২১. হাসুবৌ

হাসুবৌ আমজাদকে দুপুরবেলা ডাকিয়া গেল। বাড়ি যায় নাই সে। পাড়ার এক টেরে গাছের ছায়ায় একটি গুঁড়ির উপর দুই জনে বসিল।

কেন ডেকে আনলে, আমজাদ জিজ্ঞাসা করিল।

লক্ষ্মী ছেলে, বস না– সন্দেশ কিনে দেব।

না, জলদি বল।

হাসুবৌ ইতস্তত করিতেছিল।

 মুনি, আর আসবে না?

 আমি কি জানি। মা কত কাঁদে। আব্বার সঙ্গে কথা বলে না।

হাসুবৌ বলিল, তোর আব্বা চলে গেল। মুনি ছেলেটা ভারি বদ। আমজাদ সায় দিল না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মুখচোরা ভাব কাটিয়া যাইতেছে।

বদ! তুমি ভারি ভালো?

হাসুবৌ আমজাদকে আদর করিতে লাগিল। না, সে বেশ ভালো। আমজাদ একটু দূরে সরিয়া গিয়া ব্যঙ্গ করিল, আমাকে আদর করতে হবে না। মুনিভাই নেই, তাই।

হাসুবৌ অবাক হইয়া যায়। এইটুকে ছেলে, তারও মনে ঈর্ষার ছোঁয়াচ লাগিয়াছে।

হাসুবৌ তার নিকটে সরিয়া আসিল। আবার তার চুলের উপর হাত বুলাইয়া আদর করিতে লাগিল। না, তুমি বেশ ভালো ছেলে।

আমজাদ জবাব দিল, না।

হাসুবৌ পুনরায় বলিল, যদি তুমি একটা কাজ কর, তোমাকে বেশি আদর করব।

 কি, শুনি।

একবার মুনিরকে খবর দিতে পার?

আমি কি করে দেব?

হাসুবৌ আনমনা, গাছপালার ফাঁক অতিক্রান্ত দূরের আকাশের দিকে চাহিয়াছিল।

খোঁয়াব কাটাইয়া সে আবার বলিল, তুমি তাদের গাঁয়ে যাও না।

আমজাদ অক্ষমতা জানাইল।

খুব বেশি দূর নয়। আমি গরুর গাড়ির পয়সা দেব।

মা যে বকবে।

না, স্কুলে যাওয়ার নাম করে চলে যাবে।

হাসুবৌ আঁচলের গিট খুলিয়া একটি আধুলি বাহির করিল।

এই নাও, তোমার কাছে রেখে দাও, কতক্ষণ আর লাগবে।

 মা যদি শোনে! শঙ্কিত দৃষ্টি আমজাদের চোখে।

না, কেউ বলবে না।

মহেশডাঙায় গাছপালা এত ঘন। এই জায়গাটি আরো নীরব। বাতাসের মৃদু নিনাদ ঝোপেঝাড়ে একদল বুনো পাখি কোথায় অদৃশ্য থাকিয়া হঠাৎ ডাকিয়া উঠিল।

তুমি যাবে?

হ্যাঁ। মাথা দোলাইল আমজাদ।

বেশ, লক্ষ্মী ছেলে।

হাসুবৌ সুকুমার মতি বালকের চোখের দিকে চাহিয়া আনমনা আলিঙ্গনে জড়াইল আমজাদকে। বেশ লক্ষ্মী ছেলে তুমি। মৃদুভাবে বন-ক্রোড়ের নীরবতা হঠাৎ চমক খাইতে থাকে।

বেশ লক্ষ্মী ছেলে তুমি।

আমাকে ছেড়ে দাও।

না।

মুনিভাইয়ের মতো আমার গালে কামড়ে দিও না যে, হাসুচাচি।

হাসুবৌ স্তব্ধ হইয়া আলিঙ্গন শ্লথ করিয়া দিল, দূরে সরিয়া গেল সে।

আমজাদ হাসিতে থাকে। হাসু চাচি, মুনিভাই একটা খ্যাপা। প্রজাপতি ধরে বলে, ওর রঙ তুলে গায়ের জামা রাঙাব।

নিরুত্তর হাসুবৌ।

আচ্ছা, চাচি, প্রজাপতির রঙে জামা রঙ করা যায়?

হ্যাঁ। আমি তোমার জামা রঙ করে দেব। তুমি একবার মুনির খবর এনে দাও। দেখ না, তোমার মা কত কাঁদে।

মার নামে আমজাদের করুণা হয়। দৃঢ়কণ্ঠে সে জবাব দিল, নিশ্চয় যাব। চার আনা গরুর গাড়ির ভাড়া। আমি চার আনার মুড়ি কিনব।

বেশ।

হাসুবৌ হাত বাড়াইল আমজাদের দিকে। সে তখন এক দৌড়ে অদৃশ্য হইয়া গিয়াছে।  

.

২২.

দরিয়াবিবি ছোট মেয়েটির নাম রাখিয়াছিল শরীফন। ডাকনাম শরী। শৈরমীর স্মৃতি একবার তার মনে জাগিয়াছিল বৈকি। সেই দীন-জীবনের করুণ অবসান-মুহূর্ত! ডাক নামে শৈরমীর স্মৃতি বাঁচিয়া থাক। দেশের বিশাল মানচিত্রের এক কোণে নামহীন গ্রাম্য জননীর দীন প্রচেষ্টা-জাতি-ধর্ম যেখানে মানবতার উপর নৈরাজ্যের কোনো ফণা মেলিতে পারে না।

কিন্তু গ্রামে হিন্দু-মুসলমানে দাঙ্গা বাধিবার উপক্রম হইয়াছিল।

রোহিণী চৌধুরী ও হাতেম খাঁর মধ্যে গত কয়েক বছর একটি বিঘা-পঞ্চাশের জলাশয় লইয়া মন-কষাকষি চলিতেছিল। এতদিন জলাশয় চৌধুরীদের দখলে ছিল। দলিলে হাতেম খাঁর প্রাপ্য হইলেও সে ইহার কাছে ঘেঁষিতে পারে নাই। জলাশয় জমা। লইয়াছিল কয়েকজন মুসলমান জেলে। ইহাদের ভদ্রবংশীয় মুসলমানেরা আতরাফ বলে। বিলের আয় মন্দ নয়। হাতেম খাঁ কয়েকজন আফকে হাত করিয়া খাজনা বন্ধ করিয়া দেওয়ার প্ররোচনা দিল। তাহারা সেইমত খাজনা বন্ধ করিয়াছে। রোহিণী চৌধুরী। এই শলাপরামর্শ ভালোরূপে আঁচ করিয়াছিল। তিলি-বাগদী-ডোম শ্রেণীর কৃষক হিন্দু হাত করিয়া গ্রামে তিনি দাঙ্গার প্ররোচনা দিতে লাগিলেন।

হাতেম বকশ ইদানীং ঘোরতর মুসলমান সাজিয়াছেন। তাঁর পুত্রেরা অন্দরমহলেই শরাব পান করেন। তিনি কোনো কথা বলেন না। নিজেও নামাজ-রোজার ধার ধারেন না। বর্তমানে জুম্মার নামাজের সময় হাতেম বখ্শকে মসজিদে দেখা যায়। তার কালোশাদা দাড়ি শ্বেত-খোজাফে আরো শুভ্র রঙ ধারণ করিয়াছে। শাদা পিরহান হাঁটু পর্যন্ত ঝুলাইয়া একটি আসা (ছড়ি) হাতে গ্রামের অন্ধকারে দারোয়ান সঙ্গে ঘুরিয়া বেড়ান। বৈঠক, শলা-পরামর্শ আর যুক্তির বহর। নামাজের সময় না হইলেও তিনি এত্তেলা দেন। নামাজ কাজা করা শক্ত গোনাহ। হাদিস-কোরানের সম্প্রতি এজেন্সী লইয়াছেন তিনি। গ্রামের মখতবগুলির জীর্ণ-দশা। এক পয়সা তিনি খরচ করেন নাই। বর্তমানে তিনি একটি তামদারী করিয়া গ্রামের মুসলমানদের পোলাও-কোর্মা খাওয়াইলেন। কাফের হিন্দু জমিদার মুসলমানদের সর্বস্বান্ত করিয়া ছাড়িবে, এই কথা পাকে প্রকারে প্রচারণার খোলসে বিতরণ করিতে লাগিলেন।

নিস্তেজ মহেশডাঙার জীবনে তবু চাঞ্চল্য ফিরিয়া আসিয়াছে। হিন্দুপাড়ায় রোহিণী চৌধুরীর কার্পণ্য নাই। প্রচারণা শক্তি তাঁরও কম নয়।

সাকেরকে হাতেম বখশ এতদিন আমল দিত না। তার লাঠির জোর দশ গা জানে। হাতেম বখশ দাওয়াত খাওয়াইয়া, টাকা-পয়সার ঘুষে তাহাকে ক্রয় করিয়া ফেলিল। সেও হালফিল ভয়ানক মুসলমান হইয়া উঠিয়াছে। ইমামের পেছনে ইমামের যা নিয়ত আমারও তাই বলিয়া ঈদ ও বকর ঈদে সে বছরে দুইবার মাত্র নামাজ পড়িত, সেও নামাজ শিখিতেছে। বাংলা নামাজ শিক্ষা গঞ্জ হইতে কিনিয়া আনিয়াছে ঠিকমতো আরবি উচ্চারণ হয় না, তা লইয়া হাসাহাসি করিতে গিয়া হাসুবৌ ভয়ানক তাড়া খাইল। নূতন কাক নাকি বিষ্ঠা খাওয়ার যম, এমন মন্তব্য করিয়াছিল নিরীহ বৌটি। সুপারী খাওয়া ছাড়ো, তোমার জিভ সরল হোক।

চন্দ্র কোটাল পালের গোদা সাজিয়াছে। শেখপাড়ার একজন মুসলমানের সঙ্গে জমির আল লইয়া গত বৎসর তার বচসা হইয়াছিল। রোহিণী চৌধুরীর মোসাহেবরা সেই উপলক্ষ যথারীতি কাজে লাগাইল। পাড়ায় পাড়ায় চন্দ্র কোটাল বলিয়া বেড়াইতেছে, মুসলমানেরা যদি টু-শব্দ করে, উড়িয়ে দাও তুড়ি দিয়ে।

জলাশয়ের পাশে একদিন দুই প্রজাদলে ছোটখাটো সংঘর্ষ বাধিয়া গেল। কয়েকজন জখম হইয়াছিল। আদালতে মামলা দায়ের হইল। আহতদের পয়সা নাই। চৌধুরী ও হাতেম বখশের যখন পয়সা আছে, তখন কিছুর অভাব হইবে না।

গ্রাম থমথম করিতেছে।

এমনই আসন্ন অপরাহ্নে আজহার খাঁ ফিরিয়া আসিল। কাঁধে ঝোলানো থলে, তার ভিতর মনিহারী দ্রব্য। লাটিম, আলতার ডিবা, ছোট মেয়েদের হাতের চুড়ি ইত্যাদি।

নঈমা ও আমজাদ উৎফুল্ল হইয়া উঠিল। প্রত্যেকে উপহার পাইয়াছে। আমজাদের জন্য খাতা-পেন্সিল, লাল রবার। লাটু-লেত্তি জোর করিয়া সে আদায় করিল। নঈমার সওগাত কানফুল, কয়েকটি রেশমী চুড়ি।

দরিয়াবিবির স্তব্ধতা ভাঙিয়াছে। স্বামী-স্ত্রীর মাঝখানের সেতু তেমনই যোগ-ছিন্ন। তিরিশটা টাকা আনিয়াছিল আজহার খাঁ। চার মাস সে বেকার বসিয়া থাকে নাই। তবে দোকান সে করিয়াছিল গত একমাস। দোকানদারী পোষাইল না।

দরিয়াবিবির হাতেও টাকা ছিল। ইয়াকুব দেদার খরচ করিয়া যায় এইখানে। গঞ্জের দিনে সে প্রায়ই আসে। আজহার ফিরিয়া না আসিলে, তার কোনো হাত-টান হইত না। আমজাদের স্কুলের বেতন পর্যন্ত ইয়াকুব মাস-মাস দিবে বলিয়া শুধু মৌখিক প্রতিশ্রুতি দেয় নাই, তিন মাসের টাকা অগ্রিম দিয়া গিয়াছে।

গ্রামের কথা শুনিয়া আজহার থ হইয়া গেল। আমজাদ সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণনা করিতে লাগিল পিতার নিকট। সাকের চাচা নাকি বলিয়াছে, রোজগারের মরশুম এসেছে। সে দুই জমিদারের নিকট টাকা লুটিতেছে। রোহিণী চৌধুরীকে সে আশ্বাস দিয়াছে, দাঙ্গার দিন লাঠি ধরব না, কসম করছি– ব্যাস দেখব হাতেম বখশ কত লেঠেল আনে। হাতেম বখশকে সাকের প্রতিশ্রুতি দিয়াছিল, পাঠানের বাচ্চা শেষ লাঠিখেলা দেখিয়ে যাব।

আজহার খাঁ বিলম্ব করিল না। খাওয়া দাওয়া শেষ করিয়া একদম মাঠের দিকে গেল। বাজে ঝঞ্ঝাটের চেয়ে মাঠের অবস্থা তার প্রথমে জানা দরকার। মাঠ, ফসল, তার কামধেনু। ওই বছর ফসল পাইয়াছিল বলিয়া সংসারেও শ্ৰী বজায় আছে। সকলে রবিফসলের চাষ দিতেছে। গরু-বাছুরের জুলুমের জন্যে কয়েকজন চাষি বাখারীর বেড়া প্রস্তুত করিতেছে। পটল দিবে সকলে এবার। তরমুজ গত বছর ভালো ফলে নাই। কুমড়া আর মূলোর চাষ চলিতেছে।

দেরি হইয়া গিয়াছে তার। তাহোক। নাবি ফসল হইবে। সেজন্য আজহার বেশি অনুতাপ করিল না।

চন্দ্র কোটালের সঙ্গে দেখা করা দরকার, চন্দর! মনে মনে হাসিয়া উঠিল আজহার। সন্ধ্যার পদক্ষেপে শূন্য মাঠের আইল বিচিত্র বর্ণে অদৃশ্য হইতেছে।

চন্দ্র দাওয়ায় বসিয়াছিল, আজহারকে দে অভিভাষণ জানাইল না, বসিতে পর্যন্ত বলিল না।

চন্দ্র।

সে নিরুত্তর।

এলোকেশী একটি পিড়া বাহির করিয়া আজহারকে বসিতে দিল। চন্দ্রমণি আসিল পিছু পিছু। আজহার ডাকিল, চন্দ্র!

কোনো জবাব দিতেছে না সে। এলোকেশীর দিকে ফিরিয়া আজহার বলিল, কি, আজ চন্দ্র নেশা করে বসে আছে?

এলোকেশী ভয়ানক রাগিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল : ও কী, বসে আছে যেন সং। লোক এল, কথা বল। গায়ে হিন্দু-মুসলমান ঝগড়া তো ভাইয়ের সঙ্গে কী। যতসব অপসিষ্টি, হতচ্ছাড়া তোক।

এলোকেশী বলিতে লাগিল, জমিদারে জমিদারে ঝগড়া। বড়লোকে বড়লোকে দলাদলি তোদের কী? তোদের জমিদারি দিয়ে যাবে– ওই যে বসে আছে, রোহিণী বাবু জলাশয়টা ওকে দিয়ে যাবে। তাই নিয়ে দিন-রাত টইটই হিন্দুপাড়ায় ঘুরছে।

যার উদ্দেশে বাক্যবাণ বর্ষিত হইতেছিল, সে নির্জীব মূর্তির মতো বসিয়া রহিল। বোকা-চোখ মিটমিট করিয়া সে আজহারের দিকে চাহিয়া আবার চোখ ফিরাইয়া লইল।

কল্কে সাজিয়া আনিল চন্দ্রমণি। আজহার নীরবে টানিতে লাগিল। ধোঁয়া ছাড়ার অবকাশে সে আবার ডাকিল, চন্দ্রর।

আজহার স্তিমিত হইয়া আসিতেছে। বড় ক্ষুণকণ্ঠ তার : চন্দ্রর! আমি এতদিন দেশছাড়া। জানি চন্দর আছে। বড়লোকে বড়লোকে দলাদলি, আমরা গরিবেরা কেন ওর মধ্যে?

এলোকেশী আবার এক পশলা বর্ষণ করিয়া গেল। দাওয়ায় একটা মাদুরে আড় হইয়া চন্দ্র হুঁকা পান করিতে লাগিল। ভীষ্মের শরশয্যা আরম্ভ হইল। এলোকেশীর বাণ তা হইলে ব্যর্থ হয় নাই, কিন্তু ভীষ্মদেব শরে কাতর নন, কণ্ঠস্বরে কাতর হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। একবার সে হাই তুলিল।

সন্ধ্যায় গ্রাম ছাইয়া গিয়াছে।

উঠানে নীরবতা। দূরে মাঠে বাছুর ডাকিতেছিল।

আজহার উঠিবার পূর্বে বলিল, যোগীনের মা, আবার কাল আসব, আজ ওর মেজাজ ঠিক নেই।

ভিটার উপর হইতে নামিয়া পড়িল আজহার অন্ধকার প্রলেপিত মাঠে; তার মনের মতোই শূন্য। সে বাতাসের পদ-সঞ্চালন-ধ্বনি শুনিতে লাগিল।

একবার উৎকর্ণ হইল আজহার। চন্দ্র কোটাল গাল পাড়িতেছে : না, আমার দুচোখ নেই আর মুসলমানদের দেখি– চোখ নেই।

এলোকেশী কণ্ঠস্বর তার সঙ্গে : তা থাকবে কেন? তাড়ি গিলে গিলে চোখের। মাথাও যে গিলেছে।

আবার ভর্ৎসনার শরজাল : চুপ, শালী।

এলোকেশীর জবাব : আমার বোনের সঙ্গে অত কেন। নিজের বোনকে দিয়ে এসো রোহিণীবাবুকে। এখনো তো বয়স রয়েছে- পীরিতি করবে।

আজহার হাঁটিতে লাগিল। এই একটিমাত্র আত্মভোলা মানুষকে চিনিয়াছিল, সে তার কত নিকট। এতটুকু দরদের জায়গা আর নাই তার পৃথিবীতে।

পেছনে ফিরিয়া আজহার অব্যক্ত বেদনায় কোটালের ভিটের দিকে আবার চাহিল। দুই চোখ তার জলে ভরিয়া উঠিল। দরিয়াবিবি কি মরিয়া গিয়াছে?

পরদিন বিকালে আজহার রবি-ফসলের জন্য জমি তৈয়ারি করিতেছিল। বহুদিন মূলা চাষ করে নাই সে। এইবার মূলা ও তরমুজ দেওয়া হইবে এইখানে। জমির কিনারায় শকরগঞ্জ আলু। আমজাদও সঙ্গে আসিয়াছিল। আজকাল আজহারকে সে খুব এড়াইয়া চলে। কিন্তু পিতার নিস্তব্ধ গাম্ভীর্যের সম্মুখে সে ভয়ানক ভীরু। মাঠে কাজ করা তার ভালো লাগে না। স্কুলের পড়য়া, সে কেন সাধারণ চাষির মতো এই বয়সে জমির খবরদারী করিবে?

পিতার আদেশ নীরবে পালন করে। কয়েকটি বাঁশ কাটিয়া আনিয়াছিল আজহার। আমজাদ তার বাখারী তুলিতেছিল। গরু-বাছুরের যা জুলুম, বেড়া না দিলে ফসল আদায় হইবে না।

আরেক কৃষক দূরে কর্মব্যস্ত। এক মাসে এইখানে সমীর চঞ্চল ধান-বন রঙ রেখায় মাঠগুলি সাজাইয়া রাখিয়াছিল। এখন শূন্য ক্ষেত! খামারে গাদা উঠিয়াছে। অবেলার শূন্যতার মধ্যেও তেমনি কুটির ছোঁয়া নাই। গ্রীষ্মকালে সমস্ত প্রান্তর যেন গ্রাস করিতে আসে।

আজহার সমগ্র মাঠের দিকে তাকায় না। আমজাদ নীরবে কাজ করিতেছিল।

শিস-ধ্বনি শুনিয়া সে চমকিয়া উঠিল। নিশ্চয় চন্দ্র কাকা আসছে, কয়েক বিঘা দূরেই তার জমি। খালের ঢালু পাড় হইতে চন্দ্র কোটালের অবয়ব ক্রমশ দৃশ্যমান হইতে লাগিল।

আমজাদের কাজে মন নাই। এখনি চন্দ্র কাকা আসিয়া পড়িবে। তখন হয়ত তাকে কোনো কাজই করিতে হইবে না। তার মৃদু হাস্যে কপোল রাঙিয়া উঠিতেছিল।

চন্দ্র কোটাল সোজা এই জমির দিকে আসিল না। একটি কলাগাছের আড়ালে কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া আত্মপ্রকাশ করিল। কিন্তু স্বতঃস্ফুর্ত শিস বহু আগে নিভিয়া গিয়াছে।

আমজাদই প্রথম সম্ভাষণ জানাইল, ও চন্দর কাকা। চোখাচোখি দুইজন। হাস্য। সংবরণ করিয়া অন্যদিকে মুখ ফিরাইল কোটাল।

ও কাকা।

কাকা কোনো জবাব দিল না।

আজহার কোদাল চালাইয়া জমি পরিপাটি করিতেছিল। সে মুখ তুলিয়া আবার চক্ষু অবনত করিল।

আমজাদ হাসিমুখে অগ্রসর হইতে গেল। আজহার ধমক দিল, কাজ কর, আমু।

চন্দ্র কোটাল দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। তার দৃষ্টি অন্যদিকে। আজহার নীরব, নত মুখে কাজ করিতে লাগিল। দুজনে যেন কোনো পরিচয় নাই। আমজাদ মুখ চাওয়া চাওয়ি করিতেছিল। গায়ে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বাধিবার উপক্রম হইয়াছে। তারই কী ফল এই।

চন্দ্র কোটাল জমির পাশ দিয়া ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতে লাগিল, ক্রমশ অদৃশ্য হইয়া গেল গাছপালার আড়ালে, সন্ধ্যার বেশি দেরি নাই।

আমজাদ জিজ্ঞাসা করিল, চন্দর কাকা কথা বলল না যে?

না।

 পিতার জবাবের ধাচ দেখিয়া আমজাদ আর অন্য প্রশ্ন করিল না।

শিসের আওয়াজ ভাসিয়া আসিতেছিল। নিশ্চয় চন্দ্র কাকা। আমজাদ স্বয়ং বিষণ্ণ, মাঠের দিকে বারবার দৃষ্টিপাত করিতে লাগিল।

.

২৩.

চন্দ্রমণির সঙ্গে আজহারের পথে হঠাৎ দেখা হইয়াছিল। মাঝে মাঝে চন্দ্রমণি গ্রামের ভিতরে আসে। চন্দ্রই কেবল গ্রাম-ছাড়া, তার অন্যান্য আত্মীয়েরা এখনো পূর্ব পুরুষের ভিটায় বাস করিতেছে।

আজহার অন্যমনস্ক পথ হাঁটিতেছিল। ও দাদা শব্দে সে চমকিত হইয়া প্রশ্নকর্তীর মুখের দিকে তাকাইল। না, চন্দ্রমণিকে সহজে চেনা যায় না। তার খোলস-পরিবর্তন ঘটিয়াছে। বেশ পরিষ্কার কাপড় পরনে, পানের কষে ঠোঁট দুটি রাঙা। বিধবা বলিয়া চন্দ্রমণির যেন কোনো পরিচয় নাই। আজহার চন্দ্রমণিকে কোনো যুবতী পরস্ত্রী মনে। করিয়া হঠাৎ অপ্রস্তুত বোধ করিতেছিল।

ও দাদা, আমি চন্দ্রমণি।

আজহার সেদিন বৈকালে চন্দ্রমণির এই রূপ দেখে নাই। অবাক হইয়া গেল সে। চন্দ্র কোটালের আয়-উপার্জন নিশ্চয় বাড়িয়াছে। রাজেন্দ্রের সঙ্গে ভাঁজ-নাচের দল গড়িয়া সে ভালোই করিয়াছে।

ও মণি, তুই! আমি তো ভাবছিলাম আর কেউ।

চন্দ্রমণি কিশোরীর মতো হাসিতে লাগিল। বছর আগে ম্যালেরিয়া জ্বরে কি ছিরি না হইয়াছিল তার।

তুমি আর যাও না যে দাদা!

আজহার লজ্জায় মুখ নিচু করিল।

কি রে যাই! চন্দর একদম কথা পর্যন্ত বলে না।

ও নিয়ে বৌদির সঙ্গে রোজ ঝগড়া বাধে।

চন্দ্রমণি এলোকেশীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করিল।

চন্দ্রকে সেদিন দেখলাম। ওর শরীরটা খারাপ।

রাখালেরা একপাল গরু তাড়াইয়া আসিতেছিল। চন্দ্রমণি ও আজহার পথের এক পাশ হইয়া কথাবার্তা আরম্ভ করিল।

শরীর খারাপ হবে না। কত তাড়ি গেলে। আর আজকাল দাদা কি যেন হয়ে গেছে।

কি হয়েছে?

সে মন-মেজাজ আর নেই। আমাকে দেখতে পারে না। কথায় কথায় গালিগালাজ।

খামাখা?

হ্যাঁ, দাদা।

আজহার চন্দ্র কোটালের এই অধঃপতনে কোনো দুঃখ প্রকাশ করিল না। গুম হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। আরো একপাল গরু আসিতেছে। আজহার সেইদিকে চক্ষু ফিরাইয়া বলিল, চন্দ্র আসলে ভালোমানুষ। ও কেন এমন হয়ে গেল।

কি জানি।

রাজেন্দ্রের পাল্লায় পড়েছে?

 চন্দ্রমণি হঠাৎ কোনো জবাব দিল না, চুপ করিয়া গেল।

আজহার প্রসঙ্গ-স্রোত বন্ধ করিল না : রাজেন্দ্র ছোঁড়াটা তেমন ভালো নয়। ওর সঙ্গে বশি তাড়ি গেলে বোধহয়।

না দাদা!

চন্দ্রমণি অসোয়াস্তি বোধ করিতেছিল, কণ্ঠস্বরে তার প্রমাণ।

গাঁয়ের বড় লোকদের ঝগড়া থেকে দাদার মেজাজ আরো বিগড়ে গেছে।

সত্যি, মণি। আমিও রাগে সেদিন চন্দ্রের সঙ্গে কথা বললাম না। ও মাঠে এসেছিল। আমারও মেজাজের ঠিক নেই।

চন্দ্রমণি আবার হাসিতে লাগিল। আমার দুই দাদাই পাগল।

আজহারকে রসিকতা স্পর্শও করিল না।

পুরাতন খেই টানিতে ব্যস্ত সে : আজকার রোজগার কেমন করছে।

তা, মা লক্ষ্মীর কৃপায় বেশ। নাচের দলে দুপয়সা হয়।

আজহার হঠাৎ হিংসুকের মতো বেদনা অনুভব করে। বেশ আছে চন্দ্র কোটাল।

আমি যাই দাদা, আর একদিন আসবেন।

চন্দ্রমণি আর সেখানে দাঁড়াইল না।

.

২৪.

 দুই জমিদারে মামলা বাধিয়াছে। গ্রামে আর কোনো গোলমাল নাই। সাময়িক উত্তেজনা নিভিয়া গিয়াছিল। চন্দ্র কোটাল আজহারকে এড়াইয়া চলে। দুই পরিবারে পূর্বের মতো সদ্ভাব নাই। এলোকেশী কোনোদিন ঝগড়া-কলহ পছন্দ করে না। কোটালের সঙ্গে তার মতবিরোধ প্রায় দেখা যায়। আজহার বহুদিন চন্দ্রের বাড়ির ভিটার পাশে গিয়াও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা সাহসে কুলাইয়া উঠিতে পারে নাই। সাকের আবার রোহিণী চৌধুরীর সঙ্গে খাতির পাতাইয়াছে। কিষাণেরা রবি-ফসল লইয়া ব্যস্ত। জমিদারের কোন্দলে কারো কোনো উৎসাহ নাই।

এলোকেশী একদিন স্বেচ্ছায় দরিয়াবিবির সঙ্গে দেখা করিতে আসিল। আজহার বাড়ি ছিল না, আলু-বীজ ক্রয় করিতে ভিন-গাঁয়ে গিয়াছিল।

দরিয়াবিবি রৌদ্রে বসিয়া পান্তা খাইতেছিল তখন।

এলোকেশী হাসিয়া বলিল, ঠিক সময় এসেছি।

এসো দিদি।

শশব্যস্ত দরিয়াবিবি একটা পিঁড়া আগাইয়া দিল।

কিন্তু এলোকেশী আরো ব্যস্ততা দেখাইতেছিল।

তুমি খেয়ে নাও, আমি এখখনি উঠব।

এত তাড়া কেন? ও, আমার সঙ্গে ঝগড়া আছে নাকি?

এলোকেশী হাসিতে লাগিল।

কেন, বলো দিদি। সব জায়গায় খালি কোন্দল। গাঁয়ে, আমার ঘরে।

কোটালের সঙ্গে?

হ্যাঁ।

দরিয়াবিবি যথা দ্রুত আহার সম্পন্ন করিল। এলোকেশী তারপর দশটা টাকা বাহির করিয়া বলিল, দিদি, এই টাকা কটা রেখে দিও। জমা রাখলাম।

আমার কাছে কেন?

রেখে দাও।

পরে কানে কানে ফিসফিস করিয়া সে বলিল, রেখে গেলাম। ঘরে কী রাখার জো আছে?

আজকাল নাচে বেশ পয়সা আসছে।

তা আসছে। রাজেন্দ্র ছোঁড়াটা বেশ কাজের। এখন বলে যাত্রার দল করব।

আরো সাংসারিক কথা হইতেছিল। উঠানে হঠাৎ আগন্তুকের ছায়া পড়িল। এলোকেশী লোকটিকে কখনো এখানে দেখে নাই। সে তাড়াতাড়ি ঘোমটা টানিল।

দরিয়াবিবি উঠানের দিকে চাহিয়া হাসিয়া উঠিল।

এসো ভাই। দরিয়াবিবির ঠোঁটে কৌতুক-মাখা হাসি। আগন্তুক ইয়াকুব। দরিয়াবিবি এলোকেশীর কানে কানে বলিল, আমার দেওর।

ইয়াকুব দাওয়ায় একটি মাদুরের উপর বসিয়া পড়িল। হাতে একটি পুঁটলি ছিল। সে খবরদারীর ভার দরিয়াবিবির উপর।

সব ভালো? দরিয়াবিবি জিজ্ঞাসা করিল। এলোকেশী লজ্জায় কলাবৌ সাজিয়া বসিয়া ছিল। ধমকের সুরে দরিয়াবিবি বলিল, ঘোমটা খোল না বৌ। ও আমাদের দেওর।

এলোকেশী ঘোমটা খুলিয়া ইয়াকুবকে ভালোরূপে দেখিয়া লইল।

শরীর ভালো নয়, ভাবী! আজ চার দিন জ্বর। তোমার এখানে এসে পড়লাম।

বাড়ি থেকে দুদিন-তাহলে জ্বর গায়েই বেরিয়েছ?

হ্যাঁ।

এলোকেশী বিদায় হইল।

দরিয়াবিবি জিজ্ঞাসাবাদে কসুর করে না। জ্বর গায়ে বেরিয়েছে?

হ্যাঁ।

এ কি? আর কেউ ছিল না ব্যবসার জন্য। এতক্ষণ ইয়াকুব কোনো অস্থিরতা দেখায় নাই। হঠাৎ সে চাপিয়া বলিল, ভাবী, একটু ঘুমোবার জায়গা করে দাও।

দিচ্ছি। কিন্তু আমার বোনেরা কেমন-ধারা মেয়ে! তোমার জ্বর, অথচ গঞ্জে আসতে দিল।

চুপ করিয়া রহিল ইয়াকুব। রৌদ্রের উত্তাপ তার শরীরে মনোরম লাগিতেছিল। সে বাহিরে মাথা বাড়াইয়া দিল। ছেলেদের পড়ার ঘরে দরিয়াবিবি শয্যা রচনা করিয়া ফিরিয়া আসিল। তার মুখের কামাই নাই : ভারি খারাপ কথা। তোমার জ্বর। অথচ ছেড়ে দিল। কেউ খোঁজ নেয়নি বোধহয়।

নিস্তব্ধতা যেন ইয়াকুবের জবাব। তবু সে মুখ বিকৃত করিয়া বলিল, না। খোঁজ নিয়েছিল বৈকি। আমার মাথাটায় হাত দিয়ে দ্যাখো।

দরিয়াবিবি কপালের উষ্ণতা পরীক্ষা করিল। ভারি গরম। তোমার মুখ দেখে অসুখ হয়েছে বলে মনে হয় না। উঠে গিয়ে শুয়ে পড়।

দরিয়াবিবি আবার বলিল, বাড়ির লোকগুলো কী! এত জ্বর, ছেড়ে দিল?

ইয়াকুব জবাব দিল, আমি গঞ্জ থেকে আসছি।

আসলে ইয়াকুবের মতো মিথ্যাবাদী সংসারে অল্প। দাম্পত্য-জীবনে তার সুখ নাই। প্রায়ই দুই স্ত্রী কোন্দল বাধাইয়া থাকে। তা ছাড়া তার মতো পেশাদার লম্পটের কীর্তিকাহিনী স্ত্রীদের কানেও প্রবেশ করে বৈকি।

স্ত্রীর সহিত ঝগড়া করিয়া সে ঘর ছাড়িয়া আসিয়াছিল। দরিয়াবিবি ইহার বিন্দু বিসর্গ জানে না। গ্রামের সঙ্গতিপন্ন মানুষদের মধ্যে ইয়াকুবের প্রতিপত্তি খুব বেশি। কারণ সে তাদের সমগোত্র। ধান-আলু-পেঁয়াজের কারবারে ইয়াকুব কত উপার্জন করে, তা দরিয়াবিবির অবগতির বাহিরে।

গত কয়েক মাস ইয়াকুব যাতায়াত করিতেছে। তার ভোলা মন স্বতঃই সমীহ আকর্ষণ করে। কোনো ত্রুটি রহিল না দরিয়াবিবির সেবায়। মাথায় উত্তাপ উঠিয়াছিল। ঠাণ্ডা পানি দিয়া তাহা সে ধুইয়া দিল। মোটা কাঁথা বিছাইয়া দিল তক্তপোশে। অবশ্য তা ইয়াকুবের টাকায় কেনা। গায়ে একটি তাঁতের চাদর দিল দরিয়াবিবি।

আসেকজান নিজে ঘর হইতে বাহির হয় না। সে আমজাদের নিকট খবর সংগ্রহ করিত। একটি পুরাতন শাল ছিল তার সিন্দুকে। কোনো মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি, আত্মীয়রা দান করিয়াছিল। দরিয়াবিবি চাঁদরের জায়গায় শালের আবরণ চড়াইল। বড় নির্ঝঞ্ঝাট গৃহসুখ অনুভব করিতেছিল ইয়াকুব, আমজাদ নিজে মাথা টিপিয়া দিতে লাগিল। নঈমা পিঁচুটি ভরা চোখ লইয়া কৌতূহলে সবকিছু দেখিতেছিল।

আজও ইয়াকুব কুটুম্বপনার কোনো খুঁত রাখে নাই। ছেলেদের জন্য মিষ্টান্ন ও অন্যান্য খাবার আনিয়াছিল। পুঁটলি নয়, ছেলেদের রত্ন-ভাণ্ডার। ছোট খুকির কথা পর্যন্ত ইয়াকুব ভোলে নাই। তার জন্য পাতলা জামা আনিয়াছিল।

দরিয়াবিবি পথ্য তৈয়ার করিয়া আনিল। ইয়াকুব নিস্তেজ চোখে চারিদিকে দৃষ্টিপাত করে। বড় আরাম তার।

দরিয়াবিবি বলিল, ডাক্তার ডাকাই, ভাই।

ঘোর আপত্তি জানাইল ইয়াকুব। না, এমনি সেরে যাবে। ওষুধ গেলা আমার ভালো লাগে না।

একটি নোট বাহির করিল সে, কথা ও সাগু শেষ করিয়া।

দরিয়াবিবি কোনো আপত্তি জানাইল না। কারণ এই ক্ষেত্রে অনিচ্ছা বৃথা। ইয়াকুবের হাত হইতে নিস্তার নাই। হাজার কথা বলিতে শুরু করিবে।

দুপুরে ইয়াকুব জ্বরের ঘরে উ-উ শব্দ করিতেছিল। ঘরে আর কেউ ছিল না। হঠাৎ খুট শব্দে সে জাগিয়া উঠিল। দরিয়াবিবি তার সম্মুখে।

খাঁ-পত্নী জিজ্ঞাসা করিল, শরীর ভালো?

না, ভাবী।

তারপর ইয়াকুব কাতরোক্তি আরো বাড়াইয়া কহিল, মাথা ভেঙে পড়েছে। একটু টিপে দিলে ভালো লাগে।

দরিয়াবিবি কয়েকবার আমজাদকে ডাকিল, কোনো জবাব নাই। ইয়াকুব ইঙ্গিত করিল বিছানার উপর বসিতে।

আচ্ছা, আমি টিপে দিচ্ছি। ছেলেগুলো বজ্জাত। বলিয়া দরিয়াবিবি ইয়াকুবের মাথা টিপিয়া দিতে লাগিল।

ইয়াকুব নিরুত্তর। সে নীরবে একবার চক্ষুর পাতা খুলিতেছিল, পর মুহূর্তে বন্ধ করিতেছিল।

ভাবী, তোমার কাছে বেশি ঋণ কচ্ছি।

ধার। আমি বরং–

ইয়াকুব হঠাৎ হাত তুলিয়া তার মুখে চাপা দিতে গেল। দরিয়াবিবি মুখ তার নাগালের বাহিরে রাখিয়া বলিল, ঋণ আমরাই করছি।

ইয়াকুব আবার একটি নোট বাহির করিল। তবে আর একটু ঋণ বাড়াও ভাবী। না হলে আমি মরে যাব। আমার শেষ জ্বর।

এমন মানুষ। জ্বরের বিকার নয় তো? দরিয়াবিবি নোটটা নাড়াচাড়া করিয়া ইয়াকুবের ব্যাগেই রাখিয়া দিল। নিঃশব্দে লক্ষ্য করিল ইয়াকুব, আর কোনো কথা বলিল না।

ডাক্তার ডাকি। কি বলো ভাই?

না। যদি ডাক্তার ডাকো, আমি জ্বর গায়েই বাড়ি ফিরব।

 দরিয়াবিবি নিরুপায়। বড় একরোখা ইয়াকুব, সামান্য কয়েক মাসের পরিচয়ে সে উপলব্ধি করিয়াছিল। চুপ করিয়া গেল সে।

ঘুমাইয়া পড়িল ইয়াকুব কয়েক মিনিটে। দরিয়াবিবি মাথা টেপা বন্ধ করিল। আমজাদের গলার আওয়াজ পাইয়া সে বিছানার পাশ ছাড়িয়া বাহিরে আসিল। বেশি বেলা নাই। সংসারের হাজার কাজ অপেক্ষা করিতেছে।

সন্ধ্যার একটু পূর্বে বস্তা মাথায় ফিরিয়া আসিল আজহার। পটল বীজ পায় নাই। পটল আলের দাম বেশি। তাও প্রায় শুষ্ক।

ইয়াকুব এখানে জ্বরে ভুগিতেছে। সে-সংবাদ তার কানে গেল। তার সঙ্গে সাক্ষাতের তেমন কোনো উৎসাহ দেখাইল না আজহার।

হাত-মুখ ধুইয়া, কিছু আহারের পর সে দাওয়ায় তামাক নিঃশেষ করিতে লাগিল।

দরিয়াবিবি বলিল, একবার দেখে এসো। তোমার কী একটু মেনসত্বে (মনুষ্যত্ব) নেই। কি মনে করবে।

আজহার এই ধমকে সন্তুষ্ট হয়। সংসারের কাজে দরিয়াবিবি আবার পরামর্শ করিতেছে তার সহিত। সহযোগিতার দরদই তো সে প্রত্যাশা করে। ইয়াকুবের সহিত অনেক কথা হইল। সংসার, চাষ-বাস, ছেলেদের লেখাপড়া, নঈমার চোখের অসুখ ইত্যাদি। পটল-আলের কথাও বলিল আজহার।

ইয়াকুব পকেট হইতে কুড়িটি টাকা আজহারের হাতে দিয়া বলিল, বড় ভাই, আপনি কত জায়গায় ঘুরছেন। আমার সঙ্গে ব্যবসা করুন। কোনো কিছু আটকাবে না।

আজহার নোট লইয়া বসিয়া রহিল। দ্বিধা-দ্বন্দ্বে সে গ্রহণ করিল এই দান।

 জবাব দিন।

হ্যাঁ। কত কষ্ট করছি। তোমার সঙ্গে ব্যবসা করব, সে তো ভালো কথা।

আজহার আরো গল্প ছাড়িল।

কয়েক প্রহর রাত্রি অতিবাহিত। দরিয়াবিবির ধমকে আজহার গল্প সমাপ্ত করিল।

ভাত পরিবেশনের সময় দরিয়াবিবি হাসিয়া বলিল, ওর সঙ্গে দেখা করছিলেন না, এখন যে আঠার মতো জড়িয়ে গিয়েছ?

.

২৫.

বৈশাখের এক ঝঞ্ঝা-উতোল রাত্রে আসেকজান মরিয়া গেল। কেহ খোঁজও রাখে নাই। আমজাদ অন্য ঘরে ঘুমাইত আজকাল। পরদিন অনেক বেলা হইয়া গেলে, আসেকজান উঠিল না। খোঁজ লইতে গেল দরিয়াবিবি। বৃদ্ধার ঠাণ্ডা মৃতদেহ পড়িয়া রহিয়াছে।

অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করিল দরিয়াবিবি। আমজাদ, নঈমা, আজহার বোকার মতো চাহিয়া রহিল অনেকক্ষণ। বুড়ির আত্মীয়-স্বজন কেহই ছিল না। প্রতিবেশীদের সহায়তায় দাফন-কাফন শেষ করিল আজহার।

আসেকজানের একটি পেঁটরা খোলা হইল। দশ-বারোটি খুচরো টাকা ও কয়েকখানি কাপড় পাওয়া গেল। বিশেষ লাভ হয় নাই দরিয়াবিবির। কাফনেই দশ টাকা গিয়াছে।

এই অসহায় বৃদ্ধার কথা বারবার মনে পড়ে দরিয়াবিবির। তার জীবনের পরিসমাপ্তি কিরূপে ঘটিবে, সে কি জানে? হয়তো এমন অপমৃত্যু তারও কপালে লেখা আছে। কতদিন হইল শৈরমী মরিয়া গিয়াছে। কত দিন!

এক সপ্তাহে আসেকজানের নাম মিটিয়া গেল এই বাড়ি হইতে। চতুর্থ দিনে পাড়ার দুইজন ভিক্ষুককে খাওয়াইয়া দাওয়াইয়া দরিয়াবিবি চালাম সমাপ্ত করিল।

আমজাদ কিন্তু ভয়ে একা ঘুমাইতে পারিল না কয়েকদিন। মোনাদির নাই কাছে। নিজের ছোট কুঠরীতে শুইতে তার বড় ভয় লাগে।

দরিয়াবিবি ধমক দিয়া বলিল, ভয় কি, ব্যাটা। তোমার দাদি আম্মা তার ভেস্ত নসিব করেছে। ভয় কী?

আমজাদের তবু ভয় কাটিল না।

কয়েকদিন দরিয়াবিবি শরীফনকে লইয়া আমজাদের ঘরে আস্তানা পাতিল।

স্কুলে পণ্ডিতের মুখে আমজাদ ভূতের কাহিনী শুনিয়াছিল। মন হইতে তা সহজে মুছিয়া যায় না।

মাকে সে জিজ্ঞাসা করিল, মা, মরে গেলে ভূত হয় মানুষ?

যারা খারাপ লোক, তারা ভূত হয়।

 আসেক দাদি কি হয়েছে?

 ছিঃ ভয় কি, আমু। সে ভালো মানুষ। আল্লা তার ভেস্ত নসিব করেছে।

 ভালো মানুষ আবার পরের বাড়ি খায়!

 গরিব ছিল যে। গরিব।

 দরিয়াবিবি ঈষৎ বিচলিত হয় মনে মনে। জবাব যেন ছেলের মন মতো হয় নাই।

আমার ভয় করে। দাদি রাত্রে পাশে ঘুমায়।

থুথু-কুঁড়ি ছড়াইল দরিয়াবিবি পুত্রের গায়ে।

তার পাশে শুয়ে এত বড় হলে কিনা, তাই মনে হয়।

আমার ভয় করে কেন, মা?

বেটাছেলে। তোর বুকের পাটা নেই।

 ইস।

আমজাদ তবু রাত্রে দরিয়াবিবির কোল ঘেঁষিয়া ঘুমাইত। বাহিরে কাঁঠাল গাছের বনে বনে দমকা বাতাস লাগিলে সে মাকে জড়াইয়া ধরিত। গোরস্তান হইতে আসেকজান দাদি লাঠি হাতে কারো চল্লিশা খাইতে যাইতেছে।

ব্যাপারটা আজহারের কানে গেলে সে একদিন আমজাদকে মখতবের মৌলবী সাহেবের কাছে লইয়া গেল। তিনি ফুক দিয়া দিলেন। সঙ্গে এক গ্লাস পানি-পড়া। গোটা একটি টাকা বাহির হইয়া গেল দুই ফুকের ঠেলায়।

মৌলবী সাহেব জুম্মাবারে আর একবার আমজাদকে আসিতে বলিল, আজহার তা শুনিল মাত্র। আবার এক টাকার বন্দোবস্ত আর কি। আজহার মনে মনে যোগ করিল।

আমজাদের ভয় সহজে কাটিল না। আজকাল সন্ধ্যায় একা একা সে দাওয়ায় বসিয়া থাকিতে পারে না। কিন্তু মার কাছে সে সব চাপিয়া গেল। বাগাড়ম্বরে তার বুকের পাটা কয়েক মাইল চওড়া।

আমজাদের ভয় গেল অন্য এক ঘটনার ধাক্কায়।

আজহারের হাতে ইয়াকুবের দেওয়া টাকা ছাড়া আরো কিছু টাকা জমিয়াছে। আসেকজানের একটি ছোট বাক্স তার কাছে গচ্ছিত ছিল। দরিয়াবিবি তাহা জানিত। ভিতরে আরো গোটা কুড়ি টাকা ছিল। এই ব্যাপার ঘুণাক্ষরে দরিয়াবিবি কানে ইমামের কথা ঠিক নয়।

লা-মজহাবীরা খুব সন্তুষ্ট। সভায় তাদের দলে আনন্দের গুঞ্জন শুরু হয়। কিন্তু হানাফিরা মৌলানার উপর চটিয়া উঠিতেছিল।

প্রথম মৌলানা আবার বলিলেন, চুপ করুন। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যক্তি চুপ করার বান্দা নন।

কোন দলিলে এমন আজগুবি কথা পেয়েছো? তিরমিজী শরীফে আছে, হযরত আলীর দাড়ি নাভি পর্যন্ত নয়।

ঝুট তোমার তিরমিজী।

হানাফিরা তাহাদের মৌলানার সমর্থক। তাহারা আর চুপ থাকে না। সভায় ফিসফাস শব্দ শুরু হয়।

চুপ করুন।

না, আমি চুপ করব না।

বেয়াদব।

কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটি চলিল। তুমুল বাক-যুদ্ধ।

প্রথম মৌলানার ধৈর্য আর টেকে না। তিনি চিৎকার করিয়া বলিলেন, তুমি বেয়াদবের বাচ্চা।

তবে রে হারামজাদা।

দ্বিতীয় মৌলানা অতর্কিত উঠিয়া প্রথম মৌলানা শাহ ফখরুদ্দিনের গালে এক চড় মারিলেন।

দ্বিতীয় মৌলানা হেফজুল্লা সাহেব প্রাথমিক তাল সামলাইয়া ধরিলেন ফখরুদ্দিনের দাড়ি। তারপর ঠাস এক চড়।

শেষে দুইজনে পরস্পরের দাড়ি ধরিয়া চুলাচুলি শুরু করিল। সভায় হট্টগোল। দুই দল সমর্থক ছুটিয়া আসিল। মৌলানাদের দ্বন্দ্ব মুরীদানদের মধ্যেও হাতাহাতির সুযোগ খুলিয়া দিল।

মারো শালা- লা-মজহাবীদের-মারো শালা- হানাফিদের– ওয়াজের মজলিশে ধর্মপ্রাণ মুসলমান ভ্রাতারা হঠাৎ খিস্তী বয়ান শুরু করিলেন।

হাতেম বখশ এতক্ষণে সক্রিয়। প্রথম মৌলানার সমর্থনে তিনি চিৎকার করিতে লাগিলেন। হাতাহাতি থামিল না দেখিয়া তিনি অন্ধকারে গা আড়াল দিলেন। ইজ্জত বাঁচাইলেন চতুরজনের মতো।

আজহার খাঁও এই ওয়াজের মজলিশে আসিয়াছিল। সে নিরীহ ব্যক্তি কিন্তু এই ব্যাপারে সে পাক্কা মুসলমান। এমন বর্বর হইয়া উঠিতে পারে সে হাত আজহার কম চালায় নাই। মজলিশের বাতি নিভিয়া গিয়াছিল। মনের সুখে সে হাতের সাধ মিটাইল। গলা-ফাটা চিৎকার করে সে : শালা হানাফিদের খতম করে দাও। কে বলিবে, আজহার নিতান্ত বেচারা মানুষ। পাকা মুসলমান। ধর্মের অপমান সে সহ্য করিতে পারে না।

দাড়ি লইয়া বিরোধ বাধিয়াছিল। সভা শেষে অনেকে আস্ত দাড়ি লইয়া ঘরে ফিরিতে পারিল না, কয়েকজন জখম হইল। শুধু তাই নয়, দুই গ্রাম দুই শিবিরে পরিণত হইল।

পরদিন লা-মজহাবী পাড়ার লোক হানাফিদের সুযোগ পাইয়া মার দিল। হানাফিরা তার পাল্টা প্রতিশোধ লইল। মৌলানাগণ সেনাপতিরূপে এই গ্রাম-যুদ্ধ পরিচালনা করিতে লাগিলেন। কিন্তু ফিল্ড-মার্শালদের ফিল্ডে দেখা গেল না। তাহারা সদর অন্দরে অবস্থান করিয়া কচি মুরগির আস্বাদ লইতেছিলেন, সঙ্গে পোলাও পরোটা বাদ পড়ে নাই।

এক সপ্তাহ গ্রামে এই অবস্থা। আরো কতদিন কাটিত, কে জানে। সাকের এই সময় সকলের একটি উপকার করিল। প্রথম দিন সেও হুজুগে মাতিয়াছিল। পরে মৌলানাদের কীর্তি সে বুঝিতে পারে। ইহারাই এত গোলমালের খুঁটি। ভয়ানক চটিয়া গেল সে।

লাঠি হাতে সে প্রথমে হানাফি পাড়ায় উপস্থিত হইল। সে পাড়ায় প্রবেশের আগেই চিৎকার করিতে লাগিল : আমি মারামারি করতে আসিনি, যদিও আমার হাতে লাঠি আছে।

অন্যান্য প্রতিবেশী মজা দেখিতে দাঁড়াইল। এই গোয়র লোকের সঙ্গে লাঠিবাজি করিতে কেহ সক্ষম হইবে না।

দহলিজ হইতে সে এক মৌলানাকে কান ধরিয়া টানিয়া আনিল। তারপর দুই চড় ও এক লাঠির ঘা দিয়া বলিল : নিকালো হিয়াসে কাইজ্যা বাধাতে এসেছো, শালারা। চশমখোর শালারা নিজের রাগ সামলাতে পারে না। কুকুর-কুকুর। আবার মুরীদ করতে এসেছে।

মৌলানার মুরীদগণ স্তব্ধ। হুজুরের দুর্দশার মুখে কেহ ছুটিয়া আসিল না।

সাকের নিজে ওহাবী। নিজের পাড়ায় এক মৌলানাকে ভয়ানক চাবুক বাজির পর হাঁকাইয়া দিল।

গ্রাম হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল। প্রথমে কয়েকজন সাকেরের উপর অসন্তুষ্ট হইয়াছিল, পরে দুই হাত তুলিয়া শোকর। মেয়েমহলের অনেকে সাকেরের জন্য আল্লাহর দরগায় দোয়া প্রার্থনা করিল। ছেলেপুলে লইয়া এতদিন শান্তি ছিল না। কখন কে জখম হয়। অনেক মেয়ের বুকের ধুকধুকানি ভাব এতদিনে গেল।

গ্রাম দুই দিনে স্বাভাবিক।

আজহার প্রকৃতিস্থ হইয়াছে পুনরায়। এই কয়দিন দরিয়াবিবি পর্যন্ত তার চেহারা দেখিয়া মনে মনে ভয় পাইত। ধর্মের নামে সে যেন জানোয়ার বনিয়া যায়, অথচ আর কখনো তার এই তেজ চোখে পড়ে না।

সুযোগ বুঝিয়া দরিয়াবিবি একদিন ব্যক্ত করিয়া বলিল, যখন কেউ বিনা দোষে তোমার উপর জুলুম করে, তখন তো ভিজে বিড়াল সেজে বসে রইলে।

হুঁ।

দরিয়াবিবি ব্যঙ্গ-শব্দ করিল, হুঁ।

তারপর সে সাকেরের পৌরুষের প্রশংসা আরম্ভ মাত্র আজহার নিঃশব্দে মাঠের দিকে চলিয়া গেল।

আমজাদ বহু পূর্বে মাঠে গিয়াছে। স্কুলের ছুটি। তার লজ্জা লাগে মাঠের কাজে। কিন্তু বাড়ির দুর্দশা দেখিয়া পিতাকে সাহায্য করিতে বেশ আনন্দ পায়। যদিও পিতার উপর তার শ্রদ্ধা দিনদিন কমিয়া যাইতেছে। তার আব্বা যেন কি রকম!

জমির এক কোণে লঙ্কাচারা রোপণের জন্য মাটি তৈয়ারি হইতেছিল। লাঙল হইয়া গিয়াছে। এখন শুধু পরিপাটি বাকি।

বেড়া দিতে হইবে মজবুত করিয়া। গরু ছাগলের উৎপাত লঙ্কা গাছের উপর বেশি। সারি বন্দী চারা পুঁতিবার জন্য আইল সোজা করিতে হইবে।

আমজাদ এইসব কাজ খুব ভালোবাসে। ছোট কোদাল লইয়া সে সোজা রেখাকার মাটি সাজাইতেছিল। এই সময় পশলা বৃষ্টি হইয়া গেল, পানি-বওয়ার মেহনত দরকার হইল না।

হঠাৎ আজহারকে দেখিয়া সে উফুল্ল হয় না।

অমনি বলে, আব্বা।

আব্বা, তুমি অনেক কাজ এগিয়ে রেখেছে, দেখছি।

হ্যাঁ আব্বা।

 বেশ।

 এবার লঙ্কা হলে হাটে নিয়ে যাব না। আমাদের সারাবছর কিনতে হয়।

কিন্তু তখন হাত টান থাকলে তুমি কি তা মনে রাখবে?

লজ্জিত হয় আজহার মন্তব্যে। সত্যি তার খেয়াল থাকে না তখন। অথচ ক্ষেতের ফসল বেচিয়া দিয়া সারা বছর মুদির দোকানের দিকে চাহিয়া থাকিতে হয়।

না, এবার আর বেচব না আল্লা চায়-তো।

থামিয়া গেল আজহার। হাতে টাকা আছে, তবু খটকা তার মনে। আল্লার করুণা মুছিয়া যাইতে কতক্ষণ।

দিনের আলো নিভিয়া আসিতেছে। মাঠের রূপ বদলাইয়া যায়। পিতা-পুত্রে রবি ফসলের টুকিটাকি কাজ করে।

হঠাৎ গানের আওয়াজ শোনা গেল।

পিতা-পুত্র উৎকর্ণ। গানের কলি দোহরাইয়া গায়ক গাহিতেছে :

ভগবান, তোমার মাথায় ঝাঁটা,
ও তোমার মাথায় ঝাঁটা।
যে চেয়েছে তোমার দিকে
তারই চোখে লঙ্কা-বাটা।
ও ছড়িয়ে দিলে, ছড়িয়ে দিলে
মারলে তারে তিলে তিলে
ও আমার বৃথা ফসল কাটা
ও তোমার মাথায় ঝাঁটা।

কণ্ঠস্বর পরিচিত।

আজহার আবার নিজ মনে কাজ করিতে লাগিল।

চন্দ্ৰকাকা, না আব্বা?

আজহার কোনো জবাব দিল না। আমজাদ মাঠের দিকে চাহিয়াছিল। গায়কের অবয়ব তখনো দৃষ্টির বাহিরে।

আনমনা আমজাদ। আজহার লক্ষ করে। কাজের গাফিলতি সে পছন্দ করে না।

কাজ কর, আমু।

চন্দ্ৰকাকা, না?

হুঁ, তা কি করতে চাও?

পিতার কণ্ঠস্বর উষ্ণ। আমজাদ মাথা হেঁট করিয়া ক্ষেতের লঙ্কাচারা বসায়। আড়চোখে মাঠের দিকে চাহিয়া থাকে।

যে চেয়েছে তোমার দিকে
তারই চোখে লঙ্কা বাটা।

গান পুনরায় শুরু হইয়াছে।

আমজাদ হাসিয়া বলে, আব্বা, চন্দ্র কাকা পাগল। ভগবান মানে আল্লা না, আব্বা?

কাজ কর।

ধমক দিয়া উঠিল আজহার।

কলাবনের আড়াল হইতে মেঠোপথে চন্দ্র বাহির হইল। কণ্ঠস্বর নিকটবর্তী হইতেছে। আমজাদ মনে মনে খুশি হয়। কিন্তু আনন্দ আর বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। চন্দ্ৰকাকা আর এদিকে আসিবে না। হিন্দু-মুসলমান ঝগড়া। নিকুচি করি ঝগড়ার, কি-সব বাজে কথা। আমজাদ ভিতরে তাতিয়া উঠে।

আজহার আবার আনমনা আমজাদকে কাজে মনোযোগ দিতে বলিল।

গায়ক এইদিকে আসিতেছে। আড়চোখে আমজাদ দেখিল, আজ চন্দ্র কোটাল জমির বেড়ার ওপারে থমকিয়া দাঁড়ায় নাই। সে তাহাদের দিকেই ক্রমশ অগ্রসর হইতেছে। আরো নিকটে, ঠিক তাহাদের পাশে আসিয়া দাঁড়াইল চন্দ্র কোটাল।

আজহার চুপচাপ কাজ করিয়া যাইতেছে। কোটালের উপস্থিতি যেন সে অবহেলা করিতে চায়। পিতার ভয়ে আমজাদ তাহার দিকে তাকায় না।

তিনজনে নিস্তব্ধ। এমন অসোয়াস্তিকর মুহূর্ত কারো জীবনে যেন আসে নাই। কোটাল হঠাৎ বোকার মতো হাসিয়া উঠিল। আমজাদ তার দিকে একবার আড়চোখে চাহিয়া মাটি খুঁড়িতে লাগিল। হাসি পায় তার। শুধু পিতার ভয়ে চুপ করিয়া আছে।

–আজহার ভাই, ও খাঁ সাহেব। বলিয়া চন্দ্র থামিয়া গেল। অপরপক্ষ তখনো নীরব।

এই চাচা, তোমার বাবা এবার বোবা হয়ে গেছে নাকি?

 বোবা বাবা। ও-কার আর আ-কার।

চন্দ্র আমজাদকে লক্ষ্য করিয়া বলিল।

আজহার বিন্দুমাত্র নড়িল না। তার হাতের কাজ অবশ্য স্তব্ধ। তারপর খিলখিল হাসিয়া চন্দ্র হঠাৎ দণ্ডায়মান আজহারের ঠিক পায়ের সম্মুখে উবু হইয়া বসিয়া তার চোখের দিকে তাকাইল। চোখে চোখ পড়ে। কোটালের হাসি সংক্রামক। আজহার না। হাসিয়া পারে না।

চন্দ্র তখন তুড়ি দিয়া এক লাফে উঠিয়া আমজাদকে কাঁধে তুলিয়া লইল। আমজাদ আজকাল বড় হইয়াছে। কাঁধে উঠিতে তার লজ্জা লাগে। কিন্তু বারণের অবসর কোথায়। এতক্ষণে সে শূন্যে।

চন্দ্র নাচিতে নাচিতে বলে, ধৰ্ম্ম-উম্ম আমি মানি নে। যতসব বেজন্মাদের কীর্তি। গান ধরিল সে,

ভগবান, তোমার মাথায় ঝাঁটা,
ও তোমার মাথায় ঝাটা।

তারপরই সে বলে, আজহার ভাই, আমি ভাবতাম আমাদের সাত রকম জাত আছে। তোমাদেরও তাই। ঠিক করেছে সাকের। আমাদের শালা পুরুত ঠাউর (ঠাকুর) আর তোমাদের ওই–।

কথা শেষ করিতে পারে না সে। খিলখিল হাসির শব্দে বেলাশেষের মাঠ ভরিয়া ওঠে।

সুইৎ শব্দে আমজাদকে কাঁধ হইতে নামাইয়া সে বলিল, তামাক দাও।

অন্য কারো কথা বলার অবসর নাই।

চন্দ্র আবার কহিল, আমাদের পুরুত এলে আমিও দাড়ি ছিঁড়ে লেঙ্গা। ধর্মের নিকুচি। যতসব চালবাজি শালাদের ঝগড়া লাগানোর।

আজহার এতক্ষণে মুখ খুলিল, এই পাগল চন্দর।

ঝাঁকড়া-চুল মাথা নাড়িয়া চন্দ্র পদবী গ্রহণ করিল। তারপর আমজাদের দিকে চাহিয়া সে বলিল, চাচা, তোমার বাবার দাড়ি ছিঁড়ে লেঙ্গা।

তিনজনে দম ভরিয়া হাসিতে থাকে এইবার।

আজহার জিজ্ঞাসা করিল, চন্দ্র, তোমার হয়েছিল কি এতদিন?

ভূতে ধরেছিল।

একদম মামদো ভূত।

 হ্যাঁ, খাঁ ভাই। আমার চোখ খুলে গেছে কাল।

কাল!

হ্যাঁ।

হঠাৎ স্তব্ধ হইয়া যায় চন্দ্র। তার মুখাবয়বে থরথর কম্পন দেখা যায়। অশ্রুসজল চোখ।

আজহার ভাবে, কি হইল চন্দরের। এ আবার কোন রকম পাগলামি! এতক্ষণ তো সে হাসিতেছিল।

চন্দ্র পাথর। তার চোখ দিয়া অশ্রুর ফোঁটা ঝরিতেছে।

কি হলো, চন্দর?

আজহার নিকটে আসিয়া সমব্যথা মাখা দুই হাত বাড়াইল।

কি হয়েছে?

শালতরু যেন শিলীভূত।

কি হয়েছে?

 শিবু, ইসমাইল সদরের হাসপাতালে মারা গেছে।

মারা গেছে।

আজহারের মুখে আর কোনো কথা নাই। সেও বজ্রাহত, স্তব্ধ হইয়া গেল।

জলকর লইয়া দাঙ্গার সময় শিবু ও ইসমাইল বেশ জখম হইয়াছিল। সদর হাসপাতালে ছিল তারা এতদিন। দুইজনে খুব পরিচিত বন্ধু।

অনেকক্ষণ চুপচাপ বসিয়া থাকে তিনজন। সন্ধ্যার কালিমালেপন শুরু হইয়াছে দিকদিগন্তরে।

ফোঁপাইয়া উঠিল চন্দ্র, ওদের বাড়িতে কি কান্না। শিবুর বৌ ছেলেপুলে নিয়ে হয়ত খেয়ে মরবে। রোহিণী আর হাতেম শালার কি আসে যায়। আমার চোখ খুলে গেছে কাল সদরের হাসপাতালে।

ফোঁপাইতে থাকে চন্দ্র, কথা শেষ হয় না।

আজহার নির্বাক। চন্দ্র আর কোনো কথা বলিল না, নির্জীবের মতো বসিয়া রহিল।

সন্ধ্যার অন্ধকারে আর কাহারো মুখ দেখা যায় না। নিস্তব্ধতা প্রথম ভাঙিয়া আজহার বলিল, চল চন্দর, বাড়ি চল।

চন্দ্র কোনো জবাব না দিয়া উঠিয়া পড়িল। আর কোনো বাক্যালাপ করিল না মাত্র। সে মাঠের পথ ধরিয়াছে।

পিতা-পুত্র হতবাক। তাহারা গ্রামের পথে অগ্রসর হইল। আমজাদের অসোয়াস্তি, বহুদিন পরে চন্দ্র কাকার সঙ্গে দেখা। কিন্তু সন্ধ্যাটি আজ মাঠেই মারা গেল।

কাঠা দশেক জমি পার হইয়া আমজাদ শুনিতে পায় চন্দ্র কোটাল যেন গান ধরিয়াছে।

আজহার বলে, সত্যি পাগল চন্দর। তাড়ি গিলেছে বোধহয়।

না, আব্বা। মুখে গন্ধ নেই একদম।

সায়ং-আচ্ছন্ন মাঠের প্রান্তরে মেঠো সুর বাতাসের আলিঙ্গনে ভাসিয়া যায়। আমজাদের শ্রুতিভ্রম মাত্র।

ভগবান, তোমার মাথায় ঝাঁটা
ও তোমার মাথায় ঝাঁটা
যে চেয়েছে তোমার দিকে
 তারই চোখে লঙ্কা বাটা।
ও তোমার মাথায় ঝাঁটা।

আমজাদের কান সুরের অন্বেষণে চলে।

হঠাৎ সে জিজ্ঞাসা করিল, আব্বা, ভগবান মানে আল্লা, না?

আজহার ঠাণ্ডা কণ্ঠে জবাব দিল, হ্যাঁ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *