গদ্যের জনক ও প্রধান পুরুষেরা
বিভিন্ন লেখকের হাতের স্পর্শে বাঙলা গদ্য ধীরেধীরে ধারণ করেছিলো নিজের প্রকৃত রূপ। কেউ রচনা করেছিলেন পাঠ্যবই লেখার উপযোগী গদ্য, কেউ গদ্যকে করে তুলেছিলেন যুক্তিতর্কের উপযোগী। কারো হাতে গদ্য হয়ে উঠেছিলো গল্পের উপযোগী, কারো হাতে হয়ে উঠেছিলো সমালোচনা সাহিত্যের উপযোগী। কিন্তু উনিশশতকের প্রথম দু-তিন দশক ধরে চলে গদ্যের বিকাশ ও সুস্থিতির কাজ। এমন কোনো বড়ো গদ্যশিল্পী তখন দেখা দেন নি, যাঁর গদ্যকে বলা যেতে পারে নিটোল গদ্য। উনিশশতকের দ্বিতীয় দশকে আবির্ভূত হন রামমোহন রায় [১৭৭২-১৮৩৩]। তিনি ছিলেন কৃতী পুরুষ, নতুন কালের মহাপুরুষ। বাঙলা গদ্যে তাঁর দানও উল্লেখযোগ্য। রামমোহন সবার আগে গদ্যকে পাঠ্যবইয়ের বৃত্ত থেকে বিস্তৃততর এলাকায় নিয়ে যান। রামমোহন ছিলেন সংস্কারক। তাই তাঁকে তর্কবিতর্কে নামতে হয়েছে তাঁর প্রতিপক্ষের সাথে। তিনি বিরোধীপক্ষকে আঘাত করেছেন নানা রচনায়, আর এ-আঘাতে দল মেলেছে গদ্য। রামমোহন রচনা করেছিলেন বেশ কয়েকটি বাঙলা বই। সেগুলো হচ্ছে বেদান্ত গ্রন্থ (১৮১৫), বেদান্তসার (১৮১৫), ভট্টাচার্যের সহিত বিচার (১৮১৭), গোস্বামীর সহিত বিচার (১৮১৮), প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ (১৮১৮), পথ্যপ্রদান (১৮২৩), গৌড়ীয় ব্যাকরণ (১৮৩৩)। এছাড়া তিনি সম্পাদনা করেছিলেন দুটি পত্রিকা, ব্রাহ্মণসেবধি ও সম্বাদকৌমুদী। এসকল রচনা ভিত্তি করে গড়ে ওঠে ব্যক্তিত্বমণ্ডিত গদ্য। রামমোহনের গদ্য পাঠের সময় এক প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের লেখা পাঠ করছি, একথা সব সময় মনে হয়। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাঁর গদ্য সম্বন্ধে লিখেছিলেন যে তিনি জলের মতো সহজ গদ্য লেখেন। তবে তাঁর গদ্য বিশেষ সরস নয়। আসলে রামমোহনের গদ্য ঠিক জলের মতো ছিলো না, এ-গদ্য অনেকটা জটিল, বাক্যগুলো বড়ো বড়ো, এলানোছড়ানো। অনেক সময় তাঁর ভাষা কর্কশ। দাঁড়ি-কমা-সেমিকোলনেরও অভাব আছে। তবু রামমোহন রায় বাঙলা গদ্যের এক প্রধান ব্যক্তি।
যাঁর হাতের ছোঁয়ায় বাঙলা গদ্য রূপময় হয়ে ওঠে, তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর [১৮২০-১৮৯১]। তাকে বলা হয় বাঙলা গদ্যের জনক। বিদ্যাসাগর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালিদের একজন। তিনি বিদ্যাসাগর, দয়ার সাগর, একথা সবাই জানি। এসব কথা যদি স্মৃতিহীন বাঙালি কখনো ভুলেও যায়, তবু তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তার অনুপম গদ্য রচনার জন্যে। তাঁর গদ্য রচনাকে কেউ ভুলতে পারবে না। আজ আমরা যে-গদ্য রচনা করি, তার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন বিদ্যাসাগর। তাঁর সে-ভিত্তির ওপর কতো রঙবেরঙের প্রাসাদ উঠেছে এবং আরো কতো উঠবে, তবু তিনি থাকবেন সবার