২১.
দুদিন পর।
যুদ্ধের শুভফল কামনা করে বিশেষ এক পূজা অনুষ্ঠান হলো মন্দিরে। আমরা তাতে যোগ দিলাম না। তবে রাতে যথারীতি এক সাথে খেতে বসলাম। আয়শার মেজাজ মর্জির কোনো থই পেলাম না এ সময়। এই হাসি, পরমুহূর্তে খেপে উঠছে। বুঝতে পারছি কোনো কারণে বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে ওর মন।
জানো, বললো ও, আজ পাহাড়ের ঐ গর্দভগুলো কি করেছে? ওদের সর্দারদের পাঠিয়েছে হেসাকে জিজ্ঞেস করতে, কিভাবে যুদ্ধ হবে; শত্রুদের কাকে কাকে মারতে হবে, কাকে কাকে হবে না বা সম্মান দেখাতে হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি-আমি কোনো জবাব দিতে পারলাম না। শেষমেশ কথার ফুলঝুরি ছুটিয়ে বুঝিয়ে দিলাম, যা ইচ্ছা করতে পারে ওরা। যুদ্ধ কি হবে ভালোই জানি। আমি নিজে পরিচালনা করবো। কিন্তু ভবিষ্যৎ-ওহ! যদি জানতে পারতাম! এই একটা ব্যাপারে আমার কোনো ক্ষমতা নেই। ভবিষ্যতের কথা ভাবলেই মনে হয়, কালো দেয়াল যেন আমার সামনে।
এরপর ঘাড় গুঁজে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো আয়শা। অবশেষে মুখ তুলে তাকালো লিওর দিকে।
আমার অনুরোধ রাখবে না তুমি? কয়েকটা দিন চুপচাপ থাকবে ন এখানে? না হয় কয়েকটা দিন শিকার করে এলে?, আমিও না হয় থাকবো তোমার সঙ্গে। হলি আর অবোসই পারবে যুদ্ধ পরিচালনা করতে।
না না না! সরোষে বললো লিও। আমার ধারণা আমাকে যুদ্ধে পাঠিয়ে ও নিরাপদ আশ্রয়ে রইবে-আয়শার এই প্রস্তাবে বিশেষভাবে খেপে গেছে লিও। কিছুতেই অমন কাজ আমার দ্বারা হবে না। যদি এখানে রেখে যাও ঠিকই আমি পথ খুঁজে নিয়ে যুদ্ধে যোগ দেবো।
বেশ, তুমিই তাহলে নেতৃত্ব দেবে যুদ্ধের।…না, না, তুমি না, প্রিয়তম, আমি–আমিই পরিচালনা করবো যুদ্ধ।
এরপর হঠাৎ করেই বাচ্চা মেয়ের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো আয়শা। কারণে অকারণে হাসতে লাগলো খিল খিল করে। সুদূর অতীতের অনেক গল্প শোনালো। সে যুগের দু’একটা কৌতুকও শোনালো। অবশেষে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে এলো সে। কিভাবে সত্যের সন্ধান করেছে, জ্ঞানের অন্বেষণে ঘুরে বেড়িয়েছে দেশে দেশে; সে যুগে প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসগুলো বিশ্লেষণ করেছে এবং প্রত্যাখ্যান করেছে; তারপর নিজের মতো করে একটা ধর্মবিশ্বাস গড়ে তুলে তা প্রচার করেছে। জেরুজালেমে ওই ধর্মমত প্রচার করার সময় লোকেরা ওর গায়ে পাথর ছুঁড়ে মেরেছিলো। তখন ও নিজের দেশ আরবে ফিরে যায়। সেখানেও প্রত্যাখ্যাত হয়। অবশেষে চলে আসে মিশরে। মিশরের ফারাও-এর রাসভায় তখনকার সেরা এক যাদুকরের সাথে সাক্ষাৎ হয়। তার সব কৌশল ও শিখে নেয়, এবং শিগগিরই বেচারাকে ওর তাঁবেদার বানিয়ে ফেলে।
এরপর মিশর থেকে কোর-এ চলে এলো আয়শার গল্প। এবং এই সময় অবোসও হাজির হলো কামরায়। কুর্নিশ করে দাঁড়ালো।
উহ, তোমার জন্যে একটা ঘণ্টাও কি শান্তিতে কাটাতে পারবো না? বিরক্তকণ্ঠে বললো আয়শা। কি চাই?
ও হেস, খানিয়া আতেনের কাছ থেকে একটা লিপি এসেছে।
খুলে পড়ো, আদেশ করলো আয়শা, তারপর আপন মনেই বলতে লাগলো, আর কি লিখবে? অনুতাপ হয়েছে মনে, ক্ষমা চাই, আর কি?
অরোস, পড়তে শুরু করলো-শৈল চূড়ার মন্দিরের হেসা, যিনি পৃথিবীতে আয়শা নামে পরিচিত এবং পৃথিবীর ওপরে যখন সুযোগ পান খসে পড়া তারা-র মতো ঘুরে বেড়ান—
.
বাহ! চমৎকার সম্বোধন, বলে উঠলো আয়শা, কিন্তু, আতেন, খসে পড়া তারা আবার উঠবে, পাতাল ফুঁড়ে উঠলেও উঠবে। পড়ো, অরোস।
.
শুভেচ্ছা, ও আয়শা। আপনি প্রাচীন, অনেক জ্ঞান সঞ্চয় করেছেন বিগত শতাব্দীগুলোয়। সেই সঙ্গে এমন ক্ষমতাও অর্জন করেছেন যার বলে মানুষকে মোহাবিষ্ট করে তাদের চোখে আপনি সুন্দর বলে প্রতীয়মান হন। তবে একটা জ্ঞানের বা ক্ষমতার অভাব রয়েছে আপনার। তা হচ্ছে এখনও যা ঘটেনি তা দেখার বা জানার ক্ষমতা। শুনুন, ও আয়শা, আমি এবং আমার মহাজ্ঞানী পিতৃব্য আসন্ন যুদ্ধের ফলাফল কি হবে জানার আশায় সব স্বর্গীয় পুস্তকাদি ঘেঁটে দেখেছি।
লেখা আছে: আমার জন্যে মৃত্যু, তাতে আমার কোনো দুঃখ নেই, বরং বলতে পারেন সানন্দচিত্তে আমি বরণ করবো এই নিয়তি। আপনার জন্যে নির্ধারিত আছে আপনার নিজের হাতে তৈরি একটি বর্শা। আর কালুনের ভাগ্যে রক্তপাত আর ধ্বংস যার জননী আপনি।
আতেন,
কালুনের খানিয়া।
.
নিঃশব্দে শুনলো আয়শা। এক বিন্দু কাঁপলো না ওর ঠোঁট বা বিবর্ণ হলো না মুখ। গর্বিত ভাবে অরোসকে বললো-আতেনের দূতকে জানিয়ে দাও, আমি বার্তা পেয়েছি, জবাব দেবো কালুনের রাজপ্রাসাদে গিয়ে। এবার যাও, পূজারী, আর বিরক্ত কোরো না আমাকে।
.
পরদিন দুপরে আমরা রওনা হলাম। পাহাড়ী ঢাল বেয়ে নেমে চলেছি উপজাতীয় সেনাবাহিনী নিয়ে। হিংস্র, বুনো চেহারার মানুষ সব। অগ্রবর্তী সৈনিকরা সামনে, তারপর অশ্বারোহী বাহিনী; তাদের ডানে, বামে এবং পেছনে পদাতিকরা। বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে এগিয়ে চলেছে। প্রতিটা দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে একেকজন গোত্রপতি অর্থাৎ সর্দার।
অত্যন্ত বেগবান এবং সুদর্শন একটি সাদা মাদী ঘোড়ার পিঠে চেপে চলেছে আয়শা। ঘোড়সওয়ার বাহিনীর মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছে ও। ওর পাশে লিও আর আমি। লিও খান র্যাসেনের কালো ঘোড়ায় আর আমি অমনই আরেকটা ঘোড়ার পিঠে বসে আছি। আমাদেরকে ঘিরে থেকে এগোচ্ছে সশস্ত্র পূজারী আর বাছাই করা যোদ্ধাদের একটা দল।
সবার মন বেশ প্রফুল্প। শেষ শরতের না শীত না গরম আবহাওয়া। উজ্জ্বল সূর্যালোকে হাসছে প্রকৃতি। যত ভয় বা শঙ্কা-ই থাক এমন পরিবেশে আপনিই মন ভালো হয়ে ওঠে। তার ওপর হাজার হাজার সশস্ত্র সঙ্গীর সাহচর্য আর আসন্ন যুদ্ধের কল্পনায় উত্তেজিত হয়ে আছে স্নায়ু। আমার চেয়ে লিও আরও বেশি উৎফুল্ল। বহুদিন ওকে এত প্রাণোচ্ছল দেখিনি। আয়শাও উৎফুল্ল।
ওহ! কতদিন! বললো আয়শা। কতদিন পর পাহাড়ের ঐ কন্দর ছেড়ে বেরোলাম! মুক্ত পৃথিবীর মাঝে এসে কি যে আনন্দ আজ লাগছে! দূরের ঐ চূড়ায় দেখ, তুষার জমে আছে, কি সুন্দর! নিচে পাহাড়ী ঢলের দিকে তাকাও, তার ওপাশে সবুজ মাঠ! সূর্য! বাতাস! আহ কি মিষ্টি!
বিশ্বাস করো, লিও, বিশ শতাব্দীরও বেশি হয়ে গেছে, শেষবার আমি ঘোড়ায় চড়েছি, কিন্তু দেখ, এখনও ভুলিনি ঘোড়ায় চড়ার কায়দা কৌশল। তবে যা-ই বলো, আরবী ঘোড়ার তুলনায় এগুলো কিছু না। ওহ! আমার মনে আছে, বেদুঈনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাবার পাশে পাশে ঘোড়া ছুটিয়ে গিয়েছিলাম। আমার বাবা মহান এক মানুষ ছিলেন, অন্য একদিন বলবো তার কথা।
ঐ দেখ সেই গিরিখাত। ওর ওপাশে থাকতো সেই বিড়াল উপাসক। পুরোহিত, আরেকটু হলেই তোমরা যার লোকদের হাতে মরতে বসেছিলে। একেক সময় আমার আশ্চর্য লাগে, এই বিড়াল পূজার ব্যাপারটা এখানে চালু হলো কি করে! সম্ভবত আলেকজাণ্ডারের সেনাপতি প্রথম রাসেনের সঙ্গে মিসর থেকে এসেছিলো ঐ প্রথা। অবশ্য র্যাসেনকে পুরোপুরি দোষ দেয়া যায় না। ও বিড়াল উপাসক ছিলো না, ওর সঙ্গে যে সব ধর্মগুরু এসেছিলো তাদের কেউ গোপনে বিড়াল পূজা করতো। এক সময় সুযোগ বুঝে ব্যাটা জংলীদের ভেতর চালু করে দেয় তার আসল বিশ্বাস। সেরকমই মনে পড়ছে আমার। এই মন্দিরের প্রথম হেসা ছিলাম আমি তা জানো? র্যাসেনের সঙ্গে এসেছিলাম।
বিস্মিত চোখে আয়শার দিকে তাকালাম আমি আর লিও।
কি বিশ্বাস হলো না তো? বললো ও। তুমি, হলি, তোমার মতো সন্দেহবাতিকগ্রস্ত মানুষ আমি দেখিনি। ভাবছো আলেকজান্ডারের সময় আমি এখানে এলাম কি করে, আর যদি এসেই থাকি তাহলে আবার কোর-এ গেলাম কি করে? শোনো, সেটা আমার এ জীবনের কথা নয়, আগের জন্মের কথা। মেসিডোনিয়ার আলেকজাণ্ডার আর আমি একই গ্রীষ্মে জন্ম নিয়েছিলাম। ওকে ভালোভাবে চিনতাম, যুদ্ধবিগ্রহের ব্যাপারে আমি ছিলাম ওর প্রধান মন্ত্রণাদাতা। পরে আমাদের ভেতর ঝগড়া হয়। র্যাসেনকে নিয়ে চলে আসি আমি। সেদিন থেকেই আলেকজাণ্ডার নামক নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা মলিন হতে শুরু করে।
আগের জীবনে কি কি ঘটেছে, কি কি করেছে স্পষ্ট মনে আছে তোমার? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
না। টুকরো টুকরো কিছু স্মৃতি কেবল আছে। গোপন সাধনা—তোমরা যাকে বলো যাদু-তার মাধ্যমে পরে মনে করেছি, তা-ও সম্পূর্ণ পারিনি। যেমন ধরো, হলি, আমার মনে পড়ে তোমার কথা। নোংরা কাপড়চোপড় পরা কুৎসিত এক দার্শনিককে আমি দেখেছিলাম। আলেকজাণ্ডারের সঙ্গে গোলমাল বাধিয়েছিল লোকটা। আলেকজাণ্ডার তাকে হত্যা করেছিলো অথবা ডুবিয়ে মেরেছিলো—ঠিক মনে নেই।
নিশ্চয়ই ডায়োজেনেস নামে ডাকা হতো না আমাকে?
না, ডায়োজেনেস আরও বিখ্যাত লোক ছিলো। কিন্তু ও কি! সামনের ওরা আক্রান্ত হয়েছে মনে হচ্ছে!
আয়শার কথা শেষ হতে না হতেই দূর থেকে ভেসে এলো চিৎকার, কোলাহলের শব্দ। এবং সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেলাম দীর্ঘ এক অশ্বারোহীর সারি ছত্রভঙ্গ হয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। একটু পরেই অগ্রবর্তী বাহিনীর কয়েকজন সৈনিক এক বন্দীকে নিয়ে হাজির হলো আমাদের কাছে। তারা জানালো, নিছক একটু খোঁচা দেয়ার জন্যে এগিয়ে এসেছিলো আতেনের বাহিনীটা। ঝড়ের বেগে এসে পড়ে ওদের ওপর, তারপরই পিছিয়ে গেছে আবার। এই অদ্ভুত আক্রমণের কারণটা বোধগম্য হলো না আমাদের। তবে একটু পরেই আটক লোকটাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল, পবিত্র পাহাড়ের ওপর যুদ্ধ করার কোনো ইচ্ছা নেই খানিয়ার। আমরা যতক্ষণ না নদীর ওপারে পৌঁছুচ্ছি ততক্ষণ ঠায় অপেক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছে সে চাচা সিমব্রিকে। আমরা যাতে অবশ্যই নদী অতিক্রম করি সেজন্যে একটু উস্কানি দিলো সিমব্রি এই আক্রমণের মাধ্যমে।
সুতরাং সেদিন কোনো যুদ্ধ হলো না।
সারা বিকেল আমরা পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে চললাম! সূর্যাস্তের সামান্য আগে পৌঁছুলাম এক প্রশস্ত ঢালু জায়গায়। ঢালটা শেষ হয়েছে পাহাড়ে ওঠার দিন যেখানে আমরা নরকঙ্কাল ছড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম, যেখানে সাক্ষাৎ হয়েছিলো রহস্যময়ী পথ-প্রদর্শকের সঙ্গে সেই উপত্যকার প্রান্তে। এখানে রাতের মতো ছাউনি ফেলা হলো।
অশ্বারোহী আর পদাতিকদের এখানে রেখে। আয়শার সঙ্গে আমরা বাঁয়ে মোড় নিয়ে এগিয়ে গেলাম কয়েকটা ছোট ছোট চূড়ার দিকে। সেগুলোর ওপাশে একটা সুড়ঙ্গ মতো। মশাল জ্বেলে আমরা এগিয়ে চললাম অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে। অবশেষে পৌঁছুলাম ওপাশে। এখানেই রাত কাটাবো আমরা। সুড়ঙ্গের মুখে প্রহরী থাকবে, নিরাপদে ঘুমাতে কোনো অসুবিধা হবে না।
আয়শার জন্যে একটা তাবু খাটানো হলো। একটাই মাত্র তাবু ছিলো সঙ্গে, সুতরাং আমি আর লিও শখানেক গজ দূরে কয়েকটা পাথরের আড়ালে আশ্রয় নিলাম। কয়েকজন প্রহরী রইলো আমাদের সঙ্গে। এ অবস্থা দেখে ভীষণ রেগে গেল আয়শা। খাদ্য এবং সাজসরঞ্জামের দায়িত্ব যে সর্দারের ওপর তাকে ডেকে বকাঝকা করলো। বোকার মতো মুখ করে শুনলো বেচারা। তবু জিনিসটা কি তা-ই জানে না, তো ব্যবস্থা করবে কি?
অরোসকেও ধমকালো আয়শা। বিনীতভাবে পূজারীপ্রধান জবাব দিলো, সে ভেবেছিলো আমরা যুদ্ধের কঠোর কষ্ট সম্পর্কে ওয়াকেবহাল এবং অভ্যস্ত। শেষ পর্যন্ত নিজের ওপরই রাগ দেখাতে লাগলো আয়শা। বার বার বলতে লাগলো কেন আমি খেয়াল করলাম না খুঁটিনাটি বিষয়গুলো? শেষে যোগ করলো, তাহলে তোমরা তাঁবুতে ঘুমাও, আমি বাইরে থাকি। এখানকার ঠাণ্ডায় আমি অভ্যস্ত।
লিও হেসে উড়িয়ে দিলো ওর কথা। এরপর খোলা আকাশের নিচে বসে খেয়ে নিলাম আমরা-আমি আর লিও আশেপাশে প্রহরীরা থাকায় আয়শা ঘোমটাই খুললো না। ফলে আমাদের সুখেতে পারলো না। পরে তাঁবুতে ঢুকে খেয়েছিলো কিনা জানি না।
খাওয়ার পর আমরা আর দেরি না করে শুতে চলে গেলাম। আয়শাও ঢুকলো। ওর তাঁবুতে। প্রহরীরা ছাড়াও সুড়ঙ্গের ওপাশে রয়েছে পুরো বাহিনী। সুতরাং শোয়ার প্রায় সাথে সাথে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়লাম দুজন।
.
দূর থেকে ভেসে আসা চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল আমার। মনে হলো কোনো প্রহরী কারও পরিচয় জিজ্ঞেস করলো। এক মুহূর্ত পরে শুনতে পেলাম আমাদের প্রহরীরে দলনেতার জবাব। কি একটা প্রশ্নও করলো সে। উল্টোদিক থেকে আরেকটা। জবাব ভেসে এলো। কয়েক সেকেণ্ডের নীরবতা। তারপর একজন পূজারী কুর্নিশ করে এসে দাঁড়ালো আমার সামনে। মশাল তার হাতে। লোকটার চেহারা চেনা চেনা মনে হলো।
আমি– একটা নাম বললো সে, এখন আর নামটা মনে নেই আমার। পূজারী প্রধান অরোস আমাকে পাঠিয়েছেন। উনি বললেন, হেসা এক্ষুণি আপনাদের দুজনের সাথে আলাপ করতে চান।
ইতিমধ্যে হাই তুলতে তুলতে উঠে বসেছে লিও। ব্যাপার কি, জিজ্ঞেস করলো। আমি বললাম।
সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করলেই পারতো, বললো ও। যাক, ডেকেছে যখন যেতে হবে। চলো, হোরেস।
আবার কুর্নিশ করলো পূজারী। আপনাদের অস্ত্র আর রক্ষীদেরও নিয়ে যেতে বলেছেন হেসা।
কি! বিস্ময় প্রকাশ করলো লিও। নিজেদের সেনাবাহিনীর মাঝখানে থেকে একশো গজ যাবো তাতে আবার রক্ষী লাগবে!
হেসা তার তাবু ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন, ব্যাখ্যা করলো নোকটা। গিরিখাতের মুখে আছেন এখন। কোন দিক দিয়ে বাহিনী নিয়ে গেলে সুবিধা হবে, পর্যবেক্ষণ করছেন।
তুমি কি করে জানলে এত কথা? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
অবোস বলেছেন। হেসা ওখানে একা আছেন তাই রক্ষীদের নিয়ে যেতে বলেছেন।
পাগল নাকি ও? বললো লিও। এই মাঝাত্তিরে অমন জায়গায় গেছে, তাও আবার একা! হ্যাঁ, ওর পক্ষেই সম্ভব এমন অর কাজ।
আমারও মনে হলো, এমন অসম্ভব কাজ ওর পক্ষেই সম্ভব। তবু ইতস্তত করতে লাগলাম। অবশেষে আধা ইচ্ছায় আধা অনিচ্ছায় রওনা হলাম দূতের পেছন পেছন। আমাদের তলোয়ার, বর্শা নিয়ে নিলাম। রক্ষীদেরও ডেকে নিলাম। মোট বারো জন। একটা কথা ভেবে নিশ্চিন্ত বোধ করলাম, এর ভেতর কোনো কৌশল থাকলে রক্ষীদের নিয়ে যেতে বলা হতো না।
পথে দুজায়গায় প্রহরীরা থামালো আমাদের। সংকেত শব্দ বলতেই ছেড়ে দিলো। আমাদের যারা চিনতে পারলে তাদের মুখে বিস্ময়ের ছাপ পড়তে দেখলাম। ওরা কি কিছু সন্দেহ করছে? বুঝতে পারলাম না।
গিরিখাতের ধার দিয়ে নেমে চললাম আমরা। বেশ ঢালু পথ। তাল রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কিন্তু আমাদের পথ-প্রদর্শক পূজারী অনায়াসে নেমে চলেছে, যেন নিজের বাড়ির বাঁধানো সিঁড়ি বেয়ে নামছে।
রাত দুপুরে এমন অদ্ভুত জায়গায়! সন্দেহের সুর লিওর গলায়। রক্ষীদের দলনেতাও কিছু একটা বিড়বিড় করলো। আমি বোঝার চেষ্টা করছি ও কি বললো, এই সময় গিরিখাতের নিচে অস্পষ্ট সাদা একটা অবয়ব দেখতে পেলাম। আয়শার মুখ ঢাকা মূর্তিই মনে হলো।
হেস! হেস! বলে উঠলো রক্ষী দলনেতা। স্বস্তির ভাব তার কণ্ঠস্বরে।
দেখ ওকে, বললো লিও, এই ভয়ঙ্কর জায়গায় কেমন ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেন হাইড পার্কে বেড়াতে এসেছে। বলেই ছুটে গেল ও আয়শার দিকে।
ঘুরে আমার দিকে তাকালো মূর্তি। পেছন পেছন যাওয়ার ইশারা করে হাঁটতে শুরু করলো।
কঙ্কাল ছাওয়া উপত্যকায় পৌঁছলাম। না থেমে এগিয়ে চললো আয়শা। কিছুদূর গিয়ে নিচু একটা চূড়ার কাছে থামলো। সেখানেও চারপাশে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য কঙ্কাল। আমাদের পথপ্রদর্শক পুরোহিত দাঁড়িয়ে পড়লো রক্ষীদের নিয়ে–হেসার নির্দেশ ছাড়া তার কাছাকাছি যাওয়া বারণ। আমি এগিয়ে গেলাম। লিও সাত আট গজ সামনে। ওকে বলতে শুনলাম- এই রাতে এমন জায়গায় কি জন্যে এসেছে, আয়শা? বিপদ ঘটতে কতক্ষণ?
জবাব দিলো না আয়শা। হাত দুপাশে ছড়িয়ে দিয়ে আবার নামিয়ে আনলো। বিস্মিত হয়ে আমি ভাবছি, এটা কোনো সংকেত কিনা? হলে কিসের? এমন সময় অদ্ভুত এক আওয়াজ উঠলো চারপাশ থেকে। অনেক লোক যেন হুটোপুটি করছে।
ভুরু কুঁচকে তাকাতেই দেখলাম, ছড়িয়ে থাকা কঙ্কালগুলো উঠে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যেকের হাতে বল্লম। চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে।
ভূত বিশ্বাস করি না আমি। জানি আয়শার কোনো কৌশল এটা, তা ছাড়া এমন হতে পারে না। তবু এতগুলো কঙ্কালকে আচমকা দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে সত্যি ভূত দেখার মতোই চমকে উঠলাম। শিরশির একটা অনুভূতি হলো শরীর জুড়ে।
এ আবার কোন্ ধরনের পৈশাচিকতা? ভয় আর রাগ মেশানো স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো লিও।
এবারও কোনো জবাব দিলো না সাদা আলখাল্লা পরা মৃর্তি। পেছনে শব্দ শুনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম। আমাদের রক্ষীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে কাল। বাহিনী।:কঙ্কালগুলোকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখেই ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়েছিলো জংলীগুলো। বাধা দেয়ার কথা বোধ হয় মনেও পড়েনি বেচারাদের। এক এক করে সব কজনকে বল্পমে গেঁথে ফেললো শত্র: লিওর দিকে বল্লম উঁচিয়ে গেল এক কঙ্কাল। ঘোমটা টানা মৃর্তি হাত উঁচু করলো।
উঁহুঁ, ওকে বন্দী করো! আমার নির্দেশ, ওর যেন কোনো ক্ষতি না হয়।
কণ্ঠস্বরটা আমার চেনা। কালুনের খানিয়া আতেনের।
ষড়যন্ত্র! চিৎকার করতে চাইলাম আমি; পারলাম না। তার আগেই জ্ঞান হারালাম মাথায় শক্ত, ভারি কিছুর আঘাতে।
.
২২.
যখন জ্ঞান ফিরলো তখন দিন হয়ে গেছে। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। অরোসের শান্ত মুখটা ঝুঁকে আছে আমার ওপর। আমাকে চোখ মেলতে দেখেই খানিকটা তরল পদার্থ ঢেলে দিলো আমার গলায়। সাথে সাথে আশ্চর্য প্রতিক্রিয়া হলো আমার ভেতরে। মনের ওপর জমে থাকা ঘষা কাচের মতো একটা পর্দা যেন গলে যেতে লাগলো। যন্ত্রণা দূর হয়ে গেল কয়েক সেকেন্দ্রে ভেতর। তারপর দেখলাম আয়শাকে। অরোসের পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
কি সর্বনেশে কাণ্ড! তুমি বেঁচে আছে, আমার প্রভু লিও কোথায়? চিৎকার করলো ও। বলো কোথায় লুকিয়ে রেখেছো আমার প্রভুকে? বলো—না হলে মরবে!
হিমবাহের তুষারে যখন ডুবে মরতে বসেছিলাম তখন জ্ঞান হারানোর আগে এই দৃশ্যটাই দেখেছিলাম, এই কথাগুলোই জিজ্ঞেস করেছিলো আয়শা।
আতেন নিয়ে গেছে ওকে।
তোমাকে জীবিত রেখে ওকে নিয়ে গেছে আতেন!
আমার ওপর রাগ দেখিও না। আমার কোনো দোষ নেই।
এরপর আমি সংক্ষেপে বর্ণনা করলাম রাতের ঘটনা।
নিঃশব্দে শুনলো আয়শা। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল নিহত রক্ষীদের দিকে। গম্ভীর মুখে দেখলো কিছুক্ষণ।
আচ্ছা! তাই তো ভেবে পাচ্ছিলাম না, ওরা মরলো কিভাবে? অবশেষে সে বললো। তারপর এগিয়ে গেল আরেকটু-যে জায়গা থেকে লিওকে বন্দী করা হয়েছিলো সেখানে। ভাঙা একটা তলোয়ার পড়ে আছে। জিনিসটা খান রাসেনের। র্যাসেন মারা যাওয়ার পর ওটা লিওর সম্পত্তিতে পরিণত হয়। তলোয়ারটার পাশে দুটো মৃতদেহ। কালো আঁটো পোশাক তাদের পরনে। মাথা এবং মুখ খড়িমাটি দিয়ে সাদা করা। হাত, পা এবং বুকেও খড়িমাটির দাগ দিয়ে কঙ্কালের চেহারা দেয়া হয়েছে।
ভালোই ফন্দি এঁটেছিলো আতেন, দাঁতে দাঁত চেপে বললো আয়শা। কিন্তু, হলি, আমার প্রভু কি আঘাত পেয়েছে?
খুব একটা না। জ্ঞান হারানোর আগ মুহূর্তে দেখেছিলাম, ওই দুজনের সঙ্গে লড়ছে। মুখ থেকে বোধহয় একটু রক্তও পড়তে দেখেছিলাম। আর কিছু মনে নেই।
প্রতি বিন্দুর জন্যে একশোটা করে জীবন নেব। আমি শপথ করে বলছি, হলি।
ইতিমধ্যে শিবির ভেঙে কঙ্কাল উপত্যকায় জড়ো হতে শুরু করেছে উপজাতীয় সেনাবাহিনী। পাঁচ হাজার সৈনিকের অশ্বারোহী বাহিনীও এসে গেছে। সবগুলো দলের সর্দারকে ডেকে পাঠালো আয়শা। ভাষণ দিলো ও ওদের উদ্দেশ্যে।
হেস-এর ভৃত্যরা, শুরু করলো আয়শা, তোমাদের প্রভু, আমার অতিথি এবং হবু স্বামী লিওকে কৌশলে বন্দী করে নিয়ে গেছে খানিয়া আতেন ও তার লোকজন। যতদূর অনুমান করতে পারছি, ওঁকে জিম্মি হিসেবে আটক রাখবে। আমার ধারণা খুব বেশি দূর যেতে পারেনি ওরা আমাদের প্রভুকে নিয়ে। সুতরাং এই মুহূর্তে রওনা হতে হবে আমাদের। ঝড়ের বেগে নদী পেরিয়ে আমরা আক্রমণ করবো খানিয়ার বাহিনীকে। আজ রাতে আমি কালুনে ঘুমাতে চাই। কি বলো, অরোস, দ্বিতীয় এবং আরও বড় একটা কাহিনী থাকবে নগর প্রাচীর রক্ষা করার জন্যে? থাকুক, প্রয়োজন হলে ঐ কাহিনীও আমি ধ্বংস করে দেবো, মিশিয়ে দেবো বাতাসের সঙ্গে। না, অবাক হওয়ার কিছু নেই। ধরে নাও ওর মারা গেছে।
ঘোড়সওয়াররা, আমার পেছন পেছন এসো। পদাতিকরা, তোমরা এগিয়ে যাবে আমাদের দুপাশ দিয়ে। যে পিছু হটবে বা এগোতে ভয় পাবে তার জন্যে অপেক্ষা করছে মৃত্যু। আর অকার সম্পদ ও সম্মান, যারা সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যাবে তাদের জন্যে। হ্যাঁ, আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, কালুনের উর্বরা জমি তোমাদের হবে। এবার যাও, প্রত্যেকে যার যার দল প্রস্তুত করে নাও। এক্ষুণি রওনা হবো আমরা।
উৎফুল্ল কণ্ঠে সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো সর্দাররা। হিংস্র জাতি ওরা, পুরুষানুক্রমে যুদ্ধপ্রিয়, তার ওপর হেসার প্রতিশ্রুতি সম্পদ ও সম্মান প্রদানের। উফুল্ল হওয়ারই কথা।
প্রায় এক ঘণ্টা ঢাল বেয়ে নামার পর জলাভূমির কাছে পৌঁছুলো সেনাবাহিনী। সামনে কোনো প্রতিবন্ধক দেয়া গেল না, যদিও সবাই মনে মনে আশা করছিলো, ছোট বা বড় যা-ই হোক না কেন, বানিয়ার কোনো বাহিনী থাকবে এখানে। নেই দেখে আমাদের সেনাপতিরা হতাশ হলো না খুশি হলো বুঝতে পারলাম না।
কিছুক্ষণ পর নদী তীরে পৌঁছুলাম আমরা। এবার দেখা গেল খানিয়ার সৈনিকদের। ওপারে দীর্ঘ সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। নদীর মাঝখানেও দেখলাম, কয়েকশো কালুন সেনা। বল্লম উঁচিয়ে অপেক্ষা করছে। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলো আমাদের সৈনিকরা। তারপর প্রচণ্ড বুনো উল্লাসে চিৎকার করে ঝাঁপিয়ে পড়লো নদীতে। অশ্বারোহীরা নড়লো না। অপেক্ষা করতে লাগলো পদাতিকদের কি অবস্থা হয় দেখার জন্যে। কয়েক মিনিট মাত্র লাগলো নদীর মাঝের শত্রুদের ছত্রভঙ্গ করে দিতে। প্রাণ ভয়ে হাচড়ে পাচড়ে পাড়ে উঠতে লাগলো তারা। ধাওয়া করে গেল আমাদের সৈনিকরা। এই সময় অরোস এসে জানালো, এক গুপ্তচর এই মাত্র খবর নিয়ে এসেছে, সে লিওকে হাত পা বাঁধা অবস্থায় একটা দুই চাকাওয়ালা ঘোড়ায় টানা গাড়িতে দেখেছে। আতেন, সিমব্রি আর এক রক্ষীও ছিলো সঙ্গে। পূর্ণ বেগে কালুনের দিকে ছুটে চলেছে তারা।
ইতিমধ্যে আমাদের কিছু সৈনিক নদীর অপর পাড়ে উঠতে পেরেছে। শত্রু সেনারা ধেয়ে এলো ওদের দিকে। কয়েক মিনিট লড়ে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হলো আমাদের সৈনিকরা। পর পর তিনবার এমন পিছিয়ে আসতে হলো ওদের। ক্ষয় ক্ষতিও কম হলো না। অধীর হয়ে উঠলো আয়শা।
ওদের নেতা দরকার, বললো ও, আমি নেতৃত্ব দেবো। এসো আমার সাথে, হলি, বলেই ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো আয়শা। ঘোড়সওয়ার বাহিনীর মূল অংশটা অনুসরণ করলো ওকে। মহা উল্লাসে চিৎকার করতে করতে ঝাঁপিয়ে পড়লো নদীতে। শত সহস্র তীর বল্লম ছুটে আসতে লাগলো শত্রুর দিক থেকে। ডানে বাঁয়ে আমাদের অনেক ঘোড়া এবং আরোহীকে লুটিয়ে পড়তে দেখলাম। কিন্তু আমার বা এক কি দুগজ সামনে সাদা আলখাল্লা মোড়া আয়শার গা স্পর্শ করলো না একটাও। পাঁচ মিনিটের মাথায় নদীর অপর পাড় দখল করে নিলাম আমরা। এবার শুরু হলো আসল লড়াই।
একটু পিছিয়ে গিয়েছিলো কালুনের বাহিনী। আমরা পাড় দখল করা মাত্র হামলা চালালো আবার। আমাদের মতো ওরাও মাঝখানে অশ্বারোহী আর দুপাশে পদাতিক বাহিনী মোতায়েন করেছে। আমাদের পদাতিকরা মুখোমুখি হলো ওদের পদাতিকদের, আর ঘোড়সওয়াররা ওদের ঘোড়সওয়ারদের। দুপক্ষই সমানে বর্ষণ করছে তীর আর বল্লম। হতাহতও হচ্ছে সমানে সমানে। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম, খুব ধীরে হলেও আমরা এগোচ্ছি। আগেই বলেছি তীর বল্লম আমাদের দিকে আসছে কিন্তু অদৃশ্য কোনো শক্তির প্রভাবে যেন আমাদের গায়ে লেগে আশপাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। সামনে, পেছনে, দুপাশে লড়ছে আমাদের সৈনিক, ঘোড়সওয়াররা। জখম হচ্ছে, মরছে; কিন্তু ভূক্ষেপ নেই কারও।
অবশেষে শক্ত বাহিনীর ব্যুহ ভেদ করে বেরিয়ে এলাম আমরা। প্রায় আধ মাইল মতো ছুটে গিয়ে থামলাম কিছুক্ষণের জন্যে। পাঁচ, দশ বা বিশ, পঞ্চাশ জনের ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে হাজির হতে লাগলো আমাদের ঘোড়সওয়াররা। সামান্য সময়ের ভেতর হাজার তিনেক লোক জড় হয়ে গেল। শেষ দলটা উপস্থিত হওয়ার পর মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করলো আয়শা। আর কেউ এলো না দেখে হাত উঁচু করে এগোনোর নির্দেশ দিলো। কালুন নগরীর পথে ছুটে চললো জংলীবাহিনী। পুরোভাগে আয়শা। তার সামান্য পেছনে পাশাপাশি আমি আর অবোস।
ভয়ঙ্কর বেগে ছুটে চলেছি আমরা। খান র্যাসেন যখন মরণ-শ্বাপদ নিয়ে লিও আর আমাকে তাড়া করেছিলো তখনও সম্ভবত এত জোরে ঘোড়া ছোটাইনি। পেছনে তিন হাজার জংলীর উল্লসিত চিৎকার। খান র্যাসেনের তাড়া খেয়ে যে পথে এসেছিলাম এখন আমরা সে পথে যাচ্ছি না। সমভূমির ওপর দিয়ে কোনাকুনি একটা পথে ছুটছে আয়শা। ফলে অনেক কম সময়ে পৌঁছে গেলাম। কালুনের কাছাকাছি। দুপুরের সামান্য পরে দূরে দেখা গেল কালুন নগরী।
ছোট একটা জলার ধারে ঘোড়া থামালো আয়শা। তিন হাজার জংলী অশ্বারোহীও দাঁড়িয়ে পড়লো। এখানে ঘোড়াগুলোকে পানি খাইয়ে নেয়া হলো। যোদ্ধারাও সঙ্গের পুটুলি থেকে খাবার বের করে খেয়ে নিলো। আমিও সামান্য খেলাম। কিন্তু আয়শা কিছু মুখে তুললো না।
এখানেও কয়েকজন গুপ্তচর দেখা করলো অরোসের সঙ্গে। তাদের কাছে জানা গেল, খানিয়া আতেনের বড় বাহিনীটা নগর পরিখার সেতুগুলো পাহারা দিচ্ছে। আমাদের এই স্বল্পসংখ্যক যোদ্ধা নিয়ে ওদের আক্রমণ করাটা বোকামি হবে। এ সব কথায় কান দিলো না আয়শা। ঘোড়াগুলোর একটু বিশ্রাম হতেই আবার এগোনোর নির্দেশ দিলো সে।
আবার কয়েক ঘণ্টা একটানা ঘোড়া ছুটিয়ে চলা। ঘোড়ার খুরের সম্মিলিত আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। আয়শা কোনো কথা বলছে না, ওর সঙ্গী তিন সহস্র বুনো মানুষও নিপ। মাঝে মাঝে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাচ্ছে পেছনে।
আমিও তাকালাম একবার। সে দৃশ্য ভোলার নয়। কালো মেঘে ছেয়ে গেছে পেছনের আকাশ। মেঘের প্রান্তগুলো আগুনের মতো লাল। মাথার ওপর দিয়ে স্বর্গীয় সেনাবাহিনীর মতো এগিয়ে চলেছে যেন আমাদের সাথে সাথে। এমন কালো মেঘ আমি জীবনে কখনও দেখিনি। মাত্র বিকেল এখন, কিন্তু মনে হচ্ছে সন্ধ্যা নেমে এসেছে প্রকৃতিতে। প্রায় অন্ধকার হয়ে গেছে পেছনের সমভূমি। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে নিঃশব্দে। দেখে মনে হচ্ছে কোনো যোদ্ধা যেন মেঘের গায়ে তীব্র আঘাত হানছে হাতের খোলা তলোয়ার দিয়ে।
ক্রমশ এগিয়ে আসছে কালুন। একটু পরে দেখতে পেলাম ওদের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তর বাহিনীটাকে। ভয় পাওয়ার মতোই দৃশ্য বটে। আকাশে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের মতোই ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সৈনিকরা, ঘোড়সওয়াররা। আমরা যেমন ওদের দেখেছি তেমনি ওরাও দেখেছে আমাদের।
একটু পরেই দেখলাম একজন দূত এগিয়ে আসছে ঘোড়ায় চেপে। আয়শা হাত উঁচিয়ে সংকেত দিতেই থেমে গেলাম আমরা। আরও এগিয়ে এলো দূত। চিনতে পারলাম লোকটাকে। সাবেক খানের এক পারিষদ। লাগাম টেনে দৃঢ় কণ্ঠে সে বলতে লাগলো-শুনুন, হেস, খানিয়া আতেনের কথা। আপনার প্রিয়তম, বিদেশী প্রভু এখন বন্দী তার প্রাসাদে। এখোনোর চেষ্টা করলেই আপনাকে এবং আপনার ছোট্ট দলটাকে আমরা ধ্বংস করে দেবো। দেখতেই পাচ্ছেন কি বিশাল বাহিনী তৈরি রয়েছে এখানে। তবু যদি কোনো অলৌকিক উপায়ে আপনি জয়ী হন, কালুনের প্রাসাদে পৌঁছুনোর আগেই মারা যাবে আপনার প্রিয়তম। তার চেয়ে আপনি আপনার পাহাড়ে ফিরে যান, খানিয়া প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আপনাকে এবং আপনার লোকদের অক্ষত অবস্থায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেবেন তিনি। এখন বলুন, আপনার যদি কিছু বলার থাকে।
ফিসফিস করে অরোসকে কিছু বললো আয়শা। অবোস উঁচু গলায় শুনিয়ে দিলো কথাগুলো–কিছু বলার নেই। প্রাণের মায়া থাকলে পালাও এক্ষুণি, মৃত্যু তোমার পেছনেই।
হতাশ মুখে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো দূত। কিন্তু আয়শা তক্ষুণি রওনা হওয়ার নির্দেশ দিলো না আমাদের। গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে ও।
একটু পরেই আমার দিকে তাকালো আয়শা। পাতলা মুখাবরণের ভেতর দিয়ে দেখতে পাচ্ছি ওর মুখ। সাদা, ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। চোখ দুটো সিংহীর চোখ রাতের বেলা যেমন জ্বলে তেমন জ্বলছে। দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসে স্বরে সে বললো–নরকের মুখ দেখার জন্যে তৈরি হও, হলি! ভেবেছিলাম সম্ভব হলে ওদের মাফ করে দেবো। পারলাম না। আমার সব গোপন শক্তি প্রয়োগ করে হলেও আমি লিওকে জীবিত দেখতে চাই। ওরা ওকে খুন করতে চাইছে!
তারপর ও পেছন ফিরে চিৎকার করে উঠলো, ভয় পেয়ো না সর্দাররা। তোমরা সংখ্যায় কম, কিন্তু তোমাদের সঙ্গে আছে লক্ষ লক্ষ সৈনিকের শক্তি। হেসাকে অনুসরণ করো, যা-ই ঘটুক না কেন, ভয় পেয়ো না বা হতাশ হয়ো না। তোমাদের সৈনিকদের জানিয়ে দাও একথা। বলো, ভয়ের কিছু নেই, হেসার বর্মের আড়ালে তোমরা সেতু পেরিয়ে কালুন নগরীতে প্রবেশ করবে।
সর্দাররা যার যার যোদ্ধাদের কাছে গিয়ে জানিয়ে দিলো আয়শার নির্দেশ।
আমরা আপনার পেছন পেছন নদী পেরিয়েছি, হেস, চেঁচিয়ে জবাব দিলো বুনো লোকগুলো, এতদূর এসেছি বিনা বাধায়। আপনি এগিয়ে চলুন, আমরা আছি আপনার পেছনে।
নির্দেশ দিলো আয়শা। বর্শার ফলার মতো চেহারায় দাঁড়িয়ে গেল ঘোড় সওয়াররা। আয়শা রইলো ফলার একেবারে মাথায়। অরোস আর আমি একটু পেছনে আগের মতোই পাশাপাশি।
তীক্ষ স্বরে একবার শিঙ্গা বেজে উঠলো কোথাও। পর মুহূর্তে কাছের এক পপলার বন থেকে সার বেঁধে বেরিয়ে এলো কালুনের বিরাট এক অশ্বারোহী বাহিনী। দ্রুত বেগে আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে তারা। এদিকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাহিনীটাও এগোতে শুরু করেছে। প্রথমে ঘোড়সওয়াররা তারপর পদাতিকরা।
আমাদের খেলা বোধহয় শেষ হলো। সন্দেহ নেই আমরা হারবো, অন্তত আমার তাই মনে হচ্ছে।
পপলার বন থেকে বেরিয়ে আসা ঘোড়সওয়ারদের দিকে তাকালো একবার আয়শা। সামনের বাহিনীটার দিকে তাকালো একবার। তারপর এক টানে মুখের আবরণ ছিঁড়ে ফেলে উঁচু করে ধরলো। ওর কপালে জ্বলে উঠলো সেই অদ্ভুত রহস্যময় নীল আলো। উপস্থিত অর্ধলক্ষ মানুষের ভেতর একমাত্র আমি এর আগে দেখেছি এ আলো।
ইতিমধ্যে মাথার ওপর মেঘ আরও ঘন হয়েছে, এবং এখনও হচ্ছে। মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এখন আর নিঃশব্দে নয়, শব্দে। পেছনের পাহাড় চূড়া থেকে আচমকা বেরিয়ে এলো কয়েক দমক অগ্নিশিখা। তিমি যেমন নিঃশ্বাস ছাড়ে তেমনি ফোয়ারার মতো উঠে গেল তা অনেক অনেক উপরে। লাল আভা ধরলো মেঘের কালো গা।
ঘোড়ার লাগাম ফেলে দিয়ে দুহাত আকাশে ছুঁড়ে দিলো আয়শা। হেঁড়া সাদা মুখাবরণটা নাড়তে লাগলো, স্বর্গের উদ্দেশ্যে সংকেত দিচ্ছে যেন।
সেই মুহূর্তে আকাশের কালো চোয়ালটা যেন হাঁ হয়ে গেল। তীব্র, উজ্জ্বল আগুনের শিখা ছুটলো কালুনের দিকে। বিদ্যুচ্চমক ম্লান হয়ে যায় সে উজ্জ্বলতার কাছে। পরক্ষণে শো শো শব্দে ধেয়ে এলো বাতাস। আমাদের সামান্য উপর দিয়ে ছুটে গেল কালুন নগরীর দিকে। কি ভয়ঙ্কর বেগ সে বাতাসের! প্রবল ঝড়ও হার মানে তার কাছে। সামনে যা পেলোইট, কাঠ, পাথর, মানুষ, ঘোড়া সব, উড়িয়ে নিয়ে গেল। বসন্তের আগমনে শীতের তুষার যেমন গলে মাটির সঙ্গে মিশে যায় তেমনি দেখতে না দেখতে নাই হয়ে গেল আতেনের বিশাল বাহিনী।
আমি দেখলাম, প্রবল বাতাসে প্রথমে বেঁকে গেল পপলার গাছগুলো, তারপর উপড়ে এলো মাটি থেকে এবং একটু পরে তীব্র বাতাসে উড়তে উড়তে অদৃশ্য হয়ে গেল সব। কালুনের উঁচু নগর প্রাচীর বালির বাঁধের মত ধসে পড়লো। ইট, পাথরের দালানকোঠাগুলোয় দেখা দিলো আগুনের লেলিহান শিখা। এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে আগুন। অল্প-সময়ের ভেতর পুরো নগরীটা জ্বলন্ত চুল্লি হয়ে উঠলো। বিশাল পাখির মতো ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে, অন্ধকার নেমে এলো। আমাদের পেরিয়ে এগিয়ে গেল সামনে। তারপরই দেখলাম কালো ডানাগুলো লাল গনগনে হয়ে উঠেছে। আগুনের বান ডাকিয়ে উড়ে গেল কালুনের ওপর দিয়ে।
তারপর সব শান্ত। চারদিকে কালো শান্ত অন্ধকার, নৈঃশব্দ, ধ্বংস আর মৃত্যু। ধীরে ধীরে মেঘ কেটে গেল। গোধূলির ম্লান আলোয় দেখলাম সামনে শূন্য পড়ে আছে কালুনে ঢোকার সেতু। আতেনের বিশাল বাহিনীর চিহ্নও নেই। কোথাও। অন্যদিকে নিহত তো দূরের কথা, আমাদের জংলী বাহিনীর একটা লোকও আহত হয়নি। তবে বিস্ময়ের পাথর হয়ে গেছে তারা। আতঙ্কে মুখ দিয়ে কথা সরছে না, কারও। আয়শা যখন এগোনোর নির্দেশ দিলো তখনও দাঁড়িয়ে রইলো সবাই। অরোসের কাছ থেকে দ্বিতীয় নির্দেশ পাওয়ার পর সংবিৎ ফিরলো ওদের। ক্লান্ত ভঙ্গিতে এগোতে লাগলো আমাদের পেছন পেছন।
সেতুর ওপর উঠলো আয়শা। ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে তাকালো তার সৈনিকদের দিকে। যেন বলতে চাইলো, স্বাগতম আমার সন্তানেরা। সে এক দেখার মতো দৃশ্য। ঘোড়ার পিঠে ঋজু হয়ে আছে সে। মাথায় তারার মুকুট। জংলীরা প্রথম এবং শেষ বারের মতো দেখলো তার চেহারা।
দেবী! কাঁপা কাঁপা গলায় চিৎকার করে উঠলো তারা।
ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে চলতে শুরু করলো আয়শা। জ্বলন্ত কালুনের রাজপথ ধরে এগিয়ে চললো রাজ প্রাসাদের দিকে।
পুরোপুরি রাত নেমে আসার আগেই আমরা পৌঁছে গেলাম প্রাসাদে। প্রহরীশূন্য অবস্থায় পড়ে আছে ফটক। শূন্য উঠান পেরিয়ে ঘোড়া থেকে নামলো আয়শা। প্রাসাদে ঢুকলো। পেছনে আমি আর অরোস। একের পর এক খোলা দরজা পেরিয়ে এগিয়ে চলেছি আমরা। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। সবগুলো। ঘর ফাঁকা। সবাই পালিয়েছে নয়তো মারা গেছে।
অবশেষে একটা সিঁড়ির কাছে এলাম। উঠতে শুরু করলো আয়শা। প্রাসাদের চূড়ায় যেখানে শামান সিমব্রির ঘর সেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে সিঁড়ি। দেখামাত্র চিনতে পারলাম ঘরটা। আতেন এখানেই হত্যা করার হুমকি দিয়েছিলো। আমাদের। দরজাটা বন্ধ। কি আশ্চর্য! আয়শা সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই আপনা থেকে খুলে গেল ওটা।
আয়শার পেছন পেছন আমরা ঢুকলাম। প্রদীপের মৃদু আলোয় আলোকিত ঘরটা। ঘরের মাঝখানে একটু চেয়ারে বসে আছে লিও। হাত পা বাঁধা চেয়ারের হাতল আর পায়ার সাথে। মুখটা ফ্যাকাসে। কম্পিত হাতে একটা ছোরা ধরে আছে বৃদ্ধ শামান ওর বুকের ওপর। বিধিয়ে দিতে উদ্যত। মাটিতে পড়ে আছে খানিয়া আতেন। চোখ দুটো হাঁ করে খোলা, তাকিয়ে আছে ছাদের দিকে। মারা গেছে কালুনের খানিয়া আতেন, কিন্তু এতটুকু মলিন হয়নি তার রাজকীয় চেহারা।
মুহূর্তের ভেতর এতগুলো ব্যাপার লক্ষ করলাম আমরা। আয়শা তার হাতটা সামান্য নাড়লো। সিমব্রির হাত থেকে খসে পড়ে গেল ছুরি। আর বৃদ্ধ শামান ঘুরে দাঁড়িয়েই ভূত দেখার মতো চমকে উঠে স্থির হয়ে গেল।
ঝুঁকে ছুরিটা তুললো আয়শা। দ্রুত হাতে বাঁধন কেটে দিলো লিওর হাত পায়ের। তারপর ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে পড়লো একটা চেয়ারে। লিও উঠে শূন্য দৃষ্টিতে একবার তাকালো চারপাশে। তারপর বললো-একেবারে ঠিক সময়ে এসেছো, আয়শা! আর এক সেকেণ্ড দেরি করলেই খুনী কুকুরটা। শামানের দিকে ইশারা করলো ও, যাক সময়মতো এসেছিলে। কিন্তু, কি করে এলে তোমরা ঐ প্রচণ্ড ঝড়ের ভেতর দিয়ে? ওহ, হোরেস, তুমি এখনও বেঁচে আছে!
আমরা ঝড়ের ভেতর দিয়ে আসিনি, জবাব দিলো আয়শা। এসেছি ঝড়ের ডানায় চেপে। এখন বলল, তোমাকে ধরে আনছি পর কি কি ঘটেছে?
হাত পা বেঁধে এখানে নিয়ে এলো। তারপর তোমার কাছে চিঠি লিখতে বললো। তাতে লিখতে হবে তুমি ফিরে যাও না হলে আমি মারা পড়বে। আমি রাজি হলাম না। তখন–মেঝেতে পড়ে থাকা মৃত আতেনের দিকে তাকালো ও।
তখন? আয়শার প্রশ্ন।
তখন শুরু হলো সেই ভয়ঙ্কর ঝড়। মনে হচ্ছিলো, আর কিছুক্ষণ চললে পাগল হয়ে যাবো। এই পাথরের প্রাসাদ পর্যন্ত থর থর করে কাঁপছিলো। বাতাসের শোঁ-শোঁ গর্জন যদি শুনতে! বিদ্যুতের চমক যদি দেখতে।
তোমাকে বাঁচানোর জন্যে আমিই পাঠিয়েছিলাম ওদের।
স্থির চোখে এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো লিও আয়শার দিকে। কিছু যেন বোঝার চেষ্টা করলো। তারপর বলে চললো-আতেনও তাই বলছিলো, আমি বিশ্বাস করিনি। আমার মনে হচ্ছিলো মহাপ্রলয় আসন্ন। ওই জানালার সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো আতেন। তারপর আবার এসে দাঁড়ালো আমার সামনে। একটা ছুরি তুলে নিলো আমাকে হত্যা করার জন্যে।
আমি জানি, যেখানেই যাই না কেন, তুমি আসবে পেছন পেছন। সুতরাং নির্ভয়ে বললাম, হ্যাঁ, বিধিয়ে দাও আমার বুকে। বলেই চোখ বুজে অপেক্ষা করতে লাগলাম আঘাতের। বেশ কিছুক্ষণ পেরিয়ে গেল, আঘাত এলো না। তার বদলে কপালে অনুভব করলাম ওর ঠোঁটের ছোঁয়া।
না, এ আমি করবো না, ওকে বলতে শুনলাম। বিদায় প্রিয়তম। তোমার নিয়তি তুমিই নির্ধারণ কোরো, আমারটা আমি করছি।
চোখ মেলে দেখলাম, একটা গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে আছে আতেন। ওই যে, ওর পাশে পড়ে আছে। গ্লাসের তরল পদার্থটুকু গলায় ঢেলে দিতেই ও লুটিয়ে পড়লো। তারপর ওই বুড়ো তুলে নিলো ছুরিটা। বিধিয়ে দিতে যাবে আমার বুকে এই সময় তোমরা ঢুকলে।
বলতে বলতে হাঁপিয়ে গেছে লিও। হঠাৎ টলে উঠলো ওর পা। পড়ে যেতে যেতেও সামলে নিলো কোনো রকমে। তাড়াতাড়ি বসে পড়লো চেয়ারটায়।
তুমি অসুস্থ! উদ্বিগ্ন গলায় বললো আয়শা। অরোস, সেই ওষুধটা! তাড়াতাড়ি!
কুর্নিশ করে আলখাল্লার পকেট থেকে একটা ছোট্ট শিশি বের করলো পূজারী। লিওর হাতে দিয়ে বললো, খেয়ে নিন, প্রভু। এক্ষুণি আপনার হারানো শক্তি ফিরে পাবেন।
সত্যিই তাই। ওষুধটা খাওয়ার কয়েক মিনিটের ভেতর সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে গেল লিও। মুখের ফ্যাকাসে ভাব কেটে গেল। চোখের উজ্জ্বলতা ফিরে এলো। দেহের শক্তিও সম্ভবত স্বাভাবিক হয়ে এলো, কারণ দেখলাম, একটু পরেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ও।
টেবিলের ওপর রান্না করা মাংস ছিলো। সেটা দেখিয়ে লিও প্রশ্ন করলো, এখন খেতে পারি, আয়শা? খিদেয় মরে যাওয়ার অবস্থা আমার।
নিশ্চয়ই, বললো আয়শা। খাও। হলি, তোমারও নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে? খেয়ে নাও।
আমি আর লিও ঝাঁপিয়ে পড়লাম খাবারটুকুর ওপর। হ্যাঁ, আক্ষরিক অর্থেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম, ঘরে একটা মৃতদেহ থাকা সত্ত্বেও। অবোস খেলো না। আয়শাও কোনো খাবার স্পর্শ করলো না। বৃদ্ধ যাদুকর সিমব্রি দাঁড়িয়েই রইলো পাথরের মূর্তির মতো, ক্ষমতাহীন।
.
২৩.
খাওয়া শেষ করে লিও বললো, তোমাদের সঙ্গে থাকতে পারলে বেশ হতো। অদ্ভুত ঘটনাগুলো স্বচক্ষে দেখতে পেতাম।
দেখার মতো কিছু ঘটেনি তো দেখবে কি? বললো আয়শা। নদী পেরোনোর সময় সামান্য যুদ্ধ করতে হয়েছিলো ব্যস, আর কিছু না। আগুন, পৃথিবী, বাতাস আমার হয়ে করে দিয়েছে বাকিটুকু। আমি ওদের ঘুম থেকে ডেকে তুলেছিলাম। আমার নির্দেশে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো তোমাকে বাঁচানোর জন্যে। একজনের জন্যে অনেক জীবন গেছে, শান্ত গম্ভীর গলায় বললো লিও।
আঁ…কয়েক হাজার হাজার না হয়ে যদি ওরা সংখ্যায় লক্ষ লক্ষ হতে তবু একজনকেও আমি রেহাই দিতাম না। এর সব দায় ওর, মৃত আতেনের দিকে ইশারা করলো আয়শা। আমি ভেবেছিলাম যতটুকু না করলেই নয় ততটুকু ক্ষতি করবো। কিন্তু ও যখন বাধ্য করলো…
তবু, প্রিয়তমা, তোমার হাত রক্তে রাঙানো ভাবতে কেমন জানি লাগছে আমার।
কেমন লাগার কিছু নেই, প্রিয়তম। এতদিন তোমার রক্তের দাগ লেগে ছিলো এ হাতে, আজ ওদের রক্তে তা ধুয়ে নিলাম। যাক, রাতের দুঃস্বপ্ন আমরা যেমন ভুলে যাই, দুঃখময় অতীতও তেমন ভুলে যাওয়াই ভালো। এখন বলো কি দিয়ে তোমাকে সম্মানিত করবো?।
আতেনের মুকুটটা পড়ে আছে মেঝেতে তার চুলের ওপর। সেটা তুলে নিলো আয়শা। লিওর সামনে এসে দুহাতে উঁচু করে ধরলো। আস্তে আস্তে হাত নামিয়ে এনে মুকুটটা লিওর কপালে ঠেকালো আয়শা। শান্ত উদাত্ত স্বরে বললো, জাগতিক, অতি তুচ্ছ এই প্রতীক-এর সাহায্যে আমি তোমাকে পৃথিবীর রাজ আসনে অভিষিক্ত করছি, প্রিয়তমা। এ বিশ্বে যা কিছু আছে, সব এখন থেকে তোমার শাসনাধীন। এমন কি আমিও!
আবার ও মুকুটটা উঁচু করে ধরলো। ধীরে ধীরে নামিয়ে এনে ঠেকালো লিওর কপালে। তারপর আবার সেই সঙ্গীতের মতো সুরেলা কণ্ঠস্বর: আমি শপথ করে বলছি, প্রিয়তম, অশেষ দিনের প্রসাদ তুমি পাবে। যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন তুমি থাকবে, এবং প্রভু হিসেবেই থাকবে।
আবার উঁচু হলো মুকুট। নেমে এসে স্পর্শ করলো লিওর কপাল।
এই স্বর্ণ-প্রতীকের মাধ্যমে আমি তোমাকে দিচ্ছি জ্ঞান, প্রকৃত জ্ঞান, যে। জ্ঞান তোমার সামনে খুলে দেবে প্রকৃতির সব গোপন দুয়ার। বিজয়ীর মতো সে পথে হেঁটে যাবে তুমি আমার পাশে পাশে। তারপর এক সময় শেষ দরজাটা অতিক্রম করবো আমরা। জীবন মৃত্যুর ভেদ আর তখন থাকবে না আমাদের কাছে।
তাচ্ছিল্যের সাথে মুকুটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো আয়শা। এবং কি আশ্চর্য, মৃত আতেনের বুকের ওপর গিয়ে সেটা পড়লো। সোজা হয়ে রইলো সেখানেই।
আমার এসব উপহারে তুমি খুশি হওনি, প্রভু? জিজ্ঞেস করলো আয়শা।
বিমর্ষ ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো লিও।
আর কি তাহলে তুমি চাও? বলো, আমি দেবো তোমাকে।
সত্যিই দেবে?
হ্যাঁ। শপথ করে বলছি। এই যে এখানে যারা আছে সবাই সাক্ষী। তুমি শুধু চাও।
আমি লক্ষ করলাম, সূক্ষ্ম একটা হাসি যেন ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা শামানের ঠোঁটে।
আমি এমন কিছু চাইবো, না যা দেয়া তোমার অসাধ্য, বললো লিও। আয়শা, আমি তোমাকে চাই। এখন চাই। হ্যাঁ, এখনই, আজ রাতেই। কবে কোন রহস্যময় আগুনে স্নান করবে, ততদিন অপেক্ষা করতে পারবো না!
শোনামাত্র কুঁকড়ে গেল যেন আয়শা। একটু পিছিয়ে এলো লিওর কাছ থেকে। দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরলো নিচের ঠোঁট। তারপর ধীরে ধীরে বললো, সেই বোকা দার্শনিকের মতো অবস্থা হয়েছে আমার, হাঁটতে হাটতে নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে দেশ বিদেশের ভাগ্য গণনা করছিলো, নিজের ভাগ্যের কথা আর খেয়াল ছিলো না। শেষ পর্যন্ত দুষ্ট ছেলেদের খুঁড়ে রাখা গর্তে পড়ে হাত-পা ভেঙে মরলো। আমি ভাবতে পারিনি পৃথিবীর সব ঐশ্চর্য, সব সম্মান, ক্ষমতা পায়ে ঠেলে তুমি নিছক এক নারীর প্রেম চাইতে পা্রো।
ওহ! লিও, আমি ভেবেছিলাম আরও ভালো, আরও মহান কিছু চাইবে। ভেবেছিলাম, হয়তো বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের ওপর ক্ষমতা চাইবে, নয়তো আমার সম্পর্কে যে সব কথা এখনও জানতে পারোনি সেগুলো জানতে চাইবে। কিন্তু এ তুমি কি চাইলে?
হ্যাঁ, আয়শা, নিছক এক নারীর প্রেমই আমি চাই। আমি ঈশ্বর নই, শয়তানও নই। আমি নিছক এক মানুষ-পুরুষ। যে নারীকে ভালোবাসি তাকেই আমি চাই। ক্ষমতার সব পোশাক খুলে ফেলে দাও, আয়শা। উচ্চকাঙক্ষা, মহত্ত্ব ভুলে নারী হয়ে–আমার স্ত্রী হয়ে এসো।
কোনো জবাব দিলো না আয়শা। লিওর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো একটু।
এই তোমার শপথ, আয়শা? পাঁচ মিনিটও হয়নি, এখনি ভঙ্গ করতে চাইছো?
আগের মতোই চুপ করে রইলো আয়শা।
সত্যিই বলছি, আয়শা, বলে চললো লিও, আমি আর সইতে পারছি না, অপেক্ষার জ্বালা। কোনো কথাই আর আমি শুনতে চাই না। আমি আর অপেক্ষা করতে পারবো না। যা ঘটে ঘটুক, যা আসে আসুক, আমি হাসি মুখে বরণ করবো। অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে হলেও তো আমরা সুখ পাবো। বলতে বলতে লিও গিয়ে জড়িয়ে ধরলো আয়শাকে, চুমু খেতে চেষ্টা করলো। কিন্তু শরীর মুচড়ে বেরিয়ে এলো আয়শা ওর আলিঙ্গন থেকে।
হ্যাঁ, লিও, সুখ পাবো, কিন্তু কতক্ষণ?
কতক্ষণ? এক জীবন, এক বছর, বা এক মাস, এক দিন হতে পারে-কি এসে গেল তাতে? তুমি যতক্ষণ আমার বিশ্বস্ত আছো ততক্ষণ কোনো কিছুই আমি ভয় করি না।
সত্যি বলছো? ঝুঁকি নেবে তুমি? তুমি যা বলছে তা যদি করি, কি ঘটবে আমি জানি না। সত্যিই বলছি আমি জানি না। তুমি মারাও যেতে পারো।
কি হবে তাতে? আমরা আলাদা হয়ে যাবো?
না, না, লিও, তা কখনও সম্ভব নয়। আমরা কখনও আলাদা হবে না, হতে পারি না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আমাকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। এ জীবনে না হোক অন্য জীবনে, অন্য বলয়ে গিয়ে হলেও আমরা মিলিত হবো।
তাহলে কেন আমি এ যাতনা সইবো আয়শা? আমি আর কিছুই চাই না, তুমি তোমার শপথ রক্ষা করো।
অদ্ভুত এক পরিবর্তন লক্ষ করলাম এ সময় আয়শার ভেতর। সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে দিলো সে।
দেখ! বর্শার শত আঘাতে ছিন্ন, ধুলো বালি লাগা ময়লা আলখাল্লাটা দেখিয়ে আয়শা বললো, দেখ, প্রিয়তম, কি পোশাকে আমি এসেছি তোমাকে বিয়ে করতে। এ কি মানায়? তোমা্র আমার বিয়ে এই পোশাকে, এই অবস্থায়?
আমি আমার পছন্দের নারীকে চাই তার পোশাক নয়, আয়শার চোখে চোখ রেখে বললো লিও।
বেশ, তাহলে বলো কিভাবে বিয়ে হবে?…হ্যাঁ, পেয়েছি। হলি ছাড়া আর কে আমাদের দুজনার হাত এক করে দেবে? আজীবন আমাকে পথ দেখিয়েছে এখন তোমার হাতে সমর্পণ করবে আমাকে, আমার হাতে তোমাকে।
এসো, হলি, তোমার কাজটুকু শেষ করো, এই কুমারীকে এই পুরুষের হাতে তুলে দাও।
স্বপ্নচ্ছন্নের মতো আমি ওর নির্দেশ পালন করলাম। আয়শার বাড়িয়ে দেয়া হাত তুলে নিলাম, লিওরটাও। ধীরে ধীরে দুটো হাত এক করে দিলাম! সত্যি কথা বলতে কি, সেই মাহেন্দ্র মুহূর্তে মনে হলো, আমার শিরা উপশিরা দিয়ে যেন আগুনের এক স্রাত হয়ে গেল। অদ্ভুত এক দৃশ্য ভেসে উঠলো চোখের সামনে, কে জানে কোথা থেকে যেন ভেসে এলো অদ্ভুত এক সঙ্গীতের সুর, মস্তিষ্কে ওজনশূন্য অপার্থিব এক অনুভূতি।
আমি ওদের হাত দুটো এক করে দিলাম, জানি না কি রে। ওদের আশীর্বাদ করলাম, কি বলে তা-ও জানি না। টলতে টলতে পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে। তারপর ঘটলো সেই ঘটনা!
স্বামী! গভীর আবেগে ঘাঢ় স্বরে আয়শা বললো। দুবাহু বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো প্রেমিকের গলা। একহাতে কাছে টেনে নিলো তার মাথা। লিওর সোনালী চুল মিশে গেল আয়শার কালো কেশগুছের সাথে। ধীরে ধীরে এক হয়ে গেল দুজোড়া ঠোঁট।
কয়েক সেকেণ্ড অমন অবস্থায় রইলো ওরা। আয়শার কপাল থেকে সেই অদ্ভুত নীলচে আলো বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়লো লিওর কপালে। আগুনের আভার মতো জ্বল জ্বল করে উঠলো ওর নিটোল গোলাপি শরীর। সাদা আলখাল্লা ভেদ করে দৃশ্যমান হয়ে উঠলো।
আবেশ জড়ানো গলায় আয়শা বললো, এমনি করে, লিও ভিসি, ওহ! এমনি করে আমি দ্বিতীয়বারের মতো তোমার কাছে সমর্পণ করলাম আমাকে। সেদিন কোর-এর গুহায় যে প্রতিজ্ঞা তোমার কাছে করেছিলাম আজ এই কালুনের প্রাসাদেও তাই করছি। জেনে রাখো, ফলাফল যা-ই হোক-শুভ বা অশুভ, আমরা কখনও আলাদা হবে না। কিছুতেই ছিন্ন হতো আমাদের বন্ধন। তুমি বেঁচে থাকলে আমি বেঁচে থাকবো তোমার পাশে, তুমি মৃত্যু নদীর ওপারে গেলে আমিও যাবো। যেতেই হবে। যেখানে তুমি যাবে সেখানেই আমি যাবো, যখন তুমি ঘুমাবে আমিও ঘুমাবো তোমার সঙ্গে; জীবন মৃত্যুর স্বপ্নের ভেতর আমার কণ্ঠস্বরই তুমি শুনবে।
থামলো আয়শা। মুখ তুলে তাকালো ওপর দিকে। চোখে মুগ্ধ দৃষ্টি।
আয়শার মুখ থেকে লিওর মুখের ওপর স্থির হলো আমার চোখ। বৃদ্ধ শামান যেমন দাঁড়িয়ে আছে তেমনি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে লিও। প্রাণে কোনো লক্ষণ নেই তার শরীরে। মুখটা ফ্যাকাসে মৃতের মতো। কিন্তু সে মুখেও লেগে। আছে শান্ত মৃদু একটুখানি হাসি।
নূপুরের মৃদু নিক্কনের মতো বেজে উঠলো আয়শার গলা। কি মিষ্টি! শ্বাস আটকে গেল আমার গলার কাছে। আয়শা গান গাইছে।
পৃধিবী
ছিলো না, ছিলো না,
শুধু
ছিলো নৈঃশব্দের গর্ভে ঘুমিয়ে
মানুষের প্রাণ।
তবু আমি ছিলাম আর তুমি—
যেমন শুরু করেছিলো তেমন হঠাৎ থেমে গেল আয়শা। তারপর আমি দেখলামনা অনুভব করলাম, ওর মুখের আতঙ্ক। সঙ্গে সঙ্গে লিওর দিকে তাকালাম।
টলছে লিও। ও যেন মাটিতে নয় উর্মিমুখর নদীতে নৌকায় দাঁড়িয়ে আছে। দুলতে দুলতে অন্ধের মতো দুহাত বাড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলো আয়শাকে। তারপর আচমকা চিৎ হয়ে পড়ে গেল আতেনের বুকের ওপর। তখনও ওর মুখে লেগে আছে সেই শান্ত হাসি।
ওহ! কি তী, তীব্র এক চিৎকার বেরোলো আয়শার গলা চিরে, আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। আমার মনে হলো যুদ্ধে নিহত সব মৃত সৈনিক বুঝি জেগে উঠবে সে শব্দে। একটা মাত্র চিৎকার—তারপর আবার সব চুপ।
.
ছুটে গেলাম আমি লিওর কাছে। আয়শার প্রেমের আগুন ওকে হত্যা করেছে। আমার লিও মৃত পড়ে আছে মৃত আতেনের বুকের ওপর।
.
২৪.
একটু পরে কথা বললো আয়শা। চরম হতাশা ওর গলায়। মনে হচ্ছে আমার প্রভু ক্ষণিকের জন্যে আমায় ছেড়ে গেছে। আমাকেও যেতে হবে প্রভুর পেছন পেছন।
এর পর কি কি ঘটেছে আমি সঠিক বলতে পারবো না। পৃথিবীতে আমার একমাত্র বন্ধু, সন্তান, আপনজনকে হারিয়েছি। আমার আর বেঁচে থাকার কি অর্থ? কে কি করলো না করলো তা জেনেই বা আমার কি দরকার? অস্পষ্টভাবে যা মনে আছে তাহলো, আয়শা আর অরোস মিলে ওর প্রাণ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। মহামহিমাময়ী, শক্তিমতি আয়শার ক্ষমতা এখানে ব্যর্থ।
অবশেষে যখন একটু স্বাভাবিক অবস্থায় এলাম, শুনলাম আয়শা বলছে, অভিশপ্ত মেয়ে মানুষটার লাশ নিয়ে যাও এখান থেকে? কয়েকজন পূজারী ওর নির্দেশ পালন করলো।
একটা দীর্ঘ আসনের ওপর শুইয়ে রাখা হয়েছে লিওকে। অদ্ভুত শান্ত, পরিতৃপ্ত চেহারা। আয়শা বসে আছে ওর পাশে। একটু যেন দুশ্চিন্তার ছাপ চেহারায়। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো ও।
আমি একজনকে এক জায়গায় পাঠাতে চাই। সাধারণ কাজ নয়, আঁধার রাজ্যের খোঁজ খবর নিতে হবে। অরোসের দিকে তাকালো আয়শা।
এই প্রথমবারের মত আমি পূজারী-প্রধানের মুখ থেকে মৃদু হাসিটা মুছে যেতে দেখলাম। ফ্যাকাসে হয়ে গেল তার চেহারা, কেঁপে উঠলো শরীর।
তুমি ভয় পেয়েছে, বলে চললো আয়শা। না, অবোস, যে যেতে ভয় পাবে তাকে পাঠাবো না। তুমি যাবে, হলি, আমার—এবং ওর পক্ষ থেকে?
হ্যাঁ, আমি জবাব দিলাম। এ ছাড়া আর কি চাইবার আছে আমার? খালি দেখো, ব্যাপারটা যেন তাড়াতাড়ি ঘটে আর বেশি কষ্ট না পাই।…
এক মুহূর্ত ভাবলো আয়শা। না। এখনও তোমার সময় হয়নি। কিছু কাজ এখনও বাকি রয়ে গেছে, সেগুলো করতে হবে তোমাকে।
এরপর ও বৃদ্ধ শামানের দিকে তাকালো। এখনও লোকটা অনড় দাঁড়িয়ে আছে মূর্তির মতো।
এই শোনো! ডাকলো আয়শা।
মুহূর্তে সিমব্রির দেহে প্রাণ এলো যেন। শুনছি, দেবী। বলতে বলতে নেহায়েত নিরুপায় হয়ে করছে এমন ভঙ্গিতে কুর্নিশ করলো বুড়ো।
দেখেছো, সিমব্রি? হাত নেড়ে জিজ্ঞেস করলো আয়শা।
দেখেছি। আতেন আর আমি যা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম ঠিক তা-ই ঘটেছে। কালুনের এক ভাবী খানকে শুয়ে থাকতে দেখছি, বলেছিলাম কি না? খুশিতে চক চক করে উঠলো বুড়োর চোখ।
বুড়োর খুশিটুকু গ্রাহ্য করলো না আয়শা। তোমার ভাইঝির এই করুণ মৃত্যুর জন্যে আন্তরিকভাবে দুঃখিত, সিমব্রি। আর আনন্দিত এই ভেবে, তোমার মতো অন্ধ বাদুড়েরও দেখার ক্ষমতা আছে। যাক, সিমব্রি, আমি তোমাকে আরও উঁচু সম্মানে সম্মানিত করবো। তুমি আমার দূত হয়ে যাবে। মৃত্যুর অন্ধকার পথ ধরে চলে যাবে, আমার প্রভুকে খুঁজে বের করবে—জানি না কোথায় কি ভাবে আজ রাত কাটাবে আমার প্রিয়তম। ওকে বলবে, আয়শা শিগগিরই আসছে ওর সাথে মিলিত হওয়ার জন্যে। বলবে, এটাই আমাদের নিয়তি। আলোকিত পৃথিবীতে আমাদের মিলন নির্ধারিত ছিলো না, তাই আঁধারের রাজ্যে আমরা এক হবো। এ ই ভালো, মরণশীলতার রাত পেরিয়ে এখন অমরত্বের অনন্ত দিন ওর সামনে। এই ভালো। মৃত্যুর সিংহ দরজায় আমার জন্যে অপেক্ষা করতে বলবে ওকে। বুঝেছো?
বুঝেছি, ও মহামহিমাময়ী রানী, আন্তরিক গলায় জবাব দিলো সিমব্রি।
ও, আর একটা কথা। আতেনকে বলবে, আমি ওকে ক্ষমা করেছি। ওর বিরুদ্ধে যা-ই করে থাকি না কেন, ওর মহত্ত্ব আমি অস্বীকার করবো কি করে?
বলবো, দেবী।
তাহলে যাও তুমি!
আয়শার মুখ থেকে কথাটা বেরোনো মাত্র মেঝে থেকে শূন্যে উঠে গেল সিমব্রি। বাতাসে কিছু একটা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করলো দুহাত বাড়িয়ে। খাওয়ার টেবিলটার সাথে ধাক্কা খেলো একটা। তারপর হুড়মুড় করে পড়ে গেল মাটিতে। নিষ্পন্দ পড়ে রইলো ওর শরীর। আমার দিকে ফিরলো আয়শা।
তুমি ক্লান্ত, হলি। যাও বিশ্রাম নাও গে। কাল রাতে আমরা পাহাড়ের পথে রওনা হবো।
.
নিঃশব্দে পাশের কামরায় ঢুকে পড়লাম আমি। সিমব্রির শোয়ার ঘর এটা। খাটে পরিপাটি বিছানা পাতা। যেমন নিঃশব্দে ঢুকেছিলাম তেমনি নিঃশব্দে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুম এলো না। কালুন নগরী এখনও জ্বলছে। আগুনের আভা জানালা গলে এসে পড়েছে পাশের কামরায়। সেই অস্পষ্ট আলোয় দেখলাম, আয়শা বসে বসে দেখছে মৃত দয়িতের মুখ। নিপ নিষ্পন্দ। হাতের ওপর ভর দিয়ে আছে মাথা। কাঁদছে না ও। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলছে না। কেবল দেখছে, ঘুমন্ত শিশুর দিকে মা যেমন চেয়ে থাকে তেমন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে গেল ওর দেখা শেষ হলো না।
ওর মুখে এখন কোনো আবরণ নেই। পরিষ্কার দেখতে পেলাম, সব অহঙ্কার, ক্রোধ দূর হয়ে গেছে সে মুখ থেকে। অদ্ভুত কোমল, মায়াময় হয়ে উঠেছে। মনে হলো, কোথায় যেন দেখেছি এ মুখ। কিন্তু স্মরণংকরতে পারলাম না। অনেকক্ষণ ভাবলাম, অবশেষে মনে পড়লো। মন্দিরের উপবৃত্তাকার কক্ষে মায়ের যে প্রতিমা দেখেছিলাম হুবহু সেই মুখ। হ্যাঁ, একেবারে সেই অভিব্যক্তি, প্রেম আর শক্তি মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। এ
অবশেষে আয়শা উঠে আমার কামরায় এলো।
আমি শেষ হয়ে গেছি ভেবে আমার জন্যে দুঃখ হচ্ছে তোমার, তাই না, হলি? মৃদু কণ্ঠে ও বললো।
হ্যাঁ, আয়শা, দুঃখ হচ্ছে; তোমার জন্যে, আমার জন্যে।
দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই, হলি। আমার মানবীয় অংশ ওকে পৃথিবীতে ধরে রাখতে পারেনি বটে, কিন্তু আত্মা? আমার আত্মা ঠিকই মিলবে ওর আত্মার সাথে। সময় হলে তুমিও চলে আসবে। মৃত্যুই তো প্রেমের শক্তি; মৃত্যুই তো প্রেমের গন্ত ব্য। সেজন্যেই তো আমি জল মুছে ফেলেছি চোখ থেকে। দুঃখ কিসের? আমি যাবো, শিগগিরই যাবো ওর কাছে।
কিন্তু একি করছি আমি, ছি! ভুলে বসে আছি তোমার বিশ্রাম দরকার। হয়েছে, আর কথা নয়, এবার তুমি ঘুমাও, বন্ধু, আমি আদেশ করছি তোমাকে, ঘুমাও।
আমি ঘুমিয়ে গেলাম।
.
ঘুম যখন ভাঙলো তখন যাত্রার সময় হয়ে গেছে। আমার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আয়শা।
সব তৈরি, বললো ও। ওঠো, চলো।
রওনা হলাম আমরা। এক সহস্র অশ্বারোহী চলেছে আমাদের সাথে। বাকিরা থেকে যাচ্ছে কালুনে, দখল বজায় রাখার জন্যে। একেবারে সামনে লিওর মৃতদেহ, শুভ্রবসন পূজারীরা বয়ে নিয়ে চলেছে। তার পেছনে অবগুণ্ঠিত আয়শা, ওর সেই অপূর্ব মাদী ঘোড়ার পিঠে, পাশে আমি।
কি অদ্ভুত বৈপরীত্ব আমাদের আসা আর যাওয়ার ভেতর।
কি উল্লাসে বজ্র, বিদ্যুৎ আর ঝঞ্জাকে সাথী করে এসেছিলাম, আর যাচ্ছি কেমন ধীরে, নিঃশব্দে; আমার, আয়শার প্রাণের শব বহন করে।
সারা রাত চললাম আমরা। তারপর সারাদিন। আবার রাত হলো। অবশেষে পৌঁছুলাম অগ্নিগর্ভা পবিত্র পাহাড়ে। মন্দিরের উপবৃত্তাকার কক্ষে মায়ের প্রতিমার সামনে নামিয়ে রাখা হলো লিওর শববাহী খাট।
সিংহাসনে বসলো হেসা। পূজারী, পূজারিনীদের উদ্দেশে বললো-আমি খুব ক্লান্ত। একটু বিশ্রাম দরকার। সেজন্যে শিগগির হয়তো কিছু দিনের জন্যে তোমাদের ছেড়ে যাবো। এক বছর বা হাজার বছর–ঠিক বলতে পারি না। যদি তেমন কিছু ঘটে পাপাভকে তোমরা বরণ করে নেবে আমার জায়গায়। আমি যতদিন না ফিরি অরোসকে স্বামী এবং পরামর্শদাতা হিসেবে গ্রহণ করে ও আমার কাজ চালাবে।
হেস-এর দেবালয়ের পূজারী ও পূজারিনীগণ! নতুন একটা রাজ্য আমি তোমাদের দিয়ে যাচ্ছি। নম্র, ভদ্রভাবে ওদের শাসন করবে। এখন থেকে অগ্নি পর্বতের হেসা কালুনের খানিয়া হিসেবেও গণ্য হবে।
পূজারী ও পূজারিনীরা! আমাদের এই পবিত্র পর্বত এবং মন্দিরের পবিত্রতা তোমরা রক্ষা করবে। একটা কথা মনে রাখবে, দেবী হেসা যদি আজকের পৃথিবীকে শাসন না-ও করেন, প্রকৃতি করছেন। দেবী আইসিসের নাম যদি আজ স্বর্গের দেব সভায় ধ্বনিত না-ও হয় স্বর্গ এখনও তার মানব সন্তানদের বুকে করে পরিচর্যা করছেন।
হাত নেড়ে সবাইকে চলে যাওয়ার ইশারা করলো ও। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে যোগ করলো, আর একটা কথা এই লোকটা আমার প্রিয় বন্ধু এবং অতিথি। একেও তোমাদের একজন করে নেবে। আমি আশা করি, ওর বিশেষ যত্ন নেবে তোমরা। তারপর যখন গ্রীষ্মের সূচনায় বরফ গলতে শুরু করবে, ওকে তোমরা নিরাপদে দূরের ঐ পাহাড়শ্রেণী পার করে দিয়ে আসবে। এবার যাও তোমরা। ভোরের দিকে এগিয়ে চলেছে রাত। স্তম্ভের চূড়ায় উঠে এলাম আমরা, মাত্র চারজন—আয়শা, আমি, অরোস আর পাপাভ। বাহকরা লিওর মৃতদেহ পাশের পাথরখণ্ডটার ওপর রেখে চলে গেছে। আগুনের পর্দা জ্বলে উঠলো আমাদের সামনে। লিওর পাশে হাঁটু গেড়ে বসলো আয়শা। শান্ত হাসি মাখা মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ তারপর উঠে দাঁড়ালো।
অন্ধকার এগিয়ে আসছে, হলি, ভোরের উজ্জ্বলতা ঢেকে দেয়ার মতো গাঢ় অন্ধকার। এবার আমি যাবো। যখন তোমার মৃত্যু সময় উপস্থিত হবে—তার আগে নয় কিন্তু আমাকে ডেকো, আমি আসবো তোমার কাছে।
ভেবো না আয়শা হেরে গেছে, ভেবো না আয়শা নিঃশেষ হয়ে গেছে; আয়শা নামক বইয়ের একটা মাত্র পৃষ্ঠা তুমি পড়েছে।
একটু ভাবলো সে। তারপর আবার বললো, বন্ধু, এই সিট্রামটা নাও। এটা দেখে আমাকে স্মরণ কোরো। কিন্তু সাবধান, একেবারে শেষ মুহূর্তে, আমাকে ডাকার জন্যে ছাড়া কখনও এটা ব্যবহার করবে না। হাত বাড়িয়ে আমি নিলাম রত্নখচিত দণ্ডটা। সোনার ঘণ্টার মৃদু টুং-টাং শব্দ হলো। ওর কপালে চুমু দাও, আবার বললো ও। তারপর পিছিয়ে গিয়ে চুপ করে দাঁড়াবে, সব শেষ না হওয়া পর্যন্ত নড়বে না।
আজও অন্ধকার ধীরে ধীরে গাঢ় হয়ে আসছে। আগুনের পর্দা ক্রমে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। এক সময় নিকষ কালো হয়ে গেল চারদিক। অদ্ভুত গম্ভীর এক সঙ্গীত উঠে আসতে লাগলো নিচে থেকে লুরের পাখায় ভর করে যেন উঠে এলো দুই ডানাওয়ালা আগুনটা। জড়িয়ে ধরলো আয়শাকে।
হঠাৎ নাই হয়ে গেল আগুন। ভোরের প্রথম রশ্মি ছুটে এলো পাথরখণ্ডটার ওপর।
শূন্য পড়ে আছে ওটা। লিওর মৃতদেহ নেই, আয়শাও নেই।
.
অবোস এবং আর সব পূজারীরা খুব ভালো ব্যবহার করলো আমার সঙ্গে। আয়শা যেমন বলে গিয়েছিলো তার একটুও অন্যথা হলো না।
গ্রীষ্মের আগ পর্যন্ত মন্দিরেই কাটালাম। তারপর বরফ গলতে শুরু করলো। এবারও আয়শার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলো ওরা। আমার প্রয়োজন না থাকলেও প্রায় জোর করে আমার হাতে ধরিয়ে দিলো মূল্যবান রত্নভর্তি একটা থলে। কালুনের সমভূমি পেরিয়ে নগরে পৌঁছুলাম। রাত কাটালাম প্রাসাদের বাইরে তাবু খাঁটিয়ে। আতেনের প্রাসাদে ঢোকার প্রবৃত্তি হলো না। জায়গাটা কেমন যেন ভূকুটি করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
পরদিন নৌকায় করে রওনা হলাম আমরা। অবশেষে তোরণ গৃহে পৌঁছুলাম। আরেকটা রাত কাটাতে হলে এখানে, যদিও ঘুমাতে পারলাম না।
পরদিন সক্কালে সেই খরস্রোতা পাহাড়ী নদীর তীরে পৌঁছুলাম। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, পুল জাতীয় একটা কিছু তৈরি করা হয়েছে ওটার ওপর। ওপাশে পাহাড়ের গায়ে মই উঠে গেছে গিরিখাতের উপর পর্যন্ত। এসব করা হয়েছে কেবল আমার জন্যে।
মইয়ের গোড়ায় দাঁড়িয়ে অরোসের দিকে তাকালাম। যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিলো সেদিন যেমন মৃদু একটু হেসেছিলো তেমনি হাসলো আজও বিদায় নেয়ার আগ মুহূর্তে।
অনেক অদ্ভুত জিনিস দেখলাম, কি বলবো বুঝতে না পেরে বললাম।
খুবই অদ্ভুত, জবাব দিলো অরোস।
অন্তত, বন্ধু অবোস, ব্ৰিত ভাবে আমি বললাম, আমার কাছে লেগেছে। তোমার হয়তো লাগেনি, তোমার রাজকীয় গুণের কারণে।
আমার রাজকীয় অভিব্যক্তি ধার করা। একদিন খসে যাবে এ মুখোশ।
তুমি বলতে চাও মহান হেসা মারা যাননি?
আমি বলতে চাই, হেসা কখনও মরেন। হয়তো রূপ বদলান, ব্যস। উনি চলে গেছেন, কালই হয়তো ফিরে আসবেন। আমি তাঁর আসার অপেক্ষায় আছি।
আমিও ওর ফিরে আসার আশায় থাকবো, বলে উঠতে শুরু করলাম মই বেয়ে।
.
বিশজন সশস্ত্র পূজারী আমাকে পাহারা দিয়ে, পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো। কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই পাহাড় পেরোলাম। মরুভূমির ভেতর দিয়ে এগিয়ে চললাম। অবশেষে সেই মঠের দেখা পেলাম, যেখানে বিশাল বুদ্ধ বসে আছেন মরুভূমির দিকে তাকিয়ে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। তাঁবু ফেললাম আমরা।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম, পূজারীরা চলে গেছে। আমার ছোট্ট পুটুলিটা নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম একা। সারাদিন পর পৌঁছুলাম মঠে। দরজার সামনে ছিন্ন বসন পরে বসে আছে প্রাগৈতিহাসিক এক মূর্তি। আমাদের পুরনো বন্ধু কোউ-এন। শিং-এর চশমাটা নাকের ওপর ঠিক করতে করতে আমার দিকে তাকালো বৃদ্ধ।
তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম, বিশ্বমঠের ভাই। খুব খিদে পেয়েছে যে আবার এই বাজে জায়গায় ফিরে এসেছো?
খুউব, কোউ-এন-বিশ্রামের খিদে।
এ জন্মের বাকি দিনগুলোতে পাবে। কিন্তু আমার আরেক ভাই কোথায়?
মরে গেছে। ।
এবং কোথাও আবার জন্ম নিয়েছে। পরে ওর সঙ্গে দেখা হবে আমাদের। চলো খেয়ে নেয়া যাক, তারপর শুনবো তোমার গল্প।
এক সাথে খেলাম আমরা। মঠ থেকে রওনা হওয়ার পর যা ঘটেছে সব বললাম কোউ-এনকে। মনোযোগ দিয়ে লো বৃদ্ধ, কিন্তু বিন্দুমাত্র অবাক হলো না। আমি শেষ করতেই সে শুরু করলো পুনর্জন্মের মতবাদ দিয়ে একে ব্যাখ্যা করতে। শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম আমি। শেষে ঝিমুতে শুরু করলাম।
আর কিছু না হোক, হাই তুলতে তুলতে আমি বললাম, অন্তত কিছু জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা যা-ই বলেন, সঞ্চয় তো হলো।
হ্যাঁ, বিশ্ব মঠের ভাই, নিঃসন্দেহে জ্ঞান হয়েছে। তবে একটু ধীরে, এই আর কি। আমি যদি বলি, তোমার এই দেবী, রমণী, সে, হেস, আয়শা, খসে পড়া নক্ষত্র যে নামেই ডাকো–
(এখানেই শেষ মিস্টার হলির পাণ্ডুলিপি। কাম্বারল্যাণ্ডের বাড়িতে আগুনে ফেলে দেয়ায় পরের পৃষ্ঠাগুলো খুঁড়ে গিয়েছিলো।)
***