখাই ভালো। পুরুষেরা তাই একের বদলে একইরকম আরেককে রাখার কোনও অর্থ দেখে না। তারা অর্থহীন কাজে তেমন আগ্রহী হয় না। স্ত্রী থেকে মন উঠলে শরীর উঠলে যদি ঘরসংসার ঠিকঠাক থাকে, স্ত্রীও যেমন ছিল তেমন থাকে, বাইরের ব্যভিচারও চমৎকার ভোগ করা যায় — তবে কি পুরুষেরা বুদ্ধু হয়েছে যে ডিভোর্স করার মতো বোকামো তারা করবে! স্ত্রীরা কেন মেনে নেয় স্বামীর ব্যভিচার—প্রশ্ন এটাই। উত্তর হল, না মেনে তাদের উপায় নেই। অন্য কোনও পুরুষের ঘরে গেলে সে পুরুষও যে ব্যভিচার করবে না তার গ্যারান্টি কে দেবে নারীকে? ব্যভিচার পুরুষের রক্তে, কেউ কেউ বলে। আমি বলি রক্তে নয়, ব্যভিচার পুরুষতন্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

যার সঙ্গে প্রেম করছো, তার সঙ্গে জীবনযাপন করো। যার সঙ্গে মন মেলাচ্ছো, তার সঙ্গে শরীর মেলাও, যেহেতু শরীরেই বসত করে মনরূপ পাখি। বাস শুধু তার সঙ্গে যার সঙ্গে মন, যার সঙ্গে শরীর।–এমন সততা যদি থাকতো সবার, ডিভোর্সের সংখ্যা বাড়তো। ভালোবাসাহীন সম্পর্ককে দু’ পক্ষই বছরের পর বছর টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করতো না। যদি নারীর স্বনির্ভরতা বাড়তো, সচেতনতা বাড়তো, তবে ডিভোর্সের সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই বাড়তো। নিজেকে নিরন্তর অপমানিত হতে দিতে নারী রাজি হত না। ডিভোর্স যেহেতু স্বামী স্ত্রী দুজন দুই ভিন্ন কারণে করছে না, করা থেকে বিরত থাকছে, ব্যভিচারের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়বেই। অসুখী দম্পতি আর ব্যভিচারের অসুস্থতায় ছেয়ে যাবে সমাজ। অনেকে ব্যভিচার শব্দটিকে খুব রক্ষণশীল বলে মনে করে। আমি করি না। সম্পর্কের মধ্যে বিশ্বস্ততা থাকতে হয়, যে কোনও সম্পর্কেই। না থাকলে তা ভত্তামি, তা ব্যভিচার। সম্পর্কের মধ্যে প্রেম থাকলে পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ততা থাকেই, এটিকে জোর করে পাহারা বসিয়ে আইন করে আনা যায় না। তবে প্রেম না থাকলে সেই সম্পর্ককে জিইয়ে রাখলে তা শুধু নিজেদের যন্ত্রণা দেয় না, শিশুসন্তানদেরও দেয়। ওরা প্রতিদিন ঘৃণা দেখে, ঝগড়া দেখে, হিংসে দেখে, মারামারি দেখে। দেখে দেখে কি ওরা আদৌ কোনও সুস্থ সুন্দর হৃদয়বান যুক্তিবাদী মানুষ হিসেবে বড় হতে পারে! অসম্ভব। জাতির ভবিষ্যতের কথাও যদি ভাবি, তবেও তো ভালোবাসাহীন যে কোনও তিক্ত পরিবেশ থেকে শিশুদের সরিয়ে ফেলা আমাদের উচিত। সকলের স্বার্থে, নারী পুরুষ উভয়ের স্বার্থে, সন্তানের স্বার্থে, সুস্থ সমাজের স্বার্থে ঘরে ঘরে দুঃসহ জীবন যাপন করা মানুষের ভালোবাসাহীন সম্পর্কগুলো ভেঙে যাওয়া উচিত। যা ভাঙার তা ভাঙুক। ভাঙতে না দিলে কী করে গড়ে উঠবে নতুন কিছু! পচা পুরোনোকে আঁকড়ে রেখে স্বপ্ন কি দেখা যায় সুন্দরের!