মূলে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮২০ অব্দে, মেদেনিপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে। তাঁর পিতার নাম ঠাকুর দাস, মাতার নাম ভগবতী দেবী। বাল্যকালে তিনি দুষ্টু চঞ্চল ছিলেন, ছিলেন বড়ো একরোখা। পরবর্তী জীবনে তিনি হন নির্ভীক, এবং ভীষণভাবে একরোখা। তাঁর সম্বন্ধে গল্প আছে, বাল্যকালে তাঁকে যা বলা হতো তিনি করতেন তার উল্টোটি। যদি মা বলতেন পড়ো, তাহলে তিনি পড়া বন্ধ করতেন। তাই তার মা শীতকালে বালক ঈশ্বরচন্দ্রকে বলতেন কিছুতেই স্নান কোরো না, আর অমনি বালক ঈশ্বর লাফিয়ে পড়তেন জলে। এ-বালক পরে হয়ে উঠেছিলেন বাঙলার মহত্তম ব্যক্তি।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাঙলা গদ্যের অস্থির রূপটিকে স্থির করে দিয়ে গেছেন। তিনি রচনা করেছেন নানা রকমের বই। লিখেছেন পাঠ্যবই, করেছেন অনুবাদ। রচনা করেছেন নিজের জীবনী, শুনিয়েছেন প্রাচীন কাহিনী, লিখেছেন শোকগাথা, বিদ্রুপভরা রচনা। তাঁর সব রচনাই নানা দিক দিয়ে অমূল্য। বিদ্যাসাগরই সবার আগে আবিষ্কার করেন বাঙলা গদ্যের ছন্দ। কবিতার যেমন ছন্দ থাকে, তেমনি থাকে গদ্যেরও ছন্দ। এ-কথাটি আমাদের প্রথম দিকের গদ্যশিল্পীরা বুঝতে পারেন নি, তাই তাঁদের গদ্য প্রাণহীন। গদ্য রচনার ভেতরে গোপনে লুকিয়ে থাকে ছন্দ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এটি বুঝেছিলেন। তিনি সবার আগে নিয়মিতভাবে ঠিক জায়গাটিতে ব্যবহার করেন দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন ইত্যাদি চিহ্নগুলো। তার আগের বাঙলা গদ্যে যতিচিহ্ন ছিলো না, থাকলেও তা যথাস্থানে নিয়মিতভাবে ছিল না। বিদ্যাসাগর এগুলোকে গদ্যের ছন্দ রক্ষার জন্যে নিয়মিতভাবে ব্যবহার করেন। তাই তাঁর গদ্যরচনা পাঠ করার সময় ঘনঘনভাবে কমার ব্যবহার দেখতে পাই। তিনি কমা ব্যবহার করেছেন খুব বেশি, কেননা তিনি অনভ্যস্ত পাঠকদের চোখের সামনে গদ্যের ছন্দ তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। বিদ্যাসাগরের গদ্য সম্বন্ধে খুব ভালো কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি বলেছেন, বিদ্যাসাগর সবার আগে বাঙলা গদ্যকে মুক্তি দেন সংস্কৃত দীর্ঘ সমাসের কবল থেকে, এবং আবিষ্কার করেন বাঙলা শব্দের সঙ্গীত। তিনি বাঙলা গদ্যকে গ্রাম্য পাণ্ডিত্য ও গ্রাম্য বর্বরতা থেকে মুক্ত করে ভদ্রসভার উপযোগী করে তোলেন।
বিদ্যাসাগর গদ্যের ছন্দ আবিষ্কার করেছিলেন বলে তাঁর লেখা পড়ার সময় মধুর সঙ্গীত ধ্বনিত হয়। তাঁর ব্যবহৃত শব্দগুলো ধ্বনিময়, গুঞ্জনময়। এজন্যে পরবর্তী কালে অনেক লেখক অনুসরণ করেছেন বিদ্যাসাগরের গদ্যরীতি। সে-গদ্য সুর ছড়ায়, ছবি আঁকে, কল্পনার জগতে নিয়ে যায়। আবার তিনি যখন হাল্কা বিষয়ে কিছু রচনা করেছেন, তখন তা সরসতায় হয়ে উঠেছে মধুর। বিদ্যাসাগরের সঙ্গীতময় রচনার কিছু অংশ শোনাচ্ছি :
এই সেই জনস্থান মধ্যবর্তী প্রস্রবণগিরি। এই গিরির শিখরদেশ, আকাশপথে সততসঞ্চরমাণ জলধরমণ্ডলীর যোগে, নিরন্তর নিবিড় নীলিমায় অলকৃত, অধিত্যকা প্রদেশ ঘনসন্নিবিষ্ট বিবিধ বনপাদপ সমূহে আচ্ছন্ন থাকাতে, সতত স্নিগ্ধ, শীতল ও রমণীয়; পাদদেশে প্রসন্নলিলা গোদাবরী, তরঙ্গ বিস্তার করিয়া, প্রবল বেগে গমন করিতেছে।
এ-অংশটুকু নেয়া হয়েছে বিদ্যাসাগরের সীতার বনবাস থেকে। উচ্চারণ করে পড়লে সঙ্গীতের মতো শোনাবে।
বিদ্যাসাগরের অধিকাংশ বইই অনুবাদ। কিছু মৌলিক বইও তিনি লিখেছেন। তাঁর প্রথম বই বেতালপঞ্চবিংশতি বের হয়েছিলো ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে। এটি হিন্দি থেকে অনুবাদ। তাঁর দ্বিতীয় বইয়ের নাম বাঙ্গলার ইতিহাস (১৮৪৯)। এটি তিনি রচনা করেছিলেন মার্শম্যানের বই অবলম্বনে। বিদ্যাসাগরের তৃতীয় বইটিও একটি ইংরেজি বই অবলম্বনে লেখা, বইটি হচ্ছে জীবনচরিত (১৮৪৯)। এগুলো ছিলো পাঠ্যবই। তিনি আরো কয়েকটি অনুপম পাঠ্যবই লিখেছেন। তার মধ্যে রয়েছে বর্ণ-পরিচয় (১৮৫৪), কথামালা (১৮৫৬)। বর্ণ-পরিচয় বইটিতে আছে একটি ছন্দময় চরণ; — জল পড়ে। পাতা নড়ে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাল্যকালে এ-চরণটি পাঠ করে অভিভূত হয়েছিলেন। বালক কবির মনে হয়েছিলো তখন যেনো তাঁর সকল চেতনায় জল পড়তে এবং পাতা নড়তে লাগলো। এরকম আরো দুটি বই বোধোদয় (১৮৫১), আখ্যানমঞ্জরী (১৮৬৩-৬৮)। আখ্যানমঞ্জরীতে গল্প বলা হয়েছে সরসভাবে, এর সরসতার তলে লুকিয়ে আছে নীতিকথা।
বিদ্যাসাগর অনুবাদ করেছিলেন বিশ্বসাহিত্যের কয়েকটি অনন্য বই। এসব বই মূল থেকে অনুবাদ করা সহজ কথা নয়। বিদ্যাসাগর অনুবাদ করেছিলেন কালিদাসের বিখ্যাত বই শকুন্তলা (১৮৫৪), বাল্মীকি ও ভবভূতির কাহিনী চয়ন করে লিখেছিলেন সীতার বনবাস (১৮৬০)। তিনি শেক্সপিয়রের কমেডি অফ অ্যাররস বাঙলায় রূপান্তরিত করেছিলেন ভ্রান্তিবিলাস (১৮৬৯) নামে। এই বইগুলোকে শুধু অনুবাদ বললে ঠিক বলা হয় না। তিনি নিজের কালের মতো করে রচনা করেছিলেন এসব কাহিনী। এগুলো বই থেকে জন্ম নেয়া নতুন বই।
বিদ্যাসাগরের মৌলিক রচনা হচ্ছে বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৫), বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার (১৮৫৫), অতি অল্প হইল (১৮৭৩), আবার অতি অল্প হইল (১৮৭৩), ব্রজবিলাস (১৮৮৫), প্রভাবতী সম্ভাষণ (১৮৯২), স্বরচিত জীবনচরিত (১৮৯১)। মৌলিক রচনায় বিদ্যাসাগরকে পাওয়া যায় জীবন্তভাবে; তাঁর নিশ্বাসের প্রবাহ যেনো বোধ করা যায় এগুলোতে। প্রথম পাঁচটি বই তিনি রচনা করেন তাঁর প্রতিপক্ষের লোকদের আক্রমণ করে। বিদ্যাসাগর জড়িত ছিলেন নানা সংস্কার আন্দোলনে। তিনি বিধবাদের বিবাহ আইনসঙ্গত করার চেষ্টা করেছিলেন, এবং রহিত করতে চেয়েছিলেন বহুবিবাহ। তাই তাঁর জুটেছিলো অনেক বিরোধী। এদের সাথে তাঁকে নামতে হয়েছিলো নানা তর্কে; বিদ্যাসাগরের এ-পাঁচটি বই তাই তর্কযুদ্ধ। তাঁর যুক্তিগুলো শাণিত, বিদ্রুপভরা। বিদ্যাসাগরের বিদ্রুপ ছিলো রুচিশীল, তাতে বুদ্ধির ধার ছিলো তীক্ষ। তিনি এগুলো রচনা করেছিলেন ছদ্মনামে। তিনি অতি অল্প হইল এবং আবার অতি অল্প হইল রচনা করেছিলেন কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য’ নামে।
প্রভাবতীসম্ভাষণ এবং স্বরচিত জীবনচরিত তাঁর মৌলিক রচনা। এখানে জীবনের শান্ত গম্ভীর দিকটি প্রকাশিত হয়েছে। প্রভাবতীসম্ভাষণ একটি শোকগাথা। ছোটো রচনা। এরচনায় বিদ্যাসাগরের হৃদয়টি অনাবৃত হয়ে দেখা দিয়েছে। বিদ্যাসাগর সারাজীবন মানুষকে ভালোবেসেছেন, কিন্তু শেষ জীবনে তিনি মানুষের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি জীবনের প্রথম থেকে ছিলেন নাস্তিক; কিন্তু বিশ্বাস করতেন মানুষকে। শেষ জীবনে সেই মানুষের ওপরও তাঁর বিশ্বাস ছিলো না। বাঙলায় মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখা ভীষণ কঠিন! তিনি সঙ্গীহীন হয়ে পড়েছিলেন। তখন তাঁর প্রিয় হয়ে উঠেছিলো রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রভাবতী নামে আড়াই বছরের একটি শিশুকন্যা। বিদ্যাসাগর এ-শিশুকেই করে নিয়েছিলেন নিজের বন্ধু। কিন্তু প্রভাবতীর মৃত্যু হয় শিশুকালেই। বিদ্যাসাগর শোকে ভেঙে পড়েন। প্রভাবতীকে স্মরণ করে তিনি রচনা করেন বাঙলা ভাষার এক অসাধারণ অকাতর রচনা প্রভাবতী সম্ভাষণ। সে-করুণ রচনা থেকে বিদ্যাসাগরের বেদনার একটুখানি তুলে আনি :
বৎসে! তোমায় আর অধিক বিরক্ত করিব না, একমাত্র বাসনা ব্যক্ত করিয়া বিরত হই যদি তুমি পুনরায় নরলোকে আবির্ভূত হও, দোহাই ধর্মের এটি করিও, যাঁহারা তোমার স্নেহপাশে আবদ্ধ হইবেন, যেন তাহাদিগকে, আমাদের মত, অবিরত, দুঃসহ শোকদহনে দগ্ধ হইয়া, যাবজ্জীবন যাতনাভোগ করিতে না হয়।
স্বরচিত জীবনচরিত তাঁর আত্মজীবনী। এটি তিনি শেষ করে যান নি। এটিও অমূল্য গ্রন্থ।
বিদ্যাসাগরের সমকালে এবং একটু পরে যাঁরা উৎকৃষ্ট গদ্য লিখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪-১৮৮৩), দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫), অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-১৮৮৬), রাজেন্দ্রলাল মিত্র (১৮২২-১৮৯১), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮১৮৯৪], এবং আরো অনেকে। এর আরো পরে আসেন আধুনিক কালে রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ চৌধুরী।
অক্ষয়কুমার দত্ত লিখেছিলেন বেশ কয়েকটি বই। বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর ছিলো গভীর অনুরাগ, ত্যাগ করেছিলেন আস্তিকতা। তিনি ধর্মের নিষ্ফলতা দেখিয়ে লিখেছিলেন একটি বিখ্যাত সমীকরণ। অক্ষয়কুমারের সমীকরণটি হচ্ছে : শ্রম + প্রার্থনা = শস্য, শ্রম = শস্য, সুতরাং প্রার্থনা = ০। শ্রম ছাড়া ধর্মকর্মের ফল শূন্য। সারাদিন ধর্মকর্মেও একটি ধান জন্মানো অসম্ভব। তাঁর গদ্যও ভালো। তাঁর খুব নামকরা বই বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধবিচার। বইটি একটি অনুবাদ বই, এর প্রথমাংশ বের হয় ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে; দ্বিতীয়াংশ বের হয় ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে। অক্ষয়কুমার ছিলেন সে-সময়ের বিখ্যাত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক। তাঁর রচিত পাঠ্যপুস্তকের মাঝে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিলো চারুপাঠ। বইটি তিন খণ্ডে বিভক্ত, বের হয়েছিলো ১৮৫২, ১৮৫৪ এবং ১৮৫৯ সালে। এটি ছিলো সেকালের একটি অবশ্যপাঠ্য পাঠ্যবই। অক্ষয়কুমারের অন্য দুটি বই ধর্মনীতি (১৮৫৬), ভারতবর্ষীয় উপাসকসম্প্রদায় (১৮৭০)। অক্ষয়কুমার বাঙলা গদ্যকে জ্ঞানচর্চার উপযোগী করে তুলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন উৎকৃষ্ট কাব্যময় গদ্যলেখক। তিনি ছিলেন ব্রাহ্মধর্মের প্রতিষ্ঠাতা, তত্ত্ববোধিনী সভা ও তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর বইগুলোর মধ্যে রয়েছে আত্মতত্ত্ববিদ্যা (১৮৫২), ব্রাহ্মসমাজের বক্তৃতা (১৮৬২), স্বরচিত জীবনচরিত (১৮৯৪)। তাঁর জীবনচরিত মহৎ বই।
রাজেন্দ্রলাল মিত্র ছিলেন বিখ্যাত পত্রিকা বিবিধার্থ সহ-এর (১৮৫১) সম্পাদক। তিনি এ-পত্রিকায় জ্ঞানবিজ্ঞানচর্চা ও সাহিত্যসমালোচনার এক গৌরবজনক অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন। তাঁর বইগুলোর মধ্যে আছে প্রাকৃত ভূগোল (১৮৫৪), শিল্পিক দর্শন (১৮৬০), পত্রকৌমুদী (১৮৬৩)। এ-সময়ের দুজন বিখ্যাত গদ্যলেখক রাজনারায়ণ বসু [১৮২৬ -১৮৯৯], ও ভূদেব মুখোপাধ্যায় [১৮২৭-১৮৯৪]। রাজনারায়ণ বসুর বিখ্যাত গ্রন্থ সেকাল আর একাল (১৮৭৪), বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক বক্তৃতা (১৮৭৮)। ভূদেব মুখখাপাধ্যায়ের বিখ্যাত গ্রন্থ পারিবারিক প্রবন্ধ (১৮৮২), সামাজিক প্রবন্ধ (১৮৯২)।
বাঙলা গদ্যের ভুবনে এক তুমুল বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র। তাঁর ছদ্মনাম ছিলো টেকচাঁদ ঠাকুর। তিনি হৈচৈ বাধিয়েছিলেন বেশ। এতোদিন আমরা যে-গদ্য দেখেছি, তা হচ্ছে সাধু গদ্য। তাতে সংস্কৃত শব্দের প্রাধান্য লক্ষ্য করার মতো। প্যারীচাঁদ ১৮৫৪ সালে তার এক বন্ধুর সাথে প্রতিষ্ঠা করেন একটি পত্রিকা; নাম মাসিক পত্রিকা। তিনি ঘোষণা করেন সাধু গদ্য চলবে না, চলবে না সংস্কৃত শব্দ। বাঙলা ভাষাকে করতে হবে সত্যিকারে বাঙলা ভাষা। তিনি সাহিত্য রচনা করতে শুরু করেন কথ্যরীতিতে, সাধুরীতিতে নয়। যে-ভাষায় আমরা কথা বলি, প্যারীচাদ সে-ভাষা ব্যবহার করতে চান সাহিত্যে। এ-ভাষা হবে মুখের ভাষার অনুরূপ। দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তিনি নিজেই। লেখেন একটি উপন্যাস, প্রকাশ করতে থাকেন সাহিত্য পত্রিকায়। তাঁর এ-বইটির নাম আলালের ঘরের দুলাল (১৮৫৮)। প্যারীচাঁদ মিত্র বাঙলা গদ্যের রূপ বদলাতে চেয়েছিলেন। সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন নতুন গদ্য। আজকাল আমরা যে-চলতি গদ্য লিখি, তাই চেয়েছিলেন প্যারীচাঁদ। তাই তাঁর লেখায়, আলালের ঘরের দুলাল-এ তিনি ব্যবহার করেন চলতি ক্রিয়াপদ, ব্যবহার করেন বেশি পরিমাণে খাঁটি বাঙলা শব্দ। তিনি ভাষাকে চলতি ভাষা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি পুরোপুরি সফল হন নি। তাঁর গদ্য না চলতি, না সাধু। সাধু-চলতি-আঞ্চলিক সব রকমের ভাষা মিশিয়ে এক নতুন গদ্য তৈরি করেন তিনি। এভাষারীতি তিনি কাজে লাগিয়েছেন মাত্র আলালের ঘরের দুলাল-এ। তিনি রচনা করেছিলেন আরো অনেক বই, সেগুলো সবই বিদ্যাসাগরের মতো সাধু গদ্যে রচিত। তার আলালের ঘরের দুলাল বই আকারে প্রথম বের হয় ১৮৫৮ অব্দে। তাঁর অন্যান্য বই হচ্ছে মদ খাওয়ার বড় দায় জাত থাকার কি উপায় (১৮৫৯), রামারঞ্জিকা (১৮৬০), যৎকিঞ্চিৎ (১৮৬৫), ডেবিড হেয়ারের জীবনচরিত (১৮৭৮), বামাতোষিণী (১৮৮১)। প্যারীচাঁদের বিদ্রোহের পথ ধরে বাঙলা গদ্যের জগতে আসেন আরেক বিপ্লবী কালীপ্রসন্ন সিংহ [১৮৪০-১৮৭০l। তিনি চলতি গদ্যে লেখেন একটি অনন্য বই, যার নাম হুতোম পাচার নকশা (১৮৬২)। তাঁর এ-বইটি আলোড়ন জাগিয়েছিলো নানা কারণে, এর একটি বড়ো কারণ এর চলতি গদ্য। তাঁরা দুজন বাঙলা ভাষায় চলতি গদ্যের অগ্রপথিক।
এরপর আসেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি প্রথম যথার্থ ঔপন্যাসিক আমাদের সাহিত্যের এবং শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিকের একজন। তিনি বাঙলা গদ্যকে বিভিন্ন ভাবে বিকশিত করেছিলেন। ১৮০১ থেকে ১৮৬০ পর্যন্ত সকল গদ্য লেখকদের সাধনা যেনো চরম সফলতা হয়ে দেখা দেয় তার মধ্যে। তাঁর সম্বন্ধে বেশি বলবো না। একটি পুরো বই তো লেখা দরকার তাঁকে নিয়ে। বঙ্কিম বাঙালির সৃষ্টিশীলতা ও মনীষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রকাশ।
গদ্য বিকশিত হয়, অভাবিত সৃষ্টিশীল হয় বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস ও প্রবন্ধে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সে-গদ্যকে উচ্ছ্বসিত করে তোলেন গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে, চিঠিপত্রে। রবীন্দ্রপ্রসঙ্গেও বেশি বলার দরকার নেই। তবে একটু বলা দরকার আরেকজন সম্বন্ধে; তাঁর নাম প্রমথ চৌধুরী [১৮৬৮-১৯৪৬]। আমরা আজ যে সব কাজে চলতি গদ্য ব্যবহার করি, তা প্রমথ চৌধুরীরই জন্যে। তিনি সাহিত্যে এসেছিলেন চলতি গদ্যরীতিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যেই। তাতে তিনি সার্থক হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথও অনেকদিন চলতি গদ্য লেখেন নি, শেষ জীবনে লেখা শুরু করেন। এর মূলে আছেন প্রমথ চৌধুরী।