২২শে শ্রাবণ
বাংলা সন ১৩৪৮ এর ২২শে শ্রাবণ কপোতাক্ষ, তিস্তা, তোরসা, ডুলং… এই সব নদী তার গতি পথ বদলে নিয়েছিল। উত্তরের পাহাড় কেঁপেছিল। দক্ষিণের সমুদ্র উথাল পাথাল হয়েছিল। বাইশে শ্রাবণে কত মেঘ ছুটে এসেছিল আমাদের আকাশে। নজরুল তাঁর প্রয়াণে লিখেছিলেন, দুপুরের রবি পড়িয়াছে ঢলে অস্তপারের কোলে/ বংলার কবি শ্যাম বাংলার হৃদয়ের ছবি তুমি চলে যাবে বলে/ শ্রাবণের মেঘ ছুটে এল দলে দলে।
আমি ২২শের অনেক বছর পরে জন্মেছি। শ্রাবণ চিনেছি, আষাঢ় চিনেছি রবীন্দ্র নাথে। বর্ষা কবির গানে কবিতায় বন্দিত। বর্ষার মেঘাচ্ছন্ন সজল স্নিগ্ধ মায়াময় প্রকৃতি রবীন্দ্রনাথেই অনুভব করতে শিখেছি হয়তো। আষাঢ় শ্রাবণের একটি অন্তর আছে। সেই অন্তর চিনেছি কালিদাস আর রবীন্দ্রনাথে। মেঘদূতের স্মৃতিই যেন সমস্তজীবন ধারণ করে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই বহুযুগের ওপার হতে আষাঢ়ের আবির্ভাব কবিকে উদাত্ত করেছিল। সেই তিনি শ্রাবণে মৌন হয়ে যেতে থাকেন, বুঝিয়ে দেন, শ্রাবণ মৌনতার মাস। বাইশে সেই মৌনতা অতল হয়েছিল।
এমন দিনে তারে বলা যায়/ এমন ঘনঘোর বরিষায়…/ এমন দিনে তারে বলা যায়…/ এমন মেঘস্বরে বাদল ঝরোঝরে/ তপনহীন ঘন তমসায়।
আসলে ২২শের কথাই যেন কবি লিখে নিয়েছিলেন শ্রাবণঘন মেঘে ঢাকা প্রকৃতি থেকে, তিনি লিখছেন, ব্যাকুল বেগে আজি বহে যায়,/ বিজুলি থেকে থেকে চমকায়।/ যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে/ সে কথা আজি যেন বলা যায়/ এমন ঘনঘোর বরিষায়।।
এ যেন ২২শে শ্রাবণের কথাই। রবীন্দ্রনাথ নিজ প্রয়াণের দিনটিকেই যেন এই ভাবে ভেবেছেন। তাঁর প্রয়াণ তো অনন্তে বিলীনতা। অনন্ত থেকে এসে অনন্তে মিলিয়ে যাওয়ার কথাই তাঁর উচ্চারণে, সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর/ আমার মাঝে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর।
২২শে শ্রাবণ সেই ১৩৪৮-এর পর থেকে আমাদের জাতির কাছে এক আলাদা শব্দবন্ধ। এ যেমন কবির প্রয়াণের দিন, জাতির শূন্য হওয়ার দিনও তো। কিন্তু সবই তো দিয়ে গেছেন তিনি। নিঃস্ব হইনি। আমরা তাঁকে নিয়েই আছি। রবীন্দ্র প্রয়াণের কথা বুদ্ধদেব বসুর তিথিডোর উপন্যাসে আছে। রবীন্দ্রনাথের অসুখ, আর রবীন্দ্রনাথে আচ্ছন্ন এই উপন্যাস। স্বাতী ও তরুণ অধ্যাপক সত্যেনের ভিতরে ভালবাসার জন্ম নেয় ২২শে শ্রাবণ, প্রয়াণের পর কবিকে দেখতে গিয়ে। জোড়াসাঁকো, সেখেনে নেই কবি, কলেজ স্ট্রিট নিয়ে গেছে তাঁকে, তারা হাঁটতে হাঁটতে কলেজ স্ট্রিট আসে।
“স্বাতী ভাবছিল লম্বা গভীর আনত আচ্ছন্ন স্তব্ধ মন্থর মিছিল, কিন্তু মাত্রই কয়েকজন যেন অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে নিয়ে এল কাঁধে করে— নিয়ে গেলো উত্তর থেকে দক্ষিণে— পিছনে এলোমেলো লোক— বিদ্যুতের ঝিলিক দিলো লম্বা শাদা চুল আর মস্ত শাদা শান্ত তন্ময় কপাল। ঐটুকু দেখলো স্বাতী, আর দেখতে পেল না।”
স্বাতীকে নিয়ে সত্যেন সেই মহানিষ্ক্রমণ দেখতে গিয়েছিল। স্বাতী ঐটুকু দেখতে পেয়েছিল। ঐ তার কবিকে দেখা, প্রথম ও শেষ। তারপর সে নিজেকে সংবরণ করে। করতে চায়। স্বাতীর মুখ দেখে সত্যেনের চোখ কি ভিজে এল? বুদ্ধদেব বসু লিখছেন, “…এ মৃত্যু তো কান্না চায় না, এই দুঃখ মহান, মহামূল্য দুঃখ, আশি বছরের পরম পরিশ্রমের এই সব শেষের রত্ন— এ কি চোখের জলে বাজে খরচ করবার?”
সেই ২২শে শ্রাবণে সমস্ত কলকাতা নিস্তব্ধ। চিনারা, সায়েব, মেম, পাদরি, সাধারণ মানুষ, সবাই চলেছে ফুল হাতে নিমতলার দিকে। তিথিডোর পড়লে সেই ২২শে শ্রাবণ চোখে দেখা যায়। এ এমন এক দিন, মনে হয় আমিও তাঁর কথা কোথাও একটা লিখে রাখি, কিন্তু লিখব কোথায়, নিজের মনের ভিতরে।
“সেই যে রবি ঠাকুর চলে গেলেন বাইশে শ্রাবণ, নীলকুমার, তিস্তা, তোরসা, ধরলা, গদাধর, কালজানি আর ব্রহ্মপুত্র, যা কি না এদেশে যমুনা, সব ফুলে ফেঁপে উঠল, সেই বাইশে শ্রাবণের কথা জানতে পারল উত্তর দেশের অখ্যাত এক স্টেশনের মাস্টারবাবু নিখিলচন্দ্র একদিন না দুদিন বাদে। শিয়ালদা থেকে ছাড়া দার্জিলিং মেল একটা একটা স্টেশনে খবর দিতে দিতে আর এগোতেই পারে না। মৃত্যুর খবরের ভার বড় বেশি। আর বৃষ্টির শেষ ছিল না। ট্রেন লেট হতে থাকে। শিয়ালদা থেকে রাণাঘাট, মাজদিয়া, পোড়াদহ হয়ে পাকশি জংশন। জংশন থেকে আরো সব গাড়ি সেই মৃত্যু সংবাদ নিয়ে পূর্ববঙ্গের ভিতরে ভিতরে ঢুকে যায়, বাইশে শ্রাবণ কী হয়ে গেছে। পাকশি জংশন থেকে সেই গাড়ি পদ্মার উপরে হার্ডিঞ্জ ব্রিজে উঠল। ঝম ঝম ঝম পদ্মা নদী শুনল তিনি নেই। পদ্মার জল উত্তাল হয়ে উঠল কান্নায়। আরো সব নদীর কাছে খবর চলে গেল। অন্ধকারের নদীর উপরে ভাসা জেলে নৌকোয় খবর উঠে এল, তারা সব ঘরে ফিরতে লাগল। মৃত্যু সংবাদ তো ঘরেই ফেরায়। গাড়ি ঈশ্বরদি, নাটোর হয়ে সান্তাহার জংশনে গিয়ে আর নড়তে পারে না। কতদিকে খবর গেল। তারপর সেই বগুড়া হয়ে লালমনির হাট, কত দেরি করল সেই শোকের খবর নিয়ে আসা গাড়ি। কলকাতা থেকে তাঁর স্টেশন মেটিলি না পাটেশ্বরী, ভুরুঙ্গামারী, সোনাহাট এল এক গাড়ি ওই খবর নিয়ে। বেতারে খবর ছড়িয়েছিল, কিন্তু বেতার রেডিও তো তার ছিল না। এ আমার মনে মনে বলা। কে নিখিলচন্দ্র, কোথায় পোড়াদহ, পাকশি জংশন, ঈশ্বরদি, নাটোর, সান্তাহার জংশন, লালমনিরহাট… আমি জানিই না ভাল করে। পার্টিশনের পর কলকাতা থেকে উত্তরদেশ যাওয়ার সেই রেলপথই অবলুপ্ত। কিন্তু ২২শে শ্রাবণের কথা মনে হতে এমন এক মেল ট্রেনের সওয়ারি হয়েছিলাম সেই আমি আমার জন্মের আগের এক রাতে। ২২শে শ্রাবণ এক অনন্ত মৃত্যুর গাথা। এমন এক দুঃখের দিন, যা কি না মেঘে মেঘে ভার হয়ে ওঠে হিমালয়ের চেয়েও বেশি। কিন্তু এই শোক নিস্তব্ধতার ভিতরেই গভীর। ১৩৪৭-এর কার্ত্তিক মাসে, রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “আমার দিনের শেষ ছায়াটুকু মিশাইলে মূলতানে-/ গুঞ্জন তার রবে চিরদিন, ভুলে যাবে তাঁর মানে। … শুধু এইটুকু আভাসে বুঝিবে, বুঝিবে না আর কিছু-/ বিস্মৃত যুগে দুর্লভ ক্ষণে বেঁচেছিল কেউ বুঝি,/ আমরা যাহার খোঁজ পাই নাই তাই সে পেয়েছে খুঁজি।।
বাইশের ছায়া প্রলম্বিত। শেষ ছায়াটুকু মিলিয়ে যায়নি। রাগিনীর গুঞ্জনটুকুও না।