স্বামীরা ডিভোর্স করছে না কেন, তা জানি। কিন্তু স্ত্রীরা কেন করছে না! স্ত্রীরা ব্যভিচারী স্বামীদের দেখছে, তাদের বিশ্বাসঘাতকতা, দ্বিচারিতা সবই সইছে কিন্তু ডিভোর্স করছে না। ঘরে ঘরে এই চিত্র। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে প্রেম নেই, কিন্তু এক ছাদের তলে তারা বাস করছে অথবা বাস করতে বাধ্য হচ্ছে। পুরুষ এরকম অভিযোগ করে—স্ত্রী আর আকর্ষণীয় নয় স্বামীর কাছে। স্ত্রী যত শ্রম দিচ্ছে, যত সন্তানের জন্ম দিচ্ছে, যত স্বামী সেবায় এবং সন্তান সেবায় নিজের হাড়মাংস কালি করছে, তত সে স্বামীর কাছে অনাকর্ষণীয়, অনাদরণীয় হয়ে উঠছে। স্বামী অন্য ফুলে মধু খেতে ছোটে। স্ত্রী-ফুল তার কাছে তখন শ্রীহীন, নিতান্তই বাসি। ঠিক একইরকম কিন্তু স্ত্রীও ভাবতে পারে। আসলে স্ত্রীদেরই ভাবতে পারার কারণ বরং বেশি। এ সমাজে বেশিবয় সের পুরুষের সঙ্গে কম বয়সী নারীর বিয়ে হয়। স্ত্রীর কাছে স্বামীকে বুড়ো ভাম বলে মনে হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। স্ত্রীর কাছে স্বামীকে লাগতে পারে কুৎসিত, কদাকার বস্তু, স্বার্থান্ধ, লোভী, নষ্ট ভ্রষ্ট,ভণ্ড, ধ্বজভঙ্গ। স্ত্রীদের নিশ্চয়ই তেমনই লাগে। অন্তত গোপনে গোপনে হলেও তো লাগে। কিন্তু প্রশ্ন হল, স্ত্রী কেন এই বাসি পুরুষকে ত্যাগ করে কোনও কচি সুদর্শনের সঙ্গে প্রেম করে না? যৌনতার খেলা খেলে না? খেলে না, কারণ স্ত্রীর সময় নেই খেলার। কাঁধে তো সংসার সন্তানের বোঝা! বোঝা লাঘবের কোনও ব্যবস্থা যদি হয়ও, স্ত্রীরা তবে যাবে কোথায় ব্যভিচারী স্বামীকে ত্যাগ করে! নতুন পুরুষও তো একই রকম ব্যভিচারী হবে। হবেই। দাঁতে দাঁত চেপে তাই স্ত্রীরা ঘন করে পরা মাথার সিঁদুর আর হাতের শাঁখা-পলার আড়ালে স্বামীর ব্যভিচার লুকিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্ট করে। উপায় নেই। উপায় কি সত্যিই নেই?

ব্যভিচারি পুরুষদের ব্যভিচারী না বলে ব্যভিচারী বলা হয় মেয়েদের। ব্যভিচারের শাস্তি এতকাল মেয়েদেরই পেতে হয়েছে। যে অসহায় মেয়েদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে পুরুষ, যে মেয়েদের ভয় দেখিয়ে, লোভ দেখিয়ে, ঠকিয়ে, ঠেকিয়ে তাদের সঙ্গে যৌনসম্পর্কে যেতে বাধ্য করেছে পুরুষ—সেই মেয়েদেরই হয় দুর্নাম ‘ব্যভিচারী’ বলে। সেই মেয়েদেরই হয় শাস্তি। এতকাল হয়ে এসেছে। এখন মহিলা কমিশনের দাবিতে নতুন আইন আসছে দেশে, ব্যভিচারী হিসেবে শাস্তি পেতে হবে পুরুষকে, নারীকে নয়, নারী ব্যভিচারে লিপ্ত থাকুক বা না থাকুক।

সম্প্রতি প্রণয়ন করা নারী নিগ্রহ আইনটির মতো নারী নয় কেবল পুরুষের শাস্তি পাওয়ার নতুন এই ব্যভিচার আইনটি একটি সভ্য আইন। নারী নিয়ে লীলাখেলা ভগবানেরা যথেষ্ট করেছে। এর প্রভাব ভারতীয় পুরুষের ওপর এত পড়েছে যে লীলাখেলায় তারা বেশ সিদ্ধহস্ত। এখন ব্যভিচারের শাস্তি ব্যভিচারীকেই দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে, শাস্তি পাওয়ার যোগ্য লোককেই শাস্তি দেবার ব্যবস্থা হচ্ছে। সঠিক অপরাধীর হাতেই পরানো হচ্ছে হাতকড়া। ভগবানের উত্তরসুরীর জন্য যথেষ্ট ছাড় দেওয়া হয়েছিল, এখন হবে না।

নারীর জন্য বড় মায়া হয়। গুলি খায়। আবার গুলি খায় বলে অপরাধী বনে ফাঁসিকাঠে চড়ে। নারীর কেবল ঘুরে ঘুরে নানারকম মৃত্যুই হয়। এক মৃত্যুর পর আরেক মৃত্যু। এতবার মরে কেউ? নারীর মতো শত শত বার? একটি ভয়ংকর নারীবিরোধী সমাজে বসে আমি প্রয়োগ হোক বা না হোক নারীর পক্ষে আনা নতুন আইনগুলোকে স্বাগত জানাচ্ছি । আর সহস্রবার উচ্চারণ করছি নারীর জন্য আমার শুভকামনা। পুরুষের মিথ্যের, ছলনার, আধিপত্যের, ষড়যন্ত্রের, তন্ত্রের, দ্বিচারিতার, ঙ্গিচারিতার, চতুর্চারিতার, পুরুষের অনাচারের, অন্যায়ের, পুরুষের বদমাইশির, ব্যভিচারের শিকার যেন কোনও নারীকে আর হতে না হয়। নারী যেন পুরুষের আঁচড়, কামড় থেকে বাঁচে। জন্মের মতো বাঁচে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *