২১-২৫. টুনটুন করে ডোরবেল বাজছে

২১.

টুনটুন করে ডোরবেল বাজছে।

এতরার ভ্রূ কুঞ্চিত হল। কে হতে পারে? রাত প্রায় নটা। রুম সার্ভিস হবে না নিশ্চয়ই। দরজার পিপ হোল দিয়ে যে-লোকটিকে দেখা যাচ্ছে, সে ব্রিটিশ। অত্যন্তু ভদ্র চেহারা। এ তার কাছে কী চায়?

এতরা দরজা খুলতেই বাইরে দাঁড়ানো লোকটি বলল, আপনাকে বিরক্ত করবার জন্যে আন্তরিক দুঃখিত।

কে আপনি?

বলছি। তার আগে ভেতরে এসে বসতে পারি কি?

আমার পক্ষে বেশি সময় দেয়া সম্ভব নয়। আমি আজ সকালেই ইংল্যান্ডে এসে পৌঁছেছি। অসম্ভব ক্লান্তু।

আজ সকালে এসেছেন কথা ঠিক নয়, মিঃ এতরা। আপনি এসেছেন পরশু। আমি ভেতরে আসতে পারি?

আসুন।

ভদ্রলোক ভেতরে এসেই বললেন, আমি হচ্ছি লয়েডস ইনস্যুরেন্সের একজন তদন্তকারী অফিসার। আমার নাম রেমন্ড কিন।

 এতরা কিছু বলল না। লোকটি অত্যন্ত সহজ ভঙ্গিতে সোফায় বসে হাসিমুখে বলল, অ্যানি নামের একটি মেয়ের ইনস্যুরেন্স পলিসির ব্যাপারে আপনাকে দুএকটি কথা জিজ্ঞেস করব। অবিশ্যি আপনি যদি অনুমতি দেন।

আপনি কী করে জানলেন যে আমি এখানে আছি। আমার ঠিক এই মুহূর্তে এখানে থাকার কথা নয়।

মিঃ এতরা, এটা জানার জন্যে আমাদেরকে শার্লক হোমস হবার প্রয়োজন হয় না। আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবার জন্যে দুজন গিয়েছিলেন ইতালি। তারা ট্রাভেল এজেন্টের মাধ্যমে জেনেছে আপনি ইংল্যান্ডের টিকিট কেটেছেন। আমি তাই এখানকার হোটেলগুলিতে খোঁজ করেছি। আপনি যদি অন্য কোনো নামে হোটেল রিজার্ভেশন করতেন, তা হলে অবিশ্যি আমার পক্ষে খুঁজে বের করা সম্ভব হত না।

আমি অন্য নামে সিট রিজার্ভ করব কেন?

কথার কথা বলছি মিঃ এতরা। অবিশ্যি ইচ্ছা থাকলেও আপনি তা পারতেন না। কারণ হোটেল সিট রিজার্ভেশনের সময় বিদেশী নাগরিকদের পাসপোর্ট দেখাতে হয়।

এতরা সিগারেট ধরাল। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে।

মিঃ এতরা, এখন কি আমি দুএকটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?

না, এখন পারেন না। আমি খুবই ক্লান্ত। আপনাকে কাল আসতে হবে। রাত নটা আলোচনার জন্যে ভালো সময় নয়।

রেমন্ড কিন সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। হাসিমুখে বলল, আমি কাল সকালে আসব। বিরক্ত করার জন্যে অত্যন্ত দুঃখিত।

দশটার পর আসবেন। আমি অনেক দেরি করে উঠি।

আমি আসব ঠিক সাড়ে দশটায়। ইতালি সম্পর্কে কিছু গল্পগুজবও করা যাবে।

ইতালি সম্পর্কে গল্পগুজব করার কিছু নেই।

থাকবে না কেন? আমি দুদিন আগের খবর জানি সেখানে জামশেদ নামের একটি লোক গ্রেফতার হয়েছে পুলিশের কাছে। এ নিয়ে ইতালিতে তুমুল উত্তেজনা।

এতরা চাপা স্বরে বলল, জামশেদ গ্রেফতার হয়েছে?

হ্যাঁ, হয়েছে। আমরা জামশেদের ব্যাপারেও উৎসাহী। অ্যানির ইনস্যুরেন্সের বিষয়ে ওকেও দরকার। কাজেই আমরা ওর ব্যাপারে খোঁজ রাখার চেষ্টা করছি। মিঃ এতরা!

বলুন। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আপনিও জামশেদের ব্যাপারে বেশ উৎসাহী।

না, আমি উৎসাহী নই। আমি উৎসাহী হব কীজন্যে?

ও, সরি। আমারই ভুল হয়েছে। আচ্ছা মিঃ এতরা, আমরা কাল ভোরে কথা বলব।

দশটার পর।

ঠিক সাড়ে দশটায় আমি আসব। গুড নাইট।

এতরা টেলিফোনে ব্রুম সার্ভিসকে কফি দিতে বলল। তার দুমিনিট পরেই বলল কফি দেবার প্রয়োজন নেই। তার কিছুই ভালো লাগছে না। তার কেন জানি প্রচণ্ড ভয় করতে লাগল। ইংল্যান্ডে আসার পরিকল্পনাটি কাঁচা। তার উচিত ছিল দেশেই থাকা। দেশে নিরাপত্তার ব্যবস্থা আরো জোরদার করা যেত।

এখন ফিরে গেলে কেমন হয়? কাল সকাল দশটার আগেই রওনা হয়ে গেলে মন্দ হয় না। ইনস্যুরেন্স কোম্পানির ঐ ছাগলটির সঙ্গে কোনো কথা বলার ইচ্ছে হচ্ছে না।

এতরা রাত তিনটায় হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে এল। ভোর সাড়ে চারটায় ফ্রান্সের কনকর্ডের একটি টিকিট পাওয়া গেছে। সেখান থেকে বাসে করে ইতালি চলে যাওয়া যাবে। ভালো লাগছে না, কিছুই ভালো লাগছে না।

২২.

জামশেদ সমস্ত দিন শুয়ে রইল।

প্রচণ্ড খিদে। কিন্তু কোনো খাবার নেই। এক জগ পানি ছিল তা শেষ হয়েছে অনেক আগেই। জামশেদের শুয়ে থাকা কিংবা বসে বসে বদ্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আরকিছু করবার নেই। চুপচাপ বসে থাকার ব্যাপারটি খুবই বিরক্তিকর। জামশেদ ঘুমুতে চেষ্টা করছে। কিন্তু ঘুম আসছে না। স্নায়ু উত্তেজিত। সে মনে-মনে পরবর্তী পরিকল্পনা ঝালিয়ে নিতে গিয়ে বাধা পেল। পরবর্তী পরিকল্পনা করাও অর্থহীন। এখান থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। অলৌকিক কোনো ব্যাপার বা সৌভাগ্য এসব জিনিসে জামশেদের বিশ্বাস নেই। কাজেই পরবর্তী কোনো পরিকল্পনা তৈরির আগে বরং মৃত্যুর জন্যে মানসিক প্রস্তুতি নেয়াই ভালো।

কী হয় মৃত্যুর পর? মৃত্যুর ওপারেও কি কোনো জগৎ আছে? সুখী কোনো ভুবন? যেখানে কষ্ট নামক ব্যাপারটি মেই। ক্ষুধার কষ্ট নেই। গ্লানি ও বঞ্চনার কষ্ট নেই। আনন্দ ও উল্লাসের একটি অপরূপ ভুবন। ভাবতে ভাবতে জামশেদের ঘুম এসে গেল। অদ্ভুত একটি স্বপ্ন দেখল সে।

যেন অ্যানি ছুটতে ছুটতে আসছে, তার বদ্ধ ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বলছে, এই ভালুক, তুমি এখানে আটকা পড়ে আছ কেন?

বুদ্ধির দোষে আটকা পড়েছি।

এমন বোকা কেন তুমি?

অ্যানি মাথা দুলিয়ে খুব হাসতে লাগল। রিনরিনে মিষ্টি গলায় হাসি। ঘুম ভেঙে উঠে বসল জামশেদ।

এখন কি দিন না রাত বোঝার উপায় নেই। ঘরে সবসময় বাতি জ্বলছে। কোনোরকম শব্দটও কানে এসে পৌঁছাচ্ছে না। ক্ষুধার তীব্রতাও ক্রমে ক্রমে মরে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে এই ধরে সে আছে আটচল্লিশ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে। ত্রিশ ঘণ্টা পার হলে খিদে মরে যায়। শুধু তৃষ্ণা থাকে। তৃষ্ণাও কমে আসে পঞ্চাশ ঘণ্টায়।

না খেয়ে থাকার অভিজ্ঞতা জামশেদের আছে। একবার সে এবং বেন ওয়াটসন না খেয়ে সাত দিন ছিল। সে ছিল একটি ছেলেমানুষি ব্যাপার। বেন ওয়াটসন একদিন বলল, জামস, একটা বাজি ধরলে কেমন হয়?

কিসের বাজি?

না খেয়ে থাকায় বাজি। কে বেশি সময় থাকতে পারে।

কত টাকা বাজি?

পঞ্চাশ ইউ এস ডলার।

ঠিক আছে।

বেন ওয়াটসনের কাজই হচ্ছে বাজি ধরা। সবকিছুতেই সে একটা বাজি ধরে ফেলবে। এবং অবধারিতভাবে হারবে। না খেয়ে থাকার বাজিতেও তা-ই হল।

ত্রিশ ঘণ্টার মাথায় ওয়াটসন পঞ্চাশ ডলারের নোট এনে মুখ কালো করে বলল, আবার হারলাম। এসো এবার খানাপিনা করা যাক।

জামশেদ বলল, তুমি খাওয়াদাওয়া করো। আমি দেখতে চাই না-খেয়ে কতদিন থাকা যায়।

আর দেখাদেখি কী, তুমি তো জিতবেই।

বাজি-টাজি না। পরীক্ষা করতে চাই, না-খেয়ে কতদিন থাকা যায়।

জামশেদ ঝুলে রইল সাতদিন পর্যন্ত। বেন ওয়াটসন চিন্তায় চিন্তায় অস্থির। সামান্য বাজি ধরা থেকে এ কী ঝামেলায় পড়া গেল! শেষমেশ পাঁচশো ডলার নিয়ে সাধাসাধি, যেন জামশেদ কিছু-একটা মুখে দেয়। ইস, কীসব দিন গিয়েছে!

সে বিছানায় উঠে বসল। আবার শুয়ে পড়ল। উঠে বসা এবং শুয়ে থাকা এই দুটি মাত্র কাজ তার। প্রথম দিকে খানিক হাঁটাহাঁটি করা যেত, এখন আর যায় না। শোয়ামাত্রই ঝিমুনি এসে গেল জামশেদের। আর প্রায় তার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হল অ্যানি দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার মুখ কেমন যেন বিষণ্ণ। কথা বলছে টেনে টেনে।

বুড়ো ভালুক।

উঁ

খুব কষ্ট হচ্ছে?

তা হচ্ছে, অ্যানি।

মানুষের এত কষ্ট কেন বুড়ো ভালুক?

কী জানি অ্যানি।

আমি কারোর কষ্ট দেখতে পারি না। খুব কান্না পায়।

জামশেদের মনে হল অ্যানি কাঁদতে শুরু করেছে। সে হাত বাড়াল অ্যানিকে সান্ত্বনা দিতে, তখনই তন্দ্রা কেটে গেল। আবার সেই আগের ছোট্ট ঘর। চল্লিশ পাওয়ারের হলুদ একটা বাতি। জামশেদের পেটে পাক দিয়ে উঠল। বমি হবে বোধহয়। হয়, এরকম হয়। একটা সময় আসে যখন শরীর বিদ্রোহ করতে শুরু করে। চোখ কিছু দেখতে চায় না। পা চলতে চায় না। মস্তিষ্ক স্থবির হয়ে আসে। জামশেদ মেঝেতে বমি করল।

.

বস ভিকানডিয়া ঠাপ্তস্বরে বলল, একটি লোক হাওয়া হয়ে যেতে পারে না।

ফাজিন জবাব দিল না।

লোকটি নিশ্চয়ই কোনো মন্ত্রটন্ত্র জানে না। নাকি তোমরা বলতে চাও সে অলৌকিক ক্ষমতাধর কোনো মানুষ?

সে খুব সম্ভব ইতালিতে নেই। ইতালিতে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে তাকে খোঁজা হয়নি। আমার ধারণা সে জীবিত নেই।

এরকম ধারণা হবার কারণ কী?

 কোনো কারণ নেই, আমার মনে হচ্ছে এরকম।

কারণ ছাড়াই যারা বিভিন্ন জিনিস ভাবে ওরা ছাগল সম্প্রদায়ভুক্ত বলেই আমি মনে করি।

ফাজিন কিছু বলল না।

ভিকানডিয়া তিক্তস্বরে বলল : ওর বন্ধু ওয়াটসন কী বলছে?

ও কিছুই বলছে না।

বলাবার চেষ্টা করেছ?

হ্যাঁ করেছি। পেন্টাথল ইনজেকশন দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ও কিছু জানে না। জানলে বলত।

কী বলে সে?

সে বলে যে ওর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে জামশেদ ওর সঙ্গে দুরাত ছিল।

সেই দুরাত ওদের মধ্যে কী কথাবার্তা হয়েছে?

বিশেষ কোনো কথাবার্তা হয়নি। জামশেদ কথা বলে কম।

ভিকামডিয়া চুরুট ধরাল।

ফাজিন বলল, ওয়াটসনকে নিয়ে এখন কী করব?

আমাকে জিজ্ঞেস করছ? এইসব ছোট জিনিস নিয়ে কেন তোমরা আমাকে বিরক্ত কর? যদি দেখ ওকে ধরে রেখে আর কোনো লাভ নেই তা হলে আপদ বিদেয় করো। বস্তায় ভরতি করে ফেলে দাও সমুদ্রে।

.

ভিকির অবস্থা খারাপ হয়েছে। খাওয়াদাওয়া বন্ধ। রাতে ঘুমুতে পারে না। সমস্ত রাত বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে থাকে। রুন দিশাহারা হয়ে গেল। ডাক্তাররা তেমন কিছু ধরতে পারেন না। মানসিক অসুস্থতার কোনো লক্ষণ নেই। ডাক্তারদের সঙ্গে কথাবার্তা সহজ স্বাভাবিক মানুষের মতো। কিন্তু রুনের সঙ্গে কথা বলার সময় কথা জড়িয়ে যায়। একটি কথা শুরু করে অন্য একটি কথায় চলে যায়। রুন কয়েকবার চেষ্টা করেছে ভিকিকে নিয়ে সুইজারল্যান্ডের দিকে যেতে। বাইরে হয়তো অন্যরকম হবে। আবার হয়তো ভিকি আগের মতো হয়ে উঠবে।

 ভিকির ব্যবসা নষ্ট হয়ে গেছে তাতে কিছুই যায় আসে না। ব্যবসা আবার হবে। রুনের নিজের যথেষ্ট টাকা আছে। কোনোকিছু না করেই সে-টাকায় নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে। অবিশ্যি পুরুষমানুষ বসে থাকতে পারে না। পুরুষমানুষদের কিছু-একটা করতে হয়। কাজেই আবার যাতে ভিকি উঠে দাঁড়াতে পারে রুন সে-চেষ্টা করবে।

রুন দেখল ভিকি উঠে আসছে। পা ফেলছে এলোমেলোভাবে। রুন এগিয়ে গিয়ে ভিকিকে ধরে ফেলল।

একটা অন্যায় করেছি, রুন। তোমাকে আজ সেটা বলতে চাই।

রুন বলল, অন্যায় করে থাকলে করেছ। আমরা সবাই কখনো-না-কখনো ভুল করি।

আমি যা করেছি সেটা তোমার শোনা দরকার।

আমি কিছুই শুনতে চাই না। আমি চাই তুমি আগের মতো হও।

রুন প্লিজ, আমার কথা শোনো।

না, কোনো কথা শুনতে চাই না আমি।

রুন ভিকিকে গভীর আবেগে জড়িয়ে ধরল। ছেলেমানুষের মতো চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগল ভিকি।

২৩.

জামশেদ তুমি বেঁচে আছ?

জামশেদ চোখ মেলল। পরিষ্কার কিছু দেখা যাচ্ছে না। সব যেন ঘোলাটে লাগছে।

আমি ক্যানটারেলা। তোমার জন্যে খাবার এনেছি। নাও, খাও। প্রথম খাও ফলের রস। তারপর দুখ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। শরীরে একটু শক্তি হোক আমি আবার আসিব।

জামশেদ কথাবার্তাও ঠিক বুঝতে পারছে না। তবুও সে উঠে বসতে চেষ্টা করল।

নড়াচড়া করবে না, শুয়ে থাকো। আমি দুঃখিত যে তোমাকে ছদিন না-খেয়ে থাকতে হল! উপায় ছিল না। খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করতে গেলেই তোমাকে ওরা খুঁজে বের করে ফেলত। তবে আমি জানতাম ছদিনে তোমার কিছুই হবে না।

ক্যানটারেলা কমলার রস জামশেদের মুখের কাছে ধরল। মৃদুস্বরে বলল, একসঙ্গে বেশি খাবে না, অল্প কিছু মুখে দাও। তারপর কিছু সময় বিশ্রাম করো। আবার কিছু খাও। একজন ডাক্তার নিয়ে এসেছি, সে বোধহয় তোমার শিরা দিয়ে কিছু খাবারদাবার ঢোকাবে।

জামশেদের মনে হল ক্যানটারেলার পাশে যেন অ্যানি দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে। সে যেন বলছে, খাও, বুড়ো ভালুক, খাও। এমন বোকার মতো তাকিয়ে থেকো না।

জামশেদ গ্লাসে চুমুক দিল।

জামশেদ, এখন কি সুস্থ বোধ করছ?

জামশেদ চোখ মেলল। ক্যানটারেলা দাঁড়িয়ে আছে। জামশেদ বলল, আজ কত তারিখ?

বারো। বারোই আগস্ট। তুমি কি এখন সুস্থ বোধ করছ?

করছি।

ভালো, খুবই ভালো। আরো বিশ্রাম নাও, আমি পরে আসব।

আমার যথেষ্ট বিশ্রাম হয়েছে।

আরো হোক। একটু ব্রান্ডি খাবে? এতে স্নায়ু টানটান হয়ে ওঠে।

আমার স্নায়ু এমনিতেই টানটান।

ঠিক আছে, তা হলে ব্র্যান্ডি খেতে হবে না। বিশ্রাম নাও। ডাক্তার বলেছে দিন দুয়েকের মধ্যে তুমি আগের ফর্মে ফিরে আসবে।

জামশেদ ক্লান্তস্বরে বলল : মনে হচ্ছে তুমি চাও, আমি দ্রুত আগের ফর্মে ফিরে আসি।

হ্যাঁ, আমি চাই। তোমাকে আমার দরকার আছে। আজ রাতে একবার আসব। তখন বলা যাবে কেন দরকার।

.

এতরা ইতালিতে ফিরে এসে হকচকিয়ে গেল। জামশেদ ধরা পড়েনি। শুধু তা-ই নয়, সে নাকি বাতাসে মিলিয়ে গেছে। ক্যানটারেলার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে। ক্যানটারেলার কথাবার্তাও অস্পষ্ট। কিংবা এতরা এখন আর আগের মতো চিন্তাভাবনা করতে পারে না বলেই সব কথাবার্তাই অস্পষ্ট মনে হয়। এদের দুজনের মধ্যে কথোপকথন ছিল এরকম—

এতরা : তুমি তো বলেছিলে তিন দিনের ভেতর ওকে ধরবে, তারপর চামড়া খুলে সমুদ্রে ডুবিয়ে রাখবে।

ক্যানটারেলা : বলেছিলাম নাকি?

এতরা : হ্যাঁ।

ক্যানটারেলা; লোকটি মন্ত্রটন্ত্র জানে। বিপদের সময় ফস করে অদৃশ্য হয়ে যায়।

এতরা : কী বলছ এসব? ঠাট্টা করছ নাকি?

ক্যানটারেলা : ঠাট্টা না, আমি ঠাট্টা-ফাট্টা করি না।

এতরা : প্লিজ ক্যানটারেলা, ঠাট্টা-তামাশা সহ্য করার ক্ষমতা এখন আমার নেই।

ক্যাটারেলা : না থাকারই কথা। কারণ তুমি সম্ভবত নেক্সট টার্গেট।

এতরা : কী বলছ এসব?

ক্যানটারেলা : ঠিকই বলছি।

এতরা : তুমি পাগলের মতো প্রলাপ বকছ।

ক্যানটারেলা : হতে পারে। হওয়াই সম্ভব, হা হা হা।

এতরা : হাসছ কীজন্যে? এর মধ্যে হাসির কী হয়েছে?

ক্যানটারেলা : একটা পুরনো জোক মনে করে হাসছি। শুনতে চাও? একবার একটা লোক নাপিতের দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করল (এই জায়গায় এতরা খট করে রিসিভার নামিয়ে রাখল)।

পরপর দুরাত এতরার এক ফোঁটা ঘুম হল না। খুট করে কোনো শব্দ হতেই সে লাফিয়ে ওঠে। তার মনে সন্দেহ, গার্ডরা হয়তো পাহারা দেবার নাম করে ঘুমুচ্ছে। সে প্রতি দুঘণ্টা পরপর নিচে নেমে যায় খোঁজ নিতে। কোনো একটি কামরায় বেশিক্ষণ থাকতে পারে না।

 দ্বিতীয় রাতে কড়া এক ডোজ লিব্রিয়াম খেল। কিন্তু তাতেও কিছু হল না। শেষরাতের দিকে তার মতো হল। কিন্তু সে-তন্দ্রা বিভীষিকার তন্দ্রা, এতরা স্পষ্ট দেখল জামশেদ সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় এক হাতে একটি ধারালো তলোয়ার নিয়ে তার দিকে ছুটে আসছে। সে দৌড়াচ্ছে প্রাণপণে। দুজনের দূরত্ব ক্রমেই কমে আসছে। এতরার বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা লাফাচ্ছে, যেন এক্ষুনি ফেটে চৌচির হবে।

এতরা জেগে উঠে বিকট স্বরে কেঁদে উঠল–আহ্, বেঁচে থাকা কী কষ্টের ব্যাপার!

.

জামশেদ, তুমি কি এখন পুরোপুরি সুস্থ।

হ্যাঁ।

পাঞ্জা লড়বে এক হাত দেখতে চাই সুস্থ কি না।

ঠিক আছে। তোমার জন্যে ভালো চুরুট আনিয়ে রেখেছি। হাভানা চুরুষ্ট, নাও।

জামশেদ হাত বাড়িয়ে চুরুট নিল। শীতল স্বরে বলল, ক্যানটারেলা, এখন বলো কী বলতে চাও।

বলছি। তার আগে একটু মার্টিনি হলে কেমন হয়?

আমি এখন মদ খাই না।

ভালো। তোমার জন্যে কফি দিতে বলি?

বলো।

ক্যানটারেলা চুরুট ধরিয়ে হাসিমুখে বলল, তোমাকে ছোট্ট একটা গল্প বলতে চাই, জামশেদ।

গল্পে আমার কোনো আগ্রহ নেই, মিঃ ক্যানটারেলা।

জামশেদ তাকিয়ে রইল। ক্যানটারেলা মৃদুস্বরে বলল, আমি যখন খুব ছোট তখন ভিকানডিয়া পরিবারের সঙ্গে আমাদের পরিবারের একটা বড় ধরনের ঝামেলা শুরু হয়। মাফিয়া পরিবারগুলির ঝামেলার নিষ্পত্তি কীভাবে হয় তা হয়তো তুমি জান। এক পরিবারকে শেষ হয়ে যেতে হয়। আমাদেরও অবস্থা হল সেরকম। শেষ পর্যন্ত কোনো উপায় না দেখে আমার বাবা সন্ধির ব্যবস্থা করল। সন্ধির শর্তগুলির মধ্যে একটি হল—আমার মাকে যেতে হবে ভিকানডিয়ার ঘরে। রক্ষিতার মতো। আমার মা বিশেষ রূপসী ছিলেন। ভিকানডিয়ার শুরু থেকেই মা’র প্রতি আগ্রহ ছিল। পারিবারিক বিরোধের এটিও একটি কারণ। গল্পটি তোমার কেমন লাগছে, জামশেদ?

জামশেদ জবাব দিল না। ক্যানটারেলা থেমে বলল : আমার মা’র বেশিদিন দুঃখ ভোগ করতে হল না। অল্পদিন পরই তার মৃত্যু হল। আমরাও ধীরে ধীরে সব ভুলে যেতে শুরু করলাম। একসময় ভিকানডিয়া আমাকে স্নেহ করতে শুরু করলেন। পুরাতন স্মৃতি কিছু আর মনে রইল না।

তারপর হঠাৎ একদিন তুমি এসে উদয় হলে। তোমার কাণ্ডকারখানা দেখে পুরানো সব কথাবার্তা আমার মনে পড়তে শুরু করল। বিশেষ করে মনে পড়তে লাগল আমার মাকে। তিনি আমাকে কী ডাকতেন জান? তিনি ডাকতেন ন্যাংটা বাবা বলে। কীরকম অদ্ভুত নাম, দেখলে

জামশেদ তাকিয়ে দেখল ক্যানটারেলার চোখ দিয়ে জল পড়ছে। ক্যানটারেলা ধরাগলায় বলল : জামশেদ, আমার শরীরটা হাতির মতো। কিন্তু আমার সাহস নেই। আমি পৃথিবীর সবচে বলশালী কাপুরুষদের একজন। সেজন্যেই তোমাকে আমার প্রয়োজন।

জামশেদের চুরুট নিভে গিয়েছিল। সে আবার চুরুট ধরাল। ক্যানটারেলা মৃদুস্বরে বলল : ভিকানডিয়ার প্রাসাদে ঢোকার ব্যবস্থা আমি করে দেব। বেরুবার ব্যবস্থা করতে পারব না। এটা হচ্ছে ওয়ান ওয়ে জার্নি। তুমি ঢুকতে পারবে, বেরুতে পারবে না।

জামশেদ শান্তস্বরে বলল : বেরুতে না পারলেও ক্ষতি নেই।

আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। রওনা হতে হবে আজ রাতেই। আজ রাত নটায় বিশেষ কারণে ভিকানডিয়ার ঘরের সব বাতি হঠাৎ করে নিভে যাবে।

জামশেদ কিছু বলল না। ক্যানটারেলা ঠাণ্ডা গলায় বলল, তুমি যদি ফিরে না আসতে পার, তা হলে এতরার ব্যবস্থা আমি করব। তুমি এ ব্যাপারে কিছুমাত্র চিন্তা করবে না। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি।

ঠিক আছে।

জামশেদ, আরেকটি কথা। যদি তুমি ফিরে না আসতে পার তা হলে তোমার ডেডবডি কি দেশে ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করব?

নাহ।

কাউকে কিছু বলতে হবে?

নাহ।

কোনোকিছুই বলার নেই তোমার

জামশেদ মৃদুস্বরে বলল, যদি সম্ভব হয় অ্যানির পাশে একটু জায়গা রাখবে। মেয়েটি বড্ড ভীতু। আমি পাহারায় থাকলে হয়তো শান্তিতে ঘুমুবে।

ক্যানটারেলা তাকিয়ে রইল, কিছু বলল না।

২৪.

গভীর রাতে এতরার ঘুম ভেঙে গেল। ঝনঝন করে টেলিফোন বাজছে। যেন ভয়াবহ কোনো খবর এসেছে টেলিফোনে। এতরা কাঁপা গলায় বলল, হ্যালো।

এতরা, খবর শুনেছ?

কী খবর?

বস ভিকামডিয়াকে খুন করা হয়েছে। কে করেছে বুঝতে পারছ তো?

কে? জামশেদ?

ঠিক ধরেছ। তবে তোমার জন্যে একটি সুখবর আছে। জামশেদও মারা যাচ্ছে। খুব বেশি হলে ঘণ্টাখানেক টিকে থাকবে। আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?

পাচ্ছি।

একবার সিটি হাসপাতালে এসে দেখবে না কত লক্ষ লক্ষ মানুষ এসে জমা হয়েছে এই বিদেশী মানুষটির খবর নিতে?

তুমি কে?

ইতালির সবচে বড় বড় ডাক্তাররা ছুটে এসেছেন। তিনটি আলাদা আলাদা মেডিক্যাল বোর্ড হয়েছে। এরকম মরায় সুখ আছে, তাই না?

তুমি কে?

আমাকে চিনতে পারছ না?

না। তুমি কি ক্যানটারেলা?

টেলিফোন লাইন কেটে গেল। আবার দুঘণ্টা পর ঝনঝন করে বেজে উঠল।

হ্যালো, এতরা?

হা।

সুসংবাদ, জামশেদ মারা গেছে।

তুমি কে?

আমি ওর প্রেতাত্মা। জামশেদের মতো লোকগুলি মরেও মরে না। দীর্ঘকাল বেঁচে থাকে। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি।

এতরা কাপা গলায় বলল, তুমি ক্যানটারেলা?

না, আমি জামশেদ। আমি আসছি।

রাত চারটায় ছোট্ট একটি সাদা রঙের এপেল গাড়ি এতরার বাসার সামনে থামল। ক্যানটারেলা নেমে এল গাড়ি থেকে। নিচের গার্ডরা কেউ তাকে আটকাল না। এতরা বারান্দায় বসে শুনল সিঁড়ি বেয়ে ভারী পায়ে কে যেন উঠে আসছে উপরে।

২৫.

ইস্টার্ন সিমেট্রিতে অ্যানি নামের মেয়ের কবরের পাশে একজন বিদেশীর কবর আছে। তার গায়ে চার লাইনের একটি ইতালিয়ান কবিতা যার অর্থ অনেকটা এরকম

এখানে একজন মানুষ ঘুমিয়ে আছে। তাকে শান্তিতে ঘুমুতে দাও।

কবরটির পাশেই দুটি প্রকাণ্ড চেরিফুলের গাছ। বসন্তকালে কবরটি সাদা রঙের চেরিফুলে ঢাকা পড়ে থাকে। বড় চমৎকার লাগে দেখতে।

2 Comments
Collapse Comments

জামশেদ হোসেনের বাড়ি কি ময়মনহিংহ?

হামিদুল September 5, 2021 at 12:32 pm

Golpota sundor

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *