দ্বাবিংশ অধ্যায় – অরুন্ধতীর জন্ম
মার্কণ্ডেয় বলিলেন–সেই মহাগিরির যে সানুতে দেবগণের সভা হইয়াছিল, তথায় বিধাতার বাক্যে সীতা-নাম্নী এক দেবনদী উৎপন্ন হয়। ১
যখন, দেবগণ চন্দ্রকে মনোহর শীতা-সলিলে স্নান করাইয়া ব্রহ্মার বাক্যানুসারে তাহাকে পান করেন, তখন সেই সীতা জল চন্দ্রের স্নানে অমৃত হইয়া সেই বৃহল্লোহিত সরোবরে নিপতিত হয়। ২-৩
সেই মানস (মনঃসম্ভুত) সরোবরে অমৃত-জল বৃদ্ধি পাইল; ব্রহ্মা স্বয়ং তাহা দেখিলেন। ব্রহ্মার দর্শন মাত্রে সেই জল হইতে এক উত্তম কন্যা উত্থিতা হইলেন, স্বয়ং ব্রহ্মা, তাহার নাম রাখিলেন, “চন্দ্রভাগা”। ৪-৫
সমুদ্র, ভাৰ্য্যা করিবার নিমিত্ত ব্ৰহ্মার সম্মতিক্রমে তাহাকে গ্রহণ করিলেন। চন্দ্র, গদার অগ্রভাগদ্বারা সেই পৰ্ব্বতের পশ্চিমপার্শ্বভেদ করিয়া চন্দ্রভাগা নাম্নী সেই রমণীর অধিষ্ঠিত জলরাশি প্রবাহিত করিয়া দেন। ৬-৭
সেই অমৃত-জলপূর্ণ বৃহল্লোহিত-নামক সরোবর চন্দ্রভাগা নদীরূপে সমুদ্রে গমন করিল। ৮
তখন সমুদ্রও নিজভাৰ্যা মহানদী চন্দ্রভাগাকে সেই জলপ্রবাহ দ্বারা নিজ ভবনে লইয়া গেলেন। ৯
গঙ্গা-সদৃশ বিবিধ গুণবতী চন্দ্রভাগা নদী সেই পৰ্বত-প্রধান চন্দ্রভাগে এই রূপে উৎপন্ন হইয়াছিলেন। ১০
যত নদী বা পৰ্বত–সকলেই স্বভাবতঃ দ্বিরূপ-সম্পন্ন; নদীগণের এক রূপ জল, এতদ্ভিন্ন স্বতন্ত্র শরীর আছে। ১১
পর্বতের এক মূর্তি পাষাণময় স্থাবর, এতদ্ভিন্ন স্বতন্ত্র দেহ আছে। অর্থাৎ যেমন শুক্তি শঙ্খাদির অন্তর্গত স্বতন্ত্র দেহ এবং বাহিরে অস্থিময় স্বরূপ সর্বদা বিরাজমান। ১২-১৩
এইরূপ, নদী এবং পর্বতের জল ও স্থাবর মূর্তি-বাহিরে, আর এতদ্ভিন্ন দেহ অন্তরে অবস্থিত তাহা সর্বদা উপযোগী নহে। ১৪
স্থাবর মূর্তি, পৰ্বতের অন্তরে স্থিত শরীরের পুষ্টি ও তৃপ্তিবিধায়ক; আর, নদীর অন্তরে স্থিত শরীর তদীয় জলময় মূর্তি দ্বারা পোষিত ও তর্পিত হয়। ১৫
পূর্বকালে, বিষ্ণু, জগৎ-স্থিতির জন্য নদী ও পৰ্ব্বতদিগকে সযত্নে কামরূপী করেন। ১৬
হে দ্বিজগণ! জল শুষ্ক হইতে থাকিলে নদীর সর্বদা দুঃখ হয়, আর স্থাবরদেহ বিশীর্ণ হইলে পৰ্বতের প্রকৃত শরীর সর্বদা দুঃখাকুল হয়। ১৭
সেই চন্দ্রভাগ-পৰ্বতে সন্ধ্যাকে বৃহল্লোহিত সরোবরের তীরে অবস্থিত দেখিয়া বসিষ্ঠ, সাদরে জিজ্ঞাসা করিলেন–ভদ্রে! তুমি কি জন্য এই নির্জন গিরিবরে আসিয়াছ? গৌরাঙ্গি! তুমি কার কন্যা? তুমি কিইবা করিতে ইচ্ছা করিয়াছ? ১৮-১৯
দেখিতেছি, তোমার মুখমণ্ডল পূর্ণচন্দ্র-সদৃশ, কিন্তু এরূপ শ্রীহীন বিষণ্ণ কেন? যদি এ সকল কথা তোমার পক্ষে বিশেষ গোপনীয় না হয়; তাহা হইলে আমি শুনিতে ইচ্ছা করি। ২০
মার্কণ্ডেয় বলিলেন–সন্ধ্যা, মহাত্মা বসিষ্ঠের কথা শুনিয়া এবং জ্বলন্ত অনল-সন্নিভ মূর্তিমান ব্ৰহ্মচর্যসদৃশ সেই মহাত্মা জটাধারী তপোধন বসিষ্ঠকে অবলোকন করিয়া সাদরে প্রণিপাত-পুরঃসর বলিতে লাগিলেন–দ্বিজবর! আমি যেজন্য। এই পৰ্বতে আসিয়াছি, আপনার দর্শনমাত্রেই তাহা সিদ্ধ হইয়াছে। অথবা, প্রভু হে! অবিলম্বেই তাহা সিদ্ধ হইবে। ২১-২৩।
ব্ৰহ্মন্! আমি তপস্যা করিবার জন্য এই নির্জন পৰ্বতে আসিয়াছি; আমি ব্রহ্মার মানসী কন্যা, আমার নাম সন্ধ্যা। ২৪
মুনিবর! আমি তপস্যার কোন উপদেশ প্রাপ্ত হই নাই; যদি এই গোপনীয় বিষয় উপদেশ দেওয়া আপনার অনুচিত না হয়, তাহা হইলে আমাকে উপদেশ দিন। ২৫
ইহাই আমার গোপনীয় চিকীর্ষিত; আর অন্য কোন কার্যই নাই। ২৬
আমি তপস্যার ভাব না জানিয়া তপোবনে আসিয়াছি, এই চিন্তায় বিশুষ্ক হইতেছি এবং হৃদয় সতত কম্পিত হইতেছে। ২৭
মার্কণ্ডের বলিলেন,–ব্ৰহ্মনন্দন বসিষ্ঠ, তাহার এই কথা শুনিয়া আর কিছু জিজ্ঞাসা করিলেন না, কেননা তিনি স্বয়ং সকল তত্ত্বই অবগত ছিলেন। ২৮
অনন্তর, বসিষ্ঠ, তপস্যা করিবার জন্য কৃতনিশ্চয়া সংযতচিত্তা শিষবৎ সন্ধ্যাকে গুরুবৎ শিক্ষা দিতে লাগিলেন;–যিনি পরম মহৎ জোতিস্বরূপ, যিনি পরম মহৎ তপস্য-স্বরূপ, সেই পরমারাধ্য পরম বিষ্ণুকে মনে মনে চিন্তা কর। ২৯-৩০।
একমাত্র যিনি, ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষের আদি কারণ জগতের আদি সেই অদ্বিতীয় পুরুষোত্তমকে ভজনা কর। ৩১
হে শুভাননে! শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী, কমললোচন, বক্ষঃস্থলে শ্রীবৎসধারী বনমালী, কেয়ূর-কুণ্ডল-কিরীট-বলয়াদি-ভূষণ-ভূষিত, গরুড়-পৃষ্ঠে শ্বেতশত দলে আসীন, সূর্যমণ্ডলমধ্যস্থিত নিৰ্ম্মল-স্ফটিক-সন্নিভ বা নীলোৎপল-শ্যামল মূর্তি সাকার এবং নিরাকার নিত্যানন্দময় এবং আনন্দ-শূন্য জ্ঞান-গম্য দেব দেব বিষ্ণুকে এই মন্ত্র দ্বারা ভজনা কর। ৩২-৩৫
“ওঁ নমো বাসুদেবায় ওঁ” সৰ্ব্বদা এই মন্ত্র স্মরণ করত মৌনী তপস্যা আরম্ভ কর। ৩৬
মৌনী তপস্যা যে কিরূপ, তাহা বলিতেছি শ্রবণ কর। মৌনাবলম্বনে স্নান এবং মৌনাবলম্বনেই পূজা করিতে হইবে। প্রথম ছয় দিন কিছুই আহার করিবে না, কেবল তৃতীয় দিন রাত্রিতে এবং ষষ্ঠ দিন রাত্রিতে পর্ণজলপান করিয়া থাকিবে। ৩৭
তাহার পর তিন দিন নিরম্বু উপবাস; তৃতীয় দিন রাত্রিতেও জলপান করিবে না। এইরূপ তপস্যা সমাপ্ত হইলে, প্রতি তৃতীয়দিন রাত্রিতে যৎকিঞ্চিৎ ভোজন করিতে পারিবে। ৩৮
বৃক্ষবল পরিধান, যথাকালে ভূমিতে শয়ন–এই তপস্যার অঙ্গ। ইহার নাম মৌনী তপস্যা; ইহাতে অবিলম্বে ব্ৰতফল পাওয়া যায়। ৩৯
এইরূপ তপস্যাযোগে মাধবকে দৃঢ়চিন্তা কর। তিনি প্রসন্ন হইয়া অবিলম্বে তোমার মনোরথ পূর্ণ করিবেন। ৪০
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–এইরূপে বসিষ্ঠ মুনি সন্ধ্যাকে ন্যায্যমত তপশ্চর্যা শিক্ষা দিয়া তথায় অন্তর্হিত হইলেন। ৪১
সন্ধ্যাও তপস্যার ভাবভঙ্গী বুঝিয়া বৃহল্লোহিত সরোবরতীরে সানন্দে তপস্যা করিতে আরম্ভ করিলেন। ৪২
বসিষ্ঠ, তপস্যা-সাধন যে মন্ত্র উপদেশ দিয়াছিলেন, সন্ধ্যা তদ্দ্বারা এই ব্রতে ভক্তিভাবে গোবিন্দ পূজা করিতে লাগিলেন। ৪৩
সন্ধ্যা একাগ্রচিত্তে তপস্যা করিতে লাগিলেন; এইরূপে নারায়ণগত চিত্তে তাহার চারি যুগ কাটিয়া গেল। ৪৪
তাহার অদ্ভুত তপস্যা দেখিয়া লোকে বিস্ময়াপন্ন হইল; এইরূপ তপস্যা আর কাহারও হইবে না। ৪৫
মানুষ-প্রমাণে চারিযুগ অতীত হইলে, জগৎপতি বিষ্ণু, সন্ধ্যা যেরূপ চিন্তা করিয়াছিলেন, অন্তরে বাহিরে এবং জীবাত্মাকে সেইরূপ দেখাইয়া তাহার প্রত্যক্ষগোচর হইলেন। ৪৬-৪৭
অনন্তর, সন্ধ্যা, নিজ-চিন্তিত শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী কমললোচন, কেয়ূর কুণ্ডল-কিরীট-কটক-শোভিত, গরুড়োপরি আসীন, নীলোৎপল-দল-শ্যামল পুণ্ডরীকাক্ষ হরিকে সম্মুখে দেখিয়া “আমি হরিকে কি বলিব? কিরূপেই বা স্তব করিব” এইরূপ চিন্তা করত সভয়ে নয়নযুগল মুদ্রিত করিলেন। ৪৮-৫০
মধুসূদন, সেই মুদ্রিত-নয়না সন্ধ্যার হৃদয়ে প্রবিষ্ট হইয়া তাহাকে দিব্য জ্ঞান, দিব্য বাক্য এবং দিব্য চক্ষু দান করিলেন। ৫১
তখন সন্ধ্যা দিব্য জ্ঞান, দিব্য বাক্য এবং দিব্য চক্ষু লাভ করিয়া প্রত্যক্ষে গোবিন্দ দর্শন করত সেই জগদীশ্বরকে স্তব করিতে লাগিলেন,–জ্ঞানগম্য পরাৎপর ন-স্থূল, ন-সূক্ষ্ম ন-বৃহৎ যদীয় নিরাকার রূপ–যোগিগণ, অন্তরে ধ্যান করেন, সেই হরিকে আমি নমস্কার করি। ৫২-৫৩
যাহার শিব, শান্ত, নির্মল, নির্বিকার, জ্ঞানাতীত স্বপ্রকাশ রূপ প্রকাশ কারক মার্তণ্ড-সন্নিভ এবং তমঃপারে অবস্থিত; সেই তোমাকে আমি নমস্কার করি। ৫৪
যাহার এক শুদ্ধ দীপ্যমান মনোহর স্বাভাবিক চিদানন্দময়, অনলাত্মক প্রসন্ন রূপ নিত্যানন্দময়, সৎ, বিবিধ-প্রকার এবং শ্রীপ্রদ তাহাকে নমস্কার। ৫৫
তত্ত্বজ্ঞান সঙ্কেতে উদ্ভাবনীয়, বস্তুতঃ পৃথক হইলেও সত্ত্ব-সংবৃত আত্ম-স্বরূপে ধ্যেয়, সারাৎসার, যদীয় রূপ, সৰ্ব্বপারবর্তী এবং পাবনের পাবন, সেই তোমাকে নমস্কার করি। ৫৬
যোগিগণ যে তোমার নিত্য অজর অব্যয় সর্বব্যাপক রূপকে অষ্টাঙ্গ সমাধি-পরম্পরা দ্বারা চিন্তা করেন এবং জ্ঞান-যোগ-দ্বারা তাহা প্রাপ্ত হইয়া পরমপদ লাভ করেন, সেই তোমাকে আমি নমস্কার করি। ৫৭
যিনি সাকার শুদ্ধরূপে গরূড়োপরি-সংস্থিত, মনোহর নীলনীরদসন্নিভ এবং শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী, সেই যোগযুক্ত তোমাকে আমি নমস্কার করি। ৫৮
পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু আকাশ, কাল এবং দিঙ্মণ্ডল যাহার রূপ-সেই তোমাকে নমস্কার করি। ৫৯
প্রকৃতি এবং পুরুষ, যাঁহার কাজের অংশমাত্র; সেই প্রধান পুরুষ হইতেও অব্যক্তরূপ গোবিন্দকে নমস্কার করি। ৬০
যিনি স্বয়ং পঞ্চভূত, যিনি স্বয়ং আবার তাহাদিগের গুণ এবং যে পরাৎপর জগতের আধার, সেই তোমাকে বারংবার নমস্কার করি। ৬১
যে দেব, পরমাত্মা জগন্ময় অক্ষয় অব্যয় পরম পুরাণ-পুরুষ, সেই তোমাকে নমস্কার করি। ৬২
যিনি ব্রহ্মারূপে সৃষ্টি, বিষ্ণুরূপে স্থিতি করেন এবং যিনি রুদ্ররূপে সংহার করিবেন, সেই তোমাকে বার বার নমস্কার করি। ৬৩
যিনি কারণের কারণ, দিব্যামৃত-জ্ঞান-বিভূতি প্রদাতা, সমস্ত লোকের অন্তরে মোহান্ধকারজনয়িতা এবং স্বপ্রকাশরূপ, সেই পরাৎপরকে বারবার–নমস্কার। ৬৪
যাহার চরণ হইতে পৃথিবী, চক্ষু হইতে সূর্য, মন হইতে চন্দ্র, মুখ হইতে বহ্নি এবং নাভি হইতে অন্তরীক্ষ উৎপন্ন–এইরূপ সমস্ত জগৎই যাহার প্রপঞ্চ বলিয়া কথিত, তুমি সেই হরি; তোমাকে নমস্কার করি। ৬৫
হরি হে! তুমি পরাৎপর পরমাত্মা; তুমিই পরম শব্দব্রহ্মরূপা ব্ৰহ্মবিচারণ পরায়ণ। বিবিধ-প্রকার পরমতত্ত্ব বিদ্যা। যে জগদীশ্বরের আদি-মধ্য-অন্ত নাই, সেই বাক্য মনের অতীত দেবকে স্তব করিব কিরূপে? ৬৬-৬৭
ব্ৰহ্মাদি দেবগণ এবং তপোধন মুনিগণ, যাহার অনন্তরূপ জানিতে পারেন না, আমি তাহাকে কেমনে বর্ণনা করিব? ৬৮
প্রভু হে! তুমি নির্গুণ, আমি স্ত্রীলোক; আমি তোমার গুণাবলী জানিব কিরূপে? ইন্দ্র প্রভৃতি দেব দানবগণেও তোমার রূপ অবগত নহেন। ৬৯
হে জগন্নাথ! তোমাকে নমস্কার করি; হে তপোময়! তোমাকে নমস্কার করি, হে ভগবন। প্রসন্ন হও, আমি তোমাকে ভূয়োভুয় নমস্কার করি। ৭০
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–অনন্তর শ্রীহরি নারায়ণ, সন্ধ্যার অজিন-বল্কল সংবৃত মস্তক-স্থিত-পবিত্র-জটা-কলাপে শোভিত ক্ষীণ শরীর এবং শিশির-পীড়িত কমলোপম বিশুষ্ক মুখমণ্ডল নিরীক্ষণ করিয়া সদয়ভাবে বলিতে লাগিলেন। ৭১-৭২
হে শুভবুদ্ধিশালিনি! ভদ্রে! তোমার পরম তপস্যায় এবং স্তবে আমি প্রীত হইয়াছি; এখন যে বরে তোমার ইষ্টসিদ্ধি হয়, সেই বর প্রার্থনা কর। ৭৩
তুমি বল; আমি তোমার মনোগত বর প্রদান করিব; তোমার মঙ্গল হউক, আমি তোমার প্রতি প্রসন্ন হইয়াছি। ৭৪
সন্ধ্যা বলিলেন,–দেব! যদি আমার তপস্যার তুমি প্রসন্ন হইয়া থাক, তাহা হইলে আমি প্রথমেই এই বর চাহি, প্রদান কর। ৭৫
হে দেবেশ! পৃথিবীতলে প্রাণিগণ উৎপন্ন হইবামাত্র যেন সকাম না হয়, কিন্তু কালক্রমে যেন সকাম হয়। ৭৬
“আমি যেন ত্রিজগতে পতিব্রতা বলিয়া বিখ্যাত হই” এই আমি দ্বিতীয়, বর প্রার্থনা করিলাম। ৭৭
হে জগন্নাথ! স্বামী ব্যতীত অপর কাহারও প্রতি আমার যেন সকাম দৃষ্টি পতিত না হয় এবং স্বামীও যেন আমার বিশেষ সুহৃৎ হন। ৭৮
যে পুরুষ, আমাকে কামভাবে অবলোকন করিবে, তাহার যেন পুরুষত্ব নষ্ট হয় এবং ক্লীবত্ব হয়। ৭৯
ভগবান্ বলিলেন, প্রথম শৈশবাবস্থা, দ্বিতীয় কৌমারাবস্থা, তৃতীয় যৌবনাবস্থা, আর চতুর্থ বৃদ্ধাবস্থা। ৮০
প্রাণিগণ, তৃতীয় বয়োভাগ প্রাপ্ত হইলে, সকাম হইবে। দ্বিতীয় ভাগের অন্তেও কদাচিৎ হইবে। ৮১
প্রাণিগণ, উৎপন্ন হইবামাত্র যাহাতে সকাম না হয় এইরূপ নিয়ম তোমার তপস্যা প্রভাবে আমি জগতে স্থাপন করিলাম। ৮২
ত্রিজগতে আর কাহারও যাদৃশ সতীত্ব হইতে পারিবে না, তুমি তাদৃশ সতীত্ব প্রাপ্ত হও। ৮৩
তোমার পাণিগ্রহীতা ব্যতীত যে ব্যক্তি, কামভাবে তোমাকে দেখিবে–সে তৎক্ষণাৎ ক্লীব হইয়া দুৰ্বলত্ব প্রাপ্ত হইবে। ৮৪
তোমার স্বামী, মহাভাগ তপোরূপ-সমন্বিত এবং তোমার সহিত সপ্তকল্পান্ত-জীবী হইবেন। ৮৫
এইরূপ তুমি আমার নিকট যে সকল বর প্রার্থনা করিলে, আমি তাহা দিলাম। আর তোমার মনে যা ছিল, আমি তাহাও বলিয়া দিতেছি। ৮৬
তুমি, অগ্নিতে দেহত্যাগ করিতে পূৰ্বেই প্রতিজ্ঞা করিয়াছ, মেধাতিথি মুনির দ্বাদশবার্ষিক যজ্ঞে আহুতি- প্রজ্বলিত অনলে অবিলম্বে তাহা সম্পাদন কর। মেধাতিথি, এই পৰ্বতের উপত্যকা ভূমিতে চন্দ্রভাগা নদীতীরে তপসাশ্রমে মহাযজ্ঞ করিতেছেন। ৮৭-৮৯
আমার প্রসাদে তুমি তথায় মুনিগণের অলক্ষ্যে প্রচ্ছন্নভাবে গমন করিয়া উক্ত কাৰ্য্য সমাধা করিতে পারিবে। ৯০
অনন্তর বহ্নিসম্ভূতা হইয়া সেই মেধাতিথির দুহিতা হইবে। যে কোন ব্যক্তিকে তুমি স্বামী করিতে বাঞ্ছা কর, তাহাকে নিজ হৃদয়ে ধ্যান করত অনলে দেহ ত্যাগ করিবে। ৯১
সন্ধ্যে! যখন তুমি এই পৰ্বতে চতুর্যুগব্যাপী কঠোর তপস্যা করিতে থাক, তখন সত্যযুগ অতীত হইবে। ৯২
ত্রেতাযুগের প্রথম ভাগে দক্ষের কতকগুলি কন্যা উৎপন্ন হয়। তন্মধ্যে তিনি, সাতাইশটী কন্যা চন্দ্রকে সম্প্রদান করেন। ৯৩
অনন্তর, সেই সকল কন্যার জন্যই দক্ষ রোষাবেশে চন্দ্রকে শাপ দেন। তখন সকল দেবতারাই তোমার অতি নিকটেই আসিয়াছিলেন। ৯৪
তুমি আমার প্রতি একাগ্রচিত্ত হইয়াছিলে। তুমি ব্রহ্মা বা অন্য দেবতা কাহাকেও দেখিতে পাও নাই। তপঃপ্রভাবে তোমাকেও তাহারা দেখিতে পান নাই। ৯৫
বিধাতা, চন্দ্রের শাপমোচনাৰ্থ যখন এখানে চন্দ্রভাগা নদীর সৃষ্টি করেন, মেধাতিথি মুনি, তখনই আসিয়া উপস্থিত হন। ৯৬
তাঁহার তুল্য তপোনিষ্ঠ ব্যক্তি ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমানে নাই। তিনি মহা বিধানে জ্যোতিষ্টোম-যজ্ঞ আরম্ভ করিয়াছেন। ৯৭
সেই যজ্ঞে প্রজ্বলিত অনলে নিজ কলেবর পরিত্যাগ কর। ৯৮
হে তপস্বিনি। তোমার কার্যসিদ্ধির জন্য আমি এই সমস্ত ঘটনা ঘটাইয়া রাখিয়াছি। মহাভাগে। এখন নিজ কার্য সম্পাদন কর;–মহামুনির যজ্ঞে যাও। ৯৯
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–অনন্তর স্বয়ং নারায়ণ হস্তাগ্রদ্বারা সন্ধ্যাকে স্পর্শ করিলে, ক্ষণমধ্যে তাহার শরীর পুরোড়াশময় হইল। ১০০
মহামুনি মেধাতিথির সেই বিশ্বোপকারক যজ্ঞে অগ্নি যাহাতে ক্রব্যদাতা (অবৈধ-মাংসদাহকত্ব) প্রাপ্ত না হন, এই জন্যই নারায়ণ ঐরূপ করিলেন অর্থাৎ সন্ধ্যা-শরীরকে পুনরাডাশময় করিলেন। ১০১
জগন্নাথ, নারায়ণ এইরূপ করিয়া তথায় অন্তর্হিত হইলেন। সন্ধ্যাও মেধাতিথি মুনির যজ্ঞে গমন করিলেন। ১০২
অনন্তর, সন্ধ্যা, বিষ্ণুর প্রসাদে সকলের অলক্ষ্যে মেধাতিথি মুনির যজ্ঞে প্রবিষ্ট হইলেন। ১০৩
পূৰ্বে বসিষ্ঠ ব্রহ্মার আদেশে ব্রহ্মচারিবেশে সন্ধ্যাকে তপস্যা করিবার বিধি উপদেশ দেন। ১০৪
সেই তপস্যানুষ্ঠানের উপদেশক ব্রহ্মচারী ব্রাহ্মণকেই পতিভাবে মনে করিয়া ব্রহ্ম-নন্দিনী সন্ধ্যা, বিষ্ণুর প্রসাদে মুনিগণের অলক্ষ্যে সেই যজ্ঞীয় প্রজ্বলিত হুতাশনে প্রবেশ করিলেন। ১০৫-১০৬
অনন্তর, পুরোডাশময় সন্ধা-শরীর তৎক্ষণাৎ অলক্ষিতভাবে দগ্ধ হইয়া পুরোডাশের গন্ধ বিস্তার করিতে লাগিল। ১০৭
বহ্নি তাঁহার শরীর দগ্ধ করিয়া বিষ্ণুর অনুমতিক্রমে সেই বিশুদ্ধ দেহকে সূর্যমণ্ডলে স্থাপিত করিলেন। ১০৮
সূৰ্য সেই শরীর দ্বিধা বিভক্ত করিয়া পিতৃগণ ও দেবগণের প্রীতির উদ্দেশে নিজ রথে স্থাপিত করিলেন। ১০৯
হে দ্বিজোত্তমগণ! তদায় শরীরের ঊর্ধ ভাগ–দিবসের আদি ও অহো রাত্রের মধ্যগামিনী প্রাতঃসন্ধ্যা। ১১০
শেষভাগ–দিবসের অন্ত ও অহোরাত্রের মধ্যভাগিনী পিতৃগণের সতত প্রীতি-দায়িনী সায়ং-সন্ধ্যা হইল। ১১১
সূর্যোদয়ের পূর্বে যখন অরুণোদয় হয়, তখন দেবগণের প্রীতিদায়িনী প্রাতঃসন্ধ্যার উদয় হইয়া থাকে। ১১২
আর সূর্য অস্তমিত হইলে, রক্ত-কমল-সন্নিভা পিতৃপণের আনন্দ-বিধায়িনী সায়ংসন্ধ্যা উদিত হন। ১১৩
আর প্রভু বিষ্ণু, সন্ধ্যার প্রাণবায়ুকে দিব্য-শরীর ও মনঃসম্পর্কে শরীরী করিয়া মেধাতিথির যজ্ঞীয় অনলে স্থাপন করিলেন। ১১৪
অনন্তর, মুনি মেধাতিথি তাহাকে যজ্ঞাবসানে অগ্নিমধ্যে তপ্তকাঞ্চন-বৰ্ণা কন্যা রূপে প্রাপ্ত হইলেন। ১১৫
তখন মুনি, সেই কন্যাকে যজ্ঞীয় অর্ঘ্যজলে স্নান করাইয়া, সদয়ভাবে সানন্দে নিজ ক্রোড়ে গ্রহণ করিলেন। ১১৬
মুনি, তাহার নাম রাখিলেন “অরুন্ধতী”। এই কার্যে মুনিবর মেধাতিথি শিষ্যগণ সমভিব্যাহারে অত্যন্ত আনন্দলাভ করিলেন। ১১৭।
তিনি কোন কারণেই ধর্মরোধ করেন না, এই জন্য ত্রৈলোক্যবিখ্যাতা সেই “অরুন্ধতী” নাম তাহার অর্থপূর্ণ হইল। ১১৮
মহর্ষি মেধাতিথি, যজ্ঞ সমাপন করাতে কৃত-কৃত্য এবং তনয়া লাভে আনন্দিত হইয়া সেই নিজ আশ্রমে শিষ্যবর্গসহ নিরন্তর সেই কন্যাকেই লালন পালন করিতে লাগিলেন। ১১৯
দ্বাবিংশ অধ্যায় সমাপ্ত। ২২