২২. জেড পাথরের তসবিহ

২২. জেড পাথরের তসবিহ্

মার্চের শেষদিকের বিকেলে আহমেদনগরে প্রচণ্ড গরম পড়েছে। আওরঙ্গজেব কারও সাহায্য না নিয়ে হাতির দাঁতের হাতলওয়ালা দুটি বেতের লাঠির উপর ভর দিয়ে নগরদুর্গে তাঁর কামরার বেলকনিতে এলেন। গদিওয়ালা চেয়ারে বসতেই রোদ ঠেকাবার জন্য একজন পরিচারক তাঁর মাথার উপর একটি সবুজ রোদনিবারক ছাতা মেলে ধরলো। আরেকজন পরিচারক এক গ্লাস বরফ দেওয়া শরবত পাশে রাখলো আর তৃতীয়জন মসলিন কাপড়ে ঢাকা পিকদানিটি হাতের কাছেই রাখলো। তিন মাস আগে তার বুকের অসুখটি আবার এমন গুরুতর আকার ধারণ করেছিল যে, জ্বরে তিনি কাবু হয়ে পড়েন। তখন তিনি উদিপুরী মহলের অনুরোধে উত্তরের দিকে যাত্রা স্থগিত করতে রাজি হলেন। আবার পরিপূর্ণ সুস্থ হলে রওয়ানা দেওয়া যাবে। তারপর বেশ কিছু দিন বিশ্রাম নিয়ে স্বাস্থ্য কিছুটা ভাল হলেও এখনও তেমন শক্তি পান নি যে, সফরের ধকল পোহাতে পারবেন। ইতোপূর্বে ধূলিধূসরিত পথে পালকি দিয়ে এক মাইল চলার পর তিনি যেরকম কাহিল হয়ে পড়েছিলেন, সেরকম কাহিল যৌবনে ঘোড়ায় চড়ে অন্তত একশো মাইল গেলে হতেন। প্রতিটি ধাক্কা তার দেহমনের উপর এমন প্রভাব ফেলেছিল যে এর ফলে মাথায় যন্ত্রণা হত আর প্রতিটি হাড়ের ব্যথায় নিঘুম কাটতো। বৃদ্ধ বয়সের এই হচ্ছে পরিণতি।

 দিল্লি এখনও প্রায় আটশো মাইল দূরে রয়েছে আর তার আশঙ্কা হচ্ছিল, তিনি বোধ হয় আর কখনও তার লাল বেলেপাথরের রাজধানী দেখতে পাবেন না। অন্যরাও তাই ভাবছিল। তিন সপ্তাহ আগে একজন কাসিদ খবর নিয়ে এসেছিল যে, বাবার গুরুতর অসুস্থতার খবর পেয়ে তার পাশে থাকার জন্য ছেলে আজম গুজরাট থেকে দ্রুতগামী ঘোড়ায় চড়ে রওয়ানা দিয়েছে। আজ বিকেলেই তার পৌঁছার কথা আর সেজন্যই আওরঙ্গজেব তার আগমন দেখার জন্য বেলকনিতে এসেছেন। আবার গতকাল দাক্ষিণাত্য থেকে খবর এসেছে যে, মুয়াজ্জমও তার অসুস্থ বাবাকে দেখতে আসার পরিকল্পনা করছে। স্বভাবসুলভভাবে সাবধানী মুয়াজ্জম বলেছে সে ধীরে সুস্থে সাথে তার অনেক লোক নিয়ে আসবে। পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে, তার দুই ছেলেরই মনে উত্তরাধিকারের ভাবনা চলছে।

একই ভাবনাও কমবখস্ আর তার মা উদিপুরী মহলের মনেও চলছিল। মাত্র গতকালই তিনি ছেলেকে তার সামনে হাজির করে বলেছিলেন যে, বাংলার যে অশান্তি চলছে, তা দমন করার জন্য তিনি বিদেশি বণিকদের কাছে সামরিক সহায়তার বিনিময়ে পূর্ব উপকূলে আরো বন্দর খুলে দেবেন। অতিরিক্ত বাণিজ্যের ফলে রাজস্ব বেড়ে যাবে আর এতে স্থানীয় জনসাধারণের করের বোঝা কিছু লাঘব হবে। কমবখস্ তার প্রস্তাবটি তুলে ধরার পর, তার বাবার বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বার বার হোঁচট খেতে লাগলেন। স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে সামনে খাড়া করা হয়েছে। তিনি বার বার সমর্থনের জন্য তার মায়ের দিকে তাকাচ্ছিলেন। উদিপুরী মহলের প্রতি আওরঙ্গজেবের আকর্ষণের একটি প্রধান কারণ ছিল তার সরলতা আর রাজনৈতিক ব্যাপারে তার অনাগ্রহ। তার সুন্দর বাহুতে তিনি জাগতিক সমস্যা ভুলে যেতে পারতেন। তিনি জানেন এখনও তিনি তার সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হলেও, কমবখসের বার বার হোঁচট খাওয়া সত্ত্বেও তাকে সেরকম সমর্থন যোগাতে পারেন নি।

আওরঙ্গজেব তাদেরকে জানালেন না যে, পাঁচবছর পূর্বে ইংরেজ রাষ্ট্রদূত নরিস যখন তাকে একই ধরনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তখন তিনি তার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিলেন। কেননা বণিকরা ইতোমধ্যেই উদ্ধত হয়ে উঠেছিল আর মোগল শাসনকে অবজ্ঞা করতে শুরু করেছিল, কাজেই তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য আর উৎসাহিত করার প্রয়োজন নেই। এরপর কমবখস্ আর তার মা কিছু উদ্ভট আর অবিশ্বাস্য পরিকল্পনার কথা বলতে শুরু করলেন। কমবখস্ নিজে অবশ্য তার মায়ের কাছ থেকে দূরে সরে যুদ্ধক্ষেত্রে যে বেশ সফলতা অর্জন করেছে তা জানিয়ে নিজের অবস্থান আরো সুবিধাজনক করতে পারত। সম্প্রতি তিনি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ছোট ছোট কয়েকটি লড়াইয়ে জয় পেয়েছিলেন।

 অবশ্য কমবখস্ আর উদিপুরী মহল কেবল কমবখসের প্রতি তার আগ্রহ বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন, ওরা সিংহাসন জবরদখল করার চেষ্টা করছিলেন না। তবে আজমের বিষয়ে তিনি একই কথা বলতে পারছেন না। তার স্ত্রী জানির মৃত্যুর পর তিনি আবার তার পুরোনো স্বভাবে ফিরে গেছেন। একবার তিনি আর তার অশ্বারোহীসেনারা গুজরাটি বিদ্রোহীদের তাড়া করতে গিয়ে বিদ্রোহীদের অতর্কিত হামলার মুখে পড়ে যান। কেবল তার ব্যক্তিগত সাহসিকতার কারণে সেবার প্রাণে বেঁচে যান। তারপরও বিনাকারণে তিনি তার ভালো কয়েকজন সেনা হারিয়েছেন। আবার এদিকে মুয়াজ্জম গোয়ালিয়র থেকে মুক্তি পাবার পর বাবার সামনে এলে একেবারে মৌনি হয়ে থাকেন। তার মনোভাব বুঝা কঠিন। মুয়াজ্জম প্রকাশ্যভাবে এমন কোনো কাজ করবেন না যাতে সামান্যতম ভুল হওয়ার আশঙ্কা আছে আর তার বাবা তাকে আবার কারাগারে বন্দী করেন কিংবা এমনকি প্রাণদণ্ড দেবারও আশঙ্কা আছে।

যাই হোক সবার আগে আজমকেই সামলাতে হবে। আর যদি তার ভুল না হয়ে থাকে এখন উত্তর-পশ্চিম দিগন্তে যে ধুলার মেঘ দেখা যাচ্ছে, তা নিশ্চয়ই তার পুত্রের আগমনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাদের সাক্ষাৎকারের জন্য তাঁর যে সামান্য মানসিক আর শারীরিক শক্তি এখনও অবশিষ্ট আছে তা তুলে ধরতে হবে।

 দুই ঘণ্টা পর আওরঙ্গজেব রাজদরবারের উপযোগী পোশাক আর তৈমুরের বাঘের আংটিটি আঙুলে পরে আহমেদনগর দুর্গের একটি রাজকীয় কামরায় একটি সোনালি গিল্টি করা সিংহাসনে বসলেন। উমর আলি আর পাঁচজন দেহরক্ষী পেছনে নিয়ে ছেলের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। শিঙা ফুকার সাথে সাথে আজম কামরায় ঢুকে সিংহাসনের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাকে বেশ স্বাস্থ্যবান আর তেজোদীপ্ত মনে হচ্ছে। তবে একয়েক বছরে তার চেহারায় বয়সের ছাপ পড়েছে। চোখের নিচে কালো কালি পড়েছে। তার শরীরের অন্যান্য অঙ্গের মতো মুখও মাংসল হয়ে উঠেছে আর দাড়িতে সাদা ছিটেফোঁটা দেখা যাচ্ছে।

‘স্বাগতম বেটা। এসো, আমার বুকে এসে আমাকে জড়িয়ে ধর। প্রাণপণ চেষ্টা করে আওরঙ্গজেব বেতের লাঠি বাদ দিয়ে সিংহাসনের হাতলের উপর ভর দিয়ে কোনোমতে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর তার ছেলের মোটাসোটা শরীর দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন। কয়েক মুহূর্ত পর তাকে ছেড়ে দিয়ে তিনি আবার ধপ করে সিংহাসনে বসে পড়লেন।

 ‘এত দিন পর আপনাকে দেখে আমার খুব ভাল লাগছে বাবা। আর খবরে যা শুনেছি তার চেয়ে আপনাকে অনেক ভালো দেখাচ্ছে।

 ‘আমি এখনও আরো কিছুদিন বেঁচে থাকতে চাই। আমার এখনও অনেক পরিকল্পনা পূর্ণ করার আছে।

 আজম বললেন, আপনার স্বপ্ন পূরণ করার জন্য আমাকে সাহায্য করতে দিন। আমি আমার যথাসাধ্য ক্ষমতা দিয়ে আপনাকে সাহায্য করবো।

‘কয়েকদিন পর সে বিষয়ে কথা বলবো। এত তাড়াহুড়ার কিছু নেই। দীর্ঘ সফরের পর তোমার আর তোমার লোকজনের বিশ্রাম নেওয়ার প্রয়োজন আছে। তারপর রাজদরবারের পুরোনো বন্ধুদের সাথে মোলাকাত কর।

*

সম্রাটের ব্যক্তিগত কামরায় একা বসে উমর আলি আওরঙ্গজেবকে বললো, ‘জাঁহাপনা, আপনার কথামতো আমি আপনার ছেলের কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার সাথে ব্যক্তিগতভাবে আলাপ করতে পেরেছি।

‘বল, কি জানতে পারলে?’ অনেক বছর আগে উমর আলির বিশ্বস্ততা আর সেইসাথে তার সামরিক কুশলতা আর সাহসীকতার কারণে তিনি তাকে তার প্রধান দেহরক্ষী নিযুক্ত করেছিলেন। ম্রাটের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রয়োজনে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে মনের সূক্ষ্ম বুদ্ধি কিংবা চতুরতার প্রয়োজন নেই কিংবা আকাক্ষিতও নয়। যাইহোক এমুহূর্তে আর কেউ নেই যাকে তিনি বিশ্বাস করতে পারেন, আর যাকে দিয়ে তিনি জানার চেষ্টা করবেন যে, আজমের আহমেদনগরে আসার পেছনে কারণ কি তার বাবার স্বাস্থ্যের জন্য ব্যাকুলতা না কি আরো কিছু আছে।

 ‘জ্বী, জাহাপনা, আমার প্রথম স্ত্রীর পরিবারের সাথে সম্পর্কযুক্ত একজন সেনা কর্মকর্তার সাথে আলাপ হয়েছে। সে বললো, আজম খোলাখুলিভাবে উত্তরাধিকার বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। আর আপনার মৃত্যুর পর সিংহাসনে তার অধিকারের দাবি তুলে ধরার কথা বলেছেন। তাছাড়া সে আরো বলেছে, গুজরাট ছেড়ে আসার আগে তিনি যেসব জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদেরকে সেখানে রেখে এসেছেন, তাদেরকে তৈরি থাকতে বলেছেন, যাতে প্রয়োজন পড়লে তার সমর্থনে তারা যেন অল্পসময়ের ডাকে রওয়ানা দিতে পারে।’

 ‘আচ্ছা তাই নাকি? আর কিছু জানতে পারলে?

‘জ্বী। দাক্ষিণাত্যে আমার সাথে লড়াই করেছিল, তেমন একজন যুদ্ধ ফেরত সেনা-কর্মকর্তা বললো আজম তাকে জানিয়েছেন যে, তার ভাইদের সরিয়ে তাকে ক্ষমতায় বসাবার কাজে সে যদি তাকে সাহায্য করে তবে তিনি তাকে পদোন্নতিসহ জায়গির দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সে বললো শুধু সে একা নয় আরো অনেক কর্মকর্তাকেও এ ধরনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।’

আওরঙ্গজেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি খুব ভাল কাজ দেখিয়েছ উমর আলি।’

*

ছেলের আসার দশদিন পার হওয়ার পর আওরঙ্গজেব পুরো দরবারের সামনে তাকে হাজির হতে বললেন। এই সভায় যোগ দেবার প্রস্তুতি নিতে শক্তির জন্য প্রার্থনা করলেন আর শক্তি সঞ্চয় করতে তিনি যতক্ষণ পারেন ঘুমিয়ে নিলেন, তারপরও প্রচণ্ড কাশি আর সেই সাথে শাসকষ্ট রয়েই গেল।

সকলে তার সিংহাসনের সামনে সমবেত হওয়ার পর তিনি শুরু করলেন, ‘আজকের এই সভায় সকলকে আমি ডেকেছি, কারণ আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেব। আমাকে শারীরিক অসুস্থততায় আমাকে দেখার জন্য আমার ছেলে আজম এসে আমার প্রতি যে উদ্বেগ দেখিয়েছে, সে জন্য আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ।

 তার ঠিক বামপাশে সামনে দাঁড়ান আজম মৃদু হাসলেন।

 ‘আমি যতদূর শুনেছি গুজরাটের সুবেদার হিসেবে সে চমৎকার কাজ দেখিয়েছে, একারণে সে এবং তার অনুগত কর্মকর্তাদের সত্যি গর্বিত হওয়া উচিত। তাদের কর্মকাণ্ড এত চমৎকার হয়েছে যে, আমি আজমকে অন্য এক পদে বদলি করতে চাচ্ছি আর তার বিশ্বস্ত কর্মকর্তারা গুজরাটে থেকেই তাদের কাজ চালিয়ে যাবে।’

‘অন্য পদে বাবা? কি পদে?

‘মালওয়ার সুবেদারি। এটিও সমান গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রদেশ আর সেখানে রাজস্ব বাড়ানো, দুর্নীতিরোধ আর ডাকাত দমনের জন্য অনেক কিছু করার আছে।’

কিন্তু বাবা। আমি তো গুজরাট ফিরে যেতেই পছন্দ করবো…’

 ‘এখানে আসার পর প্রথমে তুমি আমাকে বলেছিলে আমার অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করার জন্য তুমি সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করবে আমার মনে হয় তাই বলেছিলে তুমি–এখন সেটা কর।’

 ‘মালওয়ার যদি যেতেই হয়, তবে আমার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন কর্মকর্তাকে সাথে নিতে চাই।’

আওরঙ্গজেব ঘুরে আজমের দিকে তাকলেন। আর তার ছেলে তার বাবার চোখে সেই পুরোনো আগুন দেখতে পেলেন। তিনি বললেন, আমি যতদিন শাসন করছি, ওরা আমার অধীনস্ত কর্মকর্তা, তোমার নয়। আর ওরা কোথায় যাবে না যাবে সে সিদ্ধান্ত আমি নেব তুমি নয়। আমি তোমাকে বলেছি গুজরাটে যে ভালো কাজ হয়েছে তা চালিয়ে যেতে ওরা ওখানেই থাকবে। এখন যাও কয়েকদিনের মধ্যে তোমার নতুন প্রদেশে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নাও।’ এমন সময় প্রচণ্ড কাশির দমকে সম্রাটের কথা একটু থেমে গেল, তারপর কাশি সামলে তিনি আবার বললেন, আমার কথামতো নতুন জায়গায় দায়িত্ব নেবার জন্য চলে গিয়ে তুমি প্রমাণ করবে যে সব সময়ের মতো তুমি আমার প্রতি বিশ্বস্ত আর অনুগত।

আজম মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করলেন, কোনো কথা বললেন না। তবে তার মুখের ভাব দেখে আওরঙ্গজেব বুঝতে পারলেন তিনি যে বার্তা তার ছেলেকে দিয়েছেন, তা তিনি বুঝতে পেরেছেন।

 নিজের কামরায় ফেরার পর আওরঙ্গজেব উদিপুরী মহলের বাহুতে প্রায় ঢলে পড়লেন। তিনি তাকে ধরে বিছানায় নিয়ে গেলেন। আওরঙ্গজেব মন্তব্য করলেন, ‘আল্লাহর শুকরিয়া যে, আমি তাদের দেখিয়েছি, বুড়ো বাঘ এখনও গর্জন করতে পারে।

*

এক সপ্তাহ আগে রাজদরবারের সভায় আওরঙ্গজেব যে শক্তি দেখিয়েছিলেন, তারপর মাত্র ধীরে ধীরে সেই ধকল কাটিয়ে উঠছিলেন। উদিপুরী মহল তাকে জিজ্ঞেস করলেন, যদিও আজম চলে গেছে–তারপরও আমি আমাদের ছেলের জন্য দুশ্চিন্তায় আছি। আপনি কি কমবখস্ত্রে জন্য আর কিছু করতে পারেন না?”

আওরঙ্গজেব একটু উত্তেজিত কণ্ঠে উত্তর দিলেন, আমি আজমের উচ্চাকাঙ্ক্ষা দমিয়ে দিয়েছি আর মুয়াজ্জমকে কঠোর ভাষায় লিখে বলেছি তার সেনাসামন্ত নিয়ে দাক্ষিণাত্যে থাকতে? আর কী চাও তুমি? একটু থেমে তারপর আবার বললেন, কমবখস্ নিজেকে আমার সামনে তুলে ধরার জন্য তোমার সাহায্য নিয়ে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করছে। যখন আমি থাকবো না তখন তার নিজেকে আরো শক্তিশালী দেখাতে হবে।’

‘সে এর কিছুই জানে না, আমি হলফ করে বলছি। তাকে বেশি ক্ষমতা দেওয়ার জন্য নয় আপনাকে আমি অনুরোধ করছি না, আমি শুধু চাই তাকে আপনি তার ভাইদের কাছ থেকে দূর কোনো প্রদেশে আপনার বিশ্বস্ত কিছু কর্মকর্তা সাথে দিয়ে পাঠান, যাতে ওরা তাকে নিরাপত্তা দিতে পারে। আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে রাজদরবার আর এর চারপাশে যে ষড়যন্ত্র ঘুরপাক খাচ্ছে, তা থেকে তাকে দূরে সরিয়ে রাখা। আর আপনার যখন মৃত্যু হবে প্রার্থনা করি তা যেন অনেক দেরিতে হয়, তখন এই ষড়যন্ত্র দ্বিগুণ হবে। আপনাদের দুজনের মৃত্যু আমার সহ্য হবে না। আমি চাই সে যেন এখনি নিরাপদ কোনো জায়গায় চলে যায়। কথা শেষ করেই উদিপুরী মহল যুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন।

তিনি যদি সত্যিই তার ছেলেকে দূর কোনো প্রদেশে পাঠাতে চান, তাহলে তিনি নিশ্চয়ই উচ্চাকাঙ্ক্ষার বদলে তার জীবন নিয়ে উদ্বিগ্ন। তার বড় সৎ ভাইদের তুলনায় কমবখসের খুব একটা সমর্থক ছিল না। সম্ভবত এটা তার মায়ের সাধারণ বংশ ধারার কারণে আবার সেই সাথে ভাইদের তুলনায় তার বয়সও কম। যদিও এখন তার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। এছাড়া তার যুদ্ধাভিযানের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ছিল না। সে প্রায়ই উদিপুরী মহলের ইচ্ছার কাছে নতিস্বীকার করে রাজদরবারেই থাকতে রাজি হত।

 “ঠিক আছে। আমি তার জন্য একটা প্রদেশ খুঁজে বের করবো আর সাথে বিশ্বস্ত লোক দিয়ে তাকে সেখানে পাঠাব।’

আওরঙ্গজেব যে কথাটি প্রকাশ করেন নি, তা হল উত্তরাধিকারের বিষয়টি নিয়ে তিনি বেশ কয়েক মাস যাবত দুশ্চিন্তায় আছেন। বাবা আর ভাইদের সাথে তার আচরণের কারণে, যে সন্দেহ আর অপরাধবোধ দিন-রাত তার মনকে আচ্ছন্ন। করে রেখেছিল, সেই ভার মন থেকে নামাতে পারছিলেন না। আর সেই সাথে উদ্বিগ্ন ছিলেন সিংহাসনের জন্য তার ছেলেদের পরস্পরের মাঝে সংঘর্ষ কিভাবে এড়ান যায়, যা তিনি নিজেও তার ভাইদের সাথে করেছিলেন। …কিভাবে আবার সেই ‘সিংহাসন কিংবা কফিন’–এই প্রবাদটি এড়ানো যায়। তিনি দীর্ঘদিন গভীরভাবে চিন্তা করে দুনিয়ার সামনে একজন উত্তরাধিকার ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ছেলেদের উপর তার তেমন আস্থা ছিল না, যে কে এতে সফল হবে। তিনি সবসময় ছেলেদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন, কাউকে বিশেষ প্রিয় হিসেবে মনে করেন নি। মুয়াজ্জম আর কম বখস্, উভয়কেই কারাদণ্ড দিয়েছিলেন–একজনকে রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা অপরজনকে নৈতিক স্থলনের কারণে। ওরা তিনজনই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে তাঁকে হতাশ করেছে। এছাড়া শাহজাহান দারা শিকোকে তার ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকার মনোনীত করলেও ওদের কাউকেই তাদের নিজ উচ্চাকাঙ্ক্ষা রোধ করতে পারে নি।

একমাত্র যে সমাধানটি তার মনে জেগেছিল সেকথাটি ভাবলে মনে হয় এই পরিকল্পনাটি হয়তো তার যৌবনে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো। তিনি ঘোষণা করবেন যে, তাঁর মৃত্যুর পর পুরো সাম্রাজ্য তাঁর ছেলেদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হবে। এতে হয়তো রক্তপাত বন্ধ হবে আর সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশের মাঝে দৃঢ়ভাবে শাসন নিশ্চিত করার সুবিধা পাওয়া যাবে। তিনি যেভাবে সাম্রাজ্যের পরিধি বাড়িয়েছিলেন, তাতে পুরো সাম্রাজ্য শাসন করা তার যে কোনো একজন ছেলের ক্ষমতার বাইরে। তিনি নিজে তার সমস্ত কুশলতা দিয়ে এটি অর্জন করেছিলেন। তবে তার মনে ভয় হচ্ছে, তারপরও তার ছেলেরা একটি অবিভক্ত সিংহাসনের জন্য লড়াই করবে।

যাই হোক, কমবখস চলে যাওয়ার পর তিনি ছেলেদেরকে চিঠি লিখে উত্তরাধিকারত্ব তিনভাগে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবেন। তারপর খবরটি তাদেরকে হজম করার সময় দিয়ে রাজদরবারে আর প্রজাদের সামনে ঘোষণা করবেন।

*

আওরঙ্গজেব উদিপুরী মহলকে বললেন, ‘আহমদনগরে এসে থেমেছি প্রায় একবছর হল। আমি এখন এই সত্যিটা স্বীকার করছি যে, এখানেই আমার মৃত্যু হবে।’ উদিপুরী মহল তার কপাল থেকে ঘাম মুছে দিচ্ছিলেন। জ্বরের প্রকোপটা এখন একটু কমে এসেছে, তবে আহমদনগরে আসার পর আরো কয়েকবার জ্বর কমে আবার বেড়েছিল আর মনে হয় এবারও শেষও নয়। সারা বছরই তার স্বাস্থ্যের অবস্থা উঠানামা করেছে। এখন প্রচণ্ড গরমের পর মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টি হয়ে আবহাওয়াও ঠাণ্ডা হচ্ছে, কিন্তু তিনি জানেন তিনি দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়েছেন আর ঘন ঘন জ্বর হচ্ছে। আর ঘন ঘন কাশিটা থামছেই না। ইসলামিক টুপি সেলাই করা আর পবিত্র কিতাব হাতে লিখে নকল করার কাজে তিনি তার সমস্ত শক্তি নিয়োজিত করেছিলেন।

 উদিপুরী উত্তর দিলেন, আপনার কথা হয়তো ঠিক। তবে এখানে আপনি আরাম পাচ্ছেন। কাসিদরা দ্রুত পুরো সাম্রাজ্যের খবর এনে দিচ্ছে। খামাকা কেন কষ্টকর সফরের কথা ভেবে মনে কষ্ট পাচ্ছেন?

কারণ আমি অনুভব করছি আমার কিছু অসমাপ্ত পারিবারিক কাজ রয়ে গেছে। একটি বিরাট অপরাধের বোঝা কখনও প্রশমিত করতে পারবো না। বরং এই ভারী বোঝা নিয়ে আর দোষী সাব্যস্ত হয়ে আমি এখানেই মরবো। তারপর তিনি মাথা এপাশ ওপাশ করতে লাগলেন আর সাথে সাথে আবার ঘামতে শুরু করলেন। কয়েকমিনিট পর আবার বললেন, যখনই আমি একটু ভাল বোধ করি তখন আমি ইতোপূর্বেকার পাঁচজন সম্রাটের ইতিহাস পড়ি। ওরা সবাই তাঁদের পরিবারের সাথে লড়াই করেছেন, শেষ তিনজন তাদের ছেলেদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। আমার বাবাসহ শেষ দুইজনও পরিবারের সাথে লড়াই করেছেন। আর আমার রাজত্বে দুই ছেলে আমার সাথে লড়াই করেছে। আমাদের রাজবংশ বিদেশি শত্রুদের পরাজিত করেছে আর সাম্রাজ্যের সীমানা বাড়িয়েছে কিন্তু কখনও নিজেদের মাঝে শান্তি আসেনি। কেন আমরা আর ..কেন আমি কখনও ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেই নি? আমি বিশ্বাস করেছিলাম, ধর্মীয় সততা না থাকাটাই দোষী হওয়ার জন্য যথেষ্ট আর চেষ্টা করেছি আমার সন্তানদেরকে কঠোর ধর্মীয় বিশ্বাসের সীমার মাঝে আবদ্ধ রাখতে আর চেয়েছিলাম বাবা হিসেবে ওরা আমাকে মান্য করুক যা আমাদের ধর্মমতে বলা হয়েছে, কিন্তু কোনো ফল হল না। এখন মৃত্যু যখন কাছে এগিয়ে এসেছে, তখন আমি আমার ছেলেদেরকে একসাথে আমার পাশে আনতে পারছি না, এই ভয়ে যে ওরা আমার সিংহাসন নিয়ে লড়াই করবে। আর যদি আসেও, সেটা আমাকে ভালোবাসে বলে নয়, আসবে আমার সিংহাসনের লোভে।

 ‘এটা কমবখসের বেলায় সত্যি নয়।’

‘আমি শুধু আশা করতে পারি যেন, একথাটা সত্যি হয়। তবে সে অন্য দুজনের মতোই তার প্রদেশের সবচেয়ে কাছের সীমান্তে অপেক্ষা করছে, যেন খবর পাওয়ার এক মুহূর্তের মধ্যে রওয়ানা দেবার জন্য তৈরি থাকে।

 ‘উত্তরাধিকারত্ব তিনজনের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ায় সে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ, এ ব্যাপারে আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিতে পারি–সে কেবল তার ভাইদের উদ্দেশ্যকে ভয় পায়।

‘এধরনের ভীতির ভান করা অনেক সময় উচ্চাকাঙ্ক্ষার খোলস প্রমাণিত হয়েছে। তবে আমার বংশ রক্ষা করার জন্য আমি আর কী করতে পারি? প্রতিদিন আমার শক্তি কমে যাচ্ছে আর বৃদ্ধ বয়সের ক্লান্তি আমার মন আর দেহকে আরো অবসাদ এনে দিচ্ছে। স্মরণশক্তি মাঝে মাঝে এমনভাবে কমে যায় যে, গতকাল কি হয়েছে তা মনে করতে কষ্ট হচ্ছে। আর যৌবনের ঘটনাগুলো আরো পরিষ্কার মনে পড়ে। তুমি আমার এত যত্ন নেওয়া সত্ত্বেও আমি একাকীত্ব অনুভব করি…অপরাধ বোধের বোঝা নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে একা হয়ে যাই।’ আবার আওরঙ্গজেব মাথা এপাশ-ওপাশ করতে লাগলেন।

 ‘শান্ত হোন, জান। আপনার স্মৃতি হয়তো সামান্য কমেছে, তবে এটা অধিকাংশ মানুষের মতো এখনও তীক্ষ্ণ আছে। অন্তত ছেলেদেরকে উপদেশ দিয়েও তো আপনি চিঠি লিখতে পারেন, তাই না? ওদের সামনে যে বিপদ আপনি দেখতে পাচ্ছেন, তা এড়াতে আপনার অভিজ্ঞতা থেকে ওদেরকে আপনি সাহায্য করতে পারেন। সর্বোচ্চ ক্ষমতার পুরস্কারের সাথে সাথে কি বোঝা আর দায়িত্ব কর্তব্য চলে আসে সে ব্যপারে ওদেরকে পথ দেখান।

আওরঙ্গজেব একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘তা পারি…তবে ওরা এতে কতটুকু মনোযোগ দেবে? আর ওদের জায়গায় হলে আমিই বা ততে কি মনোযোগ দিতাম?’

উদিপুরী মহলের সাথে আলোচনার পর অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি সেই সন্ধ্যায় চিঠিগুলো লিখলেন। তারপর চিঠিগুলো একবার পড়লেন, তিন ছেলেকে আলাদা আলাদা করে লেখা চিঠি। প্রতিটি চিঠিতে তিনি তাদেরকে জোর দিয়ে বলেছেন যে, সাম্রাজ্য বিভক্ত করার তিনি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা যেন ওরা মেনে নেয়। আর তারা যেন ভালোভাবে এবং বিশ্বস্ততার সাথে শাসন করে এবং নিশ্চিত করে যেন, তাদের প্রজারা তাদের মতো ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলে। চাপা স্বভাবের মুয়াজ্জমকে আর কিছু বললেন না, তবে অন্য দুজনকে লিখার সময় তার ইচ্ছে হল মন খুলে তাদেরকে কিছু বলতে, যা এর আগে জীবনে কখনও করেন নি। আর ওরা সামনে থাকলে তো কখনও না। তার মন থেকে ভয় আর অনুতাপ হুড়মুড় করে বের হয়ে যেতেই তিনি এক ধরনের মুক্তি অনুভব করলেন। তিনি আজমকে সতর্ক করে বললেন, রাষ্ট্রনায়োকচিত আচরণ করতে আর কিছু করার আগে একটু ভেবে নিতে। বিশেষত শত্রুর মন বুঝার চেষ্টা করতে হবে–তার মনে পড়লো কথাটি তিনি অনেক বছর আগে আজমের ভাই আকবরকে বলেছিলেন। তিনি লিখলেন :

*

আমি একা এসেছি আর একজন আগন্তুকের মতো চলে যাচ্ছি। যে মুহূর্তে ক্ষমতা পেয়েছি তখন থেকে দুঃখই পেয়েছি। যে জীবন এত মূল্যবান তা আমি অপব্যয় করেছি। জীবন ক্ষণস্থায়ী। অতীত চলে গেছে আর ভবিষত্যের কোনো আশা নেই। আমি ভয় পাচ্ছি আমার পাপ মোচন হবে কি-না। আমি শাস্তির ভয় পাচ্ছি। আমি আল্লাহর রহমত আর করুণায় বিশ্বাস করি তবে আমার ভয় হয় আমি যা করেছি তার জন্য।

*

কমবখসকে লিখতে অনেক বেশি সময় লেগেছিল। কাশির কারণে মাঝে মাঝে থামতে হয়েছে, আবার শক্তি সঞ্চয় করার জন্যও থামতে হয়েছে।

*

সবসময় নিজের মনোভাব গোপন রাখবে। ভালো উপদেষ্টা বেছে নেবে, যে তোমার সক্ষমতায়, যেখানে তুমি দুর্বল সেখানে ঘাটতি পূরণ করবে। তবে তাদেরকে পুরোপুরি বিশাস করো না। মনে রেখ বিশ্বাসঘাতক সবসময় ছায়ার মধ্যে রয়েছে। কখনও নিজের ছেলেদের বিশ্বাস করো না, কিংবা খুব বেশি ঘনিষ্ঠ হইও না। কেননা আমার বাবা যদি দারা শিকোকে অতিরিক্ত প্রশ্রয় না দিতেন, তবে তার সমস্ত বিষয় এরকম ভেস্তে যেত না। আমার জানের জান, আমি একা চলে যাচ্ছি। তোমার অসহায়তার জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে। আমি যত পাপ করেছি, যত ভুল করেছি, তার পরিণতি নিজে বহন করছি। আমি এই পৃথিবীতে কিছুই নিয়ে আসি নি। আর এখন পাপের এই প্রকাণ্ড কাফেলা নিয়ে যাচ্ছি। যেদিকে তাকাই কেবল সেদিকে আল্লাহকে দেখছি। আমি ভয়ঙ্কর পাপ করেছি, জানি না কি শাস্তি আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

সবশেষে আমি তোমার মা উদিপুরী মহলকে তোমার হাওলায় তুলে দিয়ে যাচ্ছি। আমার জীবনের শেষ বছরগুলোতে তিনি আমার জন্য এক বিশাল সান্ত্বনা হয়েছিলেন। তাঁকে ভালোবেসে খুব ভালোভাবে তাঁর যত্ন নিও।

*

বেহারারা আওরঙ্গজেবকে পালকিতে করে মসজিদ থেকে তাঁকে তার ঘরের দিকে ফিরে নিয়ে চললো। শুষ্ক বাগান থেকে জোর হাওয়ায় ধুলার ছোট ছোট পেঁচালো আকৃতি উপরের দিকে উড়িয়ে নিল। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের শুক্রবার জুম্মার নামাজ পড়তে পেরে তিনি খুব খুশি হলেন। সবসময় যেরকম হতো আজও সেরকম শান্তি আর নৈতিক অনুপ্রেরণা পেলেন। ঘরের দুই-তিন গজ আগে থাকতেই তিনি বেহারাদের বললেন, ‘থাম! বাকি কয়েক পা আমি হেঁটেই যাব।’

 দুজন কোরচি তাঁকে দাঁড়াতে সাহায্য করে তার হাতে দুটো বেতের লাঠি দিল। ধীরে ধীরে তবে দৃঢ়তার সাথে হেঁটে তিনি ঘরের দিকে এগিয়ে গিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। প্রখর সূর্যের আলো থেকে কামরার আধো অন্ধকার আলোয় তার দুর্বল চোখ সয়ে নিতে এক মুহূর্ত থামলেন, তারপর হাতের ইশরায় দুই কোরচি আর অন্যান্য পরিচারককে বিদায় করলেন। তোমরা যাও। আমি এখন বিশ্রাম নেব।’

ওরা চলে যাওয়ার পর তিনি বিছানার দিকে এগিয়ে গেলেন। বিছানার কাছে পৌঁছতেই অনুভব করলেন বুকে চাপ চাপ লাগছে আর নিশ্বাস নিতে গিয়ে হাঁপাতে শুরু করলেন। বুঝলেন, তিনি মরতে চলেছেন…লাঠিগুলো ফেলে হাঁটুগেড়ে বিছানার পাশে বসে পড়লেন। সবসময় তার কোমরে গুঁজে রাখা জেড পাথরের তসবিহটা আঁকড়ে ধরলেন। তিনি এক শুক্রবারেই মারা যাচ্ছেন, যা সব সময় কামনা আর প্রার্থনা করতেন…শীঘ্রই তিনি জানতে পারবেন তার জীবন সম্পর্কে আল্লাহ তার জন্য কি রায় দিয়েছেন। বেশ কিছুসময় তিনি তাঁর শুকনো ঠোঁটে দোয়া পড়তে থাকলেন আর সেই সাথে লম্বা প্রায় হাড়সর্বস্ব আঙুল দিয়ে তসবিহ গুণে চললেন। একটু পরই তসবিহ থেমে গেল…যষ্ঠ মোগল সম্রাটের মৃত্যু হল।

.

উপসংহার

দিল্লির দরবার প্রাঙ্গণের সামনে একটি সুন্দর বাড়ির সমতল ছাদে উমর আলি বসে রয়েছে। একটি বড় ছাতা তাকে মধ্য সেপ্টেম্বরের রোদ থেকে ছায়া দিচ্ছে। আড়াই বছর আগে সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর সাথে সাথে তার রাজকীয় দেহরক্ষীদলের প্রধানের পদটিরও অবসান হয়েছিল। সাথে সাথে উমর আলি দিল্লি ফিরে এসে এই বাড়িটিতে তার একমাত্র মেয়ে আর মেয়ের জামাই এবং তাদের একমাত্র কন্যাসন্তান রেহানাকে নিয়ে থাকতে শুরু করে। উমর আলির স্ত্রী অনেক দিন হল মারা গেছে। তার মেয়ের জামাই একজন হেকিম। ছোট্ট রেহানা এখন তার হিন্দু প্রতিবেশীর পাঁচবছরের ছেলে রবির সাথে খেলা করছে।

আহমদনগর থেকে ফেরার কিছুদিন পর একের পর এক ঘটনার খবর তার কানে আসতে থাকে–যা মোটেই অপ্রত্যাশিত ছিল না আর বেশির ভাগই ছিল দুঃখজনক। সম্রাটের ছেলেরা সাম্রাজ্য বিভক্ত করা নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। শাহজাদা আজম আহমদনগরে রাজদরবারে ফিরে এসে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেন। এর তিনমাসের মধ্যে শাহজাদা মুয়াজ্জম, আজমকে যুদ্ধে পরাজিত করে তাকে হত্যা করেন। আর সেই সাথে তিনিও বাহাদুর শাহ নাম নিয়ে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেন। প্রায় একই সময়ে উদিপুরী মহল মারা যান– কথিত আছে আওরঙ্গজেবকে হারিয়ে তার শোকে তিনি মারা গিয়েছিলেন।

তার ছেলে কমবখস্ অবশ্য নিজেকে একজন শক্তিশালী এবং দৃঢ়চেতা মানুষ হিসেবে প্রমাণিত করেন, যা কেউ ভাবতে পারে নি। একজন কুশলী সেনাপতির মতো তিনি দুইবছর ধরে শাহজাদা মুয়াজ্জম আর তার সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই করেন। যখন সম্ভইরা সংঘর্ষে লিপ্ত ছিলেন, তখন সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে। মারাঠি আর শিখরা আরো শক্তিশালী হয়ে উঠে আর ‘ধূর্ত ফেরিওয়ালা’ হিসেবে যাদেরকে আওরঙ্গজেব একদিন বাতিল করেছিলেন, সেই ইংরেজরা সাম্রাজ্যের এই দুর্যোগের সময় যতটা পারে সুবিধা আদায় করে নিল। এখন থেকে ঠিক চার মাস আগে হায়দরাবাদের কাছে শাহজাদা মুয়াজ্জম অথবা সম্রাট বাহাদুর শাহ, যাকে এখন থেকে এ নামে ডাকতে হবে, শেষপর্যন্ত কমবখসূকে পরাজিত করলেন। যুদ্ধে গুরুতর আহত হয়ে পরদিন তিনি মারা যান। সিংহাসন কিংবা কফিন’-এর লড়াই, মোগল শাহজাদারা যেভাবে সিংহাসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন, যে কথা সম্রাট আওরঙ্গজেব বলতেন। কথাটি আবার সঠিক প্রমাণিত হল।

 আর কয়েকমিনিটের মধ্যে নতুন সম্রাট আওরঙ্গজেবের একমাত্র জীবিত পুত্র-দরবার প্রাঙ্গণে এসে একটি মঞ্চের উপর থেকে প্রজাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। উমর আলি তার বাড়ির ছাদের উপর থেকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। হ্যাঁ ঐ যে বর্শার ডগায় সবুজ পতাকা পত পত করে উড়িয়ে সম্রাটের কুচকাওয়াজের প্রথম অশ্বারোহী দলটি মাঠে ঢুকছে। এর পেছনে ঘোড়ায় চড়ে আসছে নাকাড়া আর শিঙ্গাবাদক আর তারপর এক রাজকীয় বিশাল হাতির চারপাশ ঘিরে আরো অশ্বারোহী আসছে। হাতির পিঠে একটি রত্নখচিত খোলা হাওদা দেখা যাচ্ছে। হাতিটি দেখে বজ্রদেব মনে হচ্ছে, কিন্তু সে নিশ্চয়ই অনেক বুড়ো হয়ে গেছে? সুন্দর আলখাল্লা আর লম্বা পাখির লেজবিশিষ্ট পাগড়ি পরে মুয়াজ্জম হাওদায় বসে রয়েছেন। তার পেছনে যে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সে নিশ্চয়ই তার প্রধান দেহরক্ষী। এই জায়গায়টি ছিল উমর আলির, যখন সে প্রায়ই আওরঙ্গজেবের সাথে হাতির পিঠে চড়তো।

একটু পরই শিঙ্গা ফুঁকতেই বাহাদুর শাহ একটু আড়ষ্ট হয়ে হাতির পিঠ থেকে নামলেন। পঁয়ষট্টি বছর বয়সী সম্রাট উমর আলির চেয়ে মাত্র কয়েক বছরের ছোট। এখন তিনি মঞ্চের দিকে যাচ্ছেন। ভাষণে তিনি কী বলবেন? তার শাসনে সাম্রাজ্য কী আবার সমৃদ্ধি লাভ করবে? তবে তার নাতনি রেহানা আর তার ছোট্ট খেলার সাথী রবির কাছে এসবের মূল্য কী?

.

ঐতিহাসিক টীকা

এম্পায়ার অফ দি মোগল সিরিজের আগের পাঁচটি পুস্তকের মতো এটি একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। অর্থাৎ, কাহিনীটি ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে রচিত হলেও এর চরিত্রগুলোর কথোপকথন, চিন্তাচেতনা এবং প্রত্যক্ষ কার্যকলাপ কল্পনাপ্রসূত। যখন আমি একটি চরিত্রের মুখে কোনো শব্দ বসাই, তখন তা এমনভাবে সাজাই যেন, চরিত্রটি সে সময়ে কি ভাবতে অথবা কি বলতে পারতো, তা এতে প্রতিফলিত হয়। অনেক সময় কথাগুলো আমার কল্পনার সম্পূর্ণ বিপরীত হতো, অর্থাৎ আমি যে ইউটোপিয়ান কিংবা স্বর্গরাজ্যের কল্পনা করতাম, যেখানে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষ পাশাপাশি শান্তিতে বসবাস করবে এবং একে অপরের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে সম্মান করবে, তার বিপরীত। বিশেষত আওরঙ্গজেবের মতো একজন বিতর্কিত চরিত্রের ব্যাপারে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যা, যথেষ্ট আবেগের বহিপ্রকাশ ঘটাবে।

 আওরঙ্গজেবের জীবন সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্যের উৎস রয়েছে। তার পূর্বপুরুষদের মতো তিনিও তার শাসনামলের প্রতিদিনকার ঘটনাপঞ্জি লিপিবদ্ধ করিয়েছিলেন। এর নাম আলমগীর-নামা আর এটি রচনা করেছিলেন মোহাম্মদ কাজিম। তবে দশ বছর শাসন করার পর আওরঙ্গজেব তাকে এটি রচনা করতে নিষেধ করলেন। কেননা তিনি মনে করতেন ঘটনাপঞ্জি রচনা এক ধরনের দাম্ভিকতা। সমসাময়িক অন্যান্য ঘটনাপঞ্জির মধ্যে ছিল : মুফাজ্জল খান রচিত তারিখ-ই-মুফাজ্জলি, এটা রচিত হয়েছিল পৃথিবীর সূচনা থেকে আওরঙ্গজেবের শাসনের দশ বছর পর্যন্ত; রাই ভর মলের লুব আল-তাওয়ারিখ-ই-হিন্দ, আরেকটি ছিল দারা শিকোর একজন সভাসদ রচিত হিন্দুস্তানের সকল শাসকের ইতিহাস। মিরাত-ই-আলম রচনা করেছিলেন বখতিয়ার খান নামে আওরঙ্গজেবের অধীনে চাকরিরত একজন খোঁজা; তবে অনেকে মনে করেন এর রচয়িতা হচ্ছেন তার বন্ধু মোহাম্মদ বাকা। ঈশ্বরদাস নগর নামে আওরঙ্গজেবের একজন সভাসদ রচনা করেছিলেন, ফুতুহাত-ই- আলমগিরি। মুনতাখাব আল-লুবাব নামে তৈমুর আর তার বংশধরদের একটি ইতিহাস গোপনে রচনা করেছিলেন কাফি খান নামে আওরঙ্গজেবের একজন সভাসদ। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর কিছুকাল পর তিনি এটি সম্পূর্ণ করেন। সিংহাসনে আরোহণের পর মুয়াজ্জমের নির্দেশে আওরঙ্গজেবের দরবারের একজন লিপিকার মাসিরি-ই-আলমগিরি রচনা করেন। এছাড়া কোনো এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি আখাম-ই-আলমগিরি নামে আওরঙ্গজেবকে নিয়ে কিছু কাল্পনিক কাহিনি রচনা করে।

ফারসি ভাষায় লেখা আওরঙ্গজেবের কিছু চিঠি সংরক্ষিত এবং অনূদিত হয়েছিল। আওরঙ্গজেবের শাসনামলে কয়েকজন ইউরোপীয় পর্যটক ভারতীয় উপমহাদেশ সফর করেছিলেন। তারা মোগল সাম্রাজ্য সম্পর্কে তাদের ধারণার কথা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এদের মধ্যে নিকোলো মানুসি স্টোরিয়া দ্য মোগল নামে একটি রঙিন খোশগল্পের মতো কাহিনি রচনা করেছিলেন। মানুসি ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে তার মৃত্যু ১৭১৭ সালে পর্যন্ত ভারতবর্ষে ছিলেন। এছাড়া ফ্রান্সিস বারনিয়ার নামে একজন ফরাসিও রচনা করেন, ট্রাভেলস ইন দ্য মোগল এম্পায়ার এবং জিন-ব্যাপিস্ট রচনা করেন ট্রাভেলস ইন ইন্ডিয়া। ১৭ শতকের শেষ দিকে মোগল সাম্রাজ্যে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যর উইলিয়াম নরিস বেশকিছু অপ্রকাশিত দিনলিপি লেখে যান, যার কিছু অংশ নিয়ে এইচ দাস রচনা করেন দি নরিস এম্ব্যাসি টু আওরঙ্গজেব।

আমার নিজের গবেষণা ছাড়াও আমি আধুনিক ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিশিষ্ট ভারতীয় ঐতিহাসিক আব্রাহাম এরালির দি মোগল গ্রেন থেকে প্রচুর বিষয়বস্তু ব্যবহার করেছি আর সেই সাথে ব্যামবার গ্যাসকোইনের দি গ্রেট মোগল, ওয়াল্ডেমার হ্যাঁনসেনের দি পিকক থ্রোন এবং কেমব্রিজ হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ার সাহায্য নিয়েছি।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে অধিকাংশ চরিত্র ইতিহাস থেকে নেওয়া হয়েছে। তবে বেশ কয়েকজন, যেমন–আমবারের জগিন্দর সিং, ওয়াজিম খান, উমর আলি, ইউসুফ খান, কামরান বেগ, রশিদ খান এবং বিবিধ গভর্নর ও অতি সাধারণ কিছু চরিত্র মূলত জনগণের অংশ কিংবা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। একই কথা নিকোলাস ব্যালেনটাইন আর আমবারের অশোক সিং সম্পর্কেও বলা যায়। এদেরও সম্পর্কে এই পুস্তকে খুব সামান্য উল্লেখ করা হলেও এই সিরিজের অন্যান্য পুস্তকে এরা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিলেন।

আওরঙ্গজেব একজন গোঁড়া সুন্নি মুসলমান ছিলেন। অবশ্য তার ধর্মীয় কর্মসূচিগুলো বিশেষভাবে বিতর্কিত ছিল। কোনো কোনো লেখক যুক্তি দেখিয়েছেন যে, হিন্দু ধর্ম এবং মন্দির বিষয়ে আওরঙ্গজেবের কর্মসূচিগুলো মূলত রাজনৈতিক বাস্তবধর্মিতা দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল এবং এগুলো পরিকল্পনা করা হয়েছিল মুখ্যত রাজনৈতিক সার্বভৌম ক্ষমতা জাহির করার উদ্দেশ্যেই। তারা বলেন যে, তাঁর জীবনের অন্য সময়ে তিনি হিন্দু মন্দিরের জন্য জমি প্রদান করেছিলেন। রাজপুতদের বিরুদ্ধে তিনি অনেক পদক্ষেপ নেন নি। তাদের বিরুদ্ধে তিনি যেসব অভিযান করেছিলেন, সেগুলো ধর্মীয় কারণে নয়, সম্ভবত তাদের সময়গত ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করার ইচ্ছে থেকেই করেছিলেন। এটি অবশ্যই সত্যি যে দ্রষ্টব্য এরালি, পৃ. ৪০১] বিখ্যাত এবং ধৈর্যশীল সম্রাট আকবরের তুলনায় আওরঙ্গজেব অনেক বেশি হিন্দু কর্মকর্তাকে চাকরি দিয়েছিলেন। তাঁকে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল কেন তিনি এত শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়কে নিয়োগ দিয়েছেন, এর উত্তরে তিনি যথেষ্ট সহনশীলতা দেখিয়ে বলেছিলেন, “জাগতিক বিষয়ের সাথে ধর্মের কী সম্পর্ক?…আপনার কাছে আপনার ধর্ম আর আমার কাছে আমার ধর্ম। দপ্তর থেকে দক্ষ কর্মকর্তা। সরানো বিজ্ঞজনেরা অনুমোদন করেন না।

 এই যুক্তির বিপরীতে অনেক ঐতিহাসিক আওরঙ্গজেবের অনেক পক্ষপাতমূলক রাজ্যশাসন প্রণালির কথা তুলে ধরেন। ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল তিনি বিধর্মীদের উপর জিজিয়া কর পুনরায় চালু করেন যা, সম্রাট আকবর মওকুফ করেছিলেন। তিনি নতুন এবং সম্প্রতি পুননির্মিত হিন্দু মন্দিরগুলো ধ্বংস করার আদেশ দেন। তিনি হোলি এবং দিওয়ালির মতো উৎসব নিষিদ্ধ করেন এবং এরালির বর্ণনা অনুযায়ী–অনুমতি ছাড়া হিন্দুদের পালকি ও আরবি ঘোড়া ব্যবহারের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়।

তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাসে একজন খাঁটি মানুষ হিসেবে আমি আওরঙ্গজেবের চরিত্র চিত্রণ করেছি এবং বিশেষত তার ধর্মীয় কর্মসূচির মধ্যে প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে এরালির রচনা অনুসরণ করেছি। প্রকৃত সত্য কি তা ইতিহাসে উপলব্ধি করা অবশ্যই কঠিন, বিশেষত যখন বিতর্কিত চরিত্রের মূল্যায়ন করা হয়–এর একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় রিচার্ড। আমার মনে হয় এটিও মনে রাখা উচিত যে, যে কালে আওরঙ্গজেব রাজত্ব করেছিলেন–সেই ১৭ শতকের ইউরোপে খ্রিস্ট ধর্মের প্রোটেস্ট্যান্ট এবং ক্যাথলিক সম্প্রদায় পরস্পরের বিরুদ্ধে নৃশংস যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, যাতে ভিন্ন ধর্মবিশ্বাসীদের নির্বিচারে হত্যা করা হত। ইংল্যান্ডে রাজা প্রথম চার্লসকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পর ইংল্যান্ডের রক্ষক’ অলিভার ক্রমওয়েল কিছু ধর্মীয় উৎসব, থিয়েটার এবং মেপোল নৃত্যের মতো আরো অনেক বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেন। তার মূর্তিপূজা-বিরোধী অনুসারীরা ক্যাথলিক প্রতিমূর্তিগুলো বিকৃত করে দেয়। ক্যাথলিক প্রার্থনা অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করা হয় এবং কোনো ক্যাথলিক কোননা দফতরের পদাধিকারী হতে পারতো না।

অন্যান্য মোগলের মতো আওরঙ্গজেব মুসলিম চান্দ্র বর্ষপঞ্জি ব্যবহার করেছেন, তবে আমি পশ্চিমা জগতের সাধারণ অব্দ অনুসরণ করেছি। আওরঙ্গজেবের শাসনকাল দীর্ঘসময় জুড়ে ছিল এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সময়ের মাপকাঠিকে ব্যবহারোপযোগী এবং সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। আর অবশ্য বর্ণনার সুবিধার উদ্দেশ্যে অনেক ঘটনা বাদ দেওয়া হয়েছে। ঐতিহাসিক টীকায় প্রকৃত তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে।

.

অতিরিক্ত টীকা

অধ্যায় :১

শিবাজির জন্মতারিখ সম্পূর্ণ নিশ্চিত নয়, তবে সাধারণত বিবেচনা করা হয় যে, ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল পশ্চিম ঘাটের শিবনেরি দুর্গে তার জন্ম হয়। শিবাজি এবং আফজাল খানের মধ্যেকার লড়াই সম্পর্কে বেশ কয়েকটি ভাষ্য রয়েছে, তবে সাধারণত বলা হয় ঘটনাটি ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দের ২০ নভেম্বর ঘটেছিল। শিবাজির আরেকটি উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব ছিল। আওরঙ্গজেব তাকে দমন করার জন্য তাঁর চাচা এবং মমতাজ মহলের ভাই শায়েস্তা খানকে পাঠান, তখন শিবাজি একটি ছোট দল নিয়ে পুনরায় শায়েস্তা খানের শিবিরে ঢুকে হেরেম পর্যন্ত পৌঁছে শায়েস্তা খানকে আহত করে পালিয়ে যান। এছাড়া ১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে শিবাজি সুরাট আক্রমণ করেন।

.

অধ্যায় : ২

আরঙ্গজেবের জন্ম ১৬১৮ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে। তাঁর পিতা সম্রাট শাহজাহানের জন্ম ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের পুত্র এবং সম্রাট আকবরের পৌত্র। এই সিরিজের পঞ্চম পুস্তক দি সার্পেন্টস টুথ-এ বর্ণিত হয়েছে, ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে যখন শাহজাহান পীড়িত হন, তখন পিতার মৃত্যুতে তাদের বড় ভাই দারাশিকোর-জন্ম ১৬১৫, সিংহাসনে আরোহণে বাধা দেবার জন্য শাহজাহানের তিন পুত্র–যথাক্রমে মুরাদ–জন্ম ১৬২৪, শাহ সুজা-জন্ম ১৬১৬ এবং আওরঙ্গজেব বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। দারা শিকো তাঁর পিতার পছন্দের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকার ছিলেন। বিশেষত আওরঙ্গজেব দারা শিকোকে একজন নব্যতান্ত্রিক বা খারেজি বিবেচনা করতেন। বিদ্রোহী তিন ভাই একটি পর্যায় পর্যন্ত ঐকমত্য ছিলেন মুরাদকে লেখা আওরঙ্গজেবের একটি চিঠি সংরক্ষিত হয়েছিল, তাতে তিনি একটি ধারণা তুলে ধরেছিলেন–কিভাবে তাদের মধ্যে সাম্রাজ্য ভাগ করবেন। মে ১৬৫৮ আগ্রা থেকে আট মাইল দক্ষিণপূর্বে সমুড়ে আওরঙ্গজেব এবং মুরাদ দারাকে পরাজিত করেন। পরিশেষে আওরঙ্গজেবের সৈন্যরা দারা শিকোকে বন্দী করে এবং ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দের আগস্টে দিল্লিতে আওরঙ্গজেব তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেন। তাঁর ছোট কবরটি দিল্লিতে সম্রাট হুমায়ুনের কবর-মঞ্চে রয়েছে।

ইতোমধ্যে আওরঙ্গজেব মুরাদকেও সরিয়ে দেন। কৌশলে তাঁকে তাঁর শিবিরে, তারপর একা তাঁর তাঁবুতে ঢুকিয়ে, সেখান থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে বন্দী করা হয় এবং তার প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়। সিংহাসনের জন্য তাঁর দাবি নিয়ে এগোবার সময় প্রথম পর্যায়ে মুরাদ তার অর্থমন্ত্রীকে হত্যা করেছিলেন, তাঁর মৃত্যুদণ্ডকে ন্যায্যতা প্রদানের জন্য এই সত্যটি ব্যবহার করা হয়। আওরঙ্গজেব বিনয়ের সাথে মন্ত্রীর পরিবারকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদেরকে ন্যায় বিচার দাবি করার জন্য আহ্বান জানান। মুসলিম আইন অনুযায়ী তারা আর্থিক ক্ষতিপূরণ কিংবা যদি তারা চায়, তবে প্রাণের বদলে প্রাণ–এই দাবি করতে পারে। মন্ত্রীর জ্যেষ্ঠ পুত্র আর্থিক কিংবা শারীরিক, যে কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়, তবে কেউ কেউ বলেন দ্বিতীয় পুত্র সম্ভবত ঘুষ খেয়ে আর্থিক ক্ষতিপূরণের অর্থ গ্রহণ না করে মুরাদের প্রাণদণ্ড দাবি করে। অবশেষে ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর মুরাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। রক্তের দাবি না করার বিষয়টিকে বিশেষভবে চিহ্নিত করে আওরঙ্গজেব বড় ছেলেটিকে পুরস্কৃত করেন।

উত্তরাধিকার নিয়ে সংঘটিত যুদ্ধে শাহ সুজা প্রথম দিকেই পরাজিত হয়েছিলেন, তবে তারপরও মাঝখানে তিনি বেশ কয়েকবার হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেন। বেশ কয়েকবার পরাজিত হওয়ার পর তিনি বাংলার পুবে আরাকানের জলদস্যু রাজার দেশে পালিয়ে যান। সেখানে সম্ভবত তাকে হত্যা করা হয়। আওরঙ্গজেবের সাথে শাহ সুজার সংঘর্ষের সময় আওরঙ্গজেবের জ্যেষ্ঠ পুত্র মোহাম্মদ সুলতান কিছু সময়ের জন্য শাহ সুজার সাথে যোগ দিয়েছিলেন। তার শাস্তিস্বরূপ আওরঙ্গজেব তাকে গোয়ালিয়রে দুর্গ-প্রাসাদে বন্দী করে রাখেন। ষোল বছর পর সেখানে তার মৃত্যু হয়। একই সময়ে আওরঙ্গজেব দারা শিকোর জ্যেষ্ঠ পুত্র সোলায়মান শেখের মৃত্যুর জন্যও দায়ী ছিলেন। মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন তাকে জোর করে বিশেষ পরিমাণে আফিমের একটি দ্রবণ–পোস্তা খাওয়ানো হত। এছাড়া দারা শিকোর দ্বিতীয় পুত্র সিফিরকেও গোয়ালিয়র দুর্গে বন্দী করে রাখা হয়।

সমুগড়ের যুদ্ধের সময় থেকেই আওরঙ্গজেবের সৈন্যরা শাহজাহানকে ঘিরে ফেলে, তারপর তাঁকে আগ্রা দুর্গে বন্দী কনে রাখে। তাঁর সর্বজ্যেষ্ঠ কন্যা জাহানারার জন্ম ১৬১৪–শুরু থেকে শেষ অবধি তাঁর পিতার সাথেই ছিলেন। তবে অন্য দুই কন্যারওশনআরা (জন্ম ১৬১৭) এবং গওহরা (জন্ম ১৬৩১) তাকে ছেড়ে চলে যান। রওশনআরা আওরঙ্গজেবের দীর্ঘকালের সমর্থক ছিলেন। এই পুস্তকে উল্লেখ করা শাহজাহানের সকল সন্তানের মাতা মমতাজ মহল গওহরাকে জন্ম দিতে গিয়ে ১৬৩১ খ্রিস্টাব্দের জুনে বোরহানপুরে মারা যান। তাঁর মৃত্যু শাহাজাহানের মনে গভীর দাগ কাটে, তিনি তাঁকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। আর আমার বিশ্বাস তার সন্তানরাও একইভাবে শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তাঁকে তাজমহলে সমাহিত করা হয়, যা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভালোবাসার স্মৃতিসৌধ।

আওরঙ্গজেব অত্যন্ত সাধারণ একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জুলাই ১৬৫৮ সিংহাসনে আরোহণ করেন। পরবর্তীতে দিল্লিতে ১৫ জুন, ১৬৫৯ অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে তাঁর অভিষেক হয়।

শাহজাহানের বন্দী হয়ে কারাগারে থাকার প্রথম বছরে পিতা-পুত্রের মধ্যে পত্র বিনিময় হয়। শাহজাহানের তরফের চিঠিগুলো কেবল ভর্ৎসনায় পরিপূর্ণ ছিল আর আওরঙ্গজেব তার চিঠিতে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর কাজের স্বপক্ষে যুক্তি দেখান। একটি চিঠিতে আওরঙ্গজেব সরাসরি মূলে চলে আসেন। একজন অবহেলিত সন্তানের গভীর দুঃখ নিয়ে তিনি লিখেন, জাঁহাপনা, আমি স্থির নিশ্চিত ছিলাম যে, আপনি আমাকে ভালোবাসেন না। তিনি শাহজাহানকে নিজের ভ্রাতৃহত্যার জন্য বিদ্রূপ করেন। আমার মনে হয় আরঙ্গজেবের বিশ্বাস যে, তাকে তার পিতা ভালোবসেন না আর মাকে হারাবার শোকই তার চরিত্রের মূল চাবিকাঠি।

জানুয়ারি ১৬৬৬ শাহজাহান শেষবারের মতো আগ্রা দুর্গে অসুস্থ হয়ে পড়েন। কোনো কোনো বর্ণনা মতে, তিনি যখন বুঝতে পারলেন যে, তিনি মারা যাচ্ছেন তখন তিনি তাঁকে কাছের বেলকনিতে নিয়ে যেতে বললেন, যাতে সেখান থেকে সহজে তাজমহল দেখতে পারেন। সেখানেই কাশ্মিরি শাল গায়ে জড়িয়ে, পাশে ক্রন্দনরত জাহানারাকে নিয়ে তিনি ২২ জানুয়ারি ১৬৬৬ ভোরে মারা যান। পরিচারকরা কর্পূরের পানিতে তাঁকে গোসল করাল, তারপর মলিন কাফনে তার দেহ জড়িয়ে একটি চন্দনকাঠের কফিনে শোয়াল। পরদিন সকালে নিচের তলায় একটি নতুন ফটক খুলে প্রথানুযায়ী আগে মাথা দিয়ে তাঁকে নদীর তীরে নিয়ে যাওয়া হল। তারপর গুটিকয়েক শবানুযাত্রীসহ নৌকাবেয়ে যমুনা নদী পার হল।

 জাহানারা জাঁকজমক এবং যথাযথ সম্মানের সাথে তাঁর পিতাকে দাফন করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেন নি। আওরঙ্গজেব রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁকে দাফনের অনুমতি দেন নি। দোয়া পড়ার সাথে সাথে বৃদ্ধ সম্রাটের মৃতদেহ অত্যন্ত দ্রুত এবং নীরবে তাজমহলের ভূগর্ভস্থ মার্বেল পাথরের কক্ষে মমতাজের পাশে সমাহিত করা হয়। আমার বিশ্বাস শাহজাহান তার নিজের জন্য যমুনার অপর পাড়ে মাহতাব বাগ নামে একটি সুন্দর চন্দ্রালোকিত বাগানে আলাদা একটি চমৎকার সমাধিসৌধ নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন।

১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে দিল্লি দখলের সময় পারস্যসম্রাট নাদির শাহ ময়ূর সিংহাসন তুলে পারস্যে নিয়ে যান। তারপর এটি অদৃশ্য হয়ে যায়, সম্ভবত সেটা ভেঙ্গে ফেলা হয়। পরবর্তীতে পারস্যসম্রাটরা যে ময়ূর সিংহাসনে বসতেন সেটা ১৯ শতকে নির্মাণ করা হয়। এর সাথে মোগল ময়ূর সিংহাসনের কোনো সম্পর্ক নেই। এছাড়া নাদির শাহ মোগল কোষাগার থেকে বিখ্যাত কোহিনূর হীরাটিও তার সাথে নিয়ে যান। এই হীরা গোলকুন্ডার হীরার খনি থেকে উত্তোলন করা হয়েছিল। ১৯ শতকের শেষ দিকে দক্ষিণ আফ্রিকায় হীরা আবিষ্কৃত হওয়ার আগপর্যন্ত গোলকুন্ডাই একমাত্র হীরার খনি ছিল। কথিত আছে, গোয়ালিয়রের রাজপরিবারের সদস্যরা এই হীরাটি ভবিষ্যৎ সম্রাট হুমায়ুনকে দিয়েছিলেন। পানিপথের যুদ্ধে প্রথম মোগল সম্রাট বাবর যখন উত্তর-পশ্চিম ভারত দখল করে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করছিলেন, তখন গোয়ালিয়রের রাজা পরাজিত পক্ষের হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে নিহত হন। পরবর্তীতে হুমায়ুন রাজপরিবারের সাথে ভালো ব্যবহার করায়, কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হীরাটি তাঁর হাতে তুলে দেন। এই সিরিজের দ্বিতীয় পুস্তক ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার-এ উল্লেখ করা হয়েছে যে, পরবর্তীতে হুমায়ুন হীরাটি পারস্যের শাহের হাতে তুলে দেন, যাতে সিংহাসন পুনরুদ্ধারের সময় তিনি পারস্যের সমর্থন পান। তারপর অবশ্য রত্নটি আবার হিন্দুস্তানে ফিরে আসে এবং শাহজাহানের রত্ন ভাণ্ডারে স্থান পায়। ফরাসি রত্নকার টেভ্যরনিয়ের এটা সেখানে দেখে এর প্রশংসা করেন। নাদির শাহই এই রত্নটির নাম রাখেন কোহিনূর-’জ্যোতির পর্বত’। নাদির শাহ নিহত হওয়ার পর একজন পারসিক সেনাপতি হীরাটি আফগানিস্তানে নিয়ে যান। সেখানে তিনি নিজেকে একজন শাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৯ শতকের প্রথম দিকে তার একজন বংশধর শাহ শুজাহ পলাতক অবস্থায় থাকাকালে হীরাটি পাঞ্জাবের শাসক রণজিত সিংকে দেন। রণজিত সিং তার ব্রেসলেটে হীরাটি পরতেন। ব্রিটিশরা পাঞ্জাব দখল করার পর গভর্নর-জেনারেল হীরাটি রানি ভিক্টোরিয়ার কাছে পাঠিয়ে দেন, তারপর সেটি ব্রিটিশ রাজার মুকুটের একটি অংশে পরিণত হয়।

৪ এপ্রিল ১৬৪৪ এক দুর্ঘটনায় জাহানারার মুখ ভীষণভাবে আগুনে পুড়ে গিয়েছিল। তার মুখের পোড়া দাগটির কথা আওরঙ্গজেবের তখনও মনে ছিল। শাহজাহানের একটি ঘটনাপঞ্জিতে বিষয়টি এভাবে তুলে ধরা হয়েছে :

…কামরার মাঝখানে মাটিতে রাখা একটি জ্বলন্ত প্রদীপের সাথে তাঁর পোশাকের আঁচল ঘষা লাগলো। রাজপ্রাসাদের মেয়েদের পোশাক অত্যন্ত সূক্ষ্ম কাপড় দিয়ে তৈরি করা হত আর তাতে সুগন্ধি তেল মাখা হত। কাজেই তার পোশাকে আগুন লাগবার সাথে সাথে পুরো দেহের পোশাকে আগুনের শিখা ছড়িয়ে পড়লো। তার কাছেই চারজন পরিচারিকা ছিল, তারা সাথে সাথে আগুন নেভাতে চেষ্টা করলো। তবে পুরো পোশাকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকায় ওদের চেষ্টায় কোনো কাজ হল না। পুরো ঘটনাটি এত দ্রুত ঘটেছিল যে, কাউকে জানিয়ে পানি আনার আগেই আমার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রিয়জনের পিঠ হাত আর শরীরের দুইপাশ ভয়ঙ্করভাবে পুড়ে গেল।

.

অধ্যায় :৩

আওরঙ্গজেব যে তৈমুরের আংটি পরতেন, সেই তৈমুর (১৩৩৬-১৪০৫) পশ্চিমাবিশ্বে টমবুরলেইন নামে পরিচিত। তৈমুর দি লেইম’ নামটি বিকৃত হয়ে টমবুরলেইন হয়েছে। ক্রিস্টোফার মার্লোর নাটকে তাকে “ঈশ্বরের গজব’ হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়েছে। তিনি একজন বিখ্যাত যোদ্ধা ছিলেন। পশ্চিমা জগতের অধিকাংশ এবং মধ্য এশিয়া তিনি বিজয় করেন। ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি দিল্লি আক্রমণ করে তছনছ করে দেন। তার রাজধানী সমরকন্দকে সুন্দর করে সাজানার জন্য তিনি এখান থেকে প্রচুর রত্ন এবং কারিগর সাথে নিয়ে ফিরে যান। প্রকৃতপক্ষে তিনি প্রথম মোগল সম্রাট বাবরের একজন পূর্বপুরুষ ছিলেন। চেঙ্গিস খাও তা-ই ছিলেন।

 ১৬৬৬’র মে মাসে শিবাজি আগ্রা আসেন। আওরঙ্গজেব তাকে বন্দী করে। ওই বছরের আগস্টের শেষে তিনি একটি বেতের ঝুড়িতে লুকিয়ে পালিয়ে যান। আওরঙ্গজেব তার মতো সাধারণ পোশাক পরার অনুশাসন মেনে চলার বিষয়ে তার সভাসদদের উপর কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। একবার একজন সভাসদ একটি পোশাক পরে তার সামনে হাজির হন, যার ঝুল অনেক লম্বা ছিল এবং সম্রাটের চোখে অতি অলঙ্কৃত ছিল। আওরঙ্গজেব সাথে সাথে তার সামনে পোশাকের ঝুল কাটার নির্দেশ দিলেন।

এই সিরিজের আগের পুস্তকগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে, মোগল সম্রাটরা ঝরোকা বেলকনি থেকে প্রজাদের সামনে দর্শন দিতেন। এই প্রথা আওরঙ্গজেব বাতিল করলেন। তিনি এ-ধরনের দর্শন দেওয়াকে সম্রাটকে পূজা করার খুব কাছাকাছি একটি প্রথা মনে করতেন।

তাঁর ধর্মে মানুষ এবং প্রাণীর প্রতিকৃতি আঁকার বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করা হলেও, আওরঙ্গজেব ছবি আঁকার অনুমতি দিয়েছিলেন এবং সম্রাটের নিজের আঁকা অপরূপ সুন্দর দু-একটি ক্ষুদ্রাকৃতির চিত্রকর্ম পাওয়া যাওয়ার কথা শোনা গেছে।

সম্রাট জাহাঙ্গীরের উপর তাঁর ধূর্ত সম্রাজ্ঞী নূরজাহান কিরকম প্রভাব বিস্তার করেছিলেন এবং কিভাবে তিনি তাঁকে আফিম সেবন আর সুরা পানে অভ্যস্ত করে তুলেছিলেন, তা বিশদভাবে এই সিরিজের চতুর্থ পুস্তক–দি টেইটেড থ্রোনে উল্লেখ করা হয়েছে। একইভাবে বর্ণিত হয়েছে–কিভাবে ভবিষ্যতে ভালো আচরণ করার নামে তাঁদের পিতা শাহজাহান তাঁদেরকে জিম্মি করে রেখেছিলেন।

.

অধ্যায় : ৪

আজম এবং জানির বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় জানুয়ারি ১৬৬৯। মুয়াজ্জমের জন্ম অক্টোবর ১৬৪৩, আজমের জুন ১৬৫৩ এবং আকবরের সেপ্টেম্বর ১৬৫৭।

আওরঙ্গজেব বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকজন স্ত্রী গ্রহণ করেছিলেন। এই কাহিনিতে তিনজনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তারা হচ্ছেন–দিলরাস বানু, নওয়াব বাঈ এবং উদিপুরী মহল। দিলরাস বানু ছিলেন পারস্যের সাফাভিদ রাজবংশের একজন শাহজাদী। তিনি ছিলেন শাহজাদি জেবুন্নিসা এবং জাবতুন্নিসার মাতা, যাদের কথা এই পুস্তকে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া তিনি শাহজাদা আজম ও আকবরেরও মাতা ছিলেন। অক্টোবর ১৬৫৭ পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে তিনি আকবরকে জন্ম দেবার একমাস পর মৃত্যুবরণ করেন। সম্ভবত প্রসবকালীন কোনো জটিলতা হয়েছিল। একজন কাশ্মিরি রাজকুমারী-নওয়াব বাঈ ছিলেন শাহজাদা মুয়াজ্জম ও মোহাম্মদ সুলতানের মাতা, যাকে তার পিতা কারারুদ্ধ করে রেখেছিলেন। তিনি ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে মারা যান।

উদিপুরী মহলের বংশ সম্পর্কে বেশ কয়েকটি বর্ণনা রয়েছে। আমি সেই ভাষ্যটি অনুসরণ করেছি, যাতে বলা হয়েছে–তার জন্ম ককেশাস পর্বত এলাকার প্রাচীন জর্জিয়া রাজ্যে। আরো অনেক বিশিষ্টতার মধ্যে দাবি করা হয়–এরাই প্রথম মদ আবিষ্কার করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ অব্দে এখানে প্রথম মদ চোলাই করা হয়। উদিপুরী মহল সম্পর্কে অন্যান্য বিবরণে জানা যায়– তিনি যোধপুর অথবা কাশ্মির থেকে এসেছিলেন। দিলারা বানুর মৃত্যুর পর তিনি আওরঙ্গজেবের প্রিয়তমা স্ত্রীতে পরিণত হন।

আওরঙ্গজেব যেসব উল্লেখযোগ্য ভবন নির্মাণ করেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল–আওরঙ্গাবাদে দিলরাস বানুর জন্য নির্মিত বিবি কা মকবরা’ নামে একটি সমাধিসৌধ। এর সাথে তাজমহলের কিছুটা মিল রয়েছে। এই ভবনের নকশার পরিকল্পনা অনুমোদন করার সময় আওরঙ্গজেব সম্ভবত তাঁর প্রিয় মাতা মমতাজের সমাধির কথা বিবেচনা করেছিলেন। নকশাটি তৈরি করেছিলেন ওস্তাদ আহমেদ লাহোরীর পুত্র আতাউল্লাহ। ওস্তাদ আহমেদ লাহোরী তাজমহলের প্রধান নকশাকার হিসেবে স্বীকৃত।

 সম্ভবত সর্বাধিক সুন্দর যে ভবনটি আওরঙ্গজেব নির্মাণ করেছিলেন, সেটি হল মোতি মসজিদ। নিজের ব্যবহারের জন্য দিল্লির লাল কেল্লার ভেতরে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে এটি তিনি নির্মাণ করিয়েছিলেন। আমি প্রথম যখন ভারত ভ্রমণে গিয়েছিলাম, তখন সহজেই এই মসজিদে যাওয়া যেত। এটি সত্যিই চমৎকার একটি স্থাপনা।

আওরঙ্গজেব যেসব ধর্মীয় বিধান বলবৎ করেছিলেন, তা এরালি রচিত দি মোগল থ্রোন পুস্তকে বর্ণিত হয়েছে। জাহানারা এর প্রতিবাদ করেছিলেন। গোকলার অভ্যুত্থান হয় ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে এবং তার ভয়াবহ পরিণতি হয়। এই লড়াইয়ে আওরঙ্গজেবের অংশগ্রহণের বিষয়টি কাল্পনিক।

 মানুসি এবং বেরনিয়ার উভয়েই রওশনআরার মদ পান এবং প্রণয়ঘটিত ব্যাপারটি বর্ণনা করেছিলেন। তাদের মতে একবার তিনি গোপন প্রেমিকসহ ধরা পড়েছিলেন। এই প্রেমিকদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। উদিপুরী মহলের গর্ভে কমবখশের জন্ম হয় মার্চ ১৬৬৭ খ্রি.।

.

অধ্যায় : ৫

রওশনআরা মারা যান সেপ্টেম্বর ১৬৭১ খ্রিস্টাব্দে। কেউ কেউ অভিযোগ করেছিলেন আওরঙ্গজেব তাকে বিষ প্রয়োগ করেছিলেন, তবে এই অভিযোগের স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নি।

 সতনামি বিদ্রোহ ঘটে ১৬৭২ খ্রিস্টাব্দে। সতনামিদের প্রথা এবং তাদের জাদুফুৎকারিণীর বর্ণনা ঐতিহাসিক সূত্র থেকে নেওয়া হয়েছে। তাদের সম্পর্কে আরো পরিষ্কারভাবে ঈশ্বরদাস নগর লিখেছেন, “এরা অত্যন্ত নোংরা, অশুচি এবং নিম্নশ্রেণির মানুষ ছিল। এরা হিন্দু ও মুসলমানদের মাঝে কোনো ভেদাভেদ করতো না। এরা নোংরা শূকর ও অন্যান্য নিষিদ্ধ খাবার খেত। তাদের সাথে একই পাত্র থেকে একটি খাবার খেলে তারা কিছু মনে করতো না, ঘৃণা করতো না। লাম্পট্য ও ব্যভিচারকে তারা পাপ মনে করতো না। আওরঙ্গজেব তাঁর লোকদের মনোবল বাড়াবার জন্য তাঁর নিজের তরফ থেকে তন্ত্রমন্ত্র–দোয়া-কালাম লিখে পতাকায় সেলাই করিয়েছিলেন। তাদের সাথে সরাসরি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়া কিংবা নিজ হাতে জাদুকরীকে গুলি করে মারার বিষয়টি কাল্পনিক।

 সিফির শিকো এবং জাবতুন্নেসার মধ্যে বিয়ে হয় ১৬৭৩ খ্রি.।

.

অধ্যায় : ৬

 আওরঙ্গজেব ও তার ভাইদের মাঝে গৃহযুদ্ধ চলার সময় মারওয়াড়ের জশবন্ত সিং বেশ কয়েকবার পক্ষ বদল করেন। এজন্য তার প্রতি আওরঙ্গজেবের আস্থা ছিল না। তিনি ডিসেম্বর ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে খাইবার গিরিপথে তার সদর দফতরে মারা যান। উত্তরাধিকার নিয়ে বিভিন্ন ঘটনা এবং রাজপুতদের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য আওরঙ্গজেব মারওয়াড়ের বিরুদ্ধে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, তা অনেক বিস্তৃত এবং জটিল ছিল; তবে কেবল প্রয়োজনীয় এবং সঠিক বিষয়গুলো এখানে তুলে ধরা হয়েছে।

আওরঙ্গজেব জিজিয়া কর পুনরায় আরোপ করার কিছু দিন পর–১২ এপ্রিল ১৬৭৯ খ্রি. দিল্লিতে একটি ভূমিকম্প হয়।

.

অধ্যায় : ৭

 জুন ১৬৭৪ খ্রি., শিবাজির জাঁকজমকপূর্ণ রাজ্যাভিষেক হয়। এর বিবরণ তৎকালীন ঘটনাপঞ্জির বিবরণ থেকে নেওয়া হয়েছে।

.

অধ্যায় : ১০

এপ্রিল ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে শিবাজি মারা যান। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র সম্ভাজি তার বিষয় সম্পত্তির একটি বর্ণনাপূর্ণ তালিকা তৈরি করেন। এতে রত্ন ছাড়াও প্রায় ১০০,০০০টি সোনালি এমব্রয়ডারি করা কাপড়, ৪০০,০০০টি রেশমি কাপড়, ৬৮০০ কিলোগ্রাম মরিচ, ২,২০০ কিলোগ্রাম তিমি মাছের অন্ত্ৰজাত মোমজাতীয় তীব্র সুগন্ধি, ৪৫০০ কিলোগ্রাম আবীর–বসন্ত উৎসবে (হোলি) ব্যবহৃতব্য লাল রংজাত গুঁড়ো পদার্থ, ৪৫ কিলোগ্রাম বারুদ, ৩১,০০০টি ঘোড়া, ৩০০০টি উট এবং ৫০০টি হাতি প্রাপ্ত হন।

.

অধ্যায় ১১

আকবর জানুয়ারি ১৬৮১ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহী হয়ে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেন।

.

অধ্যায় : ১২

এখানে যেভাবে পিতার বিরুদ্ধে আকবরের যুদ্ধাভিযান তুলে ধরা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে তার চেয়েও দীর্ঘদিন ধরে চলেছিল; তবে আওরঙ্গজেব ঠিকই আকবরের সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে দিয়ে তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য নকল চিঠি ব্যবহার করেছিলেন। এছাড়া তিনি তাহাব্বুর খানকে ভয় দেখিয়ে বলেছিলেন যে, যদি সে আকবরের সঙ্গ ত্যাগ না করে তবে তার পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়া হবে। আওরঙ্গজেব তার একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, যদি তোমার কোনো শত্রুকে ধ্বংস করতে চাও, তবে ব্যর্থ না হতে চাইলে কোনো কিছুই বাদ দিও না। সরাসরি উন্মুক্ত যুদ্ধে প্রতারণা, অজুহাত, কোনো কিছুর জন্য মিথ্যা প্রতিশ্রুতি–সবকিছুই চলে। তোমার পরিকল্পনা সফল করতে হলে এই দুনিয়ায় যত ধরনের ছলচাতুরী আছে সব ব্যবহার কর।

 আওরঙ্গজেব ঠিকই তাঁর মেয়ে কবি জেবুন্নিসাকে তার ভাই আকবরকে সমর্থন দেওয়ার কারণে তাকে বাকি জীবন কারাগারে বন্দী করে রেখেছিলেন। পুস্তক সংগ্রহ এবং জ্ঞানী ব্যক্তিদের উৎসাহ দেবার ব্যাপারে তার এত আগ্রহ ছিল যে, তিনি এমন একটি গ্রন্থাগার গড়ে তুলেন যা, ‘কোন মানুষ কখনও দেখেনি।

 বিদ্রোহী আকবর ১৬৮১ খ্রিস্টাব্দে সম্ভাজির সাথে যোগ দেন। মারওয়াড়ের দুর্গাদাস তাঁকে দক্ষিণে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন।

একদিকে মারওয়াড় ও মেবার এবং অন্যদিকে মোগল সাম্রাজ্যের মধ্যে শান্তি পুনপ্রতিষ্ঠিত হলেও, তাদের সম্পর্ক সবসময় আন্তরিকতাশূন্য ছিল না। আগের মতো ওরা পরস্পরের এত কাছাকাছি আর ছিল না। এরপর খুব কম রাজপুতই মোগল সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়।

.

অধ্যায় : ১৪

 জাহানারা ১৬৮১ খ্রিস্টাব্দে মারা যান। তাঁর শেষ ইচ্ছানুযায়ী তাঁকে দিল্লির একজন সুফি সাধকের কবরের কাছে একটি অতি সাধারণ কবরে দাফন করা হয়। তার নিজ হস্তে রচিত একটি ফার্সি পঙক্তি তার কবরের ফলকে খোদাই করা আছে :

 “শুধু সবুজ ঘাস যেন আমার সমাধি ঢেকে রাখে,
নম্র ও ধৈর্যশীলের সমাধি ঢেকে রাখার জন্য ঘাসই সর্বোত্তম।”

.

অধ্যায় : ১৬

গোলকুন্ডার আদিল হাসান ও অন্য শাসকদের লুচ্চামি সম্পর্কে বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক বিবরণ রয়েছে।

সেপ্টেম্বর ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দের বিজাপুর আত্মসমর্পণ করে। যারা সাহস করে বিজাপুর দুর্গের পরিখায় যথেষ্ট পরিমাণে বিভিন্ন দ্রব্য, এমনকি মৃতদেহও ছুঁড়ে ফেলেছিল, তাদেরকে আওরঙ্গজেব পুরস্কৃত করেন।

.

অধ্যায় : ১৭

গোলকুন্ডা দরবারের সাথে যোগাযোগ করার কারণে আওরঙ্গজেব আসলেই মুয়াজ্জমকে কারাদণ্ড দেন।

 সেপ্টেম্বর ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে গোলুন্ডার পতন হয়, যখন একজন আফগান বিশ্বাসঘাতক উৎকোচ গ্রহণ করে একটি ছোট মোগল সেনাদলকে একটি ছোট ফটকের মধ্য দিয়ে দুর্গে ঢোকার সুযোগ করে দেয়। আদিল হাসানকে যখন বন্দী করা হয় তখন তিনি যে নির্লিপ্ততা দেখিয়েছিলেন, তা সত্যি ছিল। গোলকুন্ডা বিজয়ের পর মোগল সাম্রাজ্য সর্বকালের সর্ববৃহৎ বিস্তৃতি লাভ করে। এর এলাকা ছিল ৩২, ০০০০০ বর্গ কিলোমিটার বা ১২৫,০০০০০ বর্গ মাইল। জনসংখ্যা ছিল এক থেকে দেড় কোটি।

.

অধ্যায় : ১৮/১৯

 কবি-কুলেশের সাথে সম্ভাজির গ্রেফতারের ঘটনাটি ঘটে ১৬৮৯ খ্রিস্টাব্দের প্রথমভাগে। ঘটনাটি যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, প্রায় সেরকমই ঘটেছিল। ১৬৮৯ খ্রিস্টাব্দের মাচের শেষদিকে তাদেরকে দাক্ষিণাত্যের গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়ে দেখান, আওরঙ্গজেবের সামনে হাজির হওয়া, অত্যাচার আর মৃত্যুর ঘটনাগুলো ঐতিহাসিক সূত্র থেকে, বিশেষত কাফি খানের বর্ণনা থেকে নেওয়া হয়েছে। মানুচি আরো বীভৎস বর্ণনা দিয়েছেন, যা এখানে উল্লেখ করা হয় নি।

.

অধ্যায় : ২০

স্যর উইলিয়াম নরিস তার রাজার কাছে চিঠির মাধ্যমে তার প্রতিবেদন পাঠান নি। তবে তার কথিত ‘চিঠিটি’তে উল্লেখ করা তারিখগুলো সঠিক ছিল। সেই সাথে তার ভ্রমণের বিষয়বস্তু, আওরঙ্গজেবের সাথে যেখানে সাক্ষাৎ করেছিলেন, মারাঠা, জাট আর শিখদের সম্পকে বিবরণ, ১৬৯৫ খ্রিস্টাব্দে মুয়াজ্জমের কারামুক্তি এবং কমবখশের অস্থায়িভাবে কারাবরণের ঘটনাগুলো সঠিক ছিল। ভিড়ের মধ্য দিয়ে চলতে চলতে আওরঙ্গজেবের ডানে বামে না তাকিয়ে একটি বই পড়ে চলার বিবরণটি নরিসের নিজস্ব বিবরণের খুব কাছাকাছি। হেনরী এভারিকে প্রকৃতপক্ষে ইতিহাসের সবচেয়ে সফল জলদস্যু বলা হয়, সে কখনও ধরা পড়ে নি। উইলিয়াম কিডকে লন্ডনের ওয়াপিং জাহাজঘাটায় মে ১৭০১ খ্রিস্টাব্দে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। আর তার আলকাতরা মাখা নাবিকের দেহটি একটি লোহার খাঁচায় ভরে টেমস নদীর তীরে প্রদর্শন করা হয়, যাতে অন্যরা সাবধান হয়।

চিঠি লেখার সময় নরিস হয়তো মনে করেছিলেন তিনি ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় উইলিয়ামকে উদ্দেশ্য করে লিখছেন। তার জানার কথা নয় যে রাজা মার্চ ১৭০২ খ্রিস্টাব্দে মারা গিয়েছিলেন আর তার পরিবর্তে রানি এনি সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। নরিসের পূর্ব ধারণা মতে ইংল্যান্ডে পৌঁছার আগে ১০ অক্টোবর ১৭০২ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যু বরণ করেন।

.

অধ্যায় : ২১

 গওহরা মারা যান ১৭০৬ খ্রিস্টাব্দে। বিদ্রোহী আকবর পারস্যে নির্বাসিত অবস্থায় ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে মারা যান। জেবুন্নিসার কারাগারে মৃত্যু হয় ১৭০২– খ্রিস্টাব্দে।

.

অধ্যায় : ২২

 আজমকে লেখা চিঠির অনুচ্ছেদটি, প্রকৃতপক্ষে তাকে উদ্দেশ্য করে লেখা আওরঙ্গজেবের একটি চিঠির অনুবাদ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। একইভাবে কম বখশকে লেখা চিঠির প্রথম অনুচ্ছেদটি আসলেই সর্বকনিষ্ঠ পুত্রকে উদ্দেশ্য করে লেখা আওরঙ্গজেবের একটি চিঠি থেকে নেওয়া হয়েছে।

আওরঙ্গজেব শুক্রবার ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে ফজরের নামাজের পর ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী তাকে খুলদাবাদে একটি সাধারণ সমাধিতে দাফন করা হয়। লাল বেলেপাথরের কবরটির উপর কোনো কিছু উত্তীর্ণ করা নেই। যে ধরনের বিশাল সমাধিসৌধে হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর এবং শাহজাহানকে সমাহিত করা হয়েছে, তা থেকে এটি অত্যন্ত ভিন্ন ধরনের। তবে আফগানিস্তানের কাবুলে একটি পাহাড়ের পাশে প্রথম সম্রাট বাবর এবং দিল্লিতে তার আদরের বোন জাহানারার অতি সাধারণ কবরের সাথে এর মিল রয়েছে।

.

উপসংহার

আজম, কমবখস্ এবং উদিপুরী মহলের মৃত্যু এবং বাহাদুর শাহ নাম নিয়ে মুয়াজ্জমের সিংহাসনে আরোহণের ঘটনাগুলো নির্ভুল। বাহাদুর শাহ পাঁচ বছরেরও কম সময় শাসন করতে পেরেছিলেন।

মূল চরিত্রসমূহঃ
আওরঙ্গজেবের পরিবার

মা-বাবা :
 মমতাজ মহল
 সম্রাট শাহজাহান

ভাই :
 দারা শিকো
শাহ সুজা
মুরাদ

বোন :
জাহানারা
রওশনআরা
গওহারা

স্ত্রী :
দিলরাস বানু
নওয়াব বাঈ।
উদিপুরী মহল

পুত্র :
মোহাম্মদ সুলতান} (নওয়াব বাঈর পুত্র)
 মুয়াজ্জম
আজম} (দিলরাস বানুর পুত্র)
আকবর}
কমবক্স (উদিপুরী মহলের পুত্র)

কন্যা :
 জেবুন্নিসা} (দিলরাস বানুর কন্যা)
জেবাতুন্নিসা}

ভ্রাতুস্পুত্র :
সুলায়মান} (দারাশিকোর পুত্র)
সিফির}

ভ্রাতুস্পুত্রী :
জানি, দারা শিকোর কন্যা
 সেনাপতি, সভাসদ এবং রাজপ্রাসাদের বিভিন্ন কর্মকর্তা :
জসবন্ত সিং, মারওয়াড়ের রাজা এবং মোগল সেনাবাহিনীর সেনাপতি
আবু হাকিম, উলামাদের প্রধান
ওয়াজিম খান, আওরঙ্গজেবের গুপ্তচর প্রধান।
 উমর আলি, আওরঙ্গজেবের দেহরক্ষী বাহিনীর প্রধান
কামরান বেগ, আওরঙ্গজেবের প্রধান চর
আওরঙ্গজেবের প্রধান প্রতিপক্ষ :
শিবাজি, মারাঠি নেতা
সম্ভাজি, শিবাজির পুত্র
রাজারাম, শিবাজির দ্বিতীয় পুত্র
কবি-কুলেশ, সম্ভাজির একজন সেনাপতি
 গোকলা, জাট নেতা
আদিল হাসান, গোলকুন্ডার শাসক
সিকান্দার, বিজাপুরের শাসক

অন্যান্য চরিত্র :
আমবারের রাজা
জগিন্দর সিং, আমবারের রাজার পুত্র
 মেওয়াড়ের রানা
 তাহাব্বুর খান, আকবরের বন্ধু ও ঘনিষ্ঠজন
দুর্গাদাস, মারওয়াড়ের রাজপ্রতিভূ
সন্তাজি, মারাঠি যুবক।
স্যর উইলিয়াম নরিস, মোগল দরবারে ইংল্যান্ড থেকে আগত রাষ্ট্রদূত
তেগ বাহাদুর, শিখ নেতা

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *