তবু বিকেল না হতেই মন টানতে থাকে। স্নান করে, কপালে একটু চন্দন-রেখা এঁকে, দুধ-সাদা, শাড়ি-ব্লাউজ পরে প্রস্তুত হয়ে বসে থাকি গাড়ি আসার আশায়।
এই গাড়ি পাঠানোর ব্যাবস্থার পর থেকে মঠের কেউই আর আমায় সুচক্ষে দেখে না, প্রত্যেকের চোখেই যেন বিরক্তির বিরূপতা, হিংসের জ্বালা। মুখভঙ্গিতে যেন এই অভিযোগ ফুটে ওঠে, খুব দেখালে বাবা! উড়ে এসে জুড়ে বসলে একেবারে!
কিন্তু আমি কি করব?
আমার কি দোষ?
আমি তো আর আবদার করে এ সুযোগ আদায় করে নিইনি। শঙ্করজী নিজেই নাকি বলেছেন, দেবীমা না এলে কীর্তনে প্রাণ আসে না।
আর নিজেই নাকি রোজ হুশ করে ড্রাইভার হরিচরণকে বলে দেন, ওরে দেবীমাকে ঠিক সময় আনতে যাস।
কেন এই পক্ষপাতিত্ব?
সত্যিই কি তবে আমি ভগবতীর অংশ?
ভগবান ভগবান করলে মানুষ যেন কেমন ভোতা হয়ে যায়। বিশেষ করে মেয়েমানুষ। গুরুর এই পক্ষপাতিত্বে সুধাদি, অমলাদি, রাইকমল, ব্রজরাধা ঈর্ষায় জ্বলে মরে, টেনে টেনে বাঁকা বাঁকা কথা শোনায় আমায়, কিন্তু কই, গুরুর কাছে গিয়ে সোজা সতেজ কৈফিয়ত চায় না তো, দেবী না এলে যদি কীর্তনে প্রাণ আসে না, তবে এতদিন কি আপনি আমাদের প্রাণহীন গান শুনিয়ে রেখেছিলেন?
চায় না কৈফিয়ত।
কিন্তু আমি হলে চাইতাম।
আমি চেয়েওছি, অন্য কারণে।
প্রথম প্রথম যখন দেখেছি প্রসাদ পাবার দিন পংক্তি-ভোজনে বসেও প্রসাদের দুর্লভ অংশটুকু পড়ল আমার পাতে, অথবা হরির লুঠের সময় সন্দেশের জোড়াটি পড়ল আমার হাতে, তখন লজ্জায় কুণ্ঠায় মন বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে।
চাইলাম একদিন কৈফিয়ত।
যখন দুপুরের বিশ্রামের পর বিগ্রহের সামনের সেই অর্ধ-বৃত্তাকার বারান্দায় পায়চারি করছেন অলস চরণে, নবীনদার অপেক্ষায়। চারটে বাজলে নবীনদা এসে ঘণ্টা দেয়, বিগ্রহের দরজার ভারী তালাটা খুলে ফেলে দরজা হাট করে দেয়।
তখনও চারটে বাজেনি (আমি সেদিন প্রসাদ পাবার পর মঠেই রয়েছি কী একটা উৎসব বাবদ) আমি গিয়ে উঠলাম সেই বারান্দার সামনে নাটমন্দিরে। স্পষ্ট সতেজ গলায় প্রশ্ন করলাম, সবাই তো আপনার শিষ্য, আমাকে তবে বিশেষ করেন কেন?
হঠাৎ যেন চমকে উঠলেন উনি। হয়তো এ ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়নি ওঁকে কোনোদিন। হয়তো ওর উল্টোটা শুনে থাকবেন কোনো জল-ভরা চোখ আর অভিমানরুদ্ধ কণ্ঠ থেকে।
এটা অপ্রত্যাশিতই।
তাই হাঁটা থামিয়ে বললেন, কি বলছিস মা?
আমি আমার প্রশ্নের পুনরুক্তি করলাম। বললাম, উত্তর দিন।
এবার আস্তে আস্তে ওঁর সেই নিখুঁত কাটের সুগৌর মুখে ছড়িয়ে পড়ল একটি প্রসন্ন হাসির আলো। ওঁর আলতা-রাঙা ঠোঁটে ফুটে উঠল একটু মৃদু মধুর হাসির আভাস।
বললেন, এ প্রশ্নের আবার উত্তর কি রে? তুই আমার মা যে, তাই।
এখানের সবাই আপনার মা।
তুই হচ্ছিস ব্রহ্ময়মী মা।
না। আমি সাধারণ একটা মেয়ে।
উনি মিষ্টি হেসে বলেন, তুই কি, তা কি তুই নিজে জানিস? তুই কি নিজেকে দেখতে পাস? যেমন আমি পাচ্ছি?
আমার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল।
আমার মনে হল সার্চলাইট জ্বেলে উনি আমার অন্তরের অন্তঃস্থল পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছেন।
ভয়ে থর থর করে উঠল ভিতরটা।
আমার ভিতরে এখন কিসের কুটিলতা উঁকি মারছে সে তো আমি জানি। জানি, সেকথা ওই দেবোপম প্রৌঢ় মানুষটি সম্পর্কে ভাবাও মহানরক, তবু আমার মনের মধ্যে ছিল সে সন্দেহের গ্লানি।
আমি ভাবছিলাম ওঁর ওই কাজল পরার মতো চোখে যে দৃষ্টি, সে কি পিতৃদৃষ্টি? যে কণ্ঠ আমায় দেবীমা বলে আদরের সম্বোধন করছে, সে কি পিতৃকণ্ঠ?
এ সন্দেহ দেখতে পাচ্ছেন তবে উনি?
আমার কিছুক্ষণ আগের সাহসটা হারিয়ে গেল। আমি আস্তে বললাম, তা তোক আমার লজ্জা করে। সবাই তো শিষ্য, সবাই সমান।
উনি বললেন, এই তো পরীক্ষায় জয়ী হলি। আরও পরীক্ষা আসবে। অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তবে তো সীতাদেবী হবি।
তখন মনে হল ওঁর দৃষ্টিতে যে আলো, সে আলো স্বর্গের আলো। ওঁর কণ্ঠে যে মাধুর্য, সে মাধুর্য মন্দাকিনীর ধারার। মরমে মরে গেলাম।
মাথা হেঁট করলাম।
.
২২.
সেদিন বাড়ি ফিরেই দেখলাম শিপ্রা এসেছে।
শিপ্রা আসা মানেই দুরন্তর চিঠি আসা।
প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম ওর ওপর।
মনে হল ও যেন আমার উদ্ধারকত্রী হয়ে এল। ভগবান বলে যদি সত্যি কেউ থাকে, তাহলে যেন এই চিঠিতে দুরন্তর ফেরার খবর থাকে।
কিন্তু থাকবে কেন?
সাত বছরের পাঁচটা বছর তো মাত্র শেষ হয়েছে। আরও সবচেয়ে দীর্ঘ দুটো বছর।
সবচেয়ে দীর্ঘ বৈকি।
শুনেছি কোথায় নাকি কোন্ জেলখানায় একটা কুড়ি বছরের কারাদণ্ডের আসামি উনিশ বছর এগারো মাস কতদিন যেন কারাযন্ত্রণা ভোগ করে মুক্তির কয়েকটা দিন আগে যন্ত্রণা অসহ্য মনে হওয়ায় আত্মহত্যা করেছিল। জানি না গল্প না সত্যি, তবু এটা ঠিক প্রতীক্ষার শেষ প্রহরটাই সবচেয়ে দীর্ঘ।
শিপ্রা বলল, তোকে দেখে মনে হচ্ছে অমিতাভবাবু এসে মাথার চুল ছিড়বে। এ তো রীতিমতো বৈরাগিনী অবস্থা! ঘরে আবার এই সব ঠাকুর-দেবতা!
হেসে বললাম, তুই তো সবই জানিস।
জানি। কিন্তু এও জানি, জগতে সবচেয়ে বদলায় মানুষের মন।
তোর জানার জগতের বাইরেও অনেক কিছু আছে। বল এখন খবর। চিঠি আছে?
ও একটু হেসে বলল, আছে চিঠি, কিন্তু তোর দুরন্তর নয়, নিতান্তই আমার।
বলে একটা নেমন্তন্নর চিঠি বার করল। ছেলের অন্নপ্রাশন।
হঠাৎ ভয়ঙ্কর একটা রাগে আপাদমস্তক জ্বলে গেল।
জানি না কিসের সেই রাগ।
আশাভঙ্গের?
না হিংসার?
হয়তো তাই। মনে হল ও যেন আমার এই অস্বাভাবিক জীবনের সামনে ঘটা করে দেখাতে এসেছ ওর সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের ঐশ্বর্যের ভাব।
রুক্ষ গলায় বললাম, তুমি তো জান, এখন আর এসব সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিই না আমি।
শিপ্রা ম্লান গলায় বলল, খোকার মুখে-ভাত এ আর এমন কি সামাজিক ব্যাপার? কজনকে তো মাত্র বলছি।
কজনকে কেন? চিঠি-পত্তর ছাপিয়ে দিব্যি তো
ও আরও ম্লান গলায় বলল, চিঠিটা আমার সাধ। লোকেদের ছেলের ভাতে পাই। তা যাওয়া যদি নেহাত অসম্ভব হয়, জোর করব না।
আমি হঠাৎ হেসে উঠলাম।
বললাম, বাবা, মেয়ে একটু ঠাট্টা বোঝে না। যাব, যাব, যাব। তোর খোকাকে আশীর্বাদ করতে যাব। তবে জানিস তো বৈষ্ণবের ভেক? খেতে-টেতে বলিস না। বলিস ওর শরীর খারাপ।
ও কি বুঝল কে জানে।
বলল, আচ্ছা। তারপর আস্তে আস্তে উঠে গেল।
আর হাসল না।
হয়তো ভাবল আমি আর ওদের জগতে নেই।
ভাবলাম, নাঃ, একটু সেজে-গুঁজে যেতে হবে নেমন্তন্নে। কলেজের বন্ধুরা আসবে। হয়তো শিপ্রার মুখে আমার বৈষ্ণবের ভেক-এর গল্প শুনেছে, হয়তো কৌতূহলাক্রান্ত হয়ে আছে কেমন না
জানি হয়ে গেছি আমি। তাজ্জব করে দেব তাদের। সাজে ঝলসাব, হাসিতে কথাতে ঝলসাব।
শিপ্রারও অভিমান ভাঙবে।
.
২৩.
কিন্তু শিপ্রার অভিমান ভাঙবার এত গরজ কেন আমার? ভালোবাসার দায়?
ভেবে দেখলাম তাই বটে, তবে সে ভালোবাসাটা শিপ্রার জন্যে নয়। দুরন্তর ভালোবাসার দায়ে আমি শিপ্রার মন রাখতে বসছি। শিপ্রা রেগে গেলে যদি চিঠির ব্যবস্থা বানচাল হয়ে যায়!
নমাসে ছমাসে তবু আসে তো খবর।
জানতে তো পারি ও বেঁচে আছে।
শিপ্রা চলে গেলে হঠাৎ খুব কাদলাম, জানি না কেন। শিপ্রাকে আঘাত করলাম বলে? চিঠি পাইনি বলে? নাকি সেই তখন মাথা হেট করে ফিরে আসতে হয়েছিল বলে?
মনে হল হয়তো তাই।
সেই গ্লানিই আমাকে রুক্ষ করে তুলেছিল।
তখন মনে হতে লাগল, দেবতা না ছাই, লোকটা সম্মোহন জানে। আর জানে কথার চাতুর্য। কথার চাতুরিতেই দেবতার আসনের টিকিট সংগ্রহ করে রেখেছে।
যেই অসুবিধেয় পড়ে যায়, সেই কথার জাল ফেলে। অগ্নিপরীক্ষা, অনেক কিছু বলে আমাকে জব্দ করে ফেলে। আমি আর যাব না। আমার আর ভেক-এর দরকার নেই। মাকে বলব, আশা করে গিয়েছিলাম, কিন্তু কিছু পেলাম না ওখানে। বউদিকে বলব, তোমরা এত ভক্তি কর তাই বাজিয়ে দেখতে গিয়েছিলাম।
তারপর?
তারপর বলব, আমি আবার পড়ব। এম. এটা দিয়ে ফেলব।
দুটো বছর ওতেই কেটে যাবে। তার মধ্যে আমাকে কেউ জ্বালাতে আসবে না। তাছাড়া মা-র সেই ভয়ঙ্কর আবেগটা চলে গেছে। মা যেন মেনেই নিয়েছেন আমার এই জীবন। আমি মা-র কাছে না-শুলেও মা-র হেঁসেলে যে খাই, সেটাতেই মা-র সুখ।
আর—আর হয়তো বা—এই সংসার রণক্ষেত্রে প্রবল প্রতিপক্ষের সামনে একান্ত নিঃসহায় হয়ে পড়ার থেকে, এই পৃষ্ঠবলটুকু মা-র কাছে এখন ভাগ্যের দান বলে মনে হচ্ছে। তাছাড়া বউদির বোনের সঙ্গে মা-র মেয়েকে তুলনা করে মা যেন অনেকটা উঁচু আসনে উঠে গেছেন।
দিদি থাকে রেঙ্গুনে, মেজদি কোয়েম্বাটুরে।
ওরা কদাচ আসে। অথবা আসে না। ওদের সঙ্গে এ সংসারের নাড়ির যোগ ছিন্ন হয়ে গেছে, হয়তো বা মা-র সঙ্গেও। দূরে থাকতে থাকতে বুঝি মন থেকেও দূরে চলে যায়। মা-র ব্যবহার দেখলে মনে হয়, একটাই মেয়ে আমি মা-র।
দু-এক বছরে দিদিরা কেউ একটা চিঠি দিলে, মা আমায় বলেন, ওরে বেবি, তুই-ই একটা উত্তর দিয়ে দে। আমার তো সেই সাতজন্ম দেরি হবে!
বড়দির বিয়ে হয়ে গেছে আমার জন্মের আগে, মেজদির আমার নিতান্ত শৈশবে। দেখেছিই বা কবে? তবু আমিই চিঠি লিখি গুছিয়ে গুছিয়ে। অনেকদিন পরে দিদিরা সে চিঠির উত্তর দেয়, আমাকে নয়, মাকে। হয়তো লেখে, বেবি বেশ গুছিয়ে চিঠি লিখতে শিখেছে। হয়তো লেখে, বেবির বিয়ের বয়েস পার হয়ে গেল। আমাদের কোকালে বাড়িছাড়া করে দিয়েছ। কোলের মেয়েটিকে বেশ কোলে রেখে দিয়েছ।
দূরে থাকলেও বয়সের হিসেবটা ঠিক রেখেছে।
কিন্তু আর কি চিঠি আসে দিদিদের?
কই?
বহুদিন তো আসেনি। মা
কে হঠাৎ জিগ্যেস করলাম।
মা ভাঁড়ারের দরজায় বসে চালের কাকর বাছছিলেন। আমার ঠাকুরের ভোগ হয়, একটি কাকর থাকলে চলে না।
আশ্চর্য, এ সব যে আমি শিখলাম কোথা থেকে!
মা হঠাৎ আমার মুখে এরকম একটা সংসারী কথা শুনে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, এসেছিল।
কার? বড়দির? না মেজদির?
আঃ, কতদিন এই নামগুলো উচ্চারণ করিনি। বেশ লাগল।
মা তেমনি ভাবেই বললেন, দুজনেরই।
কই বলনি তো আমায়?জবাব দেওয়া হল না।
মা আস্তে বললেন, দিয়েছি। আমিই দিয়ে দিয়েছি। তুমি ব্যস্ত থাক।
সহসা লক্ষ্য পড়ল, মা আর আমায় তুই বলেন না। কতদিন বলেন না?
আমার অভিমান হল। বড়ো মেয়েদের চিঠি মা নিজে লিখেছেন বলে নয়, আমাকে তুমি বললেন বলে।
অথচ মা আমায় তুমি করে কথা বলছেন অনেকদিন। বেবির বদলে আলতো করে দেবীও বলেছেন কতদিন যেন। দাদাও যেন ওই ব আর দয়ের মধ্যবর্তী কি বলে।
বউদি অবশ্য দেবী বলে না, কিন্তু বেবিই বা কবে বলে? ডাকেই না তো!
হঠাৎ আমার সেই পুরনো নামটার জন্যে ভয়ানক মন কেমন করে উঠল। মনে পড়ে গেল দুরন্তর সেই প্রথম আদরের অভিব্যক্তি।
বেবি, বেবি! কচি খুকু! আহা-হা! লজেন্স খাবে খুকু? ড পুতুল নেবে?
মনে হল এসব নিশ্চয়ই আর মনে নেই ওর। ও বিচ্ছিরী রকম বদলে গেছে। ও হয়তো কাটখোট্টা হয়ে গেছে, হয়তো নিগ্রোদের মতো দেখতে হয়ে গেছে। ইচ্ছে করে ভাবতে বসলাম ওইসব, তারপর কঁদতে বসলাম।
বসলাম ঘরের দরজা বন্ধ করে সন্ধ্যার ধ্যান-ধারণার ছুতোয়।
কেঁদে কেঁদে বললাম, জীবনের সব সোনার দিনগুলো বরবাদ করে দিয়ে সোনা কুড়াচ্ছো তুমি! ফিরে এসে যদি আমায় না পাও?
তারপর চোখ মুছে উঠলাম।
মনের জোর করে বললাম, পাবে না কেন, আমি তো আর সত্যি বদলাচ্ছি না।
আর ও যদি বদলে আসে? ভেঙে চুরে তন করে দেব সেই বদল।
.
২৪.
পরদিন বাড়িতে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল।
শানু এল তার নতুন বরকে নিয়ে।
শুনলাম আগে থেকে নাকি নেমন্তন্ন করা হয়েছে।
বউদি দেয়ালকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, কী আর করব, মায়ের পেটের মা-মরা ছোটোবোন, ফেলব কি করে? ভাই-ভাজ তো ত্যাগ করেছে, ও বেচারী যায় কোথায়?
সত্যি, যায় কোথায়? আদর খাবার একটা জায়গা তো দরকার ওর।
অতএব এল।
নতুন শাড়ি-গহনায় ঝলমলিয়ে ঠিক নববিবাহিতার মূর্তিতেই এল। চোখের কোণে সেই ঔজ্জ্বল্য, মুখের হাসিতে সেই মাধুর্য। আগেকার লাজুক লাজুক কুণ্ঠিত কুণ্ঠিত ভাবটা আর নেই, মুখে চোখে আর এক মোহময় লজ্জার আবেশ।
আগে আমি দেখিনি, মা এসে চুপি চুপি বলেছিলেন, যা-ইচ্ছে হচ্ছে এখন সংসারে। শানু তো বর নিয়ে নেমন্তন্নে এল। মাংস রান্না হচ্ছে ঘটা করে। চপ-কাটলেটও হবে মনে হয়।
সব কিছু শুনে হঠাৎ মনে হল, এখন খাবার ঘরের টেবিলে বসেই ওসব খেতে পারবে শানু সবার সামনে।
তার মানে বাধা জিনিসটা কেবলমাত্র একটা লোকাঁচার।
লজ্জা জিনিসটা শুধু একটা কাগজের দেয়াল।
তাহলে আমারও কিছু ভাবনার নেই।
আমিও আবার আমার এই ব্রহ্মচর্যের খোলস ফেলে সহজেই রঙে রসে উথলে উঠতে পারব।
মা বললেন, সিঁদুর পরেছে সিঁথি জুড়ে।
বিরক্ত হয়ে বললাম, বিয়ে হয়েছে, পরবে না কেন?
মা ভয়ে ভয়ে সরে গেলেন।
মা-র তার এই দেবীকন্যার বিরক্তিতে বড়ো ভয়।
.
২৫.
আমি অবশ্য নিজে উঠে দেখা করতে গেলাম না। শানুই এল একসময়।
ঘরের বাইরে অস্ফুট একটু কণ্ঠ শুনলাম, এই হচ্ছে দিদির ননদের ঠাকুরঘর।
শানুও আমায় আর বেবি বলল না, বলল দিদির ননদ।
তারপর ঘরে এসে দাঁড়াল দুজনে হাসিমুখে।
শানুর মুখে নবোঢ়ার রং, শানুর বরের মুখে নতুন বরের খুশি। ওরা যে পরস্পরকে ভালো বেসেছে তাতে সন্দেহ নেই।
এতক্ষণ ভাবছিলাম, দেখা হলে বলব শানুকে, দেখলে তো শানু, জীবন জিনিসটা কত দামী? দেখলে তো ওকে হারিয়ে ফেললেই হারিয়ে গেল বলে পরকালের পথ খুঁজতে বসতে নেই। আবার তাকে আহরণ করে নিতে হয়।
কিন্তু বলতে পারলাম না।
হঠাৎ ওদের সামনে নিজেকে ভারি বেচারি মনে হল। মনে হল, আমাকে ওরা করুণার দৃষ্টিতে দেখছে। আমি ওসব কথা বললে ওরা হেসে উঠবে। বলবে, তুমি জীবনের বোঝ কি হে?
অতএব আমি দেবী মার খোলসে ঢুকে পড়লাম।
খুব নরম মিষ্টি আর করুণার হাসি হেসে বললাম, সুন্দর দেখাচ্ছে তোমায় শানু!
শানুর বরটা একটু প্রগভের মতো বলে উঠল, আর আমায় বুঝি খুব খারাপ দেখছেন?
আমি আরও মিষ্টি হেসে ওকে নস্যাৎ করে দিয়ে বললাম, তোমায় তো আগে দেখিনি ভাই! মনে হল অনেকটা উঁচুতে উঠে গেলাম ওদের থেকে।
তারপর ওদের হাতে আমার ঠাকুরের প্রসাদ দিলাম।
আর তারও পর শানু ছোট্ট একটি রুপোর মালা দিয়ে আমার ঠাকুরকে প্রণাম করে লাজুক হেসে বলল, আমার মানত ছিল।
চলে গেল তারপর।
অনেকদিন পরে এ বাড়িতে হাসি আমোদ হই হুল্লোড় শোনা গেল। দাদার খোলা গলার হাসিটা যেন অপরিচিত মনে হল।
ছোট্ট একটি পাষাণ দেবতার ভারে পাহাড় চাপিয়ে রেখেছি আমি সংসারে, আজ ওরা সে সংসারে আর একটা জানলা খুলে একটু নিশ্বাস নিচ্ছে।
শুনলাম দাদার ছেলেটা নাকি এই কঘণ্টাতেই মেসোর পরম ভক্ত হয়ে গেছে। বলছে নাকি মাসির সঙ্গে আসানসোলে চলে যাবে।
আচ্ছা, নিত্য হাজার ইষ্টনামের অবদানেও ঈর্ষা জিনিসটা যায় না কেন?
মঠে দিদিরা আমায় ঈর্ষা করে, আমি তুচ্ছ শানুকে ঈর্ষা করছি। অথচ ওই ছেলেটার দিকে ফিরেও তাকাই না আমি, যে ছেলেটা পিসিকে না ভজে মাসিকে ভজতে চাইছে।