আখেনাতেন
লাঞ্চ করার পরে আড্ডা মেরে অনেকটা টাইম কেটে গেল। আমাদের বিকেল পাঁচটা নাগাদ বেরোবার প্ল্যান ছিল। কিন্তু ভবেশদা বলল, ‘একটু ওয়েট করে যাও। একজন কালেক্টর আজকে একটা জিনিস দেখাবার জন্য নিয়ে আসছেন বললাম না, কে জানে হয়তো একটা দারুণ আর্টিফ্যাক্ট দেখতে পেয়ে যাবে।’
সাড়ে পাঁচটা নাগাদ একটা ফোন এল ভবেশদার কাছে।
‘হ্যাঁ, কত দূরে আছেন? আচ্ছা… না না, গাড়ি নিয়ে আমার বাড়ি অবদি আসতে যাবেন না। স্টেশনের কাছে বড়ো পার্কিং লট আছে। ওখানে গাড়ি রেখে একটা রিকশা নিয়ে আসুন। ঠিকানা তো আছেই আপনার কাছে।’
ফোনটা রেখে ভবেশদা বললেন,
‘মক্কেল এসে গেছে প্রায়।’
ভবেশদার বাড়িতে যে লোকটা ঢুকল তাকে দেখে কেন জানি না অনেকটা অমরেশ পুরীর মতো লাগল। ওই কাঁচাপাকা গোঁফ আর লম্বা জুলপির জন্যই মনে হয়। বয়স মনে হল পঞ্চাশের কাছাকাছি। বেশ লম্বা। পরনে একটা পোলোর টি-শার্ট আর কৰ্ডুরির প্যান্ট। চোখে-মুখে একটা আভিজাত্যের ছাপ আছে।
‘নমস্কার, আমিই শোভন জাটলা।’
‘আসুন, আমি ভবেশ সামন্ত।’
জাটলার চোখ এবারে আমাদের দিকে পড়েই কুঁচকে গেল। ভবেশদা সেটা খেয়াল করে বললেন,
‘ওরা আমার ভাইয়ের মতো, প্রদীপ্ত আর স্পন্দন।’
‘হুম, কিন্তু আমি ভেবেছিলাম আমাদের মিটিংটার প্রাইভেসি থাকবে। আসলে এটা ইতনা সেন্সিটিভ আর ট্রিকি ইসু যে কারোর ওপরে ভরোসা না করে আমি নিজেই এলাম…’
‘আপনি চিন্তা করবেন না মিস্টার জাটলা। ওরা আমার নিজেরই লোক বলতে পারেন। আপনার সিক্রেটটা এই বাড়ির বাইরে কখনো বেরোবে না।’
‘ওহ, ওকে।’
মুখে ওকে বললেও মনে হল না শোভনবাবুর খুব একটা পছন্দ হল না আমাদের উপস্থিতিটা। তবে কথা আর না বাড়িয়ে ড্রয়িং রুমের সোফাতে বসলেন।
‘কী খাবেন বলুন, চা না কফি?’
‘কুছ নেহি, একটু জল দিন, তাহলেই হবে।’
এক ঢোঁকে গ্লাসের অর্ধেক জল শেষ করে শোভন জাটলা সেটা সামনের টেবিলে রাখলেন। ভবেশদা এবারে বললেন,
‘আপনার সারনেমটা দেখে মনে হয় না আপনি বাঙালি বলে, অথচ দিব্যি ভালো বাংলা বলছেন কিন্তু।’
‘হা হা, আমাদের আদি বাড়ি রাজস্থানের সিয়ান জেলায়, বুঝলেন। কিন্তু দাদু চলে এসেছিলেন কলকাতায়। আমি তো নব নালন্দায় পড়েছি। তাই জাতে মাড়োয়ারি হলেও এখন আদ্যোপান্ত বাঙালিই বলতে পারেন। তবে কথার মাঝে একটু অবাঙালি টান মিলতেও পারে।’
‘বাহ! বেশ, বেশ। তা আপনার যেটা দেখাবার ছিল ওইটা…’
‘ও, হ্যাঁ।’
শোভন জাটলা এবারে ওর সঙ্গে আনা ব্রিফকেসটা খুললেন। ভেতর থেকে বার করে আনলেন একটা রেকট্যাঙ্গুলার চ্যাপটা মতো কিছু। বাবল র্যাপ দিয়ে মোড়ানো। এবারে ওটা ভবেশদার হাতে তুলে দিতে দিতে বললেন,
‘একটু সাবধানে হ্যান্ডল করবেন, খুব ফ্র্যাজাইল আছে কি না।’
‘গত কুড়ি বছর ধরে আমি এমন জিনিস নিয়েই ঘাঁটাঘাঁটি করছি, মিস্টার জাটলা। আপনার কোনো চিন্তা নেই।’
ভবেশদা উঠে গিয়ে অন্য ঘর থেকে একজোড়া গ্লাভস নিয়ে এলেন। সেটা হাতে পরে নিয়ে বাবল র্যাপটা খুললেন। এবারে দেখলাম তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল একটা কালচেমতো স্ল্যাব। দেখে মনে হচ্ছিল পোড়ামাটির তৈরি। তার ওপরে খুব ছোটো ছোটো অক্ষরে কিছু লেখা। আমরা দু-জনে ঝুঁকে পড়ে সেটা দেখলাম। কিন্তু মাথামুন্ডু কিচ্ছু বুঝতে পারলাম না।
ভবেশদা বেশ খানিকক্ষণ লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপরে জাটলার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,
‘এটা আমার্নার লেটার নয়, শোভনবাবু।’
‘মানে!’
‘এটা ফেক।’
‘কী বলছেন কী? আমি অলরেডি এটার জন্য ছ-লাখ অ্যাডভান্স করেছি!’
‘যাকে করেছেন তাকে বলুন টাকাটা ফেরত দিতে। আর বলুন খুব কাঁচা একটা কাজ করেছে সে। মিনিমাম একটা পড়াশোনা না থাকলে ফেক জিনিস প্রোডিউস করা যায় না।’
‘আপনি কী করে শিয়োর হচ্ছেন যে এটা আসলি নয়?’
‘এটাই তো আমার কাজ, এইজন্যই আপনি এসেছেন আমার কাছে, তাই নয় কি? এর গায়ে খোদাই করা লিপিগুলো দেখছেন?’
‘হ্যাঁ, দেখেছি তো।’
‘এটা লেখা আছে ডেমোটিক ভাষায়, যেটা মিশরের সাধারণ মানুষের ভাষা ছিল।’
‘হুম, তো?’
‘আসল আমার্নার চিঠিগুলো লেখা ছিল কিউনিফর্ম হরফে, আক্কাডিয়ান ভাষায়, যেটা এর থেকে অনেক অনেক আলাদা। যে এই কাজটা করেছে সে এটা জানত না যে এই চিঠির লেখক মিশরীয় নয়। একজন ব্যাবিলনিয়ান।’
শোভন জাটলা এবারে উত্তেজনার চোটে টেবিলে একটা ঘুসি মারলেন। জলের গ্লাসটা আরেকটু হলেই উলটে পড়ছিল।
‘মাই গড। ভাগ্যিস আপনার খোঁজ পেয়েছিলাম মিস্টার সামন্ত। খুব বাঁচালেন আমাকে এযাত্রায়!’
‘ইট’স ওকে, এইজন্যই তো আপনার আসা আমার কাছে।’
‘তা বটে, তা বটে। আচ্ছা আপনার কাছে কিছু…’
এই কথা যখন বলছেন জাটলা তখন ওর চোখ দেরাজের নীচের দিকের তাকটায়।
‘না মিস্টার জাটলা, আমি কোনো আর্টিফ্যাক্টের কেনাবেচা করি না। আর এইগুলো সব শোপিস। পিতলের তৈরি।’
‘ওহ, আচ্ছা।’
জাটলাকে দেখে মনে হল সামান্য মনঃক্ষুণ্ণ হলেন।
‘এনিওয়ে, আপনার ফিজটা…’
‘ক্যাশে দেওয়ার দরকার নেই। ব্যাঙ্ক ডিটেল দিয়ে দেব। ট্রান্সফার করে দেবেন।’
শোভন জাটলা চলে যাওয়ার পরে আমি ভবেশদাকে বললাম,
‘আপনার সত্যি এলেম আছে কিন্তু! কীরকম ঝট করে দেখে বলে দিলেন ওটা ফেক।’
‘তোমাদের মনে হচ্ছে ঝট করে বলে দিলাম ভাই। কিন্তু এটার জন্য আমাকে কত বছর পড়াশোনা করতে হয়েছে একবার ভাবো তো।’
‘তা ঠিক, কিন্তু ওই মাটির স্ল্যাবটা আসলে একটা চিঠি? বললেন ব্যাবিলন থেকে এসেছিল। কাকে লিখেছিল?’
‘যাকে লেখা হয়েছিল সে ছিল মিশরের এমন একজন ফারাও যাকে প্রায় ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা হয়েছিল। আবার সেই লোকটারই ফ্যান ছিল অ্যাডলফ হিটলার। সিগমুন্ড ফ্রয়েড ওকে নিয়েই একবার একটা উত্তপ্ত বাগ্বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। আবার ওকে নিয়ে কয়েক বছর আগে ইংল্যান্ডে অপেরাও হয়ে গেল।’
‘বাপ রে! সেলিব্রিটি লোক তো! কে সে?’
‘তুতানখামেনের বাবা।’
‘এইটিন্থ ডাইনেস্টির ফারাও তৃতীয় আমেনহোতেপের মৃত্যুর পরে মিশরের সিংহাসনে আসেন চতুর্থ আমেনহোতেপ। কিন্তু নিজের রাজত্বের পাঁচ বছরের মাথায় এমন একটা কিছু উনি করে বসলেন যাতে গোটা দেশটাই কেঁপে উঠল।
‘ততদিন অবধি দেশ জুড়ে ছিল অজস্র দেবদেবী। আইসিস, হোরাস, মাত, ওসাইরিস, আনুবিস…। আর তাদের সবার ওপরে ছিলেন আমুন। থেবসে আমুনের মন্দিরে স্বয়ং ফারাও পুজো দিতে যেতেন। কিন্তু চতুর্থ আমেনহোতেপ ঠিক করলেন যে এতগুলো দেবদেবীর আর দরকার নেই। একজনকে পুজো করলেই হবে।’
‘একেশ্বরবাদ?’
‘একদম ঠিক ধরেছ, স্পন্দন ভাই। একেশ্বরবাদই বটে। যেমন মুসলিম বা খ্রিস্টান ধর্ম। যেমন ছিল আমাদের ব্রাহ্মধর্ম।
‘আমেনহোতেপ পুজো করতে শুরু করলেন দেবতা আতেন-এর। ইনি সূর্যের দেবতা। অন্যান্য দেবতার মতো এঁর কোনো মানুষ বা পশুর রূপ নেই। শুধুমাত্র একটা গোল চাকতিই বোঝায় আতেনকে। রাজা রাতারাতি নিজের নামও বদলে ফেলে রাখলেন, ‘‘আখেনাতেন’’, যার মানে আতেনের জীবন্ত আত্মা। রাজা আখেনাতেন আর রানি নেফারতিতিই নাকি এই পৃথিবীর দুই নরনারী যাঁরা আতেনের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।
‘শুধুমাত্র তো নিজের নাম বদলালে হবে না। দেশের মানুষের মনেও সেই ধর্মীয় বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিতে হবে। তাই আখেনাতেনের নির্দেশে মিশরের বড়ো বড়ো মন্দিরগুলোতে আমুন, হোরাস, মাত এঁদের মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলা হল। কার্নাকে আর লাক্সরে তৈরি করা হল আতেনের নতুন মূর্তি।’
‘তারপর!’
দেবতা আতেন-এর পুজো করছেন আমেনহোতেপ
‘তারপরে রাজার খেয়াল হল যে নিজের একটা নতুন রাজধানীরও দরকার। সেই মতো জায়গা খোঁজা শুরু হল। ফারাওয়ের মনে ধরল নীল নদের পূর্ব পাড়ে নদী থেকে কয়েকশো মাইল দূরে একটা তিনদিক পাহাড়ে ঘেরা মরুভূমি। নাম আমার্না।’
‘এটাই সেই আমার্না লেটারের আমার্না?’
‘হ্যাঁ।’
‘কিন্তু নদী থেকে এত দূরে রাজধানী! ফারাওয়ের কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল নাকি?’
‘না ভাই, এর মতো বুদ্ধিমান ফারাও মিশরের ইতিহাসে আর দুটো নেই। আখেনাতেন বুঝতে পেরেছিলেন যে পুরোনো মন্দির ভেঙে নতুন মন্দির করলেও মানুষের মনের কোণে সেই দেবদেবীরা রয়েই যাবে। তাই এমন একটা জায়গা চাই যেখানে আগে কখনো কোনো মন্দিরের অস্তিত্বই ছিল না। সেখানে তৈরি হবে দেশের সবচেয়ে বড়ো আতেনের মন্দির। সেই মন্দিরকে ঘিরে তৈরি হবে ফারাওয়ের নতুন রাজধানী।
‘যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। প্রস্তাবিত রাজধানীর সীমানায় বসিয়ে দেওয়া হল অনেকগুলো পাথরের স্টেলা। তার প্রতিটায় একটাই জিনিস খোদাই করা। দেবতা আতেন তাঁরর গোল চাকতি নিয়ে। সেই চাকতি থেকে যে রশ্মিগুলো বেরিয়ে আসছে তাদের প্রান্তগুলো হাতের চেটোর মতো। তারা আশীর্বাদ করছে ফারাও আখেনাতেন আর ওঁর স্ত্রী নেফারতিতিকে। দেশের সেরা আর্কিটেক্টদের কাজে লাগানো হল। শ্রমিকদের দিনরাত একটানা খাটিয়ে মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে বানিয়ে ফেলা হল নতুন রাজধানী। ফারাও এর নাম দিলেন আখেতাতেন, যার মানে দিগন্তের সূর্য।’
‘আখেতাতেন একটা দারুণ প্ল্যানড শহর ছিল, বুঝলে। সেখানে ছিল বিশাল বড়ো রাজপ্রাসাদ, রাজার খাস লোকেদের জন্য বিলাসবহুল বাড়ি, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাজকর্মের জন্য অফিস, সাধারণ মানুষদের জন্য বানানো একতলা ঘর। শহরের মাঝ বরাবর ছিল বড়ো রাজপথ। নদী অনেক দূরে থাকার জন্য আখেতাতেন আর নীল নদের মধ্যে বানানো হয়েছিল আরেকটা চওড়া রাস্তা। পশুদের পিঠে করে প্রতিদিন সেই পথে আসত শহরের প্রয়োজনীয় জল। ৩০,০০০ জন মানুষ বাস করত সেই শহরে।
‘আর আতেনের মন্দির?’
‘এটার কথাই বলতে যাচ্ছিলাম। আতেনের মন্দিরের প্ল্যানটাও ছিল বেশ অদ্ভুত রকমের, বুঝলে। কয়েক মাইল জুড়ে একটা আয়তাকার জায়গার মধ্যে ছিল এটা। মন্দিরের প্রবেশপথে ছিল পাথরের তৈরি বিশাল গেট। কিন্তু ভেতরে কোনো বাড়ি ছিল না। আতেনের গোল চাকতি রাখা ছিল খোলা আকাশের নীচে। সেখানেই পুজো হত দেবতার। দেবতার সামনে ছিল সাতশো একানব্বইটা পাথরের তৈরি বেদি। রোজ সেই বেদি ভরে উঠত নৈবেদ্যতে।’
‘অদ্ভুত লোক ছিলেন বটে আখেনাতেন! এত রাডিকাল একটা কিছু করার কথা ভাবলেন কী করে!’
‘এ তো কিছুই নয়, ভাই। আখেনাতেনের ইচ্ছাতে মন্দিরের গায়ে যে সমস্ত ছবি খোদাই করা হল, শুধু তা দেখেই দেশের মানুষ চমকে উঠেছিল। সাধারণত সেখানে থাকত ফারাওদের বিজয়গাথা। এবারে সেখানে জায়গা পেল খুব সাধারণ মানুষের জীবন। প্রকৃতির ছবি। ফারাওয়ের নিজের ছবিও খোদাই করা হল একদম অন্যভাবে। অন্যদের মতো দেবতার উপাসনা করার মতো নয়, বা রথে দাঁড়িয়েও নয়। মিশরের মানুষ দেখল ফারাও আখেনাতেনের অন্দরমহলের একটা ছবি। সেখানে রাজা বসে আছেন ওঁর রানি নেফারতিতির সঙ্গে। ওঁদের কোলে ওঁদের তিন কন্যা। তাদের আদর করে চুমু খাচ্ছেন রাজা রানি।
‘আখেনাতেনের মূর্তিও ছিল বাকি ফারাওদের থেকে একদম আলাদা, বুঝলে। গুগলে আখেনাতেন বলে সার্চ করে একটা ছবি দেখো, তাহলেই বুঝতে পারবে।’
সত্যি দেখলাম ফারাওয়ের মূর্তিটা অদ্ভুতুড়ে রকমের।
‘এ কী, একম উদ্ভট কেন?’
আখেনাতেন
আখেনাতেনের মমি
‘উদ্ভট নয়, ভাই। খুব সম্ভবত এটাই কোনো ফারাওয়ের সবচেয়ে ঠিকঠাক রিফ্লেকশন। বাকিরা নিজেদের দেবতা বানানোর জন্য এতই ব্যস্ত ছিল যে তাদের সবার মূর্তি হত একইরকমের। গোল মুখ, চোখ, চওড়া কাঁধ, মেদ বর্জিত শরীর। অথচ ওদের কারোর মমির সঙ্গে এই আদল কখনো মেলেনি। কিন্তু আখেনাতেন চেয়েছিলেন দেশের মানুষ তাঁরর আসল রূপটাকেই মনে রাখুক। তাই ওঁর মূর্তিতে লম্বাটে নাক, মুখ, সামনের দিকে এগিয়ে আসা থুতনি, মোটা ঠোঁট। আমার্না শহরের বাউন্ডারিতে ফারাও আর নেফারতিতির ছবি আঁকা যে স্টেলা ছিল সেটা লক্ষ করলে আরও দেখতে পাবে যে ফারাওয়ের চওড়া কোমর, নেয়াপাতি ভুঁড়ির আভাস। আখেনাতেনের মমি পাওয়া গিয়েছিল ভ্যালি অফ দ্য কিংসের ৫৫ নম্বর টুম্বে। ২০০৭ সালে সেই মমির যখন সিটি স্ক্যান করা হয় তখন দেখা যায় যে এইসব ছবি, মূর্তির সঙ্গে আসল মানুষটার হুবহু মিল!’
পিজি এবারে খুব কাজের একটা কথা বলল,
‘কিন্তু, একটা কথা বলুন, ভবেশদা। আখেনাতেনের পরেও তো অনেক ফারাও এসেছেন। রামেসিস যেমন। তাঁরদের গল্প বলার সময় তো কখনো আতেনের কথা বলেননি। আখেতাতেনের শহরের কথাও শুনিনি।’
‘হ্যাঁ, শোননি, তার কারণ হল আখেনাতেন মারা যাওয়ার পরে ওঁর লেগাসি ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হয়।’
‘আতেন দেশের একমাত্র আরাধ্য দেবতা হওয়ায় ক্ষতি হয়েছিল বাদবাকি মন্দিরের পুরোহিতদের। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল আমুনের মন্দিরের পুরোহিতরা। ওদের প্রতিপত্তি কমে গিয়েছিল। মন্দিরের রেভিনিউ বলেও কিছু ছিল না আর। ১৭ বছর রাজত্ব করার পরে ১৩৩৬ বিসি-তে আখেনাতেন মারা যান। তারপরে মাত্র তিন বছরের জন্য ফারাও হয়েছিলেন ওঁর ভাই স্মেনখেরে। তিনিও মারা গেলে পরে ফারাও বানিয়ে দেওয়া হয় দশ বছরের তুতানখাতেনকে। এই সময় আমুনের মন্দিরের পুরোহিতরা আবার হাল ধরেন। তুতানখাতেনের নাম বদলে রাখা হয় তুতানখামুন। আতেনের সব মন্দির ভেঙে ফেলা হয়। তুতানখামেনের পরের ফারাও হোরেমহেব আর তারও পরে দ্বিতীয় রামেসিস সিস্টেমেটিকালি ফারাও আখেনাতেনের সব মূর্তি ভেঙে মাটির তলায় পুঁতে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। কোনোরকম ডকুমেন্টে ওঁর নাম রাখা হয়নি। ওদের কাছে আখেনাতেন ছিলেন শয়তান। ওঁর সময়টা ছিল অভিশপ্ত। তাই তাঁরদের কোনো চিহ্নই আর রাখতে চাননি ওঁরা।’
‘আর আখেতাতেন শহরের কী হল?’
‘তুতানখামেন রাজা হওয়ার চার বছরের মধ্যে আখেতাতেনের শহর খালি করে রাজধানী আবার সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় থেবসে। পরিত্যক্ত শহরকে গ্রাস করে মরুভূমি। ১৮৯১ সালে ব্রিটিশ আর্কিয়োলজিস্ট ফ্লিন্ডার্স পেট্রি আবার এই শহর খুঁজে বের করেন।’
‘আর আমার্নার চিঠিগুলোর কথা বললেন না?’
‘ও হ্যাঁ, সে এক মজার গল্প, বুঝলে। ১৮৮৭ সালের একটা শীতের সকাল। আমার্নার বালির নীচে এক মহিলা জ্বালানি খুঁজছিলেন। আখেনাতেন শহর তৈরির সময় যে কাদামাটির ইট ব্যবহার করা হত বহু বছর মাটির নীচে থেকে থেকে সেটাই ভালো জ্বালানির কাজ করত। না জেনেবুঝে সেই ইটই গ্রামের মানুষ বালি খুঁড়ে তুলে নিয়ে যেত উনুন ধরানোর জন্য।
‘তা, সেই ইট খুঁজতে খুঁজতে মহিলাটির হাতে এসে পড়ে একটা ভাঙাচোরা কাঠের বাক্স। সেই বাক্সতে ছিল প্রায় ৪০০ খানা পোড়ামাটির তৈরি ট্যাবলেট। এর মূল্য সেই মহিলা বুঝতে পারেননি। তাই গ্রামেরই একজনের কাছে মাত্র কুিড় ইজিপশিয়ান মুদ্রার বিনিময়ে গোটা বাক্সটাই বিক্রি করে দেন। সেই লোকটি আবার বাক্সটা নিয়ে হাজির হন লাক্সরের এক অ্যান্টিক ডিলারের কাছে। সেই ডিলার এবারে এক একটা ট্যাবলেট চড়া দামে বিক্রি করতে থাকে চোরাবাজারে। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের ইজিপশিয়ান ডিপার্টমেন্টের কিউরেটর ওয়ালিস বাজ সেসময় লাক্সরেই ছিলেন। তাঁরর হাতে এসে পৌঁছোয় কয়েকটা ট্যাবলেট।
‘ওয়ালিস বাজ কিউনিফর্ম লিপি পড়তে পারতেন। তাই ট্যাবলেটগুলো পড়ে বুঝতে পেরে যান এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব। প্রতিটা পোড়ামাটির স্ল্যাবই এক একটা চিঠি, যেগুলো মিশরের আশেপাশের ছোটো ছোটো প্রতিবেশী দেশের রাজারা লিখেছিলেন আখেনাতেনকে। সেখান থেকে ফারাওয়ের ফরেন পলিসির সম্পর্কে একটা দারুণ ধারণা পাওয়া যায়। পরে মোট অষ্টআশি খানা আমার্না লেটার ওয়ালিস বাজ উদ্ধার করে পাঠান ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। আর কিছু চিঠি আছে কায়রো, বার্লিন আর ল্যুভর মিউজিয়ামে। যেগুলোর চোরাচালান আগেই হয়ে গিয়েছিল সেগুলোর কোনো পাত্তা এখন আর পাওয়া যায় না। শোভন জাটলা ভেবেছিলেন যে তেমনই একটা ট্যাবলেট হয়তো ওঁর হাতে এসে গেছে।’
‘আচ্ছা, এবারে কেসটা ভালোভাবে বুঝলাম।’
‘হুম, সবশেষে আরেকটা ইন্টারেস্টিং গল্প তোমাদের বলে রাখি, এটা না বললে আখেনাতেনের কথা শেষ হবে না। সেটা হল ওঁর স্ত্রী নেফারতিতির কথা।’
পিজি সঙ্গেসঙ্গে বলল,
‘হ্যাঁ, শুনেছি উনি নাকি দারুণ সুন্দরী ছিলেন!’
‘নেফারতিতি থেকে লিজ টেলর। যেকোনো সুন্দরী মহিলাকেই দেখছি তুমি চেনো, পিজি ভাই। আখেনাতেনের রানি সত্যিই ছিলেন অসামান্যা সুন্দরী। নেফারতিতি শব্দের মানেই হল ‘‘দ্য বিউটিফুল ওয়ান হ্যাজ কাম’’। ফারাও আমেনহোতেপ তাঁরর স্ত্রীকে প্রচণ্ড সম্মান দিতেন। ফারাওয়ের অধিকাংশ ছবিই থাকত স্ত্রী-র সঙ্গে। নিজের সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীকেও দেবতা আতেনের দূত হিসেবে পরিচয় দিতেন আখেনাতেন। এমনকী নেফারতিতির নামের দুটো কার্তুজও পাওয়া যায়, যে কার্তুজে শুধুমাত্র ফারাওদের নাম লেখারই চল ছিল।’
‘মানে ভদ্রমহিলা খুব ইনফ্লুয়েনশিয়ালও ছিলেন!’
‘তা আর বলতে! তো, আসলে যে গল্পটা বলব বলছিলাম। ১৯১২ সালে জার্মান আর্কিয়োলজিস্ট লাডউইগ বুর্কার্ড আখেতাতেন শহরের রুইনের মধ্যে একটা ভেঙে-পড়া বাড়ি খুঁজে পান। সেটা ছিল রয়াল স্কাল্পটার তুতমোসের। সেই বাড়িতে বিশাল বেডরুম, বাথরুম, স্টোরেজ প্লেস ছাড়াও ছিল একটা ওয়ার্কশপ। আর এই ওয়ার্কশপেই বুর্কার্ড খুঁজে পান স্বয়ং রানি নেফারতিতির একটা দারুণ আবক্ষ মূর্তি! চুনাপাথরের তৈরি, তার ওপরে জিপসামের প্লাস্টার করা। রানি যে কী দারুণ সুন্দরী ছিলেন সেটা এই মূর্তি দেখেই বোঝা যায়। ১৯৩৩ সালে ইজিপ্ট গভৰ্নমেন্ট জার্মানির কাছ থেকে এই মূর্তি ফেরত চান। কিন্তু হিটলার বেঁকে বসেন। ওঁর ইচ্ছা ছিল শুধুমাত্র ইজিপশিয়ান আর্টিফ্যাক্ট নিয়ে একটা বিশাল মিউজিয়াম বানানোর। আর সেই মিউজিয়ামের ঠিক মাঝখানে একটা ঘরে থাকবে নেফারতিতির সেই মূর্তি। তবে এই মূর্তির একটা অদ্ভুত রহস্য আছে, জানো। যেটার কিনারা করার জন্য আজও আর্কিয়োলজিস্টরা ইতিহাস হাতড়ে বেড়াচ্ছেন।’
‘এখানেও রহস্য! কী সেটা?’
‘নেফারতিতির মূর্তির গোটাটা রং করা হলেও ডান চোখটা ছিল আলাদাভাবে পাথরের তৈরি। তার ওপরে আঁকা কালো পিউপিল।’
‘আর বাঁ-চোখটা?’
‘ওখানেই তো রহস্য। সেখানে শুধু চোখের কোটরটাই আছে। নেফারতিতির মূর্তির বাঁ-চোখটা কোথায় সেটা কেউ জানে না !’