রও-মেঁ হৈ রখশ্-এ উমর, কহাঁ দেখিয়ে থমে,
ন হাথ বাগ পর হৈ, নহ্ পা হৈ রকাব-মেঁ
(জীবনের ঘোড়া ছুটে চলেছে, দ্যাখো কোথায় থামে;
হাতে আছে লাগাম, না পা আছে রেকাবে।)।
আপনি চললেন কলকাতা, মির্জাসাব, আর আমাকে ডাকল বোম্বাই। একেবারে নিষ্কর্মা হয়ে বসে আছি অমৃতসরে। বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের দেখাশোনার দায়িত্বও আমার ওপর বর্তাল। এদিকে রোজগারপাতি কিছু নেই। বিবিজানের জমানো টাকা ভেঙে চলতে লাগল; কিন্তু তাতে আর কতদিন চলবে? আমি কোন ধান্দায় না ঢুকতে পারলে তো একদিন মা-বেটা দুজনকেই না খেয়ে মরতে হবে। হঠাৎ নসিবে আলো এসে পড়ল। বোম্বাই থেকে নাজির লুধিয়ানভির ডাক এসে পৌঁছল। তাড়াতাড়ি বোম্বাই এসে আমার সাথে দেখা করো। বিবিজানকে বলতে সে তো কেঁদেকেটে একসা। -তুমি কী করে বোম্বাই যাবে বেটা? বোম্বাই তুমি চেনো? শুনেছি, কত বড় শহর। কে তোমার দেখভাল করবে?
হ্যাঁ, মাহিমে আমার দিদি ইকবাল বেগম ছিল বটে, কিন্তু তার বর আমাকে একদম দেখতে পারত না, কোনও দিন মাহিমে ওদের বাড়িতে ঢুকতে দেয় নি।
-বিবিজান, অমৃতসরে থেকে আমি করব বলো? এখানে কোনও কাজ আমার জুটবে না। বোম্বাইতে কিছু না কিছু হয়ে যাবে। আর নাজিরসাব যখন ডেকেছেন—
-বেটা তোমার দিদির কাছে শুনেছি, ওই শহরে কেউ কারো দিকে ফিরে পর্যন্ত তাকায় না।
-ভালই তো। একবার চেষ্টা করে দেখি, বিবিজান।
তখন আমার বয়স চব্বিশ। খোদার কাছে বিবিজানকে রেখে আমি বোম্বাইয়ের ডাকেই সাড়া দিলাম। ভাইজানেরা, বোম্বাই না দেখলে আমি জানতেই পারতাম না, এই দুনিয়াতে মানুষ কতরকম ভাবে বেঁচে থাকে। বোম্বাইয়ের ওপর-মহল আর নীচের মহলের মতো তফাত আর কোনও শহরে নেই। ওপর মহলে টাকা উড়ছে, কত রোশনাই, গ্ল্যামার; আর নীচের মহলে তত খিদে, অন্ধকার, খুনখারাবি। কিন্তু এই দুই মহলের মধ্যে গোপন যোগাযোগও আছে। সেসব বড় আশ্চর্য কিস্সা।
নাজির লুধিয়ানভি আমাকে কাজে জুতে দিলেন। তাঁর সাপ্তাহিক মুসাওয়ার পত্রিকার সম্পাদক হয়ে গেলাম আমি। মাইনে মাসে চল্লিশ টাকা। আমাকে আর পায় কে। এ তো শালা হাতে চাঁদ পাওয়া। অফিসেই একটা ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে নিলাম। কিন্তু বেশীদিন পোষাল না। অফিসের ঘরে থাকি বলে নাজিরসাব যখন তখন এসে বিরক্ত করতেন। লোকটাকে বোঝাই কী করে, আমি তো শুধু কাগজে চাকরি করার জন্য জন্মাইনি। আমার পড়া আছে, লেখা আছে, সবচেয়ে বড় কথা একা একা থাকতে ইচ্ছে করে আমার। তাই ঠিক করে ফেললাম, একটা বাসা ভাড়া নিতেই হবে।
রোজগার করি মাসে চল্লিশ টাকা। বোম্বাইতে তো এই টাকায় ভদ্র থাকার জায়গা পাওয়া যায় না। মাসে নটাকা ভাড়ায় একটা খোলিতে গিয়ে উঠলাম। খোলিই বটে। না দেখলে বুঝতে পারবেন না, ভাইজানেরা, সে কি মানুষের থাকার জায়গা, না ইঁদুরের গর্ত। একটা লড়ে দোতলা বাড়িতে চল্লিশটা খুপরি, সূর্যের আলো ঢোকে না, সবসময় স্যাঁতস্যাঁতে, দিনের বেলাতেও ঘরে আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয়। মশা,ছাড়পোকা,ইঁদুর কী নেই সেখানে। মির্জাসাব, বোম্বাইয়ের ওই খোলিতেই আমি প্রথম দোজখ দেখেছি। খোলিতে আপনি মরে পড়ে থাকলেও কেউ খোঁজ নিতে যাবে না। চল্লিশটা খোলিতে কত যে মেয়ে-মরদ-বালবাচ্চা ছিল কে জানে। আর সবার হাগা-মোতা-চানের জন্য দরজা ভাঙা দুটো বাথরুম। সবাই জাগবার আগে আমি ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে বেরিয়ে পড়তাম। সারাদিন অফিসে কাটিয়ে অনেক রাতে ফিরতাম; সারা দিনের ক্লান্তি আর খোলির গরমে ভাজা ভাজা হতে হতে ঘুমিয়ে পড়তাম।
খোলির দিনগুলোর কথা বলতে হলে মহম্মদ কিস্সাটাও আপনাদের শোনাতে হবে। বোম্বাইয়ে যত আজিব মানুষ আমি দেখেছি, মহম্মদভাই সবার চেয়ে আলাদা। আমার খোলিটা ছিল আরব গলিতে। একটু বুঝিয়ে বলতে হবে। রেন্ডিপট্টির জন্য ফরাস রোড বিখ্যাত। ফরাস রোড থেকে একটু বাঁক নিলেই গিয়ে পৌঁছবেন সফেদ গলিতে। ওখানে অনেক কাফে আর রেস্তোরাঁ ছিল। পুরো জায়গা জুড়েই বেশ্যাদের কোঠি। ভারতবর্ষের সব জাত-ধর্মের বেশ্যা ওখানে পাবেন। সফেদ গলি ছাড়িয়ে ছিল একটা সিনেমা হল, প্লে হাউস, সারাদিন সিনেমা চলত।
একটা লোক সারাক্ষণ চেঁচিয়ে যেত, আইয়ে, আইয়ে, দো আনা মে ফার্স্ট ক্লাস শো। যাদের সিনেমা দেখার ইচ্ছে থাকত না, তেমন লোকেদেরও জোর করে হলে ঢুকিয়ে দিতে সে। আর এক মজার জিনিস ছিল। মালিশওয়ালা। যখন-তখন রাস্তায় বসে লোকজন মাথায় মালিশ করাচ্ছে। চোখ বুজে মালিশের আরাম নিতে নিতে কেউ কেউ গান গাইত। আমার বেশ মজাই লাগত। বাঁশের চিক লাগানো ছোট ছোট ঘরে বসে থাকত মেয়েগুলো। ওদের দাম? আট। আনা থেকে আট টাকা। আট টাকা থেকে আটশ টাকা। এই বাজারে এসে আপনি সব দেখেশুনে, পছন্দের মতো তাজা গোস্ত কিনে নিন।
আরব গলিতে জনা পঁচিশেক আরব থাকত; মুক্তো কেনাবেচাতেই নাকি ছিল ওদের ব্যবসা। আর যারা এই গলিতে থাকত, তার হয় পাঞ্জাবি, নয়তো রামপুরি। মহম্মদ ভাই থাকত আমাদের আরব গলিতেই। কেউ কারও খোঁজ না রাখুক, শুনেছি মহম্মদভাই নাকি মহল্লার সকলের খোঁজ রাখত। রামপুরের মানুষ, লাঠি খেলা, ছুরি চালানোয় একেবারে ওস্তাদ। এক সঙ্গে কুড়ি-পঁচিশটা লোককে কাবু করা তার কাছে জলভাত। তার ছুরি চালানোর হাত নিয়ে কত গল্প যে শুনেছি। এতই নিখুঁত ছিল তার হাত, যে মরছে, সে নাকি বুঝতেই পারত না। কিন্তু সবাই কসম খেয়ে একটা কথাই বলত, মেয়েছেলের দোষ মহম্মদের ভাইয়ের নেই। শুনেছি, গরিব, ভিখারি মেয়েদের সে সাহায্য করত। তার শার্গিদরা গিয়ে রোজ তাদের পয়সা। দিয়ে আসত। কী যে তার ধান্দা ছিল, তা আমি জানতাম না, শুনতাম, পোশাক-আশাকে বেশ ফিটফাট, খায়দায়ও ভাল, আর একটা ঝলমলে টাঙ্গায় চেপে দুতিনজন শার্গিদ নিয়ে সে মহল্লায় ঘুরে বেড়ায়। তার বেশীর ভাগ সময় কাটে ইরানি কাফেতে বসে। তো, এই মহম্মদ ভাইকে অনেকদিন ধরেই দেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আমি সকালে বেরিয়ে অনেক রাতে ফিরি, কিছুতেই তাঁকে দেখার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। তার সম্পর্কে একটা আশ্চর্য গল্প শুনেছিলাম আশিক হুসেনের কাছে। আমার পাশের খোলিতেই থাকত আশিক, সিনেমায় নাচ করত।
একদিন কথায় কথায় আশিক বলল, মহম্মদ ভাইয়ের তুলনা নেই, মান্টোসাব।
-কেন? তোমার জন্য সে কিছু করেছে নাকি?
-সেবার আমার কলেরা হয়েছিল, খবর পেয়ে মহম্মদ ভাই এসে হাজির। তারপর কী হল, জানো? ফরাস রোডের যত ডাক্তার, দেখি, সবাই আমার খোলিতে হাজির। মহম্মফ ভাই শুধু বলল, আশিকের যদি কিছু হয়, আমি তোমাদের দেখে নেব। ডাক্তাররা তো তার কথা শুনে থরথর করে কাঁপছে।
-তারপর?
-দুদিনেই ভাল হয়ে গেলাম। ফরিস্তা মান্টোসাব, ফরিস্তা ছাড়া আর কিছু নয় মহম্মদ ভাই।
আরও কত যে গল্প মহম্মদ ভাইকে নিয়ে। তার উরুর কাছে নাকি একটা ধারালো ছোরা বাঁধা থাকে। হাসতে হাসতে সে ওই ছোরা বার করে নানা খেলা দেখায়। এসব শুনতে শুনতে আমি তার চেহারাটা কল্পনা করতাম। লম্বা-পেশল শরীর, তাকালেই বুক হিম হয়ে যায়। তবু কিছুতেই নিজের চোখে মহম্মদ ভাইকে দেখা হয়ে উঠছিল না। মাঝে মাঝে ভাবতাম, একদিন। ছুটি নিয়ে লোকটাকে দেখতেই হবে। কিন্তু পত্রিকায় চাকরির যে কত হ্যাপা। সম্পাদক থেকে বেয়ারাগিরি-সবই প্রায় আমাকে করতে হত।
হঠাৎ একদিন ধুম জ্বর এল আমার, বিছানা থেকে ওঠার ক্ষমতা নেই। আশিকও গিয়েছে দেশের বাড়িতে। দুদিন একা একা খোলিতে পড়ে রইলাম। মাঝে মাঝে ইরানি হোটেলের ছেলেটা এসে খাবার দিয়ে যেত। বোম্বাইয়ে কে আমার খোঁজ নেবে? আমিই বা কজনকে চিনি? নাজিরসাবও জানতেন না, আমি কোথায় থাকি। মরে গেলে খবর পর্যন্ত পেত না। আর বোম্বাই এমন জায়গা, কে মরল আর কে বাঁচল, কেউ খোঁজ রাখে না।
তিনদিনের দিন ঠিক করলাম, যেভাবেই হোক উঠে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ল। ভাবলাম, হোটেলের ছোকরাটা বোধহয় এসেছে।- ভেতরে আয়।
দরজা খুলে দেখলাম, একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমেই চোখে পড়ল তার পেল্লায় গোঁফ, দুহাতে সে গোঁফ মোচড়াচ্ছে। আমার মনে হল, গোঁফটা না থাকলে লোকটার দিকে কেউ ফিরেও তাকাবে না, এতই সাধারণ সে। চার-পাঁচজন লোক নিয়ে সে ঘরে ঢুকে পড়ল। তারপর নরম গলায় ডাকল, ভিমটোসাব–
-ভিমটো নেহি, মান্টো।
-একই হ্যায় শালা। ভিমটোসাব, এ তো ভাল কথা নয়। তোমার বুখার হয়েছে, আমাকে জানাও নি কেন?
-আপনি কে?
সে তার সঙ্গীদের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বলল, মহম্মদ ভাই।
আমি ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলাম। -মহম্মদ ভাই, মহম্মদ ভাই-দাদা?
-হ্যাঁ, ভিমটোসাব, আমি মহম্মদ দাদা। হোটেলের ছোকরাটাই বলল, তোমার তবিয়ত খুব খারাপ। এ তো শালা ভালো কথা নয়। আমাকে খবর পাঠালে না কেন? এমন হলে মহম্মদ ভাই শালার মেজাজ ঠিক থাকে না। এবার সে তার এক শাগিদের দিকে তাকায়, এই-এই। তোর নাম কী শালা? যা, ওই শালা ডাক্তারের কাছে যা। বলবি, মহম্মদ ভাই বলেছে, ডবল কুইক যেন চলে আসে। আর শালাকে সব যন্তরপাতি নিয়ে আস্তে বলবি।
আমি মহম্মদ ভাইকে দেখতে দেখতে তার সম্পর্কে শোনা গল্পগুলো ভাবছিলাম। কিন্তু যে মহম্মদ ভাইকে আমি কল্পনা করেছিলাম, এ তো সে নয়। শুধু তার গোঁফটা দেখতে পাচ্ছিলাম, আর মনে হচ্ছিল, একটা নরম মনের মানুষ শুধু বিরাট গোঁফ তৈরি করে মহল্লার দাদা হয়ে গেছে। আমার ঘরে কোনও চেয়ার ছিল না। তাই বিছানাতেই বসতে বললাম তাকে। মাছি ওড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নাড়িয়ে মহম্মদ ভাই বলল, এসব ভাবতে হবে না, ভিমটোসাব।
দমচাপা খোলির মধ্যে পায়চারি করতে লাগল মহম্মদ ভাই। এক সময় দেখি, তার হাতে সেই বিখ্যাত ছোড়া ঝকঝকে করছে। মহম্মদ ভাই হাতের ওপর ছোরা ঘসছিল, আর লোমগুলো ঝরে পড়ছিল। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, আমার জ্বর কয়েক ডিগ্রি নেমে গেছে। আমি আমতা-আমতা করে বললাম, মহম্মদ ভাই, ছোরাটা তো ভয়ানক ধারালো। আপনার হাত কেটে যেতে পারে।
-ভিমটোসাব ছোরাটা আমার দুশমনের জন্য। আমার হাত কেন কাটবে? তারপর ছোরাটার গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে বলল, ছেলে কি বাবাকে মারতে পারে?
ডাক্তার এসে পৌঁছল। সে এক ভারী মজার ব্যাপার, মির্জাসাব, আমার নাম হয়ে গেছে ভিমটো আর ডাক্তারের নাম পিন্টো।
ডাক্তার পিন্টো মিনমিন করে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
-সেটা শালা আমি বলব? ভিমটোসাবকে ভাল না করতে পারলে, শালা, তোমাকে দাম চোকাতে হবে।
ডাক্তার পিন্টো আমাকে সবরকম ভাবে দেখে মহম্মদ ভাইকে বলল, ভয়ের কিছু নেই মহম্মদ ভাই। ম্যালেরিয়া। আমি একটা শট দিয়ে দিচ্ছি।
-ডাক্তার, এসবের আমি কিছু বুঝি না। শট দিতে চাইলে, শালা, শট দাও, কিন্তু খারাপ কিছু হলে–
-সব ঠিক হয়ে যাবে মহম্মদ ভাই। তা হলে শটটা দিয়ে দিই। বলে ডাক্তার পিন্টো ব্যাগ খুলে সিরিঞ্জ আর ইঞ্জেকশনের অ্যাম্পুল বের করল।
-দাঁড়াও ডাক্তার। মহম্মদ ভাই প্রায় আর্তনাদ করে উঠল। ডাক্তার ভয় পেয়ে ব্যাগে সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে ফেলল।
-এসব সুঁই দেওয়া-ফেওয়া, শালা আমি দেখতে পারি না। বলতে বলতে মহম্মদ ভাই তার স্যাঙাৎদের নিয়ে খোলি থেকে বেরিয়ে গেল।
ডাক্তার পিন্টো খুব সাবধানে কুইনাইন ইঞ্জেকশন দিল আমাকে। জিজ্ঞেস করলাম, কত দিতে হবে?
-দশ টাকা।
ব্যাগ বার করে ডাক্তার পিন্টোর হাতে টাকা দিতেই মহম্মদ ভাই এসে ঢুকল। -শালা, এসব কী হচ্ছে?
ডাক্তার পিন্টো কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, মহম্মদ ভাই খোদা কসম, আমি কিছু চাইনি।
-শালা, টাকা চাইলে আমার কাছে চাও। ভিমটোসাবকে এক্ষুনি টাকা ফেরত দাও। তারপর আমার দিকে ফিরে মহম্মদ ভাই বলতে থাকে, আমার এলাকার ডাক্তার তোমার কাছ থেকে। টাকা নেবে ভিমটোসাব? শালা, এ-কখনও হতে পারে? তাহলে আমার গোঁফই কেটে ফেলব। জেনে রাখো ভিমটোসাব, আমার মহল্লার সবাই তোমার চাকর।
ডাক্তার চলে যাওয়ার পর আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে আপনি চেনেন মহম্মদ ভাই?
-চিনি না? এখানে এমন কেউ আছে, যাকে শালা মহম্মদ ভাই চেনে না? শোনো ইয়ার, মহম্মদ ভাই মহল্লার রাজা, সবার খোঁজ খবর রাখে। কত লোকজন জানো, আমরা? তারা সবকিছু জানিয়ে দেয়। কে কখন আসছে, যাচ্ছে, কে কী করছে? তোমার সম্পর্কে সব জানি আমি।
-তাই?
-শালা, আমি ছাড়া কে জানবে? তুমি অমৃতসর থেকে এসেছ, তো? কাশ্মীরি, ঠিক কি না, শালা?
তুমি একটা কাগজে কাজ করো। বাজারের বিসমিল্লা হোটেল তোমার কাছ থেকে দশ টাকা পায়, তাই তুমি ওই রাস্তা দিয়ে যাও না। ঠিক বলেছি? ভিন্ডিবাজারের পানোয়ালাটা তোমাকে দিনরাত খিস্তি করে। সিগ্রেটের জন্য শালা তোমার কাছে কুড়ি টাকা দশ আনা পায়।
আমি হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, আর মনে হচ্ছিল, মাটির গভীরে তলিয়ে যাচ্ছি। এই লোকটার চোখ সব জায়গায়?
-ভিমটোসাব, কোই ডর নেহি। তোমার সব ধার আমি মিটিয়ে দিয়েছি। তুমি আবার সব নতুন করে শুরু করো। লজ্জা পাচ্ছো কেন, ভিমটোসাব? লম্বা জীবনে কত কী ঘটে। আমি সব শালাকে বলে দিয়েছি, তোমার পিছনে যেন না লাগে। মহম্মদ ভাইয়ের কথার, শালা, নড়চড় হয় না।
ভাইজানেরা, মহম্মদ ভাই শুনতে পেয়েছিলেন কি না জানি না, আমি বিড় বিড় করে বলেছিলাম, খোদা, আপনাকে খুশি রাখুন। মহম্মদ ভাই গোঁফ চুমড়োতে চুমড়োতে তার স্যাঙাতদের নিয়ে চলে গেল।
দুসপ্তাহের মাথায় আমি সুস্থ হয়ে উঠলাম। মহম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার ভাব জমে উঠল। অনেক সময়ই সে আমার কথা চুপচাপ শুনে যেত। ভাই আমার চেয়ে বছর পাঁচেকের বড় ছিল। শুধু তার গোঁফটা ছিল আমার বয়েসের চেয়ে অনেক বড়। পরে শুনেছিলাম, রোজ মাখন লাগিয়ে নাকি গোঁফের তরিবৎ করে মহম্মদ ভাই। আমি ভাবতাম, কে আসল মহম্মদ ভাই, তার গোঁফটা, না ধারালো ছোরাটা?
একদিন আরব গলির চিনা হোটেলের সামনে তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কথায় কথায় তাকে বললাম, মহম্মদ ভাই, এটা তো বন্দুক আর রিভলবারের যুগ। আপনি ছোরা নিয়ে ঘোরেন কেন?
গোঁফে হাত বোলাতে বোলাতে মহম্মদ ভাই বলে, ভিমটোসাব, বন্দুকের মতো বিরক্তিকর জিনিস আর নেই, শালা। একটা বাচ্চাও বন্দুক চালাতে পারবে। ট্রিগার টেপো, হয়ে গেল। কিন্তু ছোরা…খোদা কসম…ছোরা চালানোর মজাই আলাদা। তুমি একবার কী যেন বলেছিলে? হ্যাঁ, হ্যাঁ, আর্ট, শোনো ভিমটোসাব, ছোরা চালানোটা একটা আর্ট। আর রিভলবার কী? খিলৌনা। বলতে বলতে সে তার ঝকঝকে ছোরাটা বার করে।-দ্যাখো, একে দ্যাখো, শালা, কী ধার দ্যাখো। যখন চালাবে কোনও শব্দ হবে না। পেটে ঢুকিয়ে একটা মোচড়, সব শেষ। বন্দুক-ফন্দুক সব রাবিশ।
মহম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে যত মিশছিলাম, মনে হচ্ছিল, লোকটাকে সবাই এত ভয় পায় কেন? ইয়া বড় গোঁফটা ছাড়া তো ভাইয়ের মধ্যে ভয় পাওয়ার মতো কিছু নেই। ভয় আসলে বাইরে থাকে না, ভাইজানেরা, ভয় লুকিয়ে থাকে মানুষের মনের ভিতরের অন্ধকারে। একদিন অফিস যাওয়ার পথে চিনা হোটেলের সামনে শুনলাম, মহম্মদ ভাইকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। তা কী করে সম্ভব? পুলিশের সঙ্গে ভাইয়ের বেশ ভালই মাখামাখি ছিল। তা। হলে? ঘটনাটা এইরকম : শিরিনবাই নামে আরব গলিতে এক বেশ্যা থাকত। তার একটা ছোট মেয়ে ছিল। ভাইকে গ্রেফতারের আগের দিন শিরনবাই মহম্মদ ভাইয়ের পায়ে গিয়ে পড়েছিল। তার মেয়েকে না কি কে ধর্ষণ করেছে।
-ভাই, আপনি মহল্লার দাদা, আর আমার মেয়েকে সেখানে বেইজ্জত করে গেল। আপনি বদলা নেবেন না?
ভাই নাকি শিরিনবাইকে প্রথমে অনেক খিস্তি খাস্তা করেছিল, তারপর গম্ভীর হয়ে বলেছিল, কী চাও, মাদারচোদের পেটটা ফাঁসিয়ে দেব? যাও শালী। কোঠাও যাও, যা করার আমি করব।
আধঘন্টার মধ্যেই কাজ খতম। লোকটা খুন হয়ে গেল। তবু মহম্মদ ভাইকে পুলিশ কী করে ধরল? ভাই এসব কাজের কোন সাক্ষী রাখে না, কেউ দেখলেও ভাইয়ের বিরুদ্ধে কিছু বলতে আসবে না। দুদিন লক আপে থাকার পর বেল পেল মহম্মদ ভাই। কিন্তু লক আপ থেকে। বেরিয়ে আসা ভাই যেন অন্য মানুষ। চিনা হোটেলে যখন তার সঙ্গে দেখা হল, মনে হচ্ছিল, একটা ঝোড়ো কাক। আমি কিছু বলার আগেই সে বলল, ভিমটোসাব, শালা মরতে এত সময় নিল। সব আমার দোষ। ঠিকঠাক ছোরা ঢোকাতে পারিনি। কী আশ্চর্য, ভাবুন ভাইজানেরা, একটা মানুষকে মারার জন্য তার দুঃখ নেই, সে ভাবছে ছোরাটা ঠিকঠাক চালানো হয় নি।
কোর্টে হাজিরার দিন যতই এগিয়ে আসছিল, মহম্মদ ভাই ততই মুষড়ে পড়ছিল। তার সঙ্গে কথা বলে বুঝেছিলাম, কোর্ট সম্পর্কে কোন ধারনাই নেই, তাই এত ভয়। কোর্ট তো দূরের কথা, হাজতেই কখনও থাকতে হয় নি ভাইকে। একদিন সে আমার হাত চেপে ধরল, ভিমটোসাব, কোর্টে যাওয়ার চেয়ে আমি মরে যাব, শালা। কোর্ট-ফোর্ট তো আমি কখনও দেখিনি।
আরব গলির স্যাঙাতরা তাঁকে বোঝালো, ভয়ের কিছু নেই, কোনও সাক্ষী নেই, কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বলতে যাবে না। তবে হ্যাঁ, তার পেল্লায় গোঁফ দেখে ম্যাজিস্ট্রেটের অন্যরকম ধারনা হতে পারে। এমন যার গোঁফ, সে ক্রিমিনাল না হয়ে যায় না।
একদিন ইরানি হোটেলে বসে আছি। মহম্মদ ভাই ছোরাটা বার করে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে ফেলল। আমি বললাম, এ কী করছেন, মহম্মদ ভাই।
-ভিমটোসাব, সব কিছু আমার সঙ্গে বেইমানি করছে। সবাই বলে, ম্যাজিস্ট্রেট আমার গোঁফ দেখলেই নাকি, শালা, জেলখানায় ভরে দেবে। আমি কী করব, বলো?
অনেক কথার পর শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, আপনার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ তো কিছু নেই, তবে গোঁফ দেখলে ম্যাজিস্ট্রেটের মনে হতেই পারে…।
-তা বলে উড়িয়ে দেব? গোঁফে হাত বোলাতে বোলাতে মহম্মদ ভাই অসহায় চোখে আমার দিকে তাকায়।
-যদি মনে করেন।
-আমার মনে করায় কিছু আসে যায় না। শালা ম্যাজিস্ট্রেট কী ভাববে, সেটাই বড় কথা। তুমি কী বলে?
-তা হলে কেটেই ফেলুন।
পরদিন মহম্মদ ভাইকে দেখতে পেলাম, গোঁফহীন, আরো অসহায়।
কোর্টে মহম্মদ ভাইকে ভয়ঙ্কর গুণ্ডা বলে ঘোষণা করা হল। বলা হল, বোম্বাইয়ের বাইরে চলে। যেতে হবে তাকে। হাতে মাত্র একদিন সময়। আমরা সবাই কোর্টে গিয়েছিলাম। মহম্মদ ভাই রায় শুনে চুপচাপ বেরিয়ে এল। মাঝে মাঝেই তার হাত নাকের নীচে চলে যাচ্ছিল।
সন্ধেবেলা ইরানি হোটেলে জনাকুড়ি শাগির্দ নিয়ে চা খাচ্ছিল মহম্মদ ভাই। আমি তার মুখোমুখি গিয়ে বসলাম। দেখলাম, তার দৃষ্টি এই হোটেল, মহল্লা ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে গিয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, কী ভাবছেন?
মহম্মদ ভাই ফেটে পড়লেন। -শালা যে মহম্মদ ভাইকে তুমি জানতে, সে মরে গেছে।
-কেন এত ভাবছেন? আপনাকে তো বাঁচতে হবে। বোম্বাইতে না হলে অন্য কোথাও।
-শোনো ভিমটোসাব, বাঁচা-মরা নিয়ে আমি ভাবি না। তোমাদের কথা শুনে, শালা বুরবাক আমি, গোঁফ কেটে ফেললাম। অন্য কোথাও গেলে আমি তো গোঁফটা নিয়েই যেতে পারতাম। এর চেয়ে ওরা আমাকে ফাঁসী দিতে পারত।
মহম্মদ ভাইকে আর আমি দেখিনি। কতদিন ভেবেছি, গোঁফের জন্য কেন এত দরদ ছিল তার? গোঁফটাই কি আসলে মহম্মদ ভাই? আমি এখনও জানি না। দুএকদিন পর অমৃতসর থেকে বিবিজানের চিঠি পেলাম, বোম্বাইতে আসবে, আমার জন্য বড় মন কেমন করে তার। আমিও চিঠি লিখলাম, এসো, বিবিজান, বোম্বাইতে আমিও বড় একা, এত একা আমি কখনও থাকতে চাইনি।