–আমি তোমাকে চিনতে পারিনি বিমান।
–তুমি আমাকে লজ্জা দিচ্ছ।
–তুমি না থাকলে জয়ের সঙ্গে আমার দেখা হত কোনওদিন?
–হত। ঠিকই হত। এই পৃথিবীতে কার সঙ্গে কার দেখা হবে সবই বিধাতা স্থির করে রেখেছেন, আমি তো নিমিত্ত মাত্র। তবে বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে শুধু সুখী দেখতে চেয়েছি।
–আমি জানি বিমান।
এর পর বিমান চোখ তুলে তাকাবে। সোজাসুজি নয়, একটু কোনাকুনি। আবার নামিয়ে নেবে মাথা। ব্যস।
লাঞ্চ ব্রেকে ডায়ালগগুলো আর একবার ঝালিয়ে নিচ্ছিল কন্দর্প। আজ শেষ হলে তার আর দুদিনের শুটিং বাকি থাকবে। তারপর কবে ডাবিং পড়ে…!
লাইটের লোকজনরা খাওয়া সেরে একে একে ফিরছে। ফ্লোরের বাইরে খানিক দূরে ছোট্ট এক পুকুর, পুকুরের ধার ঘেঁষে হাঁটছে ঋতশ্রী। একা নয়, ঋতশ্রী একা হাঁটা ভালবাসে না। সঙ্গে দিদি আছে তার। দিদিটি মধ্যবয়সী, পৃথুলা, সব সময়ে একটা কুপিত ভাব ফুটিয়ে রাখে মুখে। হাঁটতে হাঁটতে মহিলা কী যেন বলে চলেছে ঋতশ্রীকে। টিনের চেয়ারে বসে দশ-পনেরো হাত দূর থেকে শোনার চেষ্টা করল কন্দর্প, শুনতে পেল না। আবার মন দিল লিখিত সংলাপে। একই ডায়ালগ বার বার পড়লে শব্দের অনেক ভাঙচুর চোখে পড়ে যায়। কোথায় উচ্চারণের তীব্রতা বাড়বে, কোথায় কমবে, কখন গলা থেকে স্বর আসবে, কখন বা নাভি থেকে, সবই আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
রূপেন সামনে এসে বসল–কি হে, কাজ তো ভালই চলছে!
কন্দর্প মুখ তুলে তাকাল। রূপেনের চোখে লালচে আভা। গন্ধ বেরোচ্ছে মুখ থেকে। সকালেই টঙ!
কন্দর্প হাসল, আপনি তো শুটিং-এ আসেন না, জানলেন কী করে?
আরে ভাই, লাইনের খবর কাকের মুখে পৌঁছে যায়। পকেট থেকে বিড়ি বার করল রূপেন। কি ভেবে আবার পকেটে রাখল, একটা সিগারেট দাও তো হে। খাওয়াটা বেশি হয়ে গেছে। জামাই আজ মাছের পিসগুলো বেশ সলিড দিয়েছিল।
কন্দর্প উত্তর দিল না, সিগারেট দেশলাই বাড়িয়ে দিল। জামাই যে কার জামাই, কে জানে! স্টুডিও পাড়ার মিল সাপ্লায়ার, অর্ডার মাফিক খাবার দিয়ে যায়। কন্দর্প টেকনিসিয়ানদের সঙ্গে ক্যান্টিনে বসেই সেরে নেয় খাওয়াটা। নায়ক-নায়িকা আর সিনিয়ার আর্টিস্টরা মেকআপ রুমে। জামাই-এর রান্না মোটামুটি ভাল, তৃপ্তি করেই খায় সকলে।
সিগারেট ধরিয়ে ফসফস ধোঁয়া ছাড়ছে রূপেন। কয়লার ইঞ্জিনের মতো। বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলে টোকা মারছে কপালে। গলা নামিয়ে বলল, পরিমল বলছিল।
–পরিমল তো ক্যামেরাম্যান, ও অ্যাক্টিং-এর বোঝেটা কী?
লাইনের পুরনো লোক, বোঝে বইকি! ফ্লোরের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে খুকখুক হাসল রূপেন, –বোঝে বলেই না মেয়েটা ওর গায়ে এঁটুলির মতো সেঁটে আছে।
বছর পঁয়তাল্লিশের ফরাসি কাটের দাড়ি গাট্টাগোট্টা পরিমল চিৎকার করে নির্দেশ দিচ্ছে লাইটম্যানদের। পাশে মণিকা। সহনায়িকা। নতুন মেয়ে, নরেন হোড়ের আমদানি। অভিনয়ে তেমন দড় নয়, তবে নিষ্পাপ মুখটি নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে মোটামুটি। কথাবার্তায় একটু ছমকছল্লু ভাব আছে, কন্দর্পের ঠিক পছন্দ নয়।
কন্দর্প হাসি হাসি মুখটা ধরে রাখার চেষ্টা করল, নতুন মেয়ে, ও তো একটু ক্যামেরা চাইবেই।
-শুধু কি অ্যাঙ্গেল? এতক্ষণ তো নরেনকে খুব জপাচ্ছিল। রূপেন চেয়ারটা আর একটু কাছে টানল, নরেন তোমার খুব প্রশংসা করছিল অশোকদার কাছে।
–নিজে থেকে প্রশংসা করল! নরেনদা! কন্দর্প সামান্য অবাক হল।
না, অশোকদাই জিজ্ঞেস করছিল।
কন্দর্পর মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। মাথার ওপর শরতের আকাশটার মতোই। আকাশে যে এখন একটাও মেঘ নেই তা নয়, সে মেঘ কন্দর্পর মনেও আছে। অশোকদাকে কাজটা দিতে পারল না, চিন্তাটা এখনও খচখচ করে বুকে। অথচ অশোকদা তাকে কথা মতো রোলটা দিয়েছে। বড় রোল, নায়কের প্যারালাল প্রায়। আউটডোর ইনডোর মিলিয়ে কুড়ি বাইশ দিনের শুটিং। কন্দর্পর জীবনে এত বড় কাজ এই প্রথম। গৃহযুদ্ধের কাহিনী বলার সময়ে গলা কেঁপেছিল তার, এই বুঝি অশোকদা তাকে হাঁকিয়ে দিল! কিমাশ্চর্য! অশোকদার শুনে ভুরুও কাঁপল না! দু-এক সেকেন্ড অন্যমনস্ক হয়ে গেল শুধু। তারপর অবিকৃত মুখে বলল, ঠিক আছে, বাড়ি তো আর পালাচ্ছে না। তুমি আউটডোরের জন্য রেডি হয়ে নাও। কন্দর্প ভয়ে ভয়ে বলেছিল, নরেনদার সঙ্গে দেখা করব?
–কিচ্ছু দরকার নেই, ঠিক সময়ে চলে যেয়ো। নরেনকে আমার বলা আছে। তোমার টিকিটও হয়ে গেছে। পরশু সকালে ট্রেন।
বাড়ির লোকজনের ওপর রাগে দুঃখে সেদিনই জামাকাপড় গোছগাছ করে কন্দর্প বেরিয়ে পড়েছিল। দু রাত হাওড়া কদমতলায় এক বন্ধুর বাড়িতে কাটিয়ে চলে গেল শুটিং-এ। হাজারিবাগ। শুটিং-এ গিয়ে ভীষণ তেতো হয়ে থাকত মন। গভীর এক আত্মগ্লানিতে বিষিয়ে থাকত হৃদয়। সে কি অশোকদাকে ঠকিয়ে রোলটা পেল!
হয়তো এই আত্মধিক্কারই তাকে এবার ক্যামেরার সামনে অনাড়ষ্ট রেখেছে। প্রাপ্যর থেকে বেশি জুটে গেছে বলেই কি জান লড়িয়ে দিয়েছে কন্দর্প? হতেও পারে। নইলে আধা রোমান্টিক দৃশ্যগুলোতে কন্দর্প কী করে অত সহজে উতরে গেল! ঋতশ্রী যে ঋতশ্রী, যে একটা ছবি বার্লিন ফিলম ফেস্টিভালে গেছে বলে আজকাল জার্মান অ্যাকসেন্টে বাংলা বলছে, সে পর্যন্ত হাজারিবাগে শুটিং-এর পর হাত চেপে ধরেছিল কন্দর্পর।
কন্দর্প মনে মনে হাসল। অশোকদা দেখুক, জানুক, কন্দর্প তাকে প্রবঞ্চিত করে রোলটা নেয়নি। সে কাজ দিয়ে উশুল করে দেবে অশোকদার ঋণ। যদি ছবিটা লেগে যায়…!
ঋতশ্রীর দিদি হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত, ফিরে গেছে ফ্লোরে। হাতের ইশারায় ঋতশ্রী ডাকছিল কন্দর্পকে, কন্দর্প ঠিক দেখতে পাচ্ছে না।
রূপেন কন্দর্পকে ঠেলল, যাও। মহারানির ডাক পড়েছে।
কন্দর্প সন্ত্রস্ত মুখে বলল, কী ব্যাপার বলুন তো?
–মাথা ধরেছে মনে হয়। টিপে দিতে বলবে। রূপেন চোখ মারল, তোমারই দিন চলছে। হিয়োর আজ শুটিং নেই, তুমিই সার্ভিস দাও।
কন্দর্প উঠে গেল।
পুকুরের নিস্তরঙ্গ জলের দিকে তাকিয়ে আছে ঋতশ্রী। শ্যাওলা রঙ সালোয়ার কামিজের ওপর সাদা শিফনের উড়নি, নায়িকার রূপটান লেপে আছে মুখে, চোখে বিদেশি ফটোসান। পানপাতা মুখ ফিরিয়ে মৃদু ঝাঁঝিয়ে উঠল, ড্রাঙ্কার্ডটার সঙ্গে বসে কী গল্প করছেন?
কন্দর্প একবার দেখে নিল রূপেনকে। এদিকেই তাকিয়ে আছে। বলল, কিছু না। এমনিই বকবক করছিলাম।
–মানে আমাদের নিয়ে টিপ্পনি কাটছিলেন, তাই তো?
না না, বিশ্বাস করুন….
আমি সব বুঝি। ঋতশ্রী ঠোঁট টিপল, –আপনার আজকাল এত পায়াভারি হয়েছে কেন?
রোদে রঙিন হয়ে চশমার আড়ালে ঋতশ্রীর চোখটা কি হাসছে? কন্দর্প বুঝতে পারল না। ভয়ে ভয়ে ঠাট্টা করার চেষ্টা করল একটু, আপনার সঙ্গে কাজ করছি, পায়াভারি তো হওয়ারই কথা।
বাহ, দিব্যি কথাও শিখে গেছেন দেখছি!
–শিখলাম কোথায়! মকসো করছি।
–ফাজলামি রাখুন। সব সময়ে অত একা একা বসে থাকেন কেন?
–কোথায় একা থাকি! এই মাত্র ক্যান্টিনে সবার সঙ্গে লাঞ্চ করে এলাম, হইহল্লা করছিলাম…
–আমার সঙ্গেও তো কথা বলতে পারেন! নাকি কথা বললে আমি কামড়ে দেব?
স্টুডিওতে প্রবাদ আছে ঋতশ্রী নাকি সত্যি সত্যি এক প্রোডিউসারকে কামড়ে দিয়েছিল। সেই প্রোডিউসারটি ছিল বীরভূমের এক কোল্ড স্টোরেজের মালিক। প্রচুর টাকা নিয়ে এসেছিল লোকটা। যতটা না ফিলম করার মতলবে, তার থেকে বেশি নায়িকাদের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেষি করার প্রলোভনে। চিত্রনাট্য শোনানোর অছিলায় ডিরেক্টরের বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছিল ঋতশ্রীকে, সেখানেই বুঝি কাঁধে হাত টাত দিয়েছিল, তখনই কামড়টা খেয়ে যায়।
কন্দর্প হেসে বলল আপনার দাঁতে জোর আছে, আমি জানি।
–শুধু দাঁতে নয়, হাতেও জোর আছে। দেখবেন? আলগা চড় দেখাল ঋতশ্রী, মুড অফ হয়ে যাচ্ছে, একটা গান শোনান তো।
গান! এখন! এখানে!
–কেন, পরিবেশটা খারাপ? সবুজ আছে, পুকুর আছে..
কন্দর্প ঢোঁক গিলল, –তা বলে এই ভরদুপুরে ভিড়ের মাঝে…
–ও বাবা, আপনি বুঝি আমাকে একান্তে গান শোনাতে চান? ঋতশ্রী খিলখিল হেসে উঠল, –আপনাকে দেখে যতটা বোকা লাগে, ততটা তো বোকা নন!
কন্দর্প মনে মনে বলল, অনেক বেশি বোকা আমি। নইলে তোমাকে ঝিনুক কুড়িয়ে দিই।
কন্দর্পর অপ্রস্তুত মুখের দিকে তাকিয়ে যেন মায়া হল ঋতশ্রীর। বলল, আপনার গানের গলাটা কিন্তু সত্যিই ভারি চমৎকার। রেগুলার রেওয়াজ করেন?
এক সময়ে করতাম। এখন আর হয়ে ওঠে না। কন্দর্প বলবে না ভেবেও বলে ফেলল, এখন অল্পস্বল্প বাজাই। সেতার।
–গুরু কে আপনার?
–মণিলাল নাগের কাছে শিখেছি এক সময়ে। এখন নিজেই পিড়িং পিড়িং করি।
–আপনার তো অনেক গুণ! হাসি থামিয়ে গম্ভীর হল ঋতশ্রী, স্মরজিৎ লাহিড়ি নেক্সট বই শুরু করছেন। পুজোর পর। আমার সঙ্গে কাস্টিং নিয়ে কথা হচ্ছিল। একটা রোলে আপনার নাম আমি রেফার করেছি। ছোট্ট, কিন্তু ভাইটাল রোল। করবেন তো?
মুহূর্তে ঋতশ্রীর ঝিনুক প্রত্যাখ্যানের অপরাধ ক্ষমা করে দিল কন্দর্প। বলল, এ তো আমার সৌভাগ্য। আপনি আমার কথা মনে রেখেছেন…
ঋতশ্রী কাঁধ ঝাঁকাল, কোআর্টিস্ট হিসেবে এটা তো আমার ডিউটি। আগে আপনার কাজ আমার ভাল লাগত না, কাউকে বলিনি। এখন আপনি বেটার করছেন… ইউ নিড সাম ব্রেক।
ফ্লোরে লাইট তৈরি হয়ে গেছে, সহপরিচালক ছেলেটি বেরিয়ে এসে ডাকছে ঋতশ্রীকে। যেতে গিয়েও ঘুরে দাঁড়াল ঋতশ্রী, এই যে শুনুন, রোলের কথাটা কিন্তু চারদিকে বলে বেড়াবেন না।
-না না, আমি কেন বলতে যাব?
রূপেনবাবু-টাবু কেউ যেন জানতে না পারে। ঋতশ্রী ঝট করে চশমাটা খুলল, লোকে কোনও কিছুই ভাল মনে নেয় না কন্দর্প, কদৰ্থ করে। অ্যান্ড আই হেট ইট।
নিজের মেকআপ রুমে ঢুকে গেছে ঋতশী। হাজার হাজার কিলোওয়াট আলোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে কন্দর্প। হালকা মেকআপ, ঘাম হয়ে ঝরে পড়ছে। তোয়ালে রুমাল বার করে আলগাভাবে মুখে থুপল কন্দর্প।
সুদিন কি এসে গেল!
.
স্টুডিও থেকে বেরোনোর সময়ে গেটে অশোক মুস্তাফির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল কন্দর্পর। মুস্তাফি এই সময়েই আসে, সাড়ে চারটে-পাঁচটা নাগাদ। থাকে শুটিং শেষ হওয়া পর্যন্ত। তার পরও নরেন হোড়ের সঙ্গে আলাপ আলোচনা হয়, দুজনে একই সঙ্গে বেরোয় স্টুডিও থেকে।
কন্দর্প অতক্ষণ থাকে না। কাজ শেষ হলেই সে বেরিয়ে যায়। মুস্তাফিও তাকে আটকায় না কোনওদিন।
আজ আটকাল। গাড়িতে বসেই ধরল কন্দর্পকে।
-তোমার আজকে হয়ে গেল?
–হ্যাঁ দাদা।
–আর কতক্ষণ চলবে কাজ?
–হাফ শিফট তো বটে। ঋতশ্রী মণিকার দুটো সিন বাকি, ঋতশ্রীর বোধহয় একটা সোলো কাজও আছে।
–তুমি এখন চললে কোথায়? বাড়ি?
–না, একটু রাসবিহারীর আড্ডায় যাব ভাবছি। রোজই তো সন্ধে হয়ে যায়, আজ একটু তাড়াতাড়ি ছুটি পেলাম। কন্দর্প স্কুটারের স্টার্ট বন্ধ করবে কিনা ভাবছিল।
মুস্তাফি বলল, তার ওপর পকেটও আজ গরম… আজ পেমেন্ট পেয়েছ তো?
কন্দর্প হাসিমুখে ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ দাদা। চার হাজার।
মুস্তাফি ঘড়ি দেখল, এক্ষুনি ঠেকে যেতে হবে না। অত ঠেক-টেকে যাওয়ার কি আছে? এসো। কথা আছে।
কন্দর্প আশঙ্কিত চোখে তাকাল—জরুরী কিছু?
মুস্তাফি সোজাসুজি উত্তর দিল না, তুমি নরেনের অফিসে বোসো, আমি ফ্লোর ঘুরে আসছি।
স্কুটার ঘোরাতেই হল কন্দর্পকে। বিকেল থাকতে থাকতে কাটতে পারলে ভাল হত আজ। ভবানীপুর থেকে তিতিরের জন্য একটা কোয়ার্টজ ঘড়ি কেনার ইচ্ছে ছিল। গোলেমালে মাঝখান থেকে তিতিরটা বঞ্চিত হয়েছে। এ কাজটা থেকে সর্বসাকুল্যে হাজার পনেরো পাওয়ার কথা, এরই মধ্যে দু খেপে নয় পেয়ে গেল, এখনও ঘড়িটা না কেনা অন্যায় হয়ে যাবে।
নরেনের কুঠুরিতে বসে নিজেকে খুঁড়ছিল কন্দর্প। নিজের মধ্যেই অদ্ভুত এক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে আজকাল। আগে দু-পাঁচশোর বেশি জুটত না, নিজে হাতখরচের জন্য সামান্য কিছু রেখে সবটাই তুলে দিত বউদির হাতে। আর এখন? কদিন আগে পাঁচ হাজার পেল, কিছুতেই হাজার টাকার বেশি বউদিকে দিতে হাত সরল না। এবারও কি প্রাণে ধরে পাঁচ-সাতশোর বেশি দিতে পারবে? মনে হয় না। গতবারও হাজার তিনেক ব্যাঙ্কে ফেলেছে, এবারও হাজার দুয়েক ঢুকিয়ে দেবে অ্যাকাউন্টে। হাতে একটু বেশি টাকা আসার পর থেকেই এরকম প্রবৃত্তি এল কেন তার? অথচ টাকা হাতে না থাকার সময়ে ঠিক এর উল্টোটাই ভাবে সে।
কন্দর্প কি সঙ্কীর্ণ হয়ে যাচ্ছে? অথবা নিজের জন্য একটু শক্ত মাটি তৈরি করতে চাইছে নিজেরই অবচেতনে? মুস্তাফি মিনিট দশেকের মধ্যেই এসে গেছে। শুটিং নিয়ে দু-একটা মন্তব্য করেই কাজের কথায় এল, শোনো, আমি পরশু দিল্লি যাচ্ছি।
সুদিন! সুদিন! কন্দর্পের হৃৎপিণ্ড কি পলকের জন্য লাফিয়ে উঠল।
কন্দর্প ক্ষুধার্তের মতো বলল, ওই সিরিয়ালটার জন্য?
সিরিয়ালের খোঁজ তো নেই।
কবে নাগাদ শুরু হতে পারে কাজটা?
–বলা কঠিন। আদৌ হবে কি না তাও সন্দেহ।
–কেন?
–দেখছ না চারদিকে কী ডামাডোলের বাজার! পুজোর পর ইলেকশন আসছে, এখন কি আর নতুন সিরিয়াল ছাড়ছে?
–তাহলে আর দিল্লি যাচ্ছেন কেন? কন্দর্প স্যাঁতানো গলায় বলল।
–অন্য কাজও আছে। রেল মিনিস্ট্রিতে। আমাকে তো এক ধান্দায় পড়ে থাকলে চলে না। তবে হ্যাঁ, মাণ্ডি হাউসেও ঢুঁ মারব।
কন্দর্প চুপ মেরে গেল।
মুস্তাফি বিদেশি সিগারেট ধরিয়ে গোল করে ধোঁয়া ছাড়ল, হ্যাঁ, যা বলছিলাম.. মানে তোমাকে যার জন্য ডাকা। তুমি যাবে আমার সঙ্গে?
–আমি…আআআমি!
জানি পরশু তোমার শুটিং আছে। নরেনকে বলে দেব তোমার সিনগুলো সকালে টেক করে নেবে।
কন্দর্প জোর করে প্রতিবাদ করতে পারল না। কিন্তু তার মনে অবিরাম বেজে যেতে লাগল–আমি কেন! আমি কেন!
অশোক মুস্তাফি চোখ সরু করে দেখছে কন্দর্পকে। কন্দর্পর অস্থিমজ্জা ভেদ করে ঢুকে যাচ্ছে দৃষ্টিটা। হঠাৎ হা হা করে হাসল, জানি কী ভাবছ। ভাবছ, তুমি কেন? তাই তো?
কন্দর্প মাথা নামাল।
–শোনো। প্রথমত, আমি আমার লাইনের লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরা পছন্দ করি না। সেকেন্ডলি, দা মোস্ট ভাইটাল রিজন হল, আমি একটু মেরুদণ্ডহীন, উচ্চাশাবিহীন লোকদের সঙ্গ ভালবাসি। অ্যান্ড ইউ নো, তুমি এই রোলটাতে একদম ফিট।
কন্দর্প পুরোপুরিই সেঁতিয়ে গেল। অপমানিতও বোধ করল যেন। তবে মুখে কিছু বলল না।
মুস্তাফি গলা তুলল, কী হল, যাচ্ছ তো?
বলছেন যখন, যাব।
–গুড। হঠাৎ কি যেন মনে পড়ে গেছে মুস্তাফির, আমি পুজোর পরে আর একটা ফিলম লঞ্চ করছি। লো বাজেট ফিলম। স্মরজিৎ লাহিড়ি ডাইরেক্ট করবে।
কন্দর্প বেশ চমকে গেল, স্মরজিৎ লাহিড়ির বই আপনি প্রোডিউস করছেন?
লাইনে থাকতে গেলে সবই করতে হবে হে। লোকটা খুব এন এফ ডি সি, আর্ট ফিল্ম, প্রতিবাদী চলচ্চিত্র, বোম ফেস্টিভাল, কান ফেস্টিভাল দেখাত। সেদিন এক বন্ধুকে নিয়ে আমার বাড়িতে এসে হাজির। করুণ মিনতি, ইন্ডাস্ট্রিতে এত পয়সা ঢালছেন, আমাদের কথাও একটু ভাবুন। তা ভেবে দেখলাম, কিছু লাগিয়েই দিই। নামও হবে, আবার ওদিকে লসের খাতায় অঙ্কটাও একটু বাড়িয়ে দেখানো যাবে। আর যদি কোনও প্রাইজ টাইজ পেয়ে যায়, তাহলে বিদেশে বেচে, টিভিতে দেখিয়ে কিছু পয়সা তো ঘরেও ফিরবে, কী বলে? ঋতশ্রীকে সাইনও করিয়ে নিয়েছি। …বাই দা বাই, ছবিটাতে তুমিও একটা রোল করছ।
কন্দর্প মনে মনে বলল, জানি। মুখে অবাক হওয়ার ভান ফোটাল, তাই?
–ইয়েস ব্রাদার। তোমাদের ঋতশ্রী রোলটার জন্য একটা ক্যান্ডিডেট ফিট করেছিল। সুনির্মল সরকার। আমি বাতিল করে দিয়েছি। স্মরজিৎকে বলে দিয়েছি, ওই রোলে তুমিই আমার চয়েস। স্মরজিৎ রাজি হয়েছে।
কন্দর্প স্তম্ভিত হয়ে গেল। পুকুরপাড়ে ঋতশ্রীর অত রঙঢঙ, অত সহৃদয় ব্যবহার, সবই কি ছলনা! না, সত্যিই মাথাটা গুলিয়ে যাচ্ছে।
মুস্তাফি সিগারেট নেবাল, –তবে কি জানো, তোমাকে রোল দিয়েও লাভ নেই। তুমি জীবনে শাইন করতে পারবে না।
–এ কথা কেন বলছেন দাদা? আমি কি এই ছবিতে খারাপ কাজ করেছি? আর দু-একটা চান্স পেলে…
কিচ্ছু হবে না। মুস্তাফি মাছি তাড়ানোর মতো উড়িয়ে দিল কথাটা, কাজ অনেকেই ভাল করে, ওপরে ওঠে কজন? ওপরে ওঠার জন্য আলাদা মেটিরিয়াল লাগে। সেটা তোমার নেই।
কন্দর্প অভিমানী গলায় বলল, কী নেই আমার দাদা? পরিশ্রম, অধ্যবসায়, নিষ্ঠা…
–দুর দুর দুর। ফুটপাথে গামছা বিক্রি করতাম, পরিশ্রম অধ্যবসায়ের জোরে টাটা-বিড়লা হয়ে গেলাম, এ সব ছেঁদো গপ্পো ছাড়ো তো। আসল জিনিস যেটা দরকার, সেটা হল বুকের পাটা। পাপ করবার সাহস। রুথলেসনেস। আমি ছাড়া পৃথিবীতে কিছু নেই, এই মনোভাব। এসব আছে তোমার? বাড়ির ছেলে বাড়িতেই মিনমিন করে থাকো, তুমি করবে উন্নতি।
জানি দাদা, বাড়িটা করে দিতে পারলাম না বলে আপনি আমার ওপর রেগে আছেন..
ধুস, ও কথা বোলো না। অপদার্থ মানুষদের আমার বেশ ভালই লাগে। একটা কেন্নো কেন্নো ভাব…! তাছাড়া তোমার বাড়িটা না হলে কি আমি মরে যাচ্ছি? হ্যাঁ, পেলে ভাল হত, কিছু ক্যাশ টাকা আসত। ইলেকশানে সব পার্টির গর্ভেই তো কিছু কিছু করে ঢালতে হবে। কবে কে কোন কম্মে লাগবে ঠিক নেই, ঝুলি পেতেই রয়েছে!
ছোট্ট অফিসঘরে আলো তেমন উজ্জ্বল নয়, বাইরেও বিকেল ক্ষয়ে যাচ্ছে দ্রুত। বিন বিন মশা ঘুরছে চারদিকে, ঘুরন্ত পাখার নীচেও অতর্কিতে হুল ফোঁটাচ্ছে।
মুস্তাফি উদাস মুখে বলল, আমি কি নিজেই কিছু করতে পারতাম না? পারতাম। গুণ্ডা ফিট করতে পারতাম, পার্টির ছেলেদের লেলিয়ে দিতে পারতাম, তারা দু দিনে তোমার বাড়ির লোকদের অতিষ্ঠ করে ছেড়ে দিত। কিন্তু তোমাদের ওই একটা বাড়ির পেছনে ছুটে আমার কী লাভ? তবে এসব একেবারে করিনি তা তো নয়, প্রথম প্রথম করেছি। টালিগঞ্জে একটা দশ কাঠা জমিতে এক বুড়ি খুব ব্যাগড়া দিচ্ছিল। যতই টোপ দিই, খায় না। শেষে তিন মাস ধরে এমন হুড়কো দিয়েছিলাম, বুড়ি ভয়েই টেসে গেল। এখন আর ওসব ভাল লাগে না। তার ওপর সামনে ইলেকশান, কোত্থেকে কোনটা পলিটিক্যাল ইস্যু হয়ে যাবে, কাগজে নাম বেরিয়ে যাবে। ….বোঝই তো, ব্যবসা করতে এসেছি, একটু আড়ালে আবডালে থাকাই ভাল। মুস্তাফি দু হাত ছড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল–যাক গে, কী আর করা। তোমার মতো একটা রঙ হর্সকে ব্যাক করেছি…আমার ইনটিউশ্যনটা সত্যিই খুব খারাপ।
কন্দর্প করুণ মুখে বলল, আমি কী করি বলুন তো দাদা? আপনাকে তো বলেইছি, ফ্যামিলিতে কী অশান্তিটা হয়ে গেল! বাবা বেঁচে থাকতে কিছু হওয়ার নয়। আমার এখন কি কোনও হাত আছে?
বাপটাকে মেরে ফেলতে পারতে। মুস্তাফি হাই তুলল, বয়স হয়েছে, তারপর শুনি তো হাঁপের টান, মুখে একটা বালিশ চেপে ধরতে পারতে! কে কখন কোথায় মরবে সবই তো ব্রহ্মময়ী ঠিক করে রেখেছেন, নয় তাঁর লীলাটা তোমার হাত দিয়েই হত।
নিজের কথাটা নিজেরই খুব পছন্দ হয়েছে মুস্তাফির। হা হা হাসছে।
কন্দর্প ঘামছিল। পাখাটা কি ঘুরছে না ভাল করে?
হাতের কবজিতে মশা বসেছে একটা, অনেকক্ষণ ধরে রক্ত চুষছে। অন্যমনস্ক কন্দর্প কবজিতে হাত বোলাল, থেঁতলে গেল মশাটা। কয়েক ফোঁটা রক্ত লেপটে গেছে চামড়ায়। কন্দর্প উঠে দাঁড়াল।
মুস্তাফির হাসি থামেনি এখনও। হাসতে হাসতেই বলল, আমি সত্যি সত্যিই তোমাকে খুন করতে বলিনি। শুধু বোঝাতে চাইছিলাম, কাকে বলে শাইন করার ইচ্ছে। জয় করার সর্বগ্রাসী বাসনা। প্যাশন ফর সাকসেস। তোমার লোভ আছে, প্যাশানটা নেই।
কন্দর্প গোমড়া মুখে বলল, পরশু কখন যেতে হবে?
–ঠিক চারটেয় বেরোব। তুমি এখানেই থেকো, আমি তোমাকে পিকআপ করে নেব। সাড়ে ছটায় ফ্লাইট।
কন্দর্প বেরিয়ে আসছিল, মুস্তাফি পিছু ডাকল, তুমি কি রাগ করলে কন্দর্প?
না। আপনি সবই বলতে পারেন।
–আমি কিন্তু তোমাকে সত্যিই লাইক করি কন্দর্প। তোমার ওপর কি জানি কেন, আমার একটা উইকনেস এসে গেছে। মুস্তাফি গলা নামাল, দেখো, আজ রাত্রেই বাবাকে যেন খুন করে বোসো না।
স্কুটার স্টার্ট করার সময়ে আবার নিজের হাতের কবজির দিকে চোখ পড়ল কন্দর্পর। রক্তটা শুকিয়ে গেছে। লাল রঙ এর মধ্যেই কালচে। রক্ত বলে বোঝাই যায় না।
লেকের পাশ দিয়ে বাড়ি ফিরছিল কন্দর্প।
আজ আর রাসবিহারীর আড্ডায় যাওয়া হল না, ইচ্ছেই করছে না। গিয়ে হবেই বা কি? অশোক, মুস্তাফির বাক্যগুলো ক্রমাগত লাথি মারছে মাথায়, উত্যক্ত হয়ে আছে করোটি। মুস্তাফি কী চায়? কী মনে করে কন্দর্পকে? ক্রিমিকীট? লেজ নাড়া লেড়ি কুত্তা?
শরতের সন্ধ্যা বড় তাড়াতাড়ি জমাট বেঁধে গেছে। বাতাস বইছে পলকা। শুকনো বাতাস নয়, একটু ভিজে ভিজে ভাব আছে বাতাসে। বৃষ্টির স্মৃতি এখনও ভুলতে পারেনি আকাশ।
পথের দু ধারে গাছের সারি ঘন পাতায় ছাওয়া। ফাঁক দিয়ে আলো এসে পড়ছে রাস্তায়। কালো পথে যতটা আলো, ঠিক ততটাই অন্ধকার।
কন্দর্প আলো-আঁধারে স্কুটার থামাল। বাহন লক করে ঢুকল লেকে। পায়ে পায়ে জলের ধারে এসে দাঁড়িয়েছে। লেকের এদিকটায় বাতি জ্বলছে না, বড় অন্ধকার হয়ে আছে জল। হাওয়ায়– কেঁপে কেঁপে পাড় ছুঁচ্ছে, জলে একটা শব্দ উঠছে মৃদু। একটু দূরের দ্বীপ কালো, ঘন কালো।
পায়ে পায়ে স্কুটারের কাছে ফিরল কন্দর্প। আবার আনমনে জলের ধারে চলে গেছে। আবার ফিরল।
ঢাকুরিয়া ব্রিজ পার হয়ে বাঁ দিকে ঘুরতেই এক তীক্ষ্ণ ডাক শুনে কন্দর্প সংবিতে ফিরেছে। থামল।
ব্যাঙ্কের গায়ে, রাস্তার চায়ের দোকান। সেখান থেকে ভাঁড় হাতে উঠে এসেছে পল্টু, কী কেস করেছ বস! পাড়ায় কী সব জিনিস আসছে!
কন্দর্প ভুরু কুঁচকে তাকাল, কী হয়েছে?
বিকেলে তোমাকে একজন খুঁজতে এসেছিল। পুরো শ্রীদেবী।
কে?
–হাইটটা অবশ্য শ্রীদেবীর নয়, জয়া প্ৰদার মতো।
–কী নাম?
–তা তো বলতে পারব না বস। আমি দত্তদার দোকানে সিগারেট কিনছিলাম, তোমার নাম করে ঠিকানা খুঁজছিল, বাড়িটা দেখিয়ে দিলাম।
কন্দর্প ধাঁধায় পড়ে গেল। কন্দর্পর যে কোনও মেয়েবন্ধু নেই তা নয়, তার চেহারায় আকৃষ্ট হয়ে অনেক মেয়েই প্রাথমিক ভাবে জমাতে আসে। পাড়ার। বেপাড়ার। কয়েক বার হালকা হালকা প্রেমেও পড়েছে সে। তবে একটা প্রেমও গাঢ় হওয়া অবধি টেকেনি। প্রেমিক হিসেবে কন্দর্প দারুণ পয়া, তার সঙ্গে তিন দিন ঘুরলেই ভাল ভাল সম্বন্ধ এসে যায় প্রেমিকাদের। এবং তাদের বিয়েতে গিয়ে কন্দর্প পেট পুরে খেয়ে আসে। ফিরে এসে তারিফ করে বরেদের, একটু ভারী বুকে। তাদেরই কেউ কি পথ ভুলে এসেছিল?
কন্দর্প জিজ্ঞাসা করল, বিয়ে হয়ে গেছে?
–আমি তো মেয়েদের কপালের দিকে তাকাই না বস। পল্টু চা শেষ করে পায়ে চেপে গুঁড়োচ্ছে ভাঁড়, –তুমি এখন হিরো বলে কথা। দেখো, হয়তো কোনও হিরোইনই এসেছিল। চিনতে পারলাম না।
কতক্ষণ আগে এসেছিল?
তা হবে সাড়ে চারটে-পাঁচটা। চলেও গেছে, আমি দেখেছি। তা বস তোমার ফিলমের শুটিং কতদূর?
–হয়ে এসেছে। কন্দর্প চিন্তিত মুখে বলল।
–পাশ টাশ দিও। তোমার বই কিন্তু গুরু পয়সা দিয়ে দেখব না।
–দিই তো। দিই না? কন্দর্প অল্প খিঁচিয়ে উঠে স্কুটার এগোল।
বাড়ি ঢুকতেই মিনতি। কন্দর্পকে দেখে হাসছে ফিক ফিক, ছোড়দা, আপনি বাড়ি ফিরলেই বড়বউদি আপনাকে দেখা করতে বলেছে।
–কেন? কন্দর্প মুখ চোখ স্বাভাবিক রাখতে চাইল।
–সে আমি কী করে বলব? হাসিটা আর একটু বেড়ে গেল যেন, গিয়েই দেখুন।
মহা ফাজিল হয়েছে তো মেয়েটা! এত আস্কারা দেয় রুনা!
নিজের বন্ধ ঘরের সামনে দু-চার সেকেন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল কন্দর্প। ওপরে যেতে, বিশেষত ইন্দ্রাণীর ঘরে, এখনও বেশ অস্বস্তি হয় তার। সেদিনের সেই অশান্তির পর কন্দর্পকে একটি কথাও জিজ্ঞাসা করেনি ইন্দ্রাণী। আউটডোর শুটিং থেকে ফেরার পরও না। প্রশ্ন করলে সব কথা উগরে দিয়ে খানিকটা লঘু হতে পারত কন্দর্প, সেই সুযোগটুকুও ইন্দ্রাণী দিল না। নিজে থেকেই ইন্দ্রাণী কথা বলেছে, গল্প করেছে, হাসিতামাশাও যে করেনি এমন নয়, কিন্তু সেদিনের প্রসঙ্গ আগাগোড়াই উহ্য রেখেছে। কেন যে রেখেছে, কন্দর্প তাও জানে। ইন্দ্রাণী কিছুই ভোলে না। ঠিক সময় বুঝে আঘাত করবে কন্দর্পকে। করবেই। আঘাতটা কোন দিক থেকে যে আসবে সেটা ভেবে ভেবে রয়ে গেছে অস্বস্তিটাও!
মেয়েটা কে এসেছিল? জানতে কৌতূহলও হচ্ছে খুব।
কন্দর্প ওপরে উঠল। তাড়াতাড়ি নয়, শ্লথ পায়ে।
ইন্দ্রাণী সেলাই মেশিন নিয়ে মাটিতে বসে আছে। কি একটা যেন সেলাই করছে। বোধহয় জানলার পর্দা। কন্দর্পকে দেখে হাসল, –বোসো।
কন্দর্প পকেট থেকে ছোট্ট বাক্সটা বার করল, দ্যাখো তো ঘড়িটা কেমন!
ইন্দ্রাণী খুলে দেখল, বাহ, দারুণ ঘড়ি।
–তিতিরের জন্য কিনে আনলাম। তিতির কোথায়? বাড়ি নেই?
বন্ধুর সঙ্গে বেরিয়েছে। এক্ষুনি ফিরবে। ইন্দ্রাণীর মুখে আলগা ছায়া পড়েই মিলিয়ে গেল, –তুমি এটা কিনতে গেলে কেন? এর তো প্রচুর দাম। কত পড়ল?
–তা দিয়ে তোমার কী হবে! মাধ্যমিকে ভাল করলে আমি ওকে দেব বলেছিলাম…
–এত দামি জিনিস দেওয়া ঠিক নয়।
কন্দর্প সাহস করে বলে ফেলল, এ তো বিটুইন আমি আর তিতির। এর মধ্যে তুমি নাক গলাচ্ছ কেন?
ইন্দ্রাণী কি বলতে গিয়েও সামলে নিল। বাক্স বন্ধ করে খাটে রেখেছে। সেলাই মেশিনের হ্যান্ডেলে হাত রাখল, তোমার খোঁজে একজন এসেছিল। কে বলো তো?
–হ্যাঁ, রাস্তায় পল্টুও বলছিল। কে?
–মধুমিতা।
–মধুমিতা? কে মধুমিতা?
–তা তো বলতে পারব না। বাগুইআটিতে থাকে বলছিল।
–ও, আচ্ছা আচ্ছা, বুঝেছি। অবাক হলেও কন্দর্প বিস্ময়টা মুখে ফুটতে দিল না, মধুমিতা মানে চিনেছ তো? আমার সেই বন্ধু দীপঙ্কর… হঠাৎ মারা গেল… তার বউ। তোমাকে বলেছিলাম না খুব স্যাড কেস… একটা বাচ্চা আছে…!
বলেছ হয়তো। তুমি তো কত কিছুই বলল, আমিই মনে রাখতে পারি না। সেলাই মেশিন চালানো শুরু করেছে ইন্দ্রাণী।
বউদি কি খোঁচা দিয়ে নিল একটু! কন্দর্প আমল দিল না, কি জন্য এসেছিল?
–কিছু তো বলল না। দু-এক মিনিট কথা বলতে না বলতেই চলে গেল। মুখ চোখ দেখে মনে হল তোমার সঙ্গে খুব দরকার। বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিল।
মাস তিন-চার ওদিকে যায়নি কন্দর্প। শেষ দিন মধুমিতাকে দুটো ঠিকানা দিয়ে এসেছিল। চাকরির। কন্দর্পর স্কুলের এক বন্ধু এক্সপোর্ট ইমপোর্টের ব্যবসা করছে, তার অফিসে রিসেপশনিস্টের। আর নতুন একটা কুরিয়ার সার্ভিসে ডেস্ক জবের। তারপর আর খোঁজ নেওয়া হয়নি।
বাড়িতে এল কেন মধুমিতা? নতুন কোনও অঘটন ঘটল কি?
ঘড়ঘড় শব্দে সেলাইমেশিন চলছে। অবিরাম যন্ত্রসূচের ওঠানামা বিদ্ধ করছে নীল কাপড়টাকে। কন্দর্প চোখ সরিয়ে নিল।
হঠাৎই দৃষ্টি কবজিতে আটকেছে। রক্তের ছোপটা এখনও মিলোয়নি।
.
২২.
স্কুলে টিফিনের সময় বেয়ারা একটা চিঠি দিয়ে গেল ইন্দ্রাণীকে।
ইন্দ্রাণী তখন গোগ্রাসে খাচ্ছিল। স্কুলে আসার আগে চা ছাড়া কিছু খেয়ে আসে না, এসেই পর পর চার পিরিয়ড ক্লাস থাকে, এই সময়টায় পেটের মধ্যে হাঁ হাঁ করে উনুন জ্বলে তার। সামনে একটা দোকানকে বলা আছে, তারাই স্কুলে এসে খাবার দিয়ে যায়। ইডলি ঘোসা পরোটা তরকারি, এই সব। খাবারের স্বাদ কেমন বোঝার তর সয় না, স্টাফ রুমে ঢুকেই ইন্দ্রাণী কচকচ চিবোতে শুরু করে দেয়।
ইন্দ্রাণীর খাওয়া থামল। বাদামি লেফাফা। মুখ বন্ধ। ওপরে তার নাম টাইপ করা আছে ইংরিজিতে।
ইন্দ্রাণী আলগোছে খামটা ছিঁড়ল। চিঠি পড়তে পড়তে ক্রমশ ভুরুর ভাঁজ ঘন হয়ে এল। স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে শো কজ করেছে!
স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বছর তিনেক ধরে একটা গণ্ডগোল চলছে ইন্দ্রাণীর। চাকরির স্থায়ীকরণের তারিখ নিয়ে। এই স্কুলে প্রথমে সে ঢুকেছিল একজনের ছুটির বদলি হিসেবে, পরে তার চাকরিটা পাকা হয়। চাকরি ঠিক কোন দিন থেকে পাকা হয়েছিল তাই নিয়েই ঠাণ্ডা লড়াই। ইন্দ্রাণীর মতে সার্ভিস বুকে যে তারিখটি লেখা আছে, সেটি ভুল, আইন মোতাবেক আরও তিন মাস আগে তার চাকরি স্থায়ী হওয়ার কথা। নিজের মত জানিয়ে স্কুল কমিটিকে অনেকগুলো চিঠি দিয়েছে ইন্দ্রাণী, একটিরও জবাব পায়নি। অসহিষ্ণু হয়ে গরমের ছুটির আগে বেশ রূঢ় ভাষায় আর একটি চিঠি দিয়েছিল, সেই চিঠির ভাষায়, চার মাস পরে, ম্যানেজিং কমিটির গোঁসা হয়েছে। কেন ইন্দ্রাণীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, জানতে চেয়েছে তারা।
চড়াং করে ইন্দ্রাণীর মাথা গরম হয়ে গেল। এমনিতেই কদিন ধরে তার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে। আদিত্য আবার উৎপাত শুরু করেছে বাড়িতে। কোথায় কি ব্যবসার লাইসেন্স বার করতে ঘুষ দিতে হবে, আজই হাজার টাকা দাও। কাল কোন উকিলকে ফিজ না দিলে চলবে না, পাঁচশো টাকা দাও। করপোরেশনে ট্রেড লাইসেন্স করাব, তিনশো টাকা দাও। অথচ বড় মুখ করে বলেছিল, এবার নাকি একটি টাকাও লাগবে না। পরশু রাত্রে কথাটা স্মরণ করিয়ে দিতেই রাগ হয়ে গেল বাবুর, দু পাত্র গিলে চলে এল। আগের দিনের মতো হল্লা করেনি, এই যা রক্ষে। কিন্তু এ তো পুরোদস্তুর ব্ল্যাকমেলিং!
তবে এরকম হামলা তো ইন্দ্রাণীর জীবনে লেগেই আছে। শুধু এইটুকুনির জন্যই কি তার মেজাজ খারাপ? না, তা বোধহয় নয়। শুভাশিসও বেশ কয়েকদিন ধরে আসছে না। ইদানীং তার আসাটা বড় অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। এ এক আশ্চর্য ব্যাধি হয়েছে ইন্দ্রাণীর। শুভাশিস এলেও পাঁচ মিনিট তার সঙ্গে ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলতে পারে না, কারণে অকারণে তর্ক বেধে যায়, আবার সে না এলেও মনটা কেমন হু হু করতে থাকে। শুন্য লাগে সব কিছু।
চটপট খাওয়া শেষ করে ইন্দ্রাণী হেডমিস্ট্রেসের ঘরে গেল। চেয়ার টেনে বসে খামটা ছুঁড়ল টেবিলে, –এটা কী?
নীলিমা কতগুলো বিল পরীক্ষা করছিলেন। একবার চোখ তুলে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়েছেন, –পড়োনি?
পড়েছি বলেই তো আসা।
উত্তর দিয়ে দাও, তুমি তো ইংরিজি ভাল লেখ।
–আমি জানতে চাই এর মানে কী! আপনারা আমার ন্যায্য চিঠির উত্তর দেবেন না…
–তুমি ঠিক বলছ না ইন্দ্রাণী। চিঠিটা আমি দিইনি, ম্যানেজিং কমিটি দিয়েছে।
–ওই হল। আপনিও তাদের একজন।
নীলিমা বিলগুলো সরিয়ে রাখলেন, হ্যাঁ একজন। আমিও তোমার চিঠির ল্যাঙ্গুয়েজে খুশি নই। তোমার জানা উচিত অথরিটিকে ওই ভাষায় চিঠি লেখা যায় না।
কিন্তু অথরিটি আমার লেজিটিমেট ডিম্যান্ডকে ইগনোর করতে পারে, তাই তো? আমার সার্ভিস বুক আজ পর্যন্ত ঠিক করা হল না, সেটা অন্যায় নয়?
–তোমার সার্ভিস বুক সময় মতোই ঠিক করা হবে। যদি প্রয়োজন হয়। তুমি তো আর এক্ষুনি রিটায়ার করছ না।
-বাহ্, চমৎকার যুক্তি! ইন্দ্রাণীর গলায় শ্লেষ, তা এই চিঠি নিয়ে আমাকে কী করতে হবে?
বললাম তো, উত্তর দিয়ে দাও। মাথা গরম কোরো না, দু লাইনে সরি লিখে দাও, সব মিটে যাবে।
–আর যদি আমি দুঃখপ্রকাশ না করি? সত্যিই তো আমি দুঃখিত নই। আপনাদের ইনএফিসিয়েন্সির জন্য আমি দুঃখিত কেন হতে যাব?
–সেটাই তাহলে কমিটিকে জানিয়ে দাও। তারপর কমিটি যা করার করবে।
কী করবে? আমার চাকরি খাবে?
–সেটাও ম্যানেজিং কমিটির ডিসিশান। তবে তুমি ক্ষমা চেয়ে নিলে গোড়াতেই মিটে যায়।
–বুঝেছি। ইন্দ্রাণী গটমট করে উঠে চলে এল।
টিচার্স রুমে ঢুকে কমলিকার সামনে আবার চিঠিটা ছুঁড়ে দিল ইন্দ্রাণী।
কমলিকা হকচকিয়ে গেছে। ইন্দ্রাণী স্কুলে শান্তই থাকে, তাকে এমন রুদ্রমূর্তিতে কমলিকা দেখেনি কোনওদিন। বলল, কী হয়েছে?
–চিঠিটা পড়। পড়লেই বুঝবি। এতদিন ধরে সিনসিয়ারলি পড়াচ্ছি, ছুটি নিই না, ক্লাস ফাঁকি দিই না, তার জন্য স্কুল কমিটি আমাকে পুরস্কার দিয়েছে!
চিঠি পড়ে কমলিকাও খেপে গেছে, এ কী অন্যায় কথা! আমরা কি কারুর খাসতালুকের প্রজা যে সব সময়ে পা চেটে কথা বলতে হবে?
–সে তোরাই বল। আমি কি কারুর দয়ায় চাকরি পেয়েছিলাম? নীলিমাদি আবার বলে ক্ষমা চাও!
কমলিকা ঘুরে ঘুরে অন্য শিক্ষিকাদের দেখাচ্ছে চিঠিটা। ঘণ্টা পড়ে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে ইন্দ্রাণী ছুটেছে ক্লাসে।
ছুটির পর জোর গজল্লা বাধল টিচার্স রুমে। এর মধ্যেই শিক্ষিকারা দুই শিবিরে ভাগ হয়ে গেছে। এক দল, তারাই সংখ্যায় ভারী, বলছে ইন্দ্রাণী যদি দুঃখপ্রকাশ করলে ঝামেলা মিটে যায় তবে তার তাই করা উচিত। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিবাদে গিয়ে কী লাভ! কমলিকা আর অল্প কয়েকজন চাইছে ইন্দ্রাণী যেন একচুলও পিছিয়ে না আসে। আরও কড়া ভাষায় উত্তর দিক শো কজের। বেগড়বাই দেখলে উকিলের চিঠি ধরিয়ে দিক কমিটিকে।
আগুন মাথায় বাড়ি ফিরল ইন্দ্রাণী। আধ ঘণ্টা ধরে শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়েও এতটুকু শীতল হল না মস্তিষ্ক। খেতে ভাল লাগল না, বিনা কারণে সন্ধ্যার মাকে মুখ করল খানিক। ঘরে এসে চিঠির মুসাবিদা করতে বসল। একটা জবরদস্ত জবাব দিতে হবে।
চিঠি লিখছে, আর কাটছে। লিখছে, আর কাটছে। কিছুতেই আর মনোমত উত্তর হচ্ছে না। চিঠির ভাষা আরও কড়া হতে হবে, কিন্তু যেন অভব্য না হয়ে যায়। যেন কেউ কোনও ফাঁক না ধরতে পারে।
হচ্ছে না। হচ্ছে না। একগাদা কাগজ কুটি কুটি করে ছিঁড়ল ইন্দ্রাণী। দুম দুম করে দুটো ঘরেরই জানলা বন্ধ করল। নেমে এল প্রেসঘরে।
দুই কম্পোজিটার টাইপ সেট করে চলেছে। উল্টোদিকের টুলে বসে আছে মিনতি। দরজার দিকে পিছন ফিরে কথা বলছে। দুর্লভের মেশিন চলছে একটানা।
ইন্দ্রাণী মিনতিকে ধমক দিল, তুই কী করছিস এখানে?
মিনতি অলস ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল, এই তো একটু বসে আছি। বাসন-কোসন মাজা হল…
-তোকে বলেছি না, এখানে যখন তখন আসবি না? লোকের কাজে ব্যাঘাত হয়।
–আমি তো চুপ করে বসে আছি। মেশিনদাদুকে জিজ্ঞেস করো না…
–ঠিক আছে, ভেতরে যা। বাবা বোধহয় শোবেন, মশারিটা টাঙিয়ে দে গে যা। বড্ড মশা বেড়েছে।
মিনতির খুব একটা তাপ-উত্তাপ দেখা গেল না। গ্যারাজ ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে শরীর মোচড়াচ্ছে, উনি এখন শোবে না। ছোড়দার সঙ্গে কথা বলছে। বলতে বলতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যাচ্ছে মিনতি।
চাঁদু কি আজও বেরোয়নি! দিল্লি থেকে ফিরে একদিন কোথায় গেল, ফিরল সেই রাত দশটায়। তারপর থেকে কদিন শুধু শুয়েই আছে বাড়িতে। কাজকর্ম কি ঘুচে গেল চাঁদুর!
কোণে এক সেট চেয়ার টেবিল রাখা আছে। অফিস কাম প্রুফ দেখার জায়গা। ইন্দ্রাণী বসল।
বসেই প্রশ্ন ছুঁড়েছে, দুর্লভবাবু, সানশাইনের জবটা ডেলিভারি দিয়ে এসেছেন?
দুর্লভ মেশিন থেকে চোখ সরাল না, কালই দিয়ে এসেছি বউদি।
কবে পেমেন্ট দেবে বলল?
–যেমন দেয়। সাত দিনে।
মনে করে নিয়ে আসবেন। ভুলবেন না।
–আমি তো ভুলি না বউদি।
ইন্দ্রাণী কিছু বলতে পারল না। শুভাশিসের পরিচিত জায়গাগুলোতে অর্ডার ডেলিভারি পেমেন্টের জন্য ইন্দ্রাণী কখনও যায় না, দুর্লভকেই পাঠায়। বরাবরই যথাসময়ে টাকা আনে দুর্লভ, কোনওদিনই ভুলচুক হয় না। কাজটা দুর্লভের নয়, এর জন্য কোনও অতিরিক্ত টাকাও পায় না সে, তবু দায়িত্ব নিয়েই করে। তাকে কী বলবে ইন্দ্রাণী!
কিন্তু মন মানতে চাইছে না আজ। ইন্দ্রাণীর ভেতরের পুঞ্জীভূত ক্রোধ আছড়ে পড়তে চাইছে কোথাও। এতে যদি শান্ত হয় ভেতরটা।
কম্পোজিটরদের ধরল ইন্দ্রাণী–কর ব্রাদার্সের ম্যাটার রেডি হয়ে গেছে?
–ওই তো প্রুফ তোলা আছে টেবিলে।
–আর কারা যেন শ্রাদ্ধের কার্ড ছাপতে দিয়ে গিয়েছিল?
–এই তো খানিক আগে ডেলিভারি নিয়ে গেল।
হুঁ। ইন্দ্রাণী অসহায় মুখে প্রুফ খুলে বসল। পেনসিল দিয়ে চেপে চেপে সংশোধন করছে। যেন টাইপে নয়, নীলিমার মুখেই পেনসিলের আঁচড় টানছে। হঠাই রুনার গলা শুনে চমকে তাকাল।
–দিদি, ও দিদি, এক্ষুনি এসো। তোমার ফোন।
ইন্দ্রাণী ভীষণ অবাক হল। রুনা তো কক্ষনও প্রেসঘরে আসে না। তাদের মধ্যে বাক্যালাপও আজকাল কমই হয়, খুব প্রয়োজন না হলে রুনা কথাই বলে না। ফোন এলেও মিনতিকে দিয়ে খবর পাঠায়। ঘুম ভাঙা চোখে রুনা ছুটে এসেছে কেন!
এক সেকেন্ডের লক্ষ ভগ্নাংশে কথাগুলো ভেবে নিল ইন্দ্রাণী। সঙ্গে সঙ্গে একটা উদ্বেগও ফুটে উঠেছে গলায়। অজান্তেই।
কার ফোন?
–তোমার মার। তোমার বাবাকে পাওয়া যাচ্ছে না।
উদভ্রান্তের মতো দৌড়েছে ইন্দ্রাণী। সিঁড়িতে উঠতে গিয়ে পায়ে পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছিল শাড়ি, রেলিঙ ধরে পতন আটকাল। অসাড় হাতে রিসিভার তুলেছে, কী হয়েছে?
–তোর বাবা সেই সকাল সাতটায় বেরিয়েছে, এখনও ফেরেনি। উমার গলা কান্নায় ভেঙে পড়েছে, আমি এখন কী করব ইনু?
নেহাইয়ের বাড়ি পড়ল ইন্দ্রাণীর মাথায়। মস্তিষ্কের সমস্ত কোষ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল যেন। আজই তো উনত্রিশে অগাস্ট! তনুর নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার দিন।
আজকের দিনটাকে কী করে ভুলে গেল ইন্দ্রাণী। এত বড় ভুল!
হাতের সাড়হীনতা ছড়িয়ে গেছে গলায়, কেউ খুঁজতে বেরিয়েছে?
কাকে বলব? দিলুও তো এখন অফিসে। আমি টুনুদের বাড়ি থেকে…
তুমি চিন্তা কোরো না। আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।
ফোনটা যেন হাত থেকে পড়ে গেল ক্রেডলে।
রুনা নীচে কন্দর্পকেও বলেছে, রুনার সঙ্গে কন্দর্পও এসেছে দোতলায়। উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করল, কখন থেকে…?
ইন্দ্রাণীর স্বর ফুটল না।
কন্দর্প বলল, চলো, আমি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি।
প্রাথমিক বিবশতা কাটিয়ে শক্ত হওয়ার চেষ্টা করল ইন্দ্রাণী। বেরোনোর আগে রুনাকে বলল, তিতির বাপ্পা ফিরলে বাড়িতে থাকতে বলিস। আর ও যদি আসে, ওকে এক্ষুনি ও বাড়ি চলে যেতে বলবি।
ইন্দ্রাণী কি একবার শুভাশিসকে ফোন করবে এ সময়ে? কোথায় করবে? এখনও তো শুভাশিসের চেম্বারের সময় হয়নি, হয়তো কোনও নার্সিংহোমে আছে।
শুভটা সঙ্গে থাকলে একটু সাহস পাওয়া যেত।
ইন্দ্রাণী কী শুভাশিসের বাড়িতে ফোন করবে একবার? থাক, ছন্দা আবার কি মনে করে।
কন্দর্প স্কুটার নেয়নি, ট্যাক্সি ডেকে এনেছে। ইন্দ্রাণী পড়িমরি করে উঠে পড়ল।
ট্যাক্সি যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। পথ আর ফুরোয় না। এক একটা সিগনালে ট্যাক্সিটা বুঝি বছরের পর বছর দাঁড়িয়ে থাকছে। ঢাকুরিয়া থেকে মানিকতলা কি এত দূর! এ যেন অ্যান্টার্কটিকা থেকে আলাস্কায় পাড়ি দেওয়া!
তনুময় নিরুদ্দেশ হওয়ার দিনটা বরাবরই খুব খারাপ যায়। প্রথম তিন-চার বছর উমা অসুস্থ হয়ে পড়তেন, ইন্দ্রাণী শুয়ে থাকত বিছানায়, ধীরাজও সারাদিন নিঝুম। একবার তো উমার বেশ বাড়াবাড়িই হয়ে গিয়েছিল। সকাল থেকে বুকে ব্যথা, নিশ্বাসের কষ্ট, বিকেলে প্রায় এখন তখন অবস্থা। আদিত্য খবর পেয়ে হাঁকপাক করে ছুটেছিল শ্বশুরবাড়ি, শুভাশিসও চেম্বার ফেলে উপস্থিত। অক্সিজেন ইনজেকশান দিয়ে কোনওক্রমে সামলানো গিয়েছিল উমাকে। জয়মোহন-শোভনাও অনেক রাত অবধি বসেছিলেন বেয়াই বেয়ানের কাছে। তাঁদেরও খুব প্রিয় ছিল তনুময়।
তবে সময় স্মৃতিকে বিবর্ণ করে দেয়। ধীরে ধীরে দিনটাকেই ভুলে গেল সবাই।
শুধু তিনজন ছাড়া।
যাদের হৃদয় শূন্য করে চলে গেছে তনুময়, সেই দুজন। আর ইন্দ্রাণী।
উমা অবশ্য একটু একটু করে সামলে নিয়েছেন নিজেকে। অনেক গভীর শোকও মেয়েরা আত্মস্থ করে নিতে পারে। হাহাকার থাকে, আগুন জ্বলে, তবু সব বুকে নিয়েই তারা সংসারের চাকাটাকে গড়িয়ে নিয়ে যায়। এই দিনটিতে উমা এখন রোজকার মতোই রাঁধাবাড়া করেন, ঠিকে ঝি সামলান, জল ভরেন, খবরের কাগজ উল্টোন, ভুলেও ছেলের নাম উচ্চারণ করেন না। কিন্তু ধীরাজ! এই দিনটিতে তিনি ছোটখাট দুর্ঘটনা ঘটাবেনই। একবার বাথরুমে পড়ে মাথা ফাটালেন, একবার খাটের কোণে ঠোক্কর খেয়ে জোর চোট লাগল, সেবার তো প্রায় বাসের নীচে পড়ছিলেন, পাড়ার এক কিশোর তাঁকে হাত ধরে টেনে না নিলে হয়তো সর্বনাশই ঘটে যেত। ইন্দ্রাণীও এই দিনটিতে কাঁটা হয়ে থাকে। স্কুল থেকে সোজা চলে যায় মানিকতলা। দুপুর সন্ধেটা কাটিয়ে রাত করে বাড়ি ফেরে। তিনজন একত্রে পরস্পরের অস্তিত্ব খুঁয়ে পার করে দেয় দিনটা। চাপা এক শূন্যতার মধ্য দিয়ে।
এবারে ইন্দ্রাণীই দিনটাকে ভুলে গেল!
অথচ কদিন আগেও কথাটা মনে ছিল। গত সপ্তাহে তিতিরকে নিয়ে গিয়েছিল মানিকতলায়, সেদিনও কথায় কথায় উমাকে বলেছিল, আজ যাবে। তবু ভুলল!
ইন্দ্রাণীর এখন কান্নাও শুকিয়ে গেছে। তার এক অপরাধে চলে গেল তনু, আজ আর এক ভুলে কি বাবাকে হারাবে?
উমাকে ঘিরে বসে আছে পাড়ার মহিলারা। এ পাড়া এখনও সম্পূর্ণ আধুনিক হয়নি, পাড়াপ্রতিবেশীরা পরস্পরের খবর রাখে। উমা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। তাঁর সামনে দুই যুবক অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে। ছেলে দুটো গোটা তল্লাট খুঁজে এসেছে, ধীরাজ কোথাও নেই।
ইন্দ্রাণী বসল না। কন্দর্পই বসতে দিল না তাকে। ধীরাজের কয়েকটা ছবি নিয়ে দুজনে ছুটল থানায়। নাম ধাম লিখিয়ে ডায়েরি করল, খুব একটা আশার বাণী শুনল না। শুধু ঘণ্টা কয়েক পরে আর একবার খবর নিয়ে যেতে বলল তাদের।
থানা থেকে বেরিয়ে ইন্দ্রাণী বলল, এবার আমরা কী করব?
কন্দর্প কি যেন ভাবছিল। আড়ষ্ট গলায় বলল, আমার মনে হয় একবার কাছাকাছি হাসপাতালগুলোতে খবর নেওয়া উচিত। মেসোমশাই বেখেয়াল মানুষ, যদি কিছু…
ইন্দ্রাণী ফ্যাকাসে হাসল। হাসি, না কান্না ঠিক বোঝা গেল না। বলল, চলো।
মাঝে কদিন হাওয়া দিচ্ছিল, আজ এতটুকু বাতাস নেই। ভাদ্রের গুমোটে ছটফট করছে শহর। সূর্য পশ্চিম আকাশের প্রান্তসীমায়, তবু যেন তাকে বড় বেশি তপ্ত লাগছে আজ। এখনও।
শ্যামবাজারের আর জি কর হাসপাতালে সন্ধান না পেয়ে শেয়ালদার নীলরতন হাসপাতালে গেল ইন্দ্রাণী আর কন্দর্প। সেখানেও আঁতিপাঁতি খুঁজল, নেই।
শেয়ালদা স্টেশনের পাশ দিয়ে হাঁটছিল দুজনে। ক্লান্ত পায়ে। অফিস ছুটির ভিড়ে রাস্তায় গাদাগাদি অবস্থা। মানুষ ঠেলে এগোতে গিয়ে আরও দ্রুত শ্রান্ত হচ্ছিল ইন্দ্রাণী।
কন্দর্প আপন মনে বলল, আর কোথায় যেতে পারেন বলো তো? ধর্মসভা হরিসভায় যান না তো? তাহলে এই পার্কগুলো একবার ঘুরে দেখা যায়।
তা কি করে হয়! বাবাকে তো কখনও… অভ্যেস বলতে তো একটাই। নিরুদ্দেশের খবর পড়া, আর নিরুদ্দেশের ছবি দেখা! লালবাজারের ক্রাইম ব্রাঞ্চে তোমার কে একজন বন্ধু আছে বলেছিলে না, সে কিছু করতে পারবে?
হুঁ। ওর অবশ্য অনেক হোন্ড আছে। হঠাই ইন্দ্রাণীর হাত চেপে ধরেছে কন্দর্প, আচ্ছা, মেসোমশাইয়ের খুব নিরুদ্দেশের ছবি দেখার অভ্যেস বলছিলে না?
–হ্যাঁ। ওই একটাই তো নেশা। যেন ওর জন্যই বাবার বেঁচে থাকা। কিন্তু তুমি এ কথা জিজ্ঞেস করছ কেন?
এক সেকেন্ড দাঁড়াও এখানে। আমি আসছি। বলেই হাত ছাড়িয়ে কন্দর্প ছুটেছে স্টেশন চত্বরের দিকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রায় উড়তে উড়তে ফিরল।
ধীরাজকে পাওয়া গেছে। জি আর পি অফিসে বসে আছেন ধীরাজ।
ইন্দ্রাণীকে দেখে ধীরাজ শিশুর মতো কেঁদে উঠলেন, আমি তনুর খোঁজ করতে এসেছিলাম, এরা আমাকে আটকে রেখেছে।
রেলপুলিশের লোকজনের কথা থেকে জানা গেল ঘটনাটা। রেলের বিভিন্ন স্টেশনে যে সব অজ্ঞাতপরিচয় লাশ পড়ে থাকে, অথবা যারা ট্রেনে কাটা পড়ে, তাদের অনেকেরই ছবি টাঙানো থাকে স্টেশনে। সেই ছবিগুলোর সামনে ঘুরছিলেন ধীরাজ, হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যান, ভাগ্যক্রমে বিশেষ চোট লাগেনি, রেলপুলিশের লোকেরাই তাঁকে ধরাধরি করে তুলে নিয়ে আসে। জ্ঞান ফেরার পর ধীরাজ শুধু নাম বলতে পেরেছেন, কিন্তু ঠিকানাটা এক একবার এক একরকম বলে যাচ্ছেন। রেলপুলিশের লোকরা সাহস করে ছাড়তে পারেনি তাঁকে, মেসেজ পাঠিয়েছে লালবাজারে।
ইন্দ্রাণী প্রকাশ্যেই কেঁদে ফেলল। কিছুটা আনন্দে, কিছুটা এক গোপন অনুশোচনায়।
তনুকে কি বাকি জীবনটা এভাবেই খুঁজে যাবে বাবা?
.
মাথাটা ছিঁড়ে পড়ছিল ইন্দ্রাণীর।
রাত এখন গভীর। একটু আগে স্টেশন মাড়িয়ে শেষ ট্রেনটাও চলে গেল। অনেক রাত অবধি এ ঘর সরগরম ছিল আজ। আদিত্য সুদীপ রুনা কন্দর্প বাপ্পা কে ছিল না। তারাও এখন যে যার বিছানায়। সুদীপদের ঘর থেকে অন্য দিন বহুক্ষণ কথাবার্তার শব্দ শোনা যায়, আজ সে ঘর নিঃসাড়। পাশের ফ্ল্যাটবাড়িতে বোধহয় ভিডিও চলছিল, হঠাৎ ঝংকার বন্ধ হওয়ার পর সম্পূর্ণ শব্দহীন হয়ে গেছে চতুর্দিক।
একটি শব্দই শুধু শুনতে পাচ্ছে ইন্দ্রাণী। নিজেরই হৃৎপিণ্ডের লাবডুব। শব্দটা প্রতি মুহূর্তে আরও উচ্চগ্রামে উঠে মস্তিষ্কে টংকার হানছে।
কেন সে ভুলে গেল আজকের দিনটা! স্কুলের অশান্তির জন্য? মিথ্যে কথা। তারই মনের ভেতর থেকে অন্য একটা মন জোর করে ভুলিয়ে দিতে চাইছে তার পাপবোধটাকে। যে বল্লমের খোঁচায় সে প্রতিদিন রক্তাক্ত হয়, তার ফলাটাকে ভোঁতা করে দিতে চায় কোন শক্তি?
পর পর ছবিগুলো দেখতে পাচ্ছে ইন্দ্রাণী। ঘর জুড়ে নিকষ অন্ধকার, তাই কি ছবি এত স্পষ্ট?
.. তনুময়কে দেখে ইন্দ্রাণী বেরিয়ে আসছে শুভাশিসের ফ্ল্যাট থেকে। দু বছরের বাপ্পাকে বুকের কাছে নিয়ে রাত জাগছে। এ কোন পরীক্ষায় পড়ল সে? যাকে সে পাগলের মতো চেয়েছিল, তাকে পেল না। যাকে পেয়েছে, তাকে সে এতটুকু চায় না। প্রার্থিত পুরুষ আবার ফিরে এসেছে। এখন সে কী করে? পরদিন আবার গেল। পরদিন আবার। কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছে প্রতিরোধের বর্ম। শুভাশিস ইন্দ্রাণীকে ফেলে চলে গেছে, শুভাশিস ছন্দাকে বিয়ে করেছে, এর পর আর তো ইন্দ্রাণীর কামনা থাকার কথা নয়! তবু বাসনা জ্বলে উঠল দাউ দাউ।
পাশের ঘরে শুয়ে আছে তনুময়, এ ঘরে মিলিত হচ্ছে নারীপুরুষ। সংযম ভুলে। সংসার ভুলে। রাত্রি দিন এক হয়ে গেল। পরপর দু রাত ঘরে ফেরা হল না ইন্দ্রাণীর।
দ্বিতীয় রাতে ইন্দ্রাণী ধরা পড়ে গেল। তনুময়ের তখনও কাঁধের ক্ষতটা ভাল করে শুকোয়নি ঘুমের ওষুধে আচ্ছন্ন পাশের ঘরে। হঠাৎ কী করে যে উঠে এল! কাচের জানলায় চোখ চেপে দেখছে দিদিকে। বিস্মিত চোখ চকিতে ঘৃণায় ভরে গেছে। শুভাশিসকে ঠেলে সরিয়ে ইন্দ্রাণী ছিটকে উঠে বসল বিছানায়। আবরণহীন, অশক্ত ইন্দ্রাণী।..
তিতির অকাতরে ঘুমোচ্ছে। তার নিশ্বাসের উষ্ণ বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে ইন্দ্রাণীর কাঁধ।
ওই মেয়ে কে?
ইন্দ্রাণীর লোভের ফসল?
ইন্দ্রাণীর প্রেমের ফসল?
ইন্দ্রাণীর চোখ ক্রূর হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। দু হাতে মাথা চেপে উঠে বসল। চোখের মণি শ্বাপদের মতো জ্বলছে।
শেষ হয়ে যাক সব কিছু। নিশ্চিহ্ন হোক ইন্দ্রাণীর পাপ।
তিতিরের গলায় হাত রাখল ইন্দ্রাণী। আর একটু চাপ… আর একটু চাপ…
.
২৩.
অরূপ বলল, – নিবি নাকি আর একটা?
শুভাশিস সোফায় শরীর ছেড়ে দিয়েছে। বলল, দে। ছোট করে। গায়ের ব্যথাটা মরুক।
অরূপ শুভাশিসের গ্লাসে অল্প সোনালি পানীয় ঢালল, রিয়েলি, নার্সিংহোম তৈরির এত হ্যাপা কে জানত! মুখে রক্ত উঠে গেল মাইরি।
শুভাশিস বোতল থেকে ঠাণ্ডা জল মেশাচ্ছে সুরায়। নিঃশব্দে চুমুক দিল। একটা প্রতিষ্ঠান গড়ার পিছনে কত যে খুঁটিনাটি থাকে, কাজে না নামলে বোঝাই যায় না। জরাজীর্ণ বাড়ির অন্দর ঝকঝকে করে তোলা, গাদা গাদা ফার্নিচার কেনা, মাপমতো পার্টিশান তুলে ডাক্তারদের চেম্বার নার্স রুগীদের কেবিন বানানো, একটা আধুনিক অপারেশন থিয়েটার গড়ে তোলা, প্যাথলজিকাল ল্যাবরেটরির সাজসরঞ্জামের বন্দোবস্ত, স্বাস্থ্যসম্মত রান্নাঘর তৈরি, যথেষ্টসংখ্যক বাথরুমের ব্যবস্থা রাখা, এসব কি মুখের কথা! এর সঙ্গে আছে কাঁড়ি কাঁড়ি সরকারি লাইসেন্স, এখানকার ছাড়পত্র, ওখানকার শংসাপত্র, আরও কত কি!
শুভাশিসরা তিনজনই যে শুধু লোকবল তা নয়, কাজকর্ম তত্ত্বাবধানের জন্য কর্মীও নেওয়া হয়েছে কয়েকজন। বেছেবুছে, বেশি টাকার টোপ দিয়ে, অন্য নার্সিংহোম থেকে ভাঙিয়ে আনা হয়েছে তাদের। এরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল অভিজ্ঞ এবং বিশ্বস্ত। অর্থাৎ খুঁতখুঁতে, নার্সিংহোম লাইনের ঘাঁতঘোত জানা, এবং চুরিচামারিটা কমই করে। তবু নিজেদের একটা পেশাদারি নজর রাখতেই হয় শুভাশিসদের। রাজসূয় যজ্ঞ বলে কথা!
তা শুভাশিসরা রাখছেও। তিনজনেই। রুগী চেম্বার আর অপারেশানের ফাঁকে ফাঁকে যে যেমন সময় পায়। নতুন নার্সিংহোমের নাম শালিনীই দিয়েছে। স্যাস ক্লিনিক। শুভাশিস অরূপ শালিনী তিনজনের নামের আদ্যক্ষর নিয়ে নাম। নামটা প্রথমে খুব পছন্দ ছিল না শুভাশিসের। তার ইচ্ছে ছিল কিওর হোম, এরকম ধরনের কিছু নাম দেওয়ার। শালিনী অরূপের স্যাসই বেশি পছন্দ। পার্টনারশিপের কাগজপত্র তৈরি করেছে অরূপ। শালিনী আর অরূপের ষাট পারসেন্ট, শুভাশিসের ভাগ চল্লিশ। সেই অনুপাতেই টাকা ঢালছে তিনজন।
এখন চলছে মেট্রন, ডায়েটিশিয়ান, কিপার, সুপারভাইজার, কেমিস্ট আর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স নিয়োগের পালা। আজ নিয়ে পর পর তিন রবিবার বিকেলে ইন্টারভিউ চলল। নার্সিংহোমেরই অফিসে। আজ ইন্টারভিউয়ের পর সন্ধেবেলা শুভাশিসের একটু ঢাকুরিয়ায় যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, হল না। অটোক্লেভ আর বয়েলস্ অ্যাপারেটাস্ আজই কোম্পানি থেকে ডেলিভারি এসেছে, সে দুটোকে পরীক্ষা করতে গিয়ে সন্ধে গড়িয়ে গেল। তারপর অরূপ প্রায় জোর করে ধরে নিয়ে এল বাড়িতে। প্রতিদিন বেশ কিছুক্ষণ নার্সিংহোম নিয়ে আলোচনা না করলে অরূপের দিনটাই বৃথা গেল মনে হয়।
কর্মী পুরুষরা কাজের আলোচনার চেয়ে কাজকেই বেশি ভালবাসে, তবু শুভাশিস এই সব মুহূর্তে অরূপদের সঙ্গ বেশ উপভোগই করে। সেন্টার টেবিলের কাছে পা তুলে দিল শুভাশিস, শালিনী কোথায় রে, শালিনী? আমরা খেটেখুটে এসে বসে আছি, মেমসাহেবের এখনও দর্শন নেই কেন?
অরূপ চোখ তটস্থ করে পিছন ফিরে দেখল একবার। সামান্য গলা নামাল, পিপিকে পড়াচ্ছে। কাল থেকে পিপির ফার্স্ট টার্মিনাল। শালিনী পড়াচ্ছে! পিপির টিউটর নেই?
–আছে। তবু মেয়েকে নিজে না পড়ালে শালুর তৃপ্তি হয় না।
–মেয়েদের যে কতরকম বাতিক থাকে।
–শালু ইজ আ ভেরি সিরিয়াস মাদার। আই মিন সেন্সেটিভ।
–আজকাল কোন মা তা নয় রে ভাই? কথাটা বলেই পলকের জন্য মনোরমার মুখটা মনে পড়ল শুভাশিসের। এখনকার মুখ নয়, যৌবনের মুখ। একটু বিষণ্ণ ভাব দুলে গেল বুকে। বিষাদটুকু ঝেড়ে ফেলে বলল, এই ছন্দাকেই দ্যাখ না। টোটোর ব্যাপারে ভালমন্দ কিছু বলতে যাই, হাঁ হাঁ করে তেড়ে উঠবে!
শালিনী দরজার পর্দা সরিয়ে উঁকি দিচ্ছে–অ্যাই, আমাকে নিয়ে কী ডিসকাশন হচ্ছে শুনি? জরুর অরূপ কিছু বদনাম করছে?
কী কান রে! শুভাশিস এক ঢোঁকে গ্লাস শেষ করল, তুমি মেয়েকে পড়াচ্ছ, না এদিকে কান পেতে আছ?
–মেয়েদের নাক কান একটু শার্পই হয় ডক্টর। দাঁড়াও, আমি আসছি। মেয়েকে বোধ হয় বইতে বসিয়ে মিনিট পাঁচেক পর ফিরল শালিনী। সোফায় বসতে গিয়েও ফিরে গিয়ে মেয়ের ঘরের দরজা টেনে বন্ধ করে দিয়েছে, কেন শার্প হয় জানো?
জানি। মেয়েদের অন্য ইনসটিংক্টগুলো ভোঁতা হয় বলে।
–নো স্যার। মেয়েদের একটা ডগস্ ইনসটিংক্ট থাকে। রাদার বিচেস ইনসটিংক্ট। আমরা গন্ধ শুঁকে অনেক কিছু বুঝে নিতে পারি।
–ইজ ইট?
–নিশ্চয়ই। তোমার গন্ধ শুঁকেও অনেক কিছু বলা যায়।
–যেমন?
–যেমন… চোখ বুজে একটা লম্বা শ্বাস টানল শালিনী, যেমন ধরো, তোমার সঙ্গে এখন ছন্দার রিলেশানটা খুব স্টেল।
শুভাশিস হাসার চেষ্টা করল, বিয়ের সতেরো বছর পর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যে দরকচা মেরে যায়, এটা বলার জন্য গন্ধ শোঁকার দরকার হয় না ভাই।
দরকচা? শালিনী অরূপের দিকে তাকাল, হোয়াট ডাজ ইট মিন?
অরূপ হাসছে, ওই তুমি যা বললে তাই। স্টেল। নীরস।
দরকচা শব্দটাকে বিড়বিড় করে বার কয়েক আউড়ে মেমারি ব্যাঙ্কে জমা করল শালিনী। তারপর বলল, আরও কিছু শুনতে চাও? তোমাদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা প্রায় ননএগজিস্টেন্ট। তোমাদের ফিজিকাল রিলেশান ভীষণ অনিয়মিত। অ্যাট লিস্ট দেড়-দু মাসের মধ্যে ইউ ডিডনট হ্যাভ ইট।
সপাটে যেন চড় খেয়েছে শুভাশিস। মুহূর্তে মুখ লাল হয়ে উঠেছে তার। প্রায় তোতলানো স্বরে বলল, বাজে কথা। তুমি কিছু বলতে পারো না।
–তুমি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো আমি ভুল বলেছি?
শুভাশিস অসহায়ের মতো পকেটে সিগারেট হাতড়াচ্ছে। তিন-চারবার লাইটার জ্বালিয়েও ধরাতে পারল না সিগারেট। আড়চোখে ফ্যানের দিকে তাকাল। ছন্দার সঙ্গে শালিনীর তো তেমন কিছু সখিত্ব নেই, শালিনী এ কথা বলছে কী করে! ষষ্ঠ অনুভূতি থেকে? অনাবশ্যক গম্ভীর স্বরে শুভাশিস বলল, যত সব ফালতু কথা। সারাদিন দৌড়ঝাঁপ করে এলাম, কোথায় নার্সিংহোমের কথা জিজ্ঞেস করবে, তা না ছুটির দিন শুয়ে বসে শুধু অলস কল্পনা।
শালিনী কয়েক পলক স্থির নেত্রে দেখল শুভাশিসকে। তারপর চোখে কৌতুক ফুটিয়ে বলল, –তোমার কি ধারণা ছুটির দিনটা আমার খুব আরামের দিন?
প্রসঙ্গ বদলে যাওয়াতে ভাদ্রের গরমও সুশীতল মনে হল শুভাশিসের। ঝুপ করে অনেকটা সহজ হয়ে গেল, নয় তো কি! শ্যাম্পু করে চুল ফাঁপিয়েছে, নাক মুখ চোখ চকচক করছে, পার্লার ফার্লারে গিয়েছিলে নাকি?
এগেইন রঙ। ছুটির দিনে আমার প্রধান কাজ কি জানো? তোমার বন্ধুর জন্য রান্না করা। তোমার বন্ধু ছুটির দিন কাজের লোকের কুক করা ফুড খান না। তারপর সেকেন্ড কাজ এই বিশাল ফ্ল্যাট ডাস্টিং ক্লিনিং। তোমার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করে দেখো তো, আজ পর্যন্ত কোনও টেবলের ধুলো টোকা দিয়ে রিমুভ করেছে কি না।
অরূপ বলল, এই শালু, তুমি কিন্তু ঠিক বলছ না। আমি আজ সকালে আমার বুকসেলফটা পরিষ্কার করেছি।
কত মাস পর?
–তা হবে দু-চার মাস।
–ফির লাই। মিনিমাম এক সাল বাদ। কেন করেছ, সেটাও বলো।
অরূপ অপ্রতিভ মুখে হাসছে।
শালিনী বলল, ও বলবে না। পুরনো কয়েকটা ম্যাগাজিন আছে সেলফে, যাতে ওর নিজের পোয়েমস বেরিয়েছিল কলেজ লাইফে, সেগুলো পোকায় কাটছিল। নিজের জিনিস ছাড়া তোমরা কিচ্ছু বোঝ না।
শুভাশিস হেসে উঠেছে, তোর বউ দেখছি হেভি ফেমিনিস্ট হয়ে গেছে রে!
শালিনী গাল ফোলাল, হাঁ, সহি বাত বললেই আমরা ফেমিনিস্ট হয়ে যাই! আসল কথা কি জানো, আমরা মেয়েরা যতই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আই এ এস, আই পি এস, কি প্রাইম মিনিস্টারই হই, ইউ পিপল, তোমরা সবসময়ে আমাদের কাছ থেকে সেবা চাও। ইউ এনজয় ইট। এই ফিউডালিটিটা, হু এভার ইউ মে বি, তোমাদের রক্তের মধ্যে রয়ে গেছে। তোমাদের বউরা তোমাদের সমান কোয়ালিফায়েড হোক, কি না হোক, কিংবা জাদাই হোক, তারা বাইরে খেটে-খেটে বহুত রুপিয়া কামিয়ে আনুক, চাই না আনুক, তোমরা কখনও ঘরের কাজে তাদের সঙ্গে হাত বাঁটবে না। তোমাদের মেল ইগো তাহলেই শ্যাটার্ড হয়ে যাবে। ইস মামলে মে আমার মারাঠি বাবাও যা, আমার বাঙালি হাজব্যান্ডও তাই।
শুভাশিসের হাসি বাড়ল, কথাটা ভুল বলোনি। কিন্তু ম্যাডাম, তোমরাই বা করো কেন? তোমরাই তো আমাদের অভ্যেস খারাপ করে দিয়েছ।
করি, বিকজ আমরা ঘরকে ভালবাসি। জঙ্গলের মানুষকে মেয়েরাই প্রথম ঘর দেখিয়েছে। ঘরের কসেপ্টটাই মেয়েদের। কিন্তু তোমাদের এখনও ঘরের প্রতি সেই অ্যাট্রাকশান তৈরি হয়নি।
অরূপ মিনমিন প্রতিবাদ জানাল এবার, তার মানে তুমি বলতে চাও আমার এই সংসারটার ওপর কোনও টান নেই? তোমার ওপর টান নেই? পিপির ওপর টান নেই?
থাকবে না কেন? আছে। কিন্তু সেখানে তোমার সেন্স অফ পোজেশানটাই বেশি। এই মেয়েটা আমার বউ। এই মেয়েটা আমার মেয়ে। মাইন। এই পোজেশানের ফিলিংটাই তোমাদের সংসারের সঙ্গে আটকে রাখে।
শালিনীর কথা শুনতে শুভাশিসের আর ভাল লাগছিল না। বলল, শুধু সেন্স অফ পজেশানের জোরেই কি হাজার হাজার বছর ধরে সংসারগুলো চলছে? লাভলেস? প্যাশানলেস?
হয়তো সব সংসার নয়, কিন্তু বেশিরভাগ সংসারই। ডেজার্টে কি আর গাছ হয় না? হয়, ওয়েসিসে হয়। কিন্তু গোটা মরুভূমির তুলনায় সে আর কতটুকুন? শালিনী হাসতে হাসতে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেছে, এই যেমন ধরো তুমি। তোমার কতটা অ্যাটাচমেন্ট আছে তোমার সংসারের সঙ্গে? তোমার স্ত্রীর সঙ্গেই বা তোমার কতটা অ্যাটাচমেন্ট আছে? তুমি কি জানো তোমার বউ রাতের পর রাত ঘুমোত পারে না!
কথাটা বলেই উঠে গেছে শালিনী। ভেজানো দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে মেয়েকে কি বলছে, মেয়েকে নিয়েই বেরিয়ে এল। বিশাল হলঘরের অন্য প্রান্তে এল শেপের ডাইনিং স্পেস। মেয়েকে টানতে টানতে খাবার টেবিলে বসিয়েছে শালিনী। চেয়ারে বসে ঢুলছে পিপি। হঠাৎই মুখ ফিরিয়ে শুভাশিসের দিকে তাকাল। ঘুম মাখা চোখে ছোট্ট একটু হাসি উপহার দিল শুভাশিসকে। আলগাভাবে একবার হাত তুলল। থম মেরে যাওয়া শুভাশিসও হাত নাড়ল একটু। শালিনী গলা তুলে রাতদিনের কাজের মেয়েটাকে ডাকছে।
অরূপ উঠে প্লেটে কাজুবাদাম নিয়ে এসেছে। দুটো গ্লাসেই হুইস্কি ঢালছে আবার। কপাল কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল, কিরে, শালুর কথায় মুড অফ হয়ে গেল নাকি?
নাআ। শুভাশিস ঈষৎ উদাস, ভাবছি।
–কী ভাবছিস? শালুটা খুব চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে?
–ভুলও তো খুব বলেনি রে। আমার তো সত্যি কোথাওই অ্যাটাচমেন্ট নেই। ছোটবেলা থেকেই এই ট্রাজেডি আমি ফেস করছি। বাবা সবসময়ে কেমন এক ঘোরে থাকত। হয় নিজের হসপিটাল আর রুগী নিয়ে, নয় মাকে নিয়ে। আমি যে একটা প্রাণী বাড়িতে আছি, বাবা বোধ হয় কোনওদিন সেটা ভাল করে ফিলই করেনি। কিংবা হয়তো করেছে, তার মতো করে। আমি বুঝতে পারিনি। মা… ডেড সোল ইন আ লিভিং বডি..
বাদ দে ওসব কথা। হৃদয়বাবুকে জিজ্ঞেস করেছিলি কবে সব বেড ডেলিভারি দিচ্ছে?
শুভাশিস অরূপের কথা শুনতে পেল না। আনমনে প্রশ্ন করল, অরূপ, তোর তথাগতর কথা মনে আছে?
–কে তথাগত?
–তথাগত ঘোষ। সেই যে রে বিদ্যাসাগরে পড়ত, আমাদের হোস্টেলে খুব আড্ডা মারতে আসত? লম্বা। দাড়িঅলা।
–অ। সেই চে গুয়েভারা? তোর কমরেড? দারুণ লেকচার দিত কিন্তু। রক্ত টগবগ করে ফুটত। তা সে পার্টি তো সত্তর-একাত্তরেই ভ্যানিশ!
না, না, ভ্যানিশ করবে কেন? তিয়াত্তরে ধরা পড়েছিল। কলকাতাতে। তুই তখন এখানে ছিলি না, তুই জানবি কী করে! জেল থেকে বেরোল সেই সাতাত্তর-আটাত্তরে। আমিও খবর রাখতাম না, কোন একটা কাগজে যেন বন্দিমুক্তির লিস্ট বেরিয়েছিল, সেই দেখে জেনেছিলাম।
-কী চার্জ ছিল ওর এগেনস্টে? অরূপের গলায় অলস আগ্রহ।
–সে কী করে বলব! খুন ডাকাতি সশস্ত্র হামলার চেষ্টা, এসবই হবে। পুলিশ তখন থোড়াই চার্জশিট দিত! এই মামলা সেই মামলায় জড়িয়ে ঝুলিয়ে রাখত বছরের পর বছর।
-হুঁ, দিল্লিতে কানে আসত বটে। ওখানে এক ক্যাবিনেট সেক্রেটারির ভাগ্নের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, তার মুখে শুনতাম কিছু কিছু। সে ব্যাটাও কলকাতার মুভমেন্টে জড়িয়ে পড়েছিল, মামা বিপদ বুঝে দিল্লিতে সরিয়ে নিয়ে যায় ভাগ্নেকে। সে এখন আই এ এস। কনাটক ক্যাডারের।
–অনেকেই পরে আখের গুছিয়েছে। শুধু তথাগতটাই…। তথাগতর সঙ্গে বহুকাল পর দেখা হল বুঝলি। গড়িয়ার চেম্বার থেকে ফিরছিলাম, গাড়িটা হঠাৎ গণ্ডগোল শুরু করল। ক্লাচ প্রবলেম। নাকতলায় এক চেনা মিস্ত্রি আছে, তার গ্যারাজে নিয়ে গেছি গাড়ি, সেখানেই দেখি সামনে চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছে তথাগত। আমি প্রথমটা চিনতে পারিনি। লম্বা চেহারা একেবারে কুঁজো মেরে গেছে। গালটাল আরও ভেঙে একদম খেকুরে মাকা অবস্থা। ও অবশ্য আমাকে দেখেই চিনেছে। ভয়েসটা ওর এখনও একই রকম আছে। গমগমে। সেই পল রোবসনের মতো।
–ছেলেটা খুব ব্রিলিয়ান্ট ছিল। ফিজিক্স অনার্স পড়ত না?
–ফিজিক্স না, কেমিস্ট্রি।
তা হবে। … কতদিন আগের কথা! এখন করছে কী?
যা করত। রাজনীতি। সমাজ বদলানোর চেষ্টা।
–ওদের এখন আবার কিসের রাজনীতি ও সমাজ বদলের চেষ্টা তো কবে পঞ্চভূতে লীন হয়ে গেছে! শালা ইস্ট ইউরোপই এখন বলে যায় যায়… অরূপ টেবিল থেকে প্যাকেট তুলে একটা সিগারেট ধরাল। ধোঁয়ার বৃত্ত তৈরি করছে। হচ্ছে না। বেঁকেচুরে যাচ্ছে বৃত্তগুলো। গ্লাসটা হাতে তুলে নিল, আমাদের শিবাজিই তো একসময়ে খুব পার্টিবাজি করত। এখন কবিতায় আগুন ছড়ায়, মদ গেলে আর মালিকের হয়ে কোম্পানির ইউনিয়নের সঙ্গে দর কষাকষি চালায়। কীরকম টানতে পারে দেখেছিস তো? মালের ঘোরে আবার দুঃখ করে বলে, উই আর অল ফ্র্যাগমেন্টেড মলিকিউলস। ওয়েটিং ফর দা ন্যাচারাল অ্যানিহিলেশান।
–আমিও তো তাই ভাবতাম। মনে হত সব শেষ হয়ে গেছে। দু-চারজন পুরনো কমরেড এখনও আসে বাড়িতে। কখনও-সখনও। খায়-দায়, হইহল্লা করে। কেউ কেউ পুরনো রাজনীতির নাম করে রিক্রিয়েশানের জন্য কিছু কাগজ-টাগজ বার করে, আমার কাছে মাঝে মাঝে চাঁদাও নিয়ে যায়। তা ভাল, কিছু নিয়ে তো থাকতে হবে। শেয়ালদায় মাইক চালিয়ে চেঁচায়, ব্লাড সারকুলেশানটা ঠিক থাকে। অন্য পার্টিদের গালিগালাজ করে, ব্রেনটা ফ্রেশ থাকে। কিন্তু ওদের দেখে এটা বোঝা যায়, ওদের আর দম নেই। বাট তথাগত ইজ ডিফারেন্ট। শান্ত। কমপোজড। সিংভূমের দিকে কোন কোন গ্রামে নাকি এখনও কাজ করে চলেছে।
–আবার সেই লোক খুনোখুনি!
না রে, এবার ঠিক আর সড়কি বল্লম ধরা মুভমেন্ট নয়। শিক্ষার কাজ। মানুষকে কনসাস করার কাজ। তথাগত বলছিল মানুষ যদি নিজের মর্যাদা নিজে বোঝে, তা হলে সমাজ বদলানোর কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। বিপ্লবটাকে চাপিয়ে দিতে হয় না। আর তার জন্যই প্রয়োজন শিক্ষা। চেতনা। তুই বিশ্বাস করবি না, ঠিকমতো খাওয়া জোটে না, থাকারও নাকি কোনও পারমানেন্ট ডেরা নেই, কিন্তু কী জিল আর আত্মবিশ্বাস! সেই যে চোখ দুটো দেখেছিলি, কথা বলতে বলতে সেগুলো আগের মতোই জ্বলে।
দুনিয়ায় কতরকম যে পাগল আছে! অরূপ আত্মগতভাবে হাসছে।
–পাগল! তা হবে। শুভাশিসের দীর্ঘশ্বাস পড়ল একটা, ওকে দেখার পর বাড়ি ফিরে সেদিন কি জানি কেন ঘুম এল না রে! খালি মনে হচ্ছিল তথাগতর জীবনে তো সেই সেলে কোনও সাকসেস নেই! বিশ বছর আগে যেখানে শুরু করেছিল এখনও সেখানেই ঘুরপাক খাচ্ছে, তার পরেও এত উৎসাহ থাকে কী করে! একেই কি অ্যাটাচমেন্ট বলে? অ্যাটাচমেন্ট উইথ আইডিয়া? অ্যাটাচমেন্ট উইথ কমন পিপল?
শুভাশিস কেমন দূরে চলে যাচ্ছিল। অরূপ আলগা চাপড় দিল শুভাশিসের হাঁটুতে, ছন্দার কথা ভাবতে গিয়ে এসব কথা আসে কোত্থেকে রে শালা?
কখন যে মানুষের কি মনে পড়ে যায়! শুভাশিস সোফায় মাথা ঠেকাল, আচ্ছা, তোর কী মনে হয় বল তো? ইজ তথাগত এ হ্যাপি ম্যান? নাকি ওটা ওর একটা প্রোজেক্টেড ইমেজ?
–সে তোর তথাগতই জানে। অরূপ গ্লাসে ঠোঁট ছোঁওয়াল, সুখের কথাই যদি বলিস, তাহলে বলি, সুখটাই বা কি এমন ডোডা পাখি রে? সুখ তো ভাই পারচেজেবল কমোডিটি। লে লে বাবু ছ আনা, লে লে বাবু ছ আনা করে বিক্রি হচ্ছে। পয়সা থাকে ফ্যালো, কিনে নাও। কী, ভুল বলছি?
অরূপের ঠাট্টায় শুভাশিস হাসতে পারল না। যেন নিজেকেই শুনিয়ে ফিসফিস করে বলল, রাজনীতিটাকেই যদি ধরে থাকতে পারতাম!
অরূপ অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছে, শালু শুনছ, শুভাশিস বলছে ও নাকি পলিটিক্সে থাকলে খুব সুখী হত।
শালিনী মেয়েকে খাওয়াচ্ছে, ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ভাল তো। পলিটিক্সই তো এখন হ্যাপিয়েস্ট প্রফেশান। নার্সিংহোম করতে গিয়ে যা খাটনি যাচ্ছে, তার থেকে অনেক কম লেবার দিয়ে অনেক বেশি টাকা কামানো যেত।
–ওই পলিটিক্স নয়, এ একেবারে চাষির কুঁড়েঘরে থাকা পলিটিক্স। যেটা করতে গিয়ে শুভাশিস একসময়ে পালিয়ে এসেছিল!
–ও। সেই ফাইনাল ইয়ারে পড়ার সময়?
–হুঁউ। অরূপ শুভাশিসকে চোখ টিপল। গলা নামিয়ে বলল, ডোন্ট ব্রুড মাই চাইন্ড। পলিটিক্স তোমার ধাতে নেই। বয়সের জোশে নেচেছিলে। মাঝখান থেকে তোমার সেই মেয়েটা ভোকাট্টা হয়ে বেরিয়ে গেল! কী যেন নাম ছিল মেয়েটার? ইন্দ্রাণী, না চন্দ্রাণী?
ইন্দ্রাণী।
–মেয়েটা কিন্তু দারুণ অ্যাট্রাকটিভ ছিল। গায়ে-পড়া টাইপ নয়, বেশ সফট। রিজার্ভড। ওকে মিস করে তুই হেভি লস করেছিস।
শুভাশিসের অস্বস্তি হচ্ছিল। বলল, কেন, ছন্দাই বা কি খারাপ? হোমলি, কেয়ারিং…।
–স্টিল শি ওয়াজ বিট ডিফারেন্ট। যেদিন হোস্টেলে তোকে খুঁজতে এল, সেদিন তো দেখেছিলাম, কী স্টেডি! শালা তুই পালালি গ্রামে বিপ্লব করতে, আর আমাকে টুপিটাপা দিয়ে যেতে হল। সে যে কী অকোয়ার্ড অবস্থা!
ছাড় তো পুরনো কথা। শুভাশিস বেশ রেগে গেল হঠাৎ, এক গপ্পো কতবার করবি?
–চটছিস কেন? অরূপ আর একটু খোঁচাল শুভাশিসকে, গ্রামে যাওয়ার সময়ে কী ভেবেছিলি রে? মেয়েরা বিপ্লবের বাধা! তুই মহান কাজে জীবন উৎসর্গ করছিস! প্রেমিকা ঠিক বুঝতে পারবে কী মহান ব্রতে জান লড়িয়ে দিয়েছে আমার প্রেমিক! তাই তো?
শুভাশিস হিংস্র চোখে বন্ধুর দিকে তাকাল। উত্তর দিল না।
অরূপ সোফায় হেলান দিয়েছে, ব্যর্থ বিপ্লব, ভাঙা প্রেম, এগুলো নস্টালজিয়া হিসেবে দারুণ, কী বল?
শুভাশিস উদাসীন হাসি মাখবার চেষ্টা করল মুখে। অরূপের ওপর রেগে লাভ নেই। সে যত উত্তেজিত হবে, অরূপ তত আলপিন ফুটিয়ে যাবে ক্ষতস্থানে।
তরল স্বরে অরূপ বলল, মেয়েটার সঙ্গে পরে আর দেখা হয়েছিল?
-নাহ্, কই আর! এত বড় শহর…! শুভাশিস দ্রুত উত্তর দিল। বছর আষ্টেক আগে বিলেত ঘুরে বউ, বাচ্চা, বিদেশি ডিগ্রি নিয়ে কলকাতা ফিরেছে অরূপ। প্রথমদিকে শুভাশিসের সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ ছিল না, হালফিল ঘনিষ্ঠতাটা বেড়েছে আবার। তবে এই ঘনিষ্ঠতা অনেকটাই পেশাদারি। ঠিক বন্ধুত্ব নয়, অন্তত যেমনটি কলেজে ছিল। এখন এই পর্দার আড়ালটুকু থাকাই বোধহয় ভাল।
আবার কি প্রশ্ন আসে ভয়ে শুভাশিস নিজেই বলে উঠল, আমি তাহলে অপারেশন থিয়েটারের ফিটিংস টিটিংসগুলো শুরু করে দিই, তুই জেনারেটর এসি মেশিন এগুলো দ্যাখ।
–দেখব। দেখব। এত তাড়া কিসের?
–মহালয়ার আর কদিন বাকি আছে? হার্ডলি আ মানথ।
মহালয়ার দিনই ওপেন করবি? নিজের ফাঁকা গ্লাস দু হাতের চেটোয় ঘোরাচ্ছে অরূপ, পুজোর পর শুরু করলে ভাল হত না?
না। টার্গেট ওইদিনই থাক। শুভদিন… যদি সব কাজ গুছিয়ে না উঠতে পারি তখন দেখা যাবে।
–এমনি সব কাজ হয়ে যাবে, শুধু তোর ইনটিরিয়ার ডেকরেশানটা ফিনিশ হলে হয়। তোর লোকটা কিন্তু হেভি স্লো।
শুভাশিস ঈষৎ আহত হল। নিজের ওপর রাগও হল খানিকটা। কেন যে যেচে ইন্দ্রাণীর বন্ধুর বরটাকে কাজ দিতে গেল! লোকটাকে ঝাড়তে গেলে ইন্দ্রাণী না এখন মনঃক্ষুণ্ণ হয়।
আরও দু-একটা আপাত দরকারি কথা সেরে উঠে পড়ল শুভাশিস। দরজার দিকে এগোচ্ছিল, শালিনী মেয়েকে ছেড়ে ছুটে এসেছে, এই যেয়ো না, দাঁড়াও। কথা আছে।
আবার কিছু শুঁকবে নাকি? শুভাশিস গলা ঠাণ্ডা রাখল, সাড়ে নটা বাজে, আমার কিন্তু আর সময় নেই।
–তুমি রেগে যাচ্ছ কেন? সত্যিই ছন্দা মাঝে মাঝে রাতে ঘুমোতে পারছে না। শালিনী নরম নিচু স্বরে কথা বলছে, ওর লোয়ার অ্যাবডোমেনে একটা পেন হচ্ছে। কাল ও আমার চেম্বারে এসেছিল।
শুভাশিসের ভুরু ঘন হল।
শালিনীও গম্ভীর, আমি চেকআপ করেছি। ছন্দার ইউটেরাসে ফাইব্রয়েড আছে। সাইজও মনে হল ভালই। আউটার ওয়ালে ফর্ম করেছে। ইমেডিয়েটলি আলট্রাসোনো করতে হবে।
–আশ্চর্য! আমাকে কোনওদিন ঘুণাক্ষরেও কোনও প্রবলেমের কথা বলেনি।
–সেই জন্যই তো বলছিলাম ডিয়ার, তোমরা বউদের ঠিক ঠিক খোঁজ রাখো না। তুমি ইউহি রেগে গেলে।
–সরি। কিন্তু ছন্দা…! শুভাশিসের কথা ফুটছিল না।
–শোনো, কথা বলে মনে হল ছন্দার বোধ হয় তোমার ওপর একটা অভিমান আছে। ও যে আমার কাছে চেকআপে এসেছিল সেটাও তোমাকে জানাতে চায় না। রিপিটেডলি তোমাকে বলতে বারণ করেছে।
বিস্মিত হওয়ার থেকেও শুভাশিসের নিজেকে অপমানিত লাগছিল বেশি। শালিনীর শোকেসের গণপতিবাপ্পার মূর্তির মতো স্থাণু হয়ে রইল কিছুক্ষণ। মেয়েদের কোনও কাজেরই কার্যকারণ খুঁজে পাওয়া ভার। শুভাশিসকে হাস্যাস্পদ করে কী লাভ ছন্দার? প্রতিশোধ? নাকি এ শুধুই সহানুভূতি কুড়োনোর চেষ্টা?
শুভাশিস তিতকুটে গলায় বলল, বারণই যখন করেছে, তুমি আমাকে বললে কেন? না হয় নাই জানতাম।
মেরি মর্জি। ভাবলাম তোমার একটু আঁখ ফুটিয়ে দিই। এঁটো হাতে কথা বলতে বলতে ঠোঁট টিপে হাসছে শালিনী, জানোই তো মহাভারতের জমানা থেকে মেয়েদের ওপর অভিশাপ আছে? আমাদের পেটে কথা থাকবে না। তুমি যেন আবার বাড়িতে গিয়েই ছন্দাকে বোলো না প্লিজ। ছন্দা তবে আমার ওপর খুব গুস্সা করবে।
শুভাশিস এক চোয়ালে হাসল। মনে মনে বলল, তোমাদের পেটে কথা থাকবে কি করে। তোমাদের মনে এত প্যাঁচ!
ফেরার পথেও শালিনীর দেওয়া খবরটা মস্তিষ্কে চিমটি কাটছিল শুভাশিসের। এক রাশ অপমান ঘামের মতো বিজবিজ করছে শরীরে। হাওয়া বড় কম আজ, সুরাটাও যেন চড়ে বসেছে মাথায়। শুভাশিসের ভার ভার লাগছিল মাথাটা।
ফ্ল্যাটের নীচে কার পার্কিং-এ গাড়ি রাখতে গিয়ে হুঙ্কার ছাড়ল শুভাশিস, দারোয়ান! অ্যাই দারোয়ান!
ছোকরা দারোয়ান কাছেপিঠেই ছিল। শশব্যস্ত হয়ে ছুটে এসেছে, কী হয়েছে সাব?
–আমার গাড়ি রাখার জায়গায় অন্য গাড়ি কেন? শুভাশিস আঙুল নাচাল।
–বোধহয় ভুল করে… সাব…।
–তোমরা থাকো না এখানে? দেখতে পারো না? বলতে পারো না? শুভাশিস আঙুল নাচিয়েই চলেছে, আমার পয়সা দিয়ে কেনা জায়গায় অন্য লোক গাড়ি রাখে কী করে?
শুভাশিস কখনও চেঁচামেচি করে না। তার রুদ্র রূপ দেখে দারোয়ান ভীষণ ঘাবড়ে গেছে।
শুভাশিস আবার গর্জে উঠল, ওটা কোন ফ্ল্যাটের গাড়ি?
-থ্রি সি সাব।
–থ্রি সি? মানে গুপ্তা?
–হাঁ। গুপ্তাজি। উনকা ড্রাইভার কথা শোনে না সাব, য্যায়সা ত্যায়সা রেখে দ্যায়।
–ঠিক হ্যায়, আমি দেখছি।
নাক দিয়ে আগুনের হলকা ছড়াতে ছড়াতে নিজের ফ্ল্যাটে এল শুভাশিস। কোনওদিকে না তাকিয়ে ফোনের সামনে বসেছে, ঝটঝট পাতা ওল্টাচ্ছে ডায়েরির। এখানকার প্রতিবেশীরা সচরাচর কেউ কারুর ফ্ল্যাটে যায় না, প্রয়োজন পড়লে টেলিফোনে কথা সারে। এটাই রেওয়াজ।
শুভাশিস বোম টিপল ডায়ালপ্লেটের, -গুপ্তাজি আছেন?
–জি। কোথা বলছি। আপ কউন?
–ডক্টর সেনগুপ্ত ফ্রম টু বি।
–নমস্কার ডাক্তারসাব। বোলুন।
শুভাশিস সৌজন্যের ধার ধারল না। সরাসরি বলল, আপনি কি লক্ষ করেছেন আপনার ড্রাইভার প্রায়ই আমার স্পেসে গাড়ি রাখছে?
–না তো ডাক্তারবাবু।
–এবার থেকে একটু দেখবেন। আমি এ ধরনের ইনট্রুশন পছন্দ করি না। কাল সকালে যখন বেরোব, তখন যেন দেখি আমার স্পেসটা ক্লিয়ার হয়ে গেছে। অর ইউ আর গোয়িং টু হ্যাভ এ ব্যাড ডে। বুঝলেন?
উত্তরের তোয়াক্কা না করে রিসিভার প্রায় আছড়ে রাখল শুভাশিস।
শুভাশিসের চড়া স্বর শুনে ছন্দা দৌড়ে এসেছে, হল কী? রাতদুপুরে কার ওপর ফোনে চেঁচাচ্ছ?
–তা জেনে তোমার কি হবে? শুভাশিস খিঁচিয়ে উঠল, তোমার গোপালঠাকুর ঘুমিয়েছে? ঘুমিয়ে না থাকলে যাও, ঘুম পাড়াও গে যাও।
–এভাবে কথা বলছ কেন?
কীভাবে বলতে হবে? সুর করে? গেয়ে গেয়ে? শুভাশিস জুতো খুলে ছুঁড়ল সজোরে। জুতো রাখার র্যাক অবধি পৌঁছল না জুতো জোড়া, দু দিকে ছিটকে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সেদিকে দৃকপাত না করে উঠে গেল শোওয়ার ঘরে। বুশ শার্ট খুলে দলা পাকিয়ে ফেলল মেঝেতে।
ছন্দাও এসেছে পিছন পিছন, দেখছে শুভাশিসকে। বুঝি বা অনুধাবন করতে চায় কেন এই ক্রোধ।
দুপদাপ লাগোয়া বাথরুমে ঢুকে গেল শুভাশিস। ছটাস ছটাস জল ছেটাল মুখে চোখে। পাগলের মতো। বেরিয়ে এসে চেপে চেপে মুখ ঘষছে তোয়ালেতে।
ছন্দা নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, খেতে দেব?
না।
বাইরে খেয়ে এসেছ? বেরোনোর সময় কিছু বলে গেলে না…। ছুটির দিন, এক সঙ্গে খাবে বলে ছেলেটা বসে আছে……
–কেন ঘ্যানঘ্যান করছ? বলছি তো খাব না।
ছন্দা সামান্য কাছে এগোল, শরীর খারাপ?
–আমার শরীর নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না। শুভাশিস খিঁচিয়ে উঠল।
ছন্দা মুহূর্তের জন্য থমকাল, পরক্ষণেই বিদ্রূপ হেনেছে, হুঁ, তোমার শরীর নিয়ে মাথা ঘামানোর তো অন্য লোক আছে।
–আছেই তো। না থাকলেও শরীর নিয়ে বিশ্বসুদ্ধ লোকের কাছে আমি ঢ্যাঁড়া পেটাতে যাব না।
কপালের ভাঁজ ঘন হয়েছে ছন্দার, তুমি কি শালিনীদের বাড়ি গিয়েছিলে?
সরাসরি উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না শুভাশিস। ছন্দার আগের বিদ্রূপটা ছ্যাঁকা দিয়েছে গায়ে। এ বিদ্রূপ নতুন কিছু নয়, এ ধরনের খোঁচা বহু দিন ধরেই হজম করে আসছে শুভাশিস, আজ পারল না। অন্য দিনের মতো এড়িয়ে না গিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, -শোনো, যাকে হিংসে করে তুমি আমাকে লোকসমাজে অপদস্থ করার চেষ্টা করো, তুমি তার নখের যোগ্যও নও। আশা করি কথাটা এবার থেকে মনে রাখবে।
–হ্যাঁ, আমি তো নখের যোগ্য নইই। হবই বা কী করে? আমি তো আর তার মতো রঙঢঙ জানি না। জানলে তো তুমি আমার আঁচলেই বাঁধা থাকতে। ছন্দার মুখ বিকৃত হয়ে গেছে। চেরা জিভে বিষ ওগরাচ্ছে সে, লজ্জাও করে না, ছেলে মেয়ে বড় বড় হয়ে গেছে, এখনও দুজনে চালিয়ে যাচ্ছ!
–বেশ করছি। শুভাশিস গর্জে উঠল, যা ইচ্ছে করি আমি, তোমার সুখে কমতি হয়েছে কোনওদিন? কী পাওনি তুমি অ্যাঁ? টাকা ফ্ল্যাট গাড়ি আরাম ছেলে কী নয়? এই যে মুখের রক্ত তুলে খেটে মরছি, এসব কার ভোগর জন্য? যখন যা চাইছ, হাতের কাছে এনে দিচ্ছি। তার বদলে আমি যদি কোথাও গিয়ে একটু শান্তি পাই…।
— থাক থাক, চিৎকার করে আর নিজের কেলেঙ্কারির কীর্তন গাইতে হবে না। পাশের ঘরে ছেলে আছে, তাকে নয় নিজের কেচ্ছা নাই শোনালে।
কথাটা বলেই ঝট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে ছন্দা। শুভাশিসকে পাল্টা আক্রমণের সুযোগ না দিয়ে।
শুভাশিস ফুঁসছিল। সোজাসুজি শালিনীর কথাগুলো শুনিয়ে দিয়ে ঠাস ঠাস চড় কষালেই কি ভাল হত? মিটত ঝালটা? ছন্দার সঙ্গে সব সংঘর্ষই কেন যে শেষ হয় ইন্দ্রাণীতেই!
লম্বা একটা বাতাস টেনে খানিকক্ষণ বুকে ধরে রাখল শুভাশিস। দূরে কোথাও বোমাবাজি শুরু হয়েছে। কেওড়াতলার দিকে কি? শ্মশানের দখল নিয়ে প্রায়ই দু দলে লড়াই বাধে আজকাল।
বোমার অস্পষ্ট আওয়াজ শুনতে শুনতেই ছেলের ঘরে এল শুভাশিস।
টোটো মন দিয়ে একটা বই পড়ছে। ছেলের মুখ দেখে শুভাশিস আন্দাজ করার চেষ্টা করল ঝগড়ার কতটুকু কানে গেছে ছেলের। বুঝতে পারল না। টোটোর মুখটা কি আজকাল বেশি কঠিন হয়ে থাকে।
তরল কিন্তু সাবধানী স্বরে শুভাশিস বলল, যা, খেয়ে নে। মা বসে আছে। তোর অরূপকাকুরা এমন খাইয়ে দিল…।
টোটো চেয়ার ছেড়ে উঠেছে, তোমার ফোন এসেছিল। দুবার।
–কোত্থেকে?
শর্টস টিশার্ট পরা টোটোর মুখ থমথম করছে। শুভাশিসের দিকে না তাকিয়ে বলল, ঢাকুরিয়া থেকে।
কে করেছিল ফোনটা জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও থেমে গেল শুভাশিস। অস্বস্তি, বড় অস্বস্তি!
.
২৪.
বিকেলে এই সময় থেকে জ্বরটা বাড়তে থাকে ইন্দ্রাণীর। বাইরের আলো যত কমে, চেতনাও বধির হয়ে আসতে থাকে ক্রমশ। চতুর্দিক এক গাঢ় কুয়াশায় ছেয়ে যায়, এক পাল মৌমাছি চাক ভেঙে বেরিয়ে এসে মাথার ভেতর ঘুরতে থাকে, ঘুরতে থাকে, ঘুরতেই থাকে অবিরল। কখনও কখনও এলোপাথাড়ি দংশনও করে চলে তারা। সে যে কী অসহ্য যন্ত্রণা! যন্ত্রণা মাথায় নিয়েই কুয়াশা ভেদ করে ইন্দ্রাণী চোখ চালায়। আবছা আবছা দেখতে পায় তিতির ঠায় বসে আছে চেয়ারে। আদিত্য মাঝে মাঝেই ঘরে ঢুকছে, বেরোচ্ছে, কখনও বা বিছানায় বসে কপালে হাত ছোঁয়াচ্ছে তার। বাপ্পাও আসে, তবে কম। এই সময়ে বাড়ি থাকলে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে বাপ্পার। সন্ধে হলে পা টিপে টিপে উঁকি দেয় কন্দর্প, একটু রাত বাড়লে সুদীপ। রুনাকেও দেখা যায় মাঝে মাঝে। আসে, যায়, ফিসফিস করে কথা বলে তিতিরের সঙ্গে। হয়তো বা ফিসফিস নয়, স্বাভাবিক স্বরেই বলে, ইন্দ্রাণীই ঠিক শুনতে পায় না। হয়তো বা শোনেও। নদীতে ডুব দিলে আশপাশের কলরোল যেমন দূরাগত ধ্বনি মনে হয়, ঠিক যেন তেমনটিই শোনে ইন্দ্রাণী। অস্পষ্ট। জড়ানো। অসাড় চৈতন্যের ঘোরে ওই ধ্বনি, মানুষের ঘোরাফেরার ওই চলচ্ছবি, সবই বড় অলীক ঠেকে ইন্দ্রাণীর। মনে হয় যা দেখছে তা সত্যি নয়, এই বুদবুদ এক্ষুনি মিলিয়ে যাবে। মিলিয়ে যাবে।
পাঁচ দিন ধরেই এই চলছে। জ্বর ছাড়ছে না কিছুতেই। গোস্বামী ডাক্তার বলে গেছে ভয়ের কিছু নেই, তবে অসুখ বোধহয় এবার বেশ ভোগাবে। কড়া অ্যান্টিবায়োটিকও শরীরের রস নিংড়ে নেবে অনেকটাই।
তিতির মাথার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে ইন্দ্রাণীর। হাতে জলের গ্লাস আর রঙিন ক্যাপসুল, একটু মাথা তোলো তো মা।
ইন্দ্রাণী প্রাণপণ শক্তিতে সামান্য ওঠার চেষ্টা করল। পারল না। তিতিরই হাতের বেড়ে মাথা তুলে ধরেছে। নিপুণ সেবিকার মতো ক্যাপসুলটা দিয়ে একটুখানি জল ঢালল মার মুখে। অপেক্ষা করল, যতক্ষণ না ওষুধটা গিলতে পারে। তারপর সন্তর্পণে মাথা বালিশে নামিয়ে দিয়ে বলল, আরেক বার মাথা ধুইয়ে দেব মা?
ইন্দ্রাণীর চোখ আরও ঝাপসা হয়ে এল। ফ্যাকাসে মুখে ঘাড় নাড়ল একটু।
ইন্দ্রাণীকে বিছানার প্রান্তে এনে মাথায় জল ঢালছে তিতির। ছপছপ আলতো চাপড় দিচ্ছে চাঁদিতে। চুল বেয়ে বালতিতে গড়িয়ে পড়ছে জল। শীর্ণ ধারায়।
ইন্দ্রাণী জলের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। শুধু বাইরের নয়, নিজের ভেতরেও। কোথা দিয়ে যেন এক নদী বয়ে চলেছে কুলকুল। এক নিরুদ্ধ কষ্টের পাষাণে আছড়ে আছড়ে পড়ছে। পাষাণ বুঝি ক্ষয়ে যায়।
মায়ের মতো মমতায় ইন্দ্রাণীর সেবা করে চলেছে এ কোন মেয়ে! একেই কিনা সেদিন রাতে ইন্দ্রাণী নিজের হাতে….!
ভাগ্যিস তিতির তক্ষুনি ধড়মড় করে ঘুম ভেঙে উঠে বসেছিল বিছানায়! গলায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেছিল, কী হয়েছে মা? ডাকছ?
ইন্দ্রাণী গোঙাচ্ছিল। তার মুখ চোখ দেখে কেমন সন্দেহ হয়েছিল তিতিরের। মার কপালে গালে হাত রেখে বলেছিল, –এ কী! তোমার গা যে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।
ইন্দ্রাণী সংবিৎ ফিরে পাচ্ছিল। বিড়বিড় করে বলেছিল, শরীরটা কেমন যেন লাগছে। ঘুম আসছে না।
বাবাকে ডাকব?
না। কাউকে ডাকতে হবে না। তুই একটু আমার পাশে থাক।
–দেখব জ্বরের কোনও ট্যাবলেট আছে কিনা?
–দ্যাখ।
তিতির মশারি সরিয়ে দ্রুত পায়ে বিছানা থেকে নেমেছিল। খুঁজে খুঁজে ওষুধ বার করল। খাইয়েও দিল তক্ষুনি। ইন্দ্রাণী শোওয়ার পরেও শুল না, বসে রইল পাশে। হাত বোলাল মাথায়। অনেকক্ষণ। কয়েক দণ্ড আগেও যাকে ডাকিনী মনে হয়েছিল, সেই যেন কোন মায়াবী কুহকে ঘুম পাড়িয়ে দিল ইন্দ্রাণীকে। তখনকার মতো।
সকালে জ্বরটা তেড়েফুঁড়ে এল। ওই ডাকিনীই ছায়ার মতো লেপটে রইল পাশে পাশে। কদিন স্কুলে গেল না, বাড়ি থেকেও বেরোয়নি এক পা, খাওয়ার সময় ছাড়া বড় একটা নীচে নামেনি।
বেলার দিকে জ্বর কম থাকে ইন্দ্রাণীর, তখন কতবার বলেছে, সারাক্ষণ ঘরে বসে আছিস কেন? এর পর তো তুই অসুখে পড়বি!
তিতির হেসেছে, তোমাকে অত ভাবতে হবে না তো। শরীরটাকে সারাও আগে।
–স্কুলে যাচ্ছিস না, পড়াশুনোতে যে পিছিয়ে পড়বি!
–পাঁচ-সাত দিনে কি আর এমন হাতিঘোড়া পড়া হবে। যদি কোনও নোটস্ দেয় ঝুলনের কাছ থেকে নিয়ে নেব।
ইন্দ্রাণী আর কথা বাড়ায় না। পাশ ফেরে। অবসন্নের মতো। ঘুম আর জাগরণের এক মধ্যবর্তী দশায় কান জুড়ে ঝিঁঝি পোকার ডাক শুনতে থাকে সারাক্ষণ।
কিছু কি ভাবে ইন্দ্রাণী! তাও বুঝি ঠিক জানে না।
তিতির বাথরুমে বালতি রেখে ফিরেছে। নরম তোয়ালে দিয়ে চেপে চেপে মাথা মোছাচ্ছে ইন্দ্রাণীর। মৃদু স্বরে বলল, তোমার স্কুল থেকে আজ কমলিকা মাসি এসেছিল।
–তাই? কখন?
দুপুরে। তুমি তখন খুব ঘুমোচ্ছিলে।
–ডাকিসনি কেন?
কমলিকা মাসি ডাকতে বারণ করল।
চকিতে নীলিমাদির সঙ্গে স্কুলে বাকবিতণ্ডার কথা ইন্দ্রাণীর মনে পড়ে গেছে। আবার কিছু ঘটল নাকি? কমলিকা কি ওই ব্যাপারেই কিছু বলতে এসেছিল!
ইন্দ্রাণী উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, ডাকলে পারতিস। কয়েকটা দরকারি কথা ছিল কমলিকার সঙ্গে। ছুটির একটা অ্যাপ্লিকেশানও পাঠিয়ে দিলে ভাল হত।
–খবর তো পাঠিয়েই দিয়েছ। জয়েন করে চিঠি দেবে। তুমি তো আর কথায় কথায় ডুব মারো না।
–তবু একটা নিয়মকানুন আছে তো। কে কি ভাববে….! কথা বলতে বলতে ইন্দ্রাণীর ছোট্ট শ্বাস পড়ল। সত্যিই সে দায়ে না পড়লে কামাই করে না। অসুখ বিসুখও বড় একটা হয় না তার। শেষ কবে বিছানার পড়েছিল সে? সেই বাপ্পার মাধ্যমিকের টেস্টের আগে। দিন পনেরো খুব ব্রংকাইটিসে ভুগেছিল। কেশে কেশে গলায় রক্ত ওঠার জোগাড়। তারপর এত দিন পরে এই মারাত্মক জ্বর।
ভেজা চুলে মেয়ের হাতের ছোঁয়া ভারি মিঠে লাগছিল ইন্দ্রাণীর। কেমন এক শিরশিরে ভাব বয়ে যাচ্ছে স্নায়ুতে। শীতল জলের স্পর্শে মাথার দপদপানি অনেকটা কম। আরাম লাগছে।
চোখ বুজে ইন্দ্রাণী হালকা স্বরে মেয়েকে প্রশ্ন করল, হ্যাঁরে, তুই যে স্কুলে যাচ্ছিস না, কই তোর বন্ধুবান্ধবরা তো কেউ খোঁজ করতে এল না?
-তাই তো দেখছি।
তার মানে তোর বন্ধুরা তোকে মিস্ করে না। এলেবেলে ভাবে!
তিতির আলতো হাসল, -হয়তো।
ইন্দ্রাণী দু-এক পল চুপ। তারপর খুব সাবধানে প্রশ্ন করল, এখন স্কুলে টোটোর সঙ্গে দেখা হয়?
হয়। খুব রেয়ার।
কথাবার্তা হয়? কিছু বলে টোটো?
কী বলবে?
ইন্দ্রাণী ঠিক উত্তর খুঁজে পেল না। টোটোর সঙ্গে বাপ্পা তিতিরের যেটুকু সম্পর্ক গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল, তা তো অঙ্কুরেই নষ্ট করে দিয়েছে ইন্দ্রাণী। এখন আর কি কথা হবে দুজনের?
সম্পর্ক যে গড়ে ওঠেনি, সে দোষ কি ইন্দ্রাণীর একার? শুভাশিসের দোষ নেই? ছন্দার দোষ ছিল না? ইন্দ্রাণী তো ছন্দার সঙ্গে একটা সহজ সম্পর্কই রাখতে চেয়েছিল। ছন্দা তাকে একটুও সহ্য করতে পারে না জেনেও শুভাশিসের কথা রাখতে গিয়েছিল বার কয়েক। কী দরকার ছিল সেবার টোটোর জন্মদিনে তিতির বাপ্পাকে নিয়ে শুভাশিসের অত আদিখ্যেতা করার? কী বিশ্রী মেজাজ দেখিয়েছিল ছন্দা সেদিন! ইন্দ্রাণীর ওপর নয়, শুভাশিসের ওপর। কিন্তু উপলক্ষ যে তিতির বাপ্পা, তা কি ইন্দ্রাণী বোঝেনি?
তিতির তোয়ালে কাঁধে উঠে দাঁড়িয়েছে, এবার চুপচাপ শুয়ে থাকো। একটু হরলিক্স খাবে এখন? করে দেব?
ইন্দ্রাণী অন্যমনস্ক ভাবে নাক কুঁচকোল, গরম গরম চা দে একটু। দোতলায় স্টোভ জ্বালাস না যেন, কেরোসিনের গন্ধ বড় নাকে লাগে। সন্ধ্যার মাকে গিয়ে বল, ওই করে দেবে।
বাইরে আলো ক্ষীণ হয়ে এসেছে। আরেকটা দিন ফুরিয়ে এল। সন্ধ্যা নামছে। ধীরে, অতি ধীরে। আলোর বুকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকে পড়ছে অন্ধকার।
তিতির ঘরে ফিরে আলো জ্বেলে দিল। জানলা বন্ধ করছে।
ইন্দ্রাণী বলল, থাক না জানলা খোলা।
তিতির অবাক চোখে তাকাল, তুমিই তো মশার জন্য জানলা বন্ধ রাখতে বলো!
ঘরে বড় গুমোট লাগছে রে।
লাগুক। ফুলস্পিডে ফ্যান ঘুরছে, এখন এই সন্ধেবেলা জানলা খোলা থাকলে… তিতির জানলার ছিটকিনি আটকাল, শরৎকাল পড়ে গেছে, হিম পড়ে এখন এই জ্বরের ওপর আবার নতুন করে ঠাণ্ডা লাগলে আর দেখতে হবে না।
–ভাদ্রমাসে হিম! হাসালি। ইন্দ্রাণী ক্লান্তভাবে পাশ ফিরল, –টিভিটা খুলে দে না। শুয়ে শুয়ে একটু দেখি।
শব্দ কম রেখে টিভি চালিয়ে দিল তিতির। চার-পাঁচজন লোক কি সব বকবক করছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তিতির বলল, –আজ বোধহয় ডাক্তার আঙ্কল আসবে। কাল বাবা ফোন করেছিল।
মুহূর্তের জন্য বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল ইন্দ্রাণীর। কত হাজার বছর আসেনি শুভ! মুখে বলল, –তোর বাবার আবার বেশি বেশি। খবর দিয়ে ডেকে পাঠানোর কি ছিল? কাজেকর্মে ব্যস্ত রয়েছে মানুষটা!
–আমি ছিলাম পাশে। বাবা তোমার অসুখের কথা বলেনি।
–ও। ইন্দ্রাণী এতক্ষণে একটু যেন ঝিমিয়ে গেল।
প্যাসেজে অ্যাটমের গলা শোনা যাচ্ছে। চিৎকার করে একটা চলতি হিন্দি গানের কলি গাইছে অ্যাটম। রুনা কি বাড়ি নেই? আদিত্যই বা গেল কোথায়?
সন্ধ্যার মা চা নিয়ে এসেছে। সঙ্গে দুটো বিস্কুট। বিস্কুটে কামড় দিয়ে প্লেট সরিয়ে রাখল ইন্দ্রাণী। কাপ ধরতে হাত কাঁপছে। বসে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে বেশ। তবু একটু একটু করে চা-টা শেষ করল ইন্দ্রাণী। তাপ, স্বাদ, কিছুই টের পেল না।
আবার ঘোর নামছে চোখে। আবার ঝিঁঝি পোকার ডাক ছড়িয়ে যাচ্ছে মাথায়। গা-টাও গুলোচ্ছে কেমন। টিউবের লম্বাটে আলো বড় চোখে লাগছে হঠাৎ। শরীর শিরশির।
ইন্দ্রাণী চোখ বুজে শুয়ে পড়ল। কাঁপা আঙুলে সুজনি টেনে নিল গায়ে। জোর করে কথা বলতে গিয়ে স্বর জড়িয়ে যাচ্ছে, –তোর বাবা কোথায় রে তিতির? ও ঘরে?
–না। রঘুবীরবাবুর সঙ্গে কথা বলছিল তখন, বোধহয় তার সঙ্গেই বেরিয়েছে। গোস্বামী ডাক্তারকে তোমার রিপোর্ট দেখিয়ে ফিরবে। তিতির টিভি বন্ধ করে দিল, দাদা আজ মানিকতলায় গেছে।
ইন্দ্রাণীর নিশ্বাসে টান পড়ছে এবার, কষ্ট করে প্রশ্নটা করল, আমার অসুখের কথা দাদু-দিদাকে বলতে বারণ করেছিস তো? বাবা শুনলে যা উতলা হয়ে পড়বে!
–সে কি দাদা জানে না? নীচে দাদুই যা ছটফট করছে তোমার জন্য।
কষ্টের মধ্যেও একটা ভাললাগা চিনচিন করছিল ইন্দ্রাণীর বুকে। এ বাড়ির সবাই আবার কী সুন্দর একত্র হয়ে গেছে! চাঁদু দীপু যে ও ঘরে কথা বলে দাদার সঙ্গে, এ ঘরে বিছানায় শুয়েও ইন্দ্রাণী টের পায় বইকি! হয়তো বা শুধু তার অসুখ নিয়েই আলোচনা হয়। তা হোক, সবাই এক সঙ্গে বসে কথা বলছে এই কি কম! ভাবতে ভাল লাগে সে-ই এখনও এ বাড়ির প্রাণবিন্দু। তাকে ঘিরেই এ বাড়ির আলো জ্বলে, আলো নেবে, আনন্দ বিষাদ আবর্তিত হয়, আশা নিরাশাও বুঝি দোল খায় এ বাড়ির মানুষজনের মনে।
শুধু ইন্দ্রাণীই যে কেন কোনও কিছুতেই উৎসাহ পায় না আজকাল! সবই বড় নিরর্থক, বড় অসার মনে হয়। চল্লিশে না পৌঁছেই কেন এত শ্রান্তি!
ইদানীং গোটা জীবনটাকেই কেমন যেন ভুল মনে হয় ইন্দ্রাণীর। শৈশবে মা বাবার আদরে বড় হয়ে ওঠা বালিকার ভূমিকা, প্রথম যৌবনে প্রেমিকার সাজ, তারপর এক দায়িত্বশীল ঘরনীর রূপ, এরাই কি ইন্দ্রাণী? নাকি সে আদৌ ইন্দ্রাণীই নয়? অন্য কেউ ইন্দ্রাণী সেজে বেঁচে আছে এত কাল? তাহলে ইন্দ্রাণী কোথায়?
ইন্দ্রাণী ডুবছিল।
সাড়ে আটটা নাগাদ শুভাশিস এল। একা নয়, সঙ্গে কন্দর্প। ইন্দ্রাণীর জ্বর তখন ভাল মতো চড়েছে। তার শিয়রে বসে কপালে জলপট্টি লাগাচ্ছে তিতির। জলের প্রলেপ শুকিয়ে যাচ্ছে মুহুর্মুহু।
শুভাশিস ঘরে ঢুকে প্রথমেই বিছানার কাছে গেল না। টেবিলে ইন্দ্রাণীর ওষুধপত্র পড়ে আছে, সেগুলো ঘেঁটে দেখল আগে। প্রেসক্রিপশান খুঁজল। পেল না।
তিতির বলল, –পাঁচ দিন হয়ে গেল। জ্বর ছাড়ছে না।
হুঁ। চেয়ার টেনে খাটের ধারে বসল শুভাশিস, আমাকে একটা খবর দিসনি কেন?
তিতির উত্তর দিল না, পট্টি বদলাচ্ছে।
শুভাশিস কবজি টিপল ইন্দ্রাণীর। নাড়ি দেখছে। চিন্তিত মুখে বলল, টেম্পারেচার চার্ট রাখছিস?
–হ্যাঁ। বালিশের তলা থেকে তিতির একটা কাগজ বার করে দিল, সকালে কম থাকে। বিকেলে বাড়ে।
মন দিয়ে কাগজে তাপমাত্রার ওঠাপড়া দেখল শুভাশিস।
জোর করে হাসি ফুটিয়েছে মুখে, কী করে বাধালে?
কুয়াশা গাঢ় এখন। শুভাশিস আবছা। ইন্দ্রাণী চোখ বুজল, তোমার নার্সিংহোমের কাজ শেষ হল?
উঁহু। চলছে।
–শেফালির বর কাজ করছে ঠিক মতো?
করছে একরকম। তুমি বেশি কথা বোলো না।
ইন্দ্রাণী ক্ষীণ স্বরে বলল, আমার কিছু হয়নি। এরা মিছিমিছি ব্যস্ত হচ্ছে। বলতে বলতে চোখ খুলেছে, তিতির, তোর ডাক্তার আঙ্কলকে চা দে।
তিতির উঠতে যাচ্ছিল, শুভাশিস বাধা দিল, কিচ্ছু লাগবে না। তুই বোস।
জ্বরের তাপে ইন্দ্রাণীর মুখ টকটকে লাল। দু চোখ রক্তাভ। তার পায়ের দিকে দাঁড়িয়ে আছে কন্দর্প! কুয়াশা মেখে সেও যেন কেমন ঘোলাটে।
ইন্দ্রাণী আবার চোখ বুজল। একবার মনে হল বাবার হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাটা বলে শুভাশিসকে। ঠোঁট নাড়তেও ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া বলেই বা লাভ কী? শুভ কি আর দিনটাকে মনে রেখেছে? তনুকেই হয়তো ভুলে গেছে শুভ!
শুভাশিস আর কন্দর্প নিচু স্বরে কথা বলছে। এলোমেলো কথা। শুনতে না চাইলেও কথাগুলো আবছাভাবে কানে আসছিল ইন্দ্রাণীর।
শুভাশিস বলছে, সময়টা ভাল নয়। সিজন চেঞ্জের টাইম, চারদিকে খুব জ্বরজারি হচ্ছে। ভোগাচ্ছেও খুব।
কন্দর্প বলল, আমাদেরই ভুল হয়ে গেছে। প্রথম দিকে পাত্তা দিইনি…ডাক্তার দেখানো হল তো এই পরশু।
হুঁ, যে অ্যান্টিবায়োটিকটা দিয়েছে, ওটা কাজ শুরু করতে কদিন টাইম লাগে। কটা ক্যাপসুল পড়েছে রে তিতির?
ছটা।
এবার কমবে। দেখিস খাওয়া দাওয়াটা যেন ঠিক মতো করে। এ সময়ে অবশ্য জিভে স্বাদ থাকে না, তবু জোর করে খেতে হবে।
কন্দর্প বলল, আমার মনে হয় বউদির জ্বরটা শুধু সিজন চেঞ্জের জ্বর নয়। অত বড় একটা টেনশান গেল…..
-কিসের টেনশান?
ইন্দ্রাণী হঠাৎ প্রলাপগ্রস্তের মতো চেঁচিয়ে উঠল, আহ চাঁদু, তোমরা থামবে? আমার অসুখ ছাড়া কি কোনও কথা নেই?
কিছুক্ষণের জন্য গোটা ঘর নীরব। মাথার ওপর পাখাটাই যা শব্দ করে চলেছে একটানা।
খানিক পরে আবার সহজ গলায় কথা শুরু করেছে কন্দর্প। পরিবেশ হালকা করতে চাইছে। শুভাশিসকে প্রশ্ন করল, – কবে নাগাদ স্টার্ট হচ্ছে নার্সিংহোম?
শুভাশিস জোরে একটা শাস ফেলল। এত জোর যে তার নিশ্বাসের শব্দটাও অনুভব করতে পারল ইন্দ্রাণী। বুকটাকে খালি করে আলগা গলায় উত্তর দিচ্ছে শুভ, ভেবেছিলাম তো মহালয়ার দিনই স্টার্ট করে দেব। এদিকে আবার একটা ফ্যাকড়া বেধে গেছে।
-কীরকম?
আর বোলো না, আজ দুপুরে আমার পার্টনারের কাছে করপোরেশানের এক লোক এসে হাজির। নানান ধরনের ভ্যানতাড়া শুরু করেছে হঠাৎ। কিসব নাকি আইন আছে, কোনও রেসিডেন্সিয়াল বাড়ির গোটাটাকেই নার্সিংহোম করা যাবে না। তার ওপর যেহেতু বাড়িটা পুরনো, করপোরেশানের ইঞ্জিনিয়ারকে দিয়ে একটা স্পেশাল সার্টিফিকেটও নিতে হবে।
কীসের সার্টিফিকেট?
বাড়িটা সেফ কিনা, ভেঙে পড়ে রুগীদের প্রাণহানি ঘটাবে কিনা, এই সব আর কি। যত সব ফালতু ব্যাপার। সেকেন্ড প্রবলেমটা অবশ্য মিটে যাবে। দু-চার হাজার গুঁজে দিতে হবে হাতে। প্রথম ফ্যাকড়াটাই ভোগাবে মনে হচ্ছে। লোকটা আমার পার্টনারকে নার্সিংহোম অ্যাক্ট ফ্যাক্ট দেখিয়ে ভীষণ ভয় দেখিয়ে গেছে।
–তাহলে কী করবেন এখন? বাড়ির কিছুটা পোরশান ছেড়ে দেবেন?
–নো চান্স। পনেরো-বিশ লাখ টাকা ঢালা হচ্ছে কি মুখ দেখতে? বাড়ির একটা সেন্টিমিটার ছাড়ব না। আমার পার্টনারের সঙ্গে গোটা তিন-চার কাউন্সিলারের খাতির আছে। দরকার হলে তাদেরকে দিয়ে চাপ দেওয়াব। আরে বাবা, কিছু খেতে চাইছিস, সেটা খোলসা করে বল। পাঁচ-দশ হাজার আরও দিয়ে দিচ্ছি।
–কিন্তু শুভাশিসদা, সব জায়গাতেই তো কিছু তেএঁটে বদখত লোক থাকে। ধরুন এমন লোকের পাল্লায় পড়লেন যে লোকটা টাকাই নেয় না, তখন?
ছাড়ো তো, টাকা আবার নেয় না! রেটের হয়তো বেশি কম থাকে। শুভাশিসের গলা একটু চড়েছে, বুঝলে ভাই, সততা, দুর্নীতি, সব কিছুকেই আমরা অপটিমাম লেভেল অবধি মেনে নিতে পারি। সতোরও একটা টলারেবল লিমিট আছে। তোমার যদি নিজের কিছু নেওয়ার না থাকে, তুমি ফাইলটা পাশের টেবিলে পাঠিয়ে দাও। নিজের সততা নিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না, সেটা হবে শুচিবায়ুগ্রস্তের কাজ। সেটা লোকে সহ্য করবে কেন? ঠিক তেমনি কোনও কাজের জন্য পাঁচ-দশ হাজার টাকা নেওয়াটা যদি দস্তুর হয়, নিয়ে নাও। তার জন্য কেউ তোমাকে চোর বলতে যাচ্ছে না। কিন্তু সেই কাজের জন্যই তুমি যদি পঞ্চাশ হাজার, এক লাখ দাবি করে বসো, আমি তোমাকে ছাড়ব কেন! আরে বাবা, আমি তো ডাক্তার। চোর জোচ্চোর স্মাগলার নই। একথাও তো তাদের বুঝতে হবে।
কন্দর্প হাসতে হাসতে বলল, গোটা বাড়ি যদি নার্সিংহোম করার নিয়ম না থাকে, তাহলে কিন্তু আপনার কাজটা একটু রিস্কি হয়ে যাবে শুভাশিসদা। আজ হয়তো কিছু হল না, নার্সিংহোম স্টার্ট করে দিলেন, কাল যদি কোনও বিপদে পড়ে যান?
সব আইনেরই ফাঁক থাকে রে ভাই। তেমন হলে আমাদের সেটা খুঁজে বার করতে হবে। বার করাও এখন কিছু কঠিন নয়। তার জন্য উকিল ব্যারিস্টাররা সব মুখিয়ে আছে। শুভাশিসও হাসছে, সমাজ হল আমাদের এই শরীরটার মতনই। জার্ম আছে, ব্যাকটিরিয়া আছে, ভাইরাস আক্রমণ করছে, আমরাও লড়ে লড়ে বেঁচে আছি। কিন্তু ভেবে দ্যাখো, কোনও শরীর যদি একদম জার্ম ফ্রি হয়, দ্যাট ইজ অলসো ভেরি ডেঞ্জারাস। সে শরীর বাঁচবেই না। মজা কি জানো, ওই জার্মগুলোই শরীরে ইমিউনিটি তৈরি করে। তবে তারা বাড়াবাড়ি শুরু করলে, তাদের জন্যও রাস্তা আছে। ওই অ্যান্টিবায়োটিক। তোমার বউদি যা খাচ্ছে।
কন্দর্প আবার কি যেন প্রশ্ন করল, শুভাশিস আবার কি বলে চলেছে একটানা। ইন্দ্রাণী আর ঠিক ঠিক শুনতে পাচ্ছিল না। শুভাশিসের আগের কথাগুলোই কেমন বিচিত্র লাগছিল তার। কফিহাউসে কি যেন সব বলত শুভ? একটা পচাগলা সমাজ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছে! ধনিকশ্রেণী সমাজকে তো শোষণ করছেই, তার সঙ্গে মধ্যবর্তী সুবিধাভোগী শ্ৰেণীও এই রাষ্ট্রব্যবস্থার সুবিধে নিয়ে সুযোগ পেলেই শোষণ করে অন্যদের! ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, উকিল, কেরানি, ছোট ব্যবসায়ী, মাঝারি ব্যবসায়ী, পাড়ার মুদি থেকে পার্কস্ট্রিটের ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, সরকারি আমলা, বেসরকারি আমলা, কেউ এর ব্যতিক্রম নয়! এই সমাজটারই খোলনোলচে বদলে ফেলে….!
ইন্দ্রাণীর বমি পাচ্ছিল। সামনে যে মধ্যবয়সী মানুষটা কন্দর্পকে সমাজের রীতি প্রকৃতি বোঝাচ্ছে, সেই কি কফিহাউসের শুভাশিস? নাকি শুভাশিসেরই খোলস পরে অন্য কেউ শুভাশিস সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে? ইন্দ্রাণীরই মতো?
ইন্দ্রাণী তিতিরের হাত চেপে ধরল, আমি একটু বাথরুমে যাব রে।
শুভাশিস কন্দর্প কথা থামিয়ে হাঁহাঁ করে উঠেছে, কী হল?
ইন্দ্রাণী নিরুত্তর। তিতিরের কাঁধে ভর রেখে এগোচ্ছে বাথরুমের দিকে। দরজা বন্ধ করে বেসিনে ওয়াক ওয়াক করল খানিকক্ষণ। কিছুই বেরোল না। উল্টে পেটটা মুচড়ে উঠছে, ভারী রেলের ইঞ্জিন ঝমঝম শব্দ তুলে ছুটছে মাথায়। মুখে চোখে একটু জল ছুঁইয়ে সামান্য প্রকৃতিস্থ হল। বেরিয়ে এসে দেখল, আদিত্য এসে গেছে। প্যাসেজে দাঁড়িয়ে কথা বলছে রুনার সঙ্গে।
রুনা বলল, কি হল দিদি, বমি করলে? এত কাঁপছ কেন?
আদিত্য তুরন্ত এগিয়ে এল। ধরেছে ইন্দ্রাণীকে। উদ্বিগ্ন গলায় বলল, খুব শরীর খারাপ লাগছে?
ইন্দ্রাণী পা দুটোকে শক্ত রাখার চেষ্টা করল, না। কী বলল ডাক্তার? ব্লাড রিপোর্ট দেখে?
বলল, ম্যালেরিয়া নয়। ইনফ্লুয়েঞ্জাই। তবে কাল-পরশুর মধ্যে জ্বর না কমলে হাই টেম্পারেচারের সময় আরেক বার ব্লাড করাতে হবে।
দু পাশে আদিত্য আর তিতিরকে নিয়ে টলমল পায়ে ঘরে ফিরছে ইন্দ্রাণী। গলাটা বড় শুকিয়ে গেছে। তেতো। এক ঢোঁক জল একটুক্ষণ মুখে রেখে গিলে নিল। যদি তেতো ভাবটা কাটে। চোখ বন্ধ করে শোওয়ার আগে একবার দেখল শুভাশিসকে। কেমন ধোঁয়াটে অবয়বহীন লাগছে শুভকে।
তিতির প্রশ্ন করল, তোমার খাবার আনব মা? একটু কিছু খেয়ে নেবে?
–ভাল লাগছে না রে।
শুভাশিস কোমল ধমক দিল, ওরকম করে না। শরীর আরও দুর্বল হয়ে যাবে। যা পারো সামান্য কিছু খাও।
শরীর কী শুভ! খাঁচা! কাঠামো! খোলস!
প্রাণ কি শুধুই এক চিলতে বাতাস!
.
উৎকট হরিধ্বনি দিতে দিতে যাচ্ছে এক দল শববাহক। রাতের স্বল্পস্থায়ী নাগরিক নির্জনতা ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে তাদের চিৎকৃত উল্লাসে। ইটপাথরের জঙ্গলে প্রতিধ্বনি আর্তনাদ হয়ে ফিরছে বার বার।
ইন্দ্রাণীর ঘুম ভেঙে গেল। ঘামে জবজবে হয়ে গেছে শরীর। বিছানাও ভিজে সপসপ করছে। হরিধ্বনি মিলিয়ে গেছে, তবু যেন তার রেশ এখনও রয়ে গেছে হাওয়ায়।
উঠে বসতে গিয়ে ইন্দ্রাণী অবাক হল। সন্ধেরাতের ভারী মাথাটা তুলোর মতো হালকা। বেশ ঝরঝরে লাগছে নিজেকে!
বেডসুইচ টিপে আলো জ্বেলে বিছানা ছাড়ল ইন্দ্রাণী। তিতির অকাতরে ঘুমোচ্ছে। মশারির বাইরে থেকে ইন্দ্রাণী একবার দেখে নিল মেয়েকে। ভেজা ব্লাউজটা বদল করল। পা এখনও কাঁপছে অল্প অল্প। শিথিল পায়ে জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়াল। খুলে দিল বন্ধ জানলা।
শুক্লপক্ষের রাত ভরে আছে এক মলিন জ্যোৎস্নায়। মিহিন মেঘের চাদরে ঢেকে আছে পঞ্চমীর চাঁদ। বড় পাণ্ডুর, কৃশ দেখাচ্ছে চাঁদকে। একটু একটু হিম ভাবও যেন এসে গেছে বাতাসে।
বাথরুমে যাওয়ার জন্য নিঃশব্দে ভেজানো দরজা খুলল ইন্দ্রাণী। প্যাসেজের বাতিটা জ্বলছে। নিবিয়ে দিতে গিয়ে বাপ্পাদের দরজায় চোখ পড়ল। দরজাটা ফাঁক হয়ে আছে।
দরজাটাকে টেনে দিতে গিয়ে ইন্দ্রাণী থমকেছে। প্যাসেজের আলো টেরচাভাবে গড়িয়ে আছে অন্ধকার ঘরে। সেই আলোতে পরিষ্কার দেখা যায় লম্বাটে রোগা শরীরটাকে। আধো আঁধারেও পিঠের ঠেলে ওঠা হাড় দুটো তাকিয়ে আছে যেন।
আদিত্য দাঁড়িয়ে আছে জানলায়। ঘুমোয়নি।
.
২৫.
গাট্টাগোট্টা ছেলেটা টুলে দাঁড়িয়ে একটানা বক্তৃতা করে চলেছে। হাত-পা ছুঁড়ে। মাথা ঝাঁকিয়ে। দেশ কাল সমাজ রাজনীতি কিছুই তার অজানা নেই। একটা একটা করে নেতাকে ধরছে, আর তার মুখোশ খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে কলেজগেটের বাইরে।
ধীমান বিরস মুখে বলল, –এ তো চৌষট্টি বগির মালগাড়ি রে! চলছে তো চলছেই।
এণাক্ষী গাল ফোলাল, –পাক্কা পঁচিশ মিনিট হয়ে গেল। এবার অন্তত থামুক।
–আর থেমেছে। দিনটাই আজ গন।
বাপ্পারও মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। কলেজে এসে ইকনমিকস আর রিসোর্স স্টাডিজ-এর ক্লাসটা সেরে আজ একবার পাসপোর্ট অফিসে যাবে ভেবেছিল বাপ্পা। দেড় মাস হয়ে গেল পাসপোর্টের ফর্ম জমা দিয়েছে, এখনও পুলিশ এনকোয়্যারির নামগন্ধ নেই! কী যে হচ্ছে আরেকবার গিয়ে দেখা দরকার। বড়কাকা বলে দিয়েছে আজ একবার বাপ্পা গিয়ে খোঁজটা নিয়ে আসুক, কাজ কিছু না হয়ে থাকলে বড়কাকার কোন চেনা ট্রাভেল এজেন্ট আছে, তাকেই লাগাবে বড়কাকা।
কিন্তু বাপ্পা এখন বেরোবে কী করে? এই যা শুরু হয়ে গেছে! আজকাল মিটিং থাকলেই ইউনিয়নের ছেলেরা কলেজের গেট বন্ধ করে দেয়। না দিয়ে উপায়ও নেই। শুধু মিটিং শোনার জন্য পাঁচ মিনিটও কলেজে থাকতে চায় না ছেলেমেয়েরা।
নাহ, সত্যিই বাপ্পার সময়টা এখন ভাল যাচ্ছে না। বম্বে থেকে ফেরার পর মনে খানিকটা হাওয়া-বাতাস খেলছিল, সেই ভাবটা ক্রমশ মরে আসছে যেন। ওশান লাইনার্স শিগগিরই চিঠি পাঠাবে বলেছিল, এখনও চিঠির চ দেখা যাচ্ছে না। পাসপোর্টের তো ওই ঝুলন্ত দশা। এর সঙ্গে একটার পর একটা উটকো ঝামেলা লেগেই আছে। কোথাও কিছু নেই, দাদু হঠাৎ মানিকতলা থেকে শিয়ালদা গিয়ে হারিয়ে গেল! তাকে খুঁজতে গিয়ে মা এক জব্বর অসুখ বাধিয়ে বসল। অসুখের বাহানায় বাড়ির লোকজনের মধ্যে বেশ একটা মিলমিশ হচ্ছিল, বিশ্বকর্মা পুজোর দিন তাও চোট। এবার বেশ ঘটা করেই বিশ্বকর্মা পুজো করেছিল মা। নিজে হাতে বিরিয়ানি বেঁধেছিল, খোঁচো দাদুটাকে চাখতে দিয়ে সে কী বিপত্তি! মাঝরাতে উঠে হাহা করছে বুড়ো। বুক জ্বলে যাচ্ছে, গলা জ্বলে যাচ্ছে, এই যেন যায় যায়। ওষুধ-টোষুধ পড়ে কমল বটে, কিন্তু কাকিমা ঝুড়ি ঝুড়ি কথা শুনিয়ে দিল মাকে। ব্যস, তারপর থেকে মা আবার গুম। কাজকর্ম করছে, কথাবার্তা বলছে, কিন্তু মুখোশটি আবার এঁটে নিয়েছে মুখে। জানে বুড়োর দৃষ্টিক্ষিধে, তবু কেন তাকে ওসব গিলতে দেওয়া! এরই মধ্যে বাপ্পার অত দামি জাপানি ঘড়িটা ছিনতাই হয়ে গেল ভিড় বাসে! বাবার দোস্ত তান্ত্রিকটাকে দিয়ে একটা শান্তি-স্বস্ত্যয়ন করালে কেমন হয়!
বাপ্পা বেজার মুখে জিজ্ঞাসা করল, –আই শেখর, কটা বাজে রে?
শেখর ধীমান এণাক্ষীরা কলেজ বিল্ডিং-এর সিঁড়িতে গিয়ে বসেছে। শেখরের আগে ধীমান পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ল, –তোর কটা চাই?
-ফাজলামি রাখ। টাইম বল।
ইন্ডিয়ান টাইম বলব? না জি এম টি বলব? চাইলে মস্কো নিউ ইয়র্কের টাইমও বলতে পারি।
বাপ্পা রেগেমেগে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
ধীমান চেঁচাচ্ছে, –চটিস কেন? তোর যদি জাহাজের চাকরিটা মিলে যায়, তোকে তখন কতগুলো স্ট্যান্ডার্ড টাইম হিসেবে রাখতে হবে জানিস?
প্রসঙ্গটা বন্ধুদের সামনে বেশি আলোচনা করতে চায় না বাপ্পা। এমনিতেই তো সবাই তাকে টিজ করে সারাক্ষণ, এরপর যদি কোনও কারণে না যাওয়া হয় তা হলে তো হ্যাটা দিয়ে দিয়ে পাগল করে দেবে।
শেখরের কাছে এসে ঘড়িটা নিজের চোখে দেখে নিল বাপ্পা। একটা চল্লিশ। মুখ বিকৃত হয়ে গেল আপনাআপনি, ধুস, ক্লাস না হয়ে এই সব ক্যাচাল হবে জানলে কলেজে ঢুকতাম না।
–যেতিস কোথায়? সিনেমা?
–আমি তোদের মতো অত সিনেমার পোকা নই। আমার অনেক কাজ থাকে।
কাজ মানে তোর সেই গঙ্গার ধার?
শেখরের কথায় এণাক্ষী ধীমানরা মুহূর্তে কৌতূহলী হয়ে উঠেছে, মানে?
জানিস না? ও এখন রোজ বিকেলে গঙ্গার ধারে গিয়ে চুপটি করে বসে থাকে। ফোঁস ফোঁস দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
–ওমা, তাই নাকি? এণাক্ষী হিহি হাসছে, –কেন রে ইন্দ্রনীল, তোর এত কিসের দুঃখ?
ভেতরে ভেতরে জ্বলে গেলেও বাইরে উদাসীন থাকার চেষ্টা করল বাপ্পা। নদীর ধারে বসে থাকার গল্পটা কেন যে বলতে গিয়েছিল শেখরকে! কাউকে কি একটুও মনের কথা শোনানোর উপায় নেই!
আজকাল এই এক নেশা হয়েছে বাপ্পার। বিকেল হলেই নদী কেমন টানতে থাকে তাকে। গঙ্গার ওপারে আকাশ বেয়ে তরতর নামতে থাকে সূর্য, নদীর পশ্চিম পাড় ছেয়ে যায় এক অলৌকিক আলোয়। লাল নয়, হলুদও নয়, ঠিক কী যে রঙ! ওই বিভা মেখে দুরের কারখানার চিমনিগুলোও কেমন অপার্থিব তখন। ইটবালির কাঠামোরা যেন স্বর্ণরেণু মাখা। বাপ্পার বুক দুলতে থাকে। উজান স্রোতে ভেসে যায় খড়কুটো, কচুরিপানা। তিরতির কাঁপতে থাকে সোনার কুচির মতো ঢেউ। বাপ্পাও ভাসে তাদের সঙ্গে। স্রোত বেয়ে পাড়ি দেয় বহু দূর। অসমাপ্ত হুগলি সেতুর দুই ডানা বাপ্পার জন্য তোরণ তৈরি করে রেখেছে। সেই তোরণ পেরিয়ে, অজস্র জনপদ দুধারে ফেলে, ভাসমান লঞ্চ নৌকোদের কাটাতে কাটাতে বাপ্পা পৌঁছে যায় মোহনায়। বঙ্গোপসাগর থেকে ভারত মহাসাগরে গিয়ে পড়ে। ভারত মহাসাগর থেকে লোহিত সাগর, সেখান থেকে সুয়েজ, সুয়েজের সুড়ঙ্গ ভেদ করে ভূমধ্যসাগর, অতলান্তিক…। ধীরে সন্ধ্যা ঘনায়। আউটরাম ঘাটের খোলা জেটিতে গিয়ে তখন দাঁড়ায় বাপ্পা। নদী একটা আঁশটে গন্ধ ছড়ায়, আশ্চর্য এক বাষ্প ওঠে জল থেকে। বাষ্প, না নদীর নিশ্বাস? বাপ্পার বুক জুড়িয়ে আসতে থাকে। নদীর নাব্যতা এখন কমে গেছে, বড় জাহাজ খুব একটা আসে না নদীতে। যা দু-একটা মাঝারি আসে, তন্ময় চোখে তাদেরই ফুটে ওঠা আলোগুলোকে দেখে বাপ্পা। গাঢ় নীল অন্ধকারে আলো ঝলমল জাহাজ কেমন অলীক মনে হয়। অদ্ভুত এক তৃপ্তি আর অতৃপ্তির ঘোরে বাপ্পা তলিয়ে যেতে থাকে। এক সময়ে ফেরে। নেশাচ্ছন্ন চোখে আবার এই শহর, সেই বাড়ি, সেই একঘেয়ে কিছু মুখ। বড় যন্ত্রণা হয় বাপ্পার।
এসব কথা বাপ্পার বন্ধুরা কী বুঝবে!
বাপ্পা ফ্যাকাসে মুখে হাসল, –গঙ্গার ধারে যারা যায়, সবাই কি দুঃখ সেলিব্রেট করতে যায় নাকি? তোরা তো আইসক্রিমও খেতে যাস।
একা একা তো যাই না! তোর মতো!
–আমার ভিড় ভাল লাগে না।
–হ্যাঁ রে ইন্দ্রনীল, তুই কবি টবি হয়ে যাচ্ছিস না তো! এণাক্ষী ভুরু কুঁচকে নিরীক্ষণ করল বাপ্পাকে, –তোকে অবশ্য অ্যাংরি পোয়েট খারাপ মানাবে না। কিন্তু তোকে তো তা হলে একটু দাড়ি, রাখতে হবে। আর চুলটা…।
বাজে কথা রাখ তো! যা দেখে আয় ওই ভ্যানতাড়া কখন শেষ হবে।
–এখন নো চান্স। দেখছিস না এবার সুরূপা উঠেছে। এর পরও গোটা তিনেক আছে।
সুরূপা নামের মেয়েটি টুলে দাঁড়িয়ে চিলচিৎকার জুড়েছে। সরু গলায়। ইঁদুরকলে আটক কলেজ পড়ুয়ার দল যে যার নিজের নিজের আড্ডায় বিভোর। কলেজের চাতালে। সিঁড়িতে। করিডোরে। গেটের কাছেই শুধু যা জনাবিশেক ছেলেমেয়ের রাজনৈতিক জটলা। তাতেই মেয়েটি খুব উদ্দীপিত, ঝাঁঝ ছড়াচ্ছে পুরোদমে।
ভাবনা ফিসফিস করে বলল, সুরূপাটা বড় বেশি অ্যাটাকিং লেকচার দিচ্ছে। যেভাবে নাম ধরে ধরে চোরফোর যা খুশি বলে যাচ্ছে…
শেখর বলল, বলবেই তো। ফরেন থেকে আর্মস কিনতে গিয়ে কাটমানি খাবে, সুইস ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট ফোলাবে….
ফালতু বকিস না তো। প্রমাণ হয়েছে কিছু? যতক্ষণ না প্রমাণ হচ্ছে, ততক্ষণ কাউকে চোরজোচ্চোর বলাটা কী ধরনের লজিক?
বা রে, প্রমাণ না হলে চুরিটা বুঝি চুরি থাকে না?
–অবশ্যই না। ধীমান গলা চড়াল, যারা চোর চোর করে চেঁচাচ্ছে, তারাই বা কী এমন ধর্মপুতুর রে? কলেজে অ্যাডমিশানের সময়ে ইউনিয়নের নাম করে যার কাছ থেকে যা পারল একশো টাকা দুশো টাকা খামচে নিল, সেই টাকাগুলো নিয়ে কী করেছে এরা? পারবে এখন হিসেব দিতে?
–এই চুপ চুপ। করছিস কি! এণাক্ষী চিমটি কাটল ধীমানকে, চারদিকে ইউনিয়নের ছেলেমেয়ে ঘুরছে, কে কোথায় শুনবে…।
–শুনুক গে। আই ডোন্ট কেয়ার। ওই সব দলবাজি নেতাবাজি জানা হয়ে গেছে আমার। যার পাঁচ পয়সার মুরোদ সে পাঁচ পয়সা চুরি করে, যার পাঁচ কোটির এলেম আছে সে পাঁচ কোটি মারে। এই নিয়ে এত শোর মাচানোর কি আছে?
–শোর মাচাচ্ছে না, বল ভাট বকছে। ধীমানের কাঁধে হাত রাখল শেখর, -বেচারা মিনি লিডার হয়েছে, ওকে তো রুটিন লেকচার দিয়ে যেতেই হবে। তোর ভাল না লাগলে তুই ডায়েরিয়া হওয়া মুখ করে চুপচাপ বসে থাক।
–তাই তো আছি রে বাপ। কিন্তু আর কতক্ষণ? একদিনও ঠিকমতো ক্লাস হচ্ছে না, রোজ মিটিং, রোজ মিটিং! প্রিন্সিপালও যখন-তখন ক্লাস ডিজলভ করে দিচ্ছেন…! ভাল্লাগে?
বারে, সামনে ইলেকশান আসছে না! মনে রাখিস ধীমান, তুই এখন একজন দায়িত্বশীল সিটিজেন। এবার প্রথম ভোট দিয়ে তোর ডেমোক্র্যাটিক রাইট এস্ট্যাবলিশ করবি। তোকে তো এখন বুকনি শুনতেই হবে। ডান, বাঁ, কম ডান, বেশি বাঁ, সব্বার।
–সে তো শুনছিই। রাস্তায় ঘাটে পাড়ায় পোস্টারে কোথায় শুনছি না?
কলেজেও শোন।
–শুনতে শুনতে কালা হয়ে যাব যে।
কালা হতে পারলে তুই তো বেশ গুড সিটিজেন হয়ে গেলি। রিঅ্যাক্ট করার ঝামেলা অনেকটা কমে গেল। আমার বাবার এক মামা আছেন, ফ্রিডম ফাইটার। টেররিস্ট গ্রুপে ছিলেন। আন্দামানে জেলও খেটে এসেছেন। কিসব বিল্বপত্র তাম্রপত্র দিয়েছিল গভর্নমেন্ট, নেননি। সেই বুড়োদাদু কী বলেন জানিস? বলেন গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার জন্য দরকার লাখ লাখ বোবা কালা আর ঠুলিআঁটা সিটিজেন। তাদের একটা হাত শুধু সচল থাকলেই চলবে। ব্যালট পেপারে ছাপ মারার জন্য। আর ছাপ মারাটা হল এমনই এক ম্যাজিক, ওই ছাপের জোরে যে গদিতে বসবে, সেই মাল ঠিইক ছাঁচে পড়ে যাবে। পয়সা খাবে, চুরি করবে, গুণ্ডা পুষবে, ঝুড়িঝুড়ি মিথ্যে কথা বলে যাবে..। কথায় আছে না, যেই যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ! দাদু বলেন ডেমোক্র্যাসিতে নেতারা শুধু রাবণ নয়, কুম্ভকর্ণও বটে। কুম্ভকর্ণ ছ মাসে একদিন জাগত, এরা জাগে পাঁচ বছরে একবার। মাঝের সময়ে তুই ওদের কান ধরে টান, খিমচো, সুড়সুড়ি দে, কানের পাশে স্যাক্সোফোন বাজা, বডিতে গজাল ঠোক, নো হিলদোল।
অ্যাই, তোর দাদুয়ালি গান থামা তো। নয়তো বল তোকেও একটা টুল দিই। সুরূপার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে যা।
–দিবি টুল? না থাক। বেচারা লাইনে সবে শাইন করছে, আমি টুলে উঠলে ওর ভাত মারা যাবে।
শেখর আড়মোড়া ভাঙল, কী রে ইন্দ্রনীল, তুই ব্যোম মেরে দাঁড়িয়ে আছিস যে? কমেন্ট দে।
মন ভাল না থাকলে কোনও কচকচানিই ভাল লাগে না। দাঁত কিড়মিড় করে বাপ্পা বলল, –সব্বাইকে গুলি করে মারা উচিত। আমার হাতে যদি একটা মেশিনগান থাকত!
কাকে আগে মারতিস?
বাপ্পা হোঁচট খেল সামান্য। যেন বা একটু ধাঁধায় পড়ে গেল। প্রথম গুলিটা কার প্রাপ্য? ওই টুলের সুরূপার? নাকি এই মুহূর্তের অসহ্য বন্ধুবান্ধবদের? না চোখের সামনে বিষের মতো ঘুরতে থাকা শহরজোড়া পিলপিল গড্ডালিকার? উঁহু, চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম। ওই নিশ্চিহ্ন করার কাজটাও বাড়ি থেকেই শুরু হওয়া উচিত। আচ্ছা, সবার আগে ডক্টর শুভাশিস সেনগুপ্তটাকে হঠালে কেমন হয়? হাসি হাসি মুখ, তেলতেলে কথা, চুকচুকে চেহারার লোকটা মেশিনগানের গুলিতে ছেতরে পড়ে আছে…! নট আ ব্যাড সাইট। নাকি আগে আদিত্যবাবুকে সাফ করবে?
কী রে, ভেবে পাচ্ছিস না তো? ধীমান খোঁচাল বাপ্পাকে।
এণাক্ষী বলে উঠল, আমি বলছি। আমি বলছি। ইন্দ্রনীল প্রথম গুলি করবে সেদিনের সেই সিনেমা হলের ছেলেটাকে।
-সত্যি কিছু রাগ আছে বটে ইন্দ্রনীলের। ভাবনা হাসছে মুখ টিপে, – এমন একটা কাণ্ড বাধাল!
ঘটনাটা গত সপ্তাহের। বন্ধুরা দল বেঁধে সিনেমায় গিয়েছিল, বাপ্পা দাঁড়িয়ে ছিল টিকিটের লাইনে। হঠাৎই একটা চালিয়াত ধরনের ছেলে বেলাইনে এসে কাউন্টারে হাত গলিয়ে দিল। ব্যস, বাপ্পাও সঙ্গে সঙ্গে কলার টেনে ধরেছে ছেলেটার। দেখতে দেখতে খণ্ডযুদ্ধ শুরু। বন্ধুরা বাপ্পাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার পরও সে যে কী সিন! বাপ্পা মাটিতে পা ঠুকছে, ছেলেটাও তড়পাচ্ছে রাগে। দুজনেরই গলা থেকে আওয়াজ বেরোচ্ছে গরগর। শেষ পর্যন্ত অবশ্য দমের অভাবে ছেলেটাই নিবে। যায়।
ধীমান বোধহয় সেই রণক্ষেত্রেরই বিশেষ কোনও খণ্ডদৃশ্য স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে এণাক্ষীকে, হাসিতে কুটিপাটি হচ্ছে এণাক্ষী, যাই বল, ইন্দ্রনীলের অ্যারোগেন্ট চেহারাটা কিন্তু ভীষণ কিউট। ওকে সেদিন একদম মেল গিবসনের মতো লাগছিল না?
ধ্যাত। মেল গিবসনের হাইট জানিস? ভাবনা প্রতিবাদ করল, গিবসন সিক্স ফিট প্লাস। চেহারাও কত রোবাস্ট!
–তবু কোথায় যেন একটা মিল আছে। এণাক্ষী ঠেলা দিল বাপ্পাকে, — কী রে ইন্দ্রনীল, যাবি নাকি একটা গিবসনের ফিল্ম দেখতে? নিউ এম্পায়ারে? বাপ্পা গম্ভীর, – না, বললাম তো আমার কাজ আছে।
কী ছাতার মাথা কাজ?
–আছে।
বাড়ির কাজ?
–এত জেরা করছিস কেন বল তো? বাপ্পা বেশ রুক্ষ এবার, বলছি তো আমি সিনেমায় যাব না। আমার নিজের কোনও ইচ্ছে অনিচ্ছে নেই? সব সময়ে তোদের সঙ্গে ল্যাঙল্যাঙ করে ঘুরতে হবে?
ধীমান শান্ত করার চেষ্টা করল বাপ্পাকে, — চটছিস কেন? গেলে পারতিস। তুই তো অ্যাকশান ফিল্ম ভালবাসিস।
–সত্যিই ভাল লাগছে না রে। আমার একটা জরুরি কাজও আছে। বিলিভ মি।
বাপ্পার আকস্মিক রূঢ়তায় এণাক্ষীর মুখ থমথমে হয়ে গেছে। চিমটি কাটার মতো করে বলল, ওকে ছেড়ে দে ধীমান। বিষ্ণুপ্রিয়া নেই তো, ও যাবে না। হ্যাঁ রে ইন্দ্রনীল, বিষ্ণুপ্রিয়া আজ ডুব মেরেছে কেন?
–আমি কী জানি? বাপ্পা হেসে ফেলল। বিষ্ণুপ্রিয়া এণাক্ষীকে দেখায়, এণাক্ষী বিষ্ণুপ্রিয়াকে! হাসিটা মুখে রেখেই বলল, – বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে আমার কী?
–বেশ। কিছু যে নেই সেটা প্রমাণ করার জন্যই আজ চল।
শেখর চোখ টিপল, অ্যাকশন ফিল্ম না যাস, রোমান্টিক চল। গ্লোবে। দারুণ ভিড় হচ্ছে।
–সে তো কাঁড়ি কাঁড়ি বেডসিনের জন্য।
এণাক্ষী ঠেটি উল্টোল, হট ফিল্ম দেখতে তোদের খুব মজা লাগে, না?
–হুঁহ, তোদের যেন লাগে না! স্ট্যালোনের বই দেখতে ছুটিস কেন? শেখর বাপ্পার দিকে ঘুরল, কী রে, যাবি?
বাপ্পা উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। যাবে না যখন ঠিক করেছে তখন যাবেই না। ফালতু বকবক করে মাথা আরও গরম করার কোনও মানেই হয় না।
সুরূপা টুল থেকে নামার পর আবার একটি ছেলে উঠেছে। এ কলেজের নয়, অন্য কলেজের। বয়সটা একটু বেশি, ইউনিভার্সিটিরও হতে পারে। চিবিয়ে চিবিয়ে বেশ বক্তৃতা দিচ্ছিল, হঠাৎ বেশি আবেগ মেশাতে গিয়ে খকখক কাশতে শুরু করেছে ছেলেটা। এক অনুগামী দৌড়ে গিয়ে জলের গ্লাস ধরল তার মুখে। দুটেক খেয়ে চলকানো আবেগ সামলাল ছেলেটা। নতুন উদ্যমে শুরু করেছে ভাষণ।
বাপ্পাকে ভুলে গিয়ে বন্ধুরাও নতুন করে মশগুল আড্ডায়। শেখরের এক বন্ধু গ্লোবে ছবিটা দেখেছে, তার কাছ থেকে শোনা গল্প তারিয়ে তারিয়ে পরিবেশন করছে শেখর। বাপ্পার মতো কাটখোট্টা নয় শেখর, বেশ রসালো করে গল্প বলতে পারে। শুনতে শুনতে এণাক্ষী ভাবনারা হাসছে হিহি। টীকা-টিপ্পনীও চলছে নানারকম। চারদিকে এখন মুক্ত দুনিয়ার রব। মেয়েরাও এখন আর ছেলেদের সঙ্গে গরম ছবি নিয়ে আলোচনা করতে লজ্জা পায় না। সহপাঠী বন্ধুদের সঙ্গে তো নয়ই।
আচমকাই বাপ্পার নজর গেল করিডোরের দিকে। ক্লাসেরই আরও দু-তিনজন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে আসছে অনীক। বাপ্পা হাত তুলে ডাকার চেষ্টা করল অনীককে। যেন দেখতেই পায়নি এমন ভঙ্গিতে অনীক মুখ ঘুরিয়ে নিল।
অনীকটা যেন কেমন হয়ে গেছে! ইদানীং ভাল করে কথাই বলতে চায় না বাপ্পার সঙ্গে। যেন। বাপ্পা ইন্টারভিউ পেল, অনীক পেল না, এর পিছনে বাপ্পারই কিছু কারসাজি ছিল।
এই তো সব বন্ধু!
মিটিং ভাঙার পর বাপ্পা দ্রুত কলেজ থেকে বেরিয়ে এল। বন্ধুরা আর হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি করার আগেই।
আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ ভাসছে। সাদা মেঘ, নীল আকাশের চালচিত্রে প্রায় বকের পাখার মতো ধবধবে সাদা। ওই মেঘ বলে দেয় আকাশের আর কান্না নেই। পুজো এসে গেল।
বাপ্পা একটা ট্রামে উঠে পড়ল। আজ আর পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে লাভ নেই, পৌনে তিনটে বাজে, ওই অফিসে যে লোকটার সঙ্গে একটু মুখচেনা হয়েছে বাপ্পার, তাকে তিনটের পর কোনওদিনই অফিসে পাওয়া যায় না। তার চেয়ে বরং কাল-পরশু যাবে। আজ একবার জাহাজ কোম্পানির এখানকার অফিসটা থেকে ঘুরে আসা যাক। যদি কোনও নতুন খবর দিতে পারে ওরা।
জাহাজ কোম্পানির অফিস বলতে মূল কাগো কোম্পানির বম্বেতে যে এজেন্ট আছে, তাদেরই একটা আঞ্চলিক পোস্টাল অফিস। ছোট্ট। নেতাজি সুভাষ রোডের এক পুরনো বিল্ডিং-এর চারতলায় পার্টিশান ঘেরা ফালি ঘর। দু-তিনটে মাত্র স্টাফ, একটাই পিওন। প্রাথমিক খোঁজখবর নিতে এখানেই প্রথম এসেছিল বাপ্পা আর অনীক। তারপরও বেশ কয়েকবার এসে এসে এখানকার সকলের সঙ্গেই মোটামুটি ভাবসাব হয়ে গেছে।
এখানে এসেই বাপ্পা সুসংবাদ পেল। এই অফিসের মিস্টার পাতিল গত সপ্তাহে অফিসের কাজে বম্বে গিয়েছিলেন, তিনিই দিলেন খবরটা। লিস্ট তৈরি হয়ে গেছে, ইন্দ্রনীল রায়ের নাম আছে লিস্টে, ট্রেনিং ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে আরম্ভ হবে, অক্টোবর নভেম্বরের যে কোনও সময়ে চিঠি পেয়ে যাবে বাপ্পা।
হঠাৎই কুৎসিত বিষণ্ণ এক দিন সুন্দর হয়ে গেল বাপ্পার চোখে। অফিসপাড়ার বিজবিজে ভিড় আর তেমন অসহ্য লাগছে না। চড়া রোদ্দুরও যেন গায়ে ঠেকছে না আর। জি পি ওর সামনে একটা অন্ধ নোক বাস ধরার জন্য অসহায়ভাবে ঘুরছিল, বাপ্পা হাত ধরে বাসে তুলে দিল তাকে। ভিড়ে হাঁটতে গিয়ে দু-তিনবার ধাক্কা খেয়েও বাপ্পা কটমট করে তাকাল না।
ব্র্যান্ড রোড ধরে কিছুটা হেঁটে দাঁড়িয়ে পড়ল বাপ্পা। গঙ্গার নির্জনতা আজ আর কে যেন তেমন টানছে না। কারুর কাছে একটা যেতে ইচ্ছে করছে। বুকের মধ্যে রাগ বিরক্তি দুঃখ জমাট বেঁধে গেলে মানুষ তা একা একা বয়ে বেড়াতে পারে, কিন্তু খুশির চাপ বড় অসহ্য। খুশিটাকে কারুর কাছে উজাড় করে না দিতে পারা পর্যন্ত কেমন যেন শান্তি হয় না।
কাকে গিয়ে শোনানো যায় খবরটা!
.
বিষ্ণুপ্রিয়ার মা দরজা খুলেছে। বাপ্পাকে দেখে এক গাল হেসে বলল, তুমি যে আজকাল ডুমুরের ফুল হয়ে গেছ ইন্দ্রনীল! এত কাছে থাকো, অথচ একটি বারও আসো না… বাপ্পা লাজুক হাসল, এই তো এলাম। আপনি আজ অফিস যাননি মাসিমা?
–আজ একটু পুজোর বাজার করতে বেরিয়েছিলাম। পিয়া আর আমি।
–ও। তাই আজ বিষ্ণুপ্রিয়া কলেজ যায়নি! বাপ্পা এদিক-ওদিক তাকাল, কখন ফিরলেন? এক্ষুনি?
–এই আধ ঘণ্টা হল এসেছি। যাও না, পিয়া ঘরেই আছে।
নিজের ঘরে টান টান শুয়ে আছে বিষ্ণুপ্রিয়া। হাত দুটো ছড়ানো। চোখ বুজে টেপ শুনছে। গুলাম আলির গজল। বাপ্পা ঘরে ঢোকার পরও চোখ খোলেনি।
বাপ্পার একটু একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। ঘরোয়া স্কার্ট টিশার্ট পরে শুয়ে আছে বিষ্ণুপ্রিয়া, স্কার্টটা উঠে গেছে হাঁটুর সামান্য ওপরে। বাদামি জংঘার অনেকটাই অনাবৃত। আঁটো টিশার্টের নীচে ছোট্ট দুটি স্তনও বড় বেশি প্রকট।
বাপ্পা নিজেকে ধমকাল। গলায় কি যেন আটকে গেছে, সেটাকে ঝাড়ল শব্দ করে।
চমকে চোখ খুলে উঠে বসেছে বিষ্ণুপ্রিয়া, –কী রে, তুই!
বাপ্পা স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করল, পুজোর ড্রেস কিনে খুব ফুর্তি! কলেজ কেটে এখন শুয়ে শুয়ে গজল শোনা হচ্ছে!
লাইনগুলো মুখস্থ করার চেষ্টা করছিলাম। বিষ্ণুপ্রিয়া চশমার ব্রিজ সেট করল নাকে। প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় হাঁটুর নীচে টেনে দিল স্কার্ট বুধবার বুধবার ফার্স্ট চ্যানেলে গানের একটা প্রোগ্রাম হচ্ছে দেখেছিস? রোজ একটা করে গজলের ওপর প্রশ্ন থাকে।
–তাই বল। ভেতরের খুশিটাকে কীভাবে প্রকাশ করবে ভেবে পাচ্ছিল না বাপ্পা। সত্যি বলতে কি বিষ্ণুপ্রিয়ার কাছে হঠাৎ এভাবে চলে আসার জন্য এখন কেমন যেন লজ্জাও লাগছে। বিষ্ণুপ্রিয়াকেই খবরটা প্রথম দিতে এল কেন? প্রথম কি মাকেই খবরটা দেওয়া উচিত ছিল না?
বাপ্পা খানিকটা বাধো বাধো গলায় বলল, জানিস, একটা ভাল নিউজ আছে।
-কী রে?
–আমি তো বোধ হয় চললাম। ট্রেনিং স্টার্ট হয়ে যাচ্ছে। ডিসেম্বর থেকে।
–ওমা, তাই! এ তো গ্র্যান্ড নিউজ! বিষ্ণুপ্রিয়া লাফিয়ে উঠল, তুই খালি হাতে এসেছিস কেন?
কী খাবি বল? চল, এক্ষুনি দুটো রোল খাইয়ে দিচ্ছি।
–ইশ, শুধু রোল! তুই কী কিপটে রে। একদিন পার্ক স্ট্রিটে পার্টি দে। বলেই বিষ্ণুপ্রিয়া চেঁচাতে শুরু করেছে, মা, ও মা…
বিষ্ণুপ্রিয়ার মা প্রায় তৎক্ষণাৎই ঘরে হাজির। হাতে প্লেটে করে বাপ্পার জন্য গরম প্যাটিস আর লাড্ডু। খবর শুনে সেও উচ্ছ্বসিত, বাহ, খুব ভাল খবর। তা ক মাসের ট্রেনিং?
–তিন মাস। ম্যাড্রাসে।
–তারপর কী পোস্টে দেবে?
–আপাতত ডেক ক্যাডেট। তারপর যেমন যেমন প্রোমোশন হয়।
বিষ্ণুপ্রিয়া চোখ নাচাল, প্রোমোশন হয়ে হয়ে ক্যাপ্টেন হওয়া যায়?
–শুনেছি তো হওয়া যায়।
উফ, কী দারুণ। আমি ভাবতেই পারছি না আমার এক বন্ধু ক্যাপ্টেন হয়ে জাহাজ চালিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেক দেশ ঘুরবি, না রে?
–হ্যাঁ। জাহাজ যেখানে যেখানে কার্গো নিয়ে যাবে…
বিষ্ণুপ্রিয়ার মা খাটে গিয়ে বসেছে, তোমাদের শিপিং কোম্পানিটা কি ইন্ডিয়ান?
না, না, ইন্টারন্যাশনাল। হেড অফিস সিঙ্গাপুরে। অনেক দেশে ওদের অফিস আছে। এশিয়ায়, ইউরোপে, আমেরিকায়। কনসাইনমেন্ট নিয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে পৌঁছে দেওয়াটাই মেন কাজ।
নিশ্চয়ই পয়সাকড়িও ভাল দেয়?
–তা দেয়। বাপ্পা ঘাড় নাড়ল, জব অ্যাসাইল্ড হলে প্রথম দিকে ইন্ডিয়ান কারেন্সিতে হাজার পনেরো তো দেবেই। এর সঙ্গে জাহাজে থাকা-খাওয়া, রিফ্রেশমেন্ট, এসব তো আছেই।
-খুব ভাল। খুউব ভাল।
বিষ্ণুপ্রিয়ার মা উচ্ছ্বসিত। বিষ্ণুপ্রিয়া তার থেকেও বেশি। লাফাচ্ছে। অজস্র খুঁটিনাটি প্রশ্ন করে চলেছে দুজনে, বাপ্পাও সাধ্যমতো উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। বিষ্ণুপ্রিয়ার এক পিসতুতো দাদা উনিশ বছর বয়সে এয়ারফোর্সে চলে গিয়েছিল, তাকে নিয়েও গল্প হল খানিকক্ষণ।
সন্ধের পর বিষ্ণুপ্রিয়ার বাড়ি থেকে বেরোল বাপ্পা। বুকটা এখন অনেক ফাঁকা। ফুরফুরে। তবু যেন কোথায় একটা পিঁপড়ে কামড় বসাচ্ছে কুটুস কুটুস। বাপ্পা চলে গেলে কোথাও কি একটুও শুন্যতা তৈরি হবে না?
আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে একটু কি মন খারাপও হতে পারত না বিষ্ণুপ্রিয়ার!