আমরা যে-যুগে জন্মেছি সে যুগকে বলা উচিত রবীন্দ্র-যুগ। রবীন্দ্রনাথ আমাদের কী না দিয়েছেন। মুখে ভাষা দিয়েছেন, কণ্ঠে গান দিয়েছেন, প্রাণে দিয়েছেন আনন্দ, আর দিয়েছেন পৃথিবীর সৌন্দর্যকে মন ভরে দেখার দৃষ্টি। একশ বছর আগে এই বাংলা দেশের আকাশে যার আবির্ভাব ঘটেছিল একশ বছর পার হয়ে এসে তার আলো আজ সারা পৃথিবীর আকাশকে উদ্ভাসিত করে দিয়েছে। আজ তাই পৃথিবীর সব দেশের মানুষ এক প্রাণ এক মন হয়ে রবীন্দ্রনাথের শতবার্ষিক জন্মোৎসব পালনের আয়োজন করেছে।
এ-উৎসব ভারতবর্ষে ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব ঘটেছিল ১৮৬১ সালে। ১৯৬১ সালের শুরুতেই বোম্বাই শহরবাসী খুব ঘটা করে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকীর শুভ উদ্বোধন করলেন, সেই থেকে সারা বৎসরব্যাপী সারা দেশ জুড়ে উৎসব চলছে।
কলকাতা শহর একদিক দিয়ে ভাগ্যবান। এই শহরের মাটিতে তিনি জন্মেছিলেন, এই শহরের মাটিতেই তাঁর দেহাবসান ঘটেছে। সুতরাং ঘটা করে শতবার্ষিকী উৎসব পালনের অধিকার কলকাতা শহরের নিশ্চয় আছে। তাই রবীন্দ্রনাথের নামে বড় বড় ইমারত তৈরী হচ্ছে। রবীন্দ্র নাট্যশালা, রবীন্দ্র ভারতী, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্র স্টেডিয়াম, রবীন্দ্র সরোবর ইত্যাদি কত কিছু। শুনছি রবীন্দ্রনাথের নামে শান বাঁধানো রাস্তা হবে, তার মোড়ে থাকবে রবীন্দ্রনাথের বিরাট মর্মর মূতি। অর্থাৎ ইট পাথর দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে আমরা বন্দী করতে চাই। শহুরে সভ্যতার এইটাই সবচেয়ে বড় অভিশাপ। এই অভিশাপ থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন বলেই শহর থেকে শত মাইল দূরে শান্তিনিকেতনের নির্জন প্রান্তরে তিনি তাঁর শান্তির নীড় রচনা করেছিলেন। শহরে শতবার্ষিকী উৎসবের যে পরিচয় ইতিমধ্যেই পাওয়া গিয়েছে তাতে দেখতে পাচ্ছি উৎসবপতি রবীন্দ্রনাথ পড়ে থাকেন নেপথ্যে। তাঁকে উপলক্ষ করে চলে নাচ-গান-নাটকের হুল্লোড়বাজি। কলকাতা শহরে পাড়ায়-পাড়ায় অলি-গলিতে কম্পিটিশন দিয়ে সরস্বতী পুজো হয়। লাউড স্পীকারে ঘুম তাড়ানো মাসিপিসির আধুনিক গান আর বিসর্জনের দিন রাস্তায় রীতে সরস্বতী মাঈ কী জয় ধ্বনির সঙ্গে রকবাজদের রক-এন-বোল নাচের মাতামাতি দেখে বড়োদের নিনে করে বলতে শুনেছি-আজকালকার ছোঁড়াগুলো গোল্লায় গেছে। বইয়ের সঙ্গে সারা বছর সম্পর্ক নেই, শুধু পূজোর নামে চাঁদা আদায় আর হই-হল্লা। কিন্তু সরস্বতীর বরপুত্র রবীন্দ্রনাথের জন্মোৎসব নিয়ে বড়রা প্রতি বৎসর কলকাতা শহরে পাড়ায় পাড়ায় যে কাণ্ডটা করেন তার নিন্দা করে কে। সেখানেও সেই চাদা আর হই-হল্লা। ছোটরা তো বড়দের দেখেই শেখে।
শহরে উৎসবের নামে যে ভিড়, কোলাহল আর উচ্ছলতা দেখা দেয় তাতে শ্রদ্ধার চেয়ে উন্মত্ততাই থাকে বেশী। উৎসব সুন্দর না হয়ে বিকৃত হয়ে পড়ে। শহুরে উৎসবে এই রুচির বিকার রবীন্দ্রনাথের মনকে পীড়া দিত, তিনি এড়িয়ে চলতেন। একটি ছোট্ট ঘটনা বলি।
রবীন্দ্রনাথের সত্তর বছরের জয়ন্তী উপলক্ষে স্থির হয়েছে কলকাতায় খুব ঘটা করে নাগরিক সম্বর্ধনা দেওয়া হবে। প্রস্তাবটা যখন তাকে দেওয়া হল তিনি কিছুতেই সম্মতি দিতে রাজী হলেন না। নাগরিক সম্বধনকে তাই ঠাট্টা করে বলতেন সংবর্ধনা। অর্থাৎ ওখানে গিয়ে সং সাজতে ওঁর আপত্তি। অবশেষে রবির কাছে আবেদন নিয়ে দুই চন্দ্রের উদয় হল। জগদীশচন্দ্র ও শরৎচন্দ্র। প্রথম জন রবীন্দ্রনাথের অভিন্নহৃদয় বন্ধু, দ্বিতীয়জন সমধর্মী অনুজসাহিত্যিক। এদের অনুরোধ এড়াতে পারলেন না, মত দিতেই হল। মত দেবার পর থেকেই দুশ্চিন্তার শেষ নেই। সত্তর বৎসরের জয়ন্তী উৎসবের উদ্যোগ আয়োজনের খবর যত আসছে ততই তিনি শঙ্কিত হয়ে পড়ছেন।
সেই সময় কবি নিশিকান্তর প্রায়ই ডাক পড়ত। নিশিকান্তকে রবীন্দ্রনাথ স্নেহ করতেন, ভালবাসতেন। নিশিকান্তর দুটি পরিচয়। কাব্যরসিক ও ভোজন-রসিক। দুটির প্রতিই তার সমান আগ্রহ, পাল্লায় এদিক ওদিক হবার জো নেই। নিশিকান্তকে ডেকে এনে দুটি রসেরই যোগান দিতেন রবীন্দ্রনাথ, নিশিকান্ত ধ্যানস্থ হয়ে দুটি রসই সমান উপভোগ করত।
কবিগুরুর সত্তর বছরের জয়ন্তীর সময় নিশিকান্ত শান্তিনিকেতনে ছিল, তখনও পণ্ডিচেরী যায় নি। জয়ন্তীর মাসখানেক আগে—তখনও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন শান্তিনিকেতনে। সেই সময়ে রোজ সকালে নিশিকান্তকে যেতে হত তার কাছে। না গেলে, একান্ত ভৃত্য বনমালীকে দিয়ে পাকড়াও করাতেন, কখনও বা একান্ত সচিব অমিয় চক্রবর্তীকে পাঠিয়ে দিতেন নিশিকান্তর ঘরে, তাকে উত্তরায়ণে হাজিরা দেবার জন্যে। হাজিরা দিতে হত।
একদিন সকালে নিশিকান্তর ঘরে বসে আড্ডা দিচ্ছি, এমন সময় উত্তরায়ণের সাইকেল-বেয়ারা চতুর এসে নিশিকান্তকে বললে—শিগগির চলুন, বাবুমশাই আপনাকে ডাকছেন।
রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে তলব এসেছে। আমার দিকে তাকিয়ে নিশিকান্ত বললে—তুই-ও চ, আজকাল গেলেই গুরুদেব সন্দেশ খাওয়ান, বড় বড় সাইজের।
এসব ব্যাপারে আমি তো এক পা তুলেই আছি। দুজনে গুটিগুটি উত্তরায়ণে গিয়ে হাজির।
নিশিকান্তকে দেখা মাত্রই উৎফুল্ল হয়ে বললেন–এই যে কান্তকবি, তোরই প্রতীক্ষায় বসে আছি। এই দ্যাখ, কত কবিতা এসেছে।
জয়ন্তী উপলক্ষে আসা বহু বাঙালী কবির কবিতা রবীন্দ্রনাথ একে-একে নিজেই পড়ে শোনাতে লাগলেন। ওদিকে বনমালী ততক্ষণে এক প্লেট মেঠাঁই সামনে ধরে দিয়েছে, কবিতা শুনতে শুনতেই তার সদ্ব্যবহার চলছে।
কবিতা পড়া শেষ হলে পর একটি চিঠি আমাদের পড়ে শোনালেন, কলকাতাবাসী একজন রবীন্দ্র-ভক্ত তাকে চিঠিতে দীর্ঘ ফিরিস্তি দিয়ে জানিয়েছেন যে, কলকাতায় জয়ন্তীর আয়োজন কী ঘটা করেই না হচ্ছে। টাউন হলে বিরাট মিটিং-এর আয়োজন, কলকাতায় শতাধিক বিখ্যাত ব্যক্তির স্বাক্ষর করা মানপত্র, কোন কোন্ প্রতিষ্ঠান মাল্যদান করবে ইত্যাদি এক বিরাট তালিকা।
চিঠিটা পড়া শেষ করেই রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন—আমার জয়ন্তী এই শান্তিনিকেতনে মানাত ভালো। আমি যে নিসর্গ প্রকৃতির শোভা ভালবাসি, স্বভাবসুন্দরীই যে আমার মানসসুন্দরী, তা কে না জানে? একটি ছোট মেয়ে আমাকে মালা-চন্দন দেবে, তোরা সকলে পুষ্পার্ঘ্য দিবি, শাস্ত্রীমশাই আর ক্ষিতিবাবু মন্ত্রপাঠ করবেন, গানের দল গান করবে। কেউ হয়তো একটা কবিতা আবৃত্তি করল। শঙ্খ বাজল, ঘৃত-প্রদীপও আছে। ধূপের গন্ধের সঙ্গে ফুলের গন্ধে মিশে রইল আমার জন্মদিন।
বলতে বলতে স্তব্ধ হয়ে গেলেন কবিগুরু। কিছুক্ষণ পরে আবার বললেন–ঐ পারুলডাঙার মাঠের পূর্বাকাশে-ঐ দিগন্তে যেমন করে দেখতে পাই আমার জীবনের প্রতীক প্রভাত সুর্য, তা কি কলকাতা শহরের সৌধে বসে দেখতে পাবো? রাজ অট্টালিকার চেয়ে আমার সীমের লতার বেড়ায় ঘেরা শ্যামলী কুটীরই ভালো। মহানগরীকে আমি পাষাণগড়া পাষাণকারা বলেছি আর এখন সেই মহানগরীতেই আমার জন্মজয়ন্তী করার জন্য বিপুল অয়োজন চলছে।
আপনমনে কথাগুলি বলে গেলেন রবীন্দ্রনাথ। এ-আক্ষেপ আমাদের বলছিলেন তা নয়। তিনি যেন নিজের মধ্যে নিজেকেই বলছিলেন, খুব তন্ময় হয়েই বলেছিলেন।
এই ঘটনার উল্লেখ করার একটা কারণ আছে। কলকাতা শহরে পল্লীতে পল্লীতে পাল্লা দিয়ে যখন রবীন্দ্র জন্মোৎসবের নামে নাচ-গান-হল্লার হিড়িক চলে সেই সময় আমার স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে শান্তিনিকেতনের শান্ত পরিবেশে রবীন্দ্র-জন্মোৎসব পালনের একটি সুন্দর দিন। তারই ছবি আজ এখানে তুলে ধরছি।
শান্তিনিকেতনের ছেলেমেয়েদের খুব মন খারাপ। সত্তর বছরের জন্মোৎসব হবে কলকাতায়। রাজধানীর জনারণ্যে তাদের স্থান কোথায়? ছেলেমেয়েদের মুখে নীরব প্রতিবাদের ছায়া, চৈত্রের আম্রকুঞ্জে আর শাল বীথিকায় মৌমাছির গুঞ্জন শোনা যায় না। তাদেরও বুঝি অভিমান হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বুঝলেন এদের বঞ্চিত করে জয়ন্তী উৎসবের আনন্দই অর্থহীন। ছেলেমেয়েদের ডেকে বললেন–যে-মাসে আমি জন্মেছি সেই মাসের প্রথম দিনের সূর্যোদয়কে তো তোরা নববর্ষের উৎসবে আহ্বান জানাস, এবার তার সঙ্গে আমার জন্মোৎসবটাও জুড়ে দে।
আজ নববর্ষ, আজ রবীন্দ্রনাথের জন্মতিথি উৎসব। রাত্রির অন্ধকার তখনও দূর হয় নি। পূর্ণচন্দ্রের ম্লান আলো ঘুমন্ত আশ্রমের উপর স্বপ্নজাল রচনা করছে। ঘুমভাঙ্গা দু-একটি প্রভাত-পাখির ক্লান্ত কাকলীতে আম্রকুঞ্জ মুখরিত। এমন সময় বালক বালিকাদের সমবেত কণ্ঠের বৈতালিক গান আশ্রমের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে প্রতিধ্বনিত হয়ে নীল আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে। বৈতালিকদল আশ্রমের চতুর্দিক প্রদক্ষিণ করে গান গাইলে—
জয় হোক্ জয় হোক্ নব অরুণোদয়।
পূর্বদিগঞ্চল হোল্ক জ্যোতির্ময়।
* * *
এস নব জাগ্রত প্রাণ,
চির যৌবন জয়গান।
এস মৃত্যুঞ্জয় আশা,
জড়ত্বনাশা,
ক্রন্দন দূর হো বন্ধন হোক্ ক্ষয়॥
নিদ্রামগ্ন আশ্রমবাসীকে জাগিয়ে দিয়ে বৈতালিক গান থেমে গেল। অন্ধকার দূর হয়েছে, প্রভাতরুণের কিরণসম্পাতে শাল বীথিকার নবীন কিশলয় হিল্লোলিত, বিহঙ্গম গীতছনে আমলকী কানন মুখরিত। আমের ছাত্রছাত্রী ও শিশুদের মধ্যে আনন্দের সাড়া পড়ে গিয়েছে, আজ নববর্ষ, আজ গুরুদেবের জন্মোৎসব।
মন্দিরে ঘণ্টা বাজল ঢং ঢং ঢং। আশ্রমের অধিবাসীরা দলে দলে আসছে, গায়ে তাদের বাসন্তী রঙের চাদর, মেয়েদের পরনে বাসন্তী রঙের শাড়ি। আশ্রম বালকরা সার বেঁধে নিঃশব্দে নম্রপদক্ষেপে মন্দিরে প্রবেশ করল, প্রবেশদ্বারে একটি বালিকা ফুল দিয়ে চন্দনের ফোঁটা লাগিয়ে দিল সবার কপালে। মন্দিরের ভিতর জনসমাগমে পূর্ণ, রবীন্দ্রনাথের অগিমন প্রতীক্ষায় সবাই উদগ্রীব।
সহসা ঘণ্টাধ্বনি স্তব্ধ। অদূরে শুভ্রবন্ত্রে আচ্ছাদিত রবীন্দ্রনাথের ঋষিসদৃশ সৌম্য শান্তমূর্তি দেখা দিল। বার্ধক্যের ভারে শরীর অনেকখানি ভেঙ্গে পড়েছে, তবু অনেকখানি পথ হেঁটে এসে তিনি মন্দিরে প্রবেশ করলেন, আশ্রমবাসী নীরবে উঠে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানাল। চন্দন রেখাঙ্কিত প্রশস্ত ললাট, কণ্ঠে শ্বেতপুষ্পের মালা। উপাসনার বেদীতে উপবেশন করলে কয়েকজন বালকবালিকা মিলিত কণ্ঠে গান ধরলেন—
তব অমল পরশ-রস শীতল শান্ত
পুণ্যকর অন্তরে দাও।
তব উজ্জ্বল জ্যোতি বিকাশি হৃদয়
মাঝে মম চাও।
সূর্যের রক্তিম আলোয় ধীরে পূব আকাশ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে, দিনের প্রথম রশ্মি নববর্ষের আশীর্বাদ বহন করে কবিগুরুর শুভ্রললাট স্পর্শ করল। গান শেষ হলে উৎসবের সার্থকতা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বললেন–
মানুষের পক্ষে উৎসবের বিশেষ উপযোগিতা আছে। প্রতিদিনের কাজের সঙ্কীর্ণতার মধ্যে মানুষ যখন নিজেকে হারিয়ে ফেলে, তখন এই ধরনের উৎসবানুষ্ঠান তাকে জীবনের প্রকৃত সত্তা স্মরণ করিয়ে দেয়।
রবীন্দ্রনাথ উদাত্ত কণ্ঠে উপাসনার শেষ মন্ত্র উচ্চারণ করে থামলেন, গানের দল গেয়ে উঠল।
সবাই যারে সব দিতেছে
তার কাছে সব দিয়ে ফেলি।
কবার আগে চাবার আগে
আপনি আমায় দেব মেলি।
বাউল সুরের গানটির মধ্যে আত্মনিবেদনের যে-মন্ত্র মূর্ত হয়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথ নিমীলিত নয়নে তা উপলব্ধি করেছিলেন।
উপাসনার শেষে সাদর সম্ভাষণ ও কোলাকুলির সাড়া পড়ে গেল। ছাত্ররা অধ্যাপক ও গুরুজনদের ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করছে, গুরুজন সহাস্যমুখে ছাত্রদের আশীর্বাদ জানাচ্ছেন। সহকর্মীরা পরস্পরকে অভিবাদন জানিয়ে আলিঙ্গন করছেন।
আশ্রমবাসী ও অতিথি অভ্যাগত বহু নরনারী একে একে আম্রকুঞ্জে এসে সমবেত হল।
আম্রকুঞ্জের খানিকটা উম্মুক্ত প্রাঙ্গণ গেরুয়া মাটি দিয়ে লেপন করা, তাতে সুনিপুণ হাতের আলপনা আঁকা। অগুরু ধূপের স্নিগ্ধ গন্ধে প্রভাত সমীরণ আমোদিত। সুসজ্জিত বেদীতলে রবীন্দ্রনাথ এসে উপবেশন করলেন। আশ্রমের সংস্কৃত পণ্ডিতরা স্বস্তিমন্ত্র পাঠ করার পর শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনের জনকয়েক বালকবালিকা নিজেদের হাতের তৈরী নানা শিল্পদ্রব্য ও চিত্র অর্ঘ্য সাজিয়ে তাদের প্রিয় গুরুদেবকে উপহার দিল। চীন, তিব্বত ও সিংহল থেকে সাধুরা এসেছেন শান্তিনিকেতনে। একে একে তারা নিজেদের ভাষায় মন্ত্র উচ্চারণ করে কবিগুরুর শতায়ু কামনা করলেন।
ভারতের বাইরে থেকে এসেছেন এই সব সন্ন্যাসী, তাঁদের শ্রদ্ধা প্রদর্শনে অভিভূত হয়ে রবীন্দ্রনাথ বললেন :
এমন একদিন ছিল, যখন বহু বাধা অতিক্রম করেও প্রেমের বাণী ভারত থেকে বিশ্বের মানবের কাছে ছড়িয়ে পড়েছিল। আজ আবার আপনাদের দেশের অধিবাসীবৃন্দ আমার মধ্য দিয়ে আমাদের দেশবাসীর কাছে প্রেমের বাণী ও প্রীতি-উপহার বহন করে এনেছেন—এজন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ।
জমোৎসব অনুষ্ঠান শেষ হলে আশ্রমের অধিবাসীবৃন্দ সম্মিলিতকণ্ঠে গেয়ে উঠলেন–
আমাদের শান্তিনিকেতন,
সে-যে সব হতে আপন।
সুমধুর কণ্ঠের এই গানের মধ্য দিয়ে আশ্রমবাসীদের প্রাণের আবেগ ও ভক্তি ফুটে উঠেছিল। এই আশ্রম তাদের একান্ত আপনার, এখানকার শ্যামল প্রান্তর, উম্মুক্ত নীলাকাশ, আম্রকুঞ্জে আলোছায়ার খেলা, বসন্তের পুষ্পমঞ্জরী এদের মনকে আকর্ষণ করে। যিনি এই আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা, এই বিদ্যালয়ের প্রাণস্বরূপ তাদের সেই গুরুদেবকে আশ্রমবাসীরা শুধু শ্রদ্ধা ও ভক্তি দিয়ে দূরে সরিয়ে রাখে নি, প্রীতি ও ভালবাসার বন্ধনে একান্ত আপনার জন বলে মনে করে। সকলের মধ্যে থেকে সবার অন্তরে তিনি আশা, উৎসাহ ও আনরসের যোগান দিয়ে থাকেন। ইনিই সেই শারদোৎসবের ঠাকুরদা, যাকে না হলে ছেলেদের খেলা জমে ওঠে না।
শাল বীথিকার মাথার উপর সন্ধ্যার চাঁদ উঠেছে। পূর্ণিমার চাঁদ, তার স্নিগ্ধ কোমল রশ্মি নব-অঙ্কুরিত কচি পাতায় নৃত্য করে ফিরছে। আশ্রমের মাঝখানে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে আলিম্পন অঙ্কিত একটি স্থান, নৃত্যের আসর। পাশেই গায়ক-গায়িকাদল বাদ্যযন্ত্র নিয়ে উপস্থিত, দর্শকদল নাটমঞ্চের চারদিকে গোল হয়ে বসে গিয়েছে। এমন সময় রবীন্দ্রনাথ আসরের একধারে আপন স্থানে উপবেশন করতেই একটি আশ্রম-কন্যা অপূর্ব সুধাকণ্ঠে গেয়ে উঠল।
যা পেয়েছি প্রথম দিনে
সেই যেন পাই শেষে,
দুহাত দিয়ে বিশ্বেরে ছুঁই
শিশুর মত হেসে।।
মাথার উপর সীমাহীন আকাশ, চন্দ্রালোকে চারিদিক প্লাবিত। গানের সুর দক্ষিণের মাতাল সমীরণের সঙ্গে ভেসে বেড়াচ্ছে।
গানের পর শুরু হল নৃত্যের পালা। তিনটি ছোট্ট মেয়ে খোলের তালের সঙ্গে আলপনা-আঁকা প্রাঙ্গণে আপন মনে নাচতে লাগল যেন চাঁদের দেশের তিনটি পরী মর্তের মাটিতে নৃত্যরতা।
এরপর রবীন্দ্রনাথ তার বহু পুরাতন রচনা সতী কবিতা আবৃত্তি করলেন। আবৃত্তি শেষ হলে আরম্ভ হল বড়দের নাচ। নৃত্যের আখ্যানবস্তু দুষ্মন্ত ও শকুন্তলা। গভীর অরণ্যে রাজা দুষ্মন্ত শিকার করে ফিরছেন, এমন সময় দেখলেন সখী পরিবৃতা শকুন্তলা আলবালে জলসেচন করছেন, পুষ্প চয়ন করে মালা গাঁথছেন, আশ্রম হরিণ-হরিণীকে আদর করছেন। সেতারের ঝঙ্কারের সঙ্গে নৃপুরনিকণে, সাবলীল দেহভঙ্গিমায়, মৃদঙ্গের তালে তালে দুষ্মন্ত শকুন্তলার প্রথম পরিচয় ও প্রেমের পরিণতির আখ্যানবস্তু নৃত্যছন্দে রূপায়িত হয়ে উঠেছিল। একে একে নৃত্যরতা অনসূয়া ও প্রিয়ম্বদা শকুন্তলাকে নিয়ে বিদায় হল, দুষ্মন্তও চলে গেলেন। শূন্য আসরে তখনও সেতারে বসন্ত-বাহারের সুর ভেসে আসছে।
শান্তিনিকেতনের স্নিগ্ধ শান্ত পরিবেশে একটি জন্মোৎসবের ছবি, যা আমার স্মৃতিপটে আজও অম্লান রয়েছে, আপনাদের কাছে তুলে ধরলাম।
কোন-কোন ব্যক্তি সখেদে বলেছেন, এ-যুগে এই পৃথিবীতে জন্মে পদাঘাতই শুধু তারা পেয়েছেন। আমি তাদের করুণা করি। আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করে এই পৃথিবীতে জন্মে তুমি কি পেলে? আমার উত্তররবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ আর রবীন্দ্রনাথ।
আমি রবীন্দ্র-যুগে জন্মেছি, রবীন্দ্রনাথকে দেখেছি, রবীন্দ্রনাথকে কাছে পেয়েছি। আমার এই লেখার পাঠকদের মধ্যে যারা এই সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত তারা হয়তো আমাকে ঈর্ষা করবেন, কিন্তু তার কোন হেতু নেই। সৃষ্টিকর্তা আপন সৃষ্টির মধ্যেই প্রকাশ। তার সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যেই তাকে খুঁজে পাওয়া যায়।
তবু হয়তো অনুশোচনা নিয়ে প্রশ্ন করবেন আপনার মত চাক্ষুষ দেখার সৌভাগ্য তো আমাদের হল না।
নাই বা হল। পঁচিশে বৈশাখ একটি পবিত্র দিন। মহানগরীর কলুষতার মধ্যে সেদিনটি না কাটিয়ে চলে যান শান্তিনিকেতনে। পূর্বপল্লীর প্রান্তে পারুলডাঙার মাঠে প্রভাত-সূর্যের প্রথম প্রকাশকে ধ্যানসমাহিত চিত্তে দেখুন, আদিত্যবর্ণ এক মহান পুরুষকে দেখতে পাবেন। তিনিই রবীন্দ্রনাথ।