২১-২৫. অর্ক এগোল

টাকাটা দিয়ে অর্ক এগোল। এদিকে কোনও গেট নেই। সোজা হেঁটে সে বাড়ির ভেতরের বাগানে পৌঁছে গেল। ডানদিকে উঁচু লম্বা বারান্দা। এবার যেন চেনা চেনা মনে হল। হঠাৎ কানে এল মহিলা কণ্ঠের চিৎকার, কে? কে ওখানে? না বলে-কয়ে ভেতরে চলে এসেছে। থতমত হয়ে অর্ক দেখল বেশ জীর্ণ একজন বৃদ্ধা বারান্দার প্রান্তে এসে তার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে কথাগুলো বললেন। সে দুপা এগিয়ে গিয়ে অনুমান করল ইনিই ছোট ঠাকুমা। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই ওপাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এল মাধবীলতা। অর্ককে দেখে তার মুখে হাসি ফুটে উঠলেও হঠাৎ গম্ভীর হয়ে ছোটমাকে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে?

কী আবার হবে! এদিকে তো গেট নেই, একটা কাঠের দরজা ছিল যেটা তিন বছর আগে চুরি হয়ে গিয়েছে। এতদিন রাতবিরেতে চোর আসত নারকোল চুরি করতে এখন দিনদুপুরে উটকো লোক ঢুকে পড়ছে। কথাগুলোতে ছোটমার যাবতীয় বিরক্তি ঝরে পড়ল, এত কথা বলছি, দেখো না, ঠুটো জগন্নাথ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

মাধবীলতা কপট ধমক দিল, এই, এগিয়ে এসো।

অর্ক সামনে আসতেই আবার হুকুম হল, ওঁকে প্রণাম করো।

ছোটমা ছুটে হাত সামনে বাড়িয়ে এক পা পিছিয়ে গেলেন, না না, এসবের কোনও দরকার নেই, তুমি এখান থেকে বিদায় হও!

এবার মাধবীলতা হেসে ফেলল, এই, তুই নিজের পরিচয় দিতে পারছিস না?

সুযোগ পাচ্ছি না। তারপর ছোটমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি অর্ক, এইমাত্র কলকাতা থেকে এসেছি।

অ্যাঁ? ছোটমায়ের চোখ কপালে উঠল, তুমি অর্ক?

ততক্ষণে অর্ক প্রণাম সেরে নিয়েছে।

ছি ছি ছি। চিনতে না পেরে কী সব বললাম। আর চিনবই বা কী করে? কোনও সম্পর্ক তো রাখোনি! আমার কী দোষ! বাপ-মা আসতে পারেনি, ঠিক আছে, তুমি তো আসতে পারতে। সেই কত ছোট অবস্থায় দেখেছিলাম! হঠাৎ গলা ভিজে গেল ছোটমার।

বাবা কোথায়? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

খাটে শুয়ে বই পড়ছে। তার বাবার পছন্দের বই। মাধবীলতা হাসল।

ছোটমা বললেন, যাও, ভেতরে গিয়ে ভাল করে হাত মুখ ধুয়ে জামাকাপড় বদলে নাও। ট্রেনের কাপড় পরে ঘরে থাকতে নেই। তুমি ওকে কিছু খেতে দাও।

মাধবীলতার পাশাপাশি যেতে যেতে অর্ক নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, খুব পিটপিটে, না?

চুপ! চাপা ধমক দিল মাধবীলতা, একদম না!

ঘরে ঢুকে অর্ক বলল, আমার সবকিছু ঝাপসা মনে পড়ছে।

অনিমেষ শুয়ে ছিল, উঠে বসল যাক, আসতে পারলি শেষ পর্যন্ত।

একটা চেয়ারে বসে অর্ক বলল, মা যা তাগাদা দিচ্ছিল তাতে না আসাটা–। যাক গে, কী ব্যাপার বলো তো?

মাধবীলতা বলল, এখনই সব জানতে হবে? চল, তোকে বাথরুম দেখিয়ে দিচ্ছি, হাত-মুখ ধুয়ে পোশাক পালটে নে। ধীরে সুস্থে কথা হবে।

অর্ক তাকাল, মনে হচ্ছে বেশ গুরুতর ব্যাপার?

অনিমেষ বলল, আজ রাত্রে তোকে আমার সঙ্গে উকিলের বাড়িতে যেতে হবে।

রাত্রে? অসম্ভব! আমি তো সন্ধের ট্রেন ধরে ফিরে যাব। অর্ক গলা তুলে বলল।

অনিমেষ অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকাল, তুই আজই চলে যাবি? তা হলে এলি কেন?

বাঃ। মা বলেছিল সকালে এসে কী সব কাজ আছে তা করে বিকেলে ফিরে যাস। কী মা, তুমি এ কথা বলোনি?

মাধবীলতা বলল, হ্যাঁ বলেছিলাম। কিন্তু এ কথাও বলেছিলাম যে কবে আসতে হবে তা তোকে জানিয়ে দেব। আজ সেই দিন নয়।

কাজটা কী? অর্ক জানতে চাইল।

এসব কথা পরে ধীরে সুস্থে আলোচনা করলে ভাল হয় না? মাধবীলতা বলল, আগে হাত মুখ ধুয়ে নিবি চল। আমি চা খাবার করি।

অর্ক মাথা নাড়ল, এখন কিছু খাব না।

মাধবীলতার কপালে ভাঁজ পড়ল, কেন?

নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পুরি তরকারি আর চা খেয়ে নিয়েছি। অর্ক বলল, খুলে বলো তো, কাজটা কী?

মাধবীলতা অনিমেষের দিকে তাকাল। অনিমেষ বলল, যা বলার তুমিই বলো। আমার এখন কথা বলতে ভাল লাগছে না।

মাধবীলতা বলল, তোর ছোট ঠাকুমাকে তো দেখলি! এত বড় বাড়িতে ওঁর পক্ষে আর একা থাকা সম্ভব নয়। এই বাড়ি বিক্রি করতে হবে। বিক্রির সময় এই বাড়ির আইনসম্মত মালিক চাই। উনি নিজে সেটা হতে চাইছেন না। উনি চাইছেন তোর নামে মালিকানা লিখে দিতে।

গম্ভীর হয়ে শুনছিল অর্ক। তারপর জিজ্ঞাসা করল, আমি কেন? বাবা তো রয়েছে। বাবার নামে লিখে দিতে বলো।

অনিমেষ আবার শুয়ে পড়ল। সেদিকে আড়চোখে দেখে নিয়ে মাধবীলতা বলল, তোর ঠাকুরদার তেমন ইচ্ছে ছিল না।

কথাটা তোমরা জানলে কী করে?

তোর ছোট ঠাকুমা বলেছেন।

মাথা নাড়ল অর্ক, তোমরা আমাকে এসবের সঙ্গে জড়িয়ো না।

তার মানে? মাধবীলতা অবাক হল।

ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে? ছোট ঠাকুমা আমাকে মালিকানা দিচ্ছেন যাতে এই বাড়ি বিক্রি করে দিতে পারি। আমার কোনও মতামত থাকছে না মালিক হওয়া সত্ত্বেও। নিজেকে পুতুল ভাবতে আমি আর রাজি নই মা। অর্ক বলল।

পুতুল? কী বলছিস তুই? মাধবীলতার শরীরে কাঁপুনি এল।

নয়তো কী? আমি মালিক হব আর তোমরা আমাকে দিয়ে বাড়ি বিক্রি করাবে। আমার অন্য প্ল্যান থাকলেও করতে পারব না। অর্ক বলল।

কী প্ল্যান? অনিমেষ আবার উঠে বসল।

এই তো শুনলাম। ভাবার সময় পেলে ভেবে বলব।

বেশ। তোমার ছোটঠাকুমার কথা ভেবে আমাদের জানাও।

তুই কী ভাবছিস বাড়ি বিক্রির টাকা আমরা ভোগ করব? হঠাৎ চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল মাধবীলতা।

আমি কিছুই ভাবিনি। বললাম তো ভাবার সুযোগ পাইনি। অর্ক মাথা নাড়ল।

অনিমেষ ছেলেকে বোঝাতে চাইল, ওই টাকায় একটা ছোট ফ্ল্যাট কিনে দেওয়া হবে ছোটমাকে। বাকি টাকা ওঁর নামেই ব্যাঙ্কে রাখা হবে যার সুদে ওঁর দিব্যি চলে যাবে। বুঝতে পেরেছিস?

তা হলে একটা সহজ ব্যাপারকে তোমরা জটিল করছ কেন? অর্ক তাকাল।

জটিল করছি? উত্তপ্ত হল অনিমেষ।

ঠাকুরদার বাড়ি ছোট ঠাকুমা পেয়েছেন। তিনি মালিক হিসেবে বিক্রি করে দিলে তোমরা পাশে দাঁড়িয়ে যা যা করতে চাও করে দিতে পারো। তা না করে আমাকে শিখণ্ডীর মতো দাঁড় করাচ্ছ কেন? অর্ক কথাগুলো বলতেই মাধবীলতা চিৎকার করল, অর্ক! তার গলার শিরা ফুলে উঠেছিল। মাথা ঘুরে যেতেই সে বিছানার ওপর টলতে টলতে বসে পড়ল। অনিমেষ চেঁচিয়ে উঠল, লতা!

অর্ক দৌড়ে এল মায়ের কাছে, শুয়ে পড়ো, তুমি অযথা উত্তেজিত হচ্ছ। মাধবীলতাকে বিছানায় শুইয়ে দিল সে। জোরে জোরে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছিল মাধবীলতা। মুখ রক্তশূন্য।

অর্ক অনিমেষের দিকে তাকাল, এই পাড়ায় ডাক্তার পাওয়া যাবে?

অনিমেষ জবাব না দিয়ে ক্রাচে ভর করে নীচে নামল। ততক্ষণে শ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, মাধবীলতা হাত নেড়ে নিষেধ করল।

অনিমেষ বলল, লতা, তুমি চুপ করে শুয়ে থাকো। আমি ডাক্তার ডেকে আনছি, একবার দেখানো দরকার।

মাধবীলতা এবার উঠে বসল, না। দরকার নেই। আমি এখন ঠিক আছি। তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, তুই যা, হাত মুখ ধুয়ে নে। তুমি ওকে বাথরুমটা দেখিয়ে দাও।

অর্ক বলল, না না, আমিই দেখে নিচ্ছি।

অর্ক ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে মাধবীলতার পাশে বসল অনিমেষ, সত্যি বলো তো, এখন কোনও কষ্ট নেই তো?

অনিমেষের গলার স্বরে চোখ তুলল মাধবীলতা, তারপর তার ঠোঁটে হাসি ফুটল, অনেকটা ভাল লাগছে। তখন চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এসেছিল।

প্লিজ, এত উত্তেজিত হোয়ো না। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি কী করব বলো তো? ভাবলেই পৃথিবীটা কীরকম ফাঁকা হয়ে যায়। অনিমেষ গাঢ় স্বরে বলল।

একটা লাভ হল। মাধবীলতা বলল।

লাভ? মানে?

ওরকম না হলে তোমার এই কথাগুলো শুনতে পেতাম না। আজকাল আমরা কথা বললে শুধু কাজের কথাই বলি। তাই না? মাধবীলতা বলল, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে অর্কর কিছু একটা হয়েছে। যে ছেলে এতগুলো বছর মুখ বুজে থাকত সে আজ কী কথা শোনাল!

অনিমেষ বলল, ছেড়ে দাও। আমার মনে হয় ওকে আজ বাড়ির ব্যাপারে আর কথা বলার দরকার নেই।

.

দুপুরের খাওয়া সেরে অর্ক গিয়েছিল তার ছোটঠাকুমার ঘরে। মাধবীলতা এখন অনেকটাই সুস্থ। ওদের পাশের ঘরটি অর্ককে দেওয়া হয়েছে। বাড়ির প্রসঙ্গ আর তোলেনি কেউ। অনিমেষ শুয়ে ছিল, তার হাতে বই। একটু দূরে খাটের ওপর মাধবীলতা বসে কাগজ পড়ছিল। এ বাড়িতে এসে খবরের কাগজ পড়ার কথা ভুলেই গিয়েছিল সে। ছোটমার অভ্যেস না থাকায় কাগজ আসে না। সকালে নিউ জলপাইগুড়ির স্টেশন থেকে কাগজটা কিনেছিল অর্ক। পড়ে ব্যাগে রেখেছিল। ছোটঠাকুমার ঘরে যাওয়ার সময় ব্যাগ থেকে বের করে টেবিলে রেখে গিয়েছিল।

কাগজে চোখ রেখে মাধবীলতা বলল, ডেবরা, গোপীবল্লভপুর তো মেদিনীপুর জেলায়, কখনও গিয়েছ?

না বইয়ে চোখ রেখে অনিমেষ বলল।

নন্দীগ্রামে?

হেসে ফেলল অনিমেষ, গেলে তো তোমাকে নিয়ে যেতাম।

উঁহু। যখন আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলে তখন কোথায় কোথায় গিয়েছ তা কি আমি জানি? তখন আমাকে নিয়ে যাবে কী করে? মাধবীলতা বলল।

ও। নন্দীগ্রামের কথা জিজ্ঞাসা করলে কেন?

এই যে, কাগজের প্রথম পাতায় নাম বেরিয়েছে। সেখানকার কৃষকরা সরকারকে জমি দখল করতে দেবে না। উত্তেজনা দানা বাঁধছে। মাধবীলতা বলল।

বামফ্রন্ট যদি জোর করে জমি দখল করতে চায় তা হলে ওরা এতদিনে নিজের কবরের জন্যে গর্ত খোঁড়া শুরু করেছে। অনিমেষ বলল।

মাধবীলতা কাগজ ভাঁজ করল, আমার তো মনে হয় না আগামী কয়েকটা নির্বাচনে বামফ্রন্টকে গদিচ্যুত করা যাবে। এত মেজরিটি, এত মানুষ বছরের পর বছর ওদের ভোট দিয়ে যাচ্ছে, যতই অত্যাচার করুক, রাতারাতি ওদের সরানো সম্ভব না।

অনিমেষ বলল, কী ব্যাপার? তুমি দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলছ! হঠাৎ কী হল?

কলকাতার বাড়িতে কাগজ এলে চোখ বুলিয়ে রেখে দিতাম। একই খবর প্রত্যেক দিন। মনে হত দুদিন আগের কাগজ আজ আবার ছাপা হয়েছে। এখানে কয়েকদিন কাগজ না পড়ে কিছুই মিস করিনি। আজ হঠাৎ হাতে পেয়ে মনে হল ভাল করে পড়ি। পড়তেই ভাবনাটা চলে এল। মাধবীলতা বলল। অর্ক ফিরে এল। এসে চেয়ারে বসল, ছোটঠাকুমার সঙ্গে কথা বললাম।

ওরা তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না।

আমি বললাম, আপনি বাড়ি বিক্রি করে দিতে চাইছেন আর একা থাকতে পারছেন না বলে। ঠিক আছে। যদি একা না থাকেন তা হলে কি বাড়িটা বিক্রি করবেন? উনি প্রথমে বুঝতে পারেননি, আমি বুঝিয়ে বললে জানতে চাইলেন সেটা কীভাবে সম্ভব? আমি বললাম, যদি এই বাড়িতে বৃদ্ধাদের জন্যে একটা আশ্রম খোলা যায় তা হলে তো আর আপনাকে একা থাকতে হচ্ছে না। কিন্তু বৃদ্ধাশ্রম সম্পর্কে কোনও ধারণা না থাকায় কথাটা ওঁর মনঃপূত হল বলে মনে হচ্ছে না। তোমরা কি এ ব্যাপারে কথা বলবে?

এই বাড়িতে বৃদ্ধাশ্রম? অনিমেষের মুখ থেকে প্রশ্নটা বেরিয়ে এল।

হ্যাঁ। শুধু বৃদ্ধাদের জন্যে। অর্ক বলল।

মাধবীলতা বলল, খুব ভাল প্রস্তাব। এতে তোর পূর্বপুরুষের তৈরি বাড়িটা থেকে যাবে। কিন্তু তোকে যে দায়িত্ব নিতে হবে।

মানে? অর্কর কপালে ভাঁজ পড়ল।

দেখ, এই বাড়িতে যত ঘর আছে তার দুটো বাদ দিলে অন্তত পনেরো জন বৃদ্ধাকে জায়গা দেওয়া যাবে। তারপর তাদের চারবেলার খাওয়ার ব্যবস্থা ঠিকঠাক করতে হবে। বয়স্কা মানুষরা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন, তাদের চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে হবে। এসব তো ছোটমা করতে পারবেন না। তোকেই দায়িত্ব নিয়ে করতে হবে। এতে মানুষের উপকার করাও হবে। শান্তিও পাবি। মাধবীলতা বলল।

এসব তো তোমরা করতে পারবে। তুমি রিটায়ার করেছ, কলকাতায় তোমাদের করার কিছুই নেই। এখানে এসব কাজের মধ্যে ইনভলভড় হয়ে থাকলে সময় ভালভাবে কেটে যাবে। অর্ক বলল।

খুব ভাল বলেছিস। আমরা এটা নিয়ে ভাবব। মাধবীলতা বলল।

আমার সঙ্গে এক ভদ্রলোকের আজই আলাপ হল। ভদ্রলোকের নাম বলরাম, কিন্তু রেডক্রশ বললে শহরের সবাই চিনতে পারে। তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখলে চিকিৎসার ব্যাপার নিয়ে ভাবতে হবে না। অর্ক বলল।

বাঃ। খুব ভাল হল। তোর ট্রেন কখন?

নিউ জলপাইগুড়ি থেকে জেনেছি এখানকার সন্ধেবেলার লোকাল ট্রেন ধরলেই হবে। ওখানে ট্রেন পেয়ে যাব।

তা হলে যা, একটু ঘুমিয়ে নে।

আমাকে আর উকিলের বাড়িতে যেতে হচ্ছে না তো? অর্ক হাসল।

আর কী দরকার। তুই যে পরামর্শ দিলি– ।

হ্যাঁ। এসব কথা অবশ্য টেলিফোনেও বলা যেত কিন্তু তুমি বুঝতে চাইতে না। এসে লাভ হল, ছোটঠাকুমার সঙ্গে কথা বলতে পারলাম। অর্ক উঠে দাঁড়াল।

অনিমেষ এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। এবার উঠে বসল, আর একটু বোস। তোর সঙ্গে কথা আছে।

আবার বসল অর্ক, বলো।

তোর সঙ্গে হাজারিবাগের লোকটির আলাপ হল কী করে?

অর্ক আচমকা প্রশ্ন শুনে অস্বস্তিতে পড়ল, ঠিক সরাসরি আলাপ আগে হয়নি। আমার পরিচিত একজনের মাধ্যমে ফোনে কথা হয়েছিল। মাস তিনেক আমরা কথা বলেছি।

তাতেই বন্ধুত্ব হয়ে গেল? এমন বন্ধুত্ব যে লোকটাকে তুই বাড়িতে থাকতে দিলি? যার মাধ্যমে আলাপ হল তার ওখানে উঠল না কেন?

ওর বাড়িতে জায়গা নেই। অর্ক গম্ভীর গলায় বলল।

ও। মাথা নাড়ল অনিমেষ, আমরা যদি জলপাইগুড়িতে না আসতাম তা হলে ওকে কোথায় রাখতিস তোরা? বাড়িতে নিয়ে আসতিস?

আচ্ছা, একটা মানুষ আমাদের বাড়িতে কদিন আছে, এতে তোমার এত অসুবিধে হচ্ছে কেন তা আমি বুঝতে পারছি না। অর্ক শান্ত গলায় বলল।

পরিচিত কেউ থাকলে অসুবিধে হত না। বাঙালি?

না।

পুরুষ না মহিলা?

আশ্চর্য! ও যদি মহিলা হয় তাতে কী এসে যায়?

এবার মাধবীলতা কথা বলল, আমরা আলাদা আমাদের মতো থাকি ঠিকই কিন্তু সেটা বস্তির এলাকার মধ্যে। যখন ফিরে যাব তখন লোকে জিজ্ঞাসা করবে, তার তো জবাবটা দিতে হবে।

অর্ক হাসল, মা, তুমিই তো বলতে অতি উচ্চবিত্ত আর বিত্তহীন মানুষরা মধ্যবিত্তদের মতো সংকীর্ণ হয় না। তা হলে জবাব দিতে হবে কেন? যাক গে, ও পুরুষ। ঝাড়খণ্ডের মানুষ। পাটনা থেকে বি এ পাশ করেছিল। তোমরা যখন কলকাতায় নেই তখন ফাঁকা বাড়িতে ও থাকলে কী অসুবিধে তোমাদের?

অনিমেষ অবাক হল, আমরা যদি ছমাস এখানে থাকি তা হলে সে অতদিন তোর সঙ্গে থাকবে! কী করছে সে কলকাতায়?

ওর কাজকর্ম আছে। নানান মানুষের সঙ্গে দেখা করতে যায়।

অর্ক উঠে দাঁড়াল, তা হলে আমি আজ চলে যেতে পারি?

অনিমেষ বা মাধবীলতা কোনও কথা বলল না। ঠিক তখনই বাইরে থেকে উত্তেজিত কয়েকটি কণ্ঠ ভেসে এল।

মাধবীলতা বলল, কারা এইভাবে চেঁচাচ্ছে?

অনিমেষ ক্রাচ নিয়ে নীচে নামল, দেখছি।

কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে ভাড়াটেদের ঘরের সামনে থেকে। অনিমেষ সেদিকে এগিয়ে গেল। মাঝখানের দরজা খুলে ওপাশে যেতেই দেখল নিবারণবাবু হাতজোড় করে বলছেন, ভাই, তোমাদের অনুরোধ করছি আমাদের বিপদে ফেলো না।

সঙ্গে সঙ্গে সামনে দাঁড়ানো তিনটে ছেলের একজন চেঁচিয়ে বলল, বিপদ? আমরা আপনাকে বিপদে ফেলছি? আপনি বুঝতে পারছেন না কেন, আপনাকে আমরা সাহায্য করছি। কোনও শালা আপনাদের এই বাড়ি থেকে তুলতে পারবে না। আপনার যতদিন ইচ্ছে এই বাড়িতে থাকবেন। ঠিক আছে?

দ্বিতীয় ছেলেটি চেঁচাল, আর যা বললাম, প্রত্যেক মাসের দুতারিখে ক্লাবে গিয়ে বাড়ির ভাড়া দিয়ে আসবেন। আর কাউকে ভাড়ার টাকা দেবেন না।

এইসময় নিবারণবাবুর চোখ পড়ল অনিমেষের ওপর। কাতর গলায় তিনি বললেন, এই দেখুন, এরা কী বলছে। হঠাৎ এদের কী হল?

কাকে বলছেন? কী করবে ওই ল্যাংড়া? যা বললাম তা মনে রাখবেন। না রাখলে আপনাকে উঠিয়ে অন্য ভাড়াটে বসাব আমরা। তৃতীয় জন বলল।

পেছন থেকে অর্কর গলা শুনতে পেল অনিমেষ, এরা কারা?

.

২২.

অনিমেষ দেখল ছেলেগুলো গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। অর্ক কয়েক পা এগিয়ে গিয়েছিল।

অনিমেষ বলল, ওরা এখানকার একটা ক্লাবের মেম্বার। ইনি নিবারণবাবু, ছোটমা এঁকেই বাড়ি ভাড়া দিয়েছেন।

অর্ক নিবারণবাবুকে দেখল, বেশ অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, তা হলে ওঁর কাছে এঁরা ভাড়া চাইছেন কেন?

নিবারণবাবু কাছে এলেন। অনিমেষকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইনি কে?

আমার ছেলে। অর্ক। একটু আগে কলকাতা থেকে এসেছে। অনিমেষ বলল।

অ। কী বিপদ বলুন তো। এখন আমি কী করি?

ওরা কি আপনাকে শাসাচ্ছে? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

শাসাচ্ছে? বুকে বসে দাড়ি উপড়ে নেবে বলছে। নিবারণবাবু বললেন।

আপনি এসব কথা শুনছেন কেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

কী করব তা হলে? জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে ঝগড়া করব?

শোনামাত্র অর্ক এগিয়ে গেল বাড়ির গেটের দিকে। ছেলেগুলো যেন অবাক হল। গেটের এপাশে দাঁড়িয়ে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা ভাই, আপনাদের সমস্যা কী?

আমাদের যে সমস্যা আছে এই খবর আপনাকে কে দিল?

তা হলে ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে ঝামেলা করছেন কেন?

তার আগে বলুন আপনি কে? এর মধ্যে নাক গলাচ্ছেন কেন?

নাক গলাতে আমি বাধ্য। উনি আমার ঠাকুমার ভাড়াটে।

ওই হ্যাঁন্ডিক্যাপড ভদ্রলোক আপনার বাবা?

এইভাবে কথা বলছেন, উনি কে তা জানেন?

যে তর্ক করছিল তাকে দ্বিতীয়জন থামাল, এই চেপে যা। কানাকে কানা, খোঁড়াকে খোঁড়া বলা উচিত নয়, জানিস তো।

তৃতীয়জন বলল, জানি জানি। সিপিএম থেকে ডিগবাজি খেয়ে উনি নকশাল হয়েছিলেন। কিন্তু যেহেতু উনি কবে সিপিএমের ঘি খেয়েছিলেন, এখনও গন্ধ লেগে থাকতে পারে তাই ওঁকে কিছু বলিনি আমরা।

বলার কী ছিল সেটাই জানতে চাইছি? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

আপনি কোন পার্টি করেন? প্রথমজন জানতে চাইল।

আমি এখনও কোনও রাজনৈতিক দলের সমর্থক নই।

কেন? দ্বিতীয়জন হাসল।

কারণ পশ্চিমবঙ্গের–। বলে থেমে গেল অর্ক, হাত নাড়ল, থাক ওসব। কেন এসেছিলেন আপনারা?

দ্বিতীয়জন বলল, ওই ভদ্রলোককে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম আমরা। বাবা জ্যাঠাদের সময়ে পাড়ায় ছিলেন, এখনকার হালচাল জানেন না, পাখির মতো বেড়াতে এসেছেন বলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। তার ওপর একসময় তো সিপিএম করতেন সেটাও একটা প্লাস পয়েন্ট। ভাড়াটে থাকলে বাড়ির দাম উঠবে না তাই ওকে ওঠাবার বিনিময়ে একটু খাওয়াদাওয়া করতে চেয়েছিলাম। উনি সোজা চলে গেলেন জেলা সম্পাদকের কাছে, নালিশ করলেন আমাদের বিরুদ্ধে। ভাবলেন তিনি ধমক দিলেই আমরা ভয়ে গর্তে ঢুকে যাব! উনি জানেন না রাজ্য কমিটিতে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে ভাড়াটে বাড়িওয়ালার ঝামেলার মধ্যে পার্টি নাক গলাবে না। লোকাল পার্টির কাছে গেলে যদি তারা নাক গলাত তা হলে জেলাসম্পাদকের ধমক খেয়ে সরে যেত। কিন্তু আমরা তো একটা আলাদা ক্লাব। এই ক্লাবের সঙ্গে পার্টির ডিরেক্ট কোনও সম্পর্ক নেই। এই কথাটা ওঁর মাথায় আসেনি, তাই কমপ্লেন করে আমাদের বদনাম করলেন। এখন আমরা ভাড়াটের পক্ষে, যদি তিনি আমাদের কথা শুনে চলেন।

ছেলেগুলো চলে গেলে অর্ক ফিরে এসে বলল, কী অবস্থা!

নিবারণবাবু বিড়বিড় করলেন, এদের হারিয়ে যদি অন্য দল পাওয়ারে আসতে পারত। কিন্তু কাদের ভোট দেবে মানুষ? কংগ্রেস তো মেরুদণ্ডহীন। বিজেপি এখানে কখনওই হালে পানি পায়নি। রইল বাকি তৃণমূল। নতুন দল। তার ওপর ওই একজন মহিলার মুখ চেয়ে কতটা ভরসা পাওয়া যায়? বাকিরা সব– ।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি কারও সঙ্গে কথা বলছেন?

নিবারণবাবুর যেন সংবিৎ ফিরল, আঁ! না, মানে, কী করি বলুন তো?

অনিমেষ বলল, একমাত্র উপায় বাড়িটাকে তাড়াতাড়ি বিক্রি করে আপনাকে মুক্তি দেওয়া। আপনি যা চেয়েছেন তাই পাবেন।

নিবারণবাবু এগিয়ে এসে হাত ধরলেন, তা হলে তাড়াতাড়ি করুন। নেক্সট ভাড়াটা যেন ওদের দিতে না হয়।

ঘরে ফিরে এসে অর্ক বলল, এখানে তো সাংঘাতিক অবস্থা। এরকম ব্যাপার কলকাতাতে কখনও হয়নি।

হয়নি। হবে। অনিমেষ বলল।

কিন্তু মানুষের তো সহ্যশক্তির সীমা আছে। যখন সেটা ছাড়িয়ে যাবে তখন এই বামফ্রন্ট সরকারকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। অর্ক বলল।

মাধবীলতা এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। সম্ভবত, আড়ালে থাকলেও তার কানে সব কথা পৌঁছেছে। এবার মুখ খুলল, মানুষ অতীত থেকে শিক্ষা নেয়। যা যা করলে ব্যক্তিগত লাভ হয় সেটা শিখতে একটুও দেরি করে না।

মানে বুঝলাম না। অর্ক বলল।

নকশাল আন্দোলনের সময় একটা ছেলে বোমা হাতে নিয়ে পাড়া কপাত। লোকে জানলা দরজা বন্ধ করে ভয়ে বসে থাকত। বস্তির বাচ্চাগুলো

অবাক হয়ে সেই ছেলেকে হিরো বলে ভেবে নিত। তারপর নকশালরা যখন হারিয়ে গেল, যুব কংগ্রেসিরা এল, তখন ওই বাচ্চাগুলো সামান্য বড় হয়ে বোমা ছোঁড়াছুড়ি আরম্ভ করল হিরো হওয়ার জন্যে। তারপর যখন বামফ্রন্ট এল তখন তাদের হার্মাদবাহিনী সেই শিক্ষাকে আরও ধারালো করে নিল। মাধবীলতা হাসল, আমার মনে হয়, বামফ্রন্টকে সরিয়ে যদি কোনও দল ক্ষমতায় আসে তাদের নিচুতলায় এই ধারা আরও বেশি ক্ষমতা দেখাতে গজিয়ে উঠবে। এ বড় সংক্রামক রোগ।

অনিমেষ কাঁধ নাচাল, কবে কী হবে তা নিয়ে এখন ভেবে কী লাভ। তুই তা হলে আজই চলে যাচ্ছিস। তফাত কী জানিস, আমার বাবা-মা তাঁদের প্রয়োজনে ডাকলে আমি সকালে এসেই বিকেলে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারতাম না।

অর্ক হাসল, মানতে পারছি না।

তার মানে? অনিমেষ অবাক।

তুমি তোমার দাদু-পিসিমা-বাবা-ছোটমায়ের কথা ভুলে গিয়ে নকশাল আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলে। কখন কোথায় আছ তা জানাবার প্রয়োজন মনে করোনি। এমনকী মাকেও অন্ধকারে রেখেছিলে। অর্ক হাসল।

এসব কথা তোকে কে বলেছে? যারা তোমাকে জানে তাদের কাছে শুনেছি। তাই বলে ভেবে নিয়ো না, মা এসব বলেছে। আজ পর্যন্ত মা তোমার বিরুদ্ধে একটা শব্দও আমাকে বলেনি।

অর্ক বলামাত্র মাধবীলতা বলল, অনেক হয়েছে। এবার তোমরা থামো।

মোবাইলে রিং শুরু হল। মাধবীলতা সেটা অন করতেই কানে এল, স্বপ্নেন্দু দত্ত বলছি। অনিমেষবাবু আছেন?

মাধবীলতা বলল, একটু ধরুন।

মোবাইল ফোন অনিমেষের হাতে দিয়ে বলল সে, স্বপ্নেন্দু দত্ত।

অনিমেষ যন্ত্রটাকে কানে চেপে বলল, হ্যাঁ। বলুন।

অনিমেষবাবু?

হ্যাঁ।

আপনি আমাকে বিপদে ফেললেন কেন?

আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না।

আপনি বলেছিলেন পার্টির সঙ্গে আপনার কথা হয়ে গেছে। পশ্চিম বাংলার অন্য কোথায় কী হচ্ছে জানি না, এই শহরে পার্টির সঙ্গে কথা না বলে কাজ করা অসম্ভব। আপনার কথায় বিশ্বাস করে আমি অ্যাডভান্স দিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু আপনি যদি আমাকে সত্যি কথা বলতেন তা হলে আমিই ওদের সঙ্গে ব্যবস্থা করে নিতাম। বেশ জোর গলায় কথাগুলো বললেন স্বপ্নেন্দু দত্ত।

আপনি এসব কেন বলছেন আমাকে?

আজ একটু আগে আপনার পাড়ার ছেলেরা এসেছিল আমার কাছে। তারা কীভাবে জেনেছে তা জানি না। বলছে, বাড়ি কিনতে হলে ওদের ক্লাব ফান্ডে পাঁচ লাখ ক্যাশ দিতে হবে। স্বপ্নেন্দু বললেন।

তারপর? অনিমেষ ঠোঁট কামড়াল।

ওরা বলল, আপনি নাকি ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেতে গিয়েছিলেন। এখন দুটো রাস্তা আছে। এক, আপনি অ্যাডভান্সের টাকা ফেরত দিন। আমি বাড়িটা কিনব না। দুই, আপনার অংশ থেকে পাঁচ লাখ ওদের দিয়ে দিচ্ছি। আপনাদের

সেটা মেনে নিতে হবে।

ওদের কেন দিচ্ছেন? ওরা তো কোনও রাজনৈতিক দল নয়।

ওরা রাজনৈতিক দলের অস্ত্র যার সাহায্য ছাড়া পার্টি ভোটে জিততে পারবে না। যদি সেই অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে, সিপিএম হেরে যায়, তা হলে জানবেন এই অস্ত্র তাদের হারিয়ে যেদিকে হাওয়া বইছে সেদিকে গিয়েছে। স্বপ্নেন্দু হাসলেন, এবার বলুন দুটোর মধ্যে কোনটা আপনার পছন্দ?

আমাকে একটু ভাবতে সময় দিন। অনিমেষ বলল।

ও হ্যাঁ, আপনাদের কাগজপত্র তৈরি হয়ে গেছে তো?

হয়ে যাবে।

দেখুন, বেশি দেরি করবেন না। আমি চাই না ওদের দাবি পাঁচ থেকে দশ লাখে উঠুক। পরে ফোন করব। লাইন কেটে দিলেন স্বপ্নেন্দু দত্ত।

মাধবীলতা তাকিয়ে ছিল। টেলিফোনে কথা বলার সময় অনিমেষ লক্ষ করছিল অর্ক ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে।

মাধবীলতা বলল, কোনও সমস্যা হয়েছে।

স্বপ্নেন্দুর বক্তব্য জানাল অনিমেষ। মাধবীলতার চোখ কপালে উঠল, কী সর্বনাশ!

একটু আগে ওই ছেলেগুলো আমাকে হ্যাঁন্ডিক্যাপড বলে গেল। ক্রাচ ছাড়া যখন চলতে পারি না তখন তো মেনে নিতেই হবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে শুধু আমি নই, আমার মতো যারা সাধারণ জীবনযাপন করে তাদের সবাই হ্যাঁন্ডিক্যাপড। বিষণ্ণ গলায় বলল অনিমেষ।

সব দিক দিয়েই তো এক অবস্থা। মাধবীলতা বলল, এই যে অর্ক তার নিজের মতন চলছে, ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও আমরা মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছি, সেটা তো হ্যাঁন্ডিক্যাপড বলেই।

ওকে যেতে দাও। মিস্টার রায়কে বলব আর কারও নামে প্রপার্টি ট্রান্সফার করার দরকার নেই। অনিমেষ বলল।

ছোটমা অর্কর মুখে খবরটা শুনে অবাক। বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিনি গলা তুলে ডাকতে লাগলেন, মাধবীলতা, ও মাধবীলতা, এদিকে এসো।

অর্ক বলল, আরে! মাকে ডাকছ কেন?

মাধবীলতা বেরিয়ে এল, বলুন।

তোমার ছেলে সকালে এসে বিকেলে চলে যাচ্ছে কেন?

ওকেই জিজ্ঞাসা করুন।

অর্ক বলল, প্রথমত, এখানে আমার করণীয় কিছু নেই। উলটে কলকাতায় প্রচুর কাজ পড়ে আছে।

তোমার বাবা-ঠাকুরদা-বড়দাদুর এই বাড়ির জন্য কোনও টান নেই?

দেখো, এখানে তো আমি একবারই ছিলাম। তখন বয়স খুব কম ছিল আর সেটা কয়েকদিনের জন্যে। কিন্তু বাবা তো পুরো স্কুলজীবন এই বাড়িতে থেকেছে। তারপর কি টান অনুভব করেছিল? কোনও কাজ ছাড়াই কলকাতায় থেকে গেছে। এই যে এখানে এবার এসেছে, তুমি একা আছ তাই। বলতে পারত এখানেই থেকে যাবে। অনেক ভাল থাকত তা হলে। তা না করে বাড়িটাই বিক্রি করে দিতে চাইছে। তার মানে ওরও কোনও টান নেই। অর্ক বলল।

মাধবীলতা কথা বলতে যাচ্ছিল হাত তুলে তাকে থামতে বলল ছোটমা, বুঝেছি বাবা। এটা বোঝার জন্য হয়তো এতদিন বেঁচে আছি।

অনিমেষ বাইরে বেরিয়ে বারান্দার একপাশে দাঁড়িয়ে ছেলের কথা শুনছিল। এবার ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞাসা করল, তোর কী হয়েছে বল তো?

মানে? পেছন ফিরল অর্ক।

এতগুলো বছর ধরে একসঙ্গে থেকে আমরা তোর মুখে প্রয়োজনের বাইরে কোনও কথা শুনিনি। তোর মা বলত, তুই নাকি নিজের মধ্যে থাকিস। এখানে এসে যেসব কথা বলছিস তা–।

অনিমেষকে থামিয়ে দিল অর্ক, অস্বীকার করতে পারো? একটাও মিথ্যে বলেছি?

মাধবীলতা বলল, না। বলিসনি।

তোমাদের ভাবনাচিন্তাগুলো যে পুরনো হয়ে গিয়েছে সেটা কেউ বোঝে না। এই যে এখানে সিপিএমের দাদাগিরি দেখছ, দেখে কী করছ? গুমরে মরছ। কেউ ভেবেছে এর প্রতিবাদ করা উচিত? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

আমি তোর সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে চাই না।

বলার কিছু থাকলে তো বলবে। তুমি যে রাজনীতিতে বিশ্বাস করতে, তা সিপিএম হোক বা নকশাল হোক, তার সঙ্গে এদেশের মাটির কোনও সম্পর্ক নেই। শুধু ধার করা শব্দ উচ্চারণ করে ভেবেছ দেশে কমিউনিজম এনেছ, আর তোমাদের নীচের কর্মীরা সেই সুযোগে লুটেপুটে খাচ্ছে। আজ তাদের হাত তোমাদের ওপর পড়লে অসহায় হয়ে তাকিয়ে আছ। এই ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনদের তোমরাই তৈরি করেছ। অর্ক বলল।

তুই এসব কথা বলছিস কেন? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

এই তথাকথিত কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে বিপ্লব আসতে বাধ্য। তার বেশি দেরি নেই। অর্ক বড় বড় পা ফেলে বাগানে নেমে গেল।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ও হঠাৎ খেপে গেল কেন? প্রসঙ্গ না থাকা সত্ত্বেও এসব কথা বলছে কেন?

আমি বুঝতে পারছি না। আচ্ছা, যে লোকটাকে ও আশ্রয় দিয়েছে সে কে? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

ঠিক বলেছ। ওই লোকটার সঙ্গে কটা দিন কাটিয়ে।

বিশেষ কোনও রাজনীতি করা লোক নয় তো? মাধবীলতা নিজের সঙ্গে কথা বলছিল, আমার ভয় করছে।

যা শুনলে তার পরেও ওর জন্য ভয় পাচ্ছ? অনিমেষ হাসল।

.

হঠাৎ দৌড়ে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল অর্ক, একটা লাঠি দাও তো, তাড়াতাড়ি। সে বেশ উত্তেজিত।

ছোটমা জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে?

একটা সাপ, বেশ বড়–।

উঠে এসো। উঠে এসো বলছি। ছোটমার গলা ওপরে উঠল।

মানে? সাপটা–।

ওটা আমার বাগানে আছে। তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না। ওকে ওর মতো থাকতে দাও। উঠে এসো। ছোটমা মাধবীলতার দিকে তাকাল, আমি ঠাকুরঘরে যাচ্ছি।

.

২৩.

লছমনের রিকশা পাওয়া গিয়েছিল। মাধবীলতা এবং অনিমেষ রোদ মরতেই মিস্টার রায়ের বাড়িতে চলে এল। অর্ক তখন তার ঘরে পা গুটিয়ে শুয়ে ছিল। মাধবীলতা বলল, শোন, আমরা বেরোচ্ছি।

ও। আমিও একটু পরে বের হব। শোওয়া অবস্থাতেই বলছিল অর্ক।

তা হলে চলেই যাচ্ছিস!

হ্যাঁ। মিছিমিছি দৌড় করালে। এই বাড়িতে একটা সাপের গুরুত্বও আমার চেয়ে বেশি। ঠিক আছে, কলকাতায় ফেরার আগে ফোন করবে। অর্ক বলল।

কেন? ফোন না করে গেলে তোর কী অসুবিধে হবে? মাধবীলতা শক্ত হল।

হাসল অর্ক, আমার নয়, তোমাদের অসুবিধে হবে। দরজায় তালা দেখলে বাইরে বসে থাকতে হবে আমি না ফেরা পর্যন্ত।

আসছি। মাধবীলতা আর দাঁড়ায়নি।

অনিমেষ ততক্ষণে বাড়ির সামনে রিকশায় উঠে বসেছে লছমনের সাহায্যে। মাধবীলতা উঠলে রিকশার প্যাডেল ঘোরাল লছমন।

আজ ছুটির দিন তাই মিস্টার রায়কে বাড়িতেই পাওয়া গেল। কাজের লোক চেম্বারের দরজা খুলে ওদের বসতে বলার পাঁচ মিনিট পরে এলেন ভদ্রলোক, কী ব্যাপার? হঠাৎ! ছুটির বিকেলে আমি চেম্বার করি না, কিন্তু আপনারা এসেছেন বলে টেবিলের ওপাশের যে চেয়ারে উনি বসেন সেটায় না বসে আর-একটা চেয়ার টেনে নিলেন ভদ্রলোক।

আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত। আসলে বাড়ির মালিকানা আইনত ঠিক না হলে অনেক সমস্যা হচ্ছে। রাজনীতি এসে গেছে এর মধ্যে। মাধবীলতা কথাগুলো না বলে পারল না।

তাই বলুন। পার্টি কি চাইছে বাড়ির দখল নিতে? মিস্টার রায় হাসলেন।

না। ঠিক তা নয়। অনিমেষ বলল, আমরা নৃপেনদার কাছে গিয়েছিলাম, তিনি সৌমেনবাবুর কাছে পাঠালেন। তার কাছেও কোনও সাহায্য পাইনি।

তা হলে? হার্মাদ বাহিনী?

পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা যারা পার্টির সমর্থক, সদস্য নয়। অনিমেষ কথাগুলো বলে মাধবীলতার দিকে তাকাল।

মাধবীলতা বলল, ওর বাবার উইলটাকে আইনসংগত করে দিন।

আপনার শাশুড়ি অ্যাকসেপ্ট করবেন?

মনে হচ্ছে এখন করবেন।

তা হলে তো কোনও সমস্যা নেই। কালই মুভ করছি।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, এটা করতে কতদিন লাগবে?

পয়সা খরচ করলে খুব দ্রুত হয়ে যাবে। নইলে–।

পয়সা খরচ মানে, ঘুষ? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

আচ্ছা ভাই, পৃথিবীতে এত রকমের পরিবর্তন হয়েছে দেখছেন, ঘুষ শব্দটাও যে বাতিল হয়ে গেছে তা জানেন না। তৎকাল শব্দটা শুনেছেন? ট্রেনের বার্থ যখন আর বিক্রির জন্য পড়ে থাকে না তখন রেল কোম্পানি যে কয়েকটা বার্থ হাতে রেখে দেয় সেগুলো অতিরিক্ত চার্জ বসিয়ে বিক্রি করে। লোকে বলে তৎকালে টিকিট কেটেছি। এটা অবশ্যই সরকারি আইনে হয়ে থাকে। এই আইনটা একদম বেসরকারি করে নিয়েছেন যাঁরা তাঁদের আনুকূল্যে কাজটা দ্রুত হয়ে যেতে পারে। মিস্টার রায় চোখ বন্ধ করে হাসলেন।

অনিমেষ কিছু বলতে যাচ্ছিল, তাকে হাত নেড়ে থামিয়ে মাধবীলতা বলল, এর জন্য আমাদের কত দিতে হবে?

খুব বেশি নয়। আপনাদের যে টাকার কথা বলেছিলাম তার মধ্যেই হয়ে যাবে। কমও হতে পারে। আপনারা কি চা খাবেন? মিস্টার রায় তাকালেন।

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, না।

একটা সময় ছিল, এই শহরের মানুষ সমস্যায় পড়লে সিপিএমের নেতাদের কাছেও যেমন যেত তেমনি কংগ্রেসের নেতাদেরও সাহায্য নিত। দুই দলের নেতারা নির্বাচনের আগে যত যুদ্ধই করে থাকুন না কেন বাকি সাড়ে চার বছর সৌজন্যবোধ হারাতেন না। তখন চা-বাগানে আর এস পি-র প্রভাব খুব বেশি ছিল। কংগ্রেস বা সিপিএমের সংগঠন সেখানে খুব দুর্বল ছিল। কিন্তু কোনও মানবিক প্রয়োজনে খগেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত যদি ননী ভট্টাচার্যকে অনুরোধ করতেন তা হলে ননীবাবু মুখ ফিরিয়ে নিতেন না। এখন তো এখানে কংগ্রেস একটা সাইনবোর্ডের পার্টি। নতুন পার্টি তৃণমূল কলকাতায় মাথা চাড়া দিচ্ছে। মা দুর্গা যখন দশ হাতে যুদ্ধ করেছিলেন তখন দেবতারা তাকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল। তৃণমূল যাঁর স্বপ্ন তার পাশের কারও ওপর তো ভরসা করা যাচ্ছে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে আপনাদের উচিত প্রশাসনের সাহায্য নেওয়া। ধীরে ধীরে কথাগুলো বললেন মিস্টার রায়।

প্রশাসন আমাদের সাহায্য করবে?

সচরাচর করে না। ভয় পায়। জলপাইগুড়ি থেকে সুন্দরবনের রামগঙ্গাতে ট্রান্সফার করে দিতে পারে। পুলিশের ট্রেনিং তো মিলিটারিদের মতো নয় যে প্রয়োজনে দেশের সব জায়গায় যেতে তৈরি থাকবে। একটা কাজ করা যায়। আমার খুব ঘনিষ্ঠ একজন উত্তরবাংলার পুলিশের এক নম্বর কর্তা। সরকার তার সঙ্গে ঝামেলায় যায় না। বছর খানেকের মধ্যেই অবসর নেবেন। আমি তাঁকে টেলিফোনে ব্যাপারটা বলছি। দেখা যাক কী হয়। আচ্ছা? মিস্টার রায় উঠে দাঁড়ালেন। এগিয়ে দিলেন দরজা পর্যন্ত।

তখন সবে সন্ধে হয়েছে। লছমনের রিকশায় ওঠার পর অনিমেষ বলল, তোমার কী মনে হয়, পুলিশ সাহায্য করবে?

মাধবীলতা হেসে ফেলল, তুমি এ কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করছ?

হুঁ। অনিমেষ অন্যদিকে তাকাল। তারপর বলল, আমার মনে হচ্ছে বাড়িতে ফিরে অর্ককে দেখতে পাব। ও নিশ্চয়ই মত পালটাবে।

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, সত্যি, তুমি খুব পালটে গেছ।

মানে? অনিমেষ তাকাল।

শান্তিনিকেতনের ওই রাতের পর যে তুমি স্বচ্ছন্দে আমার কথা ভুলে যেতে পেরেছিলে, আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় বিন্দুমাত্র দুর্বল হওনি, সেই তুমি ছেলে ফিরে যাবে শোনার পরেও ভাবছ আমাদের ছেড়ে ও যাবে না। পালটে যাওনি, বলো?

লতা, ও চলে গেলে কি তোমার ভাল লাগবে?

আমি এসব নিয়ে আর ভাবি না।

সে কী?

জীবনে দুবার প্রচণ্ড অপমানিত হয়েছিলাম। এক, লালবাজারের পুলিশ যখন আমি অন্তঃসত্ত্বা দেখেও জামাকাপড় খুলে অত্যাচার করেছিল, দুই, জেল থেকে বেরিয়ে যখন শুনলে আমি সন্তানের মা তখন অদ্ভুতভাবে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলে। মাধবীলতা শ্বাস ফেলল।

লতা, আমি তো অনেকবার বলেছি, কথাটা বলা ভুল হয়েছিল!

যখন মনে পড়ে তখন খারাপ লাগাটা ঘিরে ধরে। হ্যাঁ, তারপর এই এতগুলো বছর, প্রায় চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছর ধরে আমরা একসঙ্গে আছি। তুমি যে অসাধারণ থেকে ক্রমশ সাধারণ বাবা এবং স্বামীতে চলে এলে তা দেখে, বিশ্বাস করো, স্বস্তি পেয়েছি। গোটা জীবন ঘরের মধ্যে বাস করতে কোনও মেয়ে চায় না। তার চেয়ে বৈশাখ জ্যৈষ্ঠের প্রচণ্ড গরমের দুপুর, সেও ভাল। আমি সব মেনে নিয়েছি। তোমার পাশে আছি। কিন্তু জোর করে দুঃখে জড়াতে চাই না। মাধবীলতা বলল।

বাড়িতে ঢোকামাত্র ওরা দেখল আলো জ্বালিয়ে বারান্দায় মোড়ার ওপর চুপচাপ বসে আছে ছোটমা। চারদিক শব্দহীন। মাধবীলতা সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, এভাবে বসে আছেন?

তোমাদের ছেলে চলেই গেল। কান্না ছোটমার গলায়। মাধবীলতা অনিমেষের দিকে তাকাল। অনিমেষ মুখ ফিরিয়ে নিল।

ছোটমার মোড়ার পাশে মেঝের ওপর বসে পড়ল মাধবীলতা। তারপর নিচু গলায় বলল, যে যাওয়ার সে যাক না।

এবার শব্দ করে কেঁদে উঠলেন বৃদ্ধা। মাধবীলতা তাঁর হাত ধরল, কাঁদবেন না।

তুমি বুঝবে না, বুঝবে না।

আপনি বোঝালে নিশ্চয়ই বুঝব।

আমি এই বাড়িতে এসেছিলাম দ্বিতীয়পক্ষ হয়ে। এসে দেখলাম স্বামী তার মৃত স্ত্রীর কথা একটুও ভুলতে পারছেন না। মদ খাচ্ছেন, অদ্ভুত আচরণ করছেন। আমাকে বিয়ে করেছেন অথচ–। তোমাকে কী বলব–। আবার কাঁদলেন ছোটমা। অনিমেষ ধীরে ধীরে নিজের ঘরে চলে গেল।

বিয়ের আগে আমি যা ছিলাম বিয়ের পরেও তাই থেকে গেলাম। এমনকী অনিও প্রথম কয়েক বছর আমার সঙ্গে সহজ ছিল না। কিন্তু আমি জেদ ধরলাম। নাই বা হল আমার সন্তান, তবু এই পরিবারকে আমি নিজের করে নেবই। একদিন বড়দি জিজ্ঞাসা করেছিলেন আমার সন্তান হচ্ছে না কেন? আমি তাকে সত্যি কথা বলতে পারিনি। উনি ভেবে নিয়েছিলেন আমার পক্ষে মা হওয়া সম্ভব নয় বলেই হতে পারছি না। বলেছিলেন, তার ভাইকে বলতে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে। কিন্তু তার কথা ওঁকে বলতে পারিনি। এবার মাধবীলতার হাত জড়িয়ে ধরলেন ছোটমা, আমি এই পরিবারে আসার পর অনি কলকাতায় পড়তে চলে গেল। ওর বাবা-দাদু খুব আশা করেছিলেন। পড়া শেষ করে এখানেই ফিরে আসবে। কিন্তু সে এল না। তারপর একে একে ওর ঠাকুরদা বাবা বড়পিসিমা আমাকে ফেলে রেখে চলে গেলেন। কেন? কেন আমি পড়ে রইলাম, আর ওঁরা। ঠোঁট কামড়ে কান্না গিলতে চাইলেন ছোটমা। তার রুগণ শরীর কেঁপে উঠছিল বারংবার।

এসব কথা আজ, এতদিন পরে কেন মনে এল? মাধবীলতা বৃদ্ধাকে জড়িয়ে ধরতেই তিনি তার কাঁধে মাথা রাখলেন। মাধবীলতা অনুভব করল তার শরীরে ওঁর কাপুনি ছড়িয়ে পড়ছে। ঘনঘন শ্বাস পড়ছিল ছোটমার। তারপর একটু শান্ত হলে ছোটমা বললেন, আজ মনে হচ্ছে, সত্যি আমি অপয়া।

ছিঃ। এমন কথা বলবেন না। কুসংস্কারগ্রস্ত মানুষ এ কথা বলে।

কেন মনে করব না বলো? আজ অর্কও চলে গেল। সোজা হলেন বৃদ্ধা।

কলকাতায় ওর কাজ আছে তাই গিয়েছে।

যাওয়ার আগে বলে গেল, আপনি কোনও বৃদ্ধাশ্রমে চলে যান। এই বাড়ি যদি বিক্রি না হয় তা হলে পুরোটাই ভাড়া দিয়ে দিন। সেই টাকায় দিব্যি থাকা যাবে বৃদ্ধাশ্রমে। আমি বললাম, আমি তা হলে এতদিন এই বাড়ি আগলে রাখলাম কেন? সে জবাব না দিয়ে হেসে চলে গেল। এই যাওয়াটাকেও আমাকে দেখতে হল। ছোটমা এবার আঁচলে চোখ মুছলেন।

আপনি কিছু মনে করবেন না। আমার আজ মনে হচ্ছে আমরা কোথাও ভুল করেছিলাম। মাধবীলতার গলা ধরে এল।

অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল দুজন হাতে হাত রেখে। অন্ধকার আকাশে এখন ফিকে আলো। হয়তো অনেক পরে চাঁদ উঠবে।

ছোটমা বললেন, আচ্ছা মাধবীলতা, তুমি তো এতটা কাল অনিকে আগলে রাখলে, তোমার বাবা-মায়ের সঙ্গে কি কোনও সম্পর্কই নেই?

শ্বাস ফেলল মাধবীলতা, আমি খবর রাখতাম। কিন্তু বাবা আমাকে মেনে নিতে পারেননি। মা আগেই গিয়েছিলেন।

তুমি জানতে?

হ্যাঁ। এ কথাগুলো আপনার ছেলেকেও বলিনি। আমাকে একজন খবর দিতে ছুটে গিয়েছিলাম শ্মশানে। আমাকে দেখে বাবা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন বিরক্ত হয়ে। তখন মনে হল থাকলে উনি আরও অসন্তুষ্ট হবেন। তার কয়েক বছর পরে বাবার চলে যাওয়ার খবর পেয়েছিলাম।

তোমার বাবা-মা সম্পর্কে অনি কখনও কিছু জিজ্ঞাসা করেনি?

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে মাধবীলতা বলল, ও অত বাস্তববাদী নয়।

তা অবশ্য। নইলে ঠাকুরদা, বাবার কথা বাদ দিলাম, যে বড়পিসিমার ও প্রাণের চেয়ে প্রিয় ছিল, পেটে না ধরেও যিনি নিজেকে ওর মা ভাবতেন, তাঁর সম্পর্কে ও উদাসীন হয়ে থাকত না। এবার মাধবীলতার মাথায় হাত বোলালেন ছোটমা, তুমি অনিকে খুব ভালবাসো, তাই না?

মাথা নাড়ল মাধবীলতা, জানি না, বিশ্বাস করুন।

এইভাবে জীবনটা কাটিয়ে এখন কি আফশোস হয়?

প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলল মাধবীলতা, সবার তো সব হয় না।

যাও, ওঠো। অনিকে চা করে দাও। ছোটমা বললেন।

গলার কাছে একটা ভারী কিছু এসে ঠেকেছিল, শ্বাস ফেলল মাধবীলতা, আপনার জন্যও করি?

আলাদা করে করতে হবে না। আমার রান্নাঘরে দুকাপ চা বানিয়েছিলাম। এক কাপ অর্ক খেয়ে গেছে, আমারটা খাওয়া হয়নি। ওটাই গরম করে দাও। ছোটমা বললেন।

হেসে ফেলল মাধবীলতা। তারপর উঠে ঘরে গিয়ে দেখল অনিমেষ চুপচাপ শুয়ে আছে। সে কোনও কথা না বলে শাড়ি পালটে তিন কাপ চা তৈরি করে এককাপ অনিমেষকে দিয়ে বাকি দুকাপ নিয়ে ছোটমার পাশে এসে বসল, নিন।

তুমি আবার মেঝেতে বসলে কেন?

এখানে বসতে ভাল লাগছে। আপনি অর্ককে চা করে দিলেন?

আমার খেয়াল ছিল না। ও খেতে চাইল।

অদ্ভুত। মাধবীলতা চাপা স্বরে বলল, একটা কথা রাখবেন?

বলো।

শ্বশুরমশাইয়ের ইচ্ছেটাকে মেনে নিন।

তার মানে?

উনি তো উইল করে বাড়িটা আপনাকে দিয়ে গেছেন–।

একটু চুপ করে থেকে ছোটমা বললেন, সেই উইলের দুটো কপি তো ঘেঁড়া হয়ে গেছে।

দেখুন, এই বাড়ি নিয়ে যা সমস্যা হচ্ছে, মানে অর্ক বা আপনার অনিকে দেওয়া নিয়ে, তার সমাধান হতে অনেক সময় লাগবে। আমরা উকিলবাবুর কাছে গিয়েছিলাম। তিনি বললেন, চেষ্টা করলে তিনি শ্বশুরমশাইয়ের উইলটার আর একটা কপি উদ্ধার করতে পারবেন। আপনার আপত্তি না থাকলে খুব তাড়াতাড়ি বাড়ির সমস্যা মিটে যাবে। তারপর আপনি যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন, আমি কোনও কথা বলব না।

মাধবীলতা বলতেই ছোটমা হেসে ফেললেন, তুমি, তুমি অদ্ভুত মেয়ে।

এই সময় মোবাইলের রিং শোনা গেল। তারপর চুপচাপ। একটু পরে অনিমেষ ক্রাচ নিয়ে বেরিয়ে এল বারান্দায়, শোনো, দেবেশ ফোন করছে। বলছে কবে ওর ওখানে যাবে? সবাইকে নিয়ে যেতে বলছে।

দেবেশ কে? ছোটমা জিজ্ঞাসা করলেন।

ওর ছেলেবেলার বন্ধু। কাছাকাছি কোথাও নাকি আশ্রম করেছে। চলুন, সবাই মিলে একবার বেড়িয়ে আসি। মাধবীলতা বলল।

.

২৪.

সাতসকালে একটা লোক সাইকেলে চেপে চলে এল বাগানের ধারে, এসে গলা চড়িয়ে বলল, এখানে অনিমেষবাবু থাকেন?

মাধবীলতা সেইমাত্র বাসি কাপড় বালতির জলে ডুবিয়ে পরিষ্কার হয়ে বাথরুমের বাইরে পা রেখেছিল, অবাক হয়ে এগিয়ে গিয়ে বলল, হ্যাঁ, থাকেন। কী ব্যাপার?

লোকটা সাইকেলে বসেই বলল, এস পি সাহেব ওঁকে এখনই ডেকে পাঠিয়েছেন। বলেছেন, দেরি যেন না করেন। কোনও কারণে এখন যেতে না পারলে রাত দশটা নাগাদ যেতে পারেন। আচ্ছা! লোকটা সাইকেল ঘোরাচ্ছিল।

দাঁড়ান। এস পি মানে পুলিশের–।

হ্যাঁ। কাছারির দিকে গেলে ওঁর বাংলো দেখতে পাবেন। আশ্চর্য, জলপাইগুড়িতে থাকেন আর এস পি-র মানে জানেন না! সাইকেল ঘুরিয়ে নিয়ে লোকটা চোখের আড়ালে চলে গেল।

ছোটমা ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে?

বুঝতে পারছি না। অর্কর সঙ্গে কারও কোনও ঝামেলা হল নাকি?

কী হয়েছে বলবে তো?

এস পি, পুলিশের বড়কর্তা ওকে এখনই দেখা করতে বলেছেন।

সর্বনাশ। পুলিশে ছুঁলে কী হয় তা তো তুমি জানো।

কিন্তু ওকে কি পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে? কদিন থেকে মনে একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। এখানে এসে ওর কথাবার্তার ধরন সেটা বাড়িয়ে দিয়েছে। মাথা নাড়ল মাধবীলতা, জানি না, ভবিষ্যতে আর কী দেখব। ওকে বলি গিয়ে, যায় তো যাবে।

এখনও এই বয়সে অনিমেষের ঘুমাবার সময় শরীরে শিশুসুলভ ভঙ্গি তৈরি হয় যা দেখলে ডাকতে ইচ্ছে করে না মাধবীলতার। তবু আজ ওকে ডেকে তুলতে হল। ক্রাচ এগিয়ে দিয়ে বলল, যাও, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।

কেন? এখন কটা বাজে? বিরক্ত হল অনিমেষ।

তোমাকে শহরের এস পি সাহেব এখনই দেখা করতে বলেছেন।

মানে? কোনও মানে জানি না। আরদালি গোছের একটা লোক বাড়িতে এসে তাই বলে গেল। এখন যেতে না পারলে রাত দশটার পর যেতে হবে। সে সময় বাড়ির বাইরে যাওয়া উচিত হবে না।

কিন্তু পুলিশ সুপার আমাকে কেন ডাকবেন?

তার উত্তর আমি কী করে দেব বলো? শুধু ভয় হচ্ছে, অর্ক কিছু করেনি তো! যে লোকটাকে ও আশ্রয় দিয়েছে সে কে? অপরাধ জীবনের সঙ্গে যুক্ত কোনও লোক? না, সেটা জেনে ও থাকতে দেবে না বলে এখনও বিশ্বাস করি। যাক গে, গিয়ে শুনে এসো।

বিছানা থেকে নামতে এখনও একটু অসুবিধে হয়। নেমে ক্রাচে ভর করে সোজা হয়ে অনিমেষ বলল, তুমিও তৈরি হয়ে নাও।

উনি তোমাকে ডেকেছেন। আমাকে নয়।

বেশ। তুমি বাইরে অপেক্ষা করতে পারো, আমি ভেতরে গিয়ে কথা বলব।

অনিমেষ বাথরুমের দিকে চলে গেলে মাধবীলতা উঠল। একটা পরিষ্কার কাপড় হাতে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই নিজের মুখটাকে এই সকালে দেখল। অভ্যেসের দৈনিক চুল আঁচড়ানোর সময় আয়নার সামনে দাঁড়ানো থেকে আজ একটু আলাদা হয়ে নিজেকে দেখল। না, এখন চুলে ঈষৎ রুপোর ছোঁয়া লাগলেও কালোর আধিক্য আছে। কিন্তু চোখের তলায়, কপালের রেখায় আর গলার ভাঁজে সময়ের হাতুড়ি বেশ সক্রিয়। নিজের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল মাধবীলতা। না, এখনও তার চিবুক এবং হাসিকে বয়স দখল করতে পারেনি। সে চুল আঁচড়ে নিল।

অনিমেষ ঘরে ঢুকে বলল, এ কী! এখনও তুমি এখানে?

নিজেকে দেখছিলাম। তোমার চেহারা যতটা বদলেছে আমারটা তত হয়নি।

কী আশ্চর্য। কত যুগ পরে দেখে দেবেশ একবারেই চিনতে পারল। চুল

হয় সাদা হয়ে গেছে। যাক গে, যাওয়ার আগে এককাপ চা হবে?

নিশ্চয়ই হবে। কিন্তু ছোটমা তো ঠাকুরঘর থেকে বের হওয়ার পর চা খান। ততক্ষণে আমরা ফিরে আসব। চলো, আজকে রাস্তার পাশের দোকান থেকে ভাঁড়ের চা খাই। বেশ লাগবে।

এখানে কি কলকাতার মতো দুহাত দূরে দূরে ওই দোকান আছে? আচ্ছা। তাড়াতাড়ি তৈরি হও।

বলা না থাকায় এই সকালে লছমনকে পাওয়া যাবে না। ওরা মিনিট দশেক মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকার পরে রিকশা পেল। অনিমেষ লক্ষ করছিল ক্লাবের ছেলেদের দুজন কয়লার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের দেখছে। একজন হঠাৎ হাত নাড়ল। অনিমেষ মুখ ঘুরিয়ে নিল।

এস পি-র বাংলোর গেটে রিকশা আটকে দিল পাহারাদার। অনিমেষ তাকে বলল, এস পি সাহেব আমাদের দেখা করতে বলেছেন।

লোকটি বলল, এখন ভিজিটার্সদের সঙ্গে উনি দেখা করেন না। দশটার পরে আসুন। রিকশাওয়ালা বলল, বাবু, আমাকে ছেড়ে দিন।

ভাড়া মিটিয়ে দিল মাধবীলতা। এই এলাকাটায় মানুষের বসতি বলতে কয়েকটি সরকারি বাংলো। ওরা কী করবে বুঝতে পারছিল না।

অনিমেষ বলল, রিকশা পাওয়া মুশকিল হবে। চলো ফিরে যাই। পরে জানতে চাইলে বলব আপনার গার্ডই ঢুকতে দেয়নি। ওদের রিকশাওয়ালা রিকশা ঘোরাচ্ছিল, তাকে দাঁড়াতে বলল সে।

কথাগুলো গার্ডের কানে গিয়েছিল। সে চেঁচিয়ে ডাকল, আবদুলভাই। বাগানের ওপাশ থেকে যে বেরিয়ে এল তাকে চিনতে পারল মাধবীলতা। সে গলা তুলে বলল, আপনি খবর দিয়েছিলেন তাই এসেছিলাম।

আবদুল নামক ব্যক্তিটি বলল, গেট খুলে দে। সাহেব ওঁদের ডেকেছেন। আসুন আপনারা আমার সঙ্গে।

অনেকটা হেঁটে ব্রিটিশ আমলের বিশাল বাংলো বাড়ির একতলার ঘরে তাদের বসতে বলে আবদুল ভেতরের দরজায় দাঁড়িয়ে কাউকে বলল, সাহেব যাঁকে আসতে বলেছেন তিনি এসেছেন। তারপর সে বাইরে চলে গেল। মিনিট পাঁচেক পরে একজন ভদ্রলোক এসে জিজ্ঞাসা করলেন, অনিমেষ মিত্র?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

আপনি আসুন।

অনিমেষ মাধবীলতার দিকে তাকাল। মাধবীলতা নিঃশব্দে ঘাড় নেড়ে যেতে বলল। বাংলোর পেছনের নেট-ঘেরা বারান্দায় মধ্যবয়সি ছিপছিপে চেহারার এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরনে পাজামা পাঞ্জাবি। অনিমেষকে আসতে দেখে হাত জোড় করে বললেন, নমস্কার। সরি, আমি জানতাম না আপনাকে ক্রাচের ওপর নির্ভর করে হাঁটতে হয়। আসতে নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হল। বসুন।

সুন্দর বেতের চেয়ার দেখিয়ে দিয়ে উলটোদিকে বসলেন ভদ্রলোক।

অনিমেষ ক্রাচ দুটো চেয়ারের পাশে রেখে বলল, আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না আপনি কেন ডেকে পাঠালেন।

আমরা মানে?

আমার স্ত্রীও সঙ্গে এসেছেন।

সে কী! ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। তারপর দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলেন। এই প্রথম স্বস্তি পেল অনিমেষ। আর যাই হোক, অর্কর জন্য তাকে ডেকে পাঠাননি ইনি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মাধবীলতাকে নিয়ে ফিরে এসে ভদ্রলোক বললেন, ছি ছি। এরা আমাকে বলেইনি যে আপনিও ওঁর সঙ্গে এসেছেন। বসুন। আমি পঙ্কজ দত্ত। এস পি-র চাকরি করি। কী খাবেন? চা না শরবত?

মাধবীলতা হাসল, আপনার লোক এমন তাড়া দিয়েছে যে ভেবেছিলাম রাস্তায় চা খেয়ে নেব। কিন্তু এই এলাকায় কোনও চায়ের দোকান দেখতে পেলাম না। ও বলল এটা নাকি সাহেবপাড়া ছিল। চা–।

চায়ের হুকুম দিয়ে পঙ্কজ বললেন, এবার বলুন।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কী বলব?

সে কী! আমার বস কাল রাত্রে টেলিফোনে বললেন যে আপনারা খুব বিপদে পড়েছেন। ওঁর বন্ধু, এখানকার বিখ্যাত ল-ইয়ার মিস্টার রায় ফোনে ওঁকে জানিয়েছেন। তারপরে আমি মিস্টার রায়কে ফোন করে কিছুটা জেনে নিয়েছি। বাকিটা আপনার মুখে শুনতে চাই। পঙ্কজ দত্ত ধীরে ধীরে কথাগুলো বললেন।

অনিমেষ সমস্ত ঘটনাটা ওঁকে জানাল।

একটু চুপ করে থাকলেন পঙ্কজ দত্ত। ইতিমধ্যে চা এবং বিস্কুট এসে গেল। পঙ্কজ নিজে মাধবীলতার হাতে কাপ প্লেট তুলে দিয়ে বলল, আপনাদের এত সকালে আসতে বলার কারণ ছিল। আমি চাইনি আপনারা যে আমার সঙ্গে দেখা করেছেন তা সবাই জানুক। নিন, চা খান।

চায়ে চুমুক দিয়ে মাধবীলতা বলল, আমরা এখন কী করব?

আপনাদের তো কিছু করার নেই। নৃপেনবাবুরা হাত গুটিয়েই থাকবেন। থানায় গিয়ে যদি বলেন ক্লাবের ছেলেরা আপনাদের ভয় দেখাচ্ছে তা হলে আপনারা বাড়িতে ফেরার আগেই ওদের কাছে খবর পৌঁছে যাবে।

কিছুক্ষণ তিনজনেই চুপচাপ। হঠাৎ মাধবীলতার মনে কথাটা আসায় জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, আমরা আদালতে গেলে কি কোনও সুরাহা হবে?

হেসে নীরবে মাথা নেড়ে না বললেন পঙ্কজ দত্ত, তা হলে তো মিস্টার রায় পরামর্শটা দিতেন। আদালতে গিয়ে আপনারা কীভাবে প্রমাণ করবেন ওই ছেলেরা হুমকি দিচ্ছে, ভাড়াটেকে শাসাচ্ছে? কোনও লিখিত বা রেকর্ডের প্রমাণ নেই। তা ছাড়া কেস লড়বার জন্যে কোনও উকিল এগিয়ে আসবেন কিনা সন্দেহ।

অনিমেষ বলল, ভাড়াটে মানে, নিবারণবাবু তো সত্যি কথা বলবেন।

না। বলবেন না। চাপে পড়ে উনি বিচারককে বলতে পারেন তাঁর কাছে কেউ যায়নি। এরকম কোনও ঘটনার কথা তিনি জানেন না। সোজা হয়ে বসে ঘড়ি দেখলেন পঙ্কজ দত্ত, আপনারা আমার ওপর ছেড়ে দিন। আচ্ছা, অনিমেষবাবু, আপনারা তো কলকাতায় থাকেন?

হ্যাঁ।

কী প্রফেশনে ছিলেন?

অনিমেষ কিছু বলার আগেই মাধবীলতা বলল, আমি শিক্ষকতা করতাম। এখন অবসরে। আর ওর পায়ের অবস্থার কারণে–।

মাথা নাড়লেন পঙ্কজ দত্ত, আপনার সঙ্গে কোনও রাজনৈতিক দলের আর সম্পর্ক নেই?

না। পরিষ্কার বলল অনিমেষ।

কিছু মনে করবেন না, মাওবাদীদের কেউ যোগাযোগ করেনি?

অবাক হয়ে তাকাল অনিমেষ, হঠাৎ এই প্রশ্ন?

কারণ মাওবাদীদের শুভানুধ্যায়ীরা কলকাতায় আছেন। তাঁদের কেউ সমাজসেবী, কেউ ডাক্তার, আবার কেউ প্রাক্তন নকশাল।

না। আমার সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি। তা ছাড়া আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই ওদের ব্যাপারে। অনিমেষ বলল।

ঠিক আছে। আমার এই কার্ডটা রাখুন। খুব জরুরি দরকার হলে ফোন করবেন। আচ্ছা, নমস্কার। পঙ্কজ দত্ত উঠে দাঁড়ালেন, আপনারা বাংলোর সামনের গেট দিয়ে না বেরিয়ে পেছনের গেট দিয়ে যেতে পারবেন। কষ্ট করে তিস্তার বাঁধে উঠতে হবে। অনিমেষবাবু কি পারবেন?

চেষ্টা করব। অনিমেষ উঠে দাঁড়াল।

আবার বলছি, আমার কাছে আপনারা এসেছেন তা গোপন রাখার জন্যই এভাবে যেতে বলছি। পঙ্কজ দত্ত একজন পরিচারককে বললেন, ওঁদের বাঁধে তুলে দিয়ে এসো।

পেছনে এক চিলতে বাগান, যার পরে উঁচু তারের বেড়া। বেড়ার মাঝখানে। একটা শক্ত কাঠের দরজা। লোকটি ওদের নিয়ে এসে দরজা খুলে বলল, সামনেই বাঁধ। বাঁ দিকে গেলে জেলাস্কুল, ডানদিকে জুবিলি পার্ক। ওই ধাপে পা ফেলে উঠলে সুবিধে হবে।

বাঁধ কেটে সিঁড়ির মতো করে রাখা হয়েছে বলে অনিমেষ ওপরে উঠতে পারল। সামনেই তিস্তার চর ধু ধু করছে। বালির ওপর বেশ মজবুত ঘরবাড়ি শুধু নয়, চাষ আবাদও শুরু হয়েছে। অনিমেষ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। মাধবীলতা পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী দেখছ?

যখন স্কুলে পড়তাম তখন বর্ষার সময়ে তিস্তার ঢেউ এই বাঁধে ছোবল মারত। এখন কোথাও তো জল দেখতে পাচ্ছি না। অনিমেষ বলল।

মাধবীলতা বলল, ওই ওপাশে, অনেক দূরে বোধহয় জল আছে, চিকচিক করছে। তিস্তায় বোধহয় বর্ষাতেও বেশি জল বয়ে যায় না, নইলে এই এত বাড়িঘর করে মানুষ থাকতে পারত না।

অনিমেষ বলল, সবকিছু কীভাবে বদলে গেল। চারপাশে তাকাল মাধবীলতা, এখানে তো রিকশা পাওয়া যাবে না। ওদিকে বলল কী একটা পার্ক আছে, ওখানে গেলে পাওয়া যেতে পারে।

দূর! তার চেয়ে চলো বাঁধের ওপর দিয়ে হেঁটে যাই।

কতটা দূর?

খুব বেশি নয়।

পারবে?

অনিমেষ হেসে ফেলল, ঠিক তো, সেই আমি আর নেই আমি। কিন্তু চেষ্টা করে দেখি। চলো।

ওরা ধীরে ধীরে বাঁধের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। ডানদিকে তিস্তার শুকনো চর, বাঁ দিকে বিশাল বাগানঘেরা ব্রিটিশদের তৈরি সরকারি বড়কর্তাদের বাংলো। প্রচুর পাখি ডাকছে সেইসব বাগানে।

অসুবিধে হলে বলবে। মাধবীলতা বলল।

কী করবে? অনিমেষ তাকাল।

তা হলে এই বাঁধের ওপর বসে জিরিয়ে নিতে পারবে।

ঠিক আছে। অনিমেষ বলল, আচ্ছা, এই ভদ্রলোক কি সত্যি পুলিশ? মাধবীলতা বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছিল। এত ভদ্র, সুন্দর ব্যবহার কোনও পুলিশ অফিসার করতে পারেন তা আমার ধারণায় ছিল না। বোধহয় এখন শিক্ষিত ভদ্র ছেলেরা পুলিশে আসছে। অন্তত আই পি এস-এ।

হয়তো। কিন্তু আমরা যেখানে ছিলাম সেখানেই থেকে গেলাম। অনিমেষ বলল, কোনওভাবেই তো উনি উৎসাহিত করলেন না। এমনকী সবার চোখের সামনে আমাদের সঙ্গে কথা বলতেও চাননি। হয়তো ভয় পেয়েছেন। মন্ত্রীদের কাছে খবর গেলে পঙ্কজবাবুকে বিপদে পড়তে হবে। কী করা যায়? পুলিশ কিছু করবে না, আদালতে গেলে সাক্ষী পাব না, পাড়ায় মানুষ পাশে দাঁড়াবে না। যেভাবে আছে সেভাবেই পড়ে থাক বাড়িটা।

কিন্তু একটা কথা পঙ্কজবাবু বলেছেন, আপনারা আমার ওপর ছেড়ে দিন। কেন বললেন? নিশ্চয়ই ওঁর মাথায় কিছু আছে। মাধবীলতা কথা শেষ করামাত্র তার মোবাইল ফোন বেজেই থেমে গেল। মিস কল দিয়েছে কেউ। ব্যাগ থেকে সেটা বের করে দেখল মাধবীলতা। নাম্বারটা একদম অজানা।

.

২৫.

জলপাইগুড়ি-নিউ জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতায় সুস্থভাবে পৌঁছাতে হলে অনেক আগে রিজার্ভেশন কাউন্টারে দাঁড়াতে হয়। যাওয়ার দিনে স্টেশনে গিয়ে যে কয়েকজন যাত্রী ঠিকঠাক দাম দিয়ে শোওয়ার জায়গা পেয়ে যান তাদের পেছনে দেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ মানুষের হাত থাকে।

মাস খানেক আগে অগ্রিম টিকিট কেনা যাত্রীরা ওয়েটিং লিস্টের নাম্বার সম্বল করে ট্রেনের কামরার সামনে ভিড় করতে পারেন কিন্তু রেলের পরিভাষায় আর এ পি-তে উন্নীত না হলে ভেতরে পা রাখতে পারবেন না। জলপাইগুড়ি থেকে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌঁছে অর্ক বুঝতে পারল, সংরক্ষিত কামরায় শুয়ে কলকাতায় যাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই তার নেই।

প্ল্যাটফর্মে দালাল ঘুরছিল। কোনও রেলকর্মীর পকেট ভারী করে জায়গা পাইয়ে দেওয়ার প্রস্তাব তারা দিচ্ছে না। আজ নাকি সংরক্ষিত কামরার একটি বার্থও খালি না থাকায় কনডাক্টর গার্ডদের কিছু করার নেই। একজন বৃদ্ধ তার স্ত্রীকে নিয়ে অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি এগিয়ে এসে দালালকে সাহায্য করতে বললে সে জানাল, কোনও চিন্তা নেই। দিদিমাকে এখানেই অপেক্ষা করতে বলুন। আপনি আমার সঙ্গে স্টেশনের বাইরে গিয়ে একেবারে কনফার্মড টিকিট নিয়ে আসবেন।

স্টেশনের বাইরে কেন? বৃদ্ধ হকচকিয়ে গেলেন।

অফিসটা তো ওখানেই। শয়ে শয়ে টিকিট পাবেন। হাতে তো অনেক সময় আছে, ট্রেন ছাড়বে দেড় ঘণ্টা পরে। চলুন। দালাল হাসল।

অর্ক চুপচাপ শুনছিল, জিজ্ঞাসা করল, কত এক্সট্রা নেবে?

টিকিটের দাম আর সার্ভিস চার্জ।

বৃদ্ধ বললেন, আমার তো টিকিট হয়ে গিয়েছে। ওয়েটিং-এ।

রিফান্ড নিয়ে নেবেন কাউন্টার থেকে।

জনা পাঁচেক লোক দালালের অনুগামী হলে অর্ক ওদের অনুসরণ করল। কলকাতা থেকে আসার সময় এসি থ্রি টায়ারে জায়গা না পেয়ে অর্ডিনারি থ্রি টায়ারে উঠে কনডাক্টর গার্ডকে অনুরোধ করেছিল বার্থের জন্যে। ভদ্রলোক হেসে বলেছিলেন, আপনার আগে যারা রিকোয়েস্ট করেছে তাদের সবাইকে দিতে পারব না। আপনি আমার জায়গায় আপাতত বসুন।

সেই আপাতত-র সময়সীমা শেষ হয়েছিল নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে। ওভারব্রিজ পেরিয়ে স্টেশনের বাঁ দিকে গিয়ে রেলের আলোর নীচে টেবিল পেতে দুজনকে বসে থাকতে দেখল ওরা। তাদের আশেপাশে কয়েকজন স্বাস্থ্যবান মানুষ। দালাল বলল, পাঁচজন, হবে?

বসে থাকাদের একজন বলল, হবে। আরও তিনটে আনতে পারিস।

দালাল বলল, আপনারা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে যান। জলদি।

বৃদ্ধ অর্কর আগে, লাইনের প্রথমে দাঁড়ালেন, আমাকে দুটো টিকিট, দার্জিলিং মেলের টিকিট তো?

হ্যাঁ দাদু, সাইডের লোয়ার আপার। কী নাম হবে?

এস কে সেন, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস।

ঠিকানা বলুন। বৃদ্ধ বললেন।

এক হাজার পাঁচশো পঞ্চাশ করে দুটো টিকিট, মানে একত্রিশ শো দিন।

অ্যাঁ? কোন ক্লাস? এসি টু টায়ার নাকি? আমরা তো সিনিয়ার সিটিজেন।

দাদু, আপনি সিনিয়র সিটিজেনের সুবিধে পাবেন রেলের কাউন্টারে। আমরা এই যে স্পেশ্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট করেছি তার জন্যে এত টাকা বেরিয়ে গেছে যে কনসেশান দেওয়া সম্ভব নয়। না যেতে চান, নেক্সট লোককে চান্স দিন।

আমার মেয়ে খুব অসুস্থ! পকেট থেকে পার্স বের করে গুনে গুনে টাকা দিলে লোকটি বলল, একেবারে শেষ দিকে কামরা। দেখবেন লেখা

আছে ইন্ডিয়ান ট্যুরিস্ট। লোকটি টিকিট দিল।

বৃদ্ধ সেটাকে লক্ষ করতে লাগলেন, এ তো আমাদের নামে নয়।

নামে কী এসে যায় দাদু। ওটা আমাদের কামরা, কেউ প্রশ্ন করবে না।

এটা কি এসি কামরা?

আশ্চর্য! লোকটা রেগে গেল, আপনি সরে যান তো। ট্যুরিস্ট কম্পার্টমেন্টে যাচ্ছেন তবু। নেক্সট।

অর্ক টেবিলের সামনে দাঁড়াল।

অর্ডিনারি থ্রি টায়ারের যা ভাড়া তার তিনগুণ নিচ্ছেন কেন?

পুরো কম্পার্টমেন্ট রিজার্ভ করতে হয়েছে যে। দিন–।

আপনারা কি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দালাল লাগিয়ে ট্যুরিস্ট ধরে ব্যাবসা করছেন? অর্ক চেঁচিয়ে বলতেই স্বাস্থ্যবান লোকগুলো এগিয়ে এল, একজন চেঁচিয়ে লাইনে দাঁড়ানো লোকদের বলল, এই লোকটা ফালতু ঝামেলা করছে, এর জন্যে আপনাদের টিকিট দেওয়া যাবে না, আপনারা তাই চান?

সঙ্গে সঙ্গে সম্মিলিত প্রতিবাদ উঠল, জোর করে সরিয়ে দেওয়া হল অর্ককে। পরের যাত্রীরা এবার টিকিট কিনতে লাগল তৃপ্ত মুখে।

ওভারব্রিজ পেরিয়ে অর্ক চলে এল স্টেশন মাস্টারের ঘরে। সেখানে তিনি নেই। বেরোতেই রেলের একজন অফিসারকে দেখতে পেয়ে ঘটনাটা জানাল সে। ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, আমরা জানি, কিন্তু কিছু করার নেই।

সে কী! ট্রেনের টিকিট চড়া দামে বিক্রি করছে আর আপনি বলছেন কিছু করার নেই। এতে রেলের ক্ষতি হচ্ছে না?

হচ্ছে। প্রতিদিন শয়ে শয়ে লোক ওয়েটিং লিস্টে থাকছেন কিন্তু আমরা তাদের জায়গা দিতে পারছি না। ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন।

আপনারা অতিরিক্ত কামরার ব্যবস্থা করছেন না কেন?

দেখুন, একটা ট্রেনের বহন ক্ষমতা অনুযায়ী কামরার সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। এই ট্রেনে সেই সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে।

তা হলে ট্যুরিস্ট কোম্পানিকে কামরা দিলেন কেন? ওই জায়গায় স্বচ্ছন্দে আর একটা কামরা দিয়ে ওয়েটিং লিস্টের যাত্রীদের তুলে দিতে পারতেন।

অবশ্যই পারতাম। কিন্তু অনেক ওপরের কর্তাদের হুকুমে ট্যুরিস্ট কোম্পানিকে কামরা দেওয়া হচ্ছে। ওঁরা পুরো পেমেন্ট দিয়ে কামরা ভাড়া করে নিচ্ছেন। অভিযোগ না এলে ওই কামরায় রেল নাক গলায় না। ধরুন, আপনি একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন দশ হাজার টাকায়। আপনি যদি সেই ফ্ল্যাটে গেস্ট রাখেন পার ডে হাজার টাকায় তা হলে বাড়িওয়ালা কী করতে পারে, যদি না সেই গেস্টরা বেআইনি কিছু করেন। এও তেমনি। আপনি কোথায় যাবেন?

কলকাতায়।

ও। আচ্ছা, নমস্কার। ভদ্রলোক চলে গেলেন।

ট্রেনের দিকে তাকাল অর্ক। তারপর হাঁটতে লাগল। তারপর একটা কামরা যার গায়ে কোনও রিজার্ভেশনের নোটিশ নেই, উঠে পড়ল। শোওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই, যাত্রীদের চেহারা দেখে বোঝা যায় বেশির ভাগই দারিদ্র্যসীমার নীচে আছেন। দু-তিন জন দাঁড়িয়ে আছেন, বাকিরা ঠাসাঠাসি বসে। একেবারে কোনার দিকে একজন মধ্যবয়সের সন্ন্যাসিনী তিনজন শিষ্যকে নিয়ে বসে আছেন। সন্ন্যাসিনীর পাশে ত্রিশূল রাখা। গায়ের রং বেশ ফরসা, মাথার চুল চুড়ো করে বাঁধা, পরনে গেরুয়া কাপড় জামা। কপালে বিশাল টিপ। দুটো চোখে কাজল এমনভাবে টানা যেন দুর্গা ঠাকুরের নয়ন। অর্ক দেখল ওই বেঞ্চিতে আরও একজন স্বচ্ছন্দে বসতে পারে। সন্ন্যাসিনী বলে কেউ ওদিকে যায়নি।

অর্ক এগিয়ে জিজ্ঞাসা করল, বসতে পারি?

তিন শিষ্য নড়ল না। কিন্তু সন্ন্যাসিনী বললেন, ওরে, জায়গা দে, বাছা আমার বসতে চেয়েছে। বসো বসো। কেউ তো বলল না, তুমি মুখ ফুটে চাইলে।

শিষ্যরা এবার নড়েচড়ে বসার জায়গা করে দিল।

কিছুক্ষণের মধ্যে দাঁড়িয়ে যাওয়ার যাত্রীর সংখ্যা বেড়ে গেল। ট্রেন ছাড়ল। অর্ক ভাবছিল মাকে ফোন করে জানাবে কিনা। সে একবার চেষ্টা করে জানল এখন সংযোগ দেওয়া সম্ভব নয়। অনেক বছর পরে এবার জলপাইগুড়িতে গিয়ে মা-বাবার সঙ্গে সত্যি কথাগুলো বলতে বাধ্য হল সে। অবশ্য সে যাকে সত্যি ভাবছে ওঁরা তা ভাবছেন না, এটাও স্পষ্ট। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সে দেখে এসেছে বাবা শরীরের কারণে কোনও কাজ করছেন না, মায়ের রোজগারে সংসার চলছে। কিন্তু সংসারে বাবার প্রায় সব কথাই মা মেনে চলছেন। তার মনে হয়েছিল, পৃথিবীর অনেক মানুষ বাবার মতো প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও কাজকর্ম করছে। পা না থাকা সত্ত্বেও ইংলিশ চ্যানেল পার হচ্ছে। বাবা তার ওই প্রতিবন্ধকতার দোহাই দিয়ে অলস হয়ে থাকলেন এতগুলো বছর। আর মা সেটাকে প্রশ্রয় দিয়ে এলেন।

মা চাকরির শেষে বাবাকে নিয়ে স্বচ্ছন্দে জলপাইগুড়িতে চলে এলে ছোট ঠাকুরমার উপকার হত। খামোকা কলকাতায় থাকার তো দরকার ছিল না। জলপাইগুড়ির বাড়িতে থাকতে বাবার যে আপত্তি ছিল তার কারণ সে অনুমান করতে পারে। আজ বাড়ি বিক্রি করে ছোট ঠাকুরমার নামে টাকা নিলে সেই টাকা কয়েক বছর পরে অনাথ আশ্রমে দান করে দেবেন না বাবা। তখন ওই আপত্তির কথা কেউ যদি মনে করিয়ে দেয় তা হলে কি অন্যায় হবে? খুব খারাপ লাগছিল অর্কর। কমিউন ভেঙে যাওয়ার পর থানা থেকে বেরিয়ে বহুকাল সে চুপচাপ থেকেছে। পড়াশোনা করার চেষ্টা করেছে। কারও সঙ্গে আর নিবিড় যোগাযোগ রাখেনি। একটু একটু করে বাবার ওপর অভিমান জমতে শুরু করেছিল কিন্তু সেটা কাউকে বুঝতে দেয়নি।

ট্রেন ছুটছে হু হু করে। চোখ বন্ধ করল অর্ক।

এই যে বাছা, শুকনো মুখে বসে আছ কেন? আমাদের সঙ্গে খাবে এসো। গলা শুনে তাকিয়ে দেখল সন্ন্যাসিনী হাসছেন।

না, ঠিক আছে। অর্ক বলল।

কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক তা কি তুমি ঠিক করবে বাছা?

মানে? অর্ক অবাক হল।

এটুকু বুঝলে না। আচ্ছা বলো, এই পৃথিবীতে কি তুমি নিজের ইচ্ছায় এসেছ?

অর্ক হাসল, না।

সন্ন্যাসিনী বললেন, লোকে বলে অমুক জন্মগ্রহণ করলেন। যেন, যিনি পৃথিবীতে এলেন তিনি স্ব-ইচ্ছায় এলেন। অথচ তা তো নয়। শিশু মায়ের পেট থেকে বের হতে চায় না। মা তাকে জোর করে বের করে দেয়। তাতে সম্ভব না হলে ডাক্তাররা তাকে বের করে নিয়ে আসে। অর্থাৎ মানুষের জন্মটা তার ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে না। সারা জীবন সে যা করছে তাও কি তার ওপর নির্ভর করছে? না। প্রতিটি ক্ষেত্রে সে ঠোক্কর খাবে, আবার চেষ্টা করবে আর এই করতে করতে যখন তার সময় শেষ হয়ে আসবে তখন অতীতের দিকে তাকালে তার দুঃখ হবে, ভবিষ্যতের দিকে তাকালে ভয় পাবে। আর শরীর ফেলে চলে যাওয়াটাও তো তার ওপর নির্ভর করে না। এমনকী ঠিক কোন সময়টা চলে যাচ্ছে তাও সে অনুভব করতে পারে না। বলো, কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক?

মুগ্ধ হয়ে শুনছিল অর্ক। এবার হেসে বলল, দিন, খাব।

এই তো ভাল ছেলের মতো কথা বললো সন্ন্যাসিনী ইশারা করলে একজন শিষ্য ঝোলার ভেতর থেকে কাপড়ে মোড়া সসপ্যান বের করে শালপাতার ওপর রুটি, আলুর তরকারি আর ক্ষীর সাজিয়ে এক এক করে সবাইকে দিল। সন্ন্যাসিনী বললেন, এই আলুর তরকারিতে কিন্তু পেঁয়াজ রসুন নেই।

আপনারা ওসব খান না? অর্ক খাওয়া শুরু করল।

না না। কেন খাব না। নিশ্চয়ই খাই। কিন্তু মাটির নীচে যা ফলে তার সঙ্গে পেঁয়াজ রসুন মেশাই না। ওরাও তো মাটির নীচে জন্ম নেয়। মাছ মাংসের সঙ্গে খাব না কেন? তাই বলে কচুর সঙ্গে খাব না। হয়তো তোমার ভাল লাগবে না। সন্ন্যাসিনী খাওয়া শুরু করলেন।

বেশ লাগছে। অর্ক বলল। খাওয়া শেষ হলে শিষ্যের এগিয়ে দেওয়া বোতল থেকে জল খেল অর্ক। কিছুক্ষণ পরে সব যখন চুপচাপ, পাশে বসা শিষ্য ফিসফিস করে বলল, এখন আর মায়ের সঙ্গে কথা বলবেন না।

কেন? উনি কি ঘুমাবেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

না। এখন উনি উপলব্ধি করবেন। শিষ্যটি বলল।

কীসের উপলব্ধি?

আত্ম-উপলব্ধি। আপনি ওটা বুঝবেন না।

অর্ক দেখল সন্ন্যাসিনী একটা গেরুয়া ওড়নায় নিজের মাথা মুখ ঢেকে নিলেন। মনে মনে হাসল অর্ক। সবার সামনে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর বদলে মাথা মুখ ঢেকে একটা বাহানা করে ঘুমানোটা ঢের সহজ।

ট্রেনের দুলুনিতে ঘুম আসছিল অর্কর। পরের স্টেশনে টিকিট চেকার উঠলেন। অর্ক দেখল অনেকেই টিকিট দেখাচ্ছেন, যারা দেখাতে পারছে না তাদের সঙ্গে কথা বলছিল চেকারের সঙ্গে আসা সিঁড়িঙ্গে চেহারার একজন। দরাদরি করে লোকটা টাকা আদায় করছিল। চেকার নির্বিকার। ওসব তার চোখেই পড়ছিল না।

এগোতে এগোতে অর্কর সামনে চলে এসেছিলেন চেকার। অর্ক তাকে ইশারায় কাছে ডাকতেই তিনি বললেন, আরে না না। টিকিট না থাকলে কেন্টুর সঙ্গে কথা বলুন।

পকেট থেকে জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে কেনা অসংরক্ষিত ক্লাসের টিকিট বের করে দেখাল অর্ক। সঙ্গে সঙ্গে চেকারের মুখ বিকৃত হল। তিনি উলটোদিকের লোকটির টিকিট দেখতে চাইলে অর্ক বলল, আপনার সঙ্গে একটু কথা বলব।

বলুন। চেকার ফিরে দাঁড়ালেন।

ট্রেনের ভাড়া মন্ত্রী বাড়াচ্ছেন নাকি? না না, কোনও দুশ্চিন্তা করবেন না।

তা হলে ভারতীয় রেলওয়ের বিপুল খরচ কীভাবে মিটবে?

চলে তো যাচ্ছে।

যাচ্ছে না। খোঁড়াচ্ছে। আচ্ছা, একটা কথা বলুন তো। এই যে গোটা ভারত জুড়ে ট্রেন লাইন, তাতে কত মেল, এক্সপ্রেস, প্যাসেঞ্জার ট্রেন ছুটছে প্রতি মিনিটে, তাতে কত টিকিট চেকার কাজ করে মাইনে নিচ্ছেন?

চেকারের চোখ ছোট হল, আপনার কথার মানে বুঝলাম না।

সংখ্যাটা কত তা জানেন?

না।

অন্তত হাজার আষ্টেক? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

বললাম তো আমি জানি না। চেকার রেগে গেলেন।

ধরে নিলাম আট হাজার। ধরে নিচ্ছি তাদের মধ্যে ছয় হাজার মানুষ আপনার মতো কেন্দ্রবাবুদের পেছনে নিয়ে টিকিট চেক করতে ট্রেনে ওঠেন না। আচ্ছা, প্রতিদিন কেন্টুবাবুরা যা সংগ্রহ করেন তাকে দুহাজার দিয়ে গুণ করলে যে টাকাটা পাওয়া যায় তাকে তিনশো পঁয়ষট্টি দিয়ে গুণ করলে তো মাথা ঘুরে যাবে। সেই টাকা যদি রেলমন্ত্রী হাতে পেতেন তা হলে ভারতীয় রেলের কী বিপুল উপকার হত বলুন তো? ভাড়া বাড়ানোর দরকারই হত না। অর্ক শান্ত গলায় বলল।

জ্ঞান দেবেন না, জ্ঞান দেবেন না। চেকার ফিরলেন।

এবার সন্ন্যাসিনী মুখের আড়াল সরালেন, আমাদের টিকিট দেখবেন না?

সাধুসন্ন্যাসীদের কাছে আমি টিকিট চাই না। চেকার ট্রেনের অন্য প্রান্তে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় কেন্টুকে ইশারা করলেন তাঁর সঙ্গে চলে যেতে।

মালদা স্টেশনে নেমে গেলেন ভদ্রলোক সঙ্গীকে নিয়ে।

সন্ন্যাসিনী একটু ঝুঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি বসে ঘুমাতে পারো না বাছা?

না।

ভাবো তো কোন প্রাণী সারাজীবন দাঁড়িয়ে ঘুমোয়। কে বলো তো?

ঘোড়ার কথা বলছেন।

বাঃ। এ বাছা তো অনেক খবর রাখে। কলকাতায় যাচ্ছ?

হ্যাঁ।

সংসার করোনি?

কী করে মনে হল?

মুখ দেখলেই তো বোঝা যায়।

আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?

বোলপুরে নামব। নেমে ট্রেন ধরব।

এক শিষ্য বলল, মা, ফাস্ট বাস ধরলে ভাল হয়।

বেশ তো। বাসেই উঠব। ওদিকে গেলে দেখা করে যেয়ো। যদি কষ্ট করে থাকতে পারো তা হলে শেষ পর্যন্ত ভাল লাগবে।

জায়গাটা কোথায়?

পাশে বসা শিষ্যটি বুঝিয়ে দিল অর্ককে। জানাল তাদের আশ্রমের সামনে অজয় নদ।

ভোররাতের আগেই ওঁরা নেমে গেলেন। নামার সময় সন্ন্যাসিনী অর্কর কাঁধে হাত রাখলেন, মন যা চাইবে তাই করবে। যদি ভুল হয় হবে। বুঝলে বাছা। তোমাকে আমার মনে থাকবে।

অর্কর মহিলাকে ভাল লাগল।

শেয়ালদা থেকে উত্তর কলকাতার শেষপ্রান্তে আগে ট্রামেই আসা যেত। এখন ট্রাম চলছে না। মোড়ে বাস থেকে নেমে পাড়ায় ঢুকল সে। বস্তির মুখে আসতেই বিশ্বজিৎকে দেখতে পেল অর্ক। তাকে দেখে হাত তুলে দাঁড়াতে বলছে। অর্ক দাঁড়াল। বিশ্বজিৎ কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, বাইরে গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ। কেন বলো তো?

আপনার মা-বাবা তো জলপাইগুড়িতে গিয়েছেন। পরশু সন্ধে থেকে আপনিও বাড়িতে ছিলেন না। অথচ একজন অবাঙালি ভদ্রলোক আপনাদের বাড়িতে যে একা থাকবেন তা পাড়ার কাউকে বলে যাননি। ফলে সবাই টেনশন করছিল। তবে আপনার সঙ্গে আগে ওঁকে দেখা গিয়েছে বলে কেউ কিছু বলেনি। বিশ্বজিৎ বলল।

আশ্চর্য। আমার কোনও গেস্ট বাড়িতে থাকতে পারে না?

নিশ্চয়ই পারে। কিন্তু আপনার গেস্ট বাংলা বলতে পারেন না। কেউ কেউ প্রচার করছে উগ্রপন্থীরা নাকি কলকাতায় গা ঢাকা দিয়ে আছে। যাক আপনি এসে গেছেন, আর সমস্যা নেই। বিশ্বজিৎ চলে গেল।

একটু অবাক হল অর্ক। বিশ্বজিৎ সিপিএম করে না, আগে কংগ্রেসি ছিল, এখন কি তৃণমূলে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *