২২. জমিদার আর কালেক্টর

জমিদার আর কালেক্টর

আমি এর আগে বলেছি কেমন করে আমার জোত বেদখল হয়ে যায়। আমার তকলিফ নিয়ে আমি দোস্ত শুনতা ক্যা’র কাছেও দরবার করি। নতিজা কী হয়েছিল তা এর পরে ধীরে ধীরে জানতে পারবেন।

যে কষ্টের কথা বলছি তা স্রেফ আমার একার নয়। আর্দালির কাজ সামলাতে সামলাতে এমন বহু মামলা আমার নজরে এসেছে যা বললে আপনাদের মনে হবে আমি বানিয়ে বানিয়ে এই দর্দভরা কাহানি শোনাতে বসেছি। যাঁরা কেবল কাহানির তলাশ করেন এই ঘটনাগুলো তঁাদের জন্য নয়। আমি যা পেশ করতে যাচ্ছি তাকে আপনারা নাঙ্গা সাচ্চাই বলতে পারেন। গ্রামের নাম টান্ডা (Tandah)। সেই গ্রামের বাসিন্দা ছিল ভবানী সিং। এক মালদার কিষান। তার পরদাদারা ছিল ওই গ্রামেরই জমিদার। জুনাটিন ডানকিন বাহাদুর (Joonateen Dunkeen Bahadoor) যখন মাশুল বন্দোবস্ত চালু করলেন তখন ভবানীর বাপ সেই ব্যবস্থায় শামিল হতে চাইল না। তার মনে হয়েছিল এই বন্দোবস্তে রাজি হলে তাদের অনেক বেশি মাশুল গুনতে হবে। আমি যে সময়ের গপ্প শোনাব তখন ভবানী সিং স্রেফ পঞ্চাশ বিঘা খুব খাসা জমির রায়ত, চারধারে একবার নজর ঘোরালেই যা মালুম হয়। জমির মালগুজারি ছিল বিঘা পিছু ১ টাকা ৮ আনা বা সালিয়ানা ৭৫ রুপিয়া। টান্ডাই-এর তখন যে জমিদার তার দৌলত ও কিছু কম নয়। সরকারের পাওনা সময় মাফিক সে মিটিয়ে দিত। কিন্তু ওই তালুক যে কতটা ফয়দামন্দ তা উকিল আর আমলারাও বেশক জানত। এবার শুরু হল সাজিশ, কী করে ওই তালুক হাতানো যায়। এমন কায়দা ইস্তেমাল করতে হবে যাতে তারাই কিনে নিতে পারে পুরো জমিদারি।

আহেলাদের একটা রেওয়াজ আছে যতই দৌলত থাকুক না কেন কিছুতেই তারা কিস্তি মেটায় না। সাজা বা বেইজ্জত হওয়ার ভয় দেখালে তবেই তাদের মুঠি খোলে। সরকারের চালু নিয়ম হল যেদিন থেকে কিস্তি বাকি পড়ছে সেইদিন মালগুজারির নোটিশ জারি করা। টান্ডাগ্রামে পর পর তিন কিস্তি এই কাজটা হল না। জমিদারেরও কোনও হুঁশ নেই। জমা পড়ল না কিস্তির টাকা। হুজুরকে এত্তেলা করা হল খাজনা বাকি পড়েছে। তিনি খোঁজ নিলেন। জমিদারের দৌলতে কোনও কমতি হয়নি তা হলে বাকির সওয়াল কেন উঠছে? ঠিকঠাক নোটিশ গেছে তো? জবাব মিলল, আলবাত পাঠানো হয়েছে। হুজুর চাইলে দস্তখত আর মোহর পরখ করতে পারেন। “ঠিক হ্যায়। ফির একবার নোটিশ ভেজ আর নাজিরকে খবর কর এবার যেন কোনও হুঁশিয়ার মুলাজিমকে (molazim) পাঠায়, যে গিয়ে খোঁজ করবে খাজনা বাকি রাখার কী কারণ।” হুজুরের হুকুম মাফিক নাজির এবার আমাকে পাঠালেন কাজটা সামলাতে। বলা হল, যাও ভাই পাঁচকড়ি খান (Bhaee Panchkouree Khan) আর ওই মুফসিদ (moofsidh) দৌলত সিং-এর হুঁশ ঠিকানা লাগাও। নাজিরের হাব-ভাব দেখে মনে হল তিনি আরও কিছু বলতে চান। হুকুমমতো শুরু করলাম তোড়জোড়। এমন হাবভাব যেন তুরন্ত রওনা হব। তবে শুরুতেই হাজির হলাম নাজিরের কুঠিতে, সেখানে তখন মৌলবি উকিল আর লালা মুনশি আমার জন্য ইন্তেজার করছে। নাজির তখনও হাজির হয়নি। আমাকেও তাই বসিয়ে রাখা হল। সবাই এককাট্টা হলে শুরু হল আমার তালিম। কোম্পানির খাজনা নিয়ে কোনও তাগাদা দেওয়া যাবে না। বলতে হবে মুনশি আর নাজির তাকে মুবারক জানিয়েছেন। তাঁরাই হলেন তার সব থেকে করিব দোস্ত। মালগুজারি নিয়ে তার শিরদর্দের কোনও কারণ নেই। সাহেব কালেক্টর কিছু জানতেই পারবে না তার কত বাকি। মামলাটা তার এই দোস্তরাই সামলে দেবে। আমি তো রওনা হলাম। আলবাত আমার গায়ে ছিল চাপরাশ (Chuprass)। যাতে নজর পড়লেই মালুম হয়ে যায় আমি নাজিরের কাছ থেকে আসছি। আমাকে দেখে দৌলত সিং খুব ভড়কে গেল। খাতির করে বসতে দিল চারপাইতে (charpaee)। তারপর বেকরার হয়ে জানতে চাইল, আমার হাজিরির কী কারণ? আমার মতলব ছিল নিজের আখের গোছানো। তাই জবাব দিলাম, সাহেব কালেক্টর জানতে চান কেন তোমার মালগুজারি বাকি। উল্টে সে সওয়াল করল, দস্তক (dustuck) কোথায়? আমি হুজুরের দস্তখত করা পরোয়ানা আর দপ্তরের মোহর লাগানো দস্তকটা বের করলাম। দস্তকটা দেখে সে ফের ভড়কে গেল।

একটু চুপ করে থেকে বলতে বসল, “অনেকটা রাস্তা আসতে হয়েছে খান সাহেব, জরুর পরেশানি হয়েছে। দেখছি তোমার কতটা খিদমত করা যায়।” আমিও সুযোগ ছাড়লাম না। চারপাইতে আয়েশ করে বসে টানতে লাগলাম হুক্কা। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলতে বসলাম, আমার সঙ্গে নাজিরের কতটা খাতির তা তো তুমি জান, আর হুজুরের সঙ্গে নাজির আর মুনশির কেমন দহরম মহরম সেটাও আন্দাজ করতে পার। অশরফ লোগ (ushraf log) যে বেমতলব তাদের তাসির দেখায় না সেটা না বোঝার কথা নয় তোমার দৌলত সিং। আল্লার মেহেরবানি যে আমাদের মতো লোকের সুপারিশের কোনও জরুরত হবে না। সরকার তো পাবে স্রেফ দু’হাজার রুপিয়া আর তোমার কাছে তো এটা একটা মামুলি রকম। আমার কথা শুনে বেচারা দৌলত এবার চমকে উঠল। শুরু হল খোশামোদ। বলতে বসল, মুনশি আর নাজিরের সঙ্গে তার কেমন খাতিরদারি। তারাই বলেছিল কিস্তির টাকা না দিলেও চলবে। হালে তার লড়কার শাদি হয়েছে। সবটাকা খরচ হয়ে গেছে সেখানেই। যে মহাজনের সঙ্গে তার লেনদেন চলে সেও এখন বলছে, তালুক বাঁধা না রাখলে রুপিয়া ছাড়বে না। খান সাহেব এখন তুমিই হলে আমার আখরি ভরোসা। কোশিশ কর নাজিরের উপর তোমার তাসির খাটাতে। এই নাও তোমার পান তাম্বাকুর (pan-tumbakhoo) খরচ বাবদ একটা ছোট রকম। দেখলাম স্রেফ পাঁচ রুপিয়া। রাগের চোটে সেটা ছুড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ালাম। সেলাম ঠাকুরজি, চললাম। নাজিরকে গিয়ে বলছি তুমি যেতে চাওনি। দৌলত সিং এবার দৌড়ে এসে চেপে ধরল আমার হাত। খোশামোদ করতে লাগল যেন চলে না যাই। আমরা বসে ছিলাম শানে (suhun)। দৌলত সিং-এর এক ছোট বাচ্চা সেদিকে ছুটে এল। তার গলায় ঝুলছে একটা কুলদার আসরফি (kuldar ushurfee)। সেটার দিকে নজর পড়ায় বলে উঠলাম, বাহঃ! বহুত সুন্দর! রাজপুত ভামটা বাচ্চার গলা থেকে খুলে সেটা আমার হাতে তুলে দিল। আর সেই সঙ্গে এমন একটা মুখের ভাব যাতে না বলা অসম্ভব। মালটা হাতিয়ে নিয়ে, দাড়ি চুমড়াতে, চুমড়াতে জাহির করতে বসলাম আমার সরকারি রোয়াব।

কায়দা করে তো চার মাসের তনখা হাসিল হল। এবার শুরু করলাম আরেক ফিকির। জানালাম, মুনশি আর নাজির আমাকে চুপি চুপি বলে দিয়েছে তোমাদের রিস্তা কতটা গহরা। নানা ফালতু কথা বলে তার হৌসলা বাড়াতে কসুর করলাম না। তালুকের মামলায় সে বেফিকর থাকতে পারে। সরকারের মালগুজারি নিয়ে তাকে হয়রান না হলেও চলবে। ফিরে গিয়ে মুনশি আর নাজিরকে জানালাম পয়গম্বরি মুকাম্মল। তবে সোনার মোহরের কথাটা চেপে গেলাম।

কালেক্টর সাহেবকে দৌলত সিং-এর বকেয়ার কথা জানানো হল। হুজুর কাগজ-পত্র পরখ করে দেখলেন যে সময় মাফিক নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। এবার তাই সদরে রিপোর্ট করলেন, হুকুম হোক তালুক বেচে বকেয়া আদায়ের। কানুনি রীতি রেওয়াজ মেনে কেনা-বেচা চলত না। তাই বেচারা দৌলত সিং জানতেই পারল না কী কিয়ামত খাড়া হতে চলেছে। তালুক যেদিন বিক্রি হবে তার আগে খবর মিলতেই কাছারিতে বেদম হয়ে ছুটে এল দৌলত। বার বার হুজুরের কাছে আর্জি পেশ করতে লাগল কোনও নোটিশ মেলেনি। পুরোটাই নাজির আর মুনশির সাজিশ। সাহেব চুপচাপ থেকে স্রেফ হুকুম দিলেন, মিছিল (misl) লাও। হাজির করা হল কাগজপত্র। কালেক্টর বাহাদুর খোদ উলটেপালটে সে সব পরখ করলেন। “এই যে দস্তক, আর তুমি খোদ দৌলত সিং এখানে দস্তখত করেছ। মুশকারি পেয়াদা (muskhooree) কো বুলাও। পেয়াদারা হলফ করে বলতে লাগল, তারা ঠিকঠাক দস্তক বিলি করেছিল। নাজির জানালেন, হুজুর আমি তো মুলাজিম (molazim) পাঁচকড়ি খানকে হুকুম দিয়েছিলাম আসামিকে হাজির করার, এই দেখুন কৈফিয়ত। এবার আমার তলব হল। আমাকে দেখে ফুকরে উঠল দৌলত সিং। “ধর্মাবতার! এই হল সেই বজ্জাত যে নাজির আর মুনশির পয়গাম নিয়ে এসেছিল মালগুজারি দেওয়ার দরকার নেই। যাওয়ার সময় একটা সোনার মোহরও হাতিয়ে নিয়েছে।” আমি একবার কড়া নজরে দৌলতকে জরিপ করে নিয়ে হুজুরকে ধীরে-ধীরে বলতে বসলাম, “হুজুর আমার মনে হচ্ছে এই আদমি পাগল! জনাব-ই-আলি আমি পয়গম্বরের শপথ নিয়ে বলছি, টান্ডাতে এক ঘুঁট পিনে কা পানি মেলেনি। আমার সঙ্গে কয়েক টুকরো শুখা রোটি ছিল তাই খেয়ে ছিলাম। হুজুর যদি এই সব বদনামের মরতবা করেন তা হলে সরকারের খিদমতগারদের হেপাজত কোথায় মিলবে?” বাকি হুজুরিরাও এবার একই সুরে নালিশ করতে লাগল। কালেক্টর পুরো লবেজান হয়ে গিয়ে হুকুম করলেন, কালতক মোহলত দিচ্ছি, বকেয়া না মেটালে জমিন বেচে দেওয়া হবে।

টাকা সে দিতে পারবে না জানাই ছিল। টান্ডার তালুক তাই খরিদ করল লালা মুনশি আর মৌলভি-উকিল। দৌলত সিং-এর আর্জির কোনও সুরাহা হল না। কারণ কাগজ-পত্রে কোনও গরমিল পাওয়া যায়নি। হাতফেরতা হল নিলামে ওঠা তালুক। ইন্তেজার করুন, পরের কিস্তিতে দেখবেন কোন কায়দায় ভবানী সিং-কে উৎখাত করা হয়েছিল।

১. বেকরার: অস্থির, বিচলিত

১. হৌসলা: আত্মবিশ্বাস

২. মুকাম্মল: সম্পূর্ণ করা, সমাধা করা

১. মোহলত: বিলম্ব, সময়, অবকাশ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *