ইসলামিক ইতিহাস চর্চায় নব-জাগরণ
এক এক মন্বন্তরের সময় যেমন আগেকার সব ঢাকিয়া দিয়া এক নূতন সৃষ্টির জগৎ দেখা দেয়, সেই মত ভারতে হিন্দু যুগ ও বৌদ্ধ ধর্ম্মের ইতিহাস সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞানের যে এক যুগান্তর-সম উন্নতি ঘটিয়াছে, একথা সকলেই জানেন। ঋগবেদ ও সায়নভাষ্য (১৮৬০-এর কিছু পূর্ব্বে) ছাপা হওয়ায় ইউরোপীয় পণ্ডিতগণ তাহা লইয়া গবেষণা করিয়া নবীন মত প্রকাশ করিতে লাগিলেন। ব্রাহ্মী লিপির পাঠোদ্ধার করিয়া প্রিন্সেপ সাহেব (১৮৩৫) প্রাচীন ইতিহাসের এক আঁধার-কোঠার চাবী আবিষ্কার করিলেন। ব্রায়ান হজসন নেপালে রেসিডেন্ট থাকার সময় (১৮২০-১৮৪৪) নিজ ব্যয়ে শত শত বৌদ্ধ হস্তলিপির নকল লইয়া তাহা বিলাতে ও কলিকাতায় বিতরণ করিয়া পণ্ডিতদের সামনে বৌদ্ধধর্ম্ম চর্চ্চার এক নবীন রাজ্য খুলিয়া দিলেন; এদেশে রামদাস সেন ও রাজেন্দ্রলাল মিত্র সেই গবেষণায় যোগ দিলেন। ফলতঃ ১৮৫৬ হইতে যেন দেশব্যাপি অন্ধকার ঘুচিয়া গিয়া মেঘের ভিতর দিয়া সত্যের আলোক আসিতে লাগিল।
ঠিক সেই মতই ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইসলামিক ইতিহাস চর্চ্চায়ও যে এক মন্বন্তর ঘটিয়াছে তাহা কম লোকেই জানেন। এই পরিবর্তন সহজেই বুঝা যায় যদি আমরা গীবনের রচিত রোমক সাম্রাজ্যের অবনতি ও পতন (১৭৭৬-৮৮ প্রকাশিত) গ্রন্থখানি এবং অধ্যাপক বিউরী সম্পাদিত তাহার সটীক সংস্করণ (১৮৯৬ প্রকাশিত) পাশাপাশি রাখি।
গীবনকে সত্যই বলা হয়, খ্রিস্টপশ্চাৎ জগতের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক; তাঁহার মহাগ্রন্থ সাহিত্যের হিসাবে এক অতুলনীয় বস্তু, এবং সেই সঙ্গে ইতিহাসের ক্ষেত্রেও সর্ব্বোচ্চ। তাঁহার মৃত্যুর পর একশত বৎসর ধরিয়া ইউরোপের সব দেশের পণ্ডিতেরা ওই গ্রন্থের সংশোধন চেষ্টা করেন, টীকা যোগ দেন। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে রোমক-সাম্রাজ্যের ইংলন্ডে সৰ্ব্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক বিউরী যখন উহার সংস্করণ বাহির করিলেন তখন দেখা গেল যে গীবন অত্যন্ত কম ভুল লিখিয়াছেন অথবা আবশ্যক তথ্য বাদ দিয়াছেন, সুতরাং বিউরীর টীকা টিপ্পনী শুধু গীবনের পরবর্তী নূতন প্রকাশিত উপাদানের নাম যোগ এবং দু চারটা সংখ্যা বা নামের সংশোধন করিয়াই ক্ষান্ত হইয়াছে। এই উচ্চ গৌরব গীবনের গ্রন্থে ইউরোপীয় দেশগুলির ইতিহাসের অধ্যায়গুলির প্রাপ্য। কিন্তু গীবনের মহাগ্রন্থের যে-সব অধ্যায়ে ইস্লামের উৎপত্তি, রাজ্যবিস্তার ও সংঘর্ষ বর্ণিত হইয়াছে, সেগুলির সংশোধনের ভার বিউরী দিলেন আরবী পারসিক ভাষায় পণ্ডিত ষ্টালি লেন্পলের উপর। আমাদের বর্তমান জ্ঞানের মাপকাঠিতে গীবনের গ্রন্থের এই অংশে অনেক ত্রুটি ও মারাত্মক ভুল ধরা পড়িল।
ইহার কারণ কী? গিবনের অবহেলা বা মস্তিষ্কের দুর্বলতা নহে; গীবনের জীবতকালে ঐ ঐ ক্ষেত্রে মৌলিক উপাদানের অভাব। গীবনের আরবী ফার্সী ভাষা জানা ছিল না; তিনি কোন হস্তলিপি দেখেন নাই; তাঁহার সময়ে ইসলাম সম্বন্ধে যে-সব লাটিন, ফরাসী অথবা ইংরাজী ছাপা বই পাওয়া যাইত, শুধু তাহাই তাঁহার গ্রন্থের ওই সব অধ্যায়ের ভিত্তি। সে-যুগে হিব্রু বাইবেল (ওল্ড টেষ্টামেন্ট) শুদ্ধভাবে ব্যাখ্যা করিবার জন্য ইংলণ্ডের বড় বড় খ্রিস্টান ধৰ্ম্মযাজক এবং অক্সফোর্ডের অধ্যাপক (তাঁহারা ও ব্রহ্মচারী এবং দীক্ষিত পুরোহিত হইতে বাধ্য) হিব্রুর সহিত আরবী ও অন্য সেমিটিক ভাষার গভীর চর্চ্চা করিতেন, এবং খ্রিস্টধর্ম্মের বিস্তারের ইতিহাস লিখিতে গিয়া ইসলামের সহিত তাহার সংঘর্ষ বর্ণনা করা আবশ্যক হইত। এ জন্য এই শ্রেণীর সাহেব লেখকেরাই প্রথমে আরবী ফার্সী গ্রন্থের অনুবাদ বা সার সংকলন প্রকাশ করেন, তাহাই গীবনের পুঁজীপাটা। কোন আরবী আধার গ্রন্থ, অর্থাৎ প্রাথমিক উপাদান তাঁহার হাতে পৌঁছে নাই। তাঁহার গ্রন্থের ইসলামিক অংশে বেশীরভাগ কাহিনীর ভিত্তি দুজন লেখকের বই– (১) আবুল ফিদা; তবিম্-উল-বুলদান্ নামে অক্সাস্ নদীর উত্তর দেশ অর্থাৎ তুরান বা মধ্য এসিয়ার ইতিহাস আরবী ভাষায় ১৩৩১ খ্রিঃ (অর্থাৎ মুহম্মদের মৃত্যুর ৭০০ বৎসর পরে) লেখেন, তাহার লাটিন অনুবাদ হডসন ১৭১২ খ্রি. অক্সফোর্ড হইতে প্রকাশ করেন। তাঁহার “বিশ্ব-ইতিহাসের সংক্ষিপ্তসার”-তারিখ-ই-মুকতসর, খুব বেশী চলিত ছিল। ইহার লাটিন অনুবাদ Ganier ১৭২২ খ্রি. অক্সফোর্ড হইতে ছাপেন। (২) Gregore Barhabraeuse, or Abul Faraj নামক খ্রিস্টান পুরোহিত কর্তৃক ১২৮০ সালে আরবীতে রচিত ছোট কাহিনী, যাহার লাটিন অনুবাদ ১৬৬৩ খ্রি. Pococke প্রকাশিত করেন। এদুটি ছাড়া গীবন পাইয়াছিলেন (৩) ওই Pococke রচিত লাটিন বই Specimens of the History of the Arabs (১৬৫০ খ্রি. ছাপা) (৪) ফরাসী ভাষায় রচিত দুখানা মুহম্মদের জীবনী, Gagnier এবং Prideaux তাহাদের লেখক। (৫) D’Herbelot রচিত ফরাসী Bibliotheque Oriental (১৬৯৭ খ্রি. প্রকাশিত) একখানি কোষ গ্রন্থ। (৬) কেমব্রিজের অধ্যাপক Ockley (১৭০৪-১৭৫৭) রচিত History of the Saracens। ইহা হইতে দেখা যাইতেছে যে ইসলামের প্রথম যুগের কোন সমসাময়িক মূল গ্রন্থ গীবন পড়েন নাই, তাঁহার সব লেখার আধার মুহম্মদের ৪/৫ শত বৎসর পরে লেখা, প্রবাদপূর্ণ অথবা নিজপক্ষ ও ধর্মসম্প্রদায়কে আদি ও অকৃত্রিম প্রমাণ করিবার জন্য ইতিহাসকে মিথ্যা করিয়া সাজান গ্রন্থ। গীবনের জানা আদিতম আধার, তবারীর ইতিহাস, যদিও নবীর মৃত্যুর আড়াইশ বৎসর পরে লেখা, তথাপি উহা প্রামাণিক; কিন্তু বইখানি অতি বৃহৎ ১২৫ ভলুমে সমাপ্ত; অথচ উহা হইতে ৪০/৫০ পাতা চয়ন করিয়া তাহার যে লাটিন অনুবাদ করা হয় তাহা মাত্র গীবন জানিতেন। তেমনি আর একজন পুরাতন ইসলামীয় লেখক ওয়াকিডি (যিনি তবারী হইতে অনেক কথা চুরি করিয়াছেন), তাঁহার লেখারও ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র গিবনের ব্যবহারে আসে, বর্তমানে ইউরোপীয় পণ্ডিতগণ ওয়াকিডিকে অবিশ্বাস করেন।
মুহম্মদের আদিতম এবং সর্ব্বোচ্চ প্রামাণিক জীবনী ইস্হাক কর্তৃক ৭৬৮ খ্রি. অর্থাৎ নবীর তিরোধানের ১৩৬ বৎসর পরে রচিত বইখানি গীবনের অনেক পরে আবিষ্কৃত হয়।
এইসব কারণে গীবনের অতুলনীয় প্রতিভা ইসলামিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে সংকুচিত এবং অনেকটা ব্যর্থ-প্ৰয়াস হইয়া পড়ে। এই ক্ষেত্রেই ঊনবিংশ শতাব্দীতে যুগান্তর-সম আবিষ্কার ঘটিয়াছে। তাহারই বর্ণনা করিব। কিন্তু প্রথমে দুটি কথা বাঙ্গালী পাঠককে বুঝাইয়া দেওয়া আবশ্যক- (১) এই আদিতম উপকরণকে কিরূপে বিশ্লেষণ এবং পরীক্ষার দ্বারা সত্য নির্দ্ধারণ করিতে হইবে? এবং (২) কোন্ কারণে পরবর্তী যুগের আরব লেখকগণ ইসলামের উ দ্ভব ও খলিফাঁদের বিস্তারের ইতিহাসে ভেজাল মিশাইলেন?
মুহম্মদের জীবনের ঘটনা ও তাঁহার মত সম্বন্ধে খাঁটি খবর কোরানে পাওয়া যায়, এগুলি সংখ্যায় কম এবং ইহার সংক্ষিপ্ত ভাষার জন্য অর্থ জটিল হইলেও এগুলি তাঁহার স্বরচিত এবং তাঁহার মৃত্যুর পরই দ্বিতীয় খলিফা কোরান লিপিবদ্ধ করায়, মুখে মুখে চলিয়া ইহাতে ভ্রম ঢুকিবার ভয় দূর হইল। তাহার পর নবীর নিজ শিষ্য ও সহচরগণ তাঁহার মুখে যে যাহা শুনিয়াছিল তাহাই তাহাদের বন্ধুদের কাছে বলিত, এবং এই হদিস অর্থাৎ লোকশ্রুতি ক্রমে ক্রমে ছয় সাত জনের ভিতর দিয়া চলিয়া আসিয়া অবশেষে তবারী তাহা সব একত্র করিয়া নিজ বিরাট গ্রন্থে প্রথম লিপিবদ্ধ করেন। যে হদিসগুলি সুন্নীরা সত্য বলিয়া গ্রহণ করে তাহা প্রায় এক হাজার হইবে, এবং সেই সংগ্রহের নাম মিস্কাৎ। ১৯০৪ সালে কেশব সেনের ব্রাহ্মমিশন ইহার এক বাঙ্গলা অনুবাদ প্রকাশ করেন।
কিন্তু হদিস গ্রন্থের তথ্যগুলির প্রত্যেকটি খুব কড়া পরীক্ষা না করিয়া সত্য বলিয়া গ্রহণ করা যায় না। কারণ, দুশ বছরে মুখে মুখে চলিয়া আসিয়া অনেকগুলির রূপান্তর হওয়া স্বাভাবিক, শ্রোতার মূর্খতায় স্মৃতিদোষে, এমন কি নিজদল পোষণ করিবার ইচ্ছায় জ্ঞানকৃত মিথ্যা লাগাইয়া দেওয়ার ফলে। যেমন একটা সিঁড়িতে আমরা মাথা হইতে ছয় সাত ধাপে নামিয়া তবে মাটিতে পৌঁছি, তেমনি মুহম্মদ হইতে তবারী পর্যন্ত মধ্যবর্ত্তী ছয়সাত পুরুষের ভিতর দিয়া এক একটি নবীর উক্তি লিখিত অর্থাৎ স্থায়ী আকার ধারণ করিয়াছে। এই ছয় বা সাত মধ্যবর্তী লোকদের ইস্নাদ বলা হয়, তাহাদের সকলেই সমান বুদ্ধিমান বা বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষী ছিলেন না। অথচ হদিস ইতিহাসের অতি মূল্যবান সহায়ক। এগুলি ভিন্ন কোরানের অনেকস্থলে বোধ হয় না এবং এই আধার না হইলে ইসলামের প্রথম যুগের ইতিহাস লেখা অসম্ভব।
এই সাক্ষীর Cross-examination করিয়াছেন একজন সাহেব। Count Caetani (উপাধি Principe di Teano) ইতালি ভাষায় এক গ্রন্থমালা আরম্ভ করেন, তাহার নাম Annali dell’ Islam; প্রথম ভলুম ১৯০৫ সালে বাহির হয়, তাহার উত্তরাধিকারীরা এত দিনে দশ এগার ভলুমে উহা শেষ করিয়াছেন। এই গ্রন্থের প্রণালী এইরূপ- মুহম্মদের জীবনের কালানুক্রমে ধারাবাহিক এক একটি ঘটনা লইয়া তাহার সম্বন্ধে কোরানে অথবা হদিসে যত উল্লেখ আছে তাহা সাজাইয়া তাহাদের প্রত্যেকটির বক্তার জ্ঞান ও চরিত্রের নির্ম্মম সমালোচনা করিয়া তাহার সাক্ষ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা স্থির করা। ইস্নাদ অর্থাৎ সিঁড়ির ধাপ যত কম হইবে ততই নবীর কাছে পৌঁছান যাইবে এবং সে হদিসটি ততই বিশ্বাসযোগ্য হইবে। এইরূপ অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিঃশেষ করিয়া আরবী প্রমাণ ও উক্তি একত্র সমাবেশ করার ফলে এই গ্রন্থখানি গবেষণার চরম দৃষ্টান্ত ও অকাট্য সত্য তথ্যের খনি হইয়া দাঁড়াইয়াছে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন, কেন মুহম্মদের তিনশ বৎসর পরবর্তী আরব লেখকগণ প্ৰথম যুগের ইসলামের ইতিহাসে ভেজাল ঢুকাইলেন? মুহম্মদের মৃত্যুর পর তাঁহার তিনজন শিষ্য ক্রমে ক্রমে মুসলমান-জনসংঘের নেতা (খলিফা) হইলেন, ইঁহারা কেহই তাঁহার বংশধর নহেন। ৪র্থ খলিফা আলী ছিলেন মুহম্মদের জামাতা; আলীর এক পুত্র হুসেন পিতার খুনের পর সিংহাসন পাইবার চেষ্টায় প্রাণ হারাইলেন এবং কুরেশকুলের ওমাইয়া বংশের এক নেতা (যাঁহার সঙ্গে মুহম্মদের কোন রক্তগত সংস্রব ছিল না) খলিফা হইলেন। হুসেনের ভ্রাতা হসন নিজ খলিফাপদ (প্রকৃতপক্ষে দাবিমাত্র) এই ওমাইয়া-নেতার হাতে ছাড়িয়া দিয়া ঘরে বসিয়া সুখভোগ করিতে লাগিলেন। ওমাইয়া-বংশীয় খলিফাগণ ৬৬১-৭৫০ খ্রিঃ পর্যন্ত রাজত্ব করিবার পর আব্বাস-বংশীয় সেনানায়কের হস্তে পরাস্ত হইলেন, তখন আব্বাসীয় খলিফাগণ সিংহাসনে উঠিলেন। The
victory of the Abbasids was a victory of the Persians over the Arabs (Becker)। এই নূতন খলিফাগণ মুহম্মদের খুড়ার বংশ, সুতরাং, তাঁহাদের চাটুকার লেখকগণ ইসলামের প্রথমযুগের ইতিহাসে যেসব নেতার ও খলিফার মুহম্মদের সঙ্গে রক্ত সম্বন্ধ ছিল না তাহাদের ছোট করিয়া দিয়া, সত্য ঘটনার উপর মিথ্যার প্রলেপ দিয়া, বিশেষত: ওমাইয়া-বংশীয় খলিফাঁদের কীর্ত্তি লোপ করিবার জন্য মিথ্যা কুৎসা রচনা করিতে লাগিলেন। যেসব হদিস আলী অথবা তাঁহার অনুচরদের নিকট হইতে মুহম্মদের উক্তি বলিয়া পাওয়া যায় নাই, সেগুলিকে শিয়ারা জাল বলিয়া ত্যাগ করিয়াছে। এবং এই Propaganda Literature অর্থাৎ পারসিক জাতির (পরে শিয়া) প্রভাবে লিখিত ইতিহাসই গিবনের সময় পর্যন্ত ইউরোপে সত্য। কার্যত: একমাত্র) ইসলামীয় ইতিহাস বলিয়া গৃহীত ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইসলামের আদিযুগের ঐতিহাসিক উপাদান আবিষ্কৃত হওয়ায় এই মিথ্যা দূর করা সম্ভব হইয়াছে।
এই আধারগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিতেছি। প্রথমতঃ ইসহাক-রচিত মুহম্মদের সর্বপ্রথম বড় জীবনচরিত। নবীর নিজ পরিবারের এবং প্রতিবেশীদের মধ্যে তাঁহার গ্লানিকারক বা নিন্দার যেসব কথা ছিল তাহা এই গ্রন্থে ভাল জিনিসের সহিত লিপিবদ্ধ হইয়াছে, কিন্তু আব্বাসীয় খলিফাঁদের পক্ষে লিখিত মুহম্মদ-জীবনীতে সেগুলি লুকান হইয়াছে। এই আরবী গ্রন্থখানি জার্মাণীতে Wustenfeld ১৮৫৮-৬০ সালে ছাপেন। তবারীর গ্রন্থের একটা বড় অংশ Sprenger সাহেব অযোধ্যার নবাবদের পুস্তকাগারে আবিষ্কার করেন, ইহার কয়েকখণ্ড ছাপা হইয়াছে। খলিফাঁদের ইতিহাসের আরবী গ্রন্থের আধারে এক প্রকাণ্ড জার্মান গ্রন্থ Weil রচনা করিয়াছেন। Wellhausen প্রভৃতি এই ক্ষেত্রের নানা অংশে অমূল্য দলিলসহ ইতিহাস বর্তমানে লিখিয়াছেন।
আরবী ভাষায় আধার গ্রন্থের হস্তলিপির সন্ধান পাওয়া ও তাহার নকল লওয়া সম্ভব হইল নেপোলিয়নের ইজিপ্ট আক্রমণ (১৭৯৮) হইতে। যদিও নেপোলিয়ন ইংরাজের কাছে পরাস্ত হইয়া ইজিপ্ ছাড়িলেন, তথাপি সেইদিন হইতে পশ্চিম এসিয়ার রুদ্ধদ্বার ভাঙ্গিয়া গেল। নেপোলিয়নের সময়েই পারস্য রাজদরবারে ইংরাজী ও ফরাসী দূতের আনাগোনা চলিতে লাগিল। সেই হইতে আরব্য ও পারস্য, মিশর ও মরক্কোতে শিক্ষিত ইউরোপীয় পণ্ডিতগণ বেড়াইতে ও গ্রন্থসংগ্রহ করিতে লাগিলেন। এদের মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা বেশী সফল এবং প্রথম কৃতি ছিলেন ফন্ হামার পুর্গস্টল (১৭৭৪-১৮৫৬); ইনি অষ্ট্রিয়া সাম্রাজ্যের দূত হইয়া কনষ্টাণ্টিনোপলে যান এবং আরবী, সিরিয়াক্, তুর্কী প্রভৃতি প্রাচ্য ভাষা শিখেন। ১৮০৭ খ্রি. তিনি কর্ম্ম হইতে অবসর লন, কিন্তু পরে পঞ্চাশ বৎসর ধরিয়া পশ্চিম এসিয়ায় ভ্রমণ, হস্তলিপি অন্বেষণ, এবং অসংখ্য পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রাচ্য ইতিহাসের মূল-সম্বলিত গ্রন্থ ও প্রবন্ধ প্রকাশ করেন।
“For 50 years Hammer Purgstal wrote incessantly on the most diverse subjects and published numerous texts and translations of Arabic, Persian and Turkish authorities. In spite of many faults, he did more for oriental studies than most of his critics put together.” ওসমালী তুর্কদের ইতিহাসের ক্ষেত্রে ইনি অদ্বিতীয় পণ্ডিত; মৌলিক উপাদানগুলি তাঁহার নিজের সংগ্রহ। জার্মান ভাষায় লিখিত গ্রন্থগুলির পর ইংরাজী ভাষায় সর্ উইলিয়ম মুয়ার (এলাহাবাদ প্রদেশের গভর্ণর) এবং স্প্রেগার সাহেব (অযোধ্যার নবাবদের পুথীশালার অধ্যক্ষ) এই দুইজন ১৮৫৬-৭০ পর্যন্ত আরবী মূলের চর্চায় অত্যন্ত সফল হইয়াছিলেন।
এখন সংক্ষেপে বলিব কোন্ কোন্ দিকে এইসব নব আবিষ্কৃত মূল গ্রন্থ আমাদের জ্ঞানবিস্তার করিয়াছে।
প্রথম- মুহম্মদের চরিত্র ও মত সম্বন্ধে যেসব ধারণা পূর্ব্বে চলিত ছিল তাহা ভুল। কার্লাইল তাঁহার The Hero as Prophet নামক প্রবন্ধে এই ধৰ্ম্ম প্রবর্ত্তকের যে চিত্র আঁকিয়াছেন তাহাতে তাঁহাকে honest fanatic বা ঈশ্বর উন্মত্ত সাধু রূপে দেখান হইয়াছে; মানসিক উত্তেজনায় অধীর হইয়া প্রচারের সময় তাঁহার মাথার রগ ফুলিয়া উঠিত, ফলাফল বিচার না করিয়া তিনি যাহাতে বিশ্বাস সেইদিকে দৃঢ়মনে অন্ধবেগে ছুটিতেন। কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য, মুহম্মদ অতি শেয়ানা দূরদর্শী স্থিরবুদ্ধি ষ্টেটস্ম্যান ছিলেন, খুব সফল কাজের লোক। কোনও honest blind fanatic তাঁহার মত এক বিরাট সংঘ ও সাম্রাজ্য গঠন করিতে পারিত না। তিনি যে সফলতা লাভের জন্য কত স্থলে কিছু ছাড়িয়া দিয়া আপোষ করেন এবং অন্যান্য ধর্ম্ম ও লোকরীতি হইতে অংশ লইয়া নিজ ধর্ম্মে তাহার স্থান দিয়া দলপুষ্টি করেন, তাহাই বর্তমান জার্মান পণ্ডিতগণ প্ৰমাণ করিয়াছেন। আমাদের নিকট যে আকারের ইহুদী ও খ্রিস্টধর্ম্ম বর্তমানে জানা আছে তাহা ছাড়াও ওই দুই ধর্ম্মের অন্যান্য শাখা ছিল মুহম্মদের সময়ে যাহা এখন লোপ পাইয়াছে, এগুলি হইতে তিনি অনেক মত ও ক্রিয়াকর্ম্ম ইস্লামে ঢুকাইয়া দেন, যেমন খ্রিস্টীয় ডোসেটিষ্ট সম্প্রদায় ইত্যাদি। এজন্য Becker লিখিত Cambridge Medieval History, Vol. II ch, 10-112 এবং Margoliouth-এর Muhammad (Hero of the Nations) দ্রষ্টব্য।
দ্বিতীয়– আব্বাস-বংশীয় খলিফারা মুহম্মদের নিজবংশের সমর্থক বলিয়া পরিচয় দিয়া ওমাইয়া বংশের খলিফাঁদের পরস্ব অপহারী, অত্যাচারী, রক্ত-পিপাসু (স্যাঃ খলিফা এবং হাজাজ্জ্ প্রাদেশিক শাসনকর্তা, তথা ইজিদ্ ) বলিয়া বর্ণনা করিয়াছে; ইহা অসত্য। প্রকৃত ইতিহাসে জানা যায় যে এই রাজবংশের শাসনে বহু বিদ্রোহ ও অশান্তি দমন করিয়া দেশে শান্তি ও রাজনৈতিক ঐক্য (সেই সঙ্গে ধন ও সুখ বৃদ্ধি) সাধিত হয়। আলী বা অন্য কাহাকে মুহম্মদ নিজ উত্তরাধিকারী বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া যান নাই; আহল্-ই-কিসা গল্পটা শিয়াদের রচিত জাল হদিস। হাজাজ অতি দক্ষ ও বিবেচক শাসনকর্তা ছিলেন; তিনিও যে তিন লক্ষ লোককে বধ করেন ও পঞ্চাশ হাজারকে জেলে রাখেন, এবং ওমাইয়া খলিফা যে হুসেনের ছিন্ন মুণ্ডে আঘাত করেন– এবং সেই দৃশ্য দেখিয়া মুহম্মদের বৃদ্ধ সহচরগণ কাঁদিয়া বলে “আহা, আমরা দেখিয়াছি যে হুসেনের বাল্য কালে ঐ মুখে নবী চুমা দিতেছেন”- এসব অসত্য শিয়া রচিত গল্প। আর, হুসেনের কারবালা অভিযান প্রকৃতপক্ষে ধৰ্ম্ম যুদ্ধ ছিল না, এক নিরর্থক Political demonstration মাত্র। দুষ্ট স্বার্থপর লোকের প্ররোচনায় সেই ভাল মানুষটি অকারণ প্রতারিত হইয়া মাথা ঘুলাইয়া যাওয়ায় একগুঁয়েমী করিয়া মারা গেলেন। “কুফার লোকেরা বড় প্রতারক” এই প্রাচীন আরবী উক্তি সত্য। আর হাসানকে খলিফা করিলে রাজ্য ভাঙ্গিয়া পড়িত– তাঁহার চরিত্রের দুর্ব্বলতার ফলে। বৈজ্ঞানিক ইতিহাস এইসব সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়াছে।
তৃতীয়– ইজিপ্টের ফতেমা বংশীয় শেষ খলিফা, আব্বাস-বংশ হইতে ন্যায্য অধিকার প্রাপ্ত খলিফা-পদ যে কনস্টান্টিনোপলের তুর্ক সুলতানকে আইন সঙ্গত প্রথায় দান করিয়া যান, যাহার ফলে ওই তুর্কবংশ সমগ্র মুসলমান প্রতিনিধি (অর্থাৎ খলিফা) পদ দাবী করিতে ছিলেন, তাহা অসত্য এবং একটি অতি নবীন ঐতিহাসিক জাল কারসাজী। আমি আমার আওরংজীব নামক ইতিহাসে এবং Mughal Administration গ্রন্থে ইহা প্রমাণ করিয়াছি। এই অসত্যের উৎপত্তি এইরূপে ঘটে–
The theory of the solemn transfer of the Caliphate by al-Mutawakkil, the last Egyptian Abbasid to the Othman Sultan Selim, is devoid of any foundation (একথা Barthold ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ করেন।) It owes its dissemination to a Stambul Armenian in Swedish service, M. d’Ohsson who published it in his Tableau general de I’ Empire Othoman (Paris, 1788-1824)
বিষ্ণুপাদের অনুকরণে পাথরে খুদা কদমরসূল অর্থাৎ মুহম্মদের পদযুগলের চিহ্নের মত এই খিলাফৎও অর্থলাভের উদ্দেশে জাল দলিল।
[ইতিহাস, ৫ম খণ্ড, ২য় সংখ্যা, অগ্রহায়ণ-মাঘ, ১৩৬১।]