অবনী তালুকদার বলছিলেন, জন্মালে মরতে তো হবেই। কপালে যার যখন লেখা আছে তখন তাকে চলে যেতে হয়। আমি কি করতাম! আমি ভাল নার্স রেখেছিলাম, আয়া ছিল। এসব করতে তো কম পয়সা খরচ হয়নি! আপনি খামোকা চেঁচাচ্ছেন!
চেঁচাচ্ছি? আমি চেঁচাচ্ছি? তোমার মুখ দেখতে ইচ্ছে করে না আমার। অমন সতীলক্ষ্মী বউটাকে যন্ত্রণা দিয়ে দিয়ে মেরে ফেলল গো! আবার এসেছে। তার শ্রাদ্ধের পিণ্ডি খাওয়ার নেমন্তন্ন করতে। আমি কোথাও যাই না এই বাড়ি ছেড়ে। বৃদ্ধা জানালেন।
দেখুন, আপনি যাবেন না জানি। এই বাড়ি তো যখের মত পাহারা দিতে হবে আপনাকে। আমি বেশি লোক নেমন্তন্ন করছিও না। আপনাদের তরফে আপনাকে নেমন্তন্ন করতে এসেছি নিয়মরক্ষার জন্যে। সেই কুলাঙ্গার থাকলে আমাকে আসতে হত না। অবনী তালুকদার এবার জোর করে খামটা বৃদ্ধার হাতে গছিয়ে দিলেন।
বৃদ্ধা বললেন, ছি ছি, একি ধরনের নেমন্তন্ন করা! এসব তুমিই পারো। টাকার পাহাড়ে বসে আছ, সব পোকায় কাটবে দেখে নিও। তা কুলাঙ্গারটি কে?
তিনি যে অপদার্থটিকে রেখে গিয়েছেন পৃথিবীতে! কি লজ্জার কথা, আমার বাড়িতে দিনরাত পুলিস আসছে! পাড়ার লোকজনের কাছে মুখ দেখানোর উপায় রইল না!
পুলিশ আসছে কেন? নতুন করে আবার কি করলে? সেবার তো কারা এসে গয়নাগাটি নিয়ে গেছে জোর করে! বৃদ্ধা মনে করে বললেন।
ওঃ, সেটাও তো ওই শ্রীমান করিয়েছেন। বাপকে বাঁশ দিতে হবে না? গোপনে গোপনে ইনকামট্যাক্সকে খবর দিয়েছেন যাতে বাপের কালো টাকা ধরা পড়ে। আরে আমি হলাম তোর বাপ। বনেদি রক্ত আমার গায়ে এটা তো মানেন? সব ছাড়িয়ে আনছি এক এক করে। তিনি তো হুমকি দিয়ে পার! ডাকাতি করছে, বুঝলেন? ডাকাতি! পুলিস তাই আমার কাছে খুঁজতে এসেছিল। আমি সোজা বলে দিয়েছি, ও ছেলের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই। যে আমার দুলাখ টাকা চুরি করে হাওয়া হয়েছে, সে মরুক বাঁচুক আমার কিছু আসে যায় না।
দু-লক্ষ! বৃদ্ধার চোখ বিস্ফারিত হল, সে দুলক্ষ টাকা পেল কি করে?
উঁকি দিয়ে দেখছিল ছাদের কার্নিশে এসে সুদীপ। তার মনে হচ্ছিল লাফিয়ে লোকটার সামনে দাঁড়ায়। সে দু-লক্ষ টাকা চুরি করেছে? কাগজে সই করিয়ে হিসেব রেখে ওর এক-তৃতীয়ংশ টাকা দিয়ে যে দায় চুকিয়েছে সে কি সহজে মিথ্যে বলছে! অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করছিল সে। নিজেকে প্রকাশ করা মানে আত্মহত্যা করা। কিন্তু সেইসঙ্গে তার হৃৎপিণ্ডের চারপাশে কম্পন শুরু হয়েছিল। বুড়ি যদি বলে দেয় সে বন্ধুকে নিয়ে এখানে আছে! নিশ্চয়ই এতক্ষণে অবনী তালুকদার জানেনি খবরটা। জানলে অত নিশ্চিন্ত হয়ে কথা বলতে পারত না। শোনামাত্র থানায় ছুটতো। অবনী তালুকদার তখন বলছে, আলমারিতে ছিল। একজনকে পেমেন্ট দেব বলে ব্যাঙ্ক থেকে তুলেছিলাম। আমাকে শ্মশান করে গিয়েছে সে।
বৃদ্ধা নিজের মনে বললেন, সে ডাকাতি করে?
মায়ের শিক্ষা, বুঝলেন! বেঁচে থেকে আমার হাড় জ্বালাতে এখন নিজের মত তৈরি করে একটি অপদার্থ রেখে গিয়েছেন। তা ইচ্ছে হলে যাবেন নইলে আর কি করা যাবে। তার আত্মার শান্তি চাই বলেই এইসব করছি। কথা শেষ করে যাওয়ার জন্যে ঘুরে দাঁড়ালেন অবনী তালুকদার।
হঠাৎ বৃদ্ধা শক্ত গলায় বললেন, শোন, তোমার মুখে পোকা পড়বে। মরবার সময় এক ফোঁটা জল দেবে না কেউ গলায়। অমন সোনার মেয়ের নামে যে কুৎসা করে তার কখনও শান্তি হবে না। মোটেই বিশ্বাস করি না তোমার কথা। ও ছেলে কখনও ডাকাতি করতে পারে না। তুমি মিথ্যে বদনাম দিচ্ছ। দূর হও এখান থেকে!
অবনী তালুকদারের চোখ জ্বলে উঠল, আপনার বাড়িতে এসেছি ভদ্রতাবোধে! অনর্থক আমাকে অপমান করছেন আপনি। এই আমার শেষ আসা। তবে আপনাকে বলে দিচ্ছি সে যদি এখানে কখনও আসে তাহলে পুলিশে খবর দেবেন।
আর দাঁড়ালেন না অবনী তালুকদার। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন বৃদ্ধা। সুদীপ উঠে দাঁড়াল। গলি থেকে অবনী তালুকদারের গাড়িটা বেরিয়ে গেল। এক পলকে নিজের কর্তব্য ঠিক করে নিল সুদীপ। একবার ঘরের দিকে তাকাল। বন্ধুদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনার দরকার নেই। সে সোজা নিজে নেমে এল। বৃদ্ধা তখনও একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। তাঁর কোরা থান আরও বিষণ্ণ করে তুলেছিল তাঁকে। সুদীপকে দেখতে পাওয়া মাত্র তিনি দ্রুতবেগে ভেতরে চলে গেলেন উলটো দিকে মুখ করে। সুদীপ এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে প্রথমে সদর দরজাটা বন্ধ করল। তারপর বারান্দায় উঠে সোজা দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। একটা সাবেকী আমলের খাট। ঘরে তেমন আসবার নেই। বৃদ্ধা সেই খাটে বসে আছেন মুখ ফিরিয়ে। সুদীপ পাশে গিয়ে দাঁড়াল, বাবা আপনাকে যা বলে গেল তা আমি শুনেছি। আপনি যদি ওসব কথা বিশ্বাস করেন তাহলে আমরা এই মুহূর্তে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। কথাটা বলেই সুদীপের খেয়াল হল, বুড়ি যদি চিৎকার করে তাদের চলে যেতে বলে, যদি অবনী তালুকদারের অভিযোগগুলো আওড়াতে থাকে তাহলে দেখতে হবে না। ডায়মন্ডহারবার রোড পর্যন্ত তাদের পৌঁছতে হবে না আর। কিন্তু তার কথার উত্তরে বৃদ্ধা কিছুই বললেন না। তার ভঙ্গিরও কোন পরিবর্তন ঘটল না। সুদীপ কি করবে বুঝতে পারছিল না। এই আশ্রয়টুকু সে কিছুতেই হারাতে চাইছিল না। অথচ ওই প্রশ্নটির উত্তর না পেলে এখানে থাকাটা মোটেই নিরাপদ নয়। সে আবার জিজ্ঞাসা করল, আমি কি করব বলে দিন।
হঠাৎ বৃদ্ধা উঠে দাঁড়ালেন, আমারই মাথার গোলমাল নইলে ডিম আনাই! আমার বাড়িতে বসে মায়ের কাজ করতে হবে। ছেলে বেঁচে থাকতে সে যদি কাজ না করে তাহলে মা কখনও শান্তি পায় না। অবনী যাই বলুক তাতে আমার কিছু যায় আসে না। সে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করছে, না করুণা করছে তা সে-ই জানে। মেয়েটাকে আমি ভালবাসতাম। কেউ যদি ডাকাতি করে কিংবা বাপের টাকাপয়সা কেড়ে নিয়ে আমার কাছে আশ্রয় চায় তাহলে তাকে আমি আশ্রয় দেব না। কিন্তু ওই মেয়ের ছেলে বলেই থাকতে দিয়েছি, মনে থাকে যেন। কথাগুলো বলে তিনি তার রান্নাঘরে ঢুকে ডিমগুলো বের করলেন। বোঝাই যাচ্ছিল হয় ফেলে দেবেন নয় কাউকে দিয়ে দিতে চান।
সুদীপ চটপট বলল, ঠিক আছে, এখন যদি ডিম খেলে আপত্তি থাকে তাহলে পরে খাওয়া যাবে। কিংবা আমার বন্ধুরা তো কোন দোষ করেনি, ওদের মা-ও মারা যায়নি, ওরা তো খেতে পারে।
বৃদ্ধা দাঁড়ালেন। প্রস্তাবটা যেন তার অপছন্দ হল না। শেষ পর্যন্ত ডিমের প্যাকেটটা মাটিতে নামিয়ে রেখে ফিরে যেতে যেতে বললেন, যে খাবে খাক। আমি রাঁধতে পারব না। আমার বাড়িতে কাজ হবে আর আমি ডিম বাঁধব?
আপাতত ঝড় উঠল না। সুদীপ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর ডিমের প্যাকেটটা তুলে উপরে উঠে এল। ওকে দেখামাত্র আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে?
ওদের উদ্বিগ্ন মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে সুদীপ বলল, কেস খুব সিরিয়াস। অবনী তালুকদার এসেছিল শ্রাদ্ধের নেমন্তন্ন করতে! আমার নামে বহুৎ স্টোরি বলে গেল। ওসবের একটা যদি বুড়ি বিশ্বাস করে তাহলে এখান থেকেই আমাদের থানায় যেতে হবে।
সে কি! কল্যাণ প্রায় সাদা হয়ে গেল, অবনী, মানে তোর বাবা, আমাদের এখানকার খবর জেনে গেছেন?
খুব কপাল জোর, বুড়ি ওকে কিছু বলেনি। আশ্চর্য জালি পার্টি মাইরি, নেমন্তন্ন করতে এসে বলছে গেলেও চলবে! জয়ী, ডিমগুলো নে। বুড়ি আমাদের জন্যে আনিয়েছিল। মায়ের কাজ না হওয়া পর্যন্ত আর ছোঁবে না। দেখব তুই কি বকম ডিমের কাবি করতে পারিস। চা বানিয়েছিস? সুদীপ সিগারেট ধরাল।
জয়িতা চুপচাপ সুদাপের কথাগুলো শুনছিল। ও যেভাবে চুপচাপ নেমে গেল তাতেই ওদের উদ্বেগ বেড়ে গিয়েছিল। একটা লোক এসে বৃদ্ধার সঙ্গে কথা বলছে উত্তেজিত ভঙ্গিতে, এইটে স্বস্তিদায়ক ছিল না। কিন্তু এখন সুদীপের কথার ধরনে ওর সর্বাঙ্গ জুলে গেল। সে সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করল, সুদীপ, এখানে আরও দুজন বসে আছে। তুই শুধু আমাকে কেন জিজ্ঞাসা করলি ডিমের কারি বাঁধতে কেমন পাবি?
সুদীপ একটু হকচকিয়ে গেল। তারপর হেসে বলল, তুই কাছাকাছি বসে আছিস, তাই।
জয়িতার ঠোঁট বেঁকে গেল, সত্যি কথাটা বলার সাহসটুকু তোদের নেই। রান্নার ব্যাপার হলেই মেয়েদের ওপর হুকুম চালাতে হবে, না? তোর মা পিসী, দিদিও হয়তে, জন্মেছিলেন যখন তখন তাদের বাধ্য করা হয়েছিল ঠাকুরের কাজ করতে। সেই অসেটা তোদের রক্তে রয়ে গেছে। কিন্তু খাওয়াটা যখন তোর আমার সমান প্রয়োজন তখন খাবার তৈরি করার দায়িত্ব দুজনেরই। আজ ডিমটা তুই রান্না করবি, আমি চা করছি।
আনন্দ হেসে ফেলল। কথাগুলো কল্যাণকে সুখী করল না। সুদীপ বলল, আমি কোনদিন রান্নাঘরে ঢুকিনি।
জয়িতা চায়ের ব্যবস্থা করতে করতে উত্তর দিল, তুই এর আগে কখনও মানুষ মারিসনি কিংবা বোমা ছুঁড়িসনি। সরি, সংশোধন করছি, মানুষ নয়, তুই অমানুষ মাবিসনি! অর্থাৎ কখনও করিনি বলে করা যায় না, তা ঠিক নয়!
আনন্দ বলল, কেন ওকে এমন বলছিস জয়ী! একেই বেচারার ওপর সব চেয়ে বেশি চাপ পড়ছে!
সুদীপ হাত তুলল মাইরি, এই বয়স অবধি সংসারের জন্যে যা করিনি দুদিনে তার চেয়ে বেশি করলাম! তুই চিন্তা কর, বাজার করে বাড়ি নিয়ে আসছে আমার মত ছেলে!
জয়ী বলল, নিজেদের জন্যে কিছু করলে যদি মান যায় তাহলে সে কথাটা শেষ না করে নীরক্ত হাসল। তারপর চা ঢালতে ঢালতে বলল, এখনও যখন রাস্তায় বুড়ো ভামগুলোকে মহিলাদের মেয়েছেলে বলে অ্যাড্রেস করতে দেখি তখন ঠাস করে চড় মারতে ইচ্ছে করে। একটা ছেলে প্রেম করার সময় যে সম্মান মেয়েটিকে দেয় বিয়ের পর কিন্তু বিনা মাইনের ঝি-কাম-ঠাকুর ছাড়া কিছু ভাবতে পারে না। ইন্দিরা গান্ধী প্রাইম মিনিস্টার হওয়ার পরও এক ফোঁটা পালটায়নি এই মানসিকতা। ও ডিমগুলো নিয়ে এসে বলতে পারত, আমাদেরই রান্না করে খেতে হবে। কিন্তু বলল, দেখব কিরকম ডিমের কারি করতে পারিস! একটু তাতানো ব্যাপার আছে। যেন আমি তেতে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপ্ট করব। তাতে রান্নার প্রব্লেমটা মিটবে। তুই ভাব, কত বড় চালাকি! যতই প্রগতির কথা বলিস সুদীপ, মেয়েদের ব্যাপারে তোদের মনে একটাই ক্যাসেট ফিট করা আছে।
চা ভাগ করে সে তিনজনকে দেয়। সবাই চুপচাপ সেটা খাচ্ছিল কিন্তু সুদীপ হাসল, এটা খুব জেনুইন, আমি না বলে পারছি না। তুই যা মনে করিস করতে পারিস।
প্যাম্পারিং কথা একদম বলবি না সুদীপ। আই ডোন্ট ওয়ান্ট দ্যাট! জয়িতা মুখ ফিরিয়ে চায়ে চুমুক দিতে গেল প্রথমবার।
সুদীপ বলল, আমি জানি না এটাকে ঠিক প্যাম্পারিং কথার মধ্যে ফেলা যায় কিনা! সবাই ওর দিকে উগ্রীব হয়ে তাকাল। কল্যাণের ঠোঁটের সঙ্গে আনন্দর ঠোঁটের অভিব্যাক্তির মিল দেখে খুশী হয়ে সুদীপ উচ্চারণ করল, পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট চায়ের স্বাদ পাওয়ার সৌভাগ্য দেবার জন্যে নির্মাতা হিসাবে তুই আমার আন্তরিক অভিনন্দন গ্রহণ কর।
সঙ্গে সঙ্গে কল্যাণ গলা ফাটিয়ে হেসে উঠতেই আনন্দ চাপা গলায় ধমকে উঠল, আই আস্তে!
সত্যি চা খাওয়া যাচ্ছিল না। রাগ মিলিয়ে গিয়ে ক্রমশ লজ্জা আচ্ছন্ন করল জয়িতাকে। অন্যের জন্যে না হোক নিজের জন্যেও তো লোকে একটু ভাল করে চা করতে শেখে! এমন লাউজি চা সে জীবনে খায়নি! এই বয়স পর্যন্ত তাকে কেউ রান্নাঘরে যেতে বলেনি, তার নিজেরও প্রয়োজন হয়নি। সে ঠিক করল এর পরের বার সিরিয়াসলি ভাল চা করবে। কল্যাণ এবং আনন্দ খানিকটা খেয়ে নামিয়ে রেখেছে কিন্তু সুদীপ পুরোটা শেষ করল। এইটেতেই রাগ হল আবার জয়িতার। স্রেফ বদমাইসি! ওকে টিজ করার জন্যে সুদীপ পাঁচনটা খেল! যা নিজে জয়িতা খেতে পারছে না তা ফেলে দিলেই সে খুশী হত। সুদীপের পুরোটা খাওয়া যেন তাকে যন্ত্রণা দেওয়া। সে পাত্রটা রেখে সুদীপকে বলল, কখনও কখনও উদারতা দেখানো খুন করার চেয়ে বড় অপরাধ, বুঝলি!
বুঝলাম। প্যাকেট থেকে কল্যাণ আর জয়িতাকে দুটো সিগারেট ছুঁড়ে দিয়ে সুদীপ বলল, আনন্দ, একটা ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অবনী তালুকদারের সঙ্গে কথা বলার পর বুড়ির মাথায় ঢুকেছে যে মায়ের কাজটা আমাকে এখানেই করতে হবে। ইটস্ সামথিং!
কল্যাণ অবাক হল, সামথিং কেন? মায়ের কাজ করতে অসুবিধে কোথায়?
সুদীপ ঠোঁট কামড়াল, প্রথমত, আমি মনে করি না শ্রাদ্ধ করলেই একটি মৃত মানুষ শান্তি পাবেন। দ্বিতীয়ত, যে মানুষটার কষ্ট জীবিত অবস্থায় দুর করা আমার সাধ্যাতীত ছিল বলে এড়িয়ে গেছি, সেই মানুষটির শ্রাদ্ধ করে শান্তির ব্যবস্থা করা আমি অপরাধ বলে মনে করি।
কল্যাণ বলল, কিন্তু তোর কোন সংস্কার না থাকতে পারে, বুড়ির হয়তো আছে।
সুদীপ মাথা নাড়ল, সে থাকুক। কিন্তু আমি তো এর সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছি। এখন অবনী তালুকদার যে ধান্দায় তার স্ত্রীর কাজ করতে যাচ্ছেন আমার কাজ করা তা থেকে কি খুব আলাদা?
এই প্রশ্নের জবাব চট করে কেউ দিল না। শেষ পর্যন্ত জয়িতা বলল, ঠিক আছে, তাহলে রাজী হোস না!
রাজী না হলে হয়তো ছাদের এই ঘর আমাদের ছাড়তে হবে। অবনী তালুকদার বুড়িকে বলে গেছে, আমরা ডাকাত, পুলিশ খুঁজছে। বুড়ি সেকথা বিশ্বাস করেছে কিনা জানি না। কিন্তু ওর এই ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেলে কিছুতেই সহ্য করবে না। শালা উভয় সংকট! নেমন্তন্ন না করতে আসলে যেন চলছিল না!
এবার আনন্দ বলল, দ্যাখ সুদীপ, তোর বিবেক যা বলবে তুই তাই কর।
সুদীপ কিছু বলল না। ও চুপচাপ সিগারেট খাচ্ছিল। ভেতরে ভেতরে যে প্রচণ্ড আলোড়ন চলছে ওর তা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। ঠিক তখনই সিড়িতে গলার শব্দ পাওয়া গেল, এই যে, নিচে একটু আসলে কি মান যাবে? যত ঝামেলা আমাকেই কি করে খুঁজে পায় কে জানে!
আনন্দ বলল, তাড়াতাড়ি যা নইলে ওপরে উঠে আসবে।
সুদীপ সিগারেটটা নিবিয়ে উঠে পড়ল। সিঁড়ির তিনটে ধাপ ওপরে দাঁড়িয়ে ছাদের দিকে তাকিয়েছিলেন বৃদ্ধা। সুদীপকে দেখতে পেয়ে বললেন, আমি একটু ঠাকুরবাড়িতে যাব, পুরুতকে জিজ্ঞাসা করতে হবে কি কি করা উচিত। দরজাটা বন্ধ করবে, নাকি তালা দিয়ে যাব? চোর-ছ্যাঁচোড়ের উৎপাত চারধারে, আমি বেরুচ্ছি দেখলে সবার জিভ দিয়ে জল ঝরবে!
সুদীপ বলল, ঠিক আছে, আমি ভেতর থেকেই বন্ধ করে দিচ্ছি। সুদীপ নেমে এল।
বৃদ্ধা বললেন, কেউ এলে বলবে দুঘণ্টা পরে ঘুরে আসতে। বৃদ্ধা উষ্ণ আবহাওয়াতেও গায়ে চাদর রেখেছেন। এই পোশাকে তাকে অন্যরকম দেখাচ্ছিল। দরজা খুলে বের হওয়ার আগে জিজ্ঞাসা করলেন, দ্যাখো বাবু, সব তোমার ওপর জিম্মা রেখে যাচ্ছি। বাড়ি থেকে বেরিও না আর চোখ কান খোলা রেখ।
বৃদ্ধা চলে গেলে দরজা বন্ধ করে সুদীপ উঠোনের মাঝখানে চলে এল। এর মধ্যেই ঝাট দিয়ে সিগারেটের টুকরোগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বুড়ি যা চাইছে তা করলে এখানে আরও কয়েকটা দিন থাকা যাবে। কারও শ্রাদ্ধ করার সময় তো মাথা কামিয়ে ফেলতে হয়, ন্যাড়া হলে তাকে চেনা যাবে? এখনই খবরের কাগজের ছবির সঙ্গে তার মিল পাওয়া বেশ কষ্টকর ব্যাপার। তার ওপরে মাথা কামালে আর কোন চান্স থাকবে না। অবনী তালুকদার রাজী হয়েছেন কাজ করতে চক্ষুলজ্জার ভয়ে। কিন্তু তাকে রাজী হতে হবে আত্মরক্ষার জন্যে। সুদীপ সিগারেট ধরাল আবার। এই কদিন খুব ঘন ঘন সিগারেট খাওয়া হয়ে যাচ্ছে। এই সময় দরজায় শব্দ হল। কেউ ওখানে ধাক্কা দিয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করছে। এগিয়ে গিয়ে সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, কে? কি চাই?
ওপাশ থেকে মহিলাকণ্ঠে জানান এল, দিদিমাকে একটু ডেকে দিন তো। নিমপাতা নেব।
দিদিমা নেই। দুঘণ্টা পরে ডাকলে পাওয়া যাবে। সুদীপ এড়াতে চাইল।
দুঘন্টা পরে আবার উনুন জ্বালবে কে? দুটো নিমপাতার জন্যে দুঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে? দরজাটা খুলে দিলেই তো হয়, কয়েকটা ছিঁড়ে নিয়ে আসি। আমি তো চোর ডাকাত নই, একি রে বাবা! মহিলা হেসে উঠলেন।
সুদীপ বুঝতে পারল সকালে যে ডিম দিয়েছিল সেই এখন নিমপাতা চাইছে। এই অবস্থায় কি করা উচিত? দরজা না খুললে কি সন্দেহ করবে? পুকুর থেকে তো ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখেছে। নিমপাতা নিয়ে চলে গেলে তো ঝামেলা চুকে যাবে। সে এগিয়ে হুড়কো খুলতেই মেয়েটিকে দেখতে পেল। হাতকাটা নীল জামা, নীল শাড়ি, খোলা চুলে যে ভাবে তাকাল তাতে রহস্যময়ী শব্দটাকে মনে পড়ল সুদীপের। খোলা দরজা দিয়ে পা ফেলে ভেতরে ঢুকে মেয়েটি নিমগাছের নিচে দাঁড়াল। কোমরে হাত রেখে ওপরের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি বলল, ডালগুলো অত ওপরে চলে গেল কি করে?
সুদীপ দেখল নিমগাছের ডালগুলো মেয়েটির নাগালের বাইরে! এখন অবশ্য আর ওকে মেয়ে বলে মনে হচ্ছে না। শরীর যে কোন সুখী যুবতীর মত ভাবী। সে বলল, নিমপাতা পাড়তে হলে একটা বাঁশ দরকার।
তাই? যুবতী যেন হেসে ভেঙে পড়ল। তারপর কোনরকমে নিজেকে সামলে বলল, আপনি বাঁশটা আনবেন? দিন না দুটো নিমপাতা পেড়ে, বেগুন দিয়ে ভেজে খেতে যা ভাল লাগে!
সুদীপ হাসিটাকে অগ্রাহ্য করল। তারপর চারপাশে তাকাল একটা কিছুর জন্যে। সে মাথা নাড়ল, না, কিছুই তো দেখছি না।
আপনি গাছে উঠুন না। মই লাগবে?
উঠলে তো মইটা কেড়ে নেবেন! সুদীপের রসিকতা করার লোভ হল।
ওমা, তাই বুঝি, এত জানেন! দিদিমা কোথায় গেলেন?
জানি না। দুঘন্টা পরে ফিরবেন বলে গেছেন।
ওমা, তাহলে আমার নিমপাতা খাওয়া হবে না?
অন্য কাউকে বলুন পেড়ে দিতে।
আমার কথা কে শুনবে বলুন। কর্তা গেছেন চাকরিতে, ফিরতে ফিরতে সেই রাত। ততক্ষণ আমি একদম একা।
এইবার বিরক্ত হল সুদীপ। এমন ন্যাকা ন্যাকা কথা শুনতে তার একটুও ইচ্ছে হচ্ছিল না। সুদীপ বলে ফেলল, আপনার ললাকের অভাব আছে বলে মনে হয় না। পুকুরধারে ঘুরে আসুন না।
গালে হাত দিল যুবতী, ওমা, এত হিংসে! ও ছোঁড়া আমাকে নিয়ে গিয়েছিল ওখানে ডেকে একটা গল্প বলতে।
গল্প বলতে? আর জায়গা পেল না? সুদীপ হাসল।
কি করব বলুন! আমাদের পাশের ঘরের ভাড়াটে কান জানেন না তোর আমি কিছু করলেই দিদিমাকে লাগায়। সেই গল্প যদি কানে যেত তো হয়ে গিয়েছিল আর কি!
কিসের গল্প? সুদীপ সুত্রটা বুঝতে পারছিল না।
ওই যে প্যারাডাইস বলে যে জায়গাটায় আগুন লাগল, কাগজে পড়েননি? সেই জায়গায় ঠিক কি কি হত তার গল্প। বাবা, শুনেই আমার শরীর গুলিয়ে উঠেছিল। ছা! আপনি ভাবলেন ওর সঙ্গে আমার বুঝি খু-উ-ব! ধ্যাৎ! ও তো আমার হাঁটুর বয়সী। আপনি এখানে কতদিন থাকবেন?
দেখি। ছুটি ফুরিয়ে গেলেই চলে যাব!
কতদিনে ছুটি ফুরোবে? আপনি এখানেই থেকে যান না, দিদিমার বয়স হয়েছে, একা থাকা ঠিক না।
এখানে থেকে আমার লাভ কি? প্যারাডাইসের কথাটা শোনামাত্র বুক ঢিপঢিপ করছিল সুদীপের।
লাভ? ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। আগে দেখুন আপনার ইচ্ছে আছে নাকি। আর উপায় হলে দেখবেন এত লাভ হবে সামলাতে পারবেন না। আপনি ছাদের ঘরে থাকেন, না?
হ্যাঁ।
পরে আপনার সঙ্গে দেখা করব। আপনি নিমপাতা পেড়ে দিলেন না, কি নিষ্ঠুর আপনি! চলি। একরাশ হাসির শব্দ ছড়িয়ে মেয়েটি চলে গেল।
এরকম যুবতীর গল্প একমাত্র উপন্যাসেই পাওয়া যায় বলে ধারণা ছিল সুদীপের। শরৎচন্দ্রের কিরণময়ী কি এই বকম? এই ঠাবেইরে কথাবার্তা, অকারণ হাসি, কথাব চেয়ে চোখ আর ঠোঁটের ব্যবহারে বেশি অর্থ বোঝনো। অথচ এই যুবতী বিবাহিতা। গতকাল আর একটি পুরুষের সঙ্গে অত্যন্ত অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখা গেছে। একেই কি আগের যুগের মানুষ কুলটা বলত? মেয়েরা কখন কেন এমন হয়? এই আচরণে যখন শিক্ষাব পালিশ লাণে, বুদ্ধির ব্যবহার হয় এবং বিত্তের সম্মান জোটে তখনই যুবতীরা প্যারাডাইসের সদস্যা হয়ে যায়, কলকাতার বিভিন্ন ক্লাবে বয়ফ্রেন্ড পরিবৃত হয় অথবা কাজের অছিলায় দার্জিলিং-এ বেড়াতে যায় নিজস্ব মানুষের সঙ্গে। রাগ হল না, বরং এক ধরনের কষ্টবোধ হল যুবতীর জন্যে। কোথাও নিশ্চয়ই একটা ছোট্ট ফাঁক ছিল, সেটাই ওষুধের অভাবে বড় হতে হতে একটা অতল খাদ হতে চলেছে।
দরজাটা বন্ধ করে সুদীপ ওপরে উঠে এল। ছাদের মাঝখানে দাঁড়ালে আশপাশের বাড়ি তেমন দেখা যায় না গাছগাছালির জন্যে। কিন্তু তার নজর পড়ল নিমপাতাগুলোর ওপর। গাছটা ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে ওপরে উঠেছে। এখান থেকে হাত বাড়ালেই পাওয়া যাবে। ওই তেতো পাতা কারও কাছে এত লোভনীয় যা নিতে সব সময় রসের ফোয়ারা ছোটে? গণ্ডীর বাইরে গেলেই কত কি দেখা যায়।
জয়িতা ঠোঁট টিপে হাসছিল। কল্যাণ জিজ্ঞাসা করছিল, কেসটা কি?
সুদীপ বলল, বুড়িকে বলে দিলাম রাজী আছি। বুড়ি যা চাইছে তা করতে দিলে কদিন এখানে নিশ্চিন্তে থাকা যাবে। তাছাড়া আমি ভাবছি কাজ করলে নিশ্চয়ই মাথা কামাতে হয়। আর সেটা করলে অবনী তালুকদার পর্যন্ত আমাকে চিনতে পারবে না। সুদীপ আড়চোখে স্টোভের দিকে তাকাল। ওটা নেবানো।
জয়িতা বলল, এতক্ষণ আমরা চল্লিশ দশকের বেডিও নাটক শুনছিলাম। তোর নায়িকা দেখতে কেমন রে?
মানে? সুদীপ হকচকিয়ে গেল!
বাঃ, এমন ন্যাকামি করিস না, এইসব আক্টিং ব্যাকডেটেড হয়ে গেছে ভাই। জয়িতা মন্তব্য করল।
কি আশ্চর্য! ইউ শুড নট ইউজ দিজ ল্যাঙ্গুয়েজেস! ওই মহিলা যদি নিমপাতা চাইতে আসেন তাহলে আমি কথা বলতে বাধ্য। তা না হলে সোজা ছাদে উঠে নিমপাতা পাড়তো, সেটা নিশ্চয়ই সেফ ছিল না!
চটছিস কেন? কলেজে তে প্রচুর মেয়ের সঙ্গে কথা বলতিস, তখন ঠাট্টা করলে চটতিস না।
প্রত্যেকটা জিনিসের একটা লিমিট আছে! এই মহিলা বিবাহিতা।
এবার কল্যাণ বলল, তাই? ডায়লগ শুনলে একদম বোঝা যায় না মাইরি! ডেঞ্জারাস।
আনন্দ বলল, ওয়েল বয়েজ! প্রচুর হয়েছে। তবে এই মহিলাকে এড়িয়ে যাওয়াই আমাদের মঙ্গল। যাক, আয় এবার কাজের কথা বলি। আজ রেস-ডে। আমাদের একজনের রেসকোর্সের সামনে যাওয়া উচিত। রেসকোর্সের ভেতরে ঢুকব না। পুলিশ নিশ্চয়ই সেখানে ওয়াচ করবে। একটা ট্যাকসি নিয়ে পাক খাৰি। ট্যাকসি ড্রাইভার যেন সর্দারজী হয়। সর্দারজীরা বাংলা ইংরেজী কাগজ পড়বে না বলে মনে হয়। তারপর একটা নির্জন টেলিফোন বুথ থেকে প্রত্যেকটা মেজর খবরের কাগজকে টেলিফোনে জানাতে হবে যে সব মানুষ বুঝতে পেবেছেন আমরা যা করতে চলেছি তাতে আমাদেব একমাত্র স্বার্থ এদেশটা বাসযোগ্য করা–তাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, আমরা তাদের অনুরোধ করছি এগিয়ে এসে প্রতিবাদ করতে।
জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, আমি যাব?
সঙ্গে সঙ্গে সুদীপ মাথা নাড়ল, না। একটা কেলেঙ্কাবি না বাধালে আর তোমার চলছে না! কখন বের হব?
তুই যাবি? আনন্দ জিজ্ঞাসা করল।
হ্যাঁ। তোর এখান থেকে বের হওয়া উচিত হবে না। আমি যাওয়া আসা করতে করতে পাড়ার লোকের চোখ-সওয়া হয়ে গেছি। একটা নাগাদ বের হলেই হবে না?
হ্যাঁ। কাগজে লিখেছে রেস আরম্ভ বেলা দুটোয়। বুড়ি কোথায় গিয়েছে?
পুরুতের কাছে।
তাহলে কল্যাণ, তুই আর জয়ী চট করে স্নান সেরে আয় না নিচ থেকে। তাহলে এ ওপরে বেশি জল আনতে হয় না। সুদীপ তুই লক্ষ্য রাখ বুড়ি আসছে কিনা! আনন্দ বলল। এই সাতসকালে স্নান করতে ওদের মন ছিল না। কিন্তু কিছু করার যখন নেই তখন স্নান করা ভাল। জয়িতা, কল্যাণকে জিজ্ঞাসা করল, তুই নিজে স্নান করতে পারবি? চল, আমি জল ঢেলে দিচ্ছি।
ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিল কল্যাণ। এক হাতে প্লাস্টাব নিয়ে স্নান করা সত্যিই অসুবিধাজনক। কিন্তু সাহায্য করার প্রস্তাবটা যে জয়িতার কাছ থেকে আসবে তা অনুমান করতে পারেনি। সে চট করে বন্ধুদের দিকে তাকাল। কারও মুখে কোন প্রতিক্রিয়া নেই। এবং তখনই নিজেকে খুব ছোট মনে হল তার। জয়িতাকে সে এখনও মনে মনে একটি মেয়ে ভেবেই যাচ্ছে। এই ভাবনার কথা জয়িতা জানালে প্রচণ্ড ক্ষেপে যাবে। কল্যাণ বোঝে উত্তর কলকাতার নিম্ন মধ্যবিত্ত পাড়ায় আজন্ম কাটিযে তার মধ্যে যেসব সংস্কার শিকড় ছড়িযেছে সেগুলোকে টেনে ওপড়ানো সত্যিই সহজসাধ্য নয়।
ওরা নিচে নেমে গেলে আনন্দ আবার কাগজে চোখ রাখল। সুদীপ কাগজগুলো আনবার পর থেকে সে প্রতিটি খবর খুঁটিয়ে পড়েছে। কেন্দ্র থেকে বরাদ্দ টাকা কাজ না করায় ফেরৎ গেছে, কেন্দ্রের কাছে অন্য খাতে টাকা চেয়ে রাজ্য বঞ্চিত হচ্ছে, সরকার তার স্বার্থানুযায়ী চলছে, কংগ্রেসীরা প্রকাশ্যে ঝগড়া করছে নিজেদের মধ্যে। এছাড়া কোন উল্লেখযোগ্য সংবাদ না থাকলেও একটি ছোট্ট খবরে তার চোখ আটকাল। কলকাতার একজন বিখ্যাত স্মাগলার বিশেষ এলাকায় সাম্রাজ্য তৈরি করেছে। সেই সাম্রাজ্যে বিদেশী নাগরিকরা পাসপোর্ট ভিসা ছাড়াই আশ্রয় পেয়েছে। এই স্মাগলারটি মাঝে মাঝে কলকাতায় দাঙ্গা সৃষ্টি করে। এক একটি দাঙ্গার পরিণতিতে তার এলাকার বেশ কিছু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ি ফাঁকা হয়ে যায়। সেই বাড়িগুলো লোকটি বেশি টাকায় ভাড়া দিয়ে থাকে। সরকার এসব তথ্য জানেন। স্থানীয় দুটো থানার সঙ্গে লোকটির দারুণ ভাব-ভালবাসা আছে। এটা থাকার কারণ একজন প্রগতিবাদী মন্ত্রী নাকি লোকটির গডফাদার হয়ে আছেন। তাকে নির্বাচিত করার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েছে স্মাগলারটি। খবরটা বেরিয়েছে যে কাগজে তার পরিচয় এবং প্রচার খুব বেশি নয়। খবরটা পড়ার পর থেকেই আনন্দর মাথায় অনেক কিছু পাক খাচ্ছিল। প্রথম কথা, এই খবরটা সত্যি তার প্রমাণ পাওয়া দরকার। দ্বিতীয়ত, প্যারাডাইস অপারেশনে নামবার আগে সে পরবর্তী কার্যক্রমের তালিকা করেছিল। সেই তালিকানুযায়ী এগিয়ে যেতে হবে যতক্ষণ না কোন বিপদ ঘটে। সেই তালিকায় একজন মন্ত্রীর নাম ছিল। তিনি গত চার বছর প্রায় থোলাখুলি ঘুষ নিয়েছেন তার পার্টির নাম করে। সেই টাকা পার্টির নাম করে নেওয়া যেমন বেআইনি তেমনি সেই টাকা তিনি পার্টি ফান্ডে জমা দেবার প্রয়োজন বোধ করেননি। অথচ ভদ্রলোক প্রতিটি জনসভায় জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন বুর্জোয়া শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, পুঁজিপতি এবং শোষকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে আহ্বান জানান। এই লোকটির মুখোশ খুলে দেবার প্রয়োজন বোধ করেছিল তারা। আনন্দ এখন উত্তেজিত হচ্ছিল এই দেখে যে ওই মন্ত্রী যে এলাকা থেকে নির্বাচিত হন স্মাগলারটির সাম্রাজ্য সেখানেই।
আজ দুপুরেও নিরামিষ তরকারি আর ভাত। যদিও স্টোভে ডিম সেদ্ধ করা হয়েছিল বলে সুদীপ একটু খুশী হয়েছিল। কিন্তু তার কোন প্রয়োজন ছিল না। বৃদ্ধা সত্যিই চমৎকার রান্না করেন। এখনও তিনি জানেন না তার ছাদের ঘরে কজন রয়েছে। তিনি যে ওপরে ওঠেন না এটাই সৌভাগ্য। আজও নিচ থেকে খাবার ওপরে আনার ব্যাপারে সুদীপকে ছলচাতুরির আশ্রয় নিতে হয়েছে। আনন্দর অনুমান, বৃদ্ধা সন্দেহ করতে শুরু করেছেন। সে সুদীপকে বলেছে জয়িতার কথা না বলে বৃদ্ধাকে জানিয়ে দিতে তারা কজন ওপরে আছে। এতে আর যাই হোক ওঁর সঙ্গে সম্পর্ক পরিষ্কার থাকবে। উনি যখন অবনী তালুকদারকে কিছু জানাননি তখন এটা শোনার পর বিপদের সম্ভাবনা আধাআধি। সুদীপ রাজী হয়েছে। ও বিকেলবেলায় বুড়িকে বলবে।
ঠিক একটায় সুদীপ বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় জয়িতা বলল, সাবধানে যাস, কোন ঝুঁকি নিস না।
সুদীপ হেসে বলেছিল, আমার কখনও বিপদ হবে না। কারণ বিপদটাকে আমি কখনও বিপদ বলে মনে করি না।
খাওয়া গল্প করা এবং ঘুমানো। এছাড়া আর কোন কাজ নেই। এমন কি ওই ছাদে দাঁড়ানোর উপায় নেই। আনন্দ বুঝতে পারছিল জয়িতা এবং কল্যাণ ক্রমশ হাঁপিয়ে উঠেছে। এই ঘরটাকে জেলখানা না ভাবার কোন কারণ ওদের নেই। সে নিজেও একঘেয়েমির শিকার হচ্ছিল। এইভাবে বেশিদিন এই ঘরে আটকে থাকা সম্ভব হবে না। কিন্তু কলকাতা শহরের কোন পথ তাদের জন্যে নিরাপদ নয়। সে অনেক চিন্তা করেছে। কেউ তাদের আশ্রয় দিতে সাহস পাবে না। অথবা দিলেও তারা নিজেদের নিরাপদ বলে মনে করবে না। একটা ব্যাপার ওর কাছে খুব চমকপ্রদ মনে হচ্ছে। বড় বড় খুনের অপরাধীদের এখানকার পুলিশ ইচ্ছে করলেও খুঁজে বের করতে পারে না। অথচ কত দ্রুত ওরা সন্ধান পেয়ে গেল এই ক্ষেত্রে। কলকাতার পুলিশ.এত তৎপর হবে সে কল্পনা করেনি। বোঝাই যাচ্ছে চাপ আসছে ওপর থেকে, যাদের স্বার্থ বিপন্ন হতে পারে এই রকম অপারেশন একটার পর একটা চললে।
কিন্তু আপাতত কিছুদিন পুলিশের থাবার বাইরে যাওয়া দরকার। গত এক বছর ধরে এই রকম একটা জায়গা খুঁজেছে সে যেখানে অজ্ঞাতবাস করা যায়। মোটামুটি একটা ছক করে নিয়েছে সে। যদি জায়গাটায় পৌঁছানো যায় তাহলে আর যাই হোক অন্তত ভারতীয় পুলিশের ভয় থাকবে না। বেশ কিছুদিন কাটানোর পর যখন এদিকের হাওয়া শান্ত হয়ে আসবে, আরও নতুন ঝামেলায় পুলিশ ব্যস্ত হয়ে পড়বে তখন আবার ফিরে আসা যাবে। কিন্তু সেই গন্তব্যস্থানটিতে যেতে অনেক দূরত্ব পার হতে হবে। চারজন একসঙ্গে গেলে আর পৌঁছাতে হবে না। দুটো দলে ভাগ হয়ে তাদের যেতে হবে। কিন্তু যাওয়ার আগে প্রস্তুত হয়ে যেতে হবে।
দ্বিতীয় ইংরেজি উপন্যাসটি পড়ছিল জয়িতা। কল্যাণ পাশ ফিরে ঘুমোচ্ছ। আনন্দ ডাকল, জয়ী, তোরা ঘণ্টা তিনেক একা থাক। আমি বাইরে থেকে শেকল টেনে যাচ্ছি, সাড়াশব্দ করিস না।
কোথায় যাচ্ছিস? জয়িতা বইটা সরিয়ে রাখল।
একটু চক্কর মারতে। আনন্দ সেই মন্ত্রীর নাম করল, এই কাগজটা পড়ে দ্যাখ। আমার তো মনে হচ্ছে একই লোক। ওই এলাকা থেকে তো আর কেউ মন্ত্রী হয়নি।
জয়িতা আগ্রহ নিয়ে কাগজটা চোখের সামনে ধরল। আনন্দর দেখানো অংশটিতে চোখ বোলাতে তার বেশি সময় লাগল না। তার মুখ চোখ উত্তেজিত হয়ে উঠল, লোকটা আমাদের লিস্টে নয় নম্বর ছিল, না?
হ্যাঁ, কিন্তু ওর প্রমোশন হল। তিন নম্বরটা ওর ভাগ্যেই জুটল। আমি তবু হালচাল দেখে আসি।
জয়িতা তখনও ভাবছিল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে কিছু লোক চিরকাল মুনাফা লোটে। কিন্তু একটি প্রগতিবাদী বলে দাবী করা সরকারের সঙ্গে যুক্ত থেকে একজন যে তাই করে যেতে পারে এবং প্রশ্রয় পায় সেটা ভাবতে অসুবিধে হয়। নোকটা চোর ঘুষখোর, এই অবধি জানা ছিল। কিন্তু সে মুখ ফিরিয়ে দেখল আনন্দ যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়েছে। জয়িতা বলল, আজকেই বের হবি? খবরের কাগজের ছবি মনে করে কেউ যদি তোকে চিনে ফেলে তাহলেই—! ঝুঁকি নিচ্ছিস কিন্তু।
আনন্দ হাসল, না রে, বোকামি করব না। তুই নিশ্চিন্ত থাক। সুদীপ যদি এর মধ্যে ফিরে আসে তাহলে ওকে ব্যাপারটা বলিস। ঘরের বাইরে এসে শেকল তুলে দিল আনন্দ। এখন তার কোমরে রিভলভারটা গোঁজা। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে দেখল রোদের তেজ কমে এসেছে। বারান্দার দিকে চোখ পড়তেই সে বৃদ্ধাকে দেখতে পেল। বড় থালায় চাল নিয়ে কাকড় বাছছেন। পায়ের শব্দে চোখ তুলতেই আনন্দ বিনীত ভঙ্গিতে বলল, আমি একটু বের হচ্ছি। ডাক্তারের কাছে যাব।
ডাক্তার? কি হয়েছে তোমার? কি আশ্চর্য! বৃদ্ধা উৎকণ্ঠিত গলায় প্রশ্ন করলেন।
তেমন কিছু নয়। বুকে কেমন ব্যথা-ব্যথা লাগছে। আসছি।
এসো। এ পাড়ায় তেমন ভাল ডাক্তার নেই। ও হ্যাঁ, তোমাদের ঘরের শেকল টেনে দিয়েছ তো?
হ্যাঁ।
একমাত্র প্রার্থনা বৃদ্ধা যেন ওপরে না ওঠেন। মনে মনে বলল আনন্দ। সে খানিকটা আড়ষ্ট ছিল গলিতে হাঁটবার সময়। রাস্তায় লোকজন তার দিকে মোটেই কৌতূহলী হয়ে তাকাচ্ছে না। সে বাস স্ট্যান্ডে আসতেই ট্যাকসি পেয়ে গেল। প্রথমে ধর্মতলার একটি বিখ্যাত দোকানে পৌঁছাল সে। একটা ম্যাপ আর জায়গাটার বিস্তারিত বিবরণের জন্যে বই কিনতে প্রায় তিনশো টাকা খরচ হয়ে গেল। ইংরেজি বই-এর এত দাম! ম্যাপটা তাদের খুব সাহায্য করবে।
ট্যাকসিটাকে ছাড়ল যেখানে সেখান থেকে স্মাগলারটির এলাকা মিনিটখানেক। কলকাতার এই বিশাল এলাকার মানুষের প্রথম জীবিকা বিদেশী দ্রব্যের রক্ষণাবেক্ষণ এবং ক্রয়বিক্রয়ে সাহায্য করা। স্মাগলারটি ওদের কাছে দেবদূতের মত। আনন্দ প্রথমে মার্কেটের সামনে পৌঁছে চারপাশে চোখ বোলাল। তারপর একটা চায়ের দোকানে ঢুকে এক কাপ চমৎকার চা চাইল।
দোকানটা জমজমাট। শুধু চা চাইলে খুব পাত্তা দেবার মত সময় কর্মচারীদের নেই। আনন্দ একটা বেঞ্চিতে বসে রাস্তার দিকে তাকিয়েছিল। বেশির ভাগ খদ্দের একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের। কথাবার্তা যা হচ্ছে তা ওই কেনাবেচা নিয়ে। মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করেও সে চা পেল না এবং এমন কিছু তথ্য পেল
যা নিয়ে ভাবা যায়। শেষ পর্যন্ত আনন্দ উঠল। একটা ঝুঁকি নিতে হবে কিন্তু এছাড়া কোন উপায় নেই।
সে সোজা কাউন্টারটার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। যে লোকটি ক্যাশ নিচ্ছে সে খুব ব্যস্ত। লোকটার দৃষ্টি আকর্ষণ করে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা আপনি বলতে পারেন, নানুভাই-এর বাড়িটা কোথায়?
হঠাৎ লোকটার শরীর স্থির হয়ে গেল। মাছের মত চোখ তুলে আনন্দকে দেখল সে। তারপর স্পষ্ট হিন্দীতে জিজ্ঞাসা করল, আপনার কি দরকার?
আনন্দ লক্ষ্য করল, শুধু দোকনদার নয়, খদ্দেরদের অনেকেই তার দিকে তাকাচ্ছে। সে খুব শান্ত গলায় উত্তর দিল, নানুভাই-এর সঙ্গে আমার দেখা করা দরকার, খুব জরুরী প্রয়োজন।
লোকটি রাস্তার উলটোদিকটা দেখাল, ওই গলি দিয়ে চলে যান। মিনিট তিনেক গেলে জিজ্ঞাসা কবেন।
আনন্দ চায়ের জন্য আর তাগাদা দিল না। সে দোকান থেকে বেরিয়ে আসতেই বুঝল একটা লোক তা। সঙ্গ নিয়েছে। ক্যাশিয়ার লোকটা নানুভাই-এর নাম শুনে অমন করল, না তার মুখ দেখে চিনতে পাং ল বুঝতে পারছিল না সে। এই লোকটা তাকে অনুসরণ করছে কেন?
গলিটায় ঢুকল সে। যত এগোচ্ছে তত সরু হয়ে আসছে। এখন দুপাশে কোন বাংলা শব্দ নেই। দুজন লোমকে জিজ্ঞাসা করে সে যে বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল সেই বাড়িকে এই বস্তি এলাকায় আশা করে নি সে। সাদার্ন অ্যাভিন্য বা আলিপুরে মানাতে বাড়িটা। দুপাশের বস্তি এত ঘন যে একটা লোক সেখানে ঢুকে গেলে তাকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। আনন্দর আফসোস হচ্ছিল। এখানে যদি চেনাশোনা থাকত তাহলে চমৎকার অজ্ঞাতবাসের জায়গা মিলতো।
সে বাড়িটার কলিং বেলে হাত দিতে যাচ্ছে এমন সময় অনুসরণকারী সামনে এসে দাঁড়াল, কি চাই?
নানুভাই-এর সঙ্গে কথা বলব।
উনি বাড়িতে নেই। এই লোকটিও হিন্দীতে কথা বলছিল।
কোথায় আছেন?
কি দরকার?
আমি একটা পত্রিকা থেকে এসেছি।
লোকটি তাকে আপাদমস্তক দেখল। তারপর বলল, আপনি এখানে দাঁড়িয়ে থাকুন। আমি তিন মিনিটের মধ্যেই আসছি।
লোকটা বাঁ দিকের পথ ধরে হাওয়া হয়ে গেলে আনন্দ চারপাশে তাকাল। সে বুঝতে পারছিল অনেকেই তাকে দেখছে। বাড়িটার ভেতরে লোক আছে কিনা বোঝা যাচ্ছিল না। একটু বাদেই সেই অনুসরণকারী ফিরে এল, আসুন। নানুভাই এখন খুব ব্যস্ত। শুধু পেপারের কথা শুনে রাজী হলেন। আবার গলি, তস্য গলি। আনন্দর গা ছমছম করছিল।
যে বাড়িটার সামনে এবার সে দাঁড়াল অনুসরণকারীর সঙ্গে সেটা একতলা। লোকটা তাকে ভেতরে নিয়ে গেল। একটা বিশাল ঘরে বসে আছে নানুভাই নামের লোকটা। তার চেহারা দেখে আনন্দর শোলের গব্বর সিংকে মনে পড়ে গেল।