২১. হিন্দুস্তান আমাদের দেশ!
‘উমর আলি আমার যুদ্ধের হাতি আনতে বল। আমি যুদ্ধ সীমান্ত অগ্রে গিয়ে আক্রমণ পরিচালনা করবো। আমাকে দেখে সৈন্যদের মনোবল বেড়ে যাবে। যগিনগড়ের মতো এই দুর্গটির এত বড় একটি সেনাবাহিনীকে এতদিন থামিয়ে রাখার কথা নয়। আমি বোরহানপুর থেকে আসার আগেই আমার সেনাপতিদের এটা দখল করা উচিত ছিল।’
উমর আলি উত্তর দিল, জাঁহাপনা, আপনার প্রয়োজন পড়লে আমি অবশ্যই আপনার যুদ্ধহস্তী নিয়ে আসার নির্দেশ দেব। তবে আপনি যদি অনুমতি দেন। তো বলি, জাঁহাপনা, এখানে আসার মাত্র কিছুদিন হয়েছে, আপনি কী যথেষ্ট শক্তিশালী বোধ করছেন? আর জাঁহাপনা, যদি আপনি সম্মুখ সারি থেকে যুদ্ধ শুরু করার ইঙ্গিত দিতে চান, তা কী হাতির পিঠে বসে করতে হবে? হাওদায় বসলে আপনি মারাঠি গোলন্দাজ সেনা আর বরকন্দাজদের সহজ লক্ষ্যবস্তু হবেন। পালকিতে বসাই বরং অনেক আরামদায়ক আর কম বিপজ্জনক হবে।’
‘তুমি আমার জন্য উদ্বিগ্ন হয়েছ, তা আমি বুঝতে পেরেছি। তবে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি, আমি এখনও এই কাজ করতে যথেষ্ট শক্তি রাখি। আমি যুদ্ধহস্তী ব্যবহার করবো। যদিও এতে আমি স্বভাবতই একটি লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হব, তবে সেই সাথে আমার সৈন্যরা আমাকে দেখতে পাবে আর সেটাই আমার উদ্দেশ্য।
আধাঘণ্টা পর সবুজ রঙের মোগল যুদ্ধবেশ পরে আওরঙ্গজেব তার সোনা বাঁধান হাতের লাঠিটা তাঁর পাশে দাঁড়ান তরুণ কোরচির হাতে দিয়ে তার সাহায্য নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে মঞ্চে উঠতে শুরু করলেন। এই মঞ্চ থেকে তিনি তাঁর যুদ্ধের হাতির পিঠে চড়বেন। বিশাল প্রাণীটির নাম বজ্রদেব। এই পুরুষ হাতিটি তার অত্যন্ত প্রিয়। হাতিটি শান্তভাবে মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়েছিল। দুই মাহুত হাতিটির কানের পেছনে বসেছিল। হাতির দাঁতের হাতলের একটি ছয়ফুট লম্বা গাদা বন্দুক হাতে নিয়ে উমর আলি সবুজ মখমলের গদিওয়ালা রাজকীয় আসনের পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার দাড়ি এখন সাদা হয়ে এসেছে। অনেক সৈন্য যেন তাঁকে দেখতে পারে এজন্য আওরঙ্গজেব হাওদার ছাদ সরিয়ে দিতে বলেছেন। হাতির ঠিক পেছন পেছন যে দেহরক্ষী ঘোড়ায় চড়ে আসবে সে একটি বড় ছাতা বহন করবে। ফেরার সময় প্রয়োজন বোধে রোদের তাপ থেকে সম্রাটকে রক্ষা করার জন্য সে ছাতাটি উমর আলির হাতে দেবে।
আওরঙ্গজেব ধীরে ধীরে মঞ্চের উপর চড়লেন, তারপর উমর আলির সাহায্য নিয়ে হাতির পিঠে চড়ে হাওদায় বসলেন। মাহুতের নির্দেশে বজ্রদেব ধীরে সুস্থে গজেন্দ্রগমনে চলতে শুরু করলো, তার হাঁটার এই ভঙ্গির সাথে আওরঙ্গজেব বেশ পরিচিত ছিলেন। একটু পরই তিনি কামানের পেছনের সারির কাছে এসে থামলেন, তারপর গোলন্দাজ সেনাদেরকে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করলেন। তারপর তিনি অশ্বারোহী, বরকন্দাজ আর পদাতিক সৈন্য সারির কাছে পৌঁছলেন, সকলেই তখন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছিল। মাহুত তার ইস্পাতের আংকা দিয়ে খোঁচা দিয়ে ব্রজদেবকে সারিবদ্ধভবে দাঁড়িয়ে থাকা সৈন্যদের মধ্য দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে চললো। আওরঙ্গজেব হাত তুলে সৈন্যদের সম্ভাষণ জানাতেই সৈন্যরা ‘আওরঙ্গজেব জিন্দাবাদ! আওরঙ্গজেব দীর্ঘজীবী হোন!’ বলে চিৎকার করে উঠলো।
কয়েকমিনিট পর তিনি একদল জ্যেষ্ঠ সেনানায়কের সামনে এলেন, তাঁর অনুরোধে তারা এখানে তাঁকে স্বাগত জানাতে সমবেত হয়েছিল। বজ্রদেব তাদের সামনে এসে থামলো, তারপর উমর আলির সাহায্য নিয়ে আওরঙ্গজেব আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে প্রধান দেহরক্ষীর হাত ছেড়ে দিয়ে সেনানায়কদের মুখোমুখি হলেন। কয়েকজন তার চোখের দিকে তাকাতে পারলো না। অন্যরা এক পা থেকে অন্য পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল। পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে ওরা অস্বস্তিতে রয়েছে। তিনি ভাবলেন, হওয়ারই কথা, অবরোধ করতে গিয়ে ইতোপূর্বে তারা যে অবস্থার সৃষ্টি করেছে, তাতে এরকমই হওয়ার কথা। তিনি পরিষ্কার জোরালো কণ্ঠ বলতে শুরু করলেন, আমি আজ আশা করবো তোমরা পূর্ণ শক্তি ও মনে সাহস, আমাদের উদ্দেশ্য আর আমাদের অস্ত্রের উপর সম্পূর্ণ আস্থা নিয়ে দুর্গ আক্রমণ করবে। এযাবৎ এই মারাঠিদের তোমরা হেলাফেলা করেছ। এখন ওদের দেখিয়ে দাও কে শ্রেষ্ঠ আর আমার কাছে তোমাদের সত্যিকার যোগ্যতা প্রমাণ কর। আজই এই দুর্গ দখল কর!
একে একে তারপর একযোগে সেনানায়করা চিৎকার করে তার প্রতি সমর্থন ঘোষণা করলো। আওরঙ্গজেব এক হাত তুলে তাদেরকে চুপ করার নির্দেশ দিলেন। তারপর বললেন, এখন তোমাদের কাজ হল যার যার পল্টনের কাছে গিয়ে তোমাদের সৈন্যদেরকে নতুন উৎসাহ আর উদ্দীপনা নিয়ে উৎসাহিত করা, যেরকম এখন চিৎকার করে আমাকে সমর্থন করে দেখিয়েছ। আধাঘণ্টার মধ্যে সৈন্যদের সামনে আমি আমার গাদা বন্দুক থেকে একবার গুলি ছুঁড়ে আক্রমণ শুরু করার ইঙ্গিত দেব।’
ত্রিশ মিনিট পর বজ্রদেব ধীরে ধীরে একটি ছোট টিলার উপর চড়লো। তাকে এখন আওরঙ্গজেবের সৈন্যদের অনেকেই দেখতে পাচ্ছে, শুধু তাই নয় যগিনগড় দুর্গ থেকেও তাকে দেখা যাচ্ছিল। দুর্গটি আরো বড় একটি পাহাড়ের উপর অবস্থিত ছিল, এর দুই পাশে পাহাড় চূড়া দিয়ে বেষ্টিত এবং পাশেই একটি চওড়া খরস্রোতা নদী বয়ে যাচ্ছে। দুর্গটি বড় না হলেও, পাথরের চওড়া দেয়ালটি অত্যন্ত শক্ত প্রমাণিত হয়েছিল। বজ্রদেব টিলার সমতল চূড়ায় উঠে দাঁড়াল। দুজন অশ্বারোহী পতাকাবাহক সোনালি ঘেরের দুটি সবুজ বিশাল পতাকা হাতিটির পেছনে মেলে ধরলো। আওরঙ্গজেব আদেশ করলেন, উমর আলি আমাকে আবার দাঁড়াতে সাহায্য কর।
প্রধান দেহরক্ষী তাকে দাঁড়াতে সাহায্য করে তার হাতে গাদা বন্দুকটা তুলে দিল। এর হাতির দাঁতের বাটে লড়াইয়ের দৃশ্য খোদাই করা ছিল। উমর আলি বললো, আপনি কি আমার কাঁধে রেখে বন্দুকটা নিশানা করবেন, জাঁহাপনা?’ আওরঙ্গজেব বললেন, ‘না, আমি এটা ধরে নিশানা করতে পারবো। ঠিকই তিনি তার কথামতোই কাজ করলেন। সমস্ত শক্তি দিয়ে গাদা বন্দুকটা সোজা করে দুর্গের দিকে একটি গুলি করলেন।
সাথে সাথে তার সম্মুখ সারি থেকে গুলির আওয়াজ শোনা গেল। কামানগুলো গোলা ছুঁড়তেই অশ্বারোহী সেনারা প্রবল উৎসাহে সামনে এগোল। তাদের ঘোড়াগুলো ছোটা শুরু করতেই পতাকাগুলো বাতাসে পত পত করে ভাসতে লাগলো। তাদেরকে অনুসরণ করলো পদাতিক বাহিনী, তাদের মধ্যে কিছু সৈন্য লম্বা মই বহন করছিল।
উমর আলি আবার আওরঙ্গজেবকে তাঁর গদিওয়ালা আসনে বসাতেই কাছেই পাহাড়ের মাটিতে একটি কামানের গোলা এসে পড়লো। আওঙ্গজেব আর তার হাতির গায়ে মাটি ছড়িয়ে পড়লো। প্রশিক্ষিত বজ্রদেবের কিছুই হল না, তবে পতকাবাহকদের একটি ঘোড়া আতঙ্কিত হয়ে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতেই এর আরোহীকে পিঠ থেকে প্রায় ফেলে দিচ্ছিল। ঘন ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে আওরঙ্গজেব দেখলেন দুর্গের দিকে অর্ধেক পথ যাওয়ার আগেই মারাঠিদের কামান আর গাদা বন্দুকের গোলার আঘাতে দুজন পতাকাবাহকসহ কয়েকজন অশ্বারোহীসেনা হাত-পা ছড়িয়ে মাটিতে পড়ে রয়েছে। আরো কয়েকজন আহত অশ্বারোহীসেনা পিছু হটছে। যদিও অন্যরা ইতোমধ্যেই দুর্গের দেয়ালের নিচে পৌঁছে গেছে, কয়েকজন ঘোড়ার পাদানিতে দাঁড়িয়ে একহাতে ঘোড়ার রাশ ধরে অন্য হাতে পিস্তল নিয়ে দুর্গের ছাদের উপর শত্রুপক্ষের সেনাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছে। এদের পেছনে যে বরকন্দাজ সেপাইরা ছিল, তারা মাটিতে শুয়ে গাদা বন্দুক নিশানা করছিল।
একটি আতঙ্কিত ঘোড়া হঠাৎ আরোহীসহ দুর্গের পেছনের পাহাড় চূড়ার উপর দিয়ে ছুটলো। পদাতিক সেনারা উপরে উঠার আগেই বারোজনেরও বেশি মোগল বরকন্দাজ হতাহত হল। ওদের মধ্যেও অনেকে হতাহত হয়েছিল। কয়েকজন স্থির হয়ে পাহাড়ের খাড়া ঢালে পড়েছিল আর অন্যরা হামাগুড়ি দিয়ে কিংবা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মোগল শিবিরের দিকে ফিরে আসছিল। তবে যারা দেয়ালের কাছে পৌঁছেছিল, তারা দ্রুত মই খাড়া করে দেয়ালে উঠতে শুরু করলো। দুর্গের ছাদে থাকা মারাঠিরা কয়েকটি মই ঠেলে ফেলে দিল। মইয়ের সাথে লেগে থাকা মোগল সেনারা পেছনে তাদের সহযোদ্ধাদের গায়ের উপর পড়লো। এদের সাথে সাথে দুই-তিনজন মারাঠি সেনাও মোগল গাদা বন্দুকের গুলিতে আহত হয়ে ছাদ থেকে নিচে পড়ে গেল।
তবে তিনি যেরকম আশা করেছিলেন, মোগল সেনারা যথেষ্ট মনোবল দেখাতে লাগলো। দ্রুত প্রচুর সেনা দেয়ালের কাছে পৌঁছতেই আরো অনেক মই লাগান হল। মই থেকে ওরা অনেকে ছাদে উঠতে সফল হল। এখান থেকে দেখা যাচ্ছে ছাদের উপর উভয়পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি লড়াই চলছে। ধীরে ধীরে মারাঠিরা দেয়াল ধরে পিছু হটছে। প্রচুর হতাহত করা ছাড়াও মোগলরা ওদেরকে ছোট ছোট দলে একে অপরের কাছ থেকে আলাদা করে ফেলছিল। ইতোমধ্যে ওরা মারাঠিদের বড় একটি কামান দখল করে কামানের মুখ পিছন দিকে ঘুরিয়ে দুর্গের দিকে গোলা ছোঁড়ার চেষ্টা করছিল। এর কাছেই একজন মোগল সেনা ছাদের একটি ছিদ্রের সাথে বিশাল একটি সোনালি-সবুজ মোগল পতাকার দণ্ড বেঁধে দিতেই পতাকাটি হাওয়ায় পতপত করে উড়তে লাগলো।
আওরঙ্গজেব বললেন, “আল্লাহর রহমতে যুদ্ধের গতি আমাদের অনুকূলে যাচ্ছে। গরমে আমার মাথা দপদপ করছে উমর আলি। চল আমরা বড় তাবুতে ফিরে যাই। ঐ ছাতাটা নাও। রোদ সহ্য হচ্ছে না।’
সেদিন সন্ধ্যায় হেরেম তাঁবুতে আওরঙ্গজেব একটি রেশমি বালিশে মাথা রেখে একটি ডিভানের উপর শুয়ে চোখ বুজে ছিলেন। উদিপুরী মহল তার দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে বললেন, আপনাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। অবশ্য আজ আপনি যা করেছেন, তাতে ক্লান্ত হবারই কথা।
তিনি বললেন, হ্যাঁ আমি ক্লান্ত। তবে আমার পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। আমার উপস্থিতিতে আমার লোকেরা উজ্জীবিত হয়েছে। দুইঘণ্টারও কম সময়ে আমরা পুরো দুর্গ দখল করতে পেরেছি। যদিও কিছু সৈন্যসহ এর অধিনায়ক মাটির নিচের একটি গোপন পথ দিয়ে পালিয়ে গেছে। এবার আমি যগিনগড় দুর্গ সঠিকভাবে সুরক্ষিত করবো। মারাঠিরা আর এটা পুনর্দখল করতে পারবে না, আর নয়তো আমার সেনাপতিদের এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে।
‘আপনার সফলতায় আমি খুশি হয়েছি, তবে নিজের শরীরের উপর বেশি চাপ নেবেন না।’
‘সেটা হয়তো পুরোপুরি সম্ভব নয়। আমি একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেটা সেনাপতিদের সামনে ঘোষণা করার আগে তোমাকে বলতে চাই। কিছু সৈন্য নিয়ে আমি উত্তরে আগ্রা আর দিল্লির দিকে ফিরে যাব। তেইশ বছর যাবৎ দক্ষিণে থেকে আমাদের সাম্রাজ্যের পরিধি এযাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাড়িয়েছি। এখানে যে বিরাট সেনাবাহিনী থাকবে তার নেতৃত্ব দেবার জন্য মুয়াজ্জমকে ডেকে আনবো। সে একজন কুশলী সেনাপতি আর একটি ভুলের পর নির্দেশের প্রতি সে আরো অনুগত হয়েছে। তার কাজ হবে আমাদের এখানকার অবস্থান ধরে রাখা। আর কোনো এলাকা দখল করার দরকার নেই। আজম গুজরাটেই থাকবে।’
‘এসব সিদ্ধান্ত এখন কেন নিচ্ছেন?
‘অনেক কারণে। উত্তরে অশান্তি চলছে। রাজপুতরা উদ্ধত হয়ে উঠেছে আর শিখরাও আরো বেশি স্পর্ধা দেখাচ্ছে। এমনকি জাটরাও আগ্রায় আমার মায়ের সমাধিসৌধে লুটপাট চালিয়েছে। তার উপর আমার নিজের যে কর্মকর্তাদের চোখের আড়ালে রেখে আমি বিশ্বাস করেছিলাম, ওরাও দুর্নীতিপরায়ণ আর অর্থলোলুপ হয়ে উঠেছে। আমি এদের কয়েকজনকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেব, যাতে অন্যরা সাবধান হয়ে যায়। আর খাজনার পরিমাণ বাড়িয়ে তুলবো, যা আমার সেনাবাহিনীকে টিকিয়ে রাখার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আওরঙ্গজেব এতক্ষণ সোজা হয়ে বসে কথা বলছিলেন, এবার একটু থামলেন, তারপর আবার বলে চললেন, আর সত্যি বলতে কি, উত্তরে আবার পরিচিত লোকালয় আর দালানকোঠাগুলো আমার খুব দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে। ইচ্ছা হচ্ছে দিল্লিতে আমার বোন জাহানারার মাজারে দোয়া করার, আর আগ্রায় তাজমহলে মায়ের মাজারে আর হয়তো সেখানে বাবার কবরেও দোয়া করবো। আবার একটু থামলেন। আওরঙ্গজেবের এরকম বিষাদময় চেহারা উদিপুরী মহল আর কখনও দেখেন নি। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন তার লাল হয়ে আসা চোখে দু একফোঁটা পানি দেখা যাচ্ছে, ধীরে ধীরে গাল বেয়ে নেমে চোখের পানি সাদা দাড়ি ভিজিয়ে দিচ্ছে। তিনি তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে আবার বললেন, ‘যতই বয়স হচ্ছে ততই তার কথা আমার বেশি মনে পড়ছে। গত বছর পারস্যে আকবর মারা যাবার পর আর তার আগে কারাগারে জেরুন্নিসার মৃত্যুর খবরের পর আমার মনে যে শোক জেগেছিল, তা আমাকে অবাক করেছে। বয়স আমাকে বুঝতে শিখিয়েছে পিতামাতার সাথে তাদের সন্তানেন বন্ধন কত অসমান। বড় হলেই সন্তান তার বাবা-মার কাছ থেকে আলাদা হয়ে যায়, নিজের পরিকল্পনা আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অথচ বাবা-মা তখনও সেই বন্ধন অনুভব করে আর ওদেরকে ছোট ছেলেমেয়ে হিসেবে দেখে। বুঝতে ব্যর্থ হয় কেন সন্তান তার কথামতো চলে না। যদিও আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই যে,…মোটেই নেই…যে আমি সবসময় সঠিক কাজই করেছি …যখন বাবার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছিলাম, আর এখন একটু একটু বুঝতে শুরু করেছি তিনি তখন কেমন অনুভব করেছিলেন।
কথা বলা শেষ করতেই একটি কষ্টের হাসি আওরঙ্গজেবের মুখে দেখা দিয়েই আবার মিলিয়ে গেল। উদিপুরী তার কাছে গিয়ে দুই হাতে তার কাঁধ ধরলেন। কয়েকমিনিট নীরবতার পর তিনি বললেন, কমবখস্ কি আমাদের সাথে উত্তরে যেতে পারবে?
‘হ্যাঁ, যদি তুমি চাও।’
‘আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। সে আমার বড় আদরের আর আমার মনে হয় আপনারও একজন প্রিয়পাত্র। সেজন্য অনেক সময় আমার দুশ্চিন্তা হয় হয়তো তার ভাইয়েরা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে পারে, বিশেষত যখন সে আপনার নিরাপদ আশ্রয় থেকে দূরে থাকে…’
‘আমি যতদিন বেঁচে আছি আর আমি এত তাড়াতাড়ি মরতেও চাই না, এ ধরনের ষড়যন্ত্র হতে দেব না।’
উদিপুরী মহলের মাংসল মুখে একটি মৃদু হাসি খেলে গেল। আর তা আওরঙ্গজেবকে মনে করিয়ে দিল যৌবনে তিনি দেখতে কেমন ছিলেন। তার বুকে মাথা রেখে ধীরে ধীরে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। উদিপুরী মহল তার পাতলা হয়ে যাওয়া চুলে হাত বুলাতে বুলাতে তার মাতৃভূমি জর্জিয়ার একটি নৈশকালের ঘুমপাড়ানি গান গুন গুন করে গাইতে শুরু করলেন। আগামীকাল তিনি চাকরদের বলবেন তার সিন্দুকে মালপত্র ভরতে, কেবল সফরের উপযোগী কিছু পোশাক আর অলঙ্কার, যা তার স্বামীকে খুশি করবে সেগুলো আলাদা করে রাখবেন। তবে পোশাকগুলোতে কিছু পরিবর্তন করতে হবে, কেননা তিনি আগের চেয়ে বেশ মোটা হয়েছেন। আর সামান্য যে মদ লুকিয়ে রেখেছিলেন তা ফেলে দিতে হবে, কেননা তার স্বামী এটা খুবই অপছন্দ করেন। উত্তরে পৌঁছান পর্যন্ত তাকে ধীর-স্থির থাকতে হবে। আওরঙ্গজেবের বয়স এখন সাতাশি, কষ্টকর সফরকালে তার স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য উদিপুরীর সাহায্য প্রয়োজন হবে। কমবখও তার কর্মতৎপরতা আর সিংহাসনের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকার হিসেবে তার যোগ্যতা প্রমাণ করার একটি সুযোগ পাবে। তবে তিনি নিশ্চিত অবশ্যই সে সময় আসবে…।
*
অশ্বারোহীদলের সবার আগে অগভীর নদীর পানি ছিটিয়ে কমবখস্ বীরের মতো আক্রমণে ছুটে চললো। শেষ বিকেলের আলোয় নদীর পানির রঙ সোনালি হয়ে চিক চিক করছিল। এক হাতে রোদ আড়াল করে আওরঙ্গজেব লক্ষ করলেন তার ছেলের পেছনের একজন অশ্বারোহী তার সাদা ঘোড়ার পিঠ থেকে দুই হাত ছুঁড়ে পানিতে পড়ে গেল। তবে কম বখস্ ইতোমধ্যে নদী পার হয়ে পাহাড়ের পেছনের পরিত্যক্ত দুর্গটি পর্যন্ত অর্ধেক পথ পার হয়েছে। এর নিচু মাটির দেয়ালটি বৃষ্টি পড়ে জায়গায় জায়গায় ভেঙ্গে পড়েছে, সহজেই ঘোড়াগুলো টপকে যেতে পারবে। শীঘ্রই দুর্গে যে মারাঠি সৈন্যগুলো লুকিয়েছে তারা ধরা পড়বে এবং মারা পড়বে। ওরা ধীর গতিতে চলা মোগল সেনাবাহিনীর অগ্রবর্তী দলের উপর অতর্কিতে হামলা করে এখানে লুকিয়েছিল। মারাঠিদের হাতে তার যে লোকেরা মারা গিয়েছিল, তাদের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়া হবে। দুই মাইল দীর্ঘ মোগল কাফেলার উপর এটা সর্বশেষ অতর্কিত হামলা ছিল, এমনিতেই ধীরে চলা কাফেলাটির অগ্রগতি আরো ধীর হয়ে পড়লো, কেননা এখন তাদেরকে প্রতিটি লোকের উপর কড়া নজর রাখতে হচ্ছে। তবে এখন পাহাড়ের ঢাল আরো খাড়া হয়ে চলেছে, কমবখস তার বাদামি ঘোড়ায় চড়ে দেহরক্ষীদের আগে আগে ছুটে প্রায় দুর্গের দেয়ালের কাছে পৌঁছে গেছে। হঠাৎ তার ঘোড়াটি পা ভাঁজ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই সেও জিন থেকে ছিটকে মাটিতে পড়ে স্থির হয়ে রইল।
চার-পাঁচজন দেহরক্ষী ঘোড়ার রাশ টেনে তাদের ঘোড়া থামাল। তারপর দ্রুত ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে শাহজাদার উপরে ঝুঁকলো। বাকি মোগল সৈন্যরা ঢাল বেয়ে দুর্গের দিকে ছুটে চললো। মাটির দেয়াল টপকাতে গিয়ে দুটি ঘোড়া পড়ে গেল, অন্যরা দেয়াল টপকে দুর্গের ভেতরে ঢুকে পড়লো।
আওরঙ্গজেব চিৎকার করে বললেন, ‘হেকিমকে পাঠিয়ে আমার ছেলেকে পেছনের সারিতে নিয়ে আসতে বল। আর দেখো তার পড়ে যাওয়ার খবরটা যেন মেয়েদের কানে না যায়। ওরা কাফেলার পেছনে পর্দাঘেরা হয়ে আসছিল আর যখন মারাঠিরা অতর্কিতে আক্রমণ করেছিল তখন প্রহরীরাও ওদেরকে ঘিরে ছিল, কাজেই উদিপুরী মহল দেখতে পারেন নি কি ঘটেছে। আমি আমার ছেলের কতটুকু জখম হয়েছে দেখার পর নিজে তাকে খবরটা জানাব।’
হুমায়ুনের আমল থেকে কোনো মোগল শাহজাদা যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যান নি। তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন, তিনি যেন কমবখসের প্রাণ রক্ষা করেন। তার মনে পড়লো ছোট ছেলের জন্মের সময় তিনি ভেবেছিলেন একজন সম্রাটের বেশ কয়েকটি ছেলের প্রয়োজন, কারণ কেউ হয়তো মারাও যেতে পারে কিংবা কেউ বিশ্বাসঘাতকতাও করতে পারে। সেই তখন থেকেই তিনি আকবরের বিশ্বাসঘাতকতা সহ্য করে এসেছেন। এখন কি তাকে আরেকটি মৃত্যু সহ্য করতে হবে? অবশ্য সেটা এখনই জানা যাবে। কমবখসের চারদিকে যে দেহরক্ষীরা ভিড় করেছিল, তাদের মধ্যে একজন ঘোড়ায় চড়ে শিবিরের দিকে ফিরে আসছিল। শীঘ্রই সে আওরঙ্গজেবের সামনে এসে ঘোড়া থেকে নামলো। তার মুখ দেখে কিছু বোঝা গেল না।
‘আমার ছেলে সে কেমন আছে?
‘আমরা নিশ্চিত কিছু বলতে পারছি না জাহাপনা। একটি মারাঠি গোলা তার ঘোড়াকে আঘাত করেছিল, তাকে নয়। তবে মাটিতে পড়ে যাওয়ার সময় তার শিরস্ত্রাণটি খুলে পড়ে এবং শক্ত পাথুরে জমিনে তার মাথা ঠুকে যায়। তার নাক, মুখ আর এক কান দিয়ে রক্ত পড়ছে। জ্ঞান হারালেও তার নিশ্বাস-প্রশ্বাস ঠিকই বইছে। আর আমাদের একজন সাথি বলেছে তিনি নাকি একবার চোখের পাতা ফেলেছিলেন। হেকিম বলেছেন তাকে এখন যেখানে আছেন সেখানে রাখাই ভাল। ওরা বরফ আর কম্বল আনতে বলেছে।
কিন্তু ওকে ওখানে রাখলে মারাঠিরা কিছু করবে না?
দুর্গ থেকে যারা পালাতে পারে নি তাদের সকলকে বন্দী করা হয়েছে। সবকিছু এখন শান্ত।
কয়জনকে ধরেছ?
‘প্রায় পঁচিশজন হবে, জাহাপনা।
‘ওদেরকে কড়া পাহারায় রাখে। পরে আমি ওদের সাথে কথা বলবো। এখন আমাকে আমার ছেলের কাছে যেতে হবে। উমর আলি, একটা পালকি আনতে বল।
দশ মিনিট পর ছয়জন বেহারা পর্দাঘেরা পালকিটি কমবখকে ঘিরে থাকা সেনাদলটির কাছে এসে নামাল। ভিড়ের ফাঁক দিয়ে বিশেষ কিছু দেখা যাচ্ছে না। ষাট বছরের উমর আলি পালকির সাথে সাথে ছুটে এসেছে। সে আওরঙ্গজেবকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলো।
‘আমাকে দেখতে দাও আমার ছেলেকে। যারা কমবখসূকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল তারা সরে দাঁড়াল। আওরঙ্গজেব নিচে তাকিয়ে দেখলেন কমবখস্ এখন মনে হল অজ্ঞান হয়ে রয়েছেন। নাক মুখ থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে, তবে অন্তত তিনটি দাঁত ভেঙ্গে গেছে আর তার বাম হাতের কব্জির একটি রক্ত মাখা হাড় বেরিয়ে রয়েছে। কালো পোশাকপরা একজন হেকিম কাপড়ে মোড়ান একটি বরফের টুকরা নিয়ে তার ছড়ে যাওয়া কপাল, আর ফুলে বেগুনি হয়ে যাওয়া বাম চোখে ধরে রেখেছিলেন। তবে সকল প্রশংসাই আল্লাহর, তার ছেলের বুক উঠানামা করছিল। সে ঠিকমতোই নিশ্বাস নিচ্ছিল।
আওরঙ্গজেব হেকিমকে জিজ্ঞেস করলেন, “সে কি একবারও নড়েছে?
‘দুই তিন মিনিট আগে তিনি একবার চোখ মেলে তাকিয়েছিলেন, এমনকি মনে হলো মৃদু হেসেছিলেন। তবে এর পর আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। হেকিম কথা বলতে বলতেই কমবখ মাথাটা সামান্য নড়ে উঠলো। তিনি আবার চোখ খুললেন আর মনে হল তার বাবার দিকে তাকালেন।
আওরঙ্গজেব জিজ্ঞেস করলেন, কমবখস্, তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?” তার ছেলে কোনো উত্তর দিল না, তবে তার ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে কয়েক ফোঁটা রক্ত বের হয়ে তার কালো দাড়ির উপর গড়িয়ে বের হল–সম্ভবত মাথা নাড়াচাড়ার কারণে কোনো একটি জখম খুলে গেছে। আবার চোখ বন্ধ করলেন। আরো পাঁচ মিনিট কেটে গেল, তারপর আবার কমবখসের চোখের পাতা কেঁপে উঠলো, তিনি আবার চোখ খুললেন। এবার আওরঙ্গজেব নিশ্চিত হলেন তিনি তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন। তিনি ডেকে উঠলেন, ‘কমবখস্…?
তিনি আর কিছু বলার আগেই কমবখসের রক্তমাখা ঠোঁট নড়ে উঠলো। মৃদুস্বরে তবে পরিষ্কারভাবে তিনি বলে উঠলেন, ‘বাবা?’
হাঁটুর ব্যথা নিয়ে আওরঙ্গজেব সাথে সাথে সেখানেই হাঁটুগেড়ে বসে পড়লেন, সকল প্রশংসাই আল্লাহর!
দুই ঘণ্টা পর কমবখসের ভাঙ্গা কব্জিতে পট্টি লাগাবার পর তাকে একটি নতুন তাবুতে বসিয়ে পাশে উদিপুরী মহলকে রেখে আওরঙ্গজেব আবার পালকিতে চড়ে নদীর তীরে ফিরে এলেন। সেখানে চব্বিশ জন মারাঠি বন্দী হাত-পা পিছমোরা বাঁধা অবস্থায় একই দেহরক্ষীদলের পাহারায় অপেক্ষা করছিল। পালকিতে নেমে তিনি লাঠিতে ভর দিয়ে বন্দীদের কাছে হেঁটে গেলেন। প্রায় সবাই তার দিকে অম্লানবদনে তাকিয়ে রইল।
“তোমরা সবাই তোমাদের সম্রাট–আমার কাছে বিশ্বাসঘাতক। তোমাদের মতো লোকেরা আমার শাসনে বার বার উপদ্রব সৃষ্টি করেছ। কেউ তোমাদের মৃত্যু ঠেকাতে পারবে না, তবে তোমরা যদি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ কর, তবে ঘাতকের তরোয়ালের এক কোপে তোমাদের মৃত্যু দ্রুত, যন্ত্রণাহীন এবং যতদূরসম্ভব মর্যাদাপূর্ণ হবে। এটা জানার পর তোমাদের মধ্যে কেউ কী সত্যি ধর্মে দীক্ষিত হতে রাজি আছ?
কোনো উত্তর নেই।
“ঠিক আছে, তোমাদেরকে একজন একজন করে ঐ কামানের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। তারপর কামানের মুখে তোমাদেরকে বেঁধে গোলা ছোঁড়া হবে, তোমাদের দেহ টুকরা টুকরা হয়ে উড়ে যাবে। তারপর একটি মুণ্ড ঐ দুর্গের কোনো একটি চূড়ায় সিমেন্ট করে রাখা হবে, যাতে এটা দেখার পর অন্যরা সাবধান হয় আর আমার কর্তৃত্বকে মানতে বাধ্য হয়। প্রহরী, গোলন্দাজ সেপাই, কাজ শুরু করে দাও!’
নদীর ওপারে সূর্য অস্ত যেতেই দুইজন দীর্ঘদেহী প্রহরী লম্বাচুলের একজন মারাঠিকে ধরে তাকে টেনে-হিঁচড়ে কামানের দিকে নিয়ে চললো। লোকটি কোনো বাধা দিল না, তবে মাথা সোজা করে রইল আর আওরঙ্গজেবের কাছে। আসতেই চিৎকার করে উঠলো, হিন্দুস্তান আমাদের দেশ। এক দিন আমরা আপনার এবং সকল বিদেশি হামলাকারীদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হব। এখন আমি যত যন্ত্রণা আর অপমান বোধ করবো, হে বৃদ্ধ, আপনার বংশধরেরা তার চেয়ে দশগুণ বেশি যন্ত্রণা ভোগ করবে। একজন প্রহরী তার তলপেটে প্রচণ্ড আঘাত করতেই সে উল্টে পড়লো, তবে একটুও শব্দ করলো না। কামানের কাছে পৌঁছে প্রহরীরা কামানের মুখের উপর তার শরীর বাঁকা করে ধরলো আর হাত-পা রশি দিয়ে কামানের নলের সাথে বাঁধলো। কামানের পাশে দাঁড়ান তিনজন গোলন্দাজ সেনা ইতোমধ্যে কামানে গোলা ভরে রেখেছিল। লোকটি তারপরও কোনো ধরনের নড়াচড়া করলো না কিংবা চিৎকার করলো না। প্রধান গোলন্দাজ সেনা বারুদে আগুন ধরাতেই কামানের গোলাটি মারাঠি লোকটির দেহ ছিন্নভিন্ন করে দিল। অনেক দূরে চতুর্দিকে রক্ত, মাংস আর হাড় ছড়িয়ে পড়লো। আর মাথাটি গড়াতে গড়াতে নদীর তীরের দিকে গিয়ে পৌঁছল।
আওরঙ্গজেব উমর আলিকে বললেন, ‘বেহারাদের ডাক। আমার এসব দেখার দরকার নেই। এই লোকগুলোর মনোবল ভেঙ্গে দেবার জন্য তিনি আর কি করতে পারেন?
*
দেবপুর দুর্গ-প্রাসাদের ধূলিধূসরিত উঠানে পালকির পাশে হাঁটুগেড়ে বসা দেহরক্ষী প্রধানকে আওরঙ্গজেব বললেন, আমাকে কয়েকটা দিন অবশ্যই বিশ্রাম নিতে হবে। আমার মনে হয় আমি আমার শক্তির শেষ সীমায় এসে গেছি, দিল্লি রওয়ানা দেবার আগে আমাকে সুস্থসবল হয়ে উঠতে আরো কিছু সময় দিতে হবে। তবে দিল্লি যেতেই হবে। উমর আলি প্রয়োজনীয় নির্দেশ দাও।’
“জ্বী, জাঁহাপনা। আমি সেনাপতিদের বলবো ওরা যেন সৈন্যদের বেশ কিছু দিন থাকার মতো রসদের মজুদ এবং মোটামুটি স্থায়িভাবে থাকার বন্দোবস্ত নিশ্চিত করে।’
‘আর বিভিন্ন প্রদেশের সুবেদার আর সেনাপতিরা যেন জানে…’ হঠাৎ কাশির দমকে আওরঙ্গজেব থেমে গেলেন। এক টুকরা মসলিন কাপড় দিয়ে ঢাকা পাশে রাখা চিনামাটির একটি পেয়ালায় এক দলা কফ থুক করে ফেলে তিনি আবার কর্কশ স্বরে বলতে লাগলেন, “ওদেরকে জানাও আমি এখানে আছি, কোনো ধরনের সমস্যা হলে যেন দ্রুত আমাকে খবর দেয়।
‘আমি বলবো জাঁহাপনা। আমি কি আপনাকে পালকি থেকে উঠতে সাহায্য করবো, যাতে আপনি হেঁটে আপনার থাকার কামরায় যেতে পারেন? আমার মনে হয় পরিচারকরা কামরাগুলো সাজিয়ে রেখেছে।
না, এখন আমি হাঁটতে পারবো না, এবার খুব ক্লান্ত হয়েছি। বেহারাদের বল পালকিটা ভেতরে বয়ে নিয়ে যেতে আর চাকরদের বল কিছু বরফ পানি প্রস্তুত করতে। যদিও ঘাম নেই, তারপরও আমার শরীরের ভেতরে আগুনের মতো গরম মনে হচ্ছে।
‘অবশ্যই জাঁহাপনা। আমি নিশ্চিত বরফঘরটিতে প্রচুর বরফ রয়েছে। উদিপুরী মহল খবর পাঠিয়েছেন, তিনি আপনার জন্য আপনার কামরায় অপেক্ষা করছেন। আমি পরিচারকদের বলবো জানালায় লেইসের সুতার পর্দা লাগিয়ে পানি দিয়ে যেন ভিজিয়ে রাখে।
“ঠিক আছে। এখন বেহারাদের বল পালকিটা ঘরের ঠাণ্ডায় আমাকে নিয়ে যেতে।’ কথাগুলো বলতেই আবার কাশির দমকে তাঁর শীর্ণ দেহটি কেঁপে উঠলো।
প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে দিতে উমর আলি ভাবলো তিনি নিশ্চয়ই অসুস্থ হয়েছেন। আওরঙ্গজেবকে তিনি কখনও এরকম তাঁর কর্মচারীদের সামনে নিজের শারীরিক দুর্বলতা প্রকাশ করতে দেখেন নি।
সেদিন সন্ধ্যায় উদিপুরী মহল আওরঙ্গজেবের উপর ঝুঁকে তাঁর দিকে তাকালেন। দেবপুরের সন্ধ্যার বাতাসে ঘরে ফেরা ময়ূরের কর্কশ কেকা ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। দুর্গের সাদা মার্বেল পাথরের যে প্রাসাদে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, সেখানে পৌঁছার কিছুক্ষণ পরই আওরঙ্গজেব ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুমের মাঝে বার বার মাথা উঁচু করে এদিক ওদিক পাশ ফিরছিলেন। পাশে রাখা রূপার বাটি থেকে পানি নিয়ে উদিপুরী তার শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে দিচ্ছিলেন। তিনিও খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন আর ঘুমে তার চোখ বুজে আসছিল এমন সময় হঠাৎ আওরঙ্গজেবকে কথা বলতে শুনে তিনি চমকে জেগে উঠলেন। মা, আমাকে বাঁচাও। আমার যন্ত্রণা হচ্ছে। চারপাশে শুধু সাপ…সাপ আমার মাথায়…সাপ আমার পরিবারে…বিষ ঝরে পড়ছে তাদের বিষদাঁত থেকে। আমাকে ছেড়ে চলে যেও না, সাপ আমাকে কামড়াবে। বাঁচাও! বাঁচাও আমাকে!’ তিনি চারপাশে হাত তুলে ছুড়ছিলেন। দুচোখ খোলা আর চোখের মণি উন্মাদের মতো ঘুরছিল। তিনি প্রলাপ বকতে শুরু করেছেন। তিনি কী মারা যাচ্ছেন?
পাশে দাঁড়ান একজন তরুণ কোরচিকে উদপুরি মহল বললেন, ‘হেকিমকে ডেকে আন আর কাউকে পাঠিয়ে দোয়া পড়ার জন্য ইমামকে খবর দাও।’ তারপর তিনি পাশে রাখা বড় একটি বোল থেকে বড় এক টুকরা বরফ নিয়ে আওরঙ্গজেবের কপালের উপর ধরলেন। বরফগলা পানি ফোঁটায় ফোঁটায় তার মুখ বেয়ে সাদা দাড়িতে পড়তেই তিনি আবার এক মুহর্তের জন্য প্রচণ্ডভাবে কেঁপে উঠলেন তারপর আবার বিছানায় শুয়ে স্থির হয়ে রইলেন। কপালে হঠাৎ ঠাণ্ডা বরফ রেখে কি তিনি তাঁকে প্রচণ্ডভাবে একটা ধাক্কা দিয়ে মেরে ফেলেছেন? না, তার বুক তো ঠিকই উঠানামা করছে।
হঠাৎ আওরঙ্গজেব তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, কে, উদিপুরী মহল?
তিনি বললেন, “জ্বী, আমি এখানে আছি। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ কথাটা বলা শেষ করার আগেই আওরঙ্গজেবের সারা শরীর ঘামে ভিজে গেল, পোশাকে গাঢ় দাগ দেখা দিল। আল্লাহকে শুকরিয়া যে জ্বর চলে গেছে। তিনি হয়তো বেঁচে যাবেন। উদিপুরী মহল তার ভেজা গালে চুমু খেলেন। এখন আর কালো পোশাকপরা ইমামের দোয়া পড়ার প্রয়োজন নেই।
দুদিন পর সকালবেলা উদিপুরী মহল আবার আওরঙ্গজেবের বিছানার পাশে বসেছিলেন। তিনি সবে মাত্র জেগে উঠেছিলেন আর উদিপুরী পাশে রাখা রুপার বোল থেকে একটি চামচে করে হেকিমের তৈরি করা পানি, মধু আর ভেষজের মিশ্রণ তুলতে যাচ্ছিলেন। তাঁর কাশি কমাবার জন্য হেকিম এটা দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেব বললেন, ‘চামচের দরকার নেই। তুমি বোলটা দাও, আমি ওটা থেকে চুমুক দিয়ে খাব।
মৃদু হেসে তিনি বোলটা আওরঙ্গজেবের হাতে তুলে দিলেন। কাঁপা কাঁপা হাতে তিনি বোলটা ধরলেন। তারপর ভেষজের মিশ্রণটা খাওয়ার পর বললেন, ‘আমাকে ধরে বালিশে হেলান দিয়ে বসাও। সামান্য চেষ্টাতেই উদিপুরী তাকে টেনে তুলে বালিশে হেলান দিয়ে প্রায় খাড়া করে বসালেন। পেছনে কয়েকটা মোটা রেশমি বালিশ রাখতেই তিনি বললেন, ‘জলদি কাশ্মিরি শালটা দাও আমার হাতে! বেশ শীত করছে সকালের বাতাসে।
তিনি তার পুরনো কর্তৃত্বব্যঞ্জক আচরণ কিছুটা ফিরে পেয়েছেন দেখে উদিপুরী মহল খুশি হয়ে বললেন, আপনি আবার শক্তি ফিরে পাচ্ছেন দেখে আমার ভাল লাগছে।’
‘হ্যাঁ। আজ সকালে আবার নামাজ পড়তে পারবো। বিকেলে পোশাক পরে পালকিতে চড়ে দিওয়ান-এ-খাসে গিয়ে সভাসদদের সাথে একটি সভায় মিলিত হব।
সভায় অংশগ্রহণ করে শরীরের উপর চাপ দেবার দরকার নেই।
‘অবশ্যই প্রয়োজন আছে। এখন থেকে প্রতিদিন আমি সভাসদদের সাথে অলোচনায় যোগ দিতে চাই। এতে আমার অমাত্য, উপদেষ্টারা জানবে আমি শুধু বেঁচে নেই পুরাপুরি মন দিয়ে কার্যকরভাবে শাসনকাজ চালাতে সক্ষম। গত রাতে যখন আমি জেগে ছিলাম তখন আমার মনে পড়েছিল, পঞ্চাশ বছর আগে যখন খবর এল আমার মধ্য ষাটের বাবা গুরুতর অসুস্থ হয়েছেন, তখন আমিসহ আমার ভাইয়েরা সবাই মনে করলাম তিনি আর শাসন করার উপযুক্ত নন। আর সিংহাসনের জন্য নিজেদের দাবি নিয়ে এগোবার সময় এসেছে। পুরোনো কথা আর বলবো না। এখন মুয়াজ্জম আর আজমকে চিঠি লিখে জানাব আমি সুস্থ হয়েছি।’
উদিপুরী মহল মাথা নাড়লেন। তাকে সুস্থ হতে দেখে আর তার মনোবল ফিরে এসেছে দেখে তিনি খুশি হলেন। শুধু তাই নয়, এ খবরটি পেয়েও খুশি হলেন যে, তিনি উত্তরাধিকারীর বিষয়টি নিয়ে এখন অগ্রসর হতে পারেন। চাকর বাকর আর হেরেমের অন্যান্যের কাছ থেকে কানাঘুষা শুনেও তিনি এ বিষয়ে আরো নিশ্চিত হয়েছিলেন। এখন তাকে সুযোগ বুঝে উত্তরাধিকার হিসেবে কমবখস্রে যোগ্যতার কথাটা তুলে ধরে তাঁকে রাজি করাতে হবে। তাকে এখন তার স্বামীর সেবাযত্ন করে তাকে সুস্থ করে তুলতে হবে।
*
বার বার বৃষ্টি হওয়ায় দেবপুর আর এর আশেপাশের এলাকা আরো গাঢ় সবুজ হয়ে উঠেছে। বাইরে দুর্গে বাগানে সবুজ ফলের গাছের মাঝে ফোয়ারায় পানির বুদবুদ উঠছে আর প্রথম গোলাপ ফুটেছে। সেদিকে তাকিয়ে উদিপুরী মহল ভাবলেন, এখনও রাজদরবার এখানেই রয়েছে। যখনই আওরঙ্গজেব হাজার মাইল দূরত্বে দিল্লি যাওয়ার দীর্ঘ সফরের কথা তুলেন, তখনই তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। তবে প্রথম বারের জ্বরের পর ছাড়া প্রতিদিন তিনি দরবারের সভায় যোগ দিয়েছেন, তবে মাঝে মাঝে এমন শক্তি ক্ষয় হয় যে, এরপরে সারাদিন বিছানায় শুয়ে কাটান। এই ধরনের মনোবল দেখাবার কারণে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেও, এতে একটি উদ্দেশ্য সাধন হয়েছিল। উত্তরাধিকারত্ব নিয়ে বেশিরভাগ গোপন ষড়যন্ত্র দমন করা গেছে। এমনকি যখন একজন সেনাপতি বোকার মতো মন্তব্য করেছিল যে, সে আর তার সৈন্যরা সিদ্ধান্ত নেবে কে সিংহাসনে বসবে, তখন তিনি একথা শোনার পর তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিলেন।
এই মুহূর্তে তিনি কিছু সময়ের জন্য ভালো বোধ করছিলেন। কাশি কমে গিয়েছে আর ক্ষুধাও বেড়েছে। আবার সফর শুরু করার কথা তুললেন। এবার উদিপুরী মহল আগের চেয়ে আরো উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। বছরের এই সময় সফরের জন্য খুবই উপযুক্ত, দিনের বেলা বেশ ঠাণ্ডা হচ্ছে, বৃষ্টি আর গুমোট আবহাওয়ার আশঙ্কাও তেমন নেই।
দীর্ঘদেহী একজন তরুণী পরিচারিকা তার চিন্তার সূত্র ভেঙ্গে দিয়ে বললো, ‘বেগম সাহেবা, সম্রাট আপনাকে তার কাছে যেতে বলেছেন।
‘তিনি কী আবার অসুস্থ হয়েছেন?
‘আমার মনে হয় না বেগম সাহেবা। আমি শুনলাম, আপনাকে ডেকে পাঠাবার ঠিক আগে একজন কাসিদ এসেছে–সম্ভবত এমন কোনো খবর এসেছে যা তিনি আপনাকে জানাতে চান।
হাতের কাছে সবসময় যে ছোট রূপার আয়নাটি তিনি রাখেন, তাতে একবার চেহারা দেখে ঠিক করে নিলেন, যাতে স্বামীর কাছে তাকে সুন্দর দেখায়। তারপর তিনি তার ঘর থেকে বেরিয়ে পর্দাঘেরা করিডোর দিয়ে আওরঙ্গজেবের কামরার দিকে চললেন। একজন প্রহরী পর্দা সরিয়ে দিতেই তিনি ভেতরে ঢুকলেন। আওরঙ্গজেব একটি চেয়ারে সোজা হয়ে বসে রয়েছেন, বাম হাতে একটা কাগজ ধরে রয়েছেন, চোখে পানি।
“কি হয়েছে জান?
‘আমার বোন গওহারা মার গেছেন। একজন কাসিদ খবরটি এনেছে।
‘শুনে খুব খারাপ লাগছে। আল্লাহ তার বেহশত নসিব করুন। উদিপুরী সামনে এগিয়ে তার স্বামীর কাঁধ এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। আওরঙ্গজেবকে হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠতে দেখে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। তার সবচেয়ে ছোট বোনকে তিনি অনেক বছর দেখেন নি আর তারা তেমন ঘনিষ্ঠও ছিলেন না। সম্ভবত তাকে জন্ম দিতে গিয়ে তার মা মারা গিয়েছিলেন এই কারণে। তিনি বললেন, কাঁদবেন না। আল্লাহ সিদ্ধান্ত নেন কে কখন এই পৃথিবী ছেড়ে যাবে। তিনি একজন ভালো মানুষ ছিলেন ধার্মিক এবং অনেক দাঁতব্য কার্যকলাপে জড়িত ছিলেন। তার অবশ্যই বেহেশতে স্থান হবে, আমি নিশ্চিত।
‘আমিও তাই মনে করি। তবে শোকটা শুধু বোন হারাবার জন্য নয়, যদিও এই শোকও গভীর। আমরা দুজন ছিলাম, আমার বাবা আর মায়ের ভালোবাসা থেকে জন্ম নেওয়া চৌদ্দজন সন্তানের মধ্যে সর্বশেষ জীবিত সন্তান। আমার মনে হয় আমার দুঃখ হচ্ছে তাদেরকে আর তাদের কিছু সন্তানদের হারিয়ে, যারা অল্পবয়সে মারা গিয়েছিল আর বাদ বাকিদের ভাগ্যে কি হয়েছিল তুমি জান…’
‘আপনার একথা ভেবে খুশি হওয়া উচিত যে আপনার বাবা আর মায়ের মাঝে এমন চমৎকার বন্ধন ছিল আর তাদের মৃত্যুর পর যা হয়েছিল তা আপনি বদলাতে পারেন না।
‘আমার এই বয়সে আমার মনে মৃতদের কথাই কেবল ভিড় করছে। সেটা সবসময় মন্দ নয়। তবে এই মাসগুলোতে যখন অসুস্থ হয়ে জেগে থাকতাম, তখন অনেক সময় ভাবতাম, পরিবারের মাঝে আমার অনেক কিছু বলার ইচ্ছা ছিল কিংবা করার ইচ্ছা ছিল–কিংবা যা বলা হয়নি কিংবা করা হয়নি–সেসব ভেবে এখন মনে দুঃখ হচ্ছে। অনেক সময় আমি ভাবতাম, গওহারাকে জন্ম দেবার সময় আমার মা যদি মারা না যেতেন, তবে হয়তো তিনি তার ছেলেদের মাঝে এই বিবাদ হতে দিতেন না। তবে শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য বাঘের বাচ্চারা যেমন নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই করে সেরকম এটিও কি অবশ্যসম্ভাবী ছিল?
‘আপনার পরিবারে ভাইয়ে ভাইয়ে প্রায়ই লড়াই করে থাকেন। তৃণভূমিতে আপনার পূর্বপুরুষরা প্রায়ই উচ্চারণ করতেন, “সিংহাসন কিংবা কফিন” একথাটা আপনি প্রায়ই আমাকে বলতেন, মনে আছে?”
‘তবে তা দিয়ে এই ধরনের লড়াইয়ে আমার অংশগ্রহণকে সঠিক কিংবা ন্যায্য প্রতিপন্ন করা যায় না। আমি বার বার দুঃস্বপ্ন দেখেছি যে, আমার মা দারা শিকোর খণ্ডিত মাথা কোলে নিয়ে কাঁদছেন আর আমার বাবা, জাহানারাকে পাশে নিয়ে কারাগারের শিকের ফাঁক দিয়ে দুহাত বাড়িয়ে আমার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাচ্ছেন। সমস্ত মন আর শরীর কাঁপতে কাঁপতে আমি জেগে উঠি আমার সত্তার একেবারে অন্তঃস্থলে এক বিশাল শূন্যতা নিয়ে…’
‘হেকিম আপনাকে যে ওষুধ দিয়েছে সে কারণে এটা হচ্ছে। আমি জানি ওরা আপনাকে ঘুম পাড়াতে অনেক সময় আফিম মিশিয়ে দেয় আর এতে আপনি এ ধরনের অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছেন।
হয়তো তাই। তবে একজন মানুষের স্বপ্ন তার চিন্তার ফসল। এই মাসগুলোতে আমি কয়েকবার জীবন ফিরে পেয়েছি। সাম্রাজ্য যেভাবে শাসন করেছি, তাতে আমি মোটেই অনুতপ্ত নই, যদিও মাঝে মাঝে বেশ কঠোর হতে হয়েছিল। আমার প্রিয় বোন জাহানারা বলতেন বিশেষত বিধর্মীদের প্রতি আমার আচরণ কঠোর ছিল। তবে সাম্রাজ্য আর আমার ধর্মবিশ্বাসের জন্য যা সঠিক মনে করেছি তাই করেছি। একমাত্র আল্লাহই এর বিচার করবেন। তবে আমার পরিবারের প্রতি আমার আচরণের ব্যাপারে একই কথা বলতে পারবো না…হ্যাঁ, দারাকে আমি খারেজি বা নব্যতান্ত্রিক সন্দেহ করেছিলাম আর আমার বাবা তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রের স্নেহে অন্ধ হয়ে তার কোনো ত্রুটি খুঁজে পান নি। তবে আমি যা করেছিলাম তা কি করা উচিত ছিল? তাদেরকে কি বুঝাতে পারতাম না? মুরাদ আর শাহ সুজা নির্বোধ ছিলেন, তবে তাদের মেরে ফেলার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমি কি ভাল কিংবা নৈতিকতার কারণে কাজগুলো করার ভান করছিলাম না? প্রকৃতপক্ষে আমি কি একজন মোনাফেকের মতো আমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর ক্ষমতার লোভকে ঢেকে রাখছিলাম না? যা আমাকে ঠেলে নিয়ে চলছিল সুনিপুণ ভাবাবেগ নিয়ে…আমি কি আমার বাবার সিংহাসন দখল করতে উদগ্রীব ছিলাম না?
‘কেবল আল্লাহই আপনার মনের ভাবনা পড়তে পারেন।’
‘আমার ভয় হয় যখন তিনি আমার মনের কথা পড়বেন। তিনি দেখবেন একের পর এক আমি শুধু চেয়েছি। পরকাল আমার কঠিন শাস্তির আর যন্ত্রণাময় হবে।’
‘আপনার ভালোকাজগুলো নিশ্চয়ই আপনার পাপকে ঢেকে দেবে।
‘এটা কেবল আশাই করতে পারি। আর যে কদিন বেঁচে থাকবো তার অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য সচেষ্ট থাকবো। আমার পরিবারের মৃত সদস্যদের আত্মার শান্তির জন্য তাদের কবরে প্রার্থনা করে যাব। এমনকি দিল্লিতে সম্রাট হুমায়ুনের বিশাল মাজারের চত্বরে দারা শিকোর কবরও জেয়ারত করবো। তবে ঘাড়ের উপর মৃত্যুর কংকালসার হাতের স্পর্শ অনুভব করে মনে হয়, তা হয়তো যথেষ্ট নয়…সেজন্য আমার দীনতা দেখাবার জন্য ইসলামি টুপি সেলাই করে বিক্রি করবো। আর এই টুপিগুলো বিক্রি করে যে অর্থ পাওয়া যাবে তার বেশি যেন আমার মৃত্যুর পর দাফন-কাফনে খরচ করা না হয়। আমি চাই না আমার কবরের উপর বিশাল কোনো সমাধিসৌধ নির্মাণ করা হোক, ঠিক প্রথম সম্রাট বাবরের যেমন কাবুলে খোলা আকাশের নিচে কবর হয়েছে, সেরকম একটি অতিসাধারণ কবর আমার জন্য হবে। এছাড়া আল্লাহর আর তার নির্দেশের প্রতি আমার ভালোবাসা দেখাতে আমি নিজ হাতে পবিত্র কুরআনের নকল লিখতে শুরু করেছি। তারপরও আমার মনে স্বস্তি নেই।’
স্বামীকে সান্ত্বনা দেওয়া কিংবা তার মনে যে অশান্তি চলছে তা থেকে তার মন অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেবার মতো কোনো কিছু খুঁজে না পেয়ে এবার উদিপুরী মহল নিজেই কাঁদতে শুরু করলেন। তারপর তার একটি কথা মনে পড়তেই তিনি বললেন, আপনি পারিবারিক কবরগুলো জেয়ারত করতে চেয়েছিলেন। আর গতকাল বলেছিলেন সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা আরো জোরদার করার জন্য উত্তরে যেতে হবে। তাহলে ফিরতি সফরের প্রস্তুতি নেবার দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন না কেন? এতে যেমন আপনার সাম্রাজ্যের ভালোর জন্য কিছু করতে গিয়ে জাগতিক উদ্দেশ্য সাধন হবে আবার যে জায়গায় আপনি অনেক আগে ছোটবেলায় সবার সাথে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতেন, সেখানে গিয়ে আত্মার শান্তিও পাবেন। আওরঙ্গজেব একটি নিষ্প্রাণ হাসি দিলেন আর তাঁর চোখের পানিও থেমে এল। তিনি বললেন, হ্যাঁ। একজন মানুষ যতই বৃদ্ধ আর অনাচারী পাপী হোক না কেন, তার কিছু করার থাকে, বিশেষত যদি সে একজন শাসক হয়। আমি নিরাশ হব না–নিরাশ হওয়াটা পাপ। আজই রাজদরবারে ঘোষণা দেব এক সপ্তাহের মধ্যে আমরা উত্তরের দিকে যাত্রা শুরু করবো।