২২. উন্মীলন

উন্মীলন

পরীক্ষার আগে আগে বাবা যেচে কথা বললেন এসে। ঠাইস্যা লেখাপড়া কর। আর উপায় নাই।

আর উপায় নাই সে আমিও জানি। কবিতাকে ছুট্টি দিয়ে দিয়েছি সেই কবে, এখন রোগ আর রোগী নিয়ে দিন কাটে, কেবল দিন নয়, রাতও। হাসপাতাল আর বাড়ি, বাড়ি আর হাসপাতাল, এই করে দিনের বেশির ভাগ যাচ্ছে, আর রাতও যাচ্ছে না ঘুমিয়ে। মা গরম দধু এনে সামনে রাখছেন, দধু পড়ে থেকে নষ্ট হতে থাকে, মা বলেন, দধু টা খাইয়া লও মা, খাইলে মাথায় পড়া ঢুকব। যখন মাথা ঘামাতে থাকি লেখাপড়া নিয়ে, মা বেড়ালের মত পা টিপে টিপে এসে, যেন কোনও শব্দে আমার মনোযোগ নষ্ট হয়, মাথায় ঠাণ্ডা তেল দিয়ে যান, ফিসফিস করে বলেন, মাথাটা ঠাণ্ডা থাকব।

এত রোগ বালাই নিয়ে পড়ে থেকে মনে হয়, পৃথিবীতে কত কিছু ঘটে যাচ্ছে, কেবল আমিই তার খবর জানি না। মাঝে মাঝে চেয়ার ঠেলে উঠে পড়ি, উঠোনের খোলা হাওয়ায় দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙি। অবকাশ যেভাবে চলে, চলছে। উত্থান পতনে। ভাল মন্দে। সুখে অসুখে। সুহৃদ হাঁটতে শিখেছে, দৌড়োতে, কথা বলতে। বাড়ির সবাইকে ভালবাসতে শিখেছে, অবশ্য একটি জিনিস তাকে শিখিয়ে দেওয়া হলেও শেখেনি সে হল তার বাবা মাকে আপন ভাবতে। তাদের কোলে কাখে যেতে। তারা ঢাকা নিয়ে যেতে চাইলে ঢাকা যেতে। আরেকটি ছেলে শুভ, দাদার চেয়েও বেশি সে হাসিনার ছেলে। দেখতে হাসিনার মতই কাঠি। দিনে ছবেলা খেয়েও কাঠি। এই দুই কাঠির গায়ে মাংস বাড়াতে বাবা থলে ভরে মাছ মাংস কেনেন। দুই কাঠির পাতে বেশির ভাগ মাছ মাংস চলে যায়। তবু কাঠিরা কাঠিই থেকে যায়। মা বলেন, আসলে শরীরের গঠনই ওদের ওইরকম। বাবার চাপে হাসিনার বিএড করা হয়েছে। এখন সে বিএবিএড, যে কোনও সময় যে কোনও ইশকুলে একটি মাস্টারির চাকরি পেয়ে যেতে পারে। বাবার চাপ তাপ ভাপ ইয়াসমিনের ইমপ্রুভমেন্ট পরীক্ষা দেওয়াতে পারেনি। শেষ অবদি আনন্দমোহনেই উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হয়েছে।

বোটানি পইড়া কি হইবি রে?

বোটানিস্ট হইয়াম। ইয়াসমিনের খেয়ালি উত্তর।

ওই আর কি, মালি হইবি। হা হা।

ইয়াসমিন মালি না হলেও অনেকটা মালির মতই হয়ে গেল। বাড়ির গাছগুলো দিব্যি বাড়ছে, কিন্তু ওদের পাতা দেখে দেখে বলছে, এই গাছের এই রোগ, ওই গাছের ওই রোগ।

রোগ সারানোর ওষধু কি? এন্টিবায়োটিক গুইলা খাওয়াবি নাকি?

ইয়াসমিনকে অপদস্থ করায় বাবার চেয়ে আমি কম যাই না। অপদস্থ ও কতটুকু হয় তা বোঝা যায় না, কারণ বোটানিতে ভর্তি হওয়ার প্রথম কিছুদিন ওর যে উদ্দীপনার দীপটি ছিল, তা ধীরে ধীরে নিভতে শুরু করেছে। প্রতিদিন কচুরিপানার মত বান্ধবী বাড়ছে ওর, বান্ধবীদের বাড়িতে যাওয়া আসা হচ্ছে। পাড়াতেও ওর জনপ্রিয়তা বেশ। ভাইফোঁটায়, বিয়েতে, জন্মদিনে, বারো মাসের তেরো পুজোয় ওর নেমন্তন্ন থাকে। আমার কোনও নেমন্তন্ন থাকে না পাড়ায়।

ওরা আমারে ডাকে না কেনরে?

তুমি মানুষের সাথে মিশতে পারো না, তাই ডাকে না। সোজা উত্তর।

আমার সীমানা ইয়াসমিনের সীমানার চেয়ে অনেক ছোট। সুহৃদের জন্মদিনে ছোটদা ঢাকার পূর্বাণী হোটেল থেকে বারো পাউন্ডের একটি কেক এনে উৎসবের আয়োজন করলেন। আমার ক্লাসের ছেলেমেয়ে এসেছিল ছ জন, ইয়াসমিনের নিজস্ব জগত থেকে এল আঠারো জন। ইয়াসমিনকে অনেকটা বাঘের মত মনে হয়, তর্জন গর্জন বেশ, আঠারো ঘা দিয়ে দিতে পারে ইচ্ছে করলেই।

 

হাসিনা সেই আগের মত এখনও সুহৃদের কেন এটা আছে, শুভর কেন এটা নেই, সুহৃদ কেন আদর বেশি পাচ্ছে, শুভ কেন কম পাচ্ছে—এসব নিয়ে চিনচিন জিনজিন ঝিনঝিন করে। ঈদে বাড়ির সবার হাতে যার যার কাপড় চোপড় কেনার জন্য বাবা টাকা দিলেন। শুভ সুহৃদের জন্য সমান অঙ্কের টাকা। আমার আর ইয়াসমিনের জন্য সমান। গীতা আর হাসিনার জন্য সমান। দাদা ছোটদার জন্য সমান। লিলি লিলির মা নার্গিস আর ঝর্ণার জন্য সমান। মার জন্য কিছু নয়। মাকে ছোটদা দেবেন, যেহেতু মা ছোটদার ছেলেকে লালন পালন করছেন। অনেকটা পারিশ্রমিক দেওয়ার মত বছরে একটি বা দুটি সুতি শাড়ি। ঈদে আমার আগের মত উৎসব করা হয় না। ঈদে এমন কি আমি নতুন জামাও পরি না। ঈদের এই গরু জবাই, নতুন জামা কাপড়, পোলাও মাংস জর্দা সেমাই, আমার কাছে বড় অর্থহীন লাগে। একটি জিনিসই ভাল লাগে, বালতি ভরে মাংস নিয়ে বাইরে বসে কালো ফটকে ভিড় করা শত শত ভিখিরিদের থালায় টোনায় হাতে মাংস দিতে। ভেতরের বারান্দায় বসে মাংস কাটা আর ভাগ করায় দাদার উৎসাহ সব চেয়ে বেশি। তিনি সারাদিন ধরে তাই করেন। নিজেদের জন্য, ধনী প্রতিবেশিদের জন্য, আত্মীয় স্বজনদের জন্য ভাল ভাল মাংস রেখে রগতেলহাড়সর্বস্ব মাংসগুলো দেওয়া হয় ভিখিরিদের। ভিখিরিদের কাছে মন্দ বলে কিছু নেই। তারা যা পায়শুকুরআলহামদুলিল্লাহ বলে লুফে নেয়।

 

রোজা আসে, রোজা যায়। রোজায় বিশ্বাস করি না বলে রোজা রাখি না। সন্ধেবেলায় ইফতার খেতে ভাল লাগে, খাই। অবশ্য সাইরেন পড়ার জন্য অপেক্ষা আমার সয় না। পিঁয়াজি বেগুনি ছোলাভাজা সাজিয়ে রাখা হয় টেবিলে, খেতে স্বাদ জিনিসগুলোর। আমি ফেলে রাখি না। বাবা, আমার খুব অবাক লাগে, পীরবাড়িতে কাফের হিসেবে পরিচিত হলেও, নামাজ না পড়লেও, কোরান হাদিস ইত্যাদিতে কোনও আগ্রহ না দেখালেও পুরো মাস রোজা রাখেন। রোজা রাখার কারণ সম্পর্কে বাবাকে কখনও জিজ্ঞেস করা হয়নি। আমার বিশ্বাস বাবা রোজা রাখেন দশজনের একজন হতে। তাঁর বয়সী সবাই যখন রোজা রাখেন, তিনিও রাখেন। রাখলে প্রশ্নহীন নিঝর্ঞ্ঝাট জীবনে যাপন করতে পারেন বলে রাখেন। দাদাও রোজা রাখেন, যদিও ঈদের নামাজ ছাড়া আর কোনও নামাজ তিনি পরেন না, বাবার মত। ছোটদা ঈদের নামাজে যান, কিন্তু সারা বছর নামাজের নাম নেই, রোজার নাম নেই। হাসিনা আল্লাহ বিশ্বাস করলেও, নামাজ রোজায় বিশ্বাস করলেও রোজা রাখে না, রাখে না কারণ তার কাঠিত্ব এখনও ঘোচেনি। রোজা রাখলে, তার ভয়, হাড়ের ওপর যে চামড়াটি আছে, সেটিও ঝুরঝুর করে ঝরে যাবে। এরশাদ সরকার দেশে একটি নতুন নিয়ম চালু করেছেন, রোজার সময় দিনেরবেলা খাবার দোকানগুলো বন্ধ থাকবে। এ কি আশ্চর্য, সবাই কি রোজা রাখে নাকি! কত মুটে মজুর কুলি, দুপুরবেলা না খেলে কাজই করতে পারবে না, তারা ক্ষিধে পেলে কি করবে? হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টানদের কথাও তো ভাবতে হবে! নাস্তিকদের কথাও। দেশ তো কেবল মুসলমানের নয়। মুসলমান যারা আছে, সবাই তো রোজা রাখে না। খাবার দোকান বন্ধ থাকলে চলবে কেন! আমি অবশ্য প্রতিবাদ হিসেবে রোজার সময় মুখে একটি চুইংগাম রাখি। সারাদিন চিবোতে থাকি চুইংগামটি। কলেজ ক্যান্টিনে ঘন ঘন চা পান করে আসি। কলেজের ক্যান্টিনটি কলেজের ভেতর হওয়ায় পুলিশ এসে হানা দেয় না, রক্ষে। এরশাদের এই নিয়মে জামাতে ইসলামির লোকেরা বেজায় খুশি, কিন্তু কেউ কেউ যারা ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ, আপত্তি করছেন। কারও আপত্তি শোনার লোক নন এরশাদ। তিনি ক্ষমতায় থাকতে চান যে করেই হোক। সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মের প্রতি অতিরিক্ত ভীরুতা দেখালে সংখ্যাগরিষ্ঠ তাঁকে বাহবা দেবে এরকম বিশ্বাস নিয়ে তিনি দেশ চালাচ্ছেন। এরশাদকে কখনও আমার ধার্মিক লোক বলে মনে হয় না। মুখে গাম্ভীর্য এনে তিনি যতই ধর্মের কথা বলুন, যতই তিনি সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম নামে নতুন একটি জিনিস আমদানি করুন এবং সেই রাষ্ট্রধর্মকে ইসলাম বলে ঘোষণা করে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের সর্বনাশ করুন, আমার মনে হয় লোকটি দেশের মানুষকে ফাঁকি দিচ্ছেন, বোকা বানাতে চাইছেন। লোকটি নিরক্ষর অশিক্ষিত ধর্মভীরু মানুষের ভোট চাইছেন, আর কোনও উদ্দেশ্য তাঁর নেই।

 

ধমর্, রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে মেতে থাকলে যে আমার চলবে না, তা বাবা আমাকে বলেন। পরীক্ষা যখন গায়ে জোরে ধাক্কা দিল, রাত তিনটেয়, চারটেয় আমাকে ঠেলে তোলেন, পড়তে। আমি হুড়মুড়িয়ে বিছানা ছেড়ে পড়ার টেবিলে বসি, মা ওই রাতে উঠে ফ্লা−স্ক চা বানিয়ে রেখে যান টেবিলে। আমার লিখিত পরীক্ষা হয়ে গেলে বাবা শশব্যস্ত হয়ে মৌখিকে অন্য মেডিকেল থেকে পরীক্ষক কারা আসছেন, বাবার চেনা কিনা, বাবার ছাত্র কিনা, বাবার সহপাঠী কি না, খোঁজ নেন। খোঁজ নিয়ে তিনি পেয়ে যান যে কেউ কেউ তাঁর ছাত্র ছিলেন কোনও এক কালে। তাঁদেরই বাবা কাঁচুমাচু মখু নিয়ে হাত কচলাতে কচলাতে বলে আসেন আমার মেয়েটা পরীক্ষা দিচ্ছে এবার, একটু দেখবেন। একটু দেখবেন, এর মানে এই যে মেয়েটাকে ইচ্ছে করে কম নম্বর দেবেন না। আসলে কেউ কাউকে পাশ করিয়ে দিতে পারেন না। পারেন না, কারণ একজনের হাতে দায়িত্ব থাকে না পাশ করাবার। দেখবেন এর অনুরোধটি হল, ইচ্ছে করে যেন ফেল করাবেন না। ইন্টারনাল পরীক্ষকরা সবাই যে আমার ওপর খুশি তা নয়। সালাম না দেওয়ার কারণে আমাকে বেশির ভাগ অধ্যাপকই বেয়াদব বলে জানেন। যাই হোক, দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষা চলে। দীর্ঘদিন ধরে বাবা দুশ্চিন্তায় থাকেন। দীর্ঘদিন ধরে পাশ করব না এই আশংকা নিয়ে দুরুদুরু বক্ষে শুষ্ক হয়ে ওঠা গলদেশ নিয়ে ভয়ে ঘন ঘন তেষ্টা পাওয়া পেচ্ছাব পাওয়া আমি পরীক্ষা দিই মৌখিক। মৌখিক পরীক্ষাকে পরীক্ষা বলে মনে হয় না। মনে হয় যেন পুলসেরাত পার হচ্ছি। সরু একটি সুতোর ওপর দিয়ে হাঁটছি। একটু কাত হলাম কি ধপাশ। ধপাশ একেবারে সাপ বিচ্ছু আর দাউ দাউ আগুনের মধ্যে। ভাল ছাত্র রাজিব আহমেদের চিকিৎসাজ্ঞানে টইটম্বুর খাতা পড়ে পরীক্ষা দিয়ে হয়ত লিখিত পরীক্ষায় ভাল করা যায় কিন্তু মৌখিকের দুশ্চিন্তায় আমার মুখের ভাষা হারিয়ে যেতে থাকে। মাথা থেকে কর্পূরের মত উড়ে যেতে থাকে যা জানি তাও। এই করে পরীক্ষা হয়। ওয়ার্ডের ভেতর সারি সারি রোগীর মাঝখানে বিশাল টেবিল পেতে অধ্যাপকরা বসে থাকেন। অধ্যাপকদের অধ্যাপক মনে হয় না, যেন এক একজন আজরাইল। গলা যে কার কাটা যাচ্ছে, কারও বোঝার উপায় নেই। পরীক্ষা শেষ হয়, কিন্তু জানা হয় না, আমার মণ্ডুুটি আছে কি না এখনও ধড়ে।

 

পরীক্ষার পর ঢাকা যাওয়ার জন্য উতলা হই। কিন্তু রুদ্র ঢাকায় নেই। মিঠেখালি থেকে ফেরেনি। ময়মনসিংহে বসে রুদ্রর ঢাকা ফেরার অপেক্ষা করতে থাকি। অপেক্ষা জিনিসটি বড় অশান্তির। অশান্তির হলেও বইখাতা নিয়ে আপাতত আর বসতে হচ্ছে না, এই এক স্বস্তি আমার। হাসিনা বি এড পাশ করার পর এমএডএ ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন বাবা। শুভকে মার দায়িত্বে রেখে প্রতিদিন কড়া রঙের শাড়ি পরে মুখে নানারকম রং লাগিয়ে কলেজে যায় সে। মার হাতে এখন দুজনের লালন পালনের ভার। এক হাতে শুভকে সামলাচ্ছেন, আরেক হাতে সুহৃদকে। হাসিনা কলেজ থেকে ফিরেই প্রথম দেখে শুভর যতে ্ন কোনও ত্রুটি হয়েছে কি না। না, মা কোনও ত্রুটি রাখেন না, রাখেন না এই কারণে যে শুভর য−ত্নর ত্রুটি হলে তুলকালাম কাণ্ড বাধাঁবে হাসিনা। বাড়িটিকে কলহমুক্ত রাখতে মা ত্রুটির ত্রিসীমানা মাড়ান না। সুহৃদ আর শুভ দুজনকেই গোসল করিয়ে দুজনের গায়ে পাউডার মেখে জামা পরিয়ে দুজনকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলেন মা, হাসিনা এসেই শুভকে ছোঁ মেরে নিয়ে বলল, ইস ছেলেটা ঘাইমা গেছে। ফ্যানের নিচে তো সুহৃদরে শোয়ানো হইছে, শুভরে ফ্যানের থেইকা দূরে শোয়ানো হইল কেন? ঘরের সিলিংএ একটি মাত্র পাখা। পাখার তলে শুভও ছিল, সুহৃদও ছিল। কিন্তু সুহৃদ নাকি পাখার কাছাকাছি ছিল বেশি। মা বলেন, এইগুলা কি কও ! শুভ গড়াইয়া কিনারে গেছে। মা পছন্দ করেন না ছেলের বউএর চিৎকার চেঁচামেচি। কারণ যে কোনও চেঁচামেচিতে দাদা এসে উপস্থিত হন, এবং হাসিনা যদি অসঙ্গত বা অযৌক্তিক কোনও কথা বলে, দাদা তা নতমস্তকে মেনে নেন। দাদা রায় দিয়ে দিলেন, মা ইচ্ছে করেই শুভকে কষ্ট দেওয়ার জন্য পাখার ঠিক তলে রাখেননি। মা চোখের জল গোপনে মোছেন। গোপনে মুছেই সুহৃদের চেয়ে চতগু র্ণু যত্ন করেন শুভর। গোসল করিয়ে যখন চুল আঁচড়ে দেন, সিঁথিটিও লক্ষ রাখেন যেন একেবারে সোজা হয়। কারণ একবার সিঁথিটি এক চুল পরিমাণ বাঁকা ছিল বলে হাসিনা বলেছে, সুহৃদের সিঁথি তো বেঁকে নাই, শুভরটা বেঁকল কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর মার কাছে নেই। নেই বলে মার সারা শরীরে ভয়। সারা মনে ভয়। এমএড ক্লাস করে গোড়তোলা জুতোর ঠক ঠক শব্দ তুলে বাড়ি ঢোকে হাসিনা। এসেই গলা ছেড়ে ঝর্ণাকে ডাকে, ঝর্ণা দৌড়ে যায় কাছে। হাসিনা খবর নেয় বাড়ির সব ঠিকঠাক আছে কি না। বাড়ির অবস্থা সম্পর্কে ঝর্ণা তার জানা এবং অজানা দু খবরই বেশ অনেকটা সময় নিয়েই দেয়। শুভর কাপড় চোপড় ধোয়া, শুভর বোতলবাটি ধোওয়া, শুভর বিছানা গোছানো, খেলনা গোছানো ইত্যাদি সারা হয়ে গেলে ঝর্ণা বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে থাকে। হাসিনার কড়া নির্দেশ শুভর কাজ ছাড়া বাড়ির অন্য কাজে হাত না দেওয়ার। অন্য কাজে হাত দিতে হয় লিলির মার, লিলির, ওদের দিয়েও যখন কুলোয় না, নার্গিসের। এই অন্য কাজের মধ্যে হাসিনার কাপড় ধুয়ে দেওয়া,ইস্ত্রি করে দেওয়া, তাকে রেঁধে বেড়ে খাওয়ানো, তার এঁটো বাসন পত্র ধোয়া সবই আছে। লিলি আর লিলির মা দুদিনের জন্য গ্রামের বাড়ি গিয়েছিল, তখন নার্গিসকে সুহৃদের কাজ ফেলে বাড়ির রান্না বান্না,কাপড় ধোয়া, ঘর মোছা ইত্যাদি কাজ করতে হয়েছে। ঝর্ণা বারান্দায় বসে থেকেছে।

ঝর্না শুভ কই?

শুভ খেলে।

শুভ খেলে কেন? শুভর তো এখন ঘুমানির কথা! মা ঘুম পাড়ায় নাই কেন শুভরে? দুপুর দেড়টার জায়গায় পৌনে দুটো হয়ে গেছে, শুভ ঘুমোয়নি। কি ব্যাপার? শুভর তো দেড়টার সময় ঘুমোনোর কথা। ঘড়ি দেখে ঠিক বারোটায় দধু খাবে, একটায় মুরগির সপু খাবে, একটা দশে ভাত মাছ সবজি খাবে, খেয়ে দেড়টায় ঘুমোবে। শুভকে দধু সপু ভাত সবই খাওয়ানো হয়েছে কিন্তু না ঘুমিয়ে ছেলে খেলতে শুরু করেছে।

হাসিনার কর্কশ কন্ঠ, এইরকম অবস্থা হইলে তো আমার কলেজে যাওয়া হবে না। বাসায় বইসা বাচ্চা পালতে হবে।

হাসিনা পরদিন কলেজে যায় না।

কি শুভর মা, কলেজে যাইবা না?

নাহ! আজকে শরীরটা ভাল লাগতাছে না বলে সারাদিন শুয়ে থেকে শুভকে বিকেলে মার কোল থেকে তুলে নিয়ে নিজের ঘরে দুঃখী মখু করে বসে থাকে হাসিনা।

বাবা বাড়ি ফিরেই আজকাল বৌমা বৌমা বলে হাসিনাকে ডাকেন, প্রতিদিনই তিনি খবর নেন ক্লাস কেমন হচ্ছে, পড়াশোনা সে ঠিক ঠিক করছে কি না।

হাসিনা এবার মখু মলিন করে বলল, যাইতে পারি নাই কলেজে।

মানে? যাইতে পারো না ই মানে? কেন যাইতে পারো নাই? উত্তেজনায় বাবা চশমা খুলে ফেললেন।

শুভরে দেখতে হয়, তাই। ঝর্না তো আর শুভরে গোসল করাইতে খাওয়াইতে পারে না।

শুভর দাদি আছে না এইসব করার জন্য?

হাসিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। না,মা তো সময় পান না। মার তো সুহৃদরে দেখতে হয়।

যাও বেডিরে ডাকো।

কোন বেডিরে? লিলির মারে?

বাবা খেঁকিয়ে ওঠেন, লিলির মারে ডাকবা কেন? মাথায় বুদ্ধি সুদ্ধি নাই নাকি? নোমানের মারে ডাকো।

হাসিনা মাকে ডেকে আনে। ঠোঁটে চিকন হাসি তার।

বাবা দাঁতে দাঁত ঘঁষে মাকে বলেন, ছেলের মা যায় কলেজে,ছেলেরে তুমি রাখবা না তো রাখবে কে?

আমি তো রাখিই, শান্ত গলা মার, আমার গোসল করানি খাওয়ানি যদি শুভর মার না পছন্দ হয়, তাইলে আমি কি করতাম?

তুমি কি করতা মানে?

মানুষ রাইখা লন শুভরে পালনের লাইগা।। আমি দুই বাচ্চা আর কুলাইতে পারতাছি না।

দাদি থাকতে ছেলে কাজের মানুষের কাছে বড় হইব?

কামালরে খবর দেন। সুহৃদরে নিয়া যাক। আমার নিজের অসুখ । নিজের একটু বিশ্রাম নাই, ঘুম নাই। এত পারতাছি না।

দেখ দেখ কথার ছিরি দেখ। বাবা হাসিনার দিকে চেয়ে মাকে ইঙ্গিত করেন বাঁকা চোখে, বাঁকা ঠোঁটে।

চিকন হাসিটি দীর্ঘদীর্ঘদিন একটি নতুন বিμছুর মত সেঁটে থাকে হাসিনার ঠোঁটে।

 

সুহৃদকে ছোটদার কাছে দিয়ে দেওয়াও হয় না। শুভর জন্য আলাদা কাজের বেটি রাখাও হয় না। মা ই একা লালন পালন করতে থাকেন দুই নাতি। বালতি ভর্তি কাপড় ফেলে রাখে হাসিনা। লিলির মার তা ধুতে ধুতে বেলা যেতে থাকে, মাকে দৌড়ে রান্নাঘরে যেতে হয়। মাকে রাধঁ তে হয় বাড়ির সবার জন্য। মা পারেন না লিলির মাকে হাসিনার কাপড় ধোয়া থেকে তুলে আনতে। আমার মনে হতে থাকে, মা হাসিনাকে ভয় পাচ্ছেন। বাবাকেও মা সম্ভবত এত ভয় পান না। মার ভয় দাদাকে নিয়ে, দাদা যদি আবার বাড়ি ছেড়ে চলে যান, দাদা যদি হাসিনার মন খারাপ দেখলে অখুশি হন। দাদা যদি মাকে আর মা বলে না ডাকেন! মার রক্ত যাওয়া শরীরটি দুর্বল হতে থাকে। অথচ এই দুর্বলতা নিয়েই মা ভোরবেলা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ব্যস্ত থাকেন সংসারকাজে। বাবার কাছে বিনিয়ে বিনিয়ে বলেন, আমার ত রক্ত নাই শইলে আর। আমার তো কিছু ভাল খাইতে হইব। এক পোয়া কইরা দধু , দুইটা কলা,দুইটা ডিম আমার লাইগা কি দিবেন? বাবা ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে মার স্পর্ধা দেখেন। মা যত না মার দাবিতে তার চেয়ে বেশি শুভকে রাখার দাবি নিয়ে বলেন, কি রে নোমান, তর বাপে তো কিছু দেয় না, তুই কি আমার লাইগা একটু দধু কলার ব্যবস্থা করতে পারবি? আমার ত শইল ভাইঙ্গা যাইতাছে।

দাদা হাসতে হাসতে জিভ কেটে বলেন, কি যে কন মা। আপনার শইল কই ভাঙতাছে! বরং খুব বেশি মোটা হইয়া যাইতাছেন। ডায়েট ক−ন্ট্রাল করেন। খাওয়া কমাইয়া দেন।

পাইলসের কি কোনও ওষধু তর দোকানে আছে?

নাহ। পাইলসের কোনও ওষধু নাই।

ওষধু নেই। সাফ কথা। দাদা এখন বাবার ওষধু ব্যবসার কর্তা। রমরমা ব্যবসা তার। চমৎকার সাজিয়ে নিয়েছেন দোকান। হাসপাতালে ওষুধের যোগান দেন। বড় বড় ক্লিনিকেও দেন। ওদিকে বাবা নিজের চেম্বারটির পরিসরও বড় করেছেন। এক্সরে মেশিন বসিয়েছেন। মাইত্রে²াসকোপ কিনে প্যাথলজি বসিয়েছেন। জুরিসপ্রুডেন্স বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহকে বাবা তাঁর প্যাথলজিতে অবসরে বসতে বলেছেন, বাড়তি আয়ের লোভে আবদুল্লাহ আসেন এখানে। বাবার চেম্বারে কোনও কারণে গেলে রোগীর ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকতে হয়। গ্রামের দরিদ্র রোগীর ভিড়ই বেশি। কেউ পেট ব্যথা নিয়ে এলেও দেখি বাবা বুকের এক্সরে করতে দিচ্ছেন। মল মুত্র পরীক্ষা করতে দিচ্ছেন। কাশির সঙ্গে রক্ত যেতে থাকা এক বুড়ো এল ধোবাউড়া থেকে, বাবা এক্সরে করে বলে দিলেন যক্ষা। বুড়োকে জিজ্ঞেস করি, কবে থেইকা রক্ত যায়? কোটরাগতে চোখ ক্লান্তিতে নুয়ে আসে, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আইজ দেড় বছর।

যখন রক্ত যাওয়া আরম্ভ হইল তখন আসলেন না কেন?

আমু যে টেকা কই বইন? ধার কর্জ কইরা আইলাম শহরে।

আপনাদের গ্রামে ডাক্তার নাই?

না।

গ্রামে গঞ্জে ডাক্তার থাকলেও লোক চলে আসে বাবার কাছে, ভাল ডাক্তার হিসেবে বাবার খুব নাম। শহরের পুরোনো লোকেরা এখনও অসুখে বিসুখে বাবাকে ডাকেন। বাবার নির্দিষ্ট কোনও ফি নেই, যে যা দেয়, তিনি তাই নেন। কেউ পাঁচ টাকা দিয়ে বিদেয় হয়, কেউ দু টাকা। বাবা কেবল একটি অনুরোধই করেন রোগীদের, যেন পাশের আরোগ্য বিতান নামের ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনে নিয়ে যায়। মলমুত্রথুতুকফ পরীক্ষা করিয়ে এক্সরে করিয়ে অনেকের টাকা থাকে না ওষধু কেনার। ফিরে যায়। এরকম ফিরে যেতে থাকা যক্ষা রোগিটিকে থামিয়ে আমি আরোগ্য বিতানে নিয়ে দাদাকে বলি ওষধু মাগনা দিতে। দাদা তাচ্ছিলউ করেন,পাগল হইছস? নিজের পকেটের টাকা বের করে দিই, দাদা সে টাকা গুনে নিয়ে ওষধু দেন। আজকাল তিনি টাকা গুনতে পছন্দ করেন খুব। অবসর হলেই তিনি ড্রয়ারে সাজিয়ে রাখা টাকাগুলো পুনরায় গোনেন, টাকাগুলোর একদিকে ধানের শিষ, আরেক দিকে মসজিদ, সব টাকার ধানের শিষকে ধানের শিষের দিকে রাখেন, মসজিদকে মসজিদের দিকে। এই টাকা থেকে সংসারের কোনও খরচ হয় না। যা খরচ হয় তা হাসিনার শখ মেটাতে, তার শাড়ি গয়নায়,তার মেকআপে, চেকআপে। ইয়াসমিন মাঝে মাঝে আরোগ্যবিতানে নামে রিক্সাভাড়ার দুটো টাকা নিতে, দাদা ড্রয়ারে তালা দিয়ে চাবি পকেটে রেখে দুহাত দগুালে রেখে উদাস বসে থাকেন, ইয়াসমিনকে বলে দেন, বিক্রি টিক্রি নাই, এহনও বউনিই করি নাই।

যক্ষা রোগিটি ওষধু পেয়ে কৃতজ্ঞতায় মিইয়ে যায়। রাতে আর সে ধোবাউড়া ফিরবে না, থেকে যাবে জুবলিঘাটের চিৎকাত হোটেলে। হোটেলে লম্বা টানা বিছানা পাতা, ভাড়া বেশি নয়,চিৎ হয়ে শুলে আটআনা, কাত হয়ে শুলে চারআনা। হোটেলগুলোয় লোকের গিজগিজ ভিড়, গ্রাম থেকে শহরে ডাক্তার দেখাতে,মামলা করতে আসা লোকেরা খুব দূরের যাষনী হলে দিন ফুরোলে আর নদী পার হয় না, ঘাটের হোটেলে রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে নৌকো ধরে।

 

মার পাইলসের চিকিৎসা হয় না। মার ইদানিং ধারণা জন্মেছে, মার রোগটি পাইলস নামক কোনও সাধারণ রোগ নয়, দুরারোগ্য কোনও রোগ এটি। মার সংশয় নিয়ে মা থাকেন, কারও সময় নেই রোগশোক নিয়ে ফালতু কথা শোনার। আমার আর্তচিৎকার ফালতু হওয়ার আগে, নিজেই ব্যবস্থা নিই। এনাল ফিশারের যন্ত্রণা যখন আমাকে ধরল, বেদনানিরোধক নিউপারকেইনল মলম ব্যবহার করেও সে যন্ত্রণা যখন কমেনি, হাসপাতালের সব চেনা ডাক্তারদের সামনে গোপনাঙ্গ প্রদর্শন যখন আমার পক্ষে অসম্ভব, অচেনা ডাক্তারের চিকিৎসা পেতে আমি ঢাকা যাই। বড় সার্জন দেখিয়ে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তির ব্যবস্থা করলেন ছোটদা। কেবিন পাওয়া শক্ত, কেবিন পাওয়ার জন্য মনি ্ত্র আমানুল্লাহ চৌধুরিকে ধরতে হয়েছে। দুদিন পর অপারেশন। ভর্তি হব হব, তখনই রুদ্র মোংলা থেকে ফিরে আমার চিঠি পেয়ে জেনে যে আমি এখন ঢাকায়, ছোঁ মেরে নয়াপল্টন থেকে তুলে নিয়ে গেল। ছোঁএর সময় ছোটদা বাড়ি ছিলেন না। গীতা হাঁ হয়ে ছিল। তার এক ডাক্তার-মামাতো ভাই ঢাকা মেডিকেলে চাকরি করছে, রুদ্র আমাকে সেই পঞ্চাশ লালবাগে নিয়ে গেল ডাক্তার ভাইটিকে বলতে আমার অপারেশনের সময় যেন থাকে সে। বৈঠকঘরের সোফায় তখন চুল এলিয়ে বসা ছিল নেলি। নেলিকে ওই প্রথম আমি দেখি। রুদ্রকে দেখি চোখ বারবার নেলির এলিয়ে পড়া চুলের দিকে যাচ্ছে, নেলির আলথুালু শাড়ির দিকে যাচ্ছে। দুজন গল্প করে, পুরোনো দিনের গল্প। হাসে। একটি পত্রিকা হাতে নিয়ে মুখ ডুবিয়ে রাখি, যেন কিছু দেখছি না, কিছুই আমার চোখে পড়ছে না, কথা বলতে বলতে তোমাদের দুজনের চোখে স্মৃতি যে কাপঁ ছে তা আমি দেখছি না, সেই সব উতল প্রেমের স্মৃতি, সেই সব চুম্বন, গোলাপের গন্ধে শরীরে শরীর ডুবিয়ে মাছ মাছ খেলা— দেখছি না, তোমাদের যে পরস্পরকে স্পর্শ করতে ইচ্ছে করছে খুব, আবার ইচ্ছে করছে জগতের সকল কিছু সকল সম্পর্কে তুচ্ছ করে আগের মত প্রেমের অথৈ জলে ঝাপঁ দিতে, চুম্বনে চুম্বনে প্রতি লোমকপূ কে আবার আগের মত জাগাতে, আবার আগের মত স্বপ্নের কথা বলতে বলতে খুব খুব গভীরে চলে যেতে শরীরের—দেখছি না। আমার চোখ পত্রিকাটির অক্ষরে, তোমরা নিশ্চিন্তে যে কথা বলতে ইচ্ছে করো, বলো। সেই সব স্বপ্নের কথা, সেই সেইসব ভীষণ আবেগের কথা, যে আবেগ নিয়ে তুমি নেলির বিয়ে ভেঙে দিতে গিয়েছিলে রুদ্র। আমি মন দিয়েছি অক্ষরে, আমি শুনছি না। অক্ষরগুলোয় তাকিয়ে থাকি, অক্ষরগুলো বৃষ্টিতে ভিজছে। ভেজা অক্ষরগুলো আমার দিকে চেয়ে থাকে, ভেজা অক্ষরগুলোর মায়া হতে থাকে আমার জন্য।

হাসপাতালে অপারেশন টেবিলে আমাকে অজ্ঞান করা। আমি যখন ঘুমিয়ে যেতে থাকি, কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করতে থাকে আমার নাম ঠিকানা, বলতে চেয়েও আমি বলতে পারছি না, কোত্থেকে এক পাখি এসে আমাকে ডানায় করে আকাশে উড়িয়ে নিতে থাকে, আমি মেঘের মত উড়তে থাকি, আমার ভাল লাগতে থাকে। ভীষণ ভাল লাগতে থাকে। জ্ঞান ফিরলে দেখি অন্য এক বিছানায় শুয়ে আছি। পাশে ছোটদা, গীতা, রুনুখালা। গীতা আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, ছোটদা রুনুখালা জিজ্ঞেস করেন, ব্যথা লাগতাছে? ব্যথা আছে কি বুঝতে পারি না, থাকলেও প্রিয় এই মখু গুলো ব্যথা কমিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ সবাইকে অপ্রস্তুত করে ঘরে রুদ্র ঢোকে। ছোটদা বেরিয়ে যান। কে এই রুদ্র, কি সম্পর্কে তার সঙ্গে আমার, এ কাউকে বলিনি। সকলে বুঝে নেয়। বেরিয়ে যাওয়া ছোটদাও বুঝে নেন। দুদিন থাকতে হয় হাসপাতালে, এই দুদিন গীতা আমার জন্য তিনবেলা খাবার আনে। বসে থেকে গল্প করে। গরম জলের গামলায় বসিয়ে রাখে। হাসপাতাল ত্যাগের দিন একদিকে ছোটদা, আরেকদিকে রুদ্র। ছোটদা বললেন, চল বাসায় চল।

আমি মাথা নাড়ি, না।

না মানে?

নিরুত্তর আমি। ছোটদা আমাকে হাত ধরে টানেন, বাসায় যাইবি না ত কই যাইবি তুই? ছোটদার হাতটি আমি ধীরে ধীরে ছাড়িয়ে নিই। নিরুত্তাপ শান্ত চোখ রাখি তাঁর কষ্টভাঙা চোখে। চোখের কোণে জল উপচে ওঠে তাঁর,আড়াল করে দাঁতে ঠোঁট চাপেন। আমি রুদ্রর সঙ্গে বেরিয়ে যাই। নিরুত্তর।

মুহম্মদপুরের বাড়িতে ফিরে একটি দুর্ভাবনার সঙ্গে আমি বসে থাকি চপু চাপ। রুদ্রর মামাতো ভাইটি যদি না জেনে থাকে আমাদের বিয়ে হয়েছে! রুদ্র বলে, তুমি তো কাউকে জানাতে চাও না বিয়ের কথা। অজ্ঞান করার পর আমার গোপনাঙ্গ নিশ্চয়ই আর গোপন থাকেনি কোনও ডাক্তারের কাছে, আর গোপন না থাকা মানে জেনে যাওয়া যে আমি কুমারী নই! অন্তত তাকে জানাও যে আমরা বিয়ে করেছি। তা না হলে ভেবে বসবে আমার বুঝি বিয়ের আগেই কুমারীত্ব গেছে ছি ছি। আমি মখু নত রাখি লজ্জায়। আমার লাজ রাঙা মখু টি রুদ্রর খুব পছন্দ। মখু টি দুহাতে নিজের দিকে ফিরিয়ে সে চুমু খায়। কথা দেয়, কালই সে জানাবে তার ভাইকে বিয়ের কথা। সে রাতটি যখন গভীর হয়ে আমাদের ঘুম পাড়িয়ে দেয়, ঘুমে অচেতন করে রাখে, রুদ্রর বন্ধু মিনার দরজা ধাক্কিয়ে আমাদের ভাঙা ঘরে তুফান তোলে। সুন্দরী বউ কবিতাকে নিয়ে মিনার এসেছে ঘুমোতে, সারা শহরে ঘুমোনোর কোনও জায়গা পায়নি বলে। শোবার ঘরটি ছেড়ে দিই ওদের জন্য, রুদ্র আর আমি শুই শীতল পাটি বিছিয়ে অন্য ঘরে। ভোরবেলা দেখি রুদ্র নেই আমার পাশে। সে ঘুমোচ্ছে বিছানায় মিনার আর কবিতার সঙ্গে। কি হয়েছে? ঘটনা কি! তুমি এখানে কখন এসেছো? রুদ্রর সরল উত্তর, শীতল পাটিতে তার ঘুম আসছিল না। বুদ্ধি করে মিনারের পাশে শুয়েছে, কবিতার পাশে যদি মিনার আবিষ্কার করত তাকে, তবে নিশ্চয়ই বন্ধুটির কাণ্ডে অট্টহাসি হেসে সকালে বিদেয় হত না সস্ত্রীক। সেদিন সকালেই আমি রুদ্রর ড্রয়ারে চিঠি লেখার কাগজ খুঁজতে গিয়ে বিয়ের দলিলটি দেখি। দলিলে লেখা উকিলের সামনে বসে আমি নাকি এ দলিলে সই করেছি। আশ্চর্য এতে তো মিথ্যে কথা লেখা! বলতেই রুদ্র আমার হাত থেকে দলিলটি কেড়ে নিয়ে ড্রয়ারে রেখে দেয়। শুয়ে বসে ঘর গুছিয়ে বাইরে খেয়ে আড্ডা দিয়ে কবিতায় সঙ্গমে দুদিন কাটার পর আমার মন কেমন করতে থাকে অবকাশের সবার জন্য। মার জন্য, ইয়াসমিনের জন্য, সুহৃদের জন্য, মিনুর জন্য। কি রকম আছে ওরা! আমার কথা মা নিশ্চয়ই প্রতিদিন বলছেন, বাবা প্রতিদিন, ইয়াসমিন প্রতিদিন, সুহৃদও বলছে দোলফুপু এখনো আসে না কেন? সুহৃদকে শিখিয়েছি আমাকে দোলফুপু ডাকতে। একদিন ওকে দোলনায় দোলাতে দোলাতে দে দোল দে দোল ফুপু দে দোল দে দোল বলতেই বলতেই। মন পড়ে থাকে অবকাশে। আমার এলোমেলো আবার খুব গোছানো জীবনে। মিনুর জন্যও কষ্ট হতে থাকে, নিশ্চয়ই সে ঘরে বারান্দায় ক্ষিধে পেটে হাঁটতে হাঁটতে আমাকে খুঁজছে, রাতে তার খুব খালি খালি লাগছে বোধহয়! ঢাকাকে আমার আপন শহর মনে হয় না। ঢাকায় কদিনের জন্য বেড়াতে আসা যায়। পাকাপাকি থাকার জন্য এ শহরটিকে আজও আমি মনে নিতে পারি না। ময়মনসিংহে ফিরে যেতে চাইলে রুদ্র আর একটি দিন থাকতে অনুরোধ করে। সেই একটি দিনের একটি বিকেলে আমাকে নিয়ে মগবাজার যায়, কাজির আপিসে। রুদ্রর দুটো বন্ধওু যায়। কাজির কাছে কাবিন হবে, দুই বন্ধু সাক্ষী। সারপ্রাইজ!

তা আমাকে আগে জানালে আমি কি আপত্তি করতাম রুদ্র?

কাবিন কত টাকার হবে?

টাকার অক কি দিতেই হবে?

হ্যাঁ দিতেই হবে।

শূন্য দেওয়া যায় না?

না।

তাহলে এক টাকা।

ধুর এক টাকা কি করে হয়!

যত ইচ্ছে তত দাও, এসবের কোনও মানে হয় না, তুমি কি ভাবছ আমাদের কোনওদিন তালাক হবে, আর হলে আমি কোনও টাকা দাবি করব?

আমি হেসে উঠি। সশব্দে নিঃশব্দে।

কাবিনের কি দরকার রুদ্র?

দরকার আছে।

কি দরকার?

এসব অর্থহীন জিনিস। দুজন মানুষকে একসঙ্গে বাস করাতে পারে কোনও কাবিননামা? নাকি ভালবাসা? আমি ভালবাসায় বিশ্বাসী, কাবিনে নয়। রুদ্র ভালবাসায় কতটা জানি না, তবে সে কাবিনে বিশ্বাসী, সে কাবিন করে। পরদিন ময়মনসিংহে ফিরে যাই। অপারেশন হয়েছে শুনে মা আমার যত্ন করেন, গরম জল গামলায় ঢেলে জলে ডেটল মিশিয়ে আমাকে বসিয়ে দেন দিনে চারবার। মাকে আমার পুরোনো নিউপারকেইনল মলমটি দিই। এনাল ফিশারের যন্ত্রণা কমার মলম। মা মলম পেয়ে ভাবেন, এটিই তাঁর রক্ত যাওয়া বন্ধ করবে। রক্ত যাওয়া বন্ধ হয় না মার। ভাবেন, কোনও একদিন নিশ্চয়ই বন্ধ হবে। মার আবদারের এক পোয়া দধু , দুটো কলা আর দুটো ডিমও পাওয়া হয় না। মা সম্ভবত আশা করেন, তাঁর মেয়েটি ডাক্তার হচ্ছে, উপার্জন করবে, সেই মেয়েই তাঁর চিকিৎসা করবে, সেই মেয়েই দুধ কলা কিনে দেবে। সেই মেয়ের ডাক্তারি পাশ হয়। সেই মেয়ের ইন্টারনিশীপ শুরু হয়। সেই মেয়ের হাতে টাকা আসে। টাকা পেয়ে আর যা কিছুই হয় তার মার দীর্ঘ দীর্ঘ দিনের আবদারের দধু ডিম কেনা হয় না। ভাগীরথীর মা আসে, দুই বাচ্চার জন্য দধু দিয়ে যায়। বারান্দায় বসে দুবাচ্চার দুধ মেপে দিয়ে জিজ্ঞেস করে প্রায়ই, ও মাসি, আরও এক পোয়া দধু রাখবেন বলিয়েছিলেন না! মা বড় শ্বাস ফেলে বলেন, না ভাগীর মা, দুধ খাওয়ার কপাল আমার নাই।

 

বিছানায় দু পা বিছিয়ে সেই পায়ের ওপর শুইয়ে মা হাঁটু ভেঙে ভেঙে দোল দিয়ে ঘুম পাড়ান সুহৃদকে,ছড়া বলতে বলতে। জানালায় উদাস তাকিয়ে ছিলেন মা, সুহৃদ ঘুমিয়ে গেছে পায়ে, তখনও ওকে পা থেকে আলতো করে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিচ্ছেন না.. চোখের নিচে কালি পড়েছে,চোখদুটো ফোলা, জানালা থেকে চোখ সরিয়ে বলেন,নোমানের বউ আমারে বেডি কইয়া ডাকে।

কেমনে জানো?

পাকঘরে গিয়া শুনি লিলির মারে কইতাছে, ওই বেডি আমার ছেলেডারে দুই চোক্ষে দেখতে পারে না।

ও।

সাহস পাইছে তর বাপের কাছ থেইকা। তর বাপ ত সবার সামনেই বেডি কয়।

জানালায় আবার উদাস তাকিয়ে মা বলেন, শাশুড়ি আমি, আমারে গ্রাহ্যই করে না।

সুহৃদের ঘুমন্ত মখু খানার দিকে তাকিয়ে থাকি। অনেক সুন্দর বাচ্চা দেখেছি। সুহৃদের মত কেউ নয়। ঘুমিয়ে থাকলে মনে হয় না কি ভীষণ দুরন্ত ছেলে সে। প্রতিদিন খাট থেকে টেবিল থেকে সিঁড়ি থেকে ধুপ ধাপ পড়ে যাচ্ছে বাতাসের আগে ছুটতে যেয়ে। ভ্রুক্ষেপ নেই কোনও। শুভ একটি পা কোথাও দিলে আগে দেখে নেয় কোথায় দিচ্ছে, সাবধানী ছেলে, কোনও লম্ফ ঝম্ফ নেই। শুভর শরীরে কোনও চিহ্ন নেই কাটা দাগের। সুহৃদের আজ হাঁটু ছিলে যায় তো কাল কনুইএ কালশিটে দাগ পড়ে থাকে। সারা শরীরে তার দস্যিপনার চিহ্ন। সুহৃদ আধো আধো কথা বলে। শুভ কথা বলতে শেখা অবদি কোনওদিন কোনও আধো কথা বলেনি। সবসময় ষ্পষ্ট। খাওয়ার ব্যাপারে শুভর কোনও না নেই। সুহৃদের সবসময়ই না। মার ভোগান্তি বাড়ে। ছেলে যত বড় হচ্ছে, তত তাকে বাগে আনা মুশকিল হয়ে পড়ছে। দৌড়ে ছাদে চলে গেল। পেছনে পেছনে দৌড়োতে হয় মার, যদি আবার ছাদ থেকে লাফ দেয় নিজেকে সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান মনে করে! ফটক খোলা পেলে রাস্তায় চলে গেল, দৌড়ে ধরে আনতে হয়। মার যত না খাটনি, তার চেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা। ছোটদা অবকাশে এসে গন্ধ টের পান হাওয়ায়, গন্ধটি হাসিনার অসন্তুষ্টির। হাসিনার দৃঢ় বিশ্বাস, শুভর চেয়ে সুহৃদকে ভাল বেশি বাসা হচ্ছে। মা ছোটদাকে বলেছেন, সুহৃদের জন্য কিছু আনলে শুভর জন্যও নিয়া আসিস। হাসিনাকে তুষ্ট করতে বিদেশ থেকে আনা বাচ্চার জামা কাপড় খেলনা শুভর জন্য দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দিলেও হাসিনা জানে যে শুভর যা আছে তার চেয়ে অনেক বেশি আছে সুহৃদের। সুহৃদের জন্য ছোটদা তিন চাকার একটি সাইকেল এনেছেন। এটি ঘরে বারান্দায় মাঠে উঠোনে চালায় সে ঝড়ের বেগে চালায়। মা সুহৃদকে খানিক পর পর উঠিয়ে শুভকে দেন চালাতে, শুভ তো তোমার ভাই, ওরে চালাইতে দেও। সুহৃদের প্যারামবুলেটরটিও শুভকে দিয়ে দিয়েছিলেন মা। সুহৃদের ছ মাসের ছোট শুভ। প্যারামবুলেটর থেকে সুহৃদের নামা হয়েছে, শুভর ওঠা হয়েছে। কিন্তু হাসিনা দাদাকে বলেছে শুভর জন্য নতুন কিনে নিয়া আসো।

ময়মনসিংহে পাওয়া যায় না এইসব।

না পাওয়া যাক। ঢাকা যাও, ঢাকা থেকে কিনে নিয়ে আসো।

কি কও মুমু! ঢাকা যাব এইটা কিনার জন্য?

হ, এইটা কিনার জন্য তোমারে ঢাকা যাইতে হইব। আর যদি ঢাকায় না পাও তাইলে লন্ডন গিয়া হইলেও কিন্যা নিয়া আসতে হইব।

সুহৃদ সাইকেল পাওয়ার পর শুভকে ঠিক এরকম সাইকেল কিনে দেওয়ার জন্য হাসিনা দাদাকে আবার ধরল। দাদা সারা শহর খুঁজে একটি তিন চাকার সাইকেল কিনে নিয়ে বাড়ি এলে হাসিনা সাইকেলটি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, রাস্তা থেইকা টুকাইয়া আনছ নাকি?

এর চেয়ে ভাল সাইকেল আর নাই বাজারে। পারলে গিয়া দেইখা আসো।

মা বলেন, সুহৃদের সাইকেলটা নাকি কামাল সিঙ্গাপুর থেইকা আনছে। এইরম সাইকেল তো দেশেই পাওয়া যাবে না।

সমস্যার সমাধান সুহৃদই করে। সে নতুন আনা সাইকেলটির ওপর আকর্ষণে নতুন সাইকেলটি চালাতে থাকে। শুভ চালায় সিঙ্গাপুরি। হাসিনার দেখে খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু খুশি হয় না। তার মুখে হাসি মোটেও ফুটতে চায় না। হাসি ফোটানোর জন্য মা পরিশ্রম করেন। মা তাকে ছোটদার আনা আপেল আঙুল কমলালেবু দিতে থাকেন। মাছ মাংস রান্না হলে হাসিনাকে সবচেয়ে বেশি এবং সবচেয়ে ভাল টুকরোগুলো দেওয়া হয়। হাতে টাকা পয়সা এলে হাসিনা আর শুভর জন্য বাজার থেকে কিছু না কিছু উপহার কিনে নিয়ে আসেন। হাসিনার হাসি নেই তবু। দাদাকে তিনি অহর্নিশি বলতে থাকেন, কি নড়ো না কেন! মরার মত শুইয়া থাকলেই হবে? ফকিরের মত টিনের ঘরে আর কতদিন পইড়া থাকবা। আলদা বাসা নেও। আমার ছেলেরে তোমার এই গুষ্ঠি থেকে দূরে সরাইতে হবে।

সুহৃদ সংসারের কোনও কুটকচাল বোঝে না, শুভর জন্য সুহৃদের মমতা অনেক। শুভকে পারলে সে তার নিজের যা কিছু সম্পদ সব দিয়ে দেয়। কিল চড় আঁচড় এগুলো সুহৃদের শরীরে বসাতে শুভ সবচেয়ে বেশি পারদর্শী। একবার ধাক্কা দিয়ে সুহৃদকে ফেলে দিয়েছিল খাটের রেলিং থেকে, মাথায় চোট পেয়ে সুহৃদ পুরো চব্বিশঘন্টা অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। মা পাগল মত হয়ে গিয়েছিলেন। মার ভয় কখন না আবার কি দুর্ঘটনা ঘটে যায়। তিনি ছোটদাকে বলেছেন, এই পরিবেশে সুহৃদরে মানুষ করা যাবে না। তুই ওরে ঢাকায় নিয়া যা। ছোটদা মার এই প্রস্তাবের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি মুখ শুকনো করে বলেন, হ নিয়া যাইতে হইব। ঢাকায় নিয়া ইশকুলে ভর্তি করাইতে হবে। সুহৃদকে ঢাকা নিয়ে যাওয়া হলও এরপর। মা গেলেন সঙ্গে। দু সপ্তাহ পর মা ফিরে এসে সুহৃদের জন্য চোখের জল ফেলতে থাকেন। কেবল চোখের জলই নয়। হাঁউমাউ কান্না। কেঁদে কেটে নিজেই তিনি উন্মাদিনীর মত ঢাকা চলে যান, সুহৃদকে ফের অবকাশে ফেরত আনেন। সুহৃদ মহাসুখে অবকাশে দিন যাপন করতে থাকে। ওকে নিয়ে প্রায় বিকেলেই বেড়াতে বেরোই। রিক্সা করে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ানো। কখনও কখনও বান্ধবীদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া। ওর আবদারের খেলনা কিনে দেওয়া। আজ চাবিঅলা গাড়ি কিনে দিলাম তো কাল চাবিঅলা উড়োজাহাজ লাগবে। নিজের জন্যও রেডিমেড টু পিস থ্রি পিস কিনি। দুটো জামা, একটি ধোব, আরেকটি পরব, বাবার এই নিয়ম ভেঙে আমার জামা পাজামার সংখ্যা দাঁড়িয়ে যায় দশাধিক। শখ করে নীল জিনসের কাপড় কিনে দরজি দিয়ে একটি প্যান্টও বানাই। এবার দরজিকে বলি, সামনের দিকে বোতাম বা চেইন দিবেন, কিনারে না। লপু দিবেন। যদি বেল্ট পরতে ইচ্ছে হয়, পরব। রেডিমেড ছাড়া কখনও যদি কাপড় কিনে জামা বানাই, দরজির ফিতে নিজের হাতে নিয়ে বুকের মাপ দিই। ইয়াসমিনকে বলে দিই, এখন থেইকা নিজে মাপ দিবি। ইয়াসমিনকে বলা হয় না কেন ওর নিজের এ কাজটি করা দরকার, কেন দরজির নয়। সম্ভবত ও বুঝে নেয়। হাসপাতাল থেকে ফিরেই ওর সঙ্গ চাই আমার। জগতের সকল কথাই হয় ওর সঙ্গে, কেবল শরীরের কোনও গোপন কিছু নিয়ে কোনও কথা নয়। আমরা দুজন যেন আজও শিশু। আমরা হাসি আনন্দ করি, কবিতা পড়ি গান গাই। ঘুরে বেড়াই। যেদিন জিনস প্যান্ট পরেছি, বাবা দেখে বলেন, এইডা কি পরছস। এক্ষুনিখোল। খুইলা পায়জামা পর। আমি বলি, জিনস প্যান্ট সবাই পরে। মেয়েরাও পরে।

না মেয়েরা পরে না। এইসব ছেলেদের পোশাক।

বাবার প্রতিবাদ করি না আমি, সরে আসি সামনে থেকে। কিন্তু জিনস খুলে রাখি না, পরে থাকি। পরদিনও পরি। আমার কাপড় চোপড় ইয়াসমিনের গায়ে আঁটে। সে নিজেও আমার জামা কাপড় অবলীলায় ব্যবহার করতে থাকে। আমি না করি না। বাবা ইয়াসমিনকেও জিনস পরতে দেখে দাঁত খিচোন, কি হইছে এইগুলা? বড়টার শয়তানি তো ছোটটারেও ধরছে। যেইদিন ধরব আমি, সেইদিন কিন্তু পিটাইয়া হাড্ডিা গুড়া কইরা দিয়াম। হাড্ডি গুঁড়ো হোক, ইয়াসমিনকে বলি খুলবি না। খুলবি না বলি, কারণ আমি কোনও যুক্তি দেখি না জিনস পরা মেয়েদের জন্য অনুচিত হওয়ার। এটি পরলে আমি যে ছেলে বনে যাবো, তা তো নয়। এর ভেতরে যে শরীর, সে তো ঠিকই থাকছে। সেটি ঠিক রাখার জন্যই যদি বাবার আদেশ হয়ে থাকে। ইয়াসমিনকে ছোট বাজারের সুর তরঙ্গ থেকে একটি পুরোনো হারমোনিয়াম কিনে দিই। গানের মাস্টারও রেখে দিই। একটিই শতর্ আমার, ও যেন রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়। ঈশান চক্রবর্তী রোডের একটি দেয়াল ফুঁড়ে বটগাছের চারা ওঠা পুরোনো বাড়িতে ময়মনসিংহ সঙ্গীত বিদ্যালয়, ওতে ভর্তি করিয়ে দিই ওকে। গেল, কিন্তু সাতদিনের মাথায় বলে দিল ওর ভাল লাগছে না ওখানে। ঠিক আছে ইশকুলে যদি ভাল না লাগে বাড়িতে এসে মাস্টার গান শেখাবে, এই ভেবে সুনীল ধরের কাছে নাকি মিথুন দের কাছে! কার কাছে যাবো! শেষ অব্দি ঠিক হল, বাদল চন্দ্র। সঙ্গীত বিদ্যালয়ের গানের মাস্টার বাদল চন্দ্রর বাড়ি কোথায় খোঁজ নিয়ে জেনে ইয়াসমিনকে নিয়ে গিয়ে তাঁকে অনুরোধ করি গান শেখাতে। বাদল চন্দ্র দের ছোট ভাই সমীর চন্দ্র দে ওরফে কটন এককালে ছোটদাকে গিটার শেখাতেন। শহরের এক নম্বর গিটার শিল্পী। বাদল চন্দ্র দে বিয়ে থা করেননি। তাঁর ঘরটিতে তানপুরা হারমোনিয়াম তবলা সেতার বীণা নানা রকম যন,্ত্র ঘরের এককোণে একটি তক্তপোষ। এত অল্পে কি করে যে মানুষের জীবন যাপন চলে!ভোগ বিলাসের চিহ্ন নেই বাড়িটিতে। একটি উঠোন ঘিরে টিনের কতগুলো ছোট ছোট ঘর। পৈতৃক ভিটে। ভাইরা বিভিন্ন ঘরে থাকেন, ছেলেমেয়েও বড় হয়ে গেছে। সকলে সঙ্গীত সাধনায় উৎসর্গ করেছে জীবন। বাদল চন্দ্র আমাদের দুজনকে তক্তপোষে বসিয়ে নিজে একটি মোড়ায় বসে সঙ্গীতের গভীর কথা শোনাতে থাকেন, কতক বুঝি, কতক বুঝি না। তিনি কাউকে শখের গান শেখাতে চান না, এ যদি সত্যিকারের সঙ্গীত সাধনার উদ্দেশ্য হয়, মন প্রাণ উৎসর্গ করা হয় সঙ্গীতে, তবেই তিনি ছাত্রী নেবেন। আমাদের, আমি জানি না কেন, পছন্দ হল বাদল চন্দ্রের। তিনি সপ্তাহে দু দিন ইয়াসমিনকে শেখাতে বাড়ি আসতে লাগলেন। দীর্ঘাঙ্গ ধবল শরীর বাদল চন্দ্রের। ধবধবে শাদা পাঞ্জাবি আর ধুতি পরনে। এক হাতে ধুতির কোচা ধরে তিনি ঢোকেন অবকাশে। বৈঠক ঘরে সা রে গা মা পা ধা নি সা চলতে থাকে সারা বিকেল। আমি ট্রেতে করে চা বিস্কুট নিয়ে ঘরে ঢুকি। বাদল ওস্তাদ আমাকে দেখলে কেবল সঙ্গীত নিয়ে নয়, সাহিত্য নিয়েও গল্প করেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলি মুখস্ত বলে যেতে থাকেন। কবিতা মুখস্ত করার মাথা আমার নেই, আমি মুগ্ধ শ্রোতার ভূমিকায়। ইয়াসমিনের সা রে গা মা বাদল চন্দ্রের কাছেই প্রথম শেখা নয়। ওর যখন পাঁচ কি ছয় বছর বয়স, বাবা ওকে রাজবাড়ি ইশকুলের শিক্ষিকা রোকেয়ার বাড়িতে নিয়ে যেতেন গান শিখতে, ও বাড়িটিও নাচ গানের বাড়ি ছিল। রোকেয়ার মেয়ে পপি নাচত। ছেলে বাকি গান গাইত। রোকেয়ার বোন আয়শা, বোনের সঙ্গে একই বাড়িতে থাকতেন, তিনিও শিক্ষিকা, নিজেও গান গাইতেন, মেয়ে দোলনকেও গান শেখাতেন। ইয়াসমিনকে ও বাড়িতে নিয়ে যাওয়া, বাড়ি থেকে নিয়ে আসা এসব নিয়ে মা বলতেন, ইয়াসমিনরে গান শেখানোর উদ্দেশে ত তর বাপে ওই বাড়িতে যায় না, আয়শার সাথে রঙ্গরস করাই আসল উদ্দেশ্য। ইয়াসমিনকে ও বাড়িতে নিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে বসিয়ে দিয়ে অন্য ঘরে কোঁকড়া চুলের টানা টানা চোখের ফর্সা চামড়ার প্রায় গোলাপি ঠোঁটের ভরা বুকের যুবতী আয়শার সঙ্গে বাবা কথা বলতেন। বাবার রাজিয়া বেগমকে দিয়েও সাধ মেটেনি কোনওদিন। খুচরো আরও কিছু প্রেম বাবার এদিক ওদিক থাকতই। ইয়াসমিনের এক বান্ধবীর কৃকলাশ খালার সঙ্গেও, খালাটি উকিল, বাবাকে দেখা গেছে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে। ইয়াসমিন বাদল চন্দ্র দের কাছে সা রে গা মা যখন শিখছে, কলেজের কিছু গানের মেয়ের সঙ্গে নতুন পরিচয়ের পর খোঁজ দিল যে শহরে আনন্দধ্বনি নামে একটি গানের ইশকুল আছে, ওতে মেয়েরা যাচ্ছে। এই গানের ইশকুলটি ছুটির দিনে মহাকালি ইশকুলে বসে। আনন্দধ্বনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওস্তাদ ওয়াহিদুল হকের ইশকুল। ময়মনসিংহে ওয়াহিদুল হকের শিষ্য তপন বৈদ্য, নীলোৎপল সাধ্য, আর নূরুল আনোয়ার আনন্দধ্বনির ছাত্র ছাত্রীদের গান শেখান। ছাত্র ছাত্রীরা যে কোনও বয়সের। পাঁচও আছে, পঞ্চাশও আছে। একই সঙ্গে বসে তাল দিয়ে গান গাইছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাকে বাঁচিয়ে রাখে একরকম। দাদার সন্ধ্যা ফিরোজা হেমন্ত মান্না দে ডিঙিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতে বুঁদ হয়েছি বেশ অনেকদিন। বিশেষ করে কণিকা আর সুবিনয় রায়ে। মাঝখানে গণসঙ্গীতের ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু সরিয়ে রেখে আবার রবীন্দ্রসঙ্গীতে। এই এক সঙ্গীত, যে সঙ্গীতে মন দিলে জীবন বড় সুন্দর হয়ে ওঠে। জীবনের এমন কোনও অনুভবের কথা নেই, যা না বলা আছে এই সঙ্গীতে। কেবল সুখ বোধই নয়, দুঃখবোধও একরকম আনন্দ দেয়। ইয়াসমিনকে আনন্দধ্বনিতে ভর্তি করে দিই। বাদল চন্দ্রের বেতন, আনন্দধ্বনির বেতন মাস মাস দিতে থাকি আমি। আনন্দধ্বনিতে যাওয়া শুরু করার পর নীলোৎপল সাধ্যের নজরে পড়ে ইয়াসমিনকে, কোনও একদিন ও খুব বড় শিল্পী হবে আশায় নীলোৎপল সাধ্য ওকে যত্ন নিয়ে গান শেখাতে শুরু করেন। ইয়াসমিন একদিন তবলার আবদার করায় ভাল দেখে তবলাও কিনে দিই গোলপুকুরপাড়ে প্রমোদ বিহারির তবলার দোকান থেকে। বাদল চন্দ্র দের আগ্রহ ইয়াসমিনকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শেখাতে। ঘরে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত চলল, বাইরে রবীন্দ্রসঙ্গীত। চারপাশের মানুষের ক্ষুদ্রতা নিচতা স্বাথর্প রতা থেকে চোখ ফিরিয়ে রেখে ইয়াসমিনকে নিয়ে একটি চমৎকার জগত তৈরি হয় আমার। ইয়াসমিন যখন আনন্দধ্বনিতে শেখা গান গুলো গাইতে থাকে বাড়িতে, আমি মগ্ধু হয়ে দেখি ওকে। কোনও মন খারাপ করা বিকেলে, তোমার কাছে শান্তি চাব না, থাক না আমার দুঃখ ভাবনা.. গানটি আমাকে ফোঁটা ফোঁটা চোখের জল ঝরাতে থাকে। ইয়াসমিন মাঝে মাঝে বাড়িতে নীলোৎপলকে নিয়ে আসে, সুদর্শন যুবক নীলোৎপল সাধ্য, কাঁধে শান্তিনিকেতনি ঝোলা, পায়ে শানিপ্তুরি চপ্পল, ঠোঁটে শান্তি ছড়ানো হাসি। আমার মনে হতে থাকে নীলোৎপল বুঝি মনে মনে ইয়াসমিনকে ভালবাসছে। ভয় হয়। ওর এক বান্ধবীর ভাই ইয়াসমিনের কাছে আসে মাঝে মাঝে তবলা বাজাতে, ইয়াসমিনের দিকে ছেলেটিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি। ভয় হয়। কলকাতা থেকে ইয়াসমিনকে গোটা গোটা অক্ষরে চিঠি লিখছে কৌশিক মজুমদার। কে এই কৌশিক মজুমদার? ইয়াসমিন বলে, ওই যে ধ্রুব। মৃত্যঞ্জয় ইশকুলের সামনে থেকে প্রায় বিকেলে যে হাফপ্যান্ট পরা বড় বড় কাজল কালো চোখের মিষ্টি চেহারার কালো একটি ছেলে এই পাড়ায় বিকেলে হাঁটতে আসত, ওই ধ্রুব। ইয়াসমিনও চিঠি লেখে কৌশিককে। কৌশিক একদিন ওকে আর ইয়াসমিন নামে সম্বোধন করে না, সম্বোধন করে মৌমি বলে। ইয়াসমিন নিজের নাম সেই থেকে মৌমি লিখছে। ভয় হয় আমার। ভীষণ ভয় হয়। কৌশিকের চিঠি এলেই আমি পড়ি। খুঁটিয়ে খুঁিটয়ে দেখি কোনও প্রেমের ইঙ্গিত আছে কি না। আসলে আগলে রাখি ওকে সকল সর্বনাশ থেকে, কারও প্রেমে যেন সে না পড়ে। কোনও মোহ যেন ওর সততা ও সারল্যকে, ওর সৌন্দর্যকে এতটুকু ম্লান না করে। আমার যা হয়েছে, হয়েছে। ওকে বাঁচাতে চাই সকল কৎু সিত থেকে। যখন ইয়াসমিন কলেজে যাবে বা আনন্দধ্বনিতে যাবে বা বান্ধবীর বাড়ি যাবে বলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাজে, চোখে কাজল পরে, ঠোঁটে লিপস্টিক। ধমক লাগাই, এত সাজস কেন?

এমনি।

কেউ এমনি এমনি সাজে না। কোনও কারণ থাকে।

কোনও কারণ ছাড়া কি সাজা যায় না?

পিছনে কারণ থাকেই। তুই চাস তর রূপ দিয়া মানুষরে মগ্ধু করাইতে। ঠিক না?

না ঠিক না। আমার ভাল লাগতাছে সাজতে, তাই সাজতাছি।

তাইলে তুই ঘরে যখন থাকস, তখন এইরকম সাজস না কেন? ঘরের বাইরে বার হওয়ার জন্য তর খয়েরি ঠোঁটটারে লাল করস কেন?

ইয়াসমিন কোনও উত্তর দেয় না। আমি −শ্লষ গলায় বলি, তুই কি ভাবছস মুখে রং মাখলে তরে সুন্দর লাগে দেখতে? মোটেই না। নিজের যা আছে, তা নিয়া থাকাই সবচেয়ে ভাল। নিজের আসল চেহারা রঙের মুখোশ পইরা নষ্ট করিস না। কৃত্রিমতার আশ্রয় নেওয়ার দরকার কি তর! তর অভাব কিসের? নিশ্চয়ই ইনফিরিওরিটি কম−প্লক্সে ভগু তাছস!

ইয়াসমিন আমার যুক্তি মেনে নেয় না, সেজে যায়।একটি শীত শীত ভয় আমাকে বুকে হুল ফোটাতে থাকে।

 

হাসপাতালে পোস্টমাস্টারের ঠিকানায় রুদ্রর চিঠি আসে, চিঠি পেয়েই ঢাকা চলে এসো। মেডিসিন ওয়াডের্ ডিউটি আমার। ডিউটি থেকে একদিন কেন, এক ঘন্টার জন্যও ছুটি নেই। ছুটি নেওয়ার জন্য আমি পরদিন থেকে চেষ্টা করতে থাকি। ছুটি তিনদিন পরও নেওয়া যায় না। ওদিকে বাবাও একটি চিঠি পেয়েছেন। রুদ্রর বাবা শেখ ওয়ালিউল্লাহর চিঠি। কি লিখেছেন তিনি, কিছুই আমার জানা নেই। রুদ্রও এ সম্পর্কে আমাকে কিছু বলেনি। মার কাছে শুনি চিঠির কথা। মাকে হুংকার ছেড়ে ডেকে নিয়ে বাবা চিঠি দেখিয়েছেন, আমার পথভ্রষ্ট পুত্র শহিদুল্লাহ অবশেষে আপনার কন্যাকে বিবাহ করিয়া সঠিক পথে চলিবে বলিয়া অঙ্গীকার করিয়াছে। তাহাদের বিবাহকে মানিয়া লইয়া তাহাদিগকে সুখে শান্তিতে বসবাস করিবার সুযোগ দিয়া বাধিত করিবেন ইত্যাদি। বাবা তাঁর কালো মিশমিশে চুল খামচে ধরে অনেকক্ষণ বসেছিলেন। এর পর বিকেলে রোগী দেখা বাদ দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে রইলেন বিছানায়। চোখ কড়িকাঠে। মা শিয়রের কাছে বসে বাবার মাথার চুলে আঙুল বুলিয়ে দেন। বাবা ক্ষীণ কণ্ঠে বলেন, চুলগুলা জোরে জোরে টাইনা দেও। জোরে চুল টেনে চুল ছিঁড়ে চলে আসে হাতে, তবু মাথার যন্ত্রণা বাবার মাথাতেই থাকে। ঘুমের ওষধু খেয়েও ঘুম আসে না।

কি কইরা বিয়া করল, কখন করল! কেন করল!

আমারে কি কয় কিছু এইসবের! যা ইচ্ছা তাই করে।

এত সাহস কি কইরা হইছে তার?

সাহস না। আসলে সরল সোজা পাইয়া মেয়েটারে পটাইছে। এমন সুন্দর ডাক্তার মেয়ের সামনে দাঁড়ানোর কি যোগ্যতা আছে ছেলের? নিজের সর্বনাশ করল নাসরিন। বাবা কড়িকাঠে চেয়েই অপলক চোখ রেখে বলে যান, তার বাপেই তারে কইল পথভ্রষ্ট ছেলে। একবার ভাবো, কতটুকু খারাপ ছেলে হইলে বাপে পথভ্রষ্ট ছেলে কয়। কামাল তো কইছে ছেলে নাকি সিগারেট খায় মদ খায়।

বাবার মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিজের আগুন-জ্বলা বুকে হাত ঘঁষেন, চোখ ভিজে ওঠে, চোখের জল গাল বেয়ে বুকে নামে,বুকের আগুন তবু নেভে না, এই বুকের মধ্যে রাইখা মেয়েটারে পালছি। আপনে বেডিগর পেছনে পেছনে ঘুরছুইন। মেয়েটারে কোলে নিয়া চোক্ষের পানি ফালাইছি। এই বুকটার মধ্যে দিন রাইত পইড়া থাকত। মেয়ে বড় হইছে, ডাক্তার হইছে। কত বড় অনুষ্ঠান কইরা কত আয়োজন কইরা দেইখা শুইনা একটা ভাল ছেলের সাথে বিয়া হইব। সারা শহর জানব যে বিয়া হইতাছে। আর কি ভাবে সে বিয়া করল?কারে করল, কি জানে এই ছেলের সম্পর্কে সে?

মার চোখের জল ফুরোয় না। বাবার ঘুমও আসে না। আমি অন্য ঘরে ব্যাগে কাপড় গুছিয়ে নিই। ঢাকা যাব।

বাবাকে বা মাকে কিছু না বলে আমি কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, কার কাছে যাচ্ছি কবে ফিরব আমি ঢাকা রওনা হই। মেডিসিন বিভাগে ডিউটির কি হবে তাও আর ভাবি না। মা পথ আটকেছিলেন,পাশ কেটে আমি বেরিয়ে যাই। ঢাকা পৌঁছি দুপুরে। বাসস্ট্যান্ড থেকে রিক্সা করে তাজমহল রোডের বাড়িটিতে গিয়ে দেখি দরজায় তালা, রুদ্র নেই ঘরে। কিন্তু জানি সে ঢাকায় আছে, অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও পথ নেই। দ্বিতীয় দরজা যেটি ভেতর থেকে বন্ধ, আধঘন্টার পরিশ্রমে খানিক ফাঁক করে ফাঁকের ভেতর আড়াআড়ি বসানো খিলটি ওপরের দিকে তুলে দিতেই দরজা খুলে যায়। ভেতরে সব আছে, রুদ্র নেই। টেবিলে পড়ে আছে অপেক্ষার দিনলিপি,তুমি এখনো আসছো না কেন? আমি অপেক্ষা করছি। অপেক্ষা করছি। তুমিহীনতা ছড়িয়ে আছে সারা ঘরে। আমার ভাল লাগছে না। কখন এসে পৌঁছবে তুমি! সারাদিন ঘরে আর বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করি, অপেক্ষার হাঁটাহাঁটি। প্রতিটি মুহর্ত আমার অপেক্ষায় কাটে। বিকেল পার হয়। রুদ্র আসে না। ঘরে বসেই অপেক্ষা করতে হবে, দরজা খোলা রেখে কোথাও তাকে খুঁজতেও যেতে পারি না। অপেক্ষা করতে করতে সন্ধে পেরিয়ে যায়। রাত হয়। রাত সাতটা আটটা নটা দশটা হয়ে যায়, রুদ্র ফেরে না। বাড়িঅলার বাড়ি থেকে আমার জন্য থালায় করে খাবার আসে। রাত বারোটাও যখন বেজে যায়, বাড়িঅলার বউকে বলি, আমার খুব ভয় লাগছে ঘরে, আপনাদের বাতাসিকে দেবেন আমার ঘরে শুতে? বউটি ভাল মানুষ। কাজের মেয়ে বাতাসিকে কাথাঁ বালিশ দিয়ে পাঠিয়ে দেন। আমি বিছানায়, বাতাসি মেঝেয় কাঁথা বিছিয়ে। রাত পার হয়। ঘুম থেকে বাতাসি জাগে, আমার জাগার কোনও দরকার হয় না। জেগেই ছিলাম, মুখে পানি ছিটিয়ে দিন শুরু করি আবার। অপেক্ষার দিন। অপেক্ষার অসহ্য প্রহর। অপেক্ষা আমার কোনও কালেই ভাল লাগে না, মন দিতে চেষ্টা করি কবিতায়, পারি না। অক্ষরে চোখ, মন দরজায়। সারা বিকেল দাঁড়িয়ে থাকি ঝুল বারান্দায়। সারা বিকেল তাজমহল রোডের দিকে আসা প্রতিটি রিক্সায় বসা লোক দেখি, দেখি রুদ্র কি না। রুদ্র যদি একবার জানত আমি এসেছি, ছুটে চলে আসত খুিশতে! কেন সে ভাবছে না যে আমি এসেছি, কেন সে একবারও ভাবতে পারছে না! রুদ্র কোথায় রাত কাটিয়েছে তা আমার সমস্ত কল্পনা দিয়েও আমি অনুমান করতে পারি না। সন্ধে নেমে আসে,রুদ্র ফিরবে এক্ষুনি এই আশায় বসে থাকি। ঘরে ইঁদুর দৌড়োয়, বাইরে লোক হাঁটে, যে কোনও শব্দকেই রুদ্রর বাড়ি ফেরার শব্দ ভেবে ভুল করতে থাকি। যে কোনও রিক্সার টুং টং শব্দকে রুদ্রর রিক্সা ভেবে ভুল করতে থাকি। দিন পার হয়। আবারও রাত আসে। রাত সাড়ে দশটায় বাতাসি কাঁথা বালিশ নিয়ে এঘরে শুয়ে পড়েছে। আমি জেগে থাকি। সাড়ে বারোটায় দরজার শব্দে লাফিয়ে উঠি আনন্দে। হৃদপিণ্ডে উত্তেজনার ঢোল বাজে। দরজা খুলে রুদ্র ঢোকে। বাতাসি কাথাঁ বালিশ নিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে যায়। এ কে বেরোলো? এ কে? রুদ্র চেঁচাচ্ছে। এ বাতাসি। বাতাসি কেন? বাতাসি কি চায়? বাতাসি কিছু চায় না। ঘুমোতে এসেছিল। কেন ঘুমোতে এসেছিল? আমি ডেকেছিলাম। কেন? কে ডেকেছিলে? রাতে ভয় লাগে বলে। ভয়? কিসের ভয়? ভয় আবার কিসের? রুদ্র দরজা সশব্দে বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়ায়। এবার আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাবে সে। কিন্তু আমাকে জড়িয়ে ধরছে না, চুমু খাচ্ছে না। আমি রুদ্রর দিকে এগোতে থাকি, তার নাগালের দিকে যেন সে আমাকে স্পর্শ করতে পারে, যেন আমাকে তার উষ্ণ আলিঙ্গনে বেঁধে হৃদয় শীতল করতে পারে। আমার ঠোঁটজোড়া এগোতে থাকে তার ঠোঁটের নাগালে, যেন দীর্ঘ দিন পর আমার ঠোঁটজোড়া তার ঠোঁটের ভেতর নিয়ে উষ্ণ উষ্ণ লালায় ভিজেয়ে −তঁতুলের মত চুষে রক্তহীন করে দিয়ে সুখ পেতে পারে। আমার মসণৃ কন্ঠদেশ এগোয়, যেন সে দাঁতে ঠোঁটে জিভে চেপে রক্ত জমাট করে আনন্দ পেতে পারে।যেন তার অপেক্ষার কষ্টগুলো শরীর থেকে মন থেকে একটু একটু পলেস্তারা খসার মত খসে যায়। এই আমি রুদ্র। তোমার অপেক্ষার দিন ফুরিয়েছে, আমাকে নাও।কিন্তু আমার মুখোমুখি যে লোকটি ,সে কি সত্যিই রুদ্র! বিশ্রি গন্ধ বেরোচ্ছে মখু থেকে। কড়া স্পিরিটের গন্ধ।যেন গ্যালন গ্যালন নেল পালিশের রিমোভারে স্নান সেরে এসেছে সে। টলছে সে। টলতে টলতে কিছু বলতে চাইছে। শব্দ জড়িয়ে যাচ্ছে মুখে। আমি থমকে দাঁড়িয়ে থাকি, হৃদপিণ্ডে উত্তেজনার ঢোল আচমকা বন্ধ হয়ে গেছে, একটি আতঙ্ক হিশহিশ করে এগোচ্ছে। সামনে নয়, পেছনে ফেলতে থাকি পা। পা দু পা করে পেছনে। গন্ধ থেকে পেছনে, রক্তচোখ থেকে পেছনে। আমাকে ধরতে রুদ্র হাত বাড়ায়। যেন হাডুডু খেলছে, খপ করে ধরে ফেলে জিতে যেতে চাইছে। দূরে সরতে থাকি আমি। রুদ্রকে মোটেও চেনা কোনও মানুষ মনে হয় না।মাতাল কোনও লোক আমি আমার জীবনে এর আগে কখনও দেখিনি। এই প্রথম। এই প্রথম কোনও মাতাল লোক দেখা, ভয়ে আমার সারা শরীর থরথর করে কাঁপে। আমাকে পেছনে হটতে দেখে জোরে হাসছে সে, হাসিটি বীভৎস। গভীর জঙ্গলে যেন আটকা পড়েছি কোনও হায়েনার হাতে। এমন করে রুদ্রকে আমি হাসতে দেখিনি কখনও। পেছোতে থাকি। হৃদপিণ্ডে ঢিপঢিপ ধিকধিক বাড়ছে। রুদ্রর শব্দ একটির ওপর আরেকটি ঢলে পড়েছে। জড়ানো শব্দে চেঁচাচ্ছে,কেন তোমার আসতে দেরি হল? দেরি হল বলে সে অদ্ভুত অচেনা চোখে তাকাচ্ছে, কর্কশ কণ্ঠে কদাকার চিৎকার। এগোচ্ছে আমার দিকে। আমি পালাবার কথা ভাবি। দৌড়ে গিয়ে বাড়িঅলার বাড়িতে আশ্রয় চাওয়ার কথা ভাবি। দেয়াল ঘেঁষে নিজেকে হাডুডুর খপ থেকে সনপ্তর্ ণে বাঁচিয়ে দরজার দিকে যেতে নিলেই রুদ্র আমাকে খামচি দিয়ে ধরে, চুল ধরে হেঁচকা টানে কাছে আনে। সেই উৎকট গন্ধের মধ্যে আমাকে ডুবিয়ে বলে, কেন দেরি করলে? কেন যেদিন চিঠি পেয়েছ সেদিনই আসনি? কণ্ঠ কাঁপে যখন বলি, ছুটি পাইনি। কেন পাওনি? আবারও চিৎকার। কদাকার। রুদ্রর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পেছনে যেতে যেতে দেয়ালে আটকে থাকি। জানালার কিনারে রাখা থালবাসন তছনছ করে কিছু খোঁজে সে। তোশকের তল, চৌকির তল, খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যায় ছুরি, মহররমের মিছিলে যেমন আকাশের দিকে তুলে তলোয়ার নাচায় হায় হাসান হায় হোসেন করা ধর্মান্ধগুলো, তেমন করে রুদ্র তার হাতের ছুরিটি নাচায়। ছুরিটি দেখে আমার চোখ বুজে আসে। আমি কান্না আটকে রাখি। শ্বাস আটকে রাখি। সে কি আমাকে খুন করবে এখন! করবে। খুনের নেশায় উদ্বাহু নৃত্য করছে সে। এই তাজমহল রোডের বাড়িটিতে আজ রাতে আমাকে মরে যেতে হচ্ছে। আমার জীবনের এখানেই সমাপ্তি। কেউ জানবে না, আমার বাবা মা ভাই বোন কেউই কোনওদিন জানবে না এই বাড়িটিতে কি করে মরতে হয়েছে আমাকে। কেউ হয়ত জানবেও না যে আমি মৃত। খবরটি ওদের কে দেবে! রুদ্র আমাকে বস্তায় পুরে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেবে হয়ত! একবার কেন আমাকে রক্ষা করতে বাড়িঅলার বাড়ি থেকে কেউ আসছে না! রুদ্র আমার বুকে ছুরি তাক করে ধেয়ে আসতে থাকে দেয়ালে আটকে থাকা আমার দিকে। এই মুহূর্তে হাতের কাছের দরজাটি খুলে ঝুল বারান্দা থেকে নিচের রাস্তায় ঝাপঁ দেওয়া ছাড়া আমার আর পথ নেই যাওয়ার। আমার সামনে মৃত্যু, পেছনে মৃত্যু। একা অসহায় দাঁড়িয়ে থাকি। আমার কথা বলার, কাঁদার, এমনকি শ্বাস ফেলারও কোনও শক্তি নেই। রুদ্রর হাত থেকে এই ছুরি আমি শক্তি খাটিয়ে নিতে পারব না, অসুরের শক্তি এখন তার দেহে। তার এক হাতে ছুরি আরেক হাতে আমার হাত, হাতটি টেনে সে দ্বিতীয় ঘরটির দরজার মুখে এনে বিছানায় ধাক্কা দিয়ে ফেলল। আবারও একই প্রশ্ন, কেন দেরি হল আমার ঢাকায় আসতে। আমি ক্ষীণ কণ্ঠে উত্তর দিই, একই উত্তর দিই, ছুটি পাইনি। আবারও তার এক প্রশ্নই, কেন পাইনি। ফাঁক খুঁজি, তাকে বসিয়ে শান্ত করে শান্ত স্বরে কেন পাইনি ছুটি তার কারণটি বলতে, যেন খুনের ইচ্ছেজ্ঞট মাতাল-মাথা থেকে দূর হয়। মাতালের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার আমি কোনও নিয়ম জানিনা, অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার কোনও পদ্ধতি শিখিনি। অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকি ছুরিটির দিকে। শানানো ছুরিটির শরীর থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে চিকচিক আলো। ছুরিটি আমার গলায় নাকি বুকে বসাবে রুদ্র। আমি চোখ বুজি, যেন আমাকে দেখতে না হয় প্রেমিকের হাতে খুন হওয়ার দৃশ্যটি। হঠাৎ ছুরি ফেলে সে পেচ্ছাবখানার দিকে দৌড়োয় রুদ্র। বুকের মধ্যে কোত্থেকে জানিনা প্রাণপাখি উড়ে আসে। চকিতে ছুরিটি নিয়ে দৌড়ে যাই বারান্দায়, রাস্তায় ফেলে দিতে। কিন্তু আমাকে থামায় একটি ভাবনা, যদি ছুরি ফেলে দিয়েছি বলে রেগে গিয়ে আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলে! ছুরিটি আমি খাটের তলে একটি চালের কৌটোর ভেতর লুকিয়ে রাখি। ছুরি পেলে আমাকে খুন করবে না, এই শতর্ যদি দেয়, দেব। এই মুহুর্তে কোথায় পালাব আমি। বাড়িঅলার বাড়ি কড়া নাড়লে ও বাড়ির কেউ দরজা খোলার আগে রুদ্র আমাকে ধরে ফেলতে পারে। এই পালানোর শাস্তি তখন মৃত্যুই। তার চেয়ে ঘরে বসে বুঝিয়ে তাকে শান্ত করতে চেষ্টা করি, তার মাথা থেকে মদের বিষ নামাতে চেষ্টা করি। ছলে বলে কৌশলে প্রাণপাখিটিকে বুকের খাঁচায় আটকে রাখতে হবে আমার। মানুষের জীবন একটিই, এ জীবনটি শত চাইলেও আর ফেরত পাবো না। ঘরে এসে রুদ্র ছুরি খোঁজে। ছুরি কোথায়? আমার ছুরি কোথায়? চিৎকারে বাড়ির পলেস্তারা খসে। চিৎকারে বাড়িঅলার বাড়ির লোকেরা জানে। ওই চিৎকারে আমি হু হু করে কেঁদে বলি, ছুরি নেই। ছুরি চাইছো কেন? আমাকে মেরে ফেলতে চাও? কেন মারবে? কি করেছি আমি। ছুরি আমি ফেলে দিয়েছি! ভেতরে আর কান্না আটকে রাখা সম্ভব হয় না আমার। রুদ্র তার ক্রন্দসী প্রেয়সীর গলা টিপে ধরে। হাতদুটো শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সরিয়ে দৌড়ে অন্য ঘরে গিয়ে দরজার ছিটকিনি আটকে দিই। অনেকক্ষণ দরজায় সে লাথি দেয়। খোল খোল বলে তারস্বরে নিঝুম নিথর রাতটির ঘুম ভাঙায়। জাগায়। রাতটিতে লণ্ডভণ্ড করে। একসময় আর কোন শব্দ নেই। দরজার ফুটো দিয়ে দেখি বিছানায় ওভাবেই শার্ট প্যান্ট জুতো পরে শুয়ে আছে রুদ্র। আর কোনও শব্দ নেই। নৈঃশব্দের সঙ্গে আমার চোখের জলের ফিসফিস করে কথা হয়। ভোর হওয়ার জন্য প্রকৃতির কাছে প্রাথর্ণা করতে থাকি। এই দুঃসহ কালো রাত পার যেন হয়। এত দেরি করে কোনও রাতকে আমি পার হতে দেখিনি এর আগে। ভোরবেলা ব্যাগটি নিয়ে আলগোছে দরজা খুলে বেরিয়ে যাওয়ার আগে রুদ্রর ওই অপেক্ষার দিনলিপির পাশে লিখে রাখি, রোদ, দুদিন থেকে অপেক্ষা করেছি তোমার জন্য। তুমি আসোনি। কাল রাতে একটি অচেনা লোক ঘরে এসেছে, লোকটিকে আমি চিনি না। আমি চলে যাচ্ছি। যেখানেই থাকো তুমি, ভাল থেকো। তোমার সকাল।

এত ভোরে রাস্তায় বেশি যানবাহন থাকে না। দএু কটি রিক্সা মন্থর গতিতে চলছে। একটি মন্থরকে নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছোই। ভোরবেলার প্রথম বাসটি ঘুম ঘুম চোখে দাঁড়িয়ে আছে। বাসের দরজায় পা রাখতেই কনডাকটর জিজ্ঞেস করে সঙ্গে পুরুষলোক নাই?

না।

এই লেডিস একটা।লেডিস একটা। কনডাকটর চেঁচিয়ে বলে। কাকে বলে কে জানে। লেডিস একটা মানে সতর্কে করে দেওয়া সবাইকে যে আমাকে নিরাপদ একটি জায়গায় বসতে হবে। লেডিসের নিরাপত্তা হল লেডিস সিটে, ড্রাইভারের পাশের জায়গাগুলোকে বলা হয় লেডিস সিট। মেয়েরা একা বাসে উঠলে ওখানেই, ওই জায়গায় বসারই নিয়ম। বাসে, লেডিসের সঙ্গে লেডিসকে না বসালে লেডিসের জন্য যাত্রা নিরাপদ হয়না বলে ভাবা হয়। লেডিস সিট ভরে যাওয়ার পর যদি বাড়তি লেডিস উদয় হয় তখন তাকে অলেডিস সিটে বসিয়ে দ্বিতীয় লেডিসের অপেক্ষা করতে থাকে কনডাকটর যেন প্রথম লেডিসের পাশে দ্বিতীয়টিকে বসিয়ে দিতে পারে। সেদিন লেডিস সিটে জায়গা নেই, অপেক্ষা করেও কোনও দ্বিতীয় লেডিসএর টিকিটি দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কি করা? মাঝবয়সী স্বামী স্ত্রী বসে আছে পাশাপাশি, কনডাকটর স্বামীটিকে বলল, ভাইজান আপনে অন্য সিটে বসেন, আপনের লেডিসের সাথে এই লেডিসরে বসাইয়া দেই। আমি বললাম, না থাক, ওদেরে উঠাইয়েন না। সমস্যা সমাধানের আরও উপায় বাসের কনডাকদের জানা আছে। লেডিসের পাশে বসার জন্য কোনও লেডিস অগত্যা পাওয়া না গেলে বাসে যে পুরুষটি সবচেয়ে বুড়ো বা যে ছেলেটি একেবারে বাচ্চা, দাড়িমোচ ওঠেনি, তার সঙ্গে বসিয়ে দেওয়া। কোনওভাবেই কোনও যুবকের পাশে নয়।

লেডিস সিট খালি নাই। ছোট কনডাকটর বড়টিকে বলে। বড়টি এরপর খুঁজে পেতে এক বুড়োকে আবিস্কার করে জিজ্ঞেস করে, চাচা আপনে একলা?

হ।

যান ওই চাচার সাথে বসেন গিয়া। আমাকে নির্দেশ।

আমি মেয়ে বলে আমার সিট পছন্দ করে দেওয়ার দায়িত্ব তাদের। কোনও এক বুড়ো চাচার পাশে বসিয়ে কনডাকটর ভেবেছে আমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে সে। কোনও পুরুষ বাসে উঠলে সে তার পছন্দ মত জায়গা বেছে নিয়ে বসে। কিন্তু একা কোনও মেয়ে এলে তাকে অপেক্ষা করতে হবে যতক্ষণ না কনডাকটর তার বসার আয়োজন করে। আমাকে নিরাপদ সিটে বসার ব্যবস্থা করে ছোট এবং বড় দু কনডাকটরই স্বস্তি পায়। বাসের জানালায় মাথা রেখে আমি ভাবি, পরপুরুষের পাশে বসা নিরাপদ নয় বলে বাসে এই নিয়ম চালু করা হয়েছে, মেয়েদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ,লোকে জানে যে আপন পুরুষ। সবচেয়ে নিরাপদ স্থানটি আপন পুরুষের ঘর! স্বামীর ঘর। কনডাকটরটি যদি জানত, আমার জন্য ওটিই কত অনিরাপদ!

অবকাশে ফিরে নিরাপদ বোধ করি। অবকাশের চারদিকে উঁচু দেয়াল, দেয়ালের ওপর ভাঙা কাচ বসানো। তার ওপর আরও উঁচু করে দেওয়া কাঁটাতারের বেড়া। বাইরের জগত থেকে আলাদা করা এই বাড়িটিকে একসময় কারাগার বলে মনে হত আমার। এখন মনে হয় এখানেই থোকা থোকা শান্তি লুকিয়ে আছে। মা আমার দিকে তীক্ষ ্ন একটি দৃষ্টি ছুঁড়ে দেন যদিও, বুঝি ওই দৃষ্টির আড়ালে ওত পেতে আছে স্নেহ। যত দুর্ঘটনাই আমি ঘটাই না কেন, ওই স্নেহ আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বেই। নার্গিসকে দিয়ে মা ভাত পাঠান আমার ঘরে। ভাতের সঙ্গে আমার প্রিয় বেগুন ভাজা, খাসির মাংস। খুব যতে ্ন বেড়ে দেওয়া। মা কি করে জানেন, এই সকালে আমার পেটে ভাতের ক্ষিধে! মা মানেই কি এই, মা সব বুঝে নেবেন, কোনও কিছু বলার দরকার হবে না! ইয়াসমিন ওর নতুন তোলা একটি গান গাইছে বিছানায় বসে। সুহৃদ একটি প্রজাপতির গা রং করছে জল রংএ, আর বলছে, প্রজাপতি প্রজাপতি কোথায় পেলে তুমি এমন রঙিন পাখা! সুমন ইয়াসমিনের গান শুনতে শুনতে বলছে, ইয়াসমিন আপা তুমি এত সুন্দর গান গাইতে পারো তা আগে জানতাম না। সুমন হাশেমমামার ছেলে, একটিই ছেলে হাশেমমামার, বাকি সব মেয়ে। গতকাল এ বাড়িতে হাশেমমামা সুমনকে রেখে গেছেন। আকুয়া রেললাইনের ওপর কিছুদিন আগে একটি চৌদ্দ পনেরো বছর বয়সের ছেলেকে সমবয়সী কিছু ছেলে খুন করেছে। খুন করতে কোনও পিস্তল বা বন্দুকের প্রয়োজন হয়নি, একটি ছুরিই যথেষ্ট ছিল। খুনের আসামিদের তালিকায় সুমনের নামটিও আছে। হাশেমমামা মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে আওয়ামি লিগের আকুয়া ইয়নিয়ন শাখার সভাপতি হয়েছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা নাম ভাঙিয়ে অনেক সুবিধে লুটেছে। টাকা করেছে অনেকে অনেক রকম উপায়ে। অনেকে মন্ত্রী হয়েছে, বিদেশে রাষ্ট্রদূত হওয়ার চাকরি পেয়েছে। হাশেমমামার কিছুই হয়নি। তিনি এসবের পেছনে দৌড়োননি। জীবিকার জন্য কায়ক্লেশে নতুন বাজারে ভাত মাছ বিক্রি করার ছোট্ট একটি দোকান কিনেছেন। এই করে ঘরের পারুল বউ আর পাঁচটি মেয়ে একটি ছেলেকে নিয়ে তিনি গাদাগাদি করে থাকছেন সেই খুপড়ি একটি ঘরে। যে ঘরে বিয়ের পর থেকেই থাকছেন। এতগুলো ছেলেমেয়ে হল, ছেলেমেয়ে বড়ও হয়েছে, কিন্তু তিনি আজও সেই ঘরে। টাকা পয়সা বাড়ি গাড়ি সম্পত্তির কোনও মোহ নেই। নিজের লেখাপড়া হয়নি হাশেমমামার, ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া করাচ্ছেন। মেয়েগুলো পরীক্ষায় ভাল ফল করে, কেবল ছেলে নিয়েই ঝামেলা। পাড়ায় ছেলের বন্ধুবান্ধব বেশি, লেখাপড়ায় মন নেই। বন্ধু হলে শত্রু হয়। কোনও এক শত্রু সুমনের নামটি আসামির তালিকায় ঢুকিয়ে দিয়েছে। হাশেমমামা ছেলেকে বংশের বাতি বলে মনে করেন না। ননীটা ছানাটা খাইয়েও একে মানুষ করতে হবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন না। পনোরো ষোল হলেই মেয়েদের এক এক করে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার কথা কখনও ভাবেন না। মেয়ের চেয়ে ছেলেকে গুরুত্ব দেওয়ার পক্ষপাতি নন তিনি। এই সমাজে বাস করে হাশেমমামা সমাজের আর দশটা লোকের মত নন। এই অন্যরকম হাশেমমামার প্রতি আমার বিষম আগ্রহ। খুব ইচ্ছে করে তাঁকে জিজ্ঞেস করি, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। কি করে ভারত চলে গিয়েছিলেন, কি করে ওখানে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন যুদ্ধের, কি করে মুক্তিযুদ্ধের গ্রুপ-কমান্ডার হয়ে তিনি জঙ্গল পার হয়ে নদী সাঁতার কেটে দেশের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গিয়েছেন! কি করে তিনি পাক সেনাদের দিকে গুলি ছুঁড়েছেন, কটাকে কুপোকাৎ করেছেন কোনওদিন জিজ্ঞেস করা হয় নি। সুমনকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে হাশেমমামা হন্যে হয়ে ঘুরছেন। এক আশ্চর্য সততা সম্বল করে হাশেমমামা বাঁচেন। তিনি মিথ্যে মামলা থেকে ছেলেকে রক্ষা করতে পারেন না। কারাগারের মত এই বাড়িটি আপাতত তাঁর ছেলেকে বাঁচাবে বলে পুলিশের হাত থেকে না হলেও পাড়ার শত্রুদের হাত থেকে, হাশেমমামা বাবাকে অনুরোধ করেছেন সুমনকে এ বাড়িতে কদিন রাখার। বাবা রাজি হয়েছেন। কিন্তু ঢাকা থেকে ফিরে আসার পর সুমন আর ইয়াসমিনকে নিয়ে গান কবিতায় হাসি ঠাট্টায় গল্পেগাছায় খেলায় ধুলায় মেতে থেকে প্রমোদে মন ঢেলে দিয়ে ঠিক দুদিন পর এই আমি রাজি হইনা সুমন অবকাশে আর একটি মুহূতর্ থাকুক। কারণটি হল একটি অসহায় মেয়ের থরথর কাপঁুনি দেখেছি আমি মধ্যরাতে। নার্গিসের দৌড়ে আসার শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গিয়েছে আমার। ওর ভয়াতর্ শ্বাসের শব্দে আমি চোখ খুলেছি। আমার দরজায় দাঁড়ানো কাঁথা বালিশ হাতে, কাপঁ ছে ও। শরীর কাপঁ ছে। চোখ বিস্ফারিত।

কি হইছে তর?

আমি ঘুমাইতাছিলাম। সুমন ভাইয়া আমারে জাইত্যা ধরছে।

আমি তড়িতে বিছানা থেকে নেমে নার্গিসকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে ওর গায়ের কাপঁুনি থামাই। ঘরের ভেতর ওকে ঢুকিয়ে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিই। নার্গিস সে রাতে আমার ঘরের মেঝেয় কাথাঁয় গা মুড়ে কুকুরকুণ্ডলি হয়ে বলে, আমি জিগাইছি, আপনে এইখানে আইছেন কেল্লিগা? কইতেই আমার মখু চাইপা ধরছে। আমারে কয়, তুই রাও করিস না। কেউ জানব না। কেউ বুঝব না। আমি চিল্লাইয়া আপনেদেরে ডাকতে চাইছিলাম। অনেক কষ্টে নিজেরে ছুটাইয়া আইছি আপা।

 

কত হবে বয়স নার্গিসের? তেরো। বাবা গরিব বলে মেয়েকে অন্যের বাড়ি কাজ করতে দিয়েছে। ভোরবেলা থেকে মধ্যরাত অবদি কাজ করে ঘুমোতে যায়। এই সময়টুকুই নিজের ওর। এই ঘুমোনোর সময়টুকু। অথবা তাও হয়ত নয়, ঘুমোতে ওকে দেওয়া হয় পরদিন তাজা শরীরে বাড়ির সমস্ত কাজ যেন সারতে পারে। নার্গিসের তো ইশকুলে যাওয়ার কথা এ বয়সে। অথচ ও এখনও স্বরে অ স্বরে আ পড়তে জানে না। সুহৃদ যখন বই খুলে স্বরে অ স্বরে আ পড়ে, নার্গিস অভিভূত চোখে তাকিয়ে থাকে। ওরও নিশ্চয়ই ইচ্ছে করে এমন করে বই খুলে পড়তে। নার্গিসের বাবা অবকাশে মাঝে মাঝে নার্গিসকে দেখতে আসেন। মা তখন নার্গিসকে তড়িঘড়ি ময়লা জামা পাল্টো ধোয়া জামা পরে, হাতে পায়ে তেল মেখে রুক্ষতা আড়াল করে চুল আঁচড়ে ওর বাবার সামনে যেতে বলেন। ওর বাবা যেন দেখে মনে করেন মেয়ে তাঁর সুখে আছে এখানে। ভাতে মাছে গোসলে কাপড়ে তেলে খেলে। দুপুর হলে নার্গিসের বাবাকে বারান্দার ঘরে বসিয়ে ভাতও খাইয়ে দেন মা। খাওয়ার সময় মা দরজার পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে বলেন, আপনের মেয়ে খুব ভাল আছে এইখানে, কোনও চিন্তা কইরেন না।

খেয়ে দেয়ে নার্গিসের বাবা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, সবার কথা শুইনা থাইকো মা, তোমারে সবাই কত আদর করে এই বাড়িতে! সবাইরে মাইনা চলবা। নার্গিস দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ওর বাবার চলে যাওয়া দেখে, চোখে বানের পানি। কি রে নার্গিস কানতাছস কেন? যদি কখনও বলি, নার্গিস দ্রুত পানি মুছে হেসে ফেলে।

না আপা, কান্দি না। ঝুল পরিষ্কার করতাছিলাম, চোখে ময়লা পড়ছে।

নার্গিসের এরকমই উত্তর, না আপা কান্দি না,পিঁয়াজ কাটতাছিলাম, চোখে ঝাঁজ লাগছে।

 

সকালে আমি মাকে বলি ঘটনা। মা চপু হয়ে যান শুনে। হাশেমমামাকে মা খুব পছন্দ করেন। প্রায়ই বলেন, এই একটা ভাই আমার, বড় ভাল। কাউরে ঠগায় না। কারও ক্ষতি করে না। কাউরে খারাপ কথা কয় না। মানুষের উপকার করে যেইভাবে পারে। মানুষের কত শত্রু থাকে। হাশেমের কোনও শত্রু নাই।

 

এ বাড়িতে ভাল ভাইটির ছেলেটিকে আপাতত রেখে ভাল ভাইটিকে সামান্য হলেও দুশ্চিন্তামুক্ত করছেন বলে মার আনন্দ হচ্ছিল। মার আত্মীয়স্বজনকে বাবা কখনও সাদর আমন্ত্রণ জানান না অবকাশে। সুমনকে অবকাশে কদিন থাকতে দিতে রাজি হয়েছেন বাবা, সুমনের জন্য বাবার এমন উদার হৃদয়, হাশেমমামার ব্যক্তিত্বের কারণেই। মার কষ্টের নদীতে সুমনকে আশ্রয় দেওয়ার যে আনন্দ-ডিঙ্গিটি ছিল, তা ডুবিয়ে দিই। সুমনকে জিজ্ঞেস করেন মা, রাতে সে নার্গিসের বিছানায় গিয়েছিল কি না। আকাশ থেকে পড়ে সুমন। গলা ফাটায়, ছেড়ি মিছা কথা কয়।

মা শান্ত গলায় বললেন, না ছেড়ি মিছা কথা কয় নাই।

মা সেদিনই হাশেমমামাকে ডেকে সুমনকে অবকাশ থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ নয়, আদেশ করেন।

 

হাশেমমামা সুমনকে অবকাশ থেকে ছেড়ারে জেলে ভইরা থওয়াই ভাল বড়বু বলে নিয়ে যাওয়ার পরদিন হাসপাতালে পেছনে কৃষ্টপুরে নার্গিসদের বাড়িতে গিয়ে নার্গিসের মায়ের হাতে পাঁচশ টাকা দিয়ে বলে আসি, বিলকিসকে যেন ইশকুলে ভর্তি করায়, কারও বাড়িতে যেন বান্দিগিরি করতে না দেয়। ছোট্ট সুন্দর গোল মুখের নাকছাবি পরা বিলকিস উঠোনের ধুলোয় বসে মিছেমিছির রান্নাবাড়ি খেলছিল, ছ বছরের এই বাচ্চাজ্ঞটকে কৃষ্টপুরের এক ব্যবসায়ীর বাড়িতেই নার্গিসের মা পেটে ভাতে কাজে দেবেন বলে ঠিক করেছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *