1 of 2

২২. গোল্ডার্স গ্রীনে তুতুলের অ্যাপার্টমেন্ট

গোল্ডার্স গ্রীনে তুতুলের অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় তিনবার টোকা মারলো আলম। এখন সকাল সাড়ে আটটা, এই বছরের মধ্যে এমন ঝকঝকে সোনালি রোদ আর ওঠেনি। গ্লোরিয়াস সান সাইন যাকে বলে! এরকম রোদ দেখলেই মনটা চাঙ্গা হয়ে ওঠে, বাড়ি ছেড়ে ছুটে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। ইংরেজরা দেখা হলেই কেন আবহাওয়ার কথা বলে, তা এই সব দিনে। বোঝা যায়। এই দ্বীপভূমিতে রোদ ওঠা-না-ওঠায় অনেক তফাত! মেঘলা কিংবা কুয়াশাভরা দিনে মনের মধ্যে একটা অহেতুক বিষণ্ণতা জমতে থাকে। সুইডেনে একটানা প্র প্র কয়েকদিন মেঘলা থাকলে আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়ে যায়।

কোনো সাড়া না পেয়ে ভুরু কোঁচকালো আলম। যদিও কলিং বেল আছে, তবু দরজায় টোকা মারা তার স্বভাব। শিস দিয়ে একটা গান গাইতে গাইতে আলম আবার টোকা দিল। তিনবার। এত সকালেই তুতুল বেরিয়ে গেছে? তার তো আজ বারোটার আগে হাসপাতালে ডিউটি নেই।

তবু তুতুল শপিং করতে যেতে পারে। কিংবা গতকাল তো ফোনে বলেছিল ওর ত্রিদিবমামা

শহরে এসেছেন, তাঁর সঙ্গেই দেখা করতে গেছে হয়তো।

এই অ্যাপার্টমেন্টের একটা চাবি থাকে আলমের কাছে। তুতুল বাইরে গেলেও সে এখানে অপেক্ষা করতে পারে। খুট করে দরজাটা খুলে সে ভেতরে ঢুকে অবাক হয়ে গেল। তুতুল ঘুমোচ্ছে!

তুতুলের গায়ের ওপর রূপোলি পাড় দেওয়া একটা সমুদ্রের মতন নীল রঙের কম্বল। শীত-গ্রীষ্ম বারো মাসই তুতুল রাত্তিরে ঘরের হিটিং অফ করে দেয়। বাইরে রোদ থাকলেও তুতুলের ঘরটা এখনও ঠাণ্ডা। সমস্ত পর্দা টানা, তাই আধো অন্ধকার।

একটা পর্দা সরিয়ে দিল আলম। রোদের রেখা সোজাসুজি গিয়ে পড়লো তুতুলের মুখে। তাতেও তার ঘুম ভাঙলো না দেখে আলম বুঝলো, তুতুল স্লিপিং পিল খেয়েছে। ইদানীং প্রায়ই তার ঘুম আসে না বলে ওষুধ খেয়ে ঘুমোতে হয়।

আলম এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। যেন এক ঘুমন্ত রাজকন্যা। নিঃশ্বাসে সামান্য দুলে উঠছে বুক

মাথার ঈষৎ কোঁকড়া চুল ছড়িয়ে আছে বালিশের ওপর। অনেকগুলি স্বপ্নের রেশ এখনো লেগে আছে মুখশ্রীতে। শিয়র ও পায়ের কাছের সোনার কাঠি রূপোর কাঠি বদলাবদলি না করে দিলে এই কন্যা জাগবে না।

আলম ভাবলো, এই মেয়েটি তার নিজস্ব। পৃথিবীতে এমন কোনো কথা নেই যা সে তুতুলকে বলতে পারে না। সে খুব ভালো করেই জানে, তুতুল তার জন্য প্রাণ দিয়ে দিতে পারে

তুতুল এমনই সৎ যে সে আলমকে ভালোবেসেছে বলে আর কোনো যুবকের সঙ্গে কক্ষনো একটুও ফ্লার্ট করে না। লণ্ডনে ইতিমধ্যে কম ছেলে তো তুতুলকে জ্বালাতন করেনি। এখন অনেকেই জেনে গেছে যে তুতুলের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করতে গিয়ে কোনো সুবিধে হবে না। তবু তুতুল আলমের সঙ্গেও একটা আড়াল রেখেছে। শারীরিক সম্পর্কের বাধার ব্যাপারটা তো আছেই, তুতুল কিছুতেই বিবাহপূর্ব মিলনে রাজি নয়। আলমও কখনো জোর করেনি। কিন্তু তা ছাড়াও আরও একটা কিসের যেন আড়াল রয়ে গেছে, তুতুলকে এক এক সময় বুকে জড়িয়ে ধরেও মনে হয়, সে খুব দূরের মানুষ!

আলম শুনেছে, তার বন্ধুরা আড়ালে বলে, একটা নরম-সরম এক ফোঁটা মেয়ে কী জাদুই জানে। আলমের মতন একটা বেপরোয়া ছেলেকে একেবারে ভেড়া বানিয়ে রেখেছে!

আলম তুতুলের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে আঙুল দিয়ে তার কপাল থেকে কয়েকটা চুল সরিয়ে দিল, চোখের পাতায় আলতো করে আঙুল বোলালো, ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালো।

এবারে তুতুল জেগে উঠে চোখ মেলে প্রথমে আতঙ্কিত, তারপরেই আলমকে চিনতে পেরে লজ্জিত হয়ে তাড়াতাড়ি উঠে পড়তে গেল। আলম তার কাঁধ ধরে চেপে বললো, না না না। অমন ধড়ফড় করে ঘুম থেকে ওঠা মোটেই ভালো না স্বাস্থ্যের পক্ষে। টেইক ইয়োর টাইম! আগে চক্ষু মেলে ভালো করে পৃথিবীটা, অর্থাৎ নিজের ঘরটা দেখো, তারপর জানালা দিয়ে অকাশখানা দেখো, তারপর একটা হাত তোলো, বাকি শরীরটার ঘুম ভাঙার আরও সময় দাও!

তুতুল আপত্তি করলো না, সে আবার বালিশে মাথা দিল।

আলম জিজ্ঞেস করলো, কাল আবার স্লিপিং পিল খেয়েছিস? কয়টা?

কাল রাত্তিরে খুব মাথার যন্ত্রণা করছিল, এখনও গাটা ম্যাজম্যাজ করছে, সে কথা তুতুল আলমকে বললো না। আলম খুব ফুরফুরে মেজাজে আছে। সে আঙুল তুলে দেখালো দুটো। তারপর বললো, তুমি কতক্ষণ এসেছো?

আলম বললো, মনে তো হইতাছে যেন অনন্তকাল! ওরে তুলতুলি, এই সোনা রঙের রোদ্দুর তোর মুখে আইস্যা পড়ছে, তোরে আইজ একেবারে জেনুইন প্রিন্সেস-এর মতন দেখাইতাছে। তা প্রিন্সেস, গোলাম হাজির, কী হুকুম ক’ন!

তুতুল ফ্যাকাসে ভাবে হেসে বললো, চা না খেয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না। তুমি কেটলিটায় জল ভরে চাপিয়ে দেবে?

–অবশ্যই! আমি তোরে বেড-টি দিমু! ইভ আই শ্যাল সার্ভ ইয়োর ব্রেকফাস্ট ইন বেড। টোস্ট উইথ মামালেড, এগস অ্যান্ড বেকন।

–আলম, দারুন খারাপ একটা স্বপ্ন দেখেছি কাল–

–সিভিলাইজড লোকেরা স্বপ্ন নিয়ে অন্যের সঙ্গে আলোচনা করে না। খারাপ স্বপ্নের কথা তো কারুকেই বলতে নাই!

–তোমাকেও বলা যাবে না?

–আমাকে বলতে হবে না, আমি গেস করে নিয়েছি। তুই স্বপ্ন দেখেছিস যে আমি মরে গেছি। তাই তো? তার মানে বহু দিনের মধ্যে আমার মরণ নাই!

–আলম, আমি বাড়িতে যাবো!

–বাড়ি? কোন বাড়ি? তুই আমার বাড়িতে যাইতে চাস? চল চল চল চল, এক্ষুনি চল। কতদিন ধরে তাকে বলছি, শুধু শুধু দুটো অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া গোনার কোনো মানে হয় না।

–আমি দেশে যাবো!

–দেশ, মানে ইণ্ডিয়ায়? স্বার্থপর! তুই না বলেছিলি, আমার সাথে এক সাথে কলকাতায় যাবি? এখন তুই একা একা পালিয়ে যেতে চাস?

–কেন, তুমি যাবে না আমার সঙ্গে? আমরা দু’জনেই যাবো!

–এখন? পাগল নাকি? ফাণ্ড রেইজিং প্রোগ্রাম নিয়ে এখন আমি কত ব্যস্ত জানিস না? এই শনিবারেই তো পিকাডেলিতে একটা বড় জমায়েত আছে। তা ছাড়া আমার আর ছুটি পাওনা কোথায়? পাকিস্তানে আটকা পড়ে সব ছুটি খরচ হয়ে গেছে না?

রান্নাঘরের গ্যাস স্টোভে হুইশলিং কেটলটা হুইশল দিয়ে উঠলো। আলম উঠে গেল সেখানে। তুতুল টি ব্যাগ পছন্দ করে না, তাই আলম পাতা চা ভেজালো। কাবার্ড থেকে কাপ-সসার বার করে, চিনি খুঁজে, দুধটা একটু গরম করে চা বানালো নিপুণ হাতে।

দুটি কাপ হাতে নিয়ে ফিরে আসতে আসতে বললো, দুধবরণ কন্যা ওগো, কুচবরণ কেশ, এই নাও তোমার চা! আমি নিজের হাতে চা বানিয়ে একটা মেয়েকে খাওয়াচ্ছি, এই কথা শুনলে আমার বাপ-দাদারা কবরের মধ্যে শিউরে উঠবে! আমাদের চোদ্দ পুরুষে কেউ এসব করে নাই! দ্যাখ তো, কেমন হয়েছে?

চায়ে চুমুক না দিয়ে তুতুল আলমের দিকে চেয়ে রইলো এক দৃষ্টিতে। তারপর হঠাৎ সে উঠে আলমকে জড়িয়ে তার বুকে মাথা রেখে আর্ত স্বরে বলতে লাগলো, আলম, আমি যদি হঠাৎ মরে যাই! আমার কিছুই কি পাওয়া হবে না? আমি কী এমন দোষ করেছি?

আলম সন্ত্রস্ত বোধ করলো। তুতুলের এইরকম ব্যবহার একেবারেই অস্বাভাবিক। এতদিনের ঘনিষ্ঠতার পরেও তুতুল কখনো নিজে থেকে আমাকে আলিঙ্গন করে না, আলম তাকে কাছে টানলেও সে লজ্জা পায়। আজ কী” এমন ঘটলো? নিশ্চয়ই গত রাত্তিরের দুঃস্বপ্নের ফল!

তুতুলের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে আলম বললো, এ কী ছেলেমানুষী করছিস? হঠাৎ মরার কথা উঠছে কেন? এই তুলতুলি, তাকা, আমার মুখের দিকে তাকা, কী হয়েছে সত্যি করে। বল?

মুখ না তুলে তুতুল বললো, আমি খুব খারাপ! স্বার্থপর! প্রথম প্রথম এসে দেশের জন্য মন ছটফট করতো, প্রত্যেকদিন ফিরে যেতে ইচ্ছে করতো। আর এখন, চার বছর কেটে গেছে, একবারও যাইনি, যাওয়ার কথা মনেই পড়ে না। আমার মা, আমার মামা-মামীমারাও কেউ আমার ফেরার কথা চিঠিতে লেখে না, তারা বুঝে গেছে যে এই স্বার্থপর মেয়েটা আর ফিরবে না, শুধু নিজেকে নিয়েই

-–ঠিক আছে, একবার ঘুরে আয় দেশ থেকে। আমি টিকিটের খোঁজ নিচ্ছি।

–আমি একা যাবো না। তোমাকেও যেতে হবে সঙ্গে।

–আমার যে যাওনের এখন কোনো উপায় নাই রে! হেভি রেসপনসিবিলিটি নিয়া বসছি। এখন লণ্ডন ছাড়ার প্রশ্নই ওঠে না। তোর মন খারাপ হয়েছে, তুই ঘুরে আয়।

তুতুল এবার সংযত হয়ে চোখ মুছলো। এতদিনেও সে স্লিপিং স্যুটে অভ্যস্ত হয়নি, শাড়ি পরেই শোয়। আঁচল ঠিক করে, মাথার চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বললো, গত রবিবারের মিটিং-এ হাসান যে বললো, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তোমরা যে ফান্ড তুলছো, পাঁচ হাজার পাউন্ড উঠলে তোমাদের মধ্যে একজন সেই টাকা নিয়ে যাবে, ওদের হাতে তুলে দেবে। তখন তুমি যেতে পারো না?

–হাসানের নিজেরই যাওয়ার ইচ্ছা খুব।

–হাসানের পাকিস্তানী পাসপোর্ট, ভিসা পাবে কি না ঠিক নেই। কিন্তু তোমার ব্রিটিশ পাসপোর্ট, তোমার পক্ষে যাওয়াই সুবিধে।

–পাঁচ হাজার পাউন্ড তো এখনো ওঠে নাই। তা ছাড়া আমার সাজারি বন্ধ রাখার অসুবিধা আছে। তুই একাই এবার যা। লক্ষ্মীসোনা! শিরিন যে ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করে, সেখান থেকে আমি ধারে তোর টিকিট কেটে দেবো।

–আমি কিছুতেই একা যাবো না! তুমি খুব ভালো করেই জানো, আমি তোমাকে এখানে। একা ফেলে রেখে যেতে পারবো না। তার মানে আমার দেশে ফেরা হবে না! এর মধ্যে আমি যদি মরে যাই–

তুতুলের চোখে আবার জল এসে যাচ্ছে দেখে আলম পরিবেশ হালকা করার জন্য বললো, ব্ল্যাকমেইল, দিস ইজ ব্ল্যাকমেইল। মেয়েদের চিরকালের অস্ত্র, চোখের জল! ওরে দুষ্টু মেয়ে, আমি তোর মতলোবখানা ভালো করেই বুঝেছি!

–কী বুঝেছো?

–আমারে সাথে নিয়ে তুই কলকাতায় যাবি। তারপরের চিত্রনাট্যখানা এই রকম। ওয়ান। ফাইন মরনিং ড ক্তর মিস বহ্নিশিখা সরকার বিলাত থেকে ফিরবেন কলকাতায়, মামা-মামী, ভাগ্নে-ভাগ্নী আর মায়ের জন্য অনেক প্রেজেন্ট সঙ্গে নিয়ে, টেপ রেকর্ডার, ক্যামেরা, পারফিউম, ট্রানজিস্টার এইসব হাবিজাবি। সবাই খুব খুশি, বাড়িতে হৈ চৈ, চাচামেচি। এর মধ্যে একজন। জিজ্ঞেস করবে, বহ্নিশিখা, তোমার সাথে ঐ লোকটি কে? ঐ যে চোরের মতন মুখ করে। বৈঠকখানায় বসে আছে? ডক্তর মিস বহ্নিশিখা সরকার যেই তার লন্ডনের বন্ধুটির পরিচয়। দেবেন, অমনি তাঁর মা, হিন্দু ঘরের বিধবা চিকখৈর দিয়া ওঠবেন, আঁ? এই সেই মোছলমানের ছাওয়াল, অ্যারে তুই বিয়া করতে চাস? আমি আইজই গলায় দড়ি দিমু, বিষ খামু! এই সব কইতে কইতেই চক্ষু উল্টাইয়া অজ্ঞান! তখন ডক্তর মিস বহ্নিশিখা সরকার অশ্রু ভারাক্রান্ত। নয়নে বলবেন, ভাই আলম, তুমি তো দেখলেই সব। আমার খুবই ইচ্ছে ছিল তোমাকে শাদী। করার, কিন্তু মায়ের মনে দুঃখ দিই কী করে? দশটা নয়, পাঁচটা নয়, আমার একটা মাত্র মা? সেই মা আত্মঘাতিনী হলে আমার যে নরকেও স্থান হবে না। তাই, হে বন্ধু বিদায়! তুমি তোমার পথে যাও, আমি আমার পথে। শেষের কবিতা!

–তুমি বম্বে ফিলমের চিত্রনাট্য লিখলে সত্যিই অনেক টাকা রোজগার করতে পারতে!

–আমার ট্যালেন্ট যে কতদিকে ওয়েস্টেড হলো। ডাক্তারি ছাড়া আমি অন্য অনেক কিছুই ভালো পারি।

–তবে তুমি আমাকে ভালো চেনা না তাই বহ্নিশিখা সরকারের চরিত্রটা একেবারেই দাঁড় করাতে পারোনি। লন্ডন ছাড়ার আগে বহ্নিশিখা সরকার একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছিল, সেটা তুমি ভুলে যাচ্ছো!

–ওঃ, আবার সেই দুঃস্বপ্নের কথা। সেটা শুনতেই হবে? বাইরে কী সুন্দর একখানা সকাল, তার মধ্যে দুঃস্বপ্ন! ঠিক আছে, বলো, শুনি!

–আমি দুঃস্বপ্ন দেখেছি যে একটা বিচ্ছিরি চেহারার, বাউণ্ডুলে, দায়িত্বজ্ঞানহীন মুসলমান ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে!

–আঁ? সে আবার কে? স্বপ্নে তার মুখখানা দেখেছো?

–অফ কোর্স দেখেছি! সে একজন পচা ডাক্তার, ডাক্তারি ছাড়া অন্য পাঁচ রকম ব্যাপার নিয়ে মেতে থাকে। ভোরের স্বপ্ন মিথ্যে হয় না। কলকাতায় যাবার আগেই সেই লোকটার সঙ্গে

আমার বিয়ে হয়ে যাবে! _ খুবই অভিপ্রেত কিছুও হঠাৎ সামনে এসে পড়লে তাকে গ্রহণ করা সহজ হয় না। গত আড়াই বছর ধরে আলম তুতুলকে বিয়ে করার জন্য ঝুলোঝুলি করেছে, তুতুল কিছুতেই তাতে সায় দিতে পারেনি। আজ হঠাৎ তুতুল নিজে থেকেই সে প্রস্তাব দিতে আলমই দ্বিধা করতে লাগলো। তুতুল কি ঝোঁকের মাথায় এরকম বলছে? তুতুলের মায়ের আপত্তির কথা সে জানে, সে ভদ্রমহিলার সেন্টিমেন্টে হঠাৎ আঘাত দেওয়া যায় না, তাঁকে ভালো করে বুঝিয়ে সুঝিয়ে—

আলম নরম গলায় বললো, তুমি দেশে ফেরার জন্য ডেসপারেট হয়ে এই কথা বলছো, তাই না? আমি জানি, হঠাৎ দেশের মানুষজনের কথা মনে পড়লে কী সাংঘাতিক টান হয়। আর একদিনও এখানে থাকতে ইচ্ছে করে না। তুমি আমাকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় যাবে কথা দিয়েছিলে। আমি যদি সেই সঙ্কল্প থেকে তোমাকে মুক্তি দিই? রিয়েলি, আই ওন্ট মাইন্ড, তুমি একা ঘুরে এসো!

তুতুল বিছানা থেকে নেমে এলো। বাথরুমে যাবার জন্য কয়েক পা এগিয়েও ফিরে তাকালো আলমের দিকে। তার মাথা টলটল করছে, দুই ভুরুর মাঝখানে চিড়িক চিড়িক ব্যথা। পায়েও যেন জোর পাচ্ছে না। কাল রাত্তির থেকেই মনে হচ্ছে, তার আর বেশীদিন আয়ু নেই।

আবার সে আলমের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ফিসফিস করে বললো, আলম, আমাকে ধরো, আমাকে শক্ত করে ধরে রাখো। আমাকে কোনোদিন ছেড়ে দিও না।

বাড়ি ছেড়ে ওরা বেরিয়ে পড়লো পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে। আকাশ এখনো পরিষ্কার। যদিও ছুটির দিন নয়, তবু আজ টেমস নদীর ধারে বেশ মানুষজনের ভিড়। এর মধ্যে টুরিস্ট আছে অনেক, লন্ডন শহরের বুড়োবুড়িরাও আজ রোদ পোহাতে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। অফিস পালিয়ে চলে এসেছে যুবক-যুবতীরা।

ওয়াটালু ব্রীজ পেরিয়ে গাড়িটা পার্ক করে ডান দিকের এমব্যাঙ্কমেন্ট ধরে খানিকটা হাঁটলো তুতুল আর আলম। তুতুলের শরীরটা এখন অনেকটা ভালো লাগছে। দু’ জনের হাতে হাত, ধরা। রেলিং-এর ধারে একটা ফাঁকা বেঞ্চ পেয়ে বসলো ওরা এক সময়। এমন কিছু বড় নদী নয়, তবু এই নদী দিয়ে বহু স্টিমার ও বোট চলে। টুরিস্টদের ঘুরিয়ে দেখায় যে বোটগুলো, সেগুলো আজ ভর্তি। রোদ্দরের দিন মানেই যেন এ দেশে উৎসবের দিন।

কাছেই একটা স্টলে স্যান্ড উইচ, হট ডগ আর কফি বিক্রি হচ্ছে। আলম উঠে গিয়ে হট ডগ, কফি আর এক গোছ পেপার ন্যাপকিন নিয়ে এলো। সকালে ব্রেকফাস্ট খাওয়া হয়নি। দুপুরে ওরা নিয়ম করে লাঞ্চও খাবে না, আজ সারাদিন এখানে সেখানে ঘুরবে, আর বারে বারে টুকিটাকি খাবে। ইচ্ছে হলে লং ড্রাইভে কোনোদিকে গিয়ে একটা কোনো গ্রামের পাব-এ বসতে পারে।

হঠাৎ একটু দূরে একজন শাড়ী পরা মহিলার দিকে চোখ পড়তেই আলম বললো, শিরিন না?

মহিলাটি ওদের দিকে পেছন ফিরে হাঁটছে, তার সঙ্গে একজন পুরুষ। মনে হচ্ছে শিরিন আর মুরশিদ আলম জিজ্ঞস করলো, ওদের ডাকি?

তুতুল মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালো।

আলমের মুখে তখন অর্ধেক খাবার। সেটা কোনোক্রমে শেষ করে সে উঠে দাঁড়িয়ে। ডাকলো, শিরিন! মুরশিদ! তারপর এদেশের নিয়ম লঙ্ঘন করে আর একবার বেশ জোরেই ডেকে উঠলো।

সেই নারী-পুরুষ যুগল এদিকে ফিরলো না, হঠাৎ নেমে গেল একদিকের সিঁড়ি দিয়ে। অনেকটা দূরে চলে গেছে, এখন দৌড়ে গেলেও বোধহয় ওদের ধরা যাবে না।

আলম আর চেষ্টা করলো না। ফিরে এসে বসে পড়ে বললো, ওরা শুনতে পায়নি!

তুতুল বললো, হ্যাঁ, শুনেছে। শিরিন একবার আমাকে দেখেওছে। ও আজকাল ইচ্ছে করে। আমাকে অ্যাভয়েড করে।

–সেকি? শিরিন তোমাকে অ্যাভয়েড করবে কেন? সে তোমার ভালো বন্ধু না?

–হ্যাঁ, বন্ধুত্ব ছিল এক সময়। কিন্তু গত সপ্তাহে একটা টিউব ট্রেনে শিরিন আর আমি একই কামরায় উঠেছিলুম। শিরিন একটু দূরে বসেছিল। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতে ও চোখ ফিরিয়ে নিল। তারপর নেমে গেল পরের স্টেশনে, যতদূর মনে হয় সেখানে ওর নামার দরকার ছিল না, নামার সময় আমার দিকে একবার তাকালো না পর্যন্ত! আলম, তুমি যেমন আমার মায়ের কথা বলো, সে রকম আমাকে বিয়ে করার জন্য তোমার অনেক আত্মীয়বন্ধুও বিরক্ত হবে, তুমি সে জন্য তৈরি থেকো!

আলম গম্ভীরভাবে একটুক্ষণ সিগারেট টানলো। তারপর বললো, এটা সে ব্যাপার নয়। আরও কমপ্লিকেটেড। শিরিন ফেব্রুয়ারি মাসে মুরশিদকে বিয়ে করলো, যদি আর একটা মাস ও ওয়েট করতো! এক মাসের মধ্যে যে অনেক ডিফারেন্স হয়ে গেল!

তুতুল বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, ফেব্রুয়ারি আর মার্চ মাসের মধ্যে কী ডিফারেন্স হয়ে গেল? |||||||||

–ফেব্রুয়ারি মাসেও মুরশিদ আর আমরা সবাই ছিলাম পাকিস্তানী। কিন্তু পাকিস্তানের দুটো উইং কি আর এক থাকবে? পচিশে মার্চের পর একটা পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন এসে গেল না? একবার যখন লড়াই শুরু হয়েছে, এখন ইস্ট পাকিস্তানে স্বাধীন বাংলাদেশ হবেই! তুমি বোধহয় জানো না, এরমধ্যেই লন্ডনে ইস্ট পাকিস্তানী আর ওয়েস্ট পাকিস্তানীদের মধ্যে শাপ দুটো ভাগ হয়ে গেছে, মুখ দেখাদেখি বন্ধ। সাউথ লন্ডনের একটা পাবে করাচীর কিছু ছাত্র আর ঢাকার কিছু ছাত্রের মধ্যে তর্কাতর্কির পর হাতাহাতি পর্যন্ত হয়ে গেছে। মুরশিদ ওয়েস্ট পাকিস্তানী। শিরিন এখন কী করবে : বাঙালীদের সঙ্গে ও কি আর খোলাখুলি মিশতে পারবে?

–কিন্তু মুরশিদ ইজ আ ভেরি গুড ফ্রেন্ড অফ আস। চমৎকার মানুষ। সে ওয়েস্ট পাকিস্তানী বলেই তোমরা তার সঙ্গে আর মিশবে না?

–পরে একসময় হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এখন খুব বেশী টেনশান, পরস্পরের প্রতি চরম অবিশ্বাস, এখন মেলামেশা শক্ত হবে ঠিকই।

–আমি কোনো মানুষকে তার দেশের পরিচয় বা জাতির পরিচয় দিয়ে বিচার করা খুবই অপছন্দ করি! ব্রাহ্মণ পন্ডিত বলতে যা বোঝায়, বিদ্যাসাগরমশাই কি তাই? আইনস্টাইন কি শুধু ইহুদি? হিটলার জামান ছিলেন বলে কি সব জামান…

–আহা, আমাকে তুমি ছেলেমানুষের মতন বোঝাবার চেষ্টা করছো কেন, আমি কি এসব জানি না? কিন্তু যুদ্ধের সময় ঘৃণা আর অবিশ্বাস এমনই তীব্র হয়।

–যুদ্ধ হচ্ছে ইস্ট পাকিস্তানে, তা বলে লন্ডনেও ঝগড়া করতে হবে? তুমি যাই বলো, আমি আমাদের বিয়েতে মুরশিদকে নেমন্তন্ন করতে চাই!

–আমি তো ওদের ডাকলাম। তুমিও বলছো, ওরা ইচ্ছা করে এলো না! রাত্তিরবেলা টেলিফোন না করেই ওরা দু’জনে উপস্থিত হলো শিরিন-মুরশিদদের বাড়িতে। সারওয়ার মুরশিদ ইতিহাসের দুর্ধর্ষ ছাত্র, অধ্যাপক ব্যাসামের প্রিয় শিষ্য। বেলসাইজ পার্কে ওদের সুন্দর ছোট্ট বাড়ি। সারওয়ার মুরশিদের জন্মস্থান লাহোর, কিন্তু ওর বাবা পাকিস্তান। সিভিল সার্ভিসের বড় অফিসার, সাত বছর ঢাকায় ছিলেন। সেই সুবাদে মুরশিদও পরিষ্কার বাংলা বলতে পারে। পাঠানদের মতন লম্বা-চওড়া চেহারা, তাঁর মুখে বাংলা শুনতে বেশ মজা লাগে।

ওদের দেখে শিরিন খানিকটা আড়ষ্ট বোধ করলেও মুরশিদ সাগ্রহে অভ্যর্থনা জানালো। আজ সন্ধের পরেও ঠাণ্ডা পড়েনি। খুলে দেওয়া হয়েছে জানলার কাচের পাল্লা, সাদা নেটের পর্দা বাতাসে উড়ছে, এদেশে এই দৃশ্য বিশেষ দেখা যায় না।

আলম বললো, তোমাদের দাওয়াত দিতে আসলাম। আগামী শনিবার আমরা বিয়ে করছি। গোল্ডার্স গ্রীনে তুতুলের অ্যাপার্টমেন্টে খুব ছোট্ট একটা পাটি, তোমাদের দুইজনকেই সেখানে আসতে হবে।

শিরিন তেড়ছা চোখে তুতুলের দিকে তাকালো। মুরশিদ বললো, নেক্সট শনিবার? এত তাড়াতাড়ি? হঠাৎ ঠিক হলো বুঝি?

আলম তুতুলের মাথায় টোকা মেরে বললো, এই মেয়েটা একেবারে বিয়ে পাগলী হয়ে গেছে! রোজ ঘ্যান ঘ্যান করছে, আমায় বিয়ে করো, আমায় বিয়ে করো! তাই আর না করে উপায় কী বলো।

মুরশিদ হা-হা করে হেসে উঠে বললো, গুড কজ ফর সেলিব্রেশন। ভালো ইটালিয়ান রেড ওয়াইন আছে, খোলা যাক তা হলে?

আলম বললো, আপত্তি নাই।

তারপরই সে শিরিনের দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বললো, এই ছেমরি, তুই মুখ গোমড়া কইরা আছোস, কথা কস না যে? আমাগো শাদীর খবর শুইন্যা তুই খুশী হস নাই?

শিরিন কষ্ট করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো, ওমা, খুশী হবো না কেন? কিন্তু তোমাদের পার্টিতে আমরা যাবো, অন্য কেউ যদি কিছু মনে করে?

–কে কী মনে করবে? ঐ সব কথা বাদ দে, শুধু ওয়াইন খাবো না, আমার ক্ষুধা পাইছে, কিছু খাবার দে!

শিরিন তবু বললো, আলম ভাই, একটা সাফ কথা বলি। তোমাদের হাসান হাফিজ যদি সেখানে থাকে, সে পার্টিতে আমি আর মুরশিদ যাবো না! সেই লোক কয়েকদিন আগেই আমাকে বলেছে, আমি নাকি বাঙালীর দুশমনরে শাদী করছি!

আলম কিছু উত্তর দেবার আগেই মুরশিদ আলমের হাতে একটা চাপড় মেরে মৃদু হেসে বললো, ডোন্ট ওয়ারি, হাসান ওরকম কথা বললেও আমি তোমাদের পার্টিতে যাবো। আই ডোন্ট মাইন্ড। আমি ডক্তর বহ্নিশিখা সরকারের একজন গ্রেট অ্যাডমায়ারার।

ওয়াইন বোতলের কর্ক খুলে সে দুটি গেলাসে ঢালার পর তুতুলকে জিজ্ঞস করলো, আপনি একটু পান করবেন তো? আজ আপনাকে একটু মুখে ছোঁয়াতেই হবে।

তুতুল বললো, হ্যাঁ, একটু নিতে পারি। শিরিন খাবে না?

মুরশিদ বললো, শিরিন? সাচ্চা মুসলমান জেনানার মতন শরাব ওর কাছে হারাম। যত বোঝাবার চেষ্টা করি যে ওয়াইন আর মদ এক নয়, তা বুঝবে না। আরবরা ওয়াইন কাকে বলে জানতোই না। আরও মজার কথা, শিরিন হালফিল আমার সঙ্গে উর্দুতে বাতচিত শুরু করেছে। শী ওয়ান্টস টু বিকাম আ ট্র পাকিস্তানী!

গেলাসে চুমুক দিয়ে আলম বললো, মুরশিদ, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি, ইস্ট পাকিস্তানে আমি যে অত্যাচার শুরু করেছে, নিরীহ সিভিলিয়ানদের খুন করছে, গ্রাম জ্বালিয়ে। দিচ্ছে, সে খবরে তুমি বিশ্বাস করো?

মুরশিদ বললো, ব্রিটিশ কাগজগুলোতে কিছু কিছু খবর বেরিয়েছে। বিশ্বাস না করে উপায় কী?

–টাইম, নিউজ উইকেও সাঙ্ঘাতিক সব বিবরণ বেরিয়েছে। আমেরিকা বরাবরই পাকিস্তানের সামরিক সরকারকে মদৎ দেয়, সেই দেশের কাগজে যদি পাক আর্মির অত্যাচারের এমন খবর বেরোয়, তার গুরুত্ব আরও বেশী হবে। তাই না? মুরশিদ, আমি তোমার কাছে জানতে চাই, এই যে ইস্ট পাকিস্তানের মানুষদের ধরে ধরে মারছে, একই দেশের তো মানুষ, তাতে ওয়েস্ট পাকিস্তানে কোনো রিঅ্যাকশান নেই? তুমি তো করাচীর দু-একটা কাগজ রাখো।

–সেখানকার কাগজে এসব কিছু খবর থাকে না।

–পশ্চিম পাকিস্তানে কেউ প্রতিবাদও করছে না? আমি কি মনে করে, শুধু মেরে মেরে ইস্ট পাকিস্তানের জনসংখ্যা কমিয়ে দেবে? কত মানুষ খুন করবে, এক কোটি, দুই কোটি? পশ্চিমের থেকে পুবের মানুষ কম হয়ে যাবে! এইরকম পৈশাচিক পরিকল্পনার কথা কেউ কখনো শুনেছে? পশ্চিম পাকিস্তানে কেউ এর প্রতিবাদ করবে না? যেখানে ফয়েজ আহমদ ফয়েজের মতন কবি আছেন, মান্টোর মতন লেখক, আঃ মান্টোর এক একটা গল্প কী টাচিং, মনে আছে সেই গল্পটা? নামটা ঠিক মনে নাই, পাগলদের গল্প। পাটিশানের পর ভারত আর পাকিস্তানের দুই দেশের কর্তাদেরই টনক নড়লো যে দুই দেশের পাগলা গারদেই তো কিছু হিন্দু আর মুসলমান পাগল রয়ে গেছে। পাকিস্তান ইসলামিক স্টেট, লাহোর করাচীর পাগলা গারদে হিন্দু পাগলদের কেন পোষা হবে সরকারি খরচে? তাই হিন্দু পাগলদের পাঠাতে হবে ইন্ডিয়ায়, কিন্তু পাগলরা তত বোঝেই না, দেশ ভাগ কাকে বলে! এক সদারজী, সে তো কিছুতেই যেতে চায় না লাহোর ছেড়ে, তাকে জোর করে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হলো, তারপর সে গুলি খেয়ে মরে পড়ে রইলো দুই দেশের সীমানার মাঝখানে হাত পা ছড়িয়ে। আসলে দুই দেশের নেতারা যে কত বড় পাগল এই রকম গল্প লেখা হয়েছে যে পাকিস্তানে, সেখানে এখনকার গণহত্যা নিয়ে কোনো প্রতিবাদ নাই, এটা বিশ্বাস করি কী করে?

–সেখানকার সাধারণ মানুষ সবাই যে আর্মির এই ম্যাসাকার পলিসি সাপোর্ট করছে, তা আমিও বি ঠাস করি না, আলম। পাকিস্তানের প্রেস গ্যাগড, কেউ প্রতিবাদ করলেও সে খবর বেরুবে না। তবে ধমোন্মাদনা সৃষ্টি করা স্বৈরাচারীদের একটা কৌশল। ইয়াহিয়া আর তার হেচম্যানেরা পশ্চিম পাকিস্তানে এরকম একটা ধারণার সৃষ্টি করে দিয়েছে যে শেখ মুজিব ইন্ডিয়ার চর, হিন্দু কনসপিরেটররাই ইস্ট পাকিস্তানে সিসেশানের দাবি তুলেছে, আমি শুধু তাদের দমন করছে। অ্যান্টি ইন্ডিয়া আর অ্যান্টি হিন্দু সেন্টিমেন্ট বেশী করে প্লে আপ করে পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের সমর্থন অনেকটা পাওয়া গেছে।

শিরিন ঝাঁঝের সঙ্গে বললো, হিন্দুরাই তে ক্ষ্যাপাচ্ছে, সেটা মিথ্যা নাকি? মোটেই না!

আলম অবাক ভাবে শিরিনের দিকে তাকালো।

মুরশিদ জোরে হেসে উঠে বললো, কইলাম না, তোমার কাজিন খুব র‍্যাপিডলি ওয়েস্ট পাকিস্তানী হয়ে উঠছে! শিরিন জানে না আমার মা হিন্দু, উত্তর প্রদেশের ব্রাহ্মণের মেয়ে। ওকে যখন লাহোরে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাবো, সী উইল হ্যাভ দা শক অফ হার লাইফ টাইম। আমার মা ফেয়ারলি এডুকেটেড। মার সাবজেক্টও হিস্ট্রি। আমার স্পেশালাইজেশন। অ্যানসিয়েন্ট আর্য পিরিয়ড নিয়ে। আমার মায়ের সঙ্গে অনেক সময় আমি সংস্কৃতে কথা বলি!

তুতুল আস্তে আস্তে বললো, আমি আলমকে আজই বলছিলাম, যে-কোনো মানুষকেই শুধু তার দেশের পরিচয় বা জাতের পরিচয় দিয়ে বিচার করা কতখানি ভুল!

মুরশিদ বললো, ঐতিহাসিক কারণে, এক একটা জাতের মধ্যে, বা এক একটা অঞ্চলে কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। যেমন, বেঙ্গলে পলিটিক্যাল অ্যান্ড সোসাল মুভমেন্ট শুরু হয়েছে গত সেঞ্চুরির মাঝখান থেকে। সেইজন্য বাঙালীরা পলিটিক্যালি যতখানি কনসাস, ওয়েস্ট পাকিস্তানে তা অনেক কম। বাঙালীরা ডেমোক্রাসির স্বাদ আগে থেকেই পেতে শুরু করেছে, ওয়েস্ট পাকিস্তানে অনেকেই এখনও ডেমোক্রেসির মর্ম ঠিক বোঝে না। সেইজন্যই আর্মি রুল হলে ইস্ট পাকিস্তানে যতখানি রি-অ্যাকশান হয়, ছাত্ররা যেমন ক্ষেপে যায়, ওয়েস্ট পাকিস্তানে তা হয় না। তারা মোটামুটি ফিউডাল যুগেই রয়ে গেছে অনেকটা। পশ্চিম পাকিস্তানীরা আরবের কাছাকাছি, আর পূর্ব পাকিস্তানীরা আরব থেকে অনেক দূরে, সেখানকার মুসলমানদের একটা আলাদা কালচার গড়ে উঠেছে, হিন্দু কালচারের প্রতি তাদের একটা অ্যাফিনিটি থাকা খুবই স্বাভাবিক, আরও একটু দূরে, ইন্দো চায়নার মুসলিমদের মধ্যে হিন্দু মাইথোলজির প্রভাব এখনও অনেকখানি। আবার পূর্ব বাংলার হিন্দুদের মধ্যে, উত্তর প্রদেশের হিন্দুদের মধ্যে অনেক মুসলিম ইনফ্লুয়েন্স আছে। এসব অস্বীকার করা কিংবা জোর করে চেপে দেওয়া যায় কখনো? ওয়েস্ট পাকিস্তানের আর্মির কতারা তো বটেই, পলিটিশিয়ানরাও অনেকেই মুখ। তারা বলে যে বাংলা নাকি হিন্দুর ভাষা! বাংলা ভাষায় কত আরবী-ফার্সি শব্দ আছে, তা তারা জানে না! আরবী-ফার্সি শব্দ বাদ দিয়ে বাংলায় পর পর তিন-চারটি সেনটেন্স বলাও প্রায় অসম্ভব! আর উর্দুর মধ্যেও যে কত সংস্কৃত শব্দ আছে, তা এরা কল্পনাও করতে পারবে না! বাঞ্চ অফ ইডিয়েটস্!

আলম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, তবুও মানুষ অকারণে মরছে!

দু’ জন মাত্র সাক্ষী নিয়ে তুতুল আর আলমের রেজিস্ট্রি হলো খুবই বিনা আড়ম্বরে। সন্ধেবেলায় পাটিতেও ডাকা হয়েছে মাত্র দশজনকে। প্রথমে এলেন ত্রিদিব। গ্লাসগো থেকে কাজের জন্য তাঁকে লন্ডনে আসতে হচ্ছে প্রায়ই। এই শনিবারটা তিনি থেকে গেছেন। সেই ছিপছিপে শরীর আর নেই ত্রিদিবের, কিছুটা মেদ লেগেছে, পাতলা হয়ে এসেছে মাথার চুল। আলম আর তুতুলের জন্য একগাদা উপহার এনেছেন তিনি, সঙ্গে একটি শ্যাম্পেন ও একটি ব্ল্যাক লেবেল স্কচের বোতল। শ্যাম্পেনের বোতলটা খোলা হবে সবাই আসার পর, ত্রিদিবের ততক্ষণ অপেক্ষা করার ধৈর্য নেই, তিনি গেলাসে হুইস্কি ঢেলে বসলেন।

হাসানের স্ত্রী বুলবুল এসে রান্নাবান্না করছে বিকেল থেকে, তুতুল তাকে সাহায্য করতে গেল। একজন দু’জন করে বন্ধুরা আসছে, আলম কথা বলছে তাদের সঙ্গে। এক সময় বেজে উঠলো টেলিফোন। আলম রিসিভার তুলে দু-একটা কথা বলে চেঁচিয়ে ডাকলো, তুতুল, তোমার–!

ফোনটা এসেছে আমেরিকা থেকে, পরিষ্কার কণ্ঠস্বর, তবু তুতুল যেন প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারলো না! সে দুবার জিজ্ঞেস করলো, কে বলছেন? হু ইজ স্পিকিং!

অন্যদিক থেকে শোনা গেল, ফুলদি, আমি বাবলু! শোনো, আমি এখন বস্টনে এসেছি, অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছি, তুমি আমার ঠিকানা আর ফোন নাম্বারটা লিখে নাও। তুমি কলকাতা থেকে কোনো চিঠি পেয়েছো? আমি অনেকদিন খবর পাইনি কিছু, দুটো চিঠি দিয়েছি, সবাই ভালো আছে তো?

এখনো তুতুলের বিশ্বাস হচ্ছে না। বাবলু? সত্যি বাবলু? আমেরিকায় যাবার পর এক বছরের মধ্যে বাবলু একদিনও ফোন করেনি। চিঠি লিখলে উত্তর দেয় না, সেই বাবলু নিজে থেকে ফোন করেছে, আজই, এই বিশেষ দিনে?

তার বিয়ের কথা বাড়ির কেউ জানে না। বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র সূত্র ত্রিদিমামা। সেইজন্যই বিশেষ করে সে আজ ত্রিদিবমামাকে থাকতে বলেছে। আর বাবলু তার ভাই!

তুতুল কোনো কথা বলতে পারছে না। তার চোখে জল এসে যাচ্ছে। এই আকস্মিক যোগাযোগ তার বুকে দারুণ একটা আন্দোলন তুলে দিল। তার অসম্ভব আনন্দ হচ্ছে। অথচ বাবলুকে খবরটা জানাতেও লজ্জা করছে তার।

বাবলু আপন মনে কথা বলে যাচ্ছে, তিন মিনিট হলেই কেটে দেবে, তাই তুতুল হঠাৎ বলে ফেললো, বাবলু, তুই আজ ফোন করে কী ভালো যে করেছিস, বাবলু, আজ একটু আগে আমি বিয়ে করেছি!

কয়েক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল বাবলু, যেন সে কথাটা বুঝতে পারেনি। আবার জিজ্ঞেস করলো। তুমি কী করেছো বললে? বিয়ে? কাকে?

লন্ডনে থাকার সময় তুই তো ডক্তর আলমকে দেখেছিলি, আমার বন্ধু, সেই আলমকে, এখানে ত্রিদিবমামাও আছেন।

–তুমি সত্যি বিয়ে করেছো? তোমার ব্রত কেটে গেছে তা হলে?

–ব্রত? কিসের ব্রত!

–কংগ্রাচুলেশনস, ফুলদি! ইউ আর আ ব্রেভ গাল!

এমন অসভ্য ছেলে বাবলু, পয়সা বেশী খরচ হবার ভয়ে কট করে কেটে দিল এর পরেই। বাবলুকে আরও অনেক কথা বলার ছিল, আরও একটুক্ষণ বাবলুর গলার আওয়াজ শুনতে ইচ্ছে। করছিল। ও কালেক্ট কল করলেই পারতো!

তুতুল নিজেই বাবলুর নাম্বারটা নিয়ে চেষ্টা করবে কি না ভাবতে ভাবতেই এসে উপস্থিত হলেন শাজাহান চৌধুরী। একটা অসম্ভব সুন্দর সামার-সুট পরে এসেছেন তিনি, হাতে এক গুচ্ছ গোলাপ ও একটি ভেলভেটের বাক্স। নিছক কলকাতার লোক এবং ত্রিদিবমামার বন্ধু বলেই শাজাহান চৌধুরীকে আজ ডেকেছে তুতুল।

অন্যদের সঙ্গে পরিচয় ও অভিবাদন করতে করতে ত্রিদিবকে দেখে হঠাৎ যেন থমকে গেলেন শাজাহান। গভীর বিস্ময়ের সঙ্গে তাকালেন ত্রিদিবের দিকে। এক চুমুকে গেলাসের স্কচটা শেষ করে দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন ত্রিদিব। শাজাহানকে এখানে দেখতে পাবেন, তা যেন তিনি ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করেননি আগে।

আলম বললো, ডোন্ট য়ু নো ইচ আদার?

সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে ত্রিদিব শুকনো ভদ্রতার সঙ্গে বললেন, অফ কোর্স। হ্যালো শাজাহান–

শাজাহানও ততোধিক ভদ্রতার সুরে বললেন, হ্যালো, ত্রিদিব–

এরপরেও অন্যদের অগ্রাহ্য করে দু’জনে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলেন এক দৃষ্টিতে। যেন দুই যুযুধান।

অন্য সবাই নিজেদের মধ্যে গল্পে মত্ত। তুতুল বিস্মিত ভাবে দু’ জনের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো, কিছু একটা গণ্ডগোল ঘটে গেছে। আজ সন্ধেয় এদের এক সঙ্গে ডাকা ঠিক হয় নি। এই দু’জন পুরুষের দৃষ্টির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি অদৃশ্য নারী। সুলেখা। আজকের বিশেষ দিনটিতেও সুলেখার কথা মনে পড়ে যাওয়ায় তুতুলের মন খারাপ হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *