২২. আকাশে প্রকাণ্ড থালার মত চাঁদ উঠেছে

আকাশে প্রকাণ্ড থালার মত চাঁদ উঠেছে। জোছনার প্রাবনে থৈ থৈ করছে সুখানপুকুর। তরল জোছনা, মনে হয় ইচ্ছে করলেই এই জোছনা গায়ে মাখা যায়।

জোছনা গায়ে মেখে কুসুম জলচৌকিতে একা একা বসে আছে। সে সন্ধ্যা থেকেই কাঁদছে। তার ভেজা গালে জোছনা চক চক করছে। কুসুমের কান্না বাড়ির সবাই দেখছে কেউ গায়ে মাখছে না। বিয়ের কন্যাতো কাঁদবেই। কাঁদাটাইতো স্বাভাবিক।

কুসুমের বিয়ে ঠিক হয়েছে আজ বিকেলে। তার বড় খালা হুট করেই সব ব্যবস্থা করে ফেললেন। মনোয়ারাকে ডেকে বললেন, গরীব ঘরের মেয়ের বিয়া। জামাই হাতীর পিঠে চইড়া আসব না। জামাই ঘরে বসা। জিনিশটা ভাল দেখায় না। মৌলবী ডাক দিয়া কবুল দিয়া দেও। এজিন কাবিন হইয়া থাকুক। পরে এক সময় গেরামের মানুষের খাওয়াটা দিবা।

মনোয়ারা বলেছেন–আফনে যেটা ভাল বিবেচনা করেন।

আমি এইটাই ভাল বিবেচনা করি।

ছেলেরে জিজ্ঞেস করা দরকার না বুবু তার একটা মতামত।

জিজ্ঞেস করতাছি।

কুসুমের খুব আশা ছিল ছেলে রাজী হবে না। শখ করে কে চাইবে জ্বীনে পাওয়া মেয়েকে বউ করতে। কুসুমকে অবাক করে দিয়ে সুরুজ আলি মিনমিন করে লল, আফনে আমার মার মত। আফনে যা নির্ধারন করবেন…

নিন্দালিশের খালা বললেন, আইজ পূর্ণিমা। পূর্ণিমার দিন বিবাহ সুখের হয় না। কাইল একজন মৌলবী খবর দিয়া আনি। দশ হাজার এক টাকা কাবিনে বিবাহ রাজি আছ?

সুরুজ আলি পায়ের নখ দিয়ে মাটিতে আঁকিবুকি কাটতে কাটতে বলল, আফনে আমার মুরুব্বী।

তিনি একশ টাকার দুটা নোট বের করে দিয়ে বললেন, পায়জামা, পাঞ্জাবী আর টুপী কিনা আন। কালা টুপী কিনবা না।

কুসুমকে হতভম্ভ করে সুরুজ আলি টাকা নিয়ে পায়জামা, পাঞ্জাবী কিনতে চলে গেল। তারপরেও কুসুমের মনে ক্ষীণ আশা ছিল হয়ত টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যাবে। খালি হাতে পালিয়ে যাবার চেয়ে টাকা পয়সা নিয়ে পালিয়ে যাওয়া ভাল।

সুরুজ আলি পালায় নি। সন্ধ্যার আগেই ফিরেছে। নাপিতের দোকানে চুল কাটিয়েছে।

মৌলবী ডাকিয়ে তিনবার কবুল বলিয়ে যে বিয়ে হবে তারও আয়োজন লাগে। কুসুমের বাড়ির সবাই সেই আয়োজনে ব্যস্ত। আশে পাশের বাড়ির মেয়েরাও এসে জুটেছে। চিকণ করে সুপারী কাটা হচ্ছে। পানের খিলি বানানো হচ্ছে। হাতের সেমাই বানানোর জন্যে চালের গুড়ি তৈরী হচ্ছে। পুষ্পের খুব শখ মাঝ রাত থেকে বিয়ের গীত হবে। সে গেছে বিয়ের গীতের মানুষ জোগাড় করতে। বিয়ের গীতের আসল মানুষ মরিয়মের মা। খবর পেলেই তিনি চলে আসবেন। সাপের ওঝার যেমন সাপে কাটা রুগীর খবর পেলেই আসতে হয়। বিয়ের গীত যারা গায় তাদেরও তেমনি বিয়ের খবর পাওয়া মাত্র ছুটে আসতে হয়।

মরিয়মের মা এলেই পাড়ার বাকি বৌ-ঝিরা আসতে শুরু করবে। মাঝ রাতের পর চারদিকে নিস্তব্ধ হয়ে গেলে শুরু হবে বিয়ের গান। একজন গাইবে বাকিরা ধোয়া ধরবে–

আইজ আমরার কুসুম বেটির বিবাহ হইব।
বিবাহ হইব। বিবাহ হইব।
হাসিয়া রঙ্গিলা কুসুম পিড়িতে বসিব
বিবাহ হইব। বিবাহ হইব।
পিড়িতে বসিয়া কুসুম সিনান করিব
বিবাহ হইব। বিবাহ হইব।
সিনান করিয়া পায়ে আলতা পরিব
বিবাহ হইব। বিবাহ হইব।

কুসুম জলচৌকি থেকে উঠল। হঠাৎ তার ভেতর সামান্য অস্থির দেখা গেল। সে চোখের পানি মুছে ফেলল। সবাই ব্যস্ত। কেউ তাকে লক্ষ্য করবে না। এই ফাঁকে চট করে মতি ভাইকে দুটা কথা বলে আসা যায়। কতক্ষণ আর লাগবে দুটা কথা বলতে। যাবে আর আসবে। বিয়ের কনেকে চোখে চোখে রাখার নিয়ম। কুসুমকে কেউ চোখে চোখে রাখছে না। সে পাঁচ দশমিনিটের জন্যে চলে গলে কেউ দেখবে না।

 

মতির জ্বর বেড়েছে। সে কাঁথা গায়ে শুয়ে ছিল। হারিকেন জ্বালায় নি। খোলা দরজা ও জানালা গলে চঁদের আলো এসে আলো হয়ে আছে। কুসুম দরজা ধরে দাঁড়াতেই মতি চমকে উঠে বলল, কে?

কুসুম খুব নরম স্বরে বলল, আমি মতি ভাই।

কি ব্যাপার কুসুম?।

আফনের জ্বর কেমন দেখতে আসছি। কাইল আমার বিবাহ। বিবাহের পরে তো আর যখন তখন আসন যাইব না। আফনের জ্বর কি বাড়ছে মতি ভাই।

হুঁ।

কুসুম সহজ ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকল। মতির কপালে হাত রেখে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, জ্বরে তো শইল পুইড়া যাইতেছে।

মতি গম্ভীর গলায় বলল, রাইত কইরা তুমি আসছ কাজটাতো ভাল কর নাই কুসুম।

আমার ভাল-মন্দ আফনের দেখনের দরকার নাই। নিজের ভাল-মন্দ দেখেন। রাজবাড়ির মেয়েরে খবর দৈন নাই। খবর পাইলে সে দৌড়াইয়া আইস্যা চিকিৎসা শুরু করব। আফনেরে সে খুব ভাল পায়।

তুমি ভাল পাও না?

আমার ভাল পাওনে না পাওনে কিছু হয় না। আমি কে মতি ভাই। আমি কেউ।

কুসুম খাটে বসল। মতি আতংকিত গলায় বলল–বাড়িত যাও কুসুম। বসলা যে? কাইল তোমার বিবাহ এই খবর পাইছি। বিয়ার কন্যা হইয়া…

আফনেরে দুইটা কথা কইতে আইছি মতি ভাই। কথা দুইটা শেষ হইলেই এক দৌড় দিয়া চইল্যা যাব।

কি কথা?

ব্যাঙের মাথা।

তামাশা করবা না কুসুম। যা বলনের বল–বইল্যা বাড়িতে যাও।

কুসুম মুহূর্ত চুপ করে থেকে শান্ত গলায় বলল, মতি ভাই আফনে আমারে একটু আদর কইরা দেন।

মতি স্তম্ভিত হয়ে বলল, ছিঃ ছিঃ কুসুম। তুমি কি বলতেছ? এইসব কি কথা?

কুসুম ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি হইলাম জ্বীনে ধরা মেয়ে। কোন সময় কি বলি কোন ঠিক নাই। ভুল হইলে মাফ কইরা দেন।

ভুলতো অবশ্যই হইছে। এইসব পাপ চিন্তা মনে স্থান দিবা না। তুমি জান না তোমারে আমি অত্যাধিক স্নেহ করি।

সত্যি?

অবশ্যই সত্য। যাও অখন বাড়িত যাও।

এ যদি না যাই?

মতি হতবুদ্ধি হয়ে গেল। মেয়েটা এইসব কি শুরু করেছে? জ্বীন তাকে দিয়ে এইসব করাচ্ছে। ভরা পূর্ণিমায় জ্বীনের আছর বেশী হয়।

মতি ভাই, আমি ঠিক করছি এই চৌকির উপরে বইস্যা থাকব। লোকজন এক সময় আমার খুঁজে বাইর হইব। খুঁজতে খুঁজতে আমারে পাইব আন্ধ্যাইর ঘরে বসা।

কুসুম হাসছে। খিলখিল করে হাসছে। স্বাভাবিক মানুষের হাসি না—অস্বাভাবিক হাসি। যে হাসি শুনলে গা ঝিম ঝিম করে।

মতি ভাই?

হুঁ।

আফনে কোন দিন বিবাহ করবেন না?

না। আমার ওস্তাদের নিষেধ আছে। ওস্তাদ আমারে স্পষ্ট কইরা বলছে–সংসার আর গান দুইটা এক লগে হয় না। হয় সংসার করবা নয় গান।

আফনের ওস্তাদ তো বিবাহ করছিল। করে নাই?

হ্যাঁ করছে। এই জন্যেই তো তার গলাত গান বসে নাই।

আফনের গলাত গান বসছে?

হ্যাঁ কুসুম বসছে। তুমি নিজেও জান বসছে। আমি গানে টান দিলে মাইনষের চউক্ষে পানি আয়। কি জন্যে আয়?

কুসুম শান্ত গলায় বলল, হ্যাঁ মতি ভাই। আফনের গলায় গান বসছে। কথা সত্য।

মতি আগ্রহের সঙ্গে বলল, এর জন্যে কষ্ট আমি কম করি নাই। অনেক কষ্ট করছি। মনে সুখ থাকলে গান হয় না–এই জন্যে সুখের আশা কোন দিন করি নাই।

মতির কথার মাঝখানেই কুসুম হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, যাই মতি ভাই। তার গলার স্বরে আগের শান্ত ভাব নেই। তার গলা ভেজা।

আও তোমারে আগাইয়া দেই। আগাইয়া দেওনের দরকার নাই। কে না কে দেখব।

মতিও ঘর থেকে বের হল। তার বাড়ির উঠান জোছনায় ভরা। কুসুম বলল, কি চান্নি পসর দেখছেন মতি ভাই। এমন চান্নি কোনবার দেখি নাই।

বলতে বলতে কুসুম শব্দ করে হাসল। মতি বলল হাস কেন?

মাইনষে যেমন বৃষ্টির মইধ্যে গোসল করে আমার জোছনার মইধ্যে গোসল করনের ইচ্ছা করতেছে। গোসল করবেন মতি ভাই?

তুমি যে কি পাগলের মত কথা কও।

কুসুম ধরা গলায় বলল, আর কোন দিন আফরের বিরক্ত করব না মতি ভাই। আইজ আমার কথা শুনেন, আইয়েন উঠানে ইফদুইজনে জোছনার মইধ্যে গোসল করি। শইল্যে চান্নি পসর মাখি।

বাড়িত যাও কুসুম।

কুসুম ক্লান্ত গলায় বলল, আচ্ছা যাইতেছি।

কুসুম দ্রুত পায়ে চলে গেল। মতির ঘরে যেতে ইচ্ছা করছে না। সে উঠোনে বসে রইল। এক সময় কুসুমের মত তারো জোছনায় গোসল করতে ইচ্ছা করতে লাগল। কি আশ্চর্য জোছনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *