২১-২৫. পাঠশালার কথা

২১.

সকালে উঠিয়া আজাহের ছেলেকে বলিল, “আইজ তুই দূরি কুনহানে যাবিন্যা। তোরে নিয়া আমি পাঠশালায় দিব। লেখাপড়া করতি অবি তোর, আমি ঘুইর‍্যা আসি, তারপর নিয়া যাব তোরে।”

কিন্তু পাঠশালার কথা শুনিয়া ভয়ে বছিরের সমস্ত গা শিহরিয়া উঠিল। সে শুনিয়াছে। পাঠশালায় গুরু মশায় ছাত্রদিগকে মারে। কত রকমের শাস্তি দেয়। সে তাড়াতাড়ি না। খাইয়াই একটা জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করিল। দুপুর বেলা বাপ আসিয়া তাহাকে এ-বনে ওবনে কত খুঁজিল, কোথাও তাহার সন্ধান পাইল না। বনের মধ্যে ঢুকিয়া সারাদিন বছির এখানে সেখানে ঘুরিল। গাছের পেয়ারা পাড়িয়া খাইল। জঙ্গলের কুল পাড়িয়া স্তূপাকার করিল–তারপর সন্ধ্যাবেলায় চুপি চুপি বাড়ি ফিরিয়া আসিল। আসিয়াই দেখে গ্রামের মোড়লের সঙ্গে তাহার বাপ আলাপ করিতেছে।

মোড়ল বলিল, “বলি, আজাহের-বাই, তুমি নাকি তোমার ছাওয়ালডারে ইস্কুলি দিব্যার চাও? জান লেখাপড়া শিখলি হগলের মানায় না।”

“আপনার কতা বুজবার পারলাম না মোড়ল সাব,” আজাহের বলে।

“হোন তবে,” মোড়ল উত্তর করিল, “মুরালদার সৈজদ্দী তার পুলাডারে ঈস্কুলি দিছিল। দুই মাস না যাইতেই ছাওয়ালডা মইরা গ্যাল। সগলের উয়া সয় না।”

আজাহের বলিল, “আমি আইজ ইন্দু পাড়ায় যাইয়া দেইখ্যা আইছি। কতজনের পুলাপাইন লেখাপড়া করত্যাছে; কিন্তু তারা ত মরে না?”

“আরে মিঞা! এইডা বুজবার পারলা না? ওরা ওইল ইন্দু। ওগো মদ্দি লেহাপড়ার চইল আছে। হেই জন্যি ওগো কুনু ক্ষেতি হয় না।”

“এ কতা আমি মানি না মোড়লসাব। আমাগো দ্যাশে অনেক মোছলমানের ছেলে লেহাপড়া শিকত্যাছে। ফইরাতপুরির শহরে এমন মোছলমান দেখছি, আল্লার দইন্যার যত বিদ্যা প্যাটের মদ্দি বইরা রাখছে।” গর্বের সঙ্গে আজাহের বলে।

মোড়ল তাজ্জব হইয়া জিজ্ঞাসা করে, “আরে কও কি আজাহের বাই? মোছলমানের ছেলে লেহাপড়া জানে?”

“শুধু কি জানে মোড়লসাব? মোছলমানের ছেলে লেহাপড়া শিখ্যা হাকিম ঐছে। সারাদিন বয়া বয়া কলম দিয়া কাগজের উপর দাগ কাটে।”

“আমি ত জানি, আমরা মোছলমান জাত ছোট-জাত। আমাগো লেহাপড়া অয় না।”

“আমাগো মৌলবীসাব কন, আমরা গরীব ঐতে পারি কিন্তুক আমরা ছোট-জাত না। জানেন মোড়লসাব! একজন আমারে কইছে এক সময় আমরা এই দ্যাশের বাদশা ছিলাম। এহন লেহাপড়া জানি না বইল্যা আমরা ছোট অয়া গেছি।”

“এ কতাডা তোমার মানি আজাহের বাই। লেহাপড়া না জাইন্যা চোখ থাকতেও আমরা কানা হয়া আছি। আর যারা লেহাপড়া জানে তারা আমাগো মানুষ বইল্যাই মনে করে না। তা তুমার ছাওয়ালডারে যদি ইস্কুলি দিবা, তয় আমারডারেও লয়া যাই। দেহি কি অয়।”

“হেই কতাই ত কইবার চাইছিলাম। আপনার ছাওয়াল নেহাজদ্দী আর আমার পুলা। বছির কাইল ইস্কুলি দিয়া আসপ।”

“আইচ্ছা বাই নিয়া যাইও। কিন্তুক আর একটা কতা। সাত দিনের চাউল হেদিন তোমারে দিয়া গেছিলাম। আইজকা সাতদিন পুরা ঐল। তুমি আমার ওহান ত্যা দুই ছালা দান নিয়া আইস গ্যা। পুলাপান গো খাওয়াইবা ত।”

“দান আনতি লাগব না মাতবর সাব!”

“ক্যা? তয় খাইবা কি?”

“এই কয়দিন জঙ্গল ত্যা খড়ি নিয়া ফৈরাতপুর বেচছি। তাতে রোজ দেড় টাহা, দুই। টাকা ঐছে। তাতে আমাগো কুনু রকমে চইল্যা যায়?”।

“কও কি আজাহের? তয় ত তুমি খুব কামের মানুষ! কিন্তু বাই! যহন যা দরকার। আমার ওহানে যায়া চাবা, বুঝলা বাই? যাই দেহি, শরীরডা যেমুন জ্বর জ্বর করতাছে–শুইয়া থাকিগ্যা।”

মোড়ল চলিয়া গেল। আজাহেরের ছেলে বছির ইতিমধ্যে খাইয়া শুইয়া পড়িয়াছে। শুইয়া শুইয়া মোড়ল ও তার বাপের মধ্যে যেসব কতাবার্তা হইয়াছে সকল শুনিয়াছে। মোড়ল যে তাহার বাপের কাছে যুক্তিতে হারিয়া গেল সেজন্য সে বড়ই দুঃখিত হইল। হায়, হায়, কাল আর সে পালাইয়া যাইতে পারিবে না! তাহাকে স্কুলে যাইতে হইবে। সেই গুরু মহাশয়ের বেত যেন তাহার চোখের সামনে লকলক করিয়া নাচিতেছে।

বছির কিছুতেই ভাবিয়া পায় না, কাল হইতে সে জঙ্গলে জঙ্গলে ইচ্ছামত বেড়াইতে পারিবে না। বনের ভিতর হইতে মাকাল ফল পাড়িয়া আনিতে পারিবে না। এই দুঃখ সে কেমন করিয়া সহ্য করিবে। বাপের সহিত বহুবার শহরে যাইয়া সে বিদ্বান লোকদের দেখিয়াছে। তাহারা মোটা মোটা বই সামনে লইয়া সারাদিন বসিয়া থাকে। এই গরমের দিনেও জামা কাপড় গায়ে পরিয়া থাকে। দুনিয়ার বাদশা বানাইয়া দিলেও সে কখনো এমন জীবন যাপন করিতে পারিবে না। আধ ঘন্টা এক জায়গায় চুপ করিয়া থাকিলে তাহার দম আটকাইয়া আসিতে চায়। আর এই সব শহরের পড়ুয়া লোকেরা সারাদিন বই সামনে করিয়া বসিয়া থাকে। গরমের দিনেও জামা কাপড় গায়ে রাখে। সে হইলে দুঃখে গলায় দড়ি দিত। কিন্তু হায়! কাল হইতে তাহাকে সেই জীবনই বরণ করিয়া লইতে হইবে। আচ্ছা, আজকের রাতের মধ্যে এমন কিছু ঘটিয়া উঠিতে পারে না, যার জন্য তাহাকে স্কুলে যাইতে হইবে না। এমন হয়, খুব ঝড় হইয়া তাহাদের বাড়ি-ঘর উড়াইয়া লইয়া যায়, সকালে তার বাপ তাহাকে বলে, বছির! তুই আইজ ইস্কুলে যাইস ন্যা।

এমনও হইতে পারে তার খুব জ্বর হইয়াছে, জ্বরের ঘোরে বছির আবোলতাবোল বকিতেছে, তার বাপ আসিয়া বলে, বছির! কাজ নাই তোর স্কুলে যাইয়া।

স্কুলে যাওয়াটা বন্ধ হউক, তাহার জন্য যে-কোন ক্ষতি বা সর্বনাশ তার উপরে কিংবা তার বাড়ি-ঘরের উপরে হউক তাতে বছির কোনই পরোয়া করে না। এমনি করিয়া ভাবিতে ভাবিতে কখন সে ঘুমাইয়া পড়িল। ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া সে স্বপ্ন দেখিতে লাগিল : তাহার সামনে অনন্ত অন্ধকার, সেই আন্ধারের উপর একখানা লাঠি আগুনের মত ঝকঝক করিতেছে।

পরদিন কোরবানীর গরুর মত কাপিতে কাঁপিতে বছির আর নেহাজদ্দী ভাটপাড়া গায়ে সেন মহাশয়ের স্কুলের পথে রওয়ানা হইল। আজাহের আগে আগে যাইতে লাগিল। বছির আর নেহাজী পিছাইয়া পড়ে। আজাহের দাঁড়াইয়া তাহাদের জন্য অপেক্ষা করে। এইভাবে আধ ঘন্টার মধ্যে তাহারা সেন মহাশয়ের স্কুলে আসিয়া যাহা দেখিল তাহাতে দুইটি তরুণ বালকের মন ভয়ে শিহরিয়া উঠিল। স্কুলের বারান্দায় চার পাঁচজন ছেলে ‘নিল ডাউন’ হইয়া আছে। আর একজন ছেলেকে ‘হাফ নিল ডাউন’ করাইয়া তাহার কপালটা আকাশের দিকে উঠাইয়া সেখানে এক টুকরা ভাঙা চাড়া রাখিয়া দেওয়া হইয়াছে। সামনে মাষ্টার বেত হাতে করিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। যদি কপাল হইতে চাড়া পড়িয়া যায় তখন মাষ্টার বেত দিয়া সপাসপ তাহার পায়ে বাড়ি মারিতেছেন। ছেলেটি চীৎকার করিয়া কাঁদিয়াআবার মাটি হইতে চাড়াখানা কুড়াইয়া কপালের উপর রাখিয়া দিতেছে। তাহার পা দুইটি কাঁপতেছে আর সে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলিতেছে।

এই অবস্থার মধ্যে আজাহের ছেলে দু’টিকে সঙ্গে লইয়া মাষ্টার মহাশয়ের সামনে যাইয়া খাড়া হইল।

মাষ্টার মহাশয় ছেলে দুটির দিকে চাহিয়া খুশী হইলেন। কারণ স্কুলের ছাত্রদের নিকট হইতে যাহা বেতন পাওয়া যায় তাহাই মাষ্টার মহাশয়ের একমাত্র উপার্জন। তিনি প্রসন্ন হাসিয়া বছিরের নাম জিজ্ঞাসা করিলেন। ভয়ে বছির কথা বলিতে পারিতেছিল না। আজাহের আগাইয়া আসিয়া তাহার মাথায় হাত বুলাইয়া বলিল, “কও বাজান! নামডা কয়া ফ্যালাও।”

কাঁপতে কাঁপতে বছির বলিল, “আমার নাম বছির।”

“বেশ, বেশ। আচ্ছা তোমার নাম কি বাপু?” মাষ্টার মহাশয় নেহাজদ্দীকে জিজ্ঞাসা করিলেন। ভয়ে নেহাজদ্দীন হামলাইয়া কাঁদিয়া ফেলিল।

আজাহের বলিল, “উয়ার নাম নেহাজদ্দীন।”  

মাষ্টার আর নাম জানিবার জন্য পীড়াপীড়ি করিলেন না। তাহার খাতার মধ্যে বছির আর নেহাজদ্দীনের নাম লিখিয়া লইলেন। মাসে দুই আনা বেতন আর ভর্তির ফিস দুই আনা, দুইজনের একত্রে আট আনা দিতে হইবে। মাষ্টারের মুখে এই কথা শুনিয়া আজাহের পরিধানের কাপড়ের খোট হইতে সযত্নে বাধা আট আনার পয়সা বাহির করিয়া দুইবার তিনবার করিয়া গণিয়া মাষ্টার মহাশয়কে দিলেন। মাষ্টার মহাশয় আবার সেই পয়সাগুলি দুই তিনবার করিয়া গণিলেন। পয়সাগুলির মধ্যে একটি আনি ছিল! সেটিকে ভালমত পরীক্ষা করিয়া কোঁচার খুঁটে শক্ত করিয়া বাঁধিয়া লইলেন। তারপর আজাহেরকে বলিলেন “এবার তুমি যাইবার পার। উরা এহন থাক!”

যাইবার জন্য আজাহের পা বাড়াইতেছে এমন সময় বছির তাহার হাত ধরিয়া কাদিয়া। ফেলিল, “বাজান, আমাগো ছাইড়্যা যাইও না।”

মাষ্টার মহাশয় তার বেতখানা দিয়া সামনের মাটিতে একটা বাড়ি মারিয়া ধমক দিয়া বলিলেন, “বাপের হাত ছাইড়্যা দাও।” মাষ্টারের ধমকের সঙ্গে সঙ্গে সেই সুকোমল হাতের বন্ধনী তার বাপের হাত হইতে খসিয়া পড়িল।

বাপ ফিরিয়া মাষ্টারের দিকে চাহিয়া যেমন আর দশজন অভিভাবক মাষ্টারকে বলে, তেমনি চিরাচরিত প্রথায় তাহাকে বলিয়া গেল, “দ্যাহেন মাষ্টার-সাব! ছাওয়াল দিয়া গেলাম আপনারে। সেই সঙ্গে উয়ার চামও দিয়া গেলাম আপনারে কিন্তুক হাড্ডি রইল আমার। ছাওয়াল মানুষ করতি যত খুশী ব্যাতের বাড়ি মারবেন।” সেকালে অভিভাকদের ধারণা ছিল মাষ্টার ছেলেকে যত বেত মারিবে তাহার তত বিদ্যা বাড়িবে। একজন শিক্ষিত বাপের মতন এই অশিক্ষিত চাষাবাপও যে মাষ্টারকে তাহার ছেলেকে মারিবার জন্য এমন ভরসা দিতে পারিল তাহা শুনিয়া মাষ্টার মহাশয় বড়ই খুশী হইলেন। এই সব অশিক্ষিত লোকের ছেলেদের পড়ান সব সময় নিরাপদ নয়। একবার এক গ্রাম্য মোড়লের ছেলেকে মাষ্টার বেত মারিয়াছিলেন। মোড়ল হাটের মধ্যে মাষ্টারকে ধরিয়া যেভাবে প্রহার করিয়াছিল তাহা এদেশে প্রবাদ-বাক্য হইয়া আছে। মাষ্টার আজাহেরকে বলিলেন, “সে কতা আর কইতি অবিন্যা মিঞা! বুঝতি পারছি, তুমার মদ্দি গিয়ান আছে।” খুশী হইয়া মাষ্টারকে সালাম করিয়া আজাহের চলিয়া গেল।

বছির আর নেহাজদ্দীনকে সে যেন চিরজনমের মত বনবাস দিয়া গেল। ডাক ছাড়িয়া তাহাদের কাঁদিতে ইচ্ছা হইতেছিল। কিন্তু মাষ্টারের চোখের দিকে চাহিয়া তাহাদের সমস্ত কান্না যেন কোথায় উবিয়া গেল। আর কিন্তু মাষ্টার তাহাদের কিছু বলিলেন না। এতক্ষণ মাষ্টার আজাহেরের সঙ্গে কথা বলিতেছিলেন। এই অবসরে গণশা তাহার চৌদ্দ পোয়া অবস্থা হইতে কপালের চাড়াখানা হাতে লইয়া পাশের একটি ছেলের সঙ্গে কথা বলিতেছিল। তাহা লক্ষ্য করিবামাত্র মাষ্টার বেত লইয়া গণশার উপর ঝাপাইয়া পড়িলেন। চীৎকার করিয়া গণশা শুইয়া পড়িল। সেই অবস্থায়ই মাষ্টার তাহার সারা গায়ে সপাসপ বেতের বাড়ি মারিতে লাগিলেন। বাবারে মারে চীৎকার করিয়া গণশা আকাশ-পাতাল ফাটাইতেছিল। তাহার কান্না শুনিয়া স্কুলের সামনে বহুলোক আসিয়া জড় হইল। কিন্তু তাহারা মাষ্টারকে কিছু বলিল না। বরঞ্চ মাষ্টার যে গণশাকে এইরূপ। নির্মম ভাবে মারিতেছিলেন, সে গণশার ভালর জন্যই করিতেছিলেন, তাহাদের নীরব সমর্থনে ইহাই প্রমাণ পাইল। অনেকক্ষণ গণশাকে মারিয়া বুঝিবা হয়রান হইয়াই মাষ্টার তাহাকে ছাড়িয়া দিলেন। তারপর আর আর ছেলেদের পড়া লইতে লাগিলেন।

মাষ্টার ছেলেদের পড়াইতে লাগিলেন, না তাহাদের মারিতে লাগিলেন তাহা বুঝিয়া। উঠা বড়ই মুস্কিল। এই স্কুলের ছেলেরা প্রায় সকলেই গরীবের ঘর হইতে আসিয়াছে। তাহাদের অভিভাবকেরা কেহই লেখাপড়া জানে না। সেইজন্য বাড়িতে তাহাদের পড়া বলিয়া দিতে পারে এমন কেহই নাই। স্কুলে মাষ্টার পড়া দিয়া দেন, কিন্তু পড়া তৈয়ার করাইয়া দেন না। ছাত্রদের বাড়িতে কেউ লেখাপড়া জানে না। কে তাহাদের পড়া বলিয়া দিবে? সুতরাং পরের দিন মাষ্টার যখন পড়া ধরেন কেহই উত্তর করিতে পারে না। এই স্কুলে কোন কোন ছেলে সাত আট বৎসর ধরিয়া একাদিক্রমে একই ক্লাশে পড়িতেছে কিন্তু বর্ণ পরিচয়ের বইখানাও তাহারা ছাড়াইয়া যাইতে পারে নাই। স্কুল তাহাদের নিকট পীড়নের স্থান। শুধুমাত্র অভিভাবকদের তাড়নায়ই তাহারা এখানে আসিয়া সহ্যের অতীত নির্যাতন ভোগ করিয়া থাকে। এইভাবে ঘণ্টা খানেক ছেলেদের ঠেঙ্গাইয়া মাষ্টার তাহাদের ছুটি দিয়া দিলেন। গণশাও চৌদ্দপোয়া অবস্থা হইতে রেহাই পাইল। মহাকলবর করিয়া তাহারা স্কুল ঘর হইতে বাহির হইয়া পড়িল। বছির আর নেহাজদ্দীনও বাড়ি রওয়ানা হইল।

বছির বাড়ির কাছে আসিয়া দেখে, মা পথের দিকে চাহিয়া আছে। ছোট বোন বড় কলরব করিয়া দৌড়াইয়া আসিল। তাহার বাপ খেতে কাজ করিতেছিল, তাহাকে দেখিয়া সেও বাড়িতে আসিল। আজ সকলেই যেন তাহাকে কি একটা নূতন দৃষ্টি দিয়া দেখিতেছে। বছিরের নিজেরও মনে হইতেছিল, সে যেন আজ কি একটা হইয়া আসিয়াছে। সেই সুখের চেতনায় সে স্কুলের সকল অত্যাচারের কাহিনী ভুলিয়া গেল। মা আজ নতুন চাউলের পিঠা তৈরী করিয়াছে। তাই খাইতে খাইতে বছির তাহার স্কুলের সকল কাহিনী বলিতে লাগিল। মা ও বাপ সামনে বসিয়া অতি মনোযোগের সঙ্গে শুনিতে লাগিল। এ যেন কত বড় মহাকাব্য তাহারা শুনিতেছে।

.

২২.

পরের দিন বছির আর নেহাজদ্দীন পাঠশালায় চলিল। মাষ্টারের নির্দেশ মত রান্না করা। হড়ীর পিছনে লাউপাতা ঘসিয়া তাহাতে পানি মিশাইয়া তাহারা কালি তৈরী করিয়াছে। তাহা দোয়াতে ভরিয়া সেই দোয়াতের মুখে রশি বাধিয়া হাতে করিয়া ঝুলাইয়া লইয়া তাহারা স্কুলে চলিয়াছে। খাগড়া-বন হইতে লাল রঙের খাগড়া বাছিয়া তাহা দিয়া কলম তৈয়ার করিয়াছে। আর কলা পাতা কাটিয়া খণ্ড খণ্ড করিয়া লইয়াছে। তাহার উপরে মাষ্টার মহাশয় ক, খ প্রভৃতি বর্ণমালা লোহার কাঠি দিয়া লিখিয়া দিবেন। তাহারা উহার। উপরে হাত ঘুরাইয়া বর্ণমালা লেখা শিক্ষা করিবে।

গাঁয়ের আঁকা-বাঁকা পথ বাহিয়া ছোট গাঙ। তার উপরে বাঁশের সাঁকো! তাহা পার হইয়াই সেন মহাশয়ের পাঠশালা। মাষ্টার মহাশয় পাঠশালায় আসেন বেলা বারটায়, কিন্তু ছাত্রদের অনেকেই নয়টা বাজিতেই পাঠশালায় আসিয়া উপস্থিত হয়। তাহারা গোল্লাছুট, হাডুডু প্রভৃতি গ্রাম্য খেলা খেলিয়া এর গাছ হইতে,ওর গাছ হইতে, যখন যে-কালের যে ফল ফুল চুরি করিয়া পাড়িয়া মহাকলরবে এই সময়টা কাটাইয়া দেয়। কাহারও মাচানের শশা ছিঁড়িয়া, কাহারও কাঁদিভরা নারিকেল পাড়িয়া, কাহারও খেতের তরমুজ চুরি করিয়া, তাহারা নিরীহ গ্রামবাসীর আতঙ্কের কারণ হইয়া পড়ে। মাঝে মাঝে তাহারা পরস্পরে মারামারি করিয়া মাথা ফাটাফাটি করে। যে যে পথে মাষ্টার মহাশয়ের আসিবার সম্ভাবনা রহিয়াছে সেই সেই পথে ছেলেরা সতর্ক দৃষ্টি রাখে। দূর হইতে মাষ্টার মহাশয়ের ভাঙা ছাতাখানা যার দৃষ্টিতেই আগে পড়ুক সে দৌড়াইয়া আসিয়া আর আর ছেলেদের খবর দেয়। অমনি ছাত্রেরা যে যেখান হইতে ছুটিয়া আসিয়া উচ্চ শব্দ করিয়া পড়িতে মনোযোগ দেয়। দূর হইতে মনে হয় পাঠশালা ঘরখানিতে যেন সমুদ্র গর্জন হইতেছে।

মাষ্টার মহাশয় আসিয়াই প্রথমে গায়ের জামাটা খুলিয়া ঘরের বেড়ার সঙ্গে ঝুলাইয়া রাখিয়া হাতল-ভাঙ্গা চেয়ারখানার উপর বসিয়া পড়েন। অমনি দুই তিনটি ছাত্র মাষ্টার মহাশয়কে বাতাস করিতে আরম্ভ করে। মাষ্টার মহাশয়ের হুঁকোটিকে লইয়া একটি ছাত্র দৌড়াইয়া পানি ভরিতে যায়। আর একজন দৌড়াইয়া যায় কলিকায় তামাক ভরিয়া পাশ্ববর্তী বাড়ি হইতে আগুন আনিতে। এই কার্য প্রায়ই গণশা সমাধা করে। পূর্বে কায় পানি ভরা আর কলিকায় আগুন দেওয়ার ভার গণশার উপরেই পড়িত কিন্তু একজন ছাত্র নাফরমানি করিয়া একদিন মাষ্টার মহাশয়ের কাছে নালিশ করিয়া দিয়াছিল, “মাষ্টার মহাশয়! গণশা আপনার হুঁকায় জোরে জোরে টান দিয়া আনিয়াছে।” অবশ্য গণশা তখনই ঠাকুর দেবতার নাম লইয়া দিব্যি করিয়া বলিয়াছিল সে উহা করে নাই, কিন্তু কোতে টান দিয়া মাষ্টার মহাশয় যখন দেখিলেন, তাহাতে কিঞ্চিৎ মাত্র তামাক অবশিষ্ট নাই এবং গণশার নাক দিয়া তখনও কিঞ্চিৎ ধূম্র বাহির হইতেছে, তখন বেত লইয়া গণশাকে প্রচুর শিক্ষা দিয়া সেই হইতেই নিয়ম করিলেন যে গণশা হুঁকায় পানি ভরিতে পারিবে না, সে শুধু। কলিকায় তামাক ভরিয়া আগুন দিয়া আনিবে। এই ব্যবস্থার ফলে যদিও গণশা মাঝে মাঝে কলিকায় টান দিয়া তামাকের অর্ধেকটা পোড়াইয়া আনে তবু তার মত পরিপাটি করিয়া কলিকায় তামাক ভরিয়া আগুন দিতে আর কেহই পারে না বলিয়া একাজের ভার এখনও গণশার উপরেই রহিয়াছে।

মাষ্টার মহাশয়ের ধূমপান শেষ হইলেই আরম্ভ হইল নালিশের পালা। ও-পাড়া হইতে কমিরউদ্দীনের বিধবা বউ আসিয়া হামলাইয়া কাঁদিয়াপড়িল, “মাষ্টার মহাশয়! আমার ধরন্ত শশা গাছটি আপনার পাঠশালার আবদুল টানিয়া ছিঁড়িয়া দিয়া আসিয়াছে। তখনই আবদুলকে ডাকিয়া আনিয়া মাষ্টার মহাশয় সূর্য-ঘড়ির ব্যবস্থা করিলেন। সূর্য-ঘড়ি মানে ‘হাফ নিল ডাউন হইয়া সূর্যের দিকে চাহিয়া থাকা। ফটিকের বাপ আসিয়া নালিশ করিল, ইয়াসিন ঢিল মারিয়া তাহার ছেলের মাথা ফাটাইয়া দিয়াছে। এই মতে বহু নালিশ এবং তাহার বিচার সমাধান করিয়া মাষ্টার মহাশয় নাম প্রেজেন্ট আরম্ভ করিলেন। নাম প্রেজেন্ট করিয়া দেখা গেল মধু, আজিজ আর করিম আসে নাই। অমনি তিন চারজন ঢেঙা ছাত্র মাষ্টার মহাশয়ের নির্দেশ মত তাহাদের খুঁজিতে ছুটিল। এইবার যথারীতি মাষ্টার মহাশয় উপস্থিত ছাত্রদিগকে পড়ান আরম্ভ করিলেন। পড়ানোর সময় তাঁহার মুখ যতটা চলিল তাহার অধিক হাতের বেতখানা ছাত্রদের পিঠে পড়িতে লাগিল।

নেহাজদ্দী আর বছির নূতন আসিয়াছে। কলাপাতার উপর বর্ণমালা লিখিয়া দিয়া মাষ্টার মহাশয় তাহাদিগকে তাহার উপর হাত ঘুরাইবার নির্দেশ দিলেন। অপটু হাতে কলম ধরিতে হাত কাপিয়া যায়। কলমটি কালির দোয়াতে ডুবাইয়া সেই খাড়া পাতার উপর বুলাইতে কলমের আগা এদিকে ওদিকে ঘুরিয়া যায়। তবু অতি মনোযোগের সঙ্গে সেই খাড়া পাতার উপর তাহারা হাত বুলাইতে থাকে। বছিরের কেবলই বাড়ির কথা মনে হয়। ছোট বোন বড় যেন এখন কি করিতেছে। নেহাজদ্দীনের বোন ফুলী বুঝি এখন আম বাগানের ধারে তার সঙ্গে খেলিতে আসিয়াছে। কে বাশঝাড়ের আগায় উঠিয়া তাহার নাকের নথ গড়িবার জন্য বাঁশের কচি পাতা পাড়িয়া দিবে। এইসব কথা তাহার কলমের আঁকাবাঁকা অক্ষরগুলির মধ্যে প্রকাশ হয় কিনা জানি না, কিন্তু এইসব ভাবিতে তাহার কলমের আগা কলাপাতায় খাড়া অক্ষরের বেড়া ডিঙাইয়া এদিকে ওদিকে যাইয়া পড়ে। অমনি হাতের তালু দিয়া তাহা মুছিয়া ফেলিয়া আবার নূতন করিয়া সেই খাড়া অক্ষরের উপর হাত বুলাইতে থাকে।

অনেকক্ষণ পরে পাঠশালার ঢেঙা ছাত্ররা সেই অনুপস্থিত তিনটি ছাত্রকে ধরিয়া আনিল। বলির পাঠা যেমন কাঠগড়ায় উঠিবার আগে কপিতে থাকে তাহারাও সেইভাবে কপিতেছিল। তাহাদের একজন মাছ ধরিতে গিয়াছিল। হাতে-পায়ে কাদা লাগিয়া আছে। অপর দুইজন গহন জঙ্গলে মৌমাছির চাক হইতে মধু পাড়িবার জন্য সাজ-সরঞ্জাম তৈরী। করিতেছিল। মাষ্টার মহাশয় তাহাদিগকে এমন পিটান পিটাইলেন যে তাহাদের কান্না শুনিয়া বছিরের চোখ দিয়া জল আসিতেছিল।

বহুক্ষণ পরে পাঠশালার ছুটি। বছির আর নেহাজুদ্দীন বাড়ি ফিরিল।

.

২৩.

এইভাবে বহুদিন কাটিয়া গেল। একদিন গণশার সঙ্গে বছিরের আলাপ হইল। গণশার বাপ এদেশের একজন বর্ধিষ্ণ চাষী। বাড়িতে কোন কিছুরই অভাব নাই। বাপের বড় ইচ্ছা গণশাকে লেখাপড়া শেখায়। বাপ নিজে তিন চার গ্রামের মধ্যে সব চাইতে ধনী হইলেও লেখাপড়া জানে না বলিয়া লোকে তাহাকে সম্মানের চোখে দেখে না। সেইজন্য গণশাকে লেখাপড়া শিখাইয়া নিজের দৈন্যকে সে কতকটা ঢাকিতে চায়। কিন্তু মূর্খ পিতা ছেলেকে পাঠশালায় পাঠাইয়াই নিশ্চিন্ত। কি করিয়া ছেলের পড়াশুনার তদারক করিতে হয় জানে না। পাঠশালার মাষ্টার মহাশয়ের সেই মান্ধাতার আমলের শিক্ষা-প্রণালীর যাতাকলে পড়িয়া চার পাঁচ বৎসরেও ছেলে লেখাপড়ায় এতটুকুও অগ্রসর হইতে পারে নাই। কিন্তু পুস্তকের বিদ্যা না শিখিলেও তাহার মানস-বৃত্তি চুপ করিয়া থাকে নাই। কোন গাছের আম পাকিলে কি ভাবে চুরি করিয়া আনিতে হইবে, কোন জঙ্গলের ধারে কাহার গাছের কাঁঠাল পাড়িয়া আনিতে হইবে, এইসব বিদ্যায় তাহার সমকক্ষ কেহ নাই। এই সব চুরি-করা ফল-ফলারির একটাও সে নিজে মুখে দিয়া দেখে না। খেলার সাথীদের বিলাইয়া দিয়া আনন্দ পায়। এসব কথা প্রবাদের মত পাঠশালার সকল ছেলেই জানে।

বছির তাকে জিজ্ঞাসা করে, “আচ্ছা গণেশ ভাই! তুমি ত একটা ফলও মুহি দাও না। তয় মানষীর বাড়িত্যা চুরি কইরা পাইড়া আইন্যা সকলেরে বিলাও ক্যান?”

গণশা বলে, “দেখ বছির! তুই বুঝবি ন্যা। যাগো আমি ও-সগল আইন্যা দেই তাগো বাড়িতে ফল-ফলারি একটাও নাই। তারা ওগো গাছের ফল-ফলারির দিকে চায়া থাকে। আমার ইচ্ছা করে কিন্যা আইন্যা ওগো খাওয়াই। পয়সা নাই বইল্যা কিন্যা যহন আনবার পারি না, তহন চুরি কইরা নিয়া আসি। আয় বছির! আয় নেহা! ওই জঙ্গলের মদ্দি কুশাইর চুরি কইরা আইন্যা রাখছি। তোগো ভাগ কইরা দেই।”

বছির বলিল, “ধেৎ, তা ঐলে গুনা ঐব।”

গণশা হাসিয়া বলিল, “গুনা কিরে! ওগো খ্যাতে এত আছে! আমি ত মাত্তর কয়খানা নিয়া আইছি। চল তোগো জায়গা দেখায়া দেই। কাউকে কবি না কিন্তুক। ও-পাড়ার নেয়াজ আর মনসুর, তাগো নিজের বাড়ির কাঁঠাল চুরি কইরা আইন্যা খাওয়াইলাম। তারা কিনা মাষ্টার মশায়রে কয়া দিল। তা কয়া কি করল? মাষ্টার আমারে একটু মারল। এ মাইর ত আমার লাইগ্যাই আছে।”

এই বলিয়া গণশাবছির আর নেহাজদ্দীনকে টানিয়া লইয়া চলিল। সাহাপাড়া ছাড়িয়া আদুর ভিটা। তারপরে মাঠ। সেই মাঠের ওপারে শোভারামপুরের জঙ্গল। জঙ্গলের মাঝ দিয়া সরু একখানা পথ। সেই পথের উপরে দুই পাশের গাছের ডাল হইতে লতাপাতা আসিয়া ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে। কোথাও বেতের শিষা আসিয়া পথ আটকাইয়াছে। অতি সন্তর্পণে তাহা সরাইয়া গণশাবছির আর নেহাজদ্দীনকে আরও গভীর জঙ্গলের মধ্যে লইয়া গেল। দুই পাশ হইতে কুব কুব করিয়া কানা কুয়া ডাকিতেছিল। সামনের জলো-ডুবায় বাচ্চা লইয়া ডাহুক ডাহুকী ডাকিতেছিল। তাহাদের শব্দ শুনিয়া উহারা ঘন বেত ঝাড়ের মধ্যে লুকাইল। ডোবার একধারে সইলের পোনা কিলবিল করিতেছিল। গণশা পানির মধ্যে হাত ডুবাইয়া ধীরে ধীরে টোকা দিতে লাগিল। পোনাগুলি আসিয়া তাহার চারিধারে জড় হইল! তখন সে পকেট হইতে মুড়ি বাহির করিয়া তাহাদিগকে খাইতে দিল। এরূপ ভাবে খানিকক্ষণ খেলা করিয়া গণশা সামনের দিকে আরও আগাইয়া গেল। পথের ওই ধারে একটি গর্ত। হাতের ইশারায় বছির ও নেহাজদ্দীনকে শব্দ করিতে বারণ করিয়া গণশা যাইয়া সেই গর্তের সম্মুখে আরও কতকগুলি মুড়ি ছড়াইয়া দিল। খানিক বাদে গর্তের ভিতর হইতে তিন চারিটি শেয়ালের ছানা আসিয়া সেই মুড়ি খাইতে লাগিল। গণশা তাহার দুই তিনটাকে ধরিয়া কোলে করিয়া এমন ভাবে তাহাদের আদর করিতে লাগিল যেন উহারা তাহার মায়ের পেটের ভাই-বোন। আদর করিতে করিতে গণশা বলিল, “এগো আদর কইরা সুখ আছেরে। পাঠশালার ছাত্তরগো মত বেইমান হয় নালিশ করে না।” এখান হইতে গণশা আরও খানিক দূরে ঘন ফুলখড়ি গাছের জঙ্গলের মধ্য হইতে চার পঁচখানা গেণ্ডারী টানিয়া বাহির করিয়া বলিল, “তোরা খা।”

গেণ্ডারী খাইতে খাইতে তাহাদের অনেক কথা হইল। সন্ধ্যার পর কালো চাদর মুড়ি দিয়া কিভাবে গণশা শেখ হনুর খেত হইতে গেণ্ডারী চুরি করিয়াছিল, এমনি করিয়া দা ধরিয়া গেণ্ডারী কাটিলে শব্দ হয় না, গেণ্ডারী খেতের মধ্যেই বাঁশের চালার টং পাতিয়া হনু জাগিয়া খেত পাহারা দিতেছিল। তাহার কাশির শব্দ শুনিয়া গণশার বুক দুরু দুরু করিয়া কাঁপতেছিল। সে টের পাইলেই তাহার প্রতি হাতের তীক্ষ্ণধার টেটা হুঁড়িয়া মারিত, ইহার আনুপূর্বিক কাহিনী গণশা তাহাদের নিকট এমন করিয়া বর্ণনা করিল যেন সমস্ত ঘটনা তাহাদের চক্ষের সামনেই ঘটিতে দেখিতেছে। এই দুইটি শ্রোতার সামনে সমস্ত কিছু বলিতে পারিয়া গত রাত্রের অভিযানের সমস্ত দুঃসাহসিক ঘটনা তাহার নিকট কত বড় একটা গর্বের ব্যাপার হইয়া পড়িল।

খানিক পরে গেণ্ডারী চিবাইতে চিবাইতে-বছির বলিল, “আচ্ছা গণেশ ভাই! তুমি এত কাজ করবার পার কিন্তু রোজকার পড়াডা কইর‍্যা আস না ক্যান?”

গণশা বলে, “দেখ বছির! পড়বার ত আমারও মনে কয় কিন্তু পড়াডা মাষ্টার মশায় ক্যাবল একবার কয়া দ্যান। আমি মনে রাখপার পারি না। বাড়ি যায়া হে পড়া আমারে কিডা দেহায়া দিবি? আমাগো বাড়ির কেওই লেহাপড়া জানে না। সেন মশায়ের পুলারা বাল লেহাপড়া করে, ঘোষ মশায়ের পুলারা বাল পাশ করে, ওগো বাড়িতি পড়া দেহায়া দিব্যার লোক আছে, বাড়িতি মাষ্টার রাইখ্যাও ছাওয়ালপানগো পড়ায়।”

বছির বলে, “ঠিকই কইছ বাই। আমাগো বাড়িতি পড়া দেহায়া দিবার কেওই নাই। আমারেও মাষ্টার মশাইর মাইর খাইতি অয়। কিন্তুক আমাগো বাড়িতি যে বিদ্বান লোক নাই হে তো আমাগো অপরাধ না।”

গণশা বলে, “হে কতা কে বোঝে ভাই? তোরাও আমার মতন পোড়া কপাল্যা। সেই জন্যিই ত তোগো আমার এত ভাল লাগে!”

বছির গণশার কাছে আরও আগাইয়া আসে। গণশা বলে, “আর এক কর্তা হোন বছির! ওগো পুলারা দেমাগে আমার লগে কতা কয় না। হে দিন যে নারক্যাল চুরি কইরা আনলাম না? স্যান মশার আর গোষ মশার পুলাগো দিলাম না দেইখ্যা আমার নামে মাষ্টার মশার কাছে নালিশ করল। আচ্ছা ক তো বছির! ওগো গাছ ভরা কত নারক্যাল, তার একটাও ওরা কাউরে কুনুদিন দিয়া খায়? আমার চুরি করা নারক্যাল ওগো আমি দিব ক্যান? নালিশ পায়া মাষ্টার মশায় আমারে যা মারল! তা আমিও কয়া দিলাম বছির! একদিন কায়দায় পাইলে আমি ওগো পিঠে তার শোধ তুলব।”

বছির বলে, “গণেশ ভাই। তোমারে যহন মাষ্টার মশায় ব্যাত দিয়া মারল আমার হামলায়া কানবার ইচ্ছা করল। কানলাম না ভয়ে যদি তানি আইসা আমারেও ওইভাবে। মারে।”

এই কথা বলিতেই কোথাকার সাতসমুদুরের কান্দন যেন গণশাকে পাইয়া বসিল। মাষ্টারের অকথিত অত্যাচারের জ্বালা সে দিনের পর দিন মাসের পর মাস সহ্য করিয়া আসিতেছে, তার এত যে আদরের বাপ-মা আত্মীয়-স্বজন তারা কেউ কোনদিন এর জন্য এতটুকু সহানুভূতি তাকে দেখায় নাই। একবার মাষ্টার তাহাকে বাঁশের কঞ্চি দিয়া পিটাইয়া মাথার একস্থানে জখম করিয়া দিয়াছিল। সেই অবস্থায় বাপের কাছে গেলে বাপ বলিল, “তোরে পিটাইয়া মাইরা ফালাইল না ক্যান? মাষ্টার ত বিনি কারণে মারেন নাই। নিশ্চয়। কুনু দোষ করছিলি।” এই বলিয়া বাপ তাহার চোয়ালে আরও দুইটা থাপড় দিয়াছিল। ক্ষুদ্র পরিসর জীবনে সে যত দুঃখ পাইয়াছে সুবিশাল দুনিয়ার মধ্যে আজ এই একটি মাত্র লোক তাকে সহানুভূতি দেখাইল। মাষ্টারের এত যে মার তাতে সে কোনদিন চোখের জল ফেলে নাই। কিন্তু আজ এই ক্ষুদ্র বালকের কাছে সমবেদনার স্পর্শ পাইয়া তার সকল দুঃখ যেন। উথলাইয়া উঠিল। গায়ের জামা খুলিয়া গণশা বলিল, “দেখ বছির! মাষ্টার মাইরা আইজ আমারে রাখে নাই।”

বছির চাহিয়া দেখিল, তাহার পিঠ ভরা শুধু লাঠির দাগ। কোন কোন জায়গায় কাটিয়া গিয়া রক্ত পড়িতেছে। সেই ক্ষত স্থানে হাত বুলাইয়া দিতে দিতে বছির বলিল, “আহারে গণেশ বাই! তোমারে এমন কইরা মারছে?”

গণশা বলে, “দেখ বছির। আমি সন্ন্যাসী হয়া জঙ্গলে যায়া তপস্যা করব। দেবতা যদি আমার তপে তুষ্ট হয়া বর দিতি আসে তবে কইমু, আমারে এমন বর দাও ওই মাষ্টারের লাঠি গাছারে আমি যা হুকুম করুম ও যেন তাই করে। তহন আবার আইস্যা পাঠশালায়। পড়বার যামু। মাষ্টার যহন আমারে লাঠি দিয়া মারতি আইব অমনি লাঠিরে কইমু, লাঠি ফিরা যায়া মাষ্টারের পিঠি পড়, খানিকটা লাঠির বাড়ি পিঠি পাইলি তহন বুঝবি মাষ্টার, লাঠির মাইরের কেমুন জ্বালা।”

বছির বলে, “আচ্ছা গণেশ ভাই! এমন মন্তর সেহা যায় না? যহন মাষ্টার মশায় তোমারে মারতি আসপি তহন মন্তর পইড়া আমি কুঁক দিব, অমনি মাষ্টারের আত অবশ হয়া যাবি।”

এইভাবে তিন কিশোর বালকের জল্পনা-কল্পনায় বনের মধ্যে অন্ধকার করিয়া সন্ধ্যা হইয়া আসিল। তাহারা বন হইতে বাহির হইয়া যে যার বাড়িতে চলিয়া গেল।

বছির বাড়ি আসিতেই বড় আগাইয়া আসিল, “মিঞা বাই! তুমি এত দেরী করলা ক্যান? তোমারে না কইছিলাম, আমার জন্যি সোনালতা লয়া আইবা? তা আনছ নি?” চৌধুরীদের বাড়ির সামনে একটি কুল গাছে প্রচুর সোনালতা হইয়াছে। সোনালতা দিয়া হাতের পায়ের অলঙ্কার গড়া যায়–মালা করিয়া গলায় পরা যায়। বছির যেখানে যা কিছু। ভাল জিনিস দেখে ছোট বোন বড়ুকে আসিয়া বলে। সেদিন এই সোনালতার কথা বলিতেই বড় সোনালতা আনিবার জন্য বড় ভাইকে বারবার করিয়া বলিয়া দিয়াছিল। বছির বড়ই

অনুতপ্ত হইয়া বলিল, “আরে যা; সোনালতার কতা আমার মনেই ছিল না।”

মুখ ফুলাইয়া বোন বলে, “আচ্ছা, আচ্ছা। আমার কতা তোমার মনেই থাহে না।”

বছির বলে, “আমার সোনা বইন রাগ করিস না। কালকা আমি তোর জন্যি অনেকগুলিন সোনালতা আইনা দিব।”

বোন খুশী হইয়া বলে, “শুধু আমার জন্যি না। ফুলুর জন্যিও আইনো। আমরা দুইজনে তোমার জন্যি ডুমকুরির মালা গাইথা রাখছি। ফুলু অনেকক্ষণ দেরী কইরা এই এহন চইলা গেল।”

হাসিতে হাসিতে বড় ডুমকুরির মালা আনিয়া বছিরের গলায় পরায়া দিল।

রাত্রে বিছানায় শুইয়া বছিরের অনেকক্ষণ ঘুম হইল না। গণশার জীবনে যে অবিচারের কাহিনী সে আজ শুনিয়া আসিয়াছে, রাত্রের কালো পর্দায় কে যেন তাহা বার বার অভিনয় করিয়া দেখাইতেছিল। কিন্তু সে যে বড় অসহায়! কে তাহাকে এমন তেলেসমাতি শিখাইয়া দিবে যার বলে এক মুহূর্তে সে গণশার জীবন হইতে সমস্ত অত্যাচার মুছিয়া দিতে পারে?

.

২৪.

রবিবারের দিন পাঠশালার ছুটি। ভোর না হইতেই নেহাজদ্দীন আর তার বোন ফুলী আসিয়া উপস্থিত।

“ও বছির-বাই! তোমরা নি এহনো ঘুমায়া আছ?” ফুলের মতন মুখোনি নাচাইয়া ফুলী ডাকে, “ও বড়ু! শিগগীর আয়।”

বড়ু তাড়াতাড়ি উঠিয়া ডাক দেয়, “ও মিঞা-বাই! ওঠ, ফুলী আইছে–নেহাজ-বাই আইছে।”

হাতের তালুতে ঘুমন্ত চোখ ডলিতে ডলিতে বছির তাড়াতাড়ি উঠিয়া আসে।

বাড়ির ওধারে গহন জঙ্গল। সেই জঙ্গলের মধ্যে নাভিওয়ালা আমের গাছ। সিন্দুইরা-আমের গাছ। গাছের তলায় ঘন বেত ঝাড়। তারই মাঝ দিয়া সরু পথখানি গিয়াছে। সকলকে পিছনে ফেলিয়া বড় তাড়াতাড়ি আগাইয়া যাইয়া একটা সিন্দুরে-আম কুড়াইয়া পাইল, তারপর আর একটা। ওদিকে ফুলী নাভিওয়ালা আম গাছের তলায় যাইয়া চার পাঁচটা আম পাইল। নেহাজ যাইয়া উঠিল সিন্দুরে-আমগাছে, আর বছির উঠিল গিয়া নাভিওয়ালা আমগাছে। নাভিওয়ালা আম গাছে লাল পিঁপড়ে ভর্তি। হাতে পায়ে অসংখ্য পিঁপড়া আসিয়া বছিরকে কামড়াইয়া ধরিল। সে তাড়াতাড়ি গাছ হইতে নামিয়া আসিল।

“ও মিঞা-বাই! তোমারে যে পিঁপড়ায় কামড়ায়া চাকা চাকা কইরা দিছে। এদিকে ফেরো ত দেহি। হায়! হায়! তোমার মাথার চুলী লাল পিঁপড়া জট মেইলা রইছে। ও ফুলী! খাড়ায়া দেহস কি? মিঞা-বাইর গার ত্যা পিঁপড়া বাছ।” বড় আর ফুলী দুইজনে। মিলিয়া বছিরের গা হইতে লাল পিঁপড়ে বাছিতে লাগিল। সিন্দুরে-আমের গাছ খুব লম্বা। তার আগডালে সাত আটটি আম পাকিয়া লাল টুক টুক করিতেছে কিন্তু নেহাজদ্দী অত উপরে উঠিতে পারিল না। সেও নামিয়া আসিল।

বড় বলিল, “আইজ আর আম পাড়ার কাম নাই। আইস আমরা খেলি। আমার বড় ভাইর যেন বিয়া ঐব।”

ফুলী ভুরু নাচাইয়া বলিল, “বড় ভাইর বোনের বিয়া আগে ওক।”

“না আগে ত বড় ভাই, তবে না বোন। বড়র থইনাই না আরম্ভ করতি অয়।”

ফুলী বলে, “আ’লো তুই ত নেহাজ-ভাইর ছোট বোন। তোর বিয়া আগে ওক।”

“না, তোর,” “না তোর,” “তোর,” “তোর।”

বছির তখন মিমাংসা করে, “আচ্ছা, তোগো দুই জনের বিয়াই একত্তর হোক।” বড় বলে, “তবে তোমাগো বিয়াও একত্তর হোক।” বছির হাসিয়া বলে, “বেশ।” তখন বছিরের বউ সাজিল ফুলী, আর নেহাজদ্দীনের বউ হইল বড়। ফুলীর বিয়ার পর সে চলিয়াছে বরের বাড়ি ডোলায় চাপিয়া। দুইটা বাঁশের কঞ্চি বাকাইয়া কৃত্রিম ডোলা তৈরী হইয়াছে। ডোলার মধ্যে বসিয়া বউ কান্দে, “হু-উ-উ।” বর নেহাজদ্দী বলে, “বউ তুমি কান্দ ক্যান? বউ সুর করিয়া গান ধরে ও।

“মিঞা ভাইর বাঙেলায় খেলছি হারে খেলা সোনার গোলা লয়া নারে।

আমার যে পরাণ কান্দে সেই না গোলার লাইগারে।”

বর নেহাজী বলে, “আমার সাত ভাই-এর সাত বউ, তারা তোমারে হিরার গোলা বানাইয়া দিব খেলনের জন্যি।”

বউ তবু কান্দে, “হু-উ-উ।” বর জিজ্ঞাসা করে, “বউ! তুমি আবার কান্দ ক্যান?” বউ তখন সুর করিয়া বলে,–

“এত যে আদরের, এত যে আদরের
ও সাধুরে মাধন কোথায় রইল নারে।”
বলে বর, “আমার দ্যাশে আছে হারে মাধন
ও সুয়ারে মাধন বলিও তারেরে।”
কনে তখন বলে,
“আম্ব গাছের বাকলরে সাধুর কুমার! চন্দন গাছে ওকি লাগেরে।
তোমার মায়ের মিঠা কথারে সাধুর কুমার, নিম্ব যেমুন তিতা নারে!
আমার মায়ের মুখের কথারে সাধুর কুমার! মধু যেমন মিষ্ট নারে।”

গান শেষ হইতে না হইতেই ফুলী বলে, “ও কিলো। তোরাই বুঝি কতা কবি? আমরা বুঝি কিছু কব না?”

তখন বড় বলে, “আমি ত বউ অয়া তোগো বাড়িতি আইলাম। তুই এহন আমার লগে কতা ক।”

ফুলী তখন নতুন বউ এর ঘোমটা খসাইতে খসাইতে বলে, “ও বউ! আইস বাগুন। কুইট্যা দাও।”

বউ বলে, “বাগুন ত বালা না, পোকা লইগ্যাছে।”

ফুলী বলে, “ও মিঞা-ভাই! শোন কতা। তোমার বউ বাগুন কুটতি পারে না।”

তখন বর নেহাজদ্দীন বউকে লাঠি লইয়া যায় মারিতে।

ফুলী আবার বউকে জিজ্ঞাসা করে, “ও বউ ঘর সুইরা বিছানা কর।”

বউ বলে, “ঘরের মদ্দি মশা ভন ভন করতাছে।”

ফুলী কয়, “ও বউ! কোথায় যাও?”

“মশার জ্বালায় ঘরের পিছনে যাই।”

“ও বউ! আবার কোথায় যাও?”

“ঘরের কাঞ্ছি সাপে পট মেলছে। আমি তার ভয়ে মাঠে যাইত্যাছি।”

“ও বউ! আবার কোথায় যাও?”

“মাঠের মদ্দি কোলা গড়গড় করে। আমি গাঙের গাটে নাইতে যাই।”

গাঙের ঘাটে যাইয়া বউ দেখে তার বাইরা অনেক দূরি নাও বাইয়া যায়। বউ তাগো। ডাইকা কয়–

ও পারেতে লঙ্কা গাছটি রাঙা টুক টুক করে,
গুণবতী ভাই! আমার মন কেমন করে।
হাড় হল ভাজা ভাজা মাংস হৈল দড়ি,
আয়রে কারিন্দার পানি ডুব দিয়া মরি।”

ফুলু ঘাড় দুলাইয়া বলে, “না লো! এ খেলা আমার বাল লাগে না। খালি কান্দন আসে। আয় একটা হাসি-তামাসার খেলা খেলি।”

বড়ু বলে, “আচ্ছা! তোর বরের কাছে একটা জিনিস চা।” কনে ফুলী এবার উ-উ করিয়া কান্দে।

বর বছির তাড়াতাড়ি যাইয়া বলে, “ও বউ! তুমি কান্দ ক্যান?”

বউ বলে, “আমার যে সিন্যা খালি রইছে। আমার জন্যি সিন্দুর আনছ নি?”

পর কচু পাতায় পাকা পুঁই ডাটা ঘসিয়া বলে, “এই যে সিন্দুর আনছি, কপালে পর।”

বউ টান দিয়া সিন্দুরের পাতা ফেলাইয়া দেয়। বড়ু গান ধরে :

“দেশাল সিন্দুর চায় নারে ময়না,
আবেরি ময়না ঢাকাই সিন্দুর চায়,
ঢাকাই সিন্দুর পরিয়া ময়দার গরম লাগে গায়।”

তখন বর ইন্দুরের মাটি আনিয়া বউ-এর হাতে দিয়া বলে, “এই যে ঢাকাই সিন্দুর আইনা দিলাম, এইবার কপালে পর।”

বউ আবার কান্দে, “উ-উ-উ।”

বর বলে, “বউ! আবার কান্দ ক্যান?”

বউ বলে, “আমার পরণের শাড়ী নাই। শাড়ী আছনি?”

বর কলাপাতার শাড়ী আনিয়া দেয়, “এই যে শাড়ী পর।” বউ থাবা দিয়া শাড়ীটা ধরিয়া ছিঁড়িয়া ফেলে।

বড়ু আবার গান ধরে :

দেশাল শাড়ী চায় নারে ময়না,
আবেরি ময়না ঢাকাই শাড়ী চায়;
ঢাকাই শাড়ী পরিয়া ময়নার গরম লাগে গায়।
ডান হস্তে শ্যামলা গামছা,
বাম হস্তে আবের পাখা;
আরে দামান চুলায় বালির গায়।

গান গাহিতে গাহিতে বড় বলে, “ও মিঞা ভাই! তোমার কনেরে আবের পাখা, আর শ্যামলা-গামছা দিয়া বাতাস করতাছ না ত?”

ডাইনের ঝাড় হইতে একটি কচুপাতা আনিয়া বছির কনেকে বাতাস করিতে থাকে।

এই ভাবে শিশু-মনের সহজ কল্পনা লইয়া অভিনয়ের পর অভিনয় চলে। এ অভিনয়ের রচনাকারী, নট-নটি আর দর্শক তারাই মাত্র চারিজন বলিয়া ইহার মধ্যে ত্রুটি থাকে না, শুধুই অনাবিল আনন্দ। এমনি করিয়া খেলিতে খেলিতে দুপুর হইয়া আসিল। তাহারা খেলা শেষ করিয়া কুড়ানো আমগুলি লইয়া বাড়ি চলিল।

হঠাৎ বড় উঠিয়া কান্দিয়া বলিল, “ও মিঞা ভাই। আমার নাকের ফুল আরায়া ফেলাইছি।” গ্রাম্য সুনারুর নিকট হইতে তাহার মা রূপার একটি নাকফুল তাহার জন্য গড়াইয়া দিয়াছিল। চারজনে মিলিয়া সমস্ত জঙ্গল ভরিয়া কত আতিপাতি করিয়া খুঁজিল, কিন্তু সেই ক্ষুদ্র নাক-ফুলটি কোন্ পাতার তলে লুকাইয়া আছে কেহই খুঁজিয়া পাইল না। বড়ু কেবল ফুপাইয়া ফুপাইয়া কান্দে। গামছার খোট দিয়া বোনের চোখ মুছাইতে মুছাইতে বছির বলে, “বড়ু! আমার সোনা বইন। কান্দিস না। আমি বড় হয়া চাকরী করব। তহন। সোনা দিয়া তোর নাক-ফুল গড়ায়া দিব।”

বোন চোখের পানি মুছিতে মুছিতে বলে, “দিবি ত মিঞা বাই?”

বোনকে কাছে ডাকিয়া আদর করিয়া বছির বলে, “আল্লার কছম দিব।”

.

২৫.

তাম্বুলখানার হাট হইতে ফিরিয়া আসিয়া আজাহের বউকে বলে, “আমাগো বাড়ির উনি গ্যাল কই? চায়া দেহুক কারে আনছি!”

রহিমদ্দীন কারিকরকে দেখিয়া বউ মাথার ঘোমটাটা আর একটু টানিয়া দিয়া তাড়াতাড়ি আসিয়া তার পায় হাত দিয়া সালাম করে, “এই যে চাচাজান আইছে যে।”

বউকে দোয়া করিয়া রহিমদ্দীন হাসিয়া বলে, “কই, আমার বুবুজান কই?”

মায় ডাকে, “ও বড়ু! এদিকে আয়। তোর কারিকর দাদা আইছে।” বড়ু একটু কৃত্রিম লজ্জা ভাব দেখাইয়া হাসিয়া আগাইয়া আসে। রহিমদ্দীন বলে, “এই যে বুবুজান! তোমার

জন্যি একখানা শাড়ী আনছি। তা এই বুইড়া জামাই তোমার পছন্দ অবি নি?”

মা ঘোমটার তল হইতে হাসিয়া উত্তর করে, “জামাইর গান হুনলি মাইয়া এহনই। কোলে যায় বসপ্যানে।”

রহিমদ্দী গান ধরে :

“মাগো মা, কালো জামাই ভালো লাগে না।”

গান ছাড়িয়া দিয়া রহিমদ্দী ডাকে, “আমার মিঞা ভাই গেলা কোথায়?” বছির আগাইয়া আসিয়া রহিমদ্দীনকে সালাম করে। বছিরের হাতে একখানা লাল গামছা দিয়া রহিমদ্দী বলে, “তোমার দাদী এই গামছাহানা বুনাইছে। বলে, নাতীরে দেহী না কত বচ্ছর। তারে গামছাহানা দিয়া আইস গিয়া। তা আইলাম তালখানার আটে। কাপড় নিয়া আইছিলাম। তা বিককিরিও বাল ঐল। এহন তোমাগো বাড়ি বেড়ায়া যাই।”

আজাহের বলে, “ও বছির! তোর কারিকর দাদার কতা মনে নাই? সেই যে ছোটবেলায় তোরে কোলে লয়া নাচাইত আর কত গান গাইত।”

বছিরের একটু একটু মনে পড়ে। তাকে নাচাইবার সময় কারিকর দাদা গান করিত :

“নাচেরে মাল, চন্দনে কপাল,
ঘেতমধু খায়া তোমার টোবা টোবা গাল।”

আজাহের বউকে বলিল, “বড় মোরকডা দরো। আর চাইল বিজাও। পিটা বানাইতে অবি। আমি এদেক গিরামের হগল মানুষরে ডাক দেয়। আজ রাইত বইরা তোমার গান। হুনব চাচা।” রহিমদ্দী বাধা দিয়া বলে, “না, না অত কাণ্ড-বেকাণ্ড করণের লাগবি না। রাইত অয়া গ্যাছে। রাত্তির কালে বউ চাইল ভিজাইও না। সারা রাইত জাইগা ওসব করণের কি দরকার?” বউ বলে, “হোন কতা। জামাই শ্বশুর বাড়ি আইলি জামাইর আদর না করলি ম্যায়া যে আমারে খুঁটা দিবি। আপনিত রাইত বইরা গান করবেন, আমিও গান হুনব আর পিটা বানাব।”

আজাহের হুঁকোটি সাজিয়া আনিয়া রহিমদ্দীর হাতে দেয়। রহিমদ্দী জিজ্ঞাসা করে, “তা আজাহের! কেমুন আছ কও!” আজাহের উত্তর করে, “আল্লার দোয়ায় বাল আছি চাচা। আমাগো আলীপুরীর খবর কও। মেনাজদ্দী মাতবর কেমুন আছে?”

“সবাই ভাল আছে।” বলিয়া কোঁচার খোট হইতে লাউয়ের বীজ আর কনেসাজানী সীমের বীজ বাহির করিতে করিতে রহিমদ্দীন বলে, “আমার মনেই ছিল না। মোড়লের বউ এই বীজগুলি পাঠাইছে বউরে। তোমাগো হেই কন্যাসাজানী সীম গাছের বীজ। তোমরা ত চইলা আইলা। তোমাগো গাছে কি সীমই না দোরল! কিন্তুক মোড়ল-বউ এর একটাও কাউরে ছিড়বার দিল না। মানষীর কাছে কইত, আমার কন্যা গেছে বিদ্যাশে। কন্যাসাজানী সীম আমার কে ছিঁড়ব? আমি ওদিগে চায়া চায়া আমার কন্যারে দেখপার। পাই।” রহিমদ্দীর হাত হইতে সীমের বীজগুলি লইতে লইতে বউর চোখ দুইটি ছলছল করিতে লাগিল।

আজাহের জিজ্ঞাসা করে, “আচ্ছা চাচা! আগের মত গীদটি আর গাও না?” রহিমদ্দীন বলে, “তোমরা চইলা আসার পরে গাজীর গানের দল করছিলাম। কয় বছর চলছিলও বেশ, কিন্তু বিনা তারের গান না কি কয়, হেই যে বাক্সের মদ্দি ত্যা গান বাইর অয়, সগল লোক তাই হুনবার জন্যি ছোটে। আমাগো গান কেউ পোছেও না। দিনি দিনি বাপু কাল বদলায়া যাইত্যাছে। এহন এসব গান কেউ হুনবার চায় না। ওই যে থিয়েটার না কি কয়, নাচনাআলীরা যে সব গান গায় লোকে হেই রহম গান হুনবার চায়। তা হে গান ত আমার জানা নাই।”

আজাহেরও উৎসাহিত হইয়া উঠে বিনা তারের গানের কথায়, কিন্তু রহিমদ্দীকে যেন একটু সমবেদনা দেখাইবার জন্যই বলে, “তা দেহ চাচা! পেরথম দুই একদিন ওই বিনি তারের গান বাল লাগে। কিন্তুক যে মানুষ গীদ গাইল তারেই যদি না জানলাম, তার চেহারা, তার ভঙ্গী-ভাঙ্গী যদি না দেখলাম তয় গান শুইনা কি আরাম পাইলাম?” রহিমদ্দী খুশী হইয়া বলে, “তুমি জানি তা বুজলা। কিন্তু ওই যে কলে কথা কয়। সগগলি তাই কলের পাছে পাছে দৌড়ায়।” আজাহের যেন রহিমদ্দীকে সান্ত্বনা দিবার জন্যই বলে, “কিন্তুক আমি কয়া দিলাম চাচা, মানষীর মন ফিরবি। নতুন জিনিস দেখপার নিশা বেশী দিন থাহে না। আবার পুরান জিনিসের জন্যি মানষীর মন কানবি। ওই কলের গান থুইয়া আবার তোমাগো গান হুনবার জন্যি মানুষ ঘুরবি।”

দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া রহিমদ্দী বলে, “হেই কাল যহন আইব তহন আমরা আর থাকপ না।”

আজাহের বলে, “কি যে কও চাচা? তা যা হোক, আইজ তোমারে গীদ গাইতি অবি। আমি ওদিক গিরামের সগলরে খবর দিয়া আসি।”

বউ রহিমদ্দীর সামনে মুড়ি আর গুড় আনিয়া দিয়া বলে, “চাচাজান খাউক।”

“আরে বেটি! তুমি কি লাগাইছাও আবার?” এই বলিয়া হাত পা ধুইয়া রহিমদ্দী মুড়ি খাইতে বসে।

বউ জিজ্ঞাসা করে, “চাচাজান! কেদারীর মা কেমন আছে?” “কেদারীর মা বাল নাই। বাতের বেদনায় বড়ই কাবু অয়া গ্যাছে। আসপার সময় কইল, বউরে কইস বাতের ব্যথায় পইড়া আছি। নাতী নাতনীগো জন্যি কিছু দিবার পারলাম না। বউরে আমার দোয়া কইস।”

কেদারীর মার কথা মনে করিতে বউর চোখ ছলছল করিয়া ওঠে। বিপদে-আপদে যখন যার দরকার কেদারীর মা বিনা ডাকে তাহার উপকার করিয়া আসে। এমন মানুষ কোথায় পাওয়া যায়?

রহিমদ্দী নাস্তা খাইয়া আরাম করে। বউ ওদিকে চুলায় রান্না চড়াইয়া দিয়া চেঁকিতে চাউল কুটিতে যায়। বড়ু এখনো চাউল আলাইতে শেখে নাই। বছির আর বড় দুইজনে চেঁকিতে পার দেয়। মা চুরুনের ওঠা নামার মাঝখানে নোটের মধ্যে হাত দিয়া চাউলগুলি নাড়িয়া দেয়। মাঝে মাঝে সেই আধগুঁড়ি চাউলগুলি কুলার উপর রাখিয়া আস্তে আস্তে মা কুলা দুলাইয়া গুঁড়িগুলি টেকিয়া লয়। কেমন দুই হাতে সুন্দর পরিপাটি করিয়া ধরিয়া মা কুলাখানা দোলাইতে থাকে। মায়ের হাতের চুড়িগুলি টুং টুং করিয়া বাজে। তারই তালে। তালে অভাঙ্গা মলকেগুলি নাচিয়া নাচিয়া মাকেই যেন খুশী করিবার জন্য কুলার একপাশে যাইয়া জড় হয়। গুঁড়িগুলি জড় হয় কুলার আর একপাশে। মা আস্তে করিয়া কুলায় একটি টোকা দিয়া সেই অভাঙ্গা মলকেগুলি নোটের মধ্যে ফেলিয়া দেয়। গুঁড়িগুলি ধামার মধ্যে রাখে। সাজানো-গুছানো ভাবে সুন্দর করিয়া কাজ করিবার মায়ের কতই নিপুণতা। পেঁকির উপর হইতে চাহিয়া চাহিয়া বড়ু দেখে, আর ভাবে কতদিনে সে মায়ের মত যোগ্যতা লাভ করিবে।

চাউল কোটা শেষ হইলে মা চুলার উপরে পানি গরম দিয়া ধামায় সঞ্চিত গুঁড়িগুলি হইতে কিঞ্চিৎ লইয়া দুই হাতের মুঠায় বড় বড় গোলা বানাইয়া উননের সেই গরম পানির মধ্যে ফেলিতে থাকে। কিছুক্ষণ ঢেলাগুলি গরম পানিতে বলক দিয়া সেই পানিটুকুর কিছুটা গামলায় ঢালিয়া রাখে। এই পানির সঙ্গে ঢেলা হইতে কিছুটা চাউলের গুঁড়ি মিশিয়া গিয়াছে। বড় লোকেরা ইহা ফেলিয়া দেয়, কিন্তু মা ইহাতে নুন মিশাইয়া অতি তৃপ্তির সঙ্গে। খায়। তারপর মা গুঁড়ির ঢেলাগুলি থালের উপর রাখিয়া দুই হাতে আটা ছানিতে থাকে। কি আর এমন কাজ! কিন্তু ছেলে-মেয়ে দুইটি তাহাই একদৃষ্টিতে চাহিয়া দেখে। এ যেন মায়ের পিঠা বানানোর নাট্যভিনয়! মাকে এই পিঠা বানাইতে তাহারা কতবার দেখিয়াছে, দেখিয়া দেখিয়া তবুও তৃপ্তি হয় না। শীতের দিনে মা শেষ রাতে উঠিয়া ভাপা পিঠা বানায়। ছেলে-মেয়ে দুইটি মায়ের সঙ্গে উঠিয়া কতবার তাকে ভাপা পিঠা বানাইতে দেখিয়াছে। প্রথম পিঠাটি সিদ্ধ হইলে মা তাদের খাইতে দেয় না। দ্বিতীয় পিঠাটি ভাঙ্গিয়া তাহাদের দুইজনকে খাইতে দেয়। তাদের খাওয়া দেখিতে মায়ের সকল পরিশ্রম স্বার্থক হইয়া ওঠে। আজাহেরের কাছে মা কতদিন হাসিয়া বলিয়াছে, “পুলাপান হওনের আগে পিঠা বানায়া সুখ ছিল না। চুলার পাশে বইসা পুলা-ম্যায়ারাই যদি না খাইল তবে পিঠা বানায়া কিসির সুখ?”

আটা ছেনা হইলে মা ছোট ছোট করিয়া এক একটা গড়া বানাইল। সেই গড়াগুলি লইয়া আবার হাতের তোলায় চ্যাপটা করিয়া দুই হাতে টিপিয়া টিপিয়া এক একটুক ছোট্ট রুটির মত করিল। তারপর বেলুন লইয়া মা রুটি বেলিতে আরম্ভ করিল। মায়ের ডান হাতের বুড়ী আঙ্গুলের পরে যে ফঁক আছে তার মধ্যে বেলুনের উঁটির একধার পুরিয়া বাম হাতের তেলো দিয়া মা বেলুন ঘুরাইতে থাকে। মায়ের সুন্দর হাতের কাঁচের চুড়িগুলি আগের মতই টুং টুং করিয়া বাজিয়া উঠে। মায়ের বেলুনের তলার আটা ঘুরিয়া ঘুরিয়া রুটিতে পরিণত হয়। মায়ের আদরেই যেন এরূপ হয়। মায়ের এই কাজ দেখিয়া বছিরের বড়ই ভাল লাগে। মনে মনে ভাবে, মা যেন আরও কত কিছু বানাইতে পারে। ছোট বোন বড় মার কাছ হইতে একটু আটা লইয়া তার ছোট্ট বেলুনটি লইয়া রুটি বানাইতে চাহে। অপটু হাতে রুটির এদিকে মোটা হয় ওদিকে পাতলা হয়, মাঝে মাঝে আবার ছিঁড়িয়াও যায়। মা মিষ্টি করিয়া বলে, “আরে আদাখলের বেটি! এই রকম কইরা বল।”

বছির বলে, “মা! তুমি আমারে আটা দিয়া একটা নৌকা বানায়া দাও–একখানা পাল্কী বানায়া দাও।”

মা বলে, “একটু সবুর কর। আগে কয়খানা রুটি বেইলা লই।” সাত আটখানা রুটি বেলা হইলেই মা কাঠখোলা চুলায় দিয়া রুটি সেঁকিতে থাকে। রান্না করিতে হাঁড়ি-পাতিল ঠুসিয়া গেলে তাহার অর্ধেকটা ভাঙ্গিয়া মা কাঠখোলা বানাইয়াছে। তাহাতে কয়েকখানা রুটি সেঁকিয়া সদ্য রান্না-করা মুরগীর তরকারী একখানা মাটির সানকিতে করিয়া মা বলে, “তোরা আগে খায়া দেখ, কেমুন ছালুন ঐছে।”

বছির আর বড় সেই তরকারীতে রুটি ভরাইয়া খাইতে খাইতে মায়ের তারিফ করে, “মা! ওমুন ছালুন তুমি কুনুদিন রাব্দ নাই।” তৃপ্তিতে মার প্রাণ ভরিয়া যায়। আরও একটু ছালুন থালায় ঢালিয়া মা বলে, “বালো কইরা খা।”

বছির বলে, “মা! আর একটু ছালুন দাও। মাথাডা আমারে দ্যাও।”

মা বলে, “দেখছস না তোর দাদা আইছে? আজকার মাথাডা তারে দেই। আবার যহন মুরগী জবো করব তহন তোরে মাথাডা দিব। তুই আইজ মাইটাডা খা।”

ছেলে-মেয়ের খাওয়া হইলে আজাহের গ্রামের লোকদের গান শোনার দাওয়াত দিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিল।

রহিমদ্দীকে সঙ্গে লইয়া আজাহের এবার খাইতে বসিল। ইতিমধ্যে গ্রামের লোকেরা একে একে আসিয়া আজাহেরের বাড়িতে জড় হইল। দীনু মাতবর, মোকিম, তাহের লেংড়া, ও-পাড়ার মিঞাজান সকলেই আসিল। ফুলীকে সঙ্গে লইয়া মোড়লের স্ত্রীও আসিল। তাহারা আজাহেরের বউ-এর সঙ্গে বারান্দায় বসিল।

উঠানের মধ্যে ছেঁড়া মাদুর আর খেজুরের পাটি বিছাইয়া পুরুষ লোকদের বসিতে দেওয়া হইল। মাঝখানে মোড়লের পাশে রহিমদ্দীকে বসিবার জন্য একখানা নক্সী কাথা বিছাইয়া দিল। খাওয়া শেষ করিয়া পান চিবাইতে চিবাইতে সালাম আলেকম বলিয়া রহিমদ্দী সভাস্থলে আসিয়া দাঁড়াইল। গরীবুল্লা মাতবর উঠিয়া দাঁড়াইয়া সেই নক্সী কাঁথার আসন দেখাইয়া বলিল, “গায়েন সাহেব! বসেন।”

রহিমদ্দী বলে, “না, ও জায়গায় আপনি বসেন। আমি পাশে বসপ।” মোড়ল বলে, “আপনি ঐলেন আমাগো মেজবান। আপনাকে ওহানে বসতি ঐব।”

রহিমদ্দী বলে, “তা কি ঐতে পারে? আপনার মাইন্য ত আছে। আপনি ঐলেন মাতবর, তার উপর মুরব্বী। আপনি ওখানে বসেন।”

একে অপরকে টানাটানি করে, কেউ বসে না। তখন আজাহের বলিল, “আপনারা দুইজনেই ওই নক্সী কাথার উপর বসেন।” খুশী হইয়া মোড়ল রহিমদ্দীকে পাশে লইয়া সেই। নক্সী কাঁথার উপর বসিল। রহিমদ্দীর বিনয় দেখিয়া সভার সকলেই খুশী হইল। মোড়লের পাশে বসিয়া রহিমদ্দীন একটা বিড়ি বাহির করিয়া মোড়লকে দিল, নিজেও একটি ধরাইয়া টানিতে লাগিল। এমন সময় আজাহের একটি একতারা আনিয়া রহিমদ্দীর হাতে দিল। রহিমদ্দী একতারাটি হাতে লইয়া টুং টুং করিয়া বাজাইতে লাগিল। সকলের দৃষ্টি তাহার দিকে। না জানি কি মধুর কাহিনী সে আজ প্রকাশ করিবে তাহার ঐ একতারার ঝঙ্কারে ঝঙ্কারে। কিন্তু রহিমদ্দী কেবল বাজাইয়াই চলিয়াছে। সমবেত শ্রোতাদের ঔৎসুক্য আর ধৈর্য মানে না। মোড়ল বলে, “গায়েন সাব! এবার গান আরম্ভ করেন।”

রহিমদ্দী একতারা বন্ধ করিয়া একবার তার শ্রোতাদের উপর চারিদিকে চোখ ঘুরাইয়া দেখিয়া লইল। বুঝিতে পারিল, তাহাদের মন, কাহিনীর কম্পরাজ্যে ঘূরিবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছে। সে একটু কাশিয়া বলিল, “কি গীদ আমি গাব। গলাডাও বাল নাই। আপনাগো হুননির যোগ্য গান কি আমি জানি?”

মোড়ল বিনয় করিয়া জবাব দেয়, “আরে মিঞা! আপনি যা গাবেন তাই আমাগো বালো লাগবি। এইবার আরম্ভ করেন।”

রহিমদ্দী যেন মাটির সঙ্গেই নত হইয়া বলে, “দোহার পত্তর সঙ্গে আনি নাই। একলার গলায় কি গীদ হুনবেন?”

আজাহের বলে, “বছির। বড়ু। তোরা কই গেলি? তোর দাদার পাশে বইসা গানের গড়ান দর।”

মোড়ল বলে, “নেহাজ! ফুলী! তোরাও আয়। ও কুনা কিডা বরান নাকি? আরে মিঞা! তুমি ত এক সময় গাজীর গানের দলের দোহার ছিলা। আওগাইয়া আইস। গায়েন সাবের গানের গড়ান দর।”

দোহার ঠিক হইয়া গেল। হাতের বিড়িতে খুব জোরে আর একটা টান দিয়া নাকমুখ। দিয়া ধুয়া বাহির করিয়া রহিমদ্দী গান আরম্ভ করিল ।

ওকি আরে আরে আ—রে
দোহারেরা তাহার কণ্ঠ হইতে সুর কারিয়া গান লইয়া গায় :
 ওকি আরে আরে আ-আ-রে।

রহিমদ্দী আর বরান খর মোটা গলার সঙ্গে ফুলু, বড়, নেহাজ আর বছিরের তরুণ কণ্ঠ মিলিয়া উপস্থিত গানের আসরে এক অপূর্ব ভাবের সমাবেশ হয়। রহিমদ্দীর মনে হয়। এমন মধুর সুর যেন কোনদিন তার কণ্ঠ হইতে বাহির হয় নাই। সঙ্গের দোহারদের সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর, সেও যেন তার নিজেরই। তার অন্তরের অন্তস্থল হইতে ভাব-তরঙ্গ উঠিয়া তাহাদের কণ্ঠে যাইয়া যেন আছড়াইয়া পড়ে। তার মনে হয়, আজ এই সুরের উপর। যে-কোন কাহিনীকে সোয়ার করিয়া তাহার সূত্র লইয়া সে যে-কোন দেশে যাইতে পারে। স্বর্গ, মর্ত, পাতাল, মানুষ, দেবতা, দানব, অতীত, বর্তমান সব যেন আজ তাহার মুঠার। মধ্যে। যখন যাহাকে ইচ্ছা সুরের সূতায় টানিয়া আনিয়া শ্রোতাদের সামনে সে দাঁড় করাইতে পারে। রহিমদ্দী আরম্ভ করে?

পূবেতে বন্দনা করলাম পূর্বে ভানুশ্বর,
একদিগে উদয় গো ভানু চৌদিগে পশর।
পশ্চিমে বন্দনা করলাম মক্কা মদিস্তান,
উদ্দেশে জানায় সালাম মোমিন মুসলমান।
উত্তরে বন্দনা করলাম হিমালয় পর্বত,
যাহার হাওয়াতে কঁপে সকল গাছের পাত।
দক্ষিণে বন্দনা করলাম ক্ষীর-নদীর সায়র,
যেইখানে বাণিজ্য করে চান্দ সওদাগর।
সভায় যারা বইসা আছেন পূর্ণমাসীর চান,
তানগো উদ্দেশে আমি জানাইলাম সালাম।
সকল বন্দনা কইরা মধ্যে করলাম স্থিতি
এই খানে গাব আমি ওতলা সুন্দরীর গীতি।

ইরান তুরান মুল্লুকে আছে এক বাদশা নামদার। তার একহি কন্যা নাম ওতলা সুন্দরী। ওতলা সুন্দরী, যার রূপের কোন তুলনা নাই। সেই কন্যার

হাতে পদ্ম পায়ে পদ্ম মুখে পদ্ম দোলে,
আসমানের চন্দ্র যেন ভূমিতে পড়ল ঢ’লে।
হাইট্যা হাইট্যা যায় কন্যা খঞ্জন খঞ্জন পায়,
সোনার নূপুর বাজে যেখান দিয়া যায়।

গান শুনিতে শুনিতে বছিরের মনে হয় এ যেন তার বোন বড় আর ফুলীর রূপের বর্ণনা।

গায়েন গাহিয়া যায়, সেই কন্যার বিবাহ হইল এক সওদাগরের পুত্রের। সেই বিয়েতে কি কি শাড়ী পরছিল রাজকন্যা।

মোড়ল বলিল, “কি শাড়ী পরছিল গায়েন সাহেব? একটু নাইচা-পেইচা বলেন।”

রহিমদ্দী তখন তার গামছার খোট হইতে নূপুর জোড়া দুইপায়ে পরিয়া হেলিয়া দুলিয়া নাচিতে আরম্ভ করিল :

প্রথমে পরিল শাড়ী নামে গঙ্গাজল,
হাতের উপর থইলে শাড়ী করে টলমল।
মৃত্তিকায় থইলে শাড়ী পিঁপড়ায় লয়া যায়,
জলেতে রাখিলে শাড়ী জলেতে মিশায়।
সেই শাড়ী পরিয়া কন্যা শাড়ীর পানে চায়,
মনমত না হইলে দাসীকে পিন্দায়।

দোহারেরা ধূয়া ধরে :

ও কালো মেঘ যেন সাজিলরে।

রহিমদ্দীর নাচনের যেন আজ বাধ ভাঙ্গিয়াছে। প্রত্যেকখানা শাড়ীর বর্ণনা, যে ভাবে পরিচারিকারা তাহা রাজকন্যাকে পরাইতেছে, মনের মত না হইলে যে ভাবে রাজকন্যা শাড়ীখানা দাসীদের দিয়া দিতেছে, সদ্য বিবাহম্মুখ রাজকন্যার মনের সলাজ আনন্দ সব কিছু তার নাচের মধ্যে প্রকাশ পাইতেছে। রহিমদ্দী গাহিয়া যায়?

তারপরে পড়িল শাড়ী তার নাম হীত,
হাজারও দুঃখিতে পরলে তারও আইএ গীত।

এ শাড়ীও রাজকন্যার পছন্দ হইল না। সহচরীরা গুয়াফুল শাড়ী আনিল, আসমান-তারা শাড়ী আনিল, তারপর রাশমণ্ডল, কেলিকদম্ব, জলেভাসা, মনখুশী, দিলখুশী, কলমীলতা, গোলাপফুল, কোন শাড়ীই রাজকন্যার পছন্দ হয় না। তখন সব সখীতে যুক্তি করিয়া রাজকন্যাকে একখানা শাড়ী পরাইল।

তারপরে পরাইল শাড়ী তার নাম হিয়া,
সেই শাড়ী পিন্দিয়া হইছিল চল্লিশ কন্যার বিয়া।

এই শাড়ী রাজকন্যার পছন্দ হইল। এবার রহিমদ্দী সেই শাড়ীর বর্ণনা আরম্ভ করিল :

শাড়ীর মদ্দি লেইখ্যা থুইছে নবীজীর আসন,
শাড়ীর মদ্দি লেইখ্যা থুইছে আল্লা নিরাঞ্জন।
শাড়ীর মদ্দি লেইখ্যা থুইছে কেলীকদম্ব গাছ,
ডালে বইসা ঠাকুর কৃষ্ণ বাশী বাজায় তত।

দারুণ অভাবের মধ্যে যাহাদের দিন কাটে তাহারা ত এই সব বিলাসের উপকরণ কোনদিন চোখেও দেখে নাই। বড় লোকদের সুন্দর সুন্দর মেয়েরা কত অষ্ট-অলঙ্কার পরিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়। তাহাদের জীবন কতই না মাধুর্যময়। সেই বিলাস উপকরণ–সেই রহস্যময় জীবনকে গানের সুরের মধ্যে ধরিয়া আনিয়া রহিমদ্দী তার সর্বহারা শ্রোতাদের মধ্যে ঢালিয়া দিতেছে। বাস্তব জীবনে যারা সব কিছু হইতে বঞ্চিত, রহিমদ্দীর গানের সুরে তার কিছুটা পাইয়া হয়ত তাহাদের অবচেতন মনের কোন একটি স্থান পূর্ণ হইয়া উঠিতেছে। রহিমদ্দীন গান গাহিয়া যায় :

আনিল বেশরের ঝাপি খুলিল ঢাকনি,
ডান হস্তে তুলিয়া লইল আবের কাঙ্কনখানি।
চিরলে চিরিয়া কেশবাসে বানল খোঁপা,
খোঁপার উপর তুইল্যা দিল গন্ধরাজ চাপা।
সাজিয়া পরিয়া এই দিন কন্যা হৈল ক্ষীণ,
কোমরে পরিল কন্যা সুবর্ণের জিন।
তার দিল তরু দিল কোমরে পাশুলী,
গলায় তুলিয়া দিল সুবর্ণের হাসলী।
কোমরখানি মাঞ্জা সরু মুইটের মধ্যে ধরে,
কাকুনিয়া গুয়া গাছটি হেইলা দুইলা পড়ে।
সাজিয়া পরিয়া কন্যা বসল বড় ঠাটে,
নীমাসামের কালে যেমন সূর্য বইল পাটে।

সেই কন্যাকে বিবাহ করিয়া সওদাগরের পুত্র সারাদিন বারো বাঙলায় বসিয়া বউ-এর সঙ্গে পাশা খেলে। ষাইট’ কাহন নৌকা সওদাগরের ঘাটে বান্ধা থাকে। লোকজন পথে-ঘাটে সওদাগরের নিন্দা করে। এই খবর সওদাগরের কানেও আসিল। তখন ওতলা সুন্দরীর কাছে বিদায় লইয়া সওদাগর দূরের বাণিজ্যে পাড়ি দিল। যাইবার কালে

অশ্রুসজল কণ্ঠে সওদাগর মায়ের কাছে বোনের কাছে বলিয়া গেল ।

“ঘরেতে রহিল আমার ওতলা সুন্দরী,
আমার মতন তারে রাইখ যত্তন করি।”

সওদাগর ছয় মাসের পথ চলিয়া গিয়াছে। কত ইরানী-বিরানীর বন্দর পাছে ফেলাইয়া, কত বউখাটা, গোদাগাড়ী, চিরিঙ্গার বাজারে নৌকা ভিড়াইয়া সওদাগর সাত সমুদুরের তীরে আসিয়া উপস্থিত হইল। এখানে এক পাখির কাছে ছয় মাসের পথ একদণ্ডে যাইবার ফিকির জানিয়া সওদাগর গভীর রজনী কালে ওতলা সুন্দরীর মহলে আসিয়া উপস্থিত হইল। মা-বোন জানিল না। কাক-কোকিলও টের পাইল না। ওতলার বাসর-শয্যায় রাত্র। যাপন করিয়া প্রভাতের তারা না উঠিতেই আবার মন্ত্রবলে সওদাগর সমুদ্র তীরে যাইয়া উপস্থিত হইল।

দিনে দিনে হায়রে ভালা দিন চইলা যায়
গর্ভের চিহ্ন দেখা দিল ওতলার গায়।

প্রথমে কানাকানি-তারপর লোক জানাজানি। বাশুড়ী-ননদীর কাছে ওতলা সকল কথা কয়। কিন্তু কে বিশ্বাস করিবে ছয় মাসের পথ হইতে সওদাগর একদণ্ডে গৃহে আসিয়াছিল। তখন গায়ের অষ্ট-অলঙ্কার খুলিয়া ছেঁড়া চটের বসন পরাইয়া শ্বশুড়ী-ননদী ওতলা সুন্দরীকে বাড়ি হইতে তাড়াইয়া দিল। ছিল রাজনন্দিনী হইল পথের ভিখারিনী। গানের সুরের ঝঙ্কারে রহিমদ্দী এবার রাজসিংহাসন হইতে তার নায়িকাকে নামাইয়া আনিয়া সর্বসাধারণের দলে মিশাইয়া দিল। কান্দিতে কান্দিতে ওতলা সুন্দরী পথে বাহির হইল :

“কান্দে কান্দে হায় ওতলা পন্থ চলে হায়
ওতলার কান্দনে আজকা আসমান ভাইঙ্গা যায়।”

গানের সুরে ঢেউ লাগাইয়া লাগাইয়া রহিমদ্দীন গাহিয়া চলে :

“গাছের পাতা ঝইরা পড়ে ওতলার কান্দনে,
খায় দানা না খায় পানি বনের মৃগী বনে।”

সেই কান্দনে সমবেত শ্রোতাদের চোখের পানি ঝরিয়া পড়ে। গামছার খোটে চক্ষু মুছিয়া রহিমদ্দী গাহিয়া যায়, এক বৃদ্ধ চাষা ওতলাকে আশ্রয় দিল। সেখানে ওতলার গর্ভে এক সোনার পুত্র জন্ম গ্রহণ করিল। সেই বৃদ্ধ চাষী মরিয়া গেল, পুত্র কোলে লইয়া অভাগিনী ওতলা আবার ঘরের বাহির হইল।

“উচ্চ ডালে থাকরে কোকিল! অনেক দূরে যাও,
তুমি নি দেইখাছ পাখি আমার পতির নাও।
জাল বাউ জালুয়া ভাইরে! ছাইবা তোল পানি,
তুমি নি দেইখাছ আমার পতির নৌকাখানি।”

কিন্তু কেউ তার পতির সন্ধান দিতে পারে না। বনের মধ্যে থাকে এক দুষ্ট লোক। সে আসিয়া ওতলাকে বলে?

তোমার পতি মইরা গেছে নবলক্ষের দেশে
পান-গুয়া খাও ওতলা আমার ঘরে এসে।

ওতলা উত্তর করে :

আমার যদি মরত পতি শব্দ যাইত দূর,
রাম-লক্ষণ দুই গাছ শখ ভেঙে হইত চুর।
ভীন দেশে আমার পতি যদি মারা যাইত,
সিম্ভার সিন্দুর আমার মৈলাম হইত।

সেই দুষ্টু লোক তখন কোল হইতে ওতলার ছেলেটিকে ছিনাইয়া লইল। ওতলা কান্দে :

“এখনো শেখে নাই যাদু মা বোল বলার বোল,
এখনো সাধ মেটে নাইরে তারে দিয়া কোল।
ওরে ডাকাত। আমার যাদুমনিকে তুই ফিরাইয়া দে।”

দুষ্টু তখন বলে :

“ফিরাইয়া দিব যাদু যদি যৌবন কর দান,
ফিরাইয়া দিব যাদু যদি খাও গুয়া-পান।”

ওতলা বলে :

“নাইকা মাতা নাইকা পিতা নাইকা সোদ্দের ভাই,
সেঁতের শেহলা হয়া ভাসিয়া বেড়াই।
তুমি আমার পিতা। আমার যাদুরে ফিরাইয়া দাও।” তখন সেই দুষ্টু লোক কি করে?

ওতলার ছেলেকে শূন্যে উঠাইয়া বলে, “যদি তুমি আমার সঙ্গে না যাইবে তোমার এই সন্তানকে আমি আছড়াইয়া মারিব।” শুনিয়া ওতলা শিহরিয়া ওঠে। এই ভাবে কাহিনী করুণ হইতে করুণতর হইয়া আগাইয়া যায়। রহিমদ্দী গান গাহিতে গাহিতে গামছা দিয়া ঘন ঘন চোখ মোছে। নিদারুণ সেই দুষ্টুলোক প্রথমে ছেলের একখানা হাত কাটিয়া ফেলিল। তবু ওতলা রাজি হইল না তার কথায়। তারপর আর একখানা হাত কাটিল। তবু ওতলা অটল। তখন সেই নিদারুণ দুষ্টলোক ওতলার ছেলেটিকে আছড়াইয়া মারিয়া ফেলিল। পুত্র শোকে উন্মাদিনী ওতলা মাথার চুল ছেড়ে, বুক থাপড়ায়, মাটিতে মাথা ঘসে। হায়রে?

কারবা গাছের জালি কুমড়া কইরা ছিলাম চুরি,
সেই আমারে দিছে গালি পুত্র শোগী করি।
কোব্বা দেশে যায়া দেখব আমি সোনার যাদুর মুখ,
কোন্ দেশে যায়া জুড়াব আমার পোড়া বুক।

উন্মাদিনী পথে পথে কান্দিয়া বেড়ায়। যারে দেখে তারই পায়ে ধরিয়া কান্দে–তোরা দে–আমার বাছাধনকে আনিয়া দে। ওতলার কান্দনে ভাটীর নদী, সেও উজান ধায়। আল্লার আরশ কুরছি কাপিয়া কাপিয়া ওঠে। গানের সুরে সুরে ঢেউ দিয়া কাহিনী আগাইয়া যায়। রাত্র ভোর হইতেই রহিমদ্দী গান শেষ করে। চোখের পানি মুছিতে মুছিতে শ্রোতারা। যার যার ঘরে ফিরিয়া যায়। গায়েন সাহেবের তারিফ করিয়া তাহারা এই ভাবের আবেগে এতটুকুও স্নান করিতে চায় না। রহিমদ্দীও বোঝে তাহাদের অন্তরে সে আজ নিজেকে ঢালিয়া দিতে সমর্থ হইয়াছে। এই ত গায়কের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার!

মূর্খ রহিমদ্দী এই গ্রামে মাত্র একটি রাত কাটাইয়া নিজের কথকতায় ছেলে-বুড়ো যুবক-যুবতী গ্রামের সকলকেই মুগ্ধ করিয়া দিয়া গেল। সে যেখানে যায় সেইখানেই এইরূপ আনন্দের হাট মেলে। তার কাহিনীর ভিতর দিয়া এই দেশের সব চাইতে যে শ্রেষ্ঠ আদর্শ সেই। একনিষ্ঠ প্রেমের জয় ঘোষণা করিয়া গেল। সেই প্রেমের মর্যাদা রাখিতে এ দেশের মেয়েরা। কত দুঃখের সাগরে স্নান করিয়াছে, কত বেহুলার কলার মন্দাস গংকিনী নদীর সেঁতে। ভাসিয়া, কত চিরিঙ্গার ঘাট কত নিতাই ধুপুনীর ঘাট পার হইয়াছে, যুগে যুগে এই প্রেম, দুঃখের অনলে পুড়িয়া নিজের স্বর্ণজ্যোতি আরও উজ্জ্বলতর করিয়াছে। অস্ত্র তাহাকে ছেদন করিতে পারে নাই, অগ্নি তাহাকে দাহন করিতে পারে নাই। রহিমদ্দীর মত বাঙলার গ্রামগুলিতে এইরূপ কত গায়ক, কত কবি, কত কথক রহিয়াছে। তাহারা বাঙলার অবহেলিত জনগণের মধ্যে আনন্দ-রসে ভরিয়া এই আদর্শবাদ আর নীতির মহিমা প্রচার করিতেছে। হয়ত সেই জন্যই আজও দেশে পুণ্যাত্মাদের সমাদর। অসৎ দুজন ব্যক্তিকে লোকে হেয় চক্ষে দেখে। কিন্তু রহিমদ্দীনের মত গুণী ব্যক্তিদের সমাদর ক্রমেই কমিয়া যাইতেছে। কে তাহাদের সভ্য সমাজে ডাকিয়া আনিয়া উচ্চ সম্মানের আসনে বসাইবে?

আজাহের রহিমদ্দীকে থাকিতে বলিতে পারে না। একজন অতিথিকে আরও একদিন থাকিতে বলা মানে তাদের আর একদিন আধপেটা খাওয়া। দিন কামাই করিয়া দিন খায়। রহিমদ্দী। একদিন তাঁতের কাজ বন্ধ থাকা মানে তারও আর একদিন না খাইয়া থাকা। অনেক বলিয়া কহিয়া আবার আসিব বলিয়া রহিমদ্দী বড়ুর সরু বাহুবন্ধনখানি ছাড়ায়। আজাহেরের বউ বলে, “চাচাজান! এই শিশুর-ত্যালটুক নিয়া যান। কেদাইরার মরে দিবেন। হুনছি শিশুর-ত্যালে বাতের ব্যামো হারে। ও-পাড়ার মোকিমীর বাড়িত্যা কাইল সন্ধ্যায় আমাগো বাড়ির উনিরে দ্যা আনাইছি। আর এই ঢ্যাপের বীজগুলান নিয়া যান। চাচীজান যেন অদ্দেক রাহে আর অদ্দেক মোড়লের বউরে পাঠায়া দ্যায়। আরে তারে কইবেন, গরীব আমরা। গরে মিটাই থাকলি ঢ্যাপের বীজদ্যা খই বাইজা মওয়া বাইন্দা দিতাম। তানি যেন মোড়ল সাবরে মওয়া বাইন্দা খাওয়ায়।” রহিমদ্দী ঢ্যাপের পোটলা আর তেলের শিশি তার বোচকার মধ্যে বাঁধিতে বাঁধিতে বলে, “তোমরা সব পাগল ঐলা নাকি? এত জিনিস নেওয়া যায়?”

বউ বলে, আর এক কর্তা। মোড়ল বউরে কইবেন তার ছাইলার যহন বিয়া অবি আমারে যেন নাইয়ারে নেয়। কতকাল গিরামডারে দেহি না। একবার যাইবার ইচ্ছা করে।”

বিদায় লইয়া রহিমদ্দী পথে রওয়ানা হয়। আজাহের তাকে গ্রামের শেষ সীমা পর্যন্ত আগাইয়া দিয়া আসে। ফিরিবার সময় আজাহেরের মনে হয়, আজ যে গান গাহিয়া রহিমদ্দীন সকলের অন্তর জয় করিয়া গেল, এ যেন তাহাদের নিজেরই কীর্তি। সে যেন নিজেই গান গাহিয়া সকলকে মাতাইয়া দিয়াছে। রহিমদ্দী উপলক্ষ মাত্র। কারণ সেই ত তাহাকে ডাকিয়া আনিয়াছিল। গর্বে আজাহেরের নাচিতে ইচ্ছা করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *