২১-২৫. টেল অফ দ্য ক্লক বার

টেল অফ দ্য ক্লক বারে, মরগানের সাথে বসে আছেন ক্লেইবন। হাতে এখনও ধরে আছেন একটা বিয়ার। এদিকে মরগ্যান দ্বিতীয় দফা ড্রিংকের অর্ডার দিয়ে বসেছে। এই মুহূর্তে অভিনেতার পরনে রয়েছে চামড়ার সাথে এঁটে বসা জিন্স, ইংরেজি ভি আকৃতিতে কাটা শার্টেও গলার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সোনার একটা লকেট। একটু আগে দেখা কুঁজো হয়ে থাকা বৃদ্ধার সাথে বিন্দুমাত্র মিল নেই!

ক্ষমা চাই, বলল পল। আপনাকে ওভাবে ভয় পাইয়ে দেয়ার কোনও ইচ্ছাই আমার ছিল না।

বাদ দিন তো। এতো বার ক্ষমা চাওয়ার মতো কিছু হয়নি। নড়ে চড়ে বসলেন ক্লেইবন। আসলে আমার-ই ওখানে যাওয়াটা উচিত হয়নি।

আমারও ওখানে যাবার কথা ছিল না। বারটেন্ডার সামনে মদের গ্লাস রেখে। দিলে, সেদিকে হাত বাড়াল পল মরগ্যান। ভিজিনি বলেছিল বলেই না গিয়েছিলাম।

ভিজিনি মানে…পরিচালক?

হ্যাঁ। আমি এধরনের চরিত্রে অভিনয় করে অভ্যস্ত নই। তাই সে চাচ্ছিল, আমার মেয়েদের পোশাক পরা দৃশ্যগুলো যেন বিশ্বাসযোগ্য হয়। শুধু জামা পরাই যথেষ্ট না; কথা বলার ভঙ্গিমা, চলার ধরন-সবকিছু একদম আসলের মতো হওয়া চাই। ভাবলাম, সেটে গিয়ে একবার দেখলে কেমন হয়? হয়তো পুরো ব্যাপারটা একটু সহজ হয়ে যাবে।

দুষ্টামির হাসি হাসলেন ক্লেইবন। আমাকে ঠিক বিশ্বাস করাতে পেরেছেন।

তার কথার প্রতি সম্মান জানিয়ে গ্লাসটা উঁচু করে ধরল মরগ্যান, খুশি হয়েছে। কিন্তু আমার মনের কথা যদি জানতে পারে, তাহলে এই খুশি হাওয়ায় উড়ে যাবে মনে মনে ভাবলেন ক্লেইবর্ন। আসলেই মরগ্যানকে বৃদ্ধার পোশাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছিল, কিন্তু নরম্যান চরিত্রটা একেবারেই আলাদা। মেকাপ ছাড়াও, লোকটাকে সবাই খুব সহজে চিনে ফেলতে পারবে।

যেন ক্লেইবর্নের কথার সত্যতা প্রমাণের জন্যই, অন্য একটা টেবিল থেকে এক মেয়ে উঠে এল। আরও দুজন বান্ধবীকে সাথে নিয়ে বসেছিল মেয়েটা। সুদর্শনা, কালচে লাল চুলের মেয়েটার পোশাক তার উঠতি যৌবনকে আড়াল করতে পারেনি। সম্ভবত সদ্য ষোলোতে পা দেয়া এক তরুণী সে, দেহ থেকে এখনও বাচ্চা-বাচ্চা গন্ধটা পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি।

এক্সকিউজ মি, ক্লেইবর্নকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে, পলের দিকে তাকিয়ে বলল সে, আপনি কি পল মরগ্যান?

গ্লাস নামিয়ে রেখে নিজের ট্রেডমার্ক হাসিটা হাসল অভিনেতা। কী মনে হয়?

মাথা নীচু করে কম্পিত হাতে একটা ছোট বই আর একটা বল পয়েন্ট কলম বের করে আনল মেয়েটা। কথা বলতে গিয়ে কেঁপে উঠল কণ্ঠ, কিছু মনে না করলে, আপনার অটোগ্রাফটা পেতে পারি?

মেয়েটার ব্লাউজের সামনে দিকে স্থির হলো মরগ্যানের দৃষ্টি। শুধু অটোগ্রাফ কেন, চাইলে আমার সবকিছুই নিতে পারো।

লজ্জায় লাল হয়ে গেল মেয়েটা।

আরে আরে, ওকে শান্ত করার প্রয়াস পেল পল। আমি তো ঠাট্টা করছিলাম। বাড়ি কোথায় তোমার?

কাজ হলো। স্মিত হেসে মেয়েটা উত্তর দিল, টলেডো। আমরা এখানে টুরে এসেছি। এরপর বান্ধবীদের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ওরা আমাকে চ্যালেঞ্জ করেছে, সেজন্যই এখানে এসেছি।

কোনও সমস্যা নেই। অটোগ্রাফের খাতাটা টেনে নিয়ে নিল অভিনেতা। নাম কী তোমার?

জ্যাকি। জ্যাকি শেরবর্ন।

বানানটা বলবে?

বলল মেয়েটা। তার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে মরগ্যান কিছু একটা লিখল। এতেই হবে। খাতাটা বন্ধ করে কলমসহ ফিরিয়ে দিল।

ধন্যবাদ, বলল মেয়েটা। অনেক অনেক ধন্যবাদ।

মেয়েটা চলে যাওয়া মাত্র মরগ্যান আবার তার গ্লাসের দিকে মনোযোগ দিল। ক্লেইবর্ন দেখলেন, মেয়েটা তার বান্ধবীদের নিয়ে এক্সিটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গ্লাসে চুমুক দিল মরগ্যান। কোনও সমস্যা? জানতে চাইল সে।

শ্রাগ করে না বোঝাল ক্লেইবর্ন। তবে কথাটা মিথ্যা, কেননা সমস্যা আছে তার। অভিনেতা এইমাত্র অটোগ্রাফ খাতায় কী লিখেছে তা দেখেছেন তিনি। জ্যাকি শেরবর্নকে, মুখটা সে খুব ভালোই ব্যবহার করতে পারে।

দ্ব্যর্থবোধক বাক্য, একবার ভাবল পলকে বলেই দেয়। এখন না, পরে কখনও হবে। এখন তার মিত্র দরকার। প্রসঙ্গ ঘোরাবার জন্য বললেন, চিত্রনাট্যটা–

একদম বাজে। মরগ্যান বলল। অ্যামেস কী করতে চাইছে, তা আমি পরিষ্কার বুঝতে পারেছি। মেয়েটার জন্য ভালো ভালো দৃশ্য লিখেছে। কিন্তু ঠিকমতো অভিনয় করতে পারবে না সে। ড্ৰিসকল যে কী খেয়ে ওকে বেছে নিল, তা আমি আজও বুঝতে পারিনি।

যতদূর বুঝলাম, এরজন্য পরিচালক দায়ী। বললেন ক্লেইবন। একদম মেরি ক্রেনের মতো দেখতে কিন্তু। সম্ভবত বাস্তবতা আনতে চেয়েছে চলচ্চিত্রে।

তাহলে আমাকে কেন এক সমকামীর চরিত্রের জন্য বেছে নেয়া হলো?

সমকামী না, ট্রান্সভেস্টাইট।

কিন্তু নরম্যান ভাবে, সে আসলে তার মা—

এর সাথে সমকামিতার সরাসরি কোনও সম্পর্ক নেই।

তাহলে কীসের সাথে সম্পর্ক আছে? ভ্রূ কুঁচকে তাকাল মরগ্যান। ডাক্তারি কথা-বার্তা বাদ দিয়ে সরাসরি বলুন। নরম্যান আসলে কেমন ছিল? কী ছিল?

ত্যাগ করলেন ক্লেইবন। আপনার বা আমার মতোই আরেকজন মানুষ। বললেন তিনি। যদি আমার বা আপনার কাছ থেকে নিজের নাম কেড়ে নেয়া হয়, পরিচিতি হিসেবে ব্যবহার করা হয় শুধু একটা নাম্বার, সেল নামের একটা ঘরে বন্দি করে রাখা হয়, চারপাশে তাকে কেবল অসুস্থতা আর সমস্যা–

ওসব আমি জানি। স্ত্র কণ্ঠে বলল পল মরগ্যান। আমি পাগলা গারদে গিয়েছিলাম।

ক্লেইনের চোখের অবাক দৃষ্টিটা তার নজর এড়াল না। ভুল বুঝবেন না। আমি পাগল হয়ে পাগলা গারদে যাইনি। ইচ্ছা করেই গিয়েছিলাম। এক মাস ছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল দেহ থেকে সব মাদক বের করে দেয়া, নেশার উপর নিয়ন্ত্রণ নেয়া। গ্লাস তুলে নিয়ে এক চুমুকে ভেতরের তরলটুকু শেষ করে ফেলল অভিনেতা। কাজ হয়নি। সত্যি বলতে কী, এরপর প্রায় দেড় বছর আমি কোনও কাজ-ই করিনি। আমাদের এই ব্যবসায়, এতোদিন কাজ না করে বসে থাকলে বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে যেতে হয়।

কিন্তু ভিজিনি তো বিশেষ করে আপনাকে-ই চেয়েছিল। আমাকে না, আমার নামকে চেয়েছিল। পানির দামে পেয়েছেও। একমাত্র এই কারণেই ড্ৰিসকল আমার সাথে চুক্তি করতে রাজি হয়েছে। এমনকি আমার মুখের উপরেই বলেছে কথাটা। খালি গ্লাসটাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল মরগ্যান। হারামজাদা আমার উপর চাপ দিয়েই চলছে, ভাবছে আমাকে দিয়ে যা মন চায় তা-ই করাতে পারবে। কিন্তু স্টেজে যদি আপনার জায়গায় বেয়াদবটা থাকত- কী বলছে তা বুঝতে পেরে আচমকা চুপ করে গেল সে। বাদ দিন, চলুন আরেক দফা হয়ে যাক।

বারের টুল থেকে নেমে গেলেন ক্লেইবর্ন, মাথা নাড়ছেন। আজ আর না, মোটেলে ফেরা দরকার। একটু ইতস্তত করে জানতে চাইলেন। আপনি ঠিক আছেন তো?

নড করল মরগ্যান। অনুভূতিগুলো বের করে দেয়ার দরকার ছিল। এখন ঠিক আছি। আমি জানি, মরগ্যানের চরিত্রে আমি অভিনয় করতে পারব। অর্থবোধক হাসি হাসল সে। ভুলে যাবেন না, আমি পল মরগ্যান।

মোটেলে ফিরে যেতে যেতে ঘটনাটা মনে পড়ে গেল ক্লেইবর্নের। পল মরগ্যানকে মেয়েদের পোশাক পরা অবস্থায় স্টেজে দেখার স্মৃতিটা এখনও তার ভেতরে কাঁপ ধরিয়ে দিচ্ছে। সেই সাথে অটোগ্রাফ শিকারী মেয়েটার সাথে করা অযথা বাজে ব্যবহার…ড্ৰিসকলের ব্যাপারে কথা বলার সময় তার কণ্ঠের সুর…মোটেলে পৌঁছাবার সময় আচমকা প্রশ্নটা জেগে উঠল তার মনেঃ আসল পল মরগ্যান মানুষটা কেমন?

.

২২.

প্রায় সাতটার দিকে ওভেনের দরজাগুলো রোস্টের অবস্থা দেখে নিল জ্যান। দরজা খোলা মাত্র ভ্রু কুঁচকে ভেতরে তাকাল সে। এখনও রান্না শেষ হয়নি। দরজা আবার বন্ধ করে ওভেনের তাপমাত্রা বাড়িয়ে চারশ করে দিল। মিনিট পনেরো লাগতে পারে, সেই সুযোগে সালাদটা বানিয়ে ফেলব-ভাবল জ্যান। কপাল ভালো থাকলে হয়তো লোকটা আসতে দেরি করবে। রাস্তাও চেনে না।

তবে লেটুসটা হাতে নিয়ে গাড়ির আওয়াজ শোনার জন্য কান খাড়া করে রইল সে। শুনতে পেল শুধু এক নাইট বার্ডের গান। কনি এখনও অ্যাপার্টমেন্টেই আছে, বাইরে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আশা করা যায়, লোকটা আসার আগেই বেরিয়ে পড়বে। তেল আর ভিনেগারের মিশ্রণ ঢেলে সালাড বানানো শেষ করল জ্যান। রোস্ট হয়েছে কিনা সেই খোঁজ নেবার সময় হয়েছে। ওভেন বন্ধ করে, মাংসের অবস্থাটা দেখল। আরেকটু বাদামী হলেই, খাবার জন্য তৈরি হয়ে। যাবে ওটা। হঠাৎ বুঝতে পারল, নাইটবার্ডের গান বন্ধ হয়ে গিয়েছে। গাড়ির আওয়াজ শোনেনি, কিন্তু এখন দরজার চাইমগুলো টুংটাং আওয়াজ করছে। সেই সাথে গলার আওয়াজও ভেসে এল।

হারামজাদী কনি দরজা খুলেছে! অথচ বারবার করে ওকে বলে দিয়েছিল জ্যান, দরজাটা ও-ই খুলবে। ঝামেলা হয়ে গেল। এখন আর নতুন করে সাজার সময় নেই।

কোনওরকমে অ্যাপ্রনটা খুলে পেছনের চেয়ারে ছুঁড়ে দিল সে, হাত দিয়ে চুল গোছাবার চেষ্টা করল। রান্নাঘরে একটা আয়না রাখার কথা কেন ভাবল না সে? অন্তত আজকের মতো জরুরী অবস্থায় খুব কাজে আসত। তাড়াতাড়ি কাউন্টারের উপরে রাখা টিস্যু বক্স থেকে একটা টিস্যু তুলে নিল সে, কপাল আর চেহারায় ছোঁয়াল। অন্তত ঘর্মাক্ত নাকে তো আর লোকটার সামনে যেতে হবে না। আর তাছাড়া, ডাইনিং রুমের টেবিলে মোমবাতি জ্বালাবার পর, মেকাপের অভাবটা সে বুঝতেও পারবে না।

জ্যানের পরিকল্পনার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ এই ডিনার। হালকা কথাবার্তার মাঝ দিয়ে অ্যামেস আর ক্লেইবন সকালে কী সিদ্ধান্ত নিল, তা জেনে নিতে চায়।

সব দোষ রয়ের-চলচ্চিত্রটা বন্ধ করে দেবার বুদ্ধিটা যে কোত্থেকে তার মাথায় এল! যদি সকালে সে ক্লেইবনকে উল্টা-পাল্টা বোঝায়, তাহলে এখন জ্যান তাকে সোজা পথে নিয়ে আসবে। মোমবাতির আলোতে ডিনার, হালকা পাতলা মদ্যপান, সালাদ, রোস্ট আর তারপর?

যা দরকার হবে তা-ই!

জ্যান রান্নাঘরের দরজার দিকে যেতে যেতে, গলার আওয়াজ প্রায় অস্ফুট হয়ে এল। সদর দরজা বন্ধ হয়ে যাবার শব্দ শুনতে পেয়ে সে বুঝতে পারল, কনি বিদায় নিয়েছে।

দরজার গোবরাটে দাঁড়িয়ে, আরেকবার চুল ঠিক করে নিল জ্যান।

ঠিক আছে, বাছা। কাজে লেগে পড়!

আসলে শো-বিজনেসের ব্যাপারটাই তেমন। সবাই…একদম সবাই স্টেজে নামার আগে অস্বস্তিতে ভোগে। অ্যাল জলসনের ব্যাপারে এমন কথা অনেকবার শুনেছে। আসলে অভিনেতা যেখানকারেরই হোক না কেউ-চলচ্চিত্র, টেলিভিশন বা মঞ্চ নাটক, সবাই ভয় পায়। কিন্তু একবার যখন পরিচালক চিৎকার করে ওঠে, অ্যাকশন। তখন আর সেই ভয়ের কথা কারও মনে থাকে না।

শো-বীজের কোনও তুলনা হয় না। দুনিয়ার সেরা নেশা এটাই।

জ্যান অনেক কিছু ভেবে চিন্তেই আজকের ডিনারের পরিকল্পনাটা করেছে। কিন্তু ডা, ক্লেইবর্নের সঙ্গ ভালো লাগবে, এটা ওর পরিকল্পনায় ছিল না। প্রথম। দেখায় আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল। ভরাট গলার পুরুষদের ওর ভালোই লাগে। তবে ওর চেনা প্রায় সব অভিনেতার মাঝেই এই বৈশিষ্ট্য আছে। ক্লেইবর্নকে আলাদা করেছে তার নম্র স্বভাব। লোকটার মাঝে আত্মাভিমান বলতে যেন কিছুই নেই। চুপচাপ, শান্ত আর ভাবে কথা শুনছে ডাক্তার। নিজের ব্যাপারে কোনও কথাই বলছে না।

ডিনারের সময় এমনসব প্রসঙ্গে লোকটা ওর প্রশংসা করল, যেগুলোর ব্যাপারে প্রশংসা আশাই করেনি জ্যান। অ্যাপার্টমেন্টের সাজানো-গোছানো পরিবেশ, মোমবাতি, টেবিল সাজানো এসবের খুব প্রশংসা করলেন তিনি। এমনকী কনির প্রসঙ্গেও কথা বললেন, তোমার বান্ধবীও কি অভিনয় করে? নড করল জ্যান।

বিশ্বাস করা কঠিন। দেখে তো খুব গম্ভীর বলে মনে হয়! কোন ধরনের চরিত্রে অভিনয় করে সে?

আসলে কোনও চরিত্রে অভিনয় করে না, হাত-পা এগুলো ভাড়া দেয়।

মানে? বুঝতে পারলাম না।

কনি সবসময় কাজ করে। অগণিত টিভি বিজ্ঞাপন বা থিয়েটারে অভিনয় করেছে। তবে আপনি ওকে চিনতে পারেননি, কারণ কখনও ওর চেহারা দেখা যায় না। এমন অনেক অভিনেত্রী আছে, যাদের হাত বা পা দেখতে ভালো না। দেহের ওসব জায়গার ক্লোজ-আপ-এ ব্যবহার করা হয় ওকে।

শুনে তো মনে হচ্ছে, পরিচালকরা সুপারমার্কেট থেকে মুরগীর কাটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মতো অভিনেত্রীদের দেহের অংশ বেছে নেয়! মুচকি হাসলেন ক্লেইবর্ন। মেয়েটার লাজুক স্বভাবের কারণ এখন বুঝতে পারলাম। নিজেকে নিশ্চয় ওর খুব ছোট মনে হয়। জানে, ওর দেহ দেখিয়ে অন্য কেউ প্রশংসা পাবে। অথচ ও পাবে না, সবার অগোচরে থাকবে।

ঠিক বলেছেন।

অন্তত তোমার সেই সমস্যা হবে না।

কথাটা আমি কীভাবে নেব? প্রশংসা না অ্যানালাইসিস?

প্লেটটা সরিয়ে দিলেন ক্লেইবন, হাত বাড়ালেন কফি কাপের দিকে। কোনটা হলে তুমি খুশী হবে?

এই ব্যবসার মেয়েরা যথেষ্ট প্রশংসা পায়। কিন্তু অ্যানালাইসিস পেতে হলে, অনেক বিখ্যাত হতে হয়।

ক্লেইন চেয়ারে দেহ এলিয়ে দিলেন। হতে পারে।

ফ্রি অ্যানালাইসিসের প্রস্তাব দিচ্ছেন নাকি?

তা না। আসলে তোমার সম্পর্কে আরও জানা থাকলে, আমি তা করতেও পারব না।

কী জানতে চান, জিজ্ঞাসা করে দেখুন।

ঠিক আছে। প্রথমে একটা গত্বাঁধা ধারনা বলিঃ অধিকাংশ অভিনেত্রীর পরিবারকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক, ভেঙে যাওয়া পরিবার। যে পরিবারের হয় বাবা মারা গেছেন, নয়তো মা-বাবার ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে অথবা ছোটবেলায় বাবা, মা-মেয়েকে ফেলে চলে গেছে। তারপর থেকে মা তার মেয়েকে ব্যবহার। করে, পুতুলের মতো নাচিয়ে নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা হাসিল করে নিতে চায়। তাই মা মেয়েকে পাদপ্রদীপের নিচে ঠেলে দেয়, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ রাখে নিজের হাতে। ঠিক?

হ্যাঁ, জ্যান বিড়বিড় করে বলল।

দ্বিতীয় দলের অভিনেত্রীদের পরিবারের অবস্থা একটু ভিন্ন ধরনের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসে। এদেরও বাবা নেই, আর থেকেও নেই। হয় মারা গিয়েছেন, নতুবা মানসিক বিকারগ্রস্ত। মেয়েটি অনাথ। ফস্টার-হোমে কোনও নিরাপত্তা না পেয়ে, এদের বেশিরভাগ অল্প বয়েসে বিয়ে করে ফেলে। কিন্তু এতেও সমস্যার সমাধান হয় না। তাই সে ক্ষমতাবান লোক খুঁজে বেড়ায়। ক্ষমতাবান লোকরা তাকে ব্যবহার করে, সে-ও তাদের ব্যবহার করে নিজের ক্যারিয়ার গড়ে নেয়।

মেরিলিন মনরোর মতো, নড় করল জ্যান। এই দলের মেয়েদের সঙ্গেও পরিচয় আছে আমার।

ভালো, বললেন ক্লেইবন। তাহলে এবার প্রশ্নে আসি। তুমি কোন দলে?

আপনি অনুমান করতে পারছেন না?

জ্যানের হাসিটা ফিরিয়ে দিলেন ক্লেইবর্ন। আমার পর্যবেক্ষণ বলে দ্বিতীয় দলের।

এক মিনিট! আপনি ভাবছেন, আমি মাদকাসক্ত, আত্মহত্যা প্রবণ কেউ?

মাথা নাড়লেন ক্লেইবর্ন। অবশ্যই না। ওগুলো তো পরের উপসর্গ। আমি বলতে চাইছি, তুমি যদি সমস্যাটা বুঝতে পার, তাহলে পরিস্থিতি অতদূর যাবেই না।

এসব মন খারাপ করা প্রসঙ্গে আলোচনা করছি কেন আমরা? জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলল জ্যান। জানে, ওর নিজের দোষেই হাত থেকে নাটাই ছুটে গেছে। নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে ফিরিয়ে আনার সময় এসেছে। নিজের পরিকল্পনায় অবিচল থাকতে ওকে। স্ক্রিপ্টটা… আমার সমস্যা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। বাদ দিন ওসব। সকালটা রয়ের সঙ্গে কেমন কাটল?

বেশ ভালো। স্ক্রিপ্টে যেসব পরিবর্তন আনার পরামর্শ দিয়েছি, ছেলেটা মনে হয় সেগুলো মেনে নিয়েছে।

কী ধরনের পরিবর্তন?

আমি মূলত নরম্যানের চরিত্রটাকে কীভাবে উপস্থাপন করা উচিত, সে ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছি। ও এখন নরম্যানের চরিত্রায়ন নিয়েই কাজ করছে।

আমার দৃশ্যগুলোর কী অবস্থা?

আমার মনে হয় না ওগুলোতে খুব একটা পরিবর্তন আনা দরকার আছে। তোমার সংলাপে অল্প একটু রদবদল হতে পারে। ব্যস।

কেন?

নরম্যানের চরিত্র বদলে গেলে, স্বাভাবিকভাবে তোমার প্রতিক্রিয়াও বদলে যাবে। সেজন্য অল্প কিছু সংলাপ ছেটে ফেলা হতে পারে।

সংলাপ হেঁটে ফেলা হবে? শক্ত হয়ে গেল জ্যানের চোখমুখ। কেন? একটা কথা বলব? প্রযোজককে কেউ কাজ শিখাতে যায় না, পরিচালককে পরিচালনা শেখাতে যায় না, কিন্তু সবাই লেখককে লেখা শেখাতে চায়! ভেতর থেকে কিছু একটা সাবধান করে দিল মেয়েটাকে, শান্ত হও, সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ তুমি।

কিন্তু ভদ্রলোক ওকে ভয় পাইয়ে দিয়েছেন…

এদিকে মুখে পেশাদার হাসি ঝুলিয়ে ওর সামনে বসে আছেন ভদ্রলোক। ওকে বলছেন চিন্তা না করতে! নিজেকে কী ভাবেন তিনি, ওকে উপদেশ দিতে এসেছেন! কথাগুলো যেন হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল জ্যানের মুখ দিয়ে। এখানে কতদিন ধরে আছেন আপনি? দুদিন, তিনদিন? এরিমাঝে বিশেষজ্ঞ হয়ে গেলেন?

না। ঈশ্বর! লোকটাকে সন্তুষ্ট দেখাচ্ছে। আর সেই গভীর কণ্ঠস্বর। এটা তো একদম সহজ হিসাব! নরম্যানের চরিত্র বদলানোর অর্থ হলো তোমার সাড়া দেয়ার ভঙ্গিটাও বদলানো।

একজন ডাক্তারের ডায়াগনোসিস দরকার নেই আমার।

স্তব্ধ হয়ে গেলেন ক্লেইবন। কিন্তু মোটেও মজা করছে না ও। নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। একটা কথা বলি…

বলে ফেলেছ। হাসি মিলিয়ে গেছে ক্লেইবর্নের চেহারা থেকে। আমি জানি কী বলতে চাইছ তুমি। নিজের চরিত্র বাঁচাতে চাইছ!

এটা শুধু একটা চরিত্র নয়, আমার ভবিষ্যৎ। আপনি বুঝতে পারছেন না?

কেউ ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না। কারা দেখতে চায় জানো? যারা নিজের অতীতের দিকে ফিরে তাকাবার সাহস পায় না, তারা। নড করলেন তিনি। তোমার কেসটা একদম…

আমি কোনও কেস নই। আমি অভিনেত্রী। আর আমার অতীত সম্পর্কে কী জানেন আপনি?

জানতে পারলে আমার ভালো লাগবে।

তা তো লাগবেই! আপনারা এসব শুনে বিকৃত আনন্দ পান, তাই না? আশ্রয়হীন টিন-এজার মেয়েদের ধর্ষিতা হবার মুখরোচক গল্প আপনাদের আনন্দময় যৌন সুরসুরি দেয়। আশ্রয় আর প্রতিষ্ঠা লাভের আশায় এর-ওর সঙ্গে বিছানায় যাবার গল্প শুনেও আনন্দ পান। ক্লেইবর্নের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যে তার দিকে তাকাল জ্যান। আপনার জন্য খবর আছে আমার কাছে। অভিনেত্রীদের সম্পর্কে যেসব গল্প শোনেন, তার সবই ফালতু জঞ্জাল।

জানতে চান, কেমন পরিবার থেকে এসেছি আমি? এখানে, এই নর্থ হলিউডের এক পরিবার থেকে এসেছি আমি। আমার পরিবারের সবাই বেঁচে আছে, নথুরিজ-এ থাকে। আমার পরিবারের কারও কখনও ডিভোর্স হয়নি। এমনকী পরিবারের মধ্যে কখনও ঝগড়াও হয়নি। ভ্যান নুই হাই স্কুল থেকে লেখা-পড়া শেষ করার পর সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায় ড্রামা ক্লাসে ভর্তি হই। গত পাঁচ বছর ধরে নিজের খরচ নিজেই চালাচ্ছি।

তার মানে এই না যে জায়গাটা খুব সহজ। এখানে টিকে থাকার জন্যে সংগ্রাম করতে হয়। আর নিজের কোনও এজেন্ট, প্রযোজক বা আপনার বলা মা না থাকলে আরও অনেক কঠিন। মাঝে মাঝে একটু বোকামি করে ফেলি। তার মানে এই নয় যে আমি একটা বেশ্যা…

হলিউড নিজে বেশ্যা, রায় দিলেন ক্লেইবর্ন।

নিজেকে সামলে নিল জ্যান। কীভাবে?

নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছ না? জায়গাটা বিনোদনের রোগ বয়ে বেড়াচ্ছে। সিনেমা নিজেকে দর্শকদের কাছে বিক্রি করে, বেশ্যার মতো। সিনেমা যতভাবে সম্ভব দর্শকদের ডাকে-এসো, আমাকে ধর্ষণ করো। আমাকে চেটে পুটে খেয়ে মজা লুটো। তোমার মনোরঞ্জনের জন্যে আমি আছি। ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে হাসলেন ক্লেইবর্ন। আমাকে ভুল বুঝবে না, বিনোদনকে খাটো করছি না আমি। আমাদের সবারই আবেগ নিঃসরণের প্রয়োজন হয়। প্রয়োজন আছে বাস্তবতা থেকে পালিয়ে কিছুক্ষণের জন্য হলেও কল্পনার আশ্রয় নেয়ার। তবে শো শেষ হয়ে গেলেই সবাই বাস্তবতায় ফিরে আসে।

কিন্তু বিনোদন নির্মাতাদের একজন হতে গেলেই বিপদ। এই ফ্যান্টাসিগুলোতে আটকে যেতে হবে, হাতে আর কোনও বিকল্প উপায় থাকবে না। শেষমেশ সবার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। বাস্তবতার সাথে তাল মিলানোর সামর্থ্য হারাতে হবেই। আর যখন কারও জীবন যদি এই আবর্তে ঢুকে যায়, তাহলে ধ্বংস সুনিশ্চিত।

আমি কীভাবে জীবন্যাপন করব, তা নিয়ে কথা বলার আপনি কে? উঠে দাঁড়াল জ্যান। হয়তো আমার জীবনযাপনের পদ্ধতি ভালো নয়। হয়তো আমি বোকা, স্বার্থপর। হয়তো একদিন মুখ থুবড়ে পড়ব। কিন্তু আমি জানি আমি কী করছি! বিকল্প নিয়ে কথা বলতে চাইলে কাই-এর সঙ্গে দেখা করুন।

কাই?

আমার বোন। আমার চেয়ে স্মার্ট, আমার চেয়ে সুন্দরী। ভুল হলো, একসময় ছিল। ঠিক তখনই আপনার বলা কঠোর বাস্তবতা প্রবেশ করে তার জীবনে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, ওর পেটে। সতেরো বছর বয়সে মা হয় ও। আঠারো বছর বয়সে নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে, ওর বয়ফ্রেন্ড আর বাচ্চার সঙ্গে বনে জঙ্গলে থাকা শুরু করে। কিছুদিনের মাঝেই ওর বয়ফ্রেন্ড কপর্দকহীন হয়ে পড়ে। বাচ্চাটাকে ওরা অনাথ আশ্রমে দিয়ে দেয়। তারপর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় ওদের। কাই এখন কোথায় আছে, তা একমাত্র ঈশ্বরই জানে! হয়তো কপাল ফিরবে ওর। এমন কারও সঙ্গে দেখা হবে, যে ওকে দুচিন্তা করতে দিবে করবে। কাই সবচেয়ে ভালো যে কাজটা করেছে, তা হলো ক্যারিয়ার নিয়ে মাথা ঘামায়নি ও।

চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন ক্লেইবর্ন। নিজের সঙ্গে প্রতারণা বন্ধ কর। এমনভাবে কথা বলছেন, যেন আর কোনও উপায় ছিল না তোমার হাতে। সুড়ঙ্গের দুই মাথার মাঝে অনেকটা পথ থাকে। এরমাঝেই নিজের জন্য রাস্তা করে নিতে হয়।

তার দিকে ঘুরে দাঁড়াল জ্যান, জ্বলছে ওর চোখ দুটো। আর আপনি? আপনিও তো একই কাজ করেছেন-বছরের পর বছর ধরে বইয়ে মুখ গুঁজে রেখেছেন। বাকি সবকিছুকে একপাশে সরিয়ে দিয়েছেন আজকের এই অবস্থানে আসার জন্যে। অন্যের গোলামি করছেন।

ঠিক ধরেছ। নরম গলায় বললেন ক্লেইবন। কথাগুলো বলছি কারণ আমিও এই রাস্তায় হেঁটেছি। আর আজ এমন এক জায়গায় পৌঁছেছি, যেখানে আমি একা। কিছু নেই আমার। বাড়ি না, সংসার না, নেই কোনও ব্যক্তিগত জীবন। কাজপাগল হয়ে বেঁচে থাকা কোনও জীবন নয়। আমার হয়তো অনেক দেরি হয়ে গেছে, কিন্তু তোমার এখনও সুযোগ আছে। সে সুযোগ হেলায় নষ্ট করো না।

কথাগুলো শুনছে জ্যান। রাগ কমে এসেছে ওর। লোকটা হয়তো ভনিতা করছে না, সত্যি কথাই বলছে। বেচারা। সারাটা জীবন একটা হাসপাতালে একদল পাগলের সঙ্গে কাটিয়ে দিল। হঠাৎ করেই চিন্তাটা খেলে গেল ওর মাথায় –ভাবছি কতদিন ধরে নারী দেহের স্বাদ পায় না লোকটা।

কথাটা চিন্তা করতেই উষ্ণ হয়ে উঠল ওর দেহ। উষ্ণতাটা ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারবে না। ঠিক যৌনাকাঙ্ক্ষা নয়, আবার সহানুভূতিও না। এ দুটোর মিলিত একটা অনুভূতি বলা চলে। মুহূর্তেই উষ্ণ অনুভূতিটা তীব্র হয়ে উঠল। কিছু বুঝে উঠার আগেই জান দেখতে পেল, ক্রেইবর্নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ওর হাত দুটো। তারপর…

ডোরবেলটা বেজে উঠল।

ভ্রূ কুঁচকাল জ্যান। দরজার দিকে এগিয়ে গেল ও।

এখন আবার কে?

রয় অ্যামেস!

এমন সময়ে এসে হাজির। তার মানে হিংসা হচ্ছে তার।

কী চাও? জ্যান জিজ্ঞেস করল।

ঘরের চারপাশে নজর বোলাল রয়। তোমাকে ফোন করেছিলাম। কিন্তু তোমার লাইন ব্যস্ত পেয়েছি।

জ্যানের কুঁচকানো ভ্রূ আরেকটু কুঁচকে গেল। সন্ধ্যার পর থেকে একবারও বাজেনি আমার ফোন।

টেলিফোনটার দিকে তাকাল রয়। তা-ই তো দেখছি।

রয়ের দৃষ্টি অনুসরণ করল জ্যান। কিনি বাইরে যাবার আগে একটা ফোন করেছিল। ও নিশ্চয়ই ফোনের রিসিভারটা হুক থেকে তুলে রেখেছে।

তা-ই হবে হয়তো। ক্লেইবর্নের উদ্দেশ্যে নড় করল সে। আপনাদেরই দরকার ছিল আমার। চলুন বেরোই।

ক্লেইবন উঠে দাঁড়ালেন। কোথায়?

করনেটে। ডিসকল আমাকে ফোন করেছিল। চলুন, আমার গাড়িতে যাব।

এত তাড়া কীসের?

ঘুরে দরজার উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরল রয়। কে যেন আগুন লাগিয়ে দিয়েছে স্টুডিওতে।

.

২৩.

জ্যান আর ক্লেইবনকে পাশে বসিয়ে ঝড়ের বেগে গাড়ি ছুটিয়েছে রয়।

বুলেভার্দের বুক চিরে গাড়ি ছুটতে ছুটাতে সাইরেনের শব্দ শোনার জন্যে কান পেতে আছে সে। কিন্তু কোনও শব্দ আসছে না। স্টুডিওতে ঢুকে আগুনের বিন্দুমাত্র চিহ্ন খুঁজে পেল না ওরা।

ফলস অ্যালার্ম? বিড়বিড় করে বললেন ক্লেইবর্ন।

অসম্ভব, জোর দিয়ে বলল রয়। ড্রিসকল নিজে আমাকে ফোন করে বলেছে।

তখনই ওরা খেয়াল করল, একজন গার্ডের সঙ্গে ড্ৰিসকল স্বয়ং হাজির হয়ে গিয়েছে।

গেট দিয়ে তাড়াহুড়ো করে ঢোকার সময় তাকে খেয়াল করেনি ওরা। রাগী দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে ড্ৰিসকল।

কোন জাহান্নাম থেকে এসেছে এই দুইজন? ঘাউ করে উঠল লোকটা।

জ্যানের সঙ্গে ডিনার করছিলেন ড. ক্লেইবর্ন, রয় জবাব দিল। এই পরিস্থিতিতে, আমি ভেবেছিলাম, তাদের জানা উচিত…

পরিস্থিতি চুলোয় যাক! রয়ের সঙ্গীদের দিকে ঘুরল সে। চলে যখন এসেছেন, কিছু করার নেই। তবে মনে রাখবেন, আপনাদের দুজনের মুখই যেন বন্ধ থাকে। উত্তরের অপেক্ষা না করেই ফিরতি পথ ধরল সে। এসো।

কী হয়েছিল, বলবেন না আমাদের? ক্লেইবর্ন প্রশ্ন করলেন।

দেখতেই পাচ্ছেন। একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।

স্টুডিও যাবার রাস্তা পার হতেই ওদের গন্তব্য বুঝে ফেলল রয়। বাঁ দিকের একটা সাউন্ড স্টেজে আগুন ধরে গেছে।

আগুন তার লকলকে শিখা দিয়ে চাটছে সাত নম্বর স্টেজ। ড্রিসকল সেদিকে নিয়ে চলল ওদের।

ওখানে ঢুকে সাজসজ্জা দেখেই রয় চিনে ফেলল ওটা নরম্যানের মায়ের বেডরুমের সেট ছিল। ঠিক যেভাবে স্ক্রিপ্টে লিখেছিল ও, সেভাবেই সাজানো হয়েছিল বেডরুমটা।

দুজন লোক অপেক্ষা করছিল ওখানে: গাঁট্টাগোট্টা, গোঁফওয়ালা মাদেরো আর একজন সিকিউরিটি গার্ড, বুড়ো চাক গ্রসিংগার। এক কোণে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল ওরা দুজন।

আগুনের তীব্র আলোতে চোখ পিটপিট করল রয়। প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয়েছিল, সেটের কোনও ক্ষতি হয়নি। কিন্তু বাতাসে কাপড় পোড়ার কটু গন্ধ পেতেই রয়ের ভুল ধারণা ভেঙে গেল।

তারপরই পুড়ে যাওয়া বিছানার চাদর, বালিশ চোখে পড়ল ওর।

ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, সময়মতো এসে পড়েছিলাম, বলছে এসিংগার। আমি যখন আসি, তখন দরজাটা খোলা ছিল। ভেতর থেকে টিমটিমে আলো আসছে দেখে সন্দেহ হয় আমার। সাথে সাথে ধোঁয়ার গন্ধও পাই। ভেতরে ঢুকে দেখি বিছানায় আগুন ধরে গেছে। তাই দেয়াল থেকে এক্সটিংগুইসার নামিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলি।

আর সেই সাথে নিজেকেও পুড়িয়ে কাবাব বানানোর ব্যবস্থা করে ফেলেছিলে প্রায়। ফ্রাঙ্ক মাদেরো মাথা দোলাল। এমন পরিস্থিতিতে আমাকে ডাকার কথা তোমার। রেগে আছে মাদেরো। সেটাই স্বাভাবিক, স্টুডিওর ফায়ার পেট্রোল বিভাগের প্রধান লোকটা।

তোমার মাথা! গ্যারেজ থেকে ইকুইপমেন্ট নিয়ে আসতে আসতে পুরো জায়গাটায় আগুন ধরে যেত। ওই গ্যাসোলিনটা যদি বিস্ফোরিত হতো…

গ্যাসোলিন? আবার রাগী ভাবটা ফিরে এসেছে ড্ৰিসকলের চেহারায়। ওদের দুজনের দিকে এগিয়ে গেল সে।

বিছানার নিচে এটা খুঁজে পেয়েছি, পাঁচ গ্যালনের একটা ড্রাম তুলে ধরল মাদেরো।

ড্রামটা হাতে নিয়ে ঝাঁকি দিল ড্ৰিসকল। ক্যানটা এখনও খোলা হয়নি।

ঢাকনির প্যাঁচ কিন্তু ঢিলে হয়ে আছে। তার মানে আগুন লাগানোর ঠিক আগ মুহূর্তে বাধা পেয়েছিল লোকটা। তাকে বলল মাদেরো।

তুমি কীভাবে জানো? হাঁটু গেড়ে বসল ড্ৰিসকল। উঁকি মেরে তাকাল বিছানার নিচে। দেখ, এখানে রঙের ক্যান, ব্রাশও আছে। বেজন্মা অলসগুলো কাজ করার পর এগুলো আর স্টোর রুমে নিয়ে যায়নি, এখানেই ফেলে গেছে। ওদের কেউ বোধ হয় কিছুক্ষণ ঘুমিয়েছিল এখানে। ঘুম থেকে উঠে সিগারেট টানে। সিগারেট থেকে আগুন ধরে যায় বিছানায়। শালা তখন ভয়ের চোটে ভাগে।

মাথা নাড়ল মাদেরো। আমার কথা লিখে রাখুন, কেউ ইচ্ছে করে লাগিয়েছে এ-আগুন। একে বরং…

হয়েছে, থামো। গার্ডের দিকে ফিরল ড্ৰিসকল। ট্যালবটের সঙ্গে কথা বলেছ?

নামটা চিনতে পারল রয়: ট্যালবট স্টুডিওর সিকিউরিটি প্রধান।

ড্ৰিসকলের কুপিত দৃষ্টির সামনে অস্বস্তি নিয়ে নড়েচড়ে দাঁড়াল গ্রসিংগার। সে সুযোগ পাইনি। আপনি জানেন, ও কোথায় থাকে। আমি ভাবলাম, থাউজ্যান্ড ওকস থেকে সে আসতে আসতে…

তুমি কী ভেবেছ না ভেবেছ তা নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। নাইট শিফটের আর কেউ এ ঘটনার কথা জানে?

না। জিমি গেটে। ফিট আর ম্যানহফ পেছনের গেটে।

মাদেরোর দিকে ঘুরল ড্ৰিসকল। তোমার লোকজন জানে?

পেরি আর কজেনের ডিউটি ছিল। কিন্তু গ্রসিংগার যখন আমাকে ডাকতে যায়, ওরা দুজন তখন ঘুমাচ্ছিল। তাই আমি একাই আসি এখানে।

তাহলে এখানে কী হয়েছিল, তা আমরা ছাড়া আর কেউ জানে না।

যে লোকটা এ কাজ করেছে তাকেও কেউ দেখেনি। ড্ৰিসকলের হাতের ড্রামটার দিকে ইশারা করল ফ্রাঙ্ক মাদেরো। আমি জানি আপনি কী ভাবছেন। কিন্তু কাজটা অবৈধ…

মাথা নাড়তে নাড়তে পিছিয়ে গেল ড্ৰিসকল। তুমি ভুল করছ। এটা দুর্ঘটনা ছিল।

লাল হয়ে গেল মাদেরোর মুখ। আপনার আদেশ কবে থেকে মানতে শুরু করলাম আমি?

বারনি ওয়েংগারটন যেদিন ইউরোপ চলে গেছে, সেদিন থেকে, ড্ৰিসকল বলল। রুবেন গিয়েছে নিউ ইয়র্ক। তার মানে, আমিই এখানে সর্বেসর্বা। তুমি যখন ফোন করেছলেন তখনও অফিসে ছিলাম আমি। এত রাত পর্যন্ত কোন ঘোড়ার ঘাস কাটতে অফিসে ছিলাম, বলো তো? আমি আমার কাজ করতে জানি, অন্য কারও কাছে শিখতে হবে না।

গলা চড়ে গেল মাদেরোর। হয়তো তা-ই। তবে আপনি যদি এ ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেন, তাহলে কিন্তু ভুগতে হবে…

চোপরাও! শোনো। ঝামেলা যখন চাইছ, তাহলে যাও পুলিশের কাছে। ওদের কাছে রিপোর্ট লেখাও। ওয়েংগারটন ফিরে এসে যখন দেখবে আজ রাতের সিকিউরিটি ব্যবস্থা কতটা দুর্বল ছিল, যখন জানতে পারবে তোমার গার্ডরা নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছিল, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, তোমাদের দুজনের পাছায় লাথি মেরে চাকরি থেকে বের করে দেবে ও।

এ কাজ করে পার পাবেন না। নিচু হয়ে এসেছে মাদেরোর গলার স্বর।

আমার ওপর বিশ্বাস রাখো, রয়, জ্যান ও ক্লেইবর্নের দিকে ফিরল ড্রিসকল আমি চাই আপনারাও মুখ বন্ধ রাখবেন। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে আজ রাতে এখানে এসেছিলেন কেন, তাহলে বলবেন, প্রডাকশন মিটিং ছিল।

গ্রসিংগার এগিয়ে এল। আরেকটা জিনিস ভুলে যাচ্ছেন। প্রমাণটা…

কীসের প্রমাণ? গ্যাসোলিন ড্রামের একপাশে টোকা মারল মার্টি ড্ৰিসকল। এটা আমি দেখব। বিছানার দিকে তাকাল ও। তুমি আর মাদেরো বিছানার চাদরটা সরিয়ে ফেলো। কাল হসকিনসকে বলব, আমাকে যেন আরেকটা বিছানার চাদর ডিজাইন করে দেয়। দেয়ালের দাগগুলো মুছে ফেলো। এয়ার কন্ডিশনার ছেড়ে দাও, যাতে ধোঁয়া আর কাপড় পোড়ার গন্ধ বেরিয়ে যেতে পারে।

শ্রাগ করল মাদেরো। ঠিক আছে। তবে কোনও কিছু যদি গড়বর হয়…

যদি তোমার লম্বা নাকটা না গলাও, তাহলে হবে না। ড্রিসকল হাসল। শুধু আমি যা বললাম তা-ই করো। আগামীকাল থেকে পুরোপুরি ঝামেলামুক্ত হয়ে যাবে তুমি। ঠিক আছে তাহলে। কাল সকালে সেটে তোমার সঙ্গে দেখা করব।

দুই সঙ্গীর পিছু পিছু অন্ধকার সড়কে এসে হাজির হলো রয়। জ্যান বা ক্লেইবর্ন কেউই কথা বলছে না। কিন্তু রয় জানে ওরা কী ভাবছে।

ধামাচাপা দেয়া হচ্ছে একটা অপরাধ। আর ওরা সবাই সহযোগী।

জ্যানকে ব্রার জন্য দ্রুত পা চালাল সে। চকচক করছে জ্যানের চোখ দুটো। চাঁদের আলোয় ওর ফ্যাকাসে মুখটাকে আরও ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। ক্লেইবর্নের চেহারা দেখার সুযোগ হয়নি ওর। ড্ৰিসকলের পাশে চলে গেছেন তিনি।

আপনার সঙ্গে কথা আছে আমার, বললেন তিনি।

বলুন।

একটু একা বলতে চাই।

মাথা নাড়ল প্রযোজক। দেখুন, আমরা সবাই একসঙ্গে আছি। আপনার যা বলার আছে, সবার সামনেই বলুন।

রয় ও জ্যান এগিয়ে আসতে ড্ৰিসকলের হাতের জিনিসের দিকে নজর ফেরালেন ক্লেইবর্ন।

ওই গ্যাসোলিন ড্রাম, বিড়বিড় করে বললেন তিনি। ঠিক এ-রকম একটা ড্রাম দেখেছি গত রবিবার। নরম্যান যখন ভ্যানটা পুড়িয়ে দিয়েছিল।

ওহ, যীশু! আবার! প্রতিবাদে কুঁচকে গেল ড্ৰিসকলের টেকো ললাট। আপনি বলতে চাচ্ছেন, নরম্যান এই আগুন লাগিয়েছে?

আপনাকে আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলাম, ও বাগড়া দেয়ার চেষ্টা করবে, বললেন ক্লেইবন। আর কার ঠেকা পড়েছে আগুন লাগানোর? ক্যানটির দিকে নড করলেন তিনি। এই যেমন ধরুন পদ্ধতি…।

কাকতাল। যখনই কেউ আগুন ধরাতে যায়, তখন প্রথমে গ্যাসোলিনের কথাই ভাবে।

তাহলে আপনি স্বীকার নিচ্ছেন, কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে লাগিয়েছিল আগুনটা।

এমন কোনও স্বীকারোক্তি দেইনি আমি! আবারও বলছি, এটা স্রেফ একটা দুর্ঘটনা। আমাকে ভয় দেখানোর কথা ভাবলে, ভুলে যান।

ভয় দেখাতে পারলে তো ভালোই হতো। এবার ক্লেইবনেও চেহারা দেখতে পাচ্ছে রয়। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে ডাক্তারের কপালে। এজন্যই মুখ বন্ধ রেখেছিলাম আমি। কারণ চাইনি কেউ ভয় পেয়ে যাক। আর আমি নিশ্চিতও ছিলাম না। কিন্তু আজ রাতের ঘটনার পর আর কোনও সন্দেহ নেই। নরম্যান আছে আশেপাশে।

আপনি আবোলতাবোল যা-ই বকুন না কেন, গ্যাসোলিন ভ্রামটা ঘোরালো ড্ৰিসকল, তাতে কিছুই প্রমাণ হয় না।

কিন্তু ওকে আমি নিজের চোখে দেখেছি।

কী…

ওকে দেখেছি আমি, আবারও বললেন ক্লেইবর্ন। এবার তার গলার স্বর আরও কোমল। কাল রাতে।

কেউ কথা বলছে না। সবাই তাকিয়ে আছে ক্লেইবনেরও দিকে। আরও কিছু শোনার অপেক্ষা করছে তার মুখ থেকে।

পারফেক্ট সেটিং, আনমনে বলল রয়। এবার গল্প বলা শুরু করো!

কিন্তু কোনও গল্প বলছেন না ক্লেইবন। তার বলা কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। রয়ের কানে। ভেঞ্চুরার সুপারমার্কেটে। দোকানিদের ভিড়ে। উজ্জ্বল আলোয়। আয়নায়। ওকে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি, এখন যেমন আপনাকে দেখছি। পালিয়ে গেছে…হাত ফস্কে…

তাহলে এত নিশ্চিত হলেন কী করে? ড্ৰিসকল বলল। আপনি হয়তো ভুল দেখেছেন।

আপনাকে আরও আগে না জানিয়ে ভুল করেছি। আর কোনও ভুল করিনি। আমার পরামর্শ মেনে নিয়ে যদি সবকিছু বন্ধ করে দিতেন, তাহলে আজ এ। দুর্ঘটনা ঘটত না।

কিছুই হয়নি। ড্রামটা বগলে নিয়ে বলল ড্ৰিসকল। কিচ্ছু হবে না।

কিন্তু ও চেষ্টা করবে…

ভাববেন না। এখন থেকে আরও কড়া নজরদারির ব্যবস্থা করা হবে। ডিউটির সময় আর কোনও আলসেমি নয়। আমার এখনও মনে হচ্ছে, আপনি ভুল করছেন। আর যদি আপনার কথা ঠিকও হয়, বেজন্মাটার জন্যে প্রস্তুত হয়ে থাকব আমরা।

রয় এগিয়ে এল। ঝুঁকি নিচ্ছেন কেন শুধু শুধু? পুলিশ যতদিন ওকে খুঁজে না পায়, ততদিন শুটিংটা অন্তত স্থগিত করতে পারেন।

রয় তাকে সমর্থন করায় হাসিমুখে নড করে ওর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন ক্লেইবর্ন। কিন্তু অস্বীকৃতি জানাল ড্রিসকল।

অনেক দেরি হয়ে গেছে। মাদেরো আর এসিংগার ইতোমধ্যে সব প্রমাণাদি মুছে ফেলেছে। আর সবাই যখন জানতে চাইবে, আগুন লাগার ব্যাপারে আর কাউকে জানাইনি কেন, কী জবাব দেব আমরা? মাথা নাড়ল সে। নাহ, কোনও পুলিশ নয়।

কিন্তু স্থগিত তো করতে পারেন…

ব্যাপারটা আমি ভেবে দেখব।

ঘুরে দাঁড়িয়ে গটগট করে হাঁটতে শুরু করল ড্ৰিসকল।

তার মানে কিছুই বন্ধ করবে না ও, বিড়বিড় করে বলল রয়। ক্লেইবর্নের দিকে ফিরল ও। আপনি নিশ্চিত, নরম্যানকেই দেখেছিলেন?

নিশ্চয়ই।

জ্যানের চোখে দ্বিধা। ভেঞ্চুরার ওই সুপারমার্কেট, বলল ও। আমি যেটার কথা ভাবছি, সেটা এখান থেকে মাত্র কয়েক ব্লক দূরে।

যদি আমাকে সে গতরাতে দেখে ফেলে, ওকে বললেন ক্লেইবর্ন। তাহলে আর অসাবধানে ঘোরাফেরা করবে না। কিন্তু এখানে যদি কোথাও লুকানোর জায়গা পেয়ে যায়…

রয় সবিস্ময়ে দেখল, ওর আরও কাছে ঘেঁষে এসেছে জ্যান। হাত দুটো বাড়িয়ে দিয়েছে রয়ের হাতের দিকে। জ্যানের মুখের দিকে তাকাল রয়। নিজের সমস্ত অভিনয় দক্ষতা দিয়ে ভয় ঢাকতে চেষ্টা করছে ও। কিন্তু আঙুলের কাঁপাকাঁপিই বলে দিচ্ছে, সেই চেষ্টায় ব্যর্থ ও। রয়ের সামনে এখন কোনও মুখোশ-পরা অভিনেত্রী দাঁড়িয়ে নেই। ওর সামনে এক ভীতসন্ত্রস্ত মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

নিরাপত্তা আর আশ্বাসের আশায় ওর দিকে ফিরেছে মেয়েটি। কিন্তু এই মুহূর্তে কারও কাছে নেই মহামূল্যবান এই জিনিস দুটো। চলো, বলল সে। এখান থেকে বেরোই।

টায় ব্যর্থ ও করছে ও। কিন্তু আজের

.

২৪.

ছুরির ফলাটা ছয় ইঞ্চি লম্বা ও এক ইঞ্চি চওড়া। দুই পাশ দিয়েই কাটা যায়, প্রচন্ড ধারালো।

ছোরাটা শক্ত মুঠিতে ধরে ওটার তীক্ষ্ণ ধারালো ডগার দিকে তাকিয়ে আছে স্যান্টো ভিজিনি।

ক্লেইবর্ন রুমে প্রবেশ করতে চমকে গেল সে।

মি. ভিজিনি…

বলুন?

আমি ডা. ক্লেইবন। আপনার অফিস থেকে আমাকে জানানো হয়েছে, আপনাকে এখানে পাব। আশা করি, বিরক্ত করছি না।

মোটেও না। একেবারে সময়মতো এসেছেন আপনি। ছুরিটা টেবিলে রেখে হাত বাড়িয়ে দিল সে। খুব ভালো লাগছে আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ায়, বলল সে। আপনার আসার খবর পাবার পর থেকেই দেখা করার জন্যে উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছিলাম।

ভিজিনির শরীর থেকে যে সুগন্ধীর গন্ধ আসছে ক্লেইবন ওটার সঙ্গে পরিচিত নন। পরিচালক আরেকবার ছুরিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বিড়বিড় করে মন্তব্য করল, বড় পাতলা।

ছুরিটার দিকে কোনও নজর নেই ক্লেইবর্নের। ভিজিনিকে দেখছেন তিনি। আপনার কি মনে হয়? আবারও বলল পরিচালক। আরও চওড়া ছুরি দরকার আমাদের?

হ্যাঁ। নড় করলেন ক্লেইবন। জোর করে ভিজিনির ওপর থেকে নজর সরিয়ে ছুরিটার দিকে তাকালেন।

এই প্রপ ডিপার্মেন্টটা, দীর্ঘশ্বাস ফেলল ভিজিনি। কোনও কাজের না। চাইলাম কী আর দিল কী! চোখ পাকাল সে। আমি যতই বলি নরম্যান বেটস এই খেলনা জিনিস ব্যবহার করেনি, ওরা ততই আমাকে উল্টো বোঝায়। বলে, আজকাল তো সবাই সুইচ-ব্লেড ব্যবহার করে। আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। অবিশ্বাস্য!

আপনি আসায় খুব খুশি হয়েছি, আগের কথার খেই ধরল ভিজিনি। একসঙ্গে প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র বাছাই করব আমরা।

রুমটা ওকে ঘুরে দেখাতে শুরু করল ভিজিনি। কামরায় ঢোকার পর এই প্রথম পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হলেন ক্লেইবর্ন

বাঁ পাশে অস্ত্রভান্ডার পাবেন, কেরানি বলেছিল তাকে। আসলেই তাই। কিন্তু অস্ত্র ভান্ডার বললে, খুব কমই বলা হয় ঘরটাকে।

ঘরটা অস্ত্রাগারের খুদে সংস্করণ। ডানপাশের দেয়ালের কাছে একগাদা প্রাচীন অস্ত্রশস্ত্র রাখা আছে। বর্শা, পাইক, যুদ্ধ-কুঠার, ল্যান্স, গদা প্রভৃতি অস্ত্রের সবগুলোর গায়ে ট্যাগ নাম্বার লাগানো।

বিপরীত পাশের দেয়ালে রাইফেল সাজিয়ে রাখা থরে থরে। নানা ধরনের, নানা কোম্পানির-ফ্লিন্টলক, উইনচেস্টার, মাউজার, গারান্ড আরও অনেক। এরপর সাজিয়ে রাখা আছে লং-বো, ক্রস-বো, ইন্ডিয়ান তীর ভর্তি তূণীর। মাথার ওপর গ্লাস কেসে হ্যান্ডগান, ডুয়েলিং পিস্তল, পিপারবক্স, কোল্ট, লুগার, সার্ভিস রিভলভার, পুলিশ মডেল ও স্যাটারডে নাইট স্পেশাল দেখতে পেলেন।

তবে ভিজিনির মতো ক্লেইবর্নও পেছনের দিকের দেয়ালে রাখা অস্ত্রগুলোর দিকে আকৃষ্ট হলেন বেশি। এখানে, এই অন্ধকারেও বার্নিশ করা স্টিল চকচক করছে। রোমান তলোয়ার, খাঁজকাটা অ্যাজটেক তরবারি, একধারী তলোয়ার, খঞ্জর, অটোমান সাম্রাজ্যের ক্ষুর, ভাইকিংদের দ্বন্দ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত তরবারি এবং নেপোলিয়নের ক্যাভালরিতে ব্যবহৃত তরবারি সাজিয়ে রাখা এখানে।

ওপরের শেলফে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা জিনিসগুলোর ওপর নজর ভিজিনির। দেখুন কেমন এলোমেলো করে রেখেছে সব! সেফ পাগলামি। শ্রাগ করল সে। তবে এর ভেতর থেকেই কিছু না কিছু খুঁজে বের করব আমরা। গাদাগাদি করে রাখা অস্ত্রগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করে একটা ভারি হাতলওয়ালা ছুরি বের করে আনল সে।

এটা কী?

দেখে তো মনে হচ্ছে বাউয়ি নাইফ, জবাব দিলেন ক্লেইবন। বুনো পশ্চিমের দিনগুলোতে ফ্রন্টিয়ারে ব্যবহার করা হতো।

এখন আর ব্যবহার করা হয় না? নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে ছুরিটা রেখে দিল ভিজিনি। এই ছুরিটা হলে খুব ভালো হতো।

তার হাত এখনও শেলফ হাতড়াচ্ছে। আচমকা থেমে গেল হাতটা। টেনে একটা ছুরি নামিয়ে আনল সে। ছুরিটা আট ইঞ্চি লম্বা, দুই দিকেই ধার আছে, আর হাতলটা বেশ চওড়া। আলোআঁধারিতেও চকচক করছে ব্লেডটা।

কসাইয়ের ছুরি। এটাই ব্যবহার করবে ও।

এটা কি…

সিনেমায় ব্যবহার করব, সবকটা দাঁত বেরিয়ে গেছে ভিজিনির। সাইজ, দৈর্ঘ্য একদম ঠিকঠাক। ছবিও আসবে দারুণ। কয়েকটা ডুপ্লিকেট বানাব এটার।

ঘুরে দাঁড়াল ও। ছুরির স্টিলের টোকা মেরে বলল, দারুণ একটা আবিষ্কার। শত হলেও, ছুরিটাই আসল স্টার। কী বলেন?

তার তীক্ষ্ণ নজর এড়িয়ে গেলেন ক্লেইবন। একদিক দিয়ে, হ্যাঁ…

স্ক্রিপ্টটাও গুরুত্বপূর্ণ, ভিজিনি বলল। আজ সকালে সংশোধিত জায়গাগুলো রয় দেখিয়েছে আমাকে।

এজন্যই আপনার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম আমি, হড়বড় করে বললেন ক্লেইবন। আপনার কী মনে হয়?

কিছু কিছু জায়গায় বেশ ভালো। ও যেভাবে নরম্যানের রিঅ্যাকশনগুলোর যেভাবে সামলেছে, সেটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। এতে চরিত্রের গভীরতা বেড়েছে। কিন্তু মার্ডার সিনগুলোতে কাঁচি চালানো…আমাদের জন্য ঠিক হবে না।

সেটার দায় আমার, বললেন ক্লেইবর্ন। আমার পরামর্শে কিছু জায়গায় অতিরিক্ত সহিংসতা কেটে ফেলা হয়েছে।

কেন? হাসি মিলিয়ে গেছে ভিজিনির মুখ থেকে। শত হলেও, আমরা একটা গল্প বলছি।

সিনেমায় যা দেখানো হয়, লোকজন তা-ই বিশ্বাস করতে পছন্দ করে। নিশ্চয়ই! কিন্তু আমাদের গল্পটা খুনের। আর লোকজনকে সেটা দেখাতে হবে আমাকে। আপনার ভাষায়, বাস্তবসম্মত করে তোলার জন্য।

হিংস্রতাই একমাত্র বাস্তবতা নয়।

তাই? দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়াল ভিজিনি। এখানে দেখুন। এই অস্ত্রগুলো মানবসভ্যতার ইতিহাস। এখানে শুধু বর্তমান যুগের নিউক্লিয়ার অস্ত্র নেই। সভ্যতার উন্নয়ন! হুহ! যত্তসব ফালতু কথা!

কিন্তু আপনি যুদ্ধ নিয়ে কথা বলছেন…

আমার সেই অধিকার আছে। ছুরিটার দিকে তাকাল ভিজিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যখন সিসিলি আক্রমণ করা হয়, তখন বাচ্চা ছিলাম আমি। কিন্তু সব লুটপাট, অত্যাচার আর হত্যাযজ্ঞ নিজ চোখে দেখেছি। তারপর অনেক সময় চলে গেছে। কিন্তু সহিংসতার ইতিহাস বদলায়নি। বিয়াফ্রা, বাংলাদেশ, গুলাগ আর্চিপেলাগো, পাপা ডক জেলখানা, ভিয়েতনাম-কোথাও বদলায়নি। সহিংসতা এখন সব জায়গায় স্বাভাবিক।

দয়া আর সমঝোতাও স্বাভাবিক।

মাথা নেড়ে অসম্মতি জানাল ভিজিনি। দয়া আমার কাছে বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই না। পৃথিবী আগের মতো নেই। অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। নরম্যান বেটসের মতো বেজন্মা লোকের সংখ্যা বাড়বে দিন দিন। ওর মা একটা বেশ্যা আর ও আমাদের যুগের জন্ম দেয়া সন্তান। ছুরির হাতলটা শক্ত করে ধরল পরিচালক। এটা আমার বিশ্বাস। আমার ছায়াছবিও এই মেসেজ দেবে।

আবারও অন্যদিকে তাকালেন ক্লেইবন। ভিজিনির চেহারা দেখতে চাচ্ছেন না তিনি। কিন্তু তাকে কথা বলতে হবে।

আমাদের অনেকেই এখনও বিশ্বাস করে, পৃথিবীটা ভালো একটা জায়গা।

হয়তো তা-ই। কিন্তু ভালো জিনিসে বিশ্বাস করতে হলে খারাপটাকেও মেনে নিতে হবে আপনাকে।

ছুরিটা হাতে নিয়ে দরজার দিকে হাঁটা ধরল ভিজিনি।

সব মানুষের ভেতরই একটা শয়তান আছে। আপনাদের সেই শয়তানটাকেই দেখাব আমি।

নির্বাক ক্লেইবনের সামনে রুম থেকে বেরিয়ে গেল লোকটা। মানসিক বৈকল্য। একটা অসুস্থতা, একটা রোগ, খুব সম্ভবত বিপদও। কিন্তু এটা নিয়ে চিন্তিত নন। তিনি। এমন বৈকল্য আগেও বহুবার দেখেছেন।

তিনি আসলে চমকে গেছেন ভিজিনির চেহারা দেখে। এই চেহারা আগেও দেখেছেন ক্লেইবর্ন।

কারণ, স্যান্টো ভিজিনি দেখতে অবিকল নরম্যান বেটসের মতো।

.

২৫.

লেখক হিসেবে, সব ধরনের গত্বাঁধা বুলি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে রয়। কিন্তু ক্লেইবনকে দেখে যে কথাটা ওর মুখ দিয়ে উচ্চারিত হলো, সেটাকে গত্বাঁধা না বলে উপায় নেই। কী হয়েছে? ভূত দেখেছেন নাকি?

আসন গ্রহণ করলেন ক্লেইবন। এইমাত্র ভিজিনির সঙ্গে দেখা করে এলাম।

কাটছাঁট করতে নিশ্চয় অস্বীকার করেছে ও। নড করল রয়। কী বলল সে? সহিংসতা নিয়ে বাণী ঝাড়ল?

হ্যাঁ, তবে…

ওসব ভুলে যান। কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন টক শো আর সেমিনারে ওই বাণী ঝাড়ছে ভিজিনি, আমি জানি। কারণ, আমারই এক বন্ধু লিখেছিল ওই বক্তৃতা…দুশো ডলারের বিনিময়ে। যদিও কখনও টাকাটা পায়নি ও।

সেটা আমার সমস্যা না, হতবুদ্ধি দেখাচ্ছে ক্লেইবর্নকে। কথা হচ্ছে, আমাকে আগে বলনি কেন?

কী বলিনি?

ভিজিনি যে দেখতে অবিকল নরম্যান বেটসের মতো।

মজা করছেন? রয়ের মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে। আমাদের কাছে নরম্যানের যে ছবি আছে…

ওটা অনেক বছর আগের ছবি। নরম্যানকে এখন অবিকল ভিজিনির মতো দেখায়।

তার দিকে দীর্ঘ এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল রয়। তারপর মুখ খুলল, তাহলে সেদিন সুপারমার্কেটে আপনি কি ভিজিনিকে দেখেছিলেন?

হতে পারে। বিরতি নিলেন ক্লেইবন। ওর সম্পর্কে তুমি কী জানেন?

বেশি কিছু না। পত্রপত্রিকায় যা পড়েছি তা-ই জানি। ইতালিতে প্যাগেটি ওয়েস্টার্ন দিয়ে এ পেশায় ওর যাত্রা শুরু। হরর ফিল্ম জনপ্রিয় হয়ে উঠলে, পরিচালনা শুরু করে সে। চলে যায় ফ্রান্সে। ওখানে কয়েকটা ছবি পরিচালনা করে। লোপগারো ওর প্রথম হিট সিনেমা। ওই মুভিতেই ওর বিশেষ মিশ্রণ ব্যবহার করে সে।

বিশেষ মিশ্রণ?

যৌনতা ও সহিংসতা। শ্রাগ করল রয়। ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দর্শকরা এ ছবিটা। লুফে নেয়।

তোমার ভালো লাগেনি?

কেউ জানতে চায়নি। দর্শকরা স্ক্রিনে যা দেখেছে, তা-ই পছন্দ করেছে। আর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফুলে-ফেঁপে উঠতে দেখে খুশিতে ডগমগ হয়েছে। অ্যাকাউন্ট্যান্টরা। তিনটা সিনেমা বানানোর চুক্তিতে এই স্টুডিও-তে আসে সে। তারপর বাকিটা ইতিহাস।

ওর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছু জানো?

সবসময় লো প্রোফাইল বজায় রেখেছে। তবে অনেক গুজবও শুনেছেন নিশ্চয়ই ওর ব্যাপারে? তার নাকি পাঁচবার বিয়ে আর ডিভোর্স হয়েছে, সমকামী।

ড্রাগে আসক্ত-চেষ্টা করেও ছাড়তে পারছে না ইত্যাদি।

তোমার কী ধারণা?

শুধু ওর কাজ সম্পর্কে ধারণা দিতে পারি। আমার ধারনা ভিজিনির সমস্যা আছে। সে এমন ধরনের মানুষ, যে পারলে ইলেকট্রিক ছুরি নিয়ে জ্যাক দ্য রিপারের ফেলে যাওয়া কাজ আবার নতুন করে শুরু করবে।

মার্ডার মুভি বানাতে ওস্তাদ ভিজিনি। বোধহয় জানেন, ড্ৰিসকলের কাছে ওই প্রথম প্রজেক্টটা নিয়ে আসে। আমাকে ডাকার আগেই একাজ করে সে। তবে আমি শুনেছি ভিজিনির আসল পরিকল্পনা ছিল, নরম্যানের চরিত্রে ও নিজেই অভিনয় করবে।

আমি জানতাম না। মাথা নাড়লেন ক্লেইবন। ওদের দুজনের চেহারায় মিল আছে…

ড্রিসকল নিশ্চয়ই হটিয়ে দিয়েছে ওকে। বলেছে, ওদের বড় স্টার দরকার। এজন্য পল মরগ্যানকে বেছে নেয়। কিন্তু ভিজিনি নিজে পলকে কোচিং করাচ্ছে। এমনকি সে-ই উইগ আর পোশাক নির্বাচন করেছে।

আর ছুরিটাও, বললেন ক্লেইবর্ন। এইমাত্র ছুরি বাছাই করতে দেখে এলাম। দেখে মনে হচ্ছিল, সে যেন জানে, নরম্যান কোন ছুরি ব্যবহার করেছিল!

গভীর নিঃশ্বাস নিল রয়। আপনি যে চমকে গেছেন, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। ও যদি সত্যিই নরম্যানের মতো দেখতে হয়…

উঠে দাঁড়ালেন ক্লেইবন। আমার মনে হয়, মি. ড্ৰিসকলের সঙ্গে কথা বলা উচিত আমাদের।

কিন্তু বাধ সাধল অনিতা কেজি।

তারা ড্ৰিসকলের অফিসে পৌঁছতেই মাথা নাড়তে শুরু করল মেয়েটি। দুঃখিত। তিনি ভেতরে নেই, ওদের বলল সে। দুপুরে ফিরবেন কিনা বলতে পারছি না…

ভালো মেয়ে।

দরজার পেছনে দাঁড়ানো মার্টি ড্ৰিসকলের দিকে তাকাল মিস কেজি। অতিথিদের উদ্দেশ্যে নড় করল সে। অভিনন্দন। স্ক্রিপ্ট পছন্দ হয়েছে আমার।

ক্লেইবর্নের দিকে এক নজর তাকাল রয়। ভিজিনির পছন্দ হয়নি।

জানি, ড্ৰিসকলকে আপসেট দেখাচ্ছে। এ ব্যাপারে কথা বলতে চান? ইশারায় ওদের দুজনকে তার পিছু নিতে বলল সে।

মি. ড্ৰিসকল। ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করল অনিতা কেজি। নিউ ইয়র্ক থেকে আপনার ফোন কল আসার কথা…।

চিন্তা করো না। ঘড়ির দিকে তাকাল প্রযোজক। ওখানে এখন সাতটার বেশি বাজে। খুব সম্ভবত ও এখন ডিনারে গেছে। যদি চেক ইন করে, তাহলে রাতে আমাকে বাসায় ফোন করতে বলো।

অনিতার ভ্রুকুটির সামনে দরজা বন্ধ করে রয় আর ক্লেইবর্নের মুখোমুখি বসল। সে। আপনারা আসায় খুশি হয়েছি। আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে যাচ্ছিলাম, ভিজিনি তো খেপে বোম। কেবল কান ভারী করে গেল। রয়ের দিকে তাকিয়ে হাসল সে। আপনাকে খুব যন্ত্রণা দিয়েছে?

আমি কথা বলেছি ভিজিনির সঙ্গে, ক্লেইবর্ন বললেন। মার্ডার সিনগুলোর সহিংসতা কমিয়ে দেয়ায় তার আপত্তি আছে মনে হয়।

আমার নেই, চওড়া হাসি উপহার দিল ড্ৰিসকল। একটা কথা মনে রাখবেন। ভিজিনি এখন প্রচুর চাপের মধ্যে আছে। শুটিং শুরুর তারিখ নিয়ে আমরা সবাই ই চাপে আছি।

সে-ব্যাপারেই কথা বলতে চাইছি, ক্লেইবর্ন বললেন তাকে।

বলুন।

ক্লেইবর্ন ড্ৰিসকলকে ঘটনাটা আবার বলার সময় প্রযোজকের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করল রয়।

দেখে মনে হচ্ছে, মনোযোগ দিয়েই শুনছে সব। নরম্যানের সঙ্গে ভিজিনির চেহারার মিলের কথায় আসতেই বাধা দিল সে।

আমার তো এমন কিছু মনে হয় না, বলল সে।

কিন্তু এটাই সত্যি। ভিজিনি কিন্তু জানে ব্যাপারটা। সে কিন্তু নরম্যানের চরিত্রে অভিনয়ও করতে চেয়েছিল।

জর্জ ওয়ার্ড আপনাকে পছন্দ করবে। খলখল করে হাসল ড্ৰিসকল। এ ধরনের কৌতুক ও-ই চালু করে প্রথমে।

আমি কিন্তু সিরিয়াস। এই লোকটা…

একজন পরিচালক, ক্লেইবর্নের হয়ে কথাটা শেষ করে দিল ড্ৰিসকল। ওকে ছাড়া চলবে না আমাদের। পল মরগ্যানের চেহারা অল্পস্বল্প টিকিট বেঁচে দিতে পারবে। কিন্তু ওর মাধ্যমে আমাদের অ্যাকাউন্ট ফুলবে না। জ্যান কিছুই না। ভিজিনিকে বিক্রি করছি আমরা। ও-ই সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু।

এমনকি ও যদি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়, তা-ও?

সব পরিচালকই কমবেশি পাগল। এসবে পাত্তা দেবেন না।

কিন্তু আমাকে পাত্তা দিতে হচ্ছে। –কুচকে গেছে ক্লেইবর্নের। কাল রাতে আগুনের কথা শুনে রয়কে ফোন করেন আপনি। ভিজিনিকে জানানোর চেষ্টা করেননি কেন?

চেষ্টা করেছি, দ্বিধাজড়িত গলায় বলল ড্ৰিসকল। ওর অ্যানসারিং মেশিনে মেসেজ দিয়ে রেখেছিলাম।

তার মানে বাইরে ছিল ও, আরও গম্ভীর হলো ক্লেইবর্নের জ্বর কুঁচকানি। ও কোথায় ছিল, সেটা বলেছে আপনাকে? আপনাকে কি আদৌ ফিরতি কল করেছিল ও?

যীশু! ডেস্কে থাবা মারল ড্ৰিসকল। আপনি বলতে চাইছেন, ভিজিনি তার নিজের সিনেমায় স্যাবোটাজ করার জন্য আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল?

কেউ একজন তো লাগিয়েছে।

ঝোঁপের মতো ঘন ভ্রু উঁচু করল ড্ৰিসকল। দেখুন, ডাক্তার। গতকাল রাতে যা ঘটেছে, তা যেন বাইরের কারও কাছে ফাস না হয় সে-ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে চাই আমি। এজন্য আজ সকাল সাতটায় ট্যালবটকে আমার অফিসে ডাকি।

আপনার সিকিউরিটি চিফ?

হ্যাঁ। পুরো ঘটনাটা বুঝতে পেরেছে সে। আর গ্যাসোলিন ক্যানটাও পরীক্ষা। করে দেখেছে। ক্যানটায় আমার আর মাদেরোর হাতের ছাপ পাওয়া গেছে। তবে অন্য একটা হাতের ছাপও পাওয়া গেছে। আর সেটা ভিজিনির হাতের ছাপ নয়।

সামনে ঝুঁকল রয়। এতো নিশ্চিত হচ্ছেন কীভাবে?

স্টুডিওর সব কর্মচারীর হাতের ছাপের সাথে মিলিয়ে দেখেছি আমরা। অন্য ছাপটা লয়েড পার্সনসের। লোকটা সেট-ড্রেসার। আজ দুপুরে ওর সঙ্গে দেখা করে কথা বলেছি আমি আর ট্যালবট।

আগুন নিয়ে?

বিজয়ীর ভঙ্গিতে হাসল ড্ৰিসকল। কাল রাতে আপনাকে কী বলেছিলাম, মনে আছে? আমি যা বলেছিলাম, তা-ই ঘটেছে। কাল কাজ শেষে ক্যানটা ভুলে ওখানে ফেলে আসে ও। ও হ্যাঁ, কাজ শেষে প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে পড়ায় ওই বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ সিগারেট টানে ব্যাটা।

কিন্তু এসব তো বাইরে গিয়েও করতে পারত! বললেন ক্লেইবন।

আমরাও তো সেকথাই বলেছিলাম। কিন্তু লোকটা আমাদের ভুজুং-ভাজুং দিয়ে গেল। খুব নাকি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। আমার ধারনা, গাঁজা টানছিল লোকটা। এখানকার অনেকেই টানে। এটা অবশ্য তার ঘুমিয়ে পড়ার একটা কারণ হতে পারে। আগুন জ্বলে ওঠায়, জেগে ওঠে লয়েড। ভয় পেয়ে পালাতে চেষ্টা করে। ঠিক আমি যেমনটা বলেছিলাম। পুড়ে যে মরেনি, এই কত!

এই গল্প বিশ্বাস করেন আপনি? রয় জিজ্ঞেস করল।

ও যদি মিথ্যাই বলত, তাহলে এমন কিছু বলবে কেন? যখন সে জানে যে ওর বিরুদ্ধে আমরা অভিযোগ আনতে পারি?

আনবেন নাকি?

অভিযোগ করে বীমার লোকজনের সঙ্গে ঝামেলায় জড়াই আরকি! তাহলেই হয়েছে! চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল ড্ৰিসকল। ওকে সেকথা বলিনি আমি। ও বারবার আমাকে অনুরোধ করেছে, ওকে যেন ইউনিয়নের সামনে হাজির না করি। আমি বলেছি, ঠিক আছে। তবে এক শর্তে। ওকে যেন আর সিনেমার সেটে দেখা না যায়। আমি জানি না, লয়েড কী অজুহাত দেখিয়েছে। তবে আজ বিকেলে ছবির সেট ছেড়ে চলে গেছে সে। দুশ্চিন্তা করবেন না। এমনটা ঘটবে না আর।

ক্লেইবর্নের প্রতিবাদের অপেক্ষায় আছে রয়। কিন্তু শুধু নড করলেন তিনি।

স্টুডিও থেকে বেরিয়ে এসেও তার নীরবতা ভাঙল না। শেষমেশ রয়-ই ভাঙল এই মৌনতা।

কী মনে হয় আপনার? লোকটা কি সত্যি কথা বলেছে?

সেটের লোকটার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে, আমি জানি না। তবে ড্ৰিসকলের ব্যাপারে সন্দেহ আছে আমার।

সন্দেহ দূর করার কোনও উপায় আছে?

অস্তরত সূর্যের দিকে তাকালেন ক্লেইবন। থাকতেই হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *