২২। অকস্মাৎ দৈত্যের দেখা
পরদিন যখন ভোর হল তখনও হাথোরেত উড়ে চলেছে। সূর্যের জ্যোতি আরও জোরালো হওয়ার পর গাছের পাতার ফাঁকে নীলনদ আবার দৃশ্যমান হল। গত কালের রাত নির্বিঘ্নে কেটেছে। এখানকার বাতাসের গতিপথের কোন বদল হয়নি। সারারাত হাথোরেত প্রায় সোজাই চলেছে। তবে সেশেনুর অরণ্য যে এতটা বড় তা অগস্ত্যদের ধারণার বাইরে ছিল। এই বনানী যেন এক সবুজ সমুদ্রের মতো। নীচে নীলনদও আপন খেয়ালে বয়ে চলেছে।
সাধারণত উৎসের পরেই নদী খুব বেশি প্রশস্ত হয় না, স্রোতস্বীনী থাকে। তবে অগস্ত্যরা নদীর যতটুকু দেখতে পাচ্ছে তাতে বোঝা যাচ্ছে যে নীলনদ এখনও একই প্রস্থের খাত দিয়ে বয়ে চলেছে, এর স্রোতও শান্ত। তাহলে নদীর উৎস এখনও অনেকটা দূরে। তবে উপল এতে খুব একটা বিচলিত নয়। হাথোরেতের মধ্যে এখনও অবধি যে পরিমাণ উড়ান বায়ু আছে তাতে করে অনায়াসে দু’দিন এখনও এই গতিতে এগিয়ে চলা সম্ভব। তার বিশ্বাস তার আগেই নদীর উৎস দৃশ্যমান হবে।
দিনের তৃতীয় প্রহর থেকে অরণ্যের মানচিত্র বদলে গেল। হাথোরেত এসে পড়ল পাহাড়ি এক অঞ্চলে। মাঝারি আকারের পাহাড়গুলির মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে নীলনদ। এখন তাকে অনেক পরিষ্কার ভাবে দেখা যাচ্ছে। পাহাড় এবং অরণ্যের ফাঁকে নদীর দু’পাশে সবুজ ঘাসে ভরা চারণক্ষেত্র। সেখানে চরে বেড়াচ্ছে হরিণ, বন্য শূকর এবং মহিষের দল। উপল হাথোরেতের বায়ু কিছুটা কমিয়ে দিলে পর হাথোরেত খানিকটা নীচের দিকে নেমে এল।
প্রকৃতির রূপ যেন আরও ভালো ভাবে দৃশ্যমান হল এবারে। ঘাস খেতে খেতে কখনও নিজের খেয়ালে কোন হরিণ মাথা তুলে তাকাচ্ছে। সজাগ দৃষ্টি তার, এই অরণ্যে নিশ্চয়ই শ্বাপদের অভাব নেই। বন্য কুকুর এবং শৃগাল তো আছেই, সিংহ এবং চিতাবাঘ থাকাটাও অসম্ভব কিছু নয়। রাত্রে চিতাবাঘের ডাক শুনেছে তারা। নীলনদের তীরে রোদ পোহাচ্ছে কিছু কুমিরের দল। তারা যেন চলতশক্তিহীন প্রস্তরের মূর্তি। তাদের মুখগুলি হাঁ হয়ে আছে।
হরিণের দল সেখান থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে নদীর তীরে এসে জল খাচ্ছে। নদীর বুকে ভেসে আছে কিছু জলহস্তীর মাথাটুকু, বাকি শরীরটা জলের তলায়। এই জীবটিকে অগস্ত্য এবং উপল আগে দেখেনি, ভারতবর্ষে এর দেখা মেলে না। বাকারি তাদেরকে চিনিয়ে দিল। একটি জলহস্তী স্লথ গতিতে নদী থেকে উঠে কাদামাটির উপর দিয়ে হাঁটতে লাগল। এদের দেহের তুলনায় মাথার আকার অনেকটা বড়, মুখের সামনের দিক চাপা, নাসারন্ধ্র স্ফীত। স্কুল মেদবহুল শরীরটিকে নিয়ে যে ভাবে জলহস্তীটি চলছিল তাতে মনে হয় যেন এই পৃথিবী থমকে রয়েছে, স্থির। বাকারি বলল, ‘এই প্রাণীগুলিকে দেখে শান্ত মনে হলেও এরা অরণ্যের ত্রাস। প্রয়োজনে প্রচণ্ড গতিতে ছুটতে পারে। এদের চোয়ালের জোর অকল্পনীয়। এক কামড়ে কোন বন্য মহিষের ধড় থেকে মুণ্ড আলাদা করতে সক্ষম এরা। বনের সিংহ এবং জলের কুমিরও এদেরকে সমীহ করে চলে।’
অগস্ত্য এবং উপল অবাক হয়ে এই অদ্ভুত দর্শন প্রাণীটিকে দেখছিল। ইরতেনসেনুর কথায় তাদের চমক ভাঙল।
‘নদীর স্রোত কি সামান্য বেড়েছে?’
সত্যিই মনে হচ্ছে নীলনদের ঢেউ-এর জোর যেন একটু বেশিই। নদীর বুকে বড় বড় পাথরদের জেগে থাকতে দেখা গেল। অগস্ত্যরা দেখল এই অংশের জমিতে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। অরণ্যও যেন আবার ঘন হয়ে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যে নদীর দু’পাশের ঘাস জমি অদৃশ্য হল। বাকারি বলল, ‘তোমাদের কারোর শীতবোধ হচ্ছে?
ঠান্ডা হাওয়া বয়ে এল উল্টোদিক থেকে। সেই সঙ্গে একটি শব্দও সবার কানে এল। শব্দটি খুবই মৃদু কিন্তু তার অস্তিত্ব নিয়ে কোন সন্দেহই নেই। কেউ যেন পাথরের উপরে ক্রমাগত হাতুড়ি পিটছে। উপল এবারে চমকে উঠল, দ্রুত এগিয়ে গেল দিকযন্ত্রের দিকে। যন্ত্রটিকে চালনা করে বলল, ‘উল্টোদিক থেকে ঠান্ডা বায়ু বইতে শুরু করল, এর অর্থ…’
এর অর্থ কী তা আর উপলকে বলে দিতে হল না। পাহাড়ের গায়ে একটি বাঁক নিতেই অগস্ত্যদের মনে হল তাদের মাথার উপরের সূর্য যেন অকস্মাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল! কিছুটা দূরেই দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে এক পর্বত! অরণ্যের মাঝে এত বড় পর্বত থাকবে তা কল্পনাই করতে পারেনি তারা কেউ! পর্বতটির মাঝের অংশে একটি ফাটল। সেই ফাটল দিয়ে প্রবল বেগে নীচের দিকে নেমে আসছে এক জলপ্রপাত!
বিপুল জলরাশি নীচে পাথরের গায়ে ধাক্কা খাচ্ছে, তার ফলে ওই আওয়াজ তৈরি হচ্ছে। শীতল বাতাসের উৎসও ওই জলপ্রপাত। হাথোরেত এখন অনেকটা নীচ দিয়ে উড়ছে। যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে চলেছে জলপ্রপাতের দিকে। আর কিছুটা পথ এগোলেই ধাক্কা খাবে পর্বতের গায়ে, নিশ্চিত মৃত্যু এখন হাতছানি দিয়ে ডাকছে অগস্ত্যদের!
‘হাতে সময় নেই, হাথোরেতকে উপরের দিকে নিয়ে যেতে হবে!’
এই বলেই উপল দৌড়ে গেল চুপড়ির এক প্রান্তে। চুপড়ির চারটি বাহুতে বাঁধা আছে বেশ কিছু পুটুলি, সেগুলি বালি দিয়ে ভরা। উপল এবারে চিৎকার করে বলল, ‘সব কটি পুটুলি খুলে দাও দ্রুত!’
বাকি তিনজনও ছুট লাগাল অন্য তিন বাহুর দিকে। তড়িৎগতিতে খুলতে শুরু করল বালি ভরা পুটুলিগুলিকে। চারটি পুটুলি খোলার পরই দেখা গেল উড়ানবায়ুর প্রভাবে হালকা হয়ে হাথোরেত উপরের দিকে উঠতে শুরু করেছে, কিন্তু সেই সঙ্গে তার গতিবেগও যে বেড়ে গেল! তারা আরও দ্রুত হাতে বাকি পুটুলিগুলিকে খুলতে শুরু করল। পর্বতের খাড়াই গাত্রের কাছে, আরও কাছে এগিয়ে আসতে লাগল হাথোরেত। কিন্তু সেই সঙ্গে সে উচ্চতাও লাভ করছে। আরও একটু, আরও একটু উপরে ওঠার প্রয়োজন।
শেষ পুটুলিটিকে খুলে দেওয়ার পর ধপ করে চুপড়ির মধ্যে বসে পড়ল উপল। বাকিদের উদ্দেশে বলল, ‘তোমরাও এখনই বসে পড়! শক্ত হাতে ধরে রাখ চুপড়ির গায়ের রজ্জুগুলিকে!
হাথোরেত যখন জলপ্রপাতের একেবারে সামনে এসে পড়ল তখন সে মাটি থেকে অনেকটা উপরের দিকে উঠে এসেছে। পর্বতের গায়ের ফাটলের দিকে এগিয়ে চলল হাথোরেত। জলপ্রপাতের ঠিক উপরে এসে পৌঁছল। হাথোরেতের চুপড়িটি এবার জলের উপরিভাগকে স্পর্শ করে এগিয়ে যেতে থাকল। ইরতেনসেনুদের পরনের বস্ত্র ভিজিয়ে দিতে থাকল চুপড়ির মধ্যে ঢুকে আসা জল। আর উপরে ওঠা সম্ভব নয়।
এমন সময়ে এই গিরিখাতের মধ্যে বায়ুর গতিবেগ আচমকাই বৃদ্ধি পেল! যেন শুকনো পাতার মতো হাথোরেতকে ঠেলে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকল এক উন্মত্ত বাতাস। টাল সামলাতে না পেরে হাথোরেত এক দিকে বেঁকে গেল, ধাক্কা মারল গিরিখাতের গায়ে। শক্ত পাথরের আঘাতে চুপড়ির একটি কোণ ভেঙ্গে গেল! ওই অংশে বসেছিল বাকারি। দ্রুত হাতে তাকে নিজেদের দিকে টেনে নিল অগস্ত্য এবং উপল!
গিরিখাতটি সংকীর্ণ হলেও খুব বেশি দীর্ঘ ছিল না। অচিরেই গিরিখাত পেরিয়ে হাথোরেত পর্বতের অন্য প্রান্তে এসে পড়ল। যে প্রবল বায়ু এতক্ষণ তাদেরকে বেসামাল করে রেখেছিল তাও যেন এবারে শান্ত হল। আবার সোজা হয়ে ভাসতে লাগল হাথোরেত, স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে যেতে থাকল। খুব সাবধানে তারা চারজন চুপড়ির উপরে উঠে দাঁড়াল। চুপড়ির একটি অংশ আর নেই। সেখানে পানীয় জলের একটি ঘড়া রাখা ছিল, সেটিও চুপড়ি ভেঙে নীচে পড়ে গেছে। উপল গম্ভীর মুখে বলল, ‘ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে হাথোরেত। তবে আমরা যে সাক্ষাৎ মৃত্যুকে উপেক্ষা করে ওই গিরিঘাত পেরিয়ে আসতে পারব তা ভাবিনি।’
তাদের নীচে আবার সেশেনুর অরণ্য শুরু হয়ে গেছে। তার মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে নীলনদ। নদীর প্রস্থ এখন অনেকটা ছোট হয়ে এসেছে। উপল বলল, ‘মনে হয় না নদীর উৎস থেকে আর খুব বেশি দূরে আমরা। পানীয় জল আর নেই, সামান্য কিছু সুরা আছে, তাই দিয়ে যদি একটি দিন কাটাতে পারি তাহলে নীলনদের উৎসে আমরা ঠিক পৌঁছে যেতে পারব বলেই আমার বিশ্বাস। সৌভাগ্যের কথা এই যে, উড়ানবায়ু ভরা কাপড়ের থলিটির কোন ক্ষতিই হয়নি। অনেকটা উপর দিয়ে উড়ছি এখন, নীচের দিকে নেমে আসার দরকার।’
বাকারি এবারে প্যাঁচানো রজ্জুর বাঁধন খুলে দিয়ে হাথোরেতের ভিতরের উড়ানবায়ু বার করতে শুরু করল। ধীরে ধীরে নীচের দিকে নেমে আসতে লাগল তারা। যে কয়েকটি সামগ্রী চুপড়ির ভাঙা অংশের খুব কাছাকাছি রয়েছে তাদেরকে সাবধানে সরিয়ে আনতে লাগল ইরতেনসেনু এবং অগস্ত্য। উপল দিগযন্ত্রটিকে চালনা করে বাতাসের গতিপথ বোঝার চেষ্টা করছিল। উচ্চতার এই তারতম্যে বায়ুযানের অভিমুখ বদলে যেতেই পারে। সহসা এক শব্দে চমকে উঠল সে। হুস করে এক আওয়াজ হল, যেন তীব্র গতিতে কিছু চলে গেল হাথোরেতের পাশ দিয়ে। সেটি কী তা বোঝা গেল না। তার পরক্ষণেই যেন সোনালি বিদ্যুতের এক রেখা ছুটে গেল চুপড়ির পাশ দিয়ে।
বল্লম! তার তীক্ষ্ণ ধাতব অগ্রভাগ ঝলসে উঠেছে সূর্যের আলোয়!
মুহূর্তের মধ্যে আরও কয়েকটি বল্লম অরণ্যের আড়াল থেকে ছুটে এল হাথোরেতের দিকে। কীংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অগস্ত্য ঝুঁকে পড়ে বোঝার চেষ্টা করছিল কোথা থেকে আসছে বল্লমগুলি। এক টানে তাকে চুপড়ির মধ্যে বসিয়ে দিল উপল। ওই বল্লমের সূঁচাগ্র শরীর ফুঁড়ে বেরিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। এবারে একটি বল্লম ছুটে এসে হাথোরেতের কাপড়ের থলিটিকে ফুটো করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে তীব্র বেগে নির্গত হতে থাকল উড়ানবায়ু!
প্রবল বেগে হাথোরেত নেমে আসতে লাগল মাটির দিকে, তাকে ভাসিয়ে রাখার মতো কোনও বায়ুই-ই আর অবশিষ্ট নেই। চুপড়িটি একটি দিকে বেঁকে গেছে। অগস্ত্যরা কোনওক্রমে রজ্জু ধরে বসে রয়েছে চুপড়ির মধ্যে। অগস্ত্য দেখল উপলের মুখে এক অদ্ভুত হাসি! সেই হাসিতে উন্মাদনা ছড়িয়ে আছে যেন! উপল চিৎকার করে বলতে গেল, ‘অগস্ত্য! পুন্তের শহর…!’
উপলের কথা শেষ হল না। সজোরে অরণ্যের বুকে আছড়ে পড়ল হাথোরেত। প্যাপিরাসের কাণ্ড দিয়ে তৈরি চুপড়ি ছিন্নভিন্ন হয়ে ছিটকে পড়ল মাটিতে। জ্ঞান হারাল অগস্ত্য।