২১. হারমিওন-এর সিক্রেট

২১. হারমিওন-এর সিক্রেট

ভয়াবহ ঘটনা খুবই ভয়ের … আশ্চর্য ওদের কেউই মারা যায়নি এরকম আগে কখনও শোনা যায়নি বজ্রপাতে, সৌভাগ্যের কথা আপনি সেখানে ছিলেন, স্নেইপ …

ধন্যবাদ মন্ত্রীমহোদয়।

অর্ডার অফ মার্লিন, সেকেন্ড ক্লাস, ফার্স্ট ক্লাস, যদি আমি ওটা আদায় করতে পারি!

আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ, মন্ত্রীমহোদয়।

আপনার এখানে খুবই গভীরভাবে কেটে গেছে … নিশ্চয়ই ব্ল্যাক-এর কাজ আমার তাই ধারণা?

আসল কথা হচ্ছে, পটার, উইজলি এবং গ্রেঞ্জার-এর কাজ এটা …

না!

ওদেরকে জাদু করেছিল ব্ল্যাক, সঙ্গে সঙ্গে আমি ওটা বুঝতে পেরেছিলাম। কনফস চার্ম, ওদের আচরণ দেখেই বোঝা গিয়েছিল। এটা মনে হচ্ছিল যে ওরা ভাবতে শুরু করেছে ব্ল্যাক-এর নির্দোষ হওয়ার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। ওদের আচরণের জন্য ওরা দায়ী ছিল না। অন্যদিকে, ওরা হস্তক্ষেপ করার ফলে ব্ল্যাক পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল অবশ্য ওরা ভেবেছিল যে ওরা নিজেরাই ব্ল্যাককে ধরে ফেলবে। এর আগে এ ধরনের অনেক কাজ করে ওরা পার পেয়ে গিয়েছে … আমার ভয় হচ্ছে এর ফলে নিজেদের সম্পর্কে ওদের খুব উচ্চ ধারণা সৃষ্টি হয়েছে এবং নিশ্চয়ই পটারকে হেডমাস্টার অস্বাভাবিক মাত্রায় স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছেন

আহ, বেশ, স্নেইপ আপনি জানেন, হ্যারি পটার ওর সম্পর্কে কথা উঠলেই আমাদের একটা বিশেষ বিবেচনা কাজ করে।

এবং তারপরও এই মাত্রায় বিশেষ সুবিধা দেয়াটা ওর জন্য কী ভালো? ব্যক্তিগতভাবে, ওকে আমি আর দশটা ছাত্রের মতোই দেখি। এবং এমন ক্ষেত্রে অন্য যেকোন ছাত্রকে স্কুল থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হতো–নিদেনপক্ষে নিজের বন্ধুদেরকে বিপদের মুখে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। বিবেচনা করন মন্ত্রীমহোদয়, স্কুলের সমস্ত নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে তার নিজের নিরাপত্তার জন্য যত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল তার বিরুদ্ধে গিয়ে, রাতের বেলায় একজন খুনি আরেকটা ওয়েরউলফ-এর সঙ্গে মিলে এবং আমার বিশ্বাস করার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে যে সম্প্রতি সে অবৈধভাবে হগসমিডেও যাতায়াত করছে

বেশ, বেশ ব্যাপারটা আমরা দেখব স্নেইপ, আমরা দেখব ছেলেটা নিঃসন্দেহে বোকামিই করেছে …।

বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে সবই শুনতে পাচ্ছে হ্যারি। নিজেকে বিধ্বস্ত মনে হচ্ছে তার। যে কথাগুলো শুনছে, মনে হচ্ছে কান থেকে খুব ধীরে ধীরে মগজে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে, বুঝতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। নিজের হাত–পাগুলো মনে হচ্ছে শীসার মতো ভারি; চোখের পাতা এত ভারি যে খোলাই যাচ্ছে না মনে হচ্ছে এই আরামের বিছানায় সারা জীবন সে শুয়েই থাকবে

আমাকে সবচেয়ে বেশি যেটা অবাক করেছে, সেটা হচ্ছে ডিমেন্টারদের আচরণ ওরা কেন ফিরে গেল সে সম্পর্কে আপনার আসলেই কী কোন ধারণা নেই, স্নেইপ?

না, মন্ত্রীমহোদয়। যখন আমার জ্ঞান ফিরেছে ততক্ষণে ওরা পিছু হটে স্কুলের গেটগুলোতে ওদের জায়গায় আবার অবস্থান নিয়েছে …

অসাধারণ। এবং তারপরও ব্ল্যাক, এবং হ্যারি এবং মেয়েটি।

আমি যখন ওদের কাছে পৌঁছলাম সবাই তখন অজ্ঞান। ব্ল্যাককে বেধে ফেলে ওর মুখ আটকে দিলাম, জাদু করে স্ট্রেচার এনে সবকটাকে নিয়ে সোজা প্রাসাদে ফিরে এলাম।

সবাই নিশ্চুপ। হ্যারির এতক্ষণে মনে হচ্ছে যেন তার মাথাটা খুলছে, এবং যতই তার বোধশক্তি ফিরে আসছে মনে হচ্ছে তার পাকস্থলীর গভীর থেকে উঠে আসছে যন্ত্রণার অনুভূতি

চোখ খুলল হ্যারি।

সবকিছু আবছা দেখাচ্ছে। চোখ থেকে কেউ ওর চশমাটা খুলে নিয়েছে। অন্ধকারে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে সে। ওয়ার্ডের শেষ মাথায় দেখা যাচ্ছে ওর দিকে পেছন ফিরে রয়েছেন মাদাম পমফ্রে, ঝুঁকে আছেন একটা বিছানার উপর। চোখ সরু করে দেখার চেষ্টা করল হ্যারি। মাদাম পমফ্রের হাতের নিচ দিয়েদেখা গেল রন-এর লাল চুল।

বালিশের উপর মাথাটা ঘোরালো হ্যারি। ওর ডান দিকের বিছানায় শুয়ে আছে হারমিওন। চাঁদের আলো পড়েছে ওর উপর। চোখ খোলা। দৃষ্টি ভীতসন্ত্রস্ত, এবং যখন সে দেখল হ্যারি জেগে গেছে, ঠোঁটের উপরে আঙুল চেপে চুপ করে থাকার ইশারা করল, আঙুল দিয়ে দেখাল ওয়ার্ডের দরজাটা। দরজাটা সামান্য ফাঁক করা, বাইরের করিডোর থেকে কর্নেলিয়াস ফাজ এবং স্নেইপ-এর আলোচনার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।

দ্রুত হেঁটে হ্যারির বিছানার পাশে চলে এলেন মাদাম পামফ্রে। মাথা ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকাল হ্যারি। ওর হাতে চকলেট। হ্যারি জীবনে কখনো এতবড় চকলেট দেখেনি। মোটামুটি ছোটখাট একটা গোলগাল পাথরের চাইয়ের সমান।

এই যে, জেগে গেছ! দ্রুত বললেন তিনি। বিছানার পাশের টেবিলে চকলেটটা রাখলেন। ছোট্ট একটা হাতুড়ি দিয়ে ওটা ভাঙতে শুরু করলেন।

রন কেমন আছে? হ্যারি এবং হারমিওন বলল এক সাথে।

ও বাঁচবে, গম্ভীর মুখে বললেন তিনি। তোমাদের দুজনের কথা অবশ্য আমি যতদিন পর্যন্ত সন্তুষ্ট না হচ্ছি তোমাদের ব্যাপারে ততদিন পর্যন্ত এখানেই থাকতে হবে–পটার, কি করছ তুমি, ভেবেছ কী?

বিছানায় উঠে বসেছে হ্যারি, চোখে চশমা দিল, হাতে তুলে নিল জাদুর কাঠিটা।

আমাকে হেডমাস্টারের সঙ্গে দেখা করতে হবে, বলল সে।

পটার, মধুর স্বরে বললেন মাদাম পমফ্রে, কোন অসুবিধা নেই, সবকিছুই ঠিক হয়ে গেছে। ওরা ব্ল্যাককে ধরে ফেলেছে। উপর তলায় ওকে আটকে রাখা হয়েছে। এখন থেকে যেকোন সময়ে ডিমেন্টররা ওর উপর ওদের কুখ্যাত কিস প্রয়োগ করবে

কী?

বিছানায় থেকে লাফিয়ে নামল হ্যারি; হারমিওনও ঠিক তাই করল। অবশ্য ওর চিৎকারটা বাইরের করিডোর থেকে শোনা গেল; পরমুহূর্তেই কর্নেলিয়াস ফাজ এবং স্নেইপ ঢুকলেন ওয়ার্ডে।

হ্যারি, হ্যারি, কী হচ্ছে এসব? বললেন ফাজ, ওকে উত্তেজিত দেখাচ্ছে। তোমাকে এখন শুয়ে থাকতে হবে–ওকি কোন চকলেট খেয়েছে? উদ্বেগের সাথে মাদাম পমফ্রেকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি।

শুনুন মন্ত্রীমহোদয়! বলল হ্যারি। সাইরিয়াস ব্ল্যাক নির্দোষ! পিটার পেট্টিগ্রু নিজেই নিজের ভুয়া মৃত্যু ঘটিয়েছে! আজ রাতে আমরা ওকে দেখেছি। আপনারা ডিমেন্টারদেরকে ব্ল্যাক-এর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিতে পারেন না, সে

মাথা নাড়ছেন ফাজ, মুখে মৃদু হাসি।

হ্যারি, হ্যারি, তুমি বিভ্রান্ত, তুমি একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিয়ে এসেছে, শুয়ে পড় এখনই, সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ..।

আপনাদের নিয়ন্ত্রণে নেই! চিৎকার করল হ্যারি। আপনারা ভুল লোককে ধরেছেন!

মন্ত্রীমহোদয় প্লিজ শুনুন, হারমিওন বলল; দ্রুত হ্যারির পাশে চলে এসেছে। সে, ফাজ-এর দিকে তাকিয়ে রয়েছে অনুনয়ের দৃষ্টিতে। আমিও ওকে দেখেছি। ওটা ছিল রন-এর ইঁদুর, পেট্টিগ্রু একজন অ্যানিম্যাগাস, আমি বোঝাতে চাইছি

দেখছেন মন্ত্রীমহোদয়? বললেন স্নেইপ। দুজনকেই জাদু করা হয়েছে … ওদের দুজনকে ভালো করেই ধরেছে ব্ল্যাক।

আমাদেরকে কোন জাদু করা হয়নি? এবার গর্জন করল হ্যারি।

মন্ত্রীমহোদয়! প্রফেসর! এবার ক্ষেপে গিয়ে বললেন মাদাম পমফ্রে। আমাকে এখন বলতেই হচ্ছে যে আপনাদের এখান থেকে চলে যেতে হবে। পটার আমার রোগী, তাকে কিছুতেই আরও অসুস্থ করা যাবে না!

আমি অসুস্থ হচ্ছি না, আমি ওদেরকে জানানোর চেষ্টা করছি আসলে কী হয়েছিল! ক্ষিপ্ত হয়ে বলল হ্যারি। শুধু ওরা যদি শুনতেন

কিন্তু হঠাৎ হ্যারির মুখের ভেতর মাদাম পমফ্রে বিরাট একটা চকলেটের দলা ঢুকিয়ে দিল। দম আটকে গেল হ্যারির, এবং এই সুযোগ তিনি জোর করে ওকে বিছানায় শুইয়ে দিলেন।

এখন, প্লিজ, মন্ত্রীমহোদয়, এই ছেলেগুলোর বিশ্রাম দরকার, যত্ন দরকার। প্লিজ যান–

আবার খুলে গেল দরজাটা। এবার ঢুকলেন ডাম্বলডোর। মুখের চকলেটের বিরাট দলাটা কোনরকমে গিলে আবার উঠে বসল হ্যারি।

প্রফেসর ডাম্বলডোর, সাইরিয়াস ব্ল্যাক

ঈশ্বরের দোহাই! ক্ষিপ্ত স্বরে বললেন মাদাম পমফ্রে। এটা হাসপাতাল না আর কিছু? হেডমাস্টার, আমাকে জোর দিয়ে বলতেই হচ্ছে–।

আমি মাফ চাচ্ছি, পপি, কিন্তু মিস্টার পটার এবং মিস গ্লেঞ্জার-এর সাথে আমার কিছু কথা রয়েছে যে, শান্ত স্বরে বললেন ডাম্বলডোর। এইমাত্র আমি সাইরিয়াস ব্ল্যাক-এর সঙ্গে কথা বলে এলাম

মনে হচ্ছে পটার-এর মাথায় যেসব আজগুবি গল্প সে ঢুকিয়ে দিয়েছে সেগুলিই আপনাকে সে শুনিয়েছে? থুথু ফেললেন স্নেইপ। এই একটা ইঁদুর, এবং পেট্টিগ্রু বেঁচে রয়েছে এই ধরনের

ঠিক এটাই, ব্ল্যাক-এর কাহিনী, বললেন ডাম্বলডোর ওর অর্ধচন্দ্রাকৃতির চশমার মধ্য দিয়ে স্নেইপকে মাপতে মাপতে।

এবং আমার সাক্ষ্যের কী কোনই মূল্য নেই? দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বললেন স্নেইপ। শিকিং শ্যাক-এ পিটার পেট্টিগ্রুঞ ছিল না, এবং মাঠেও আমি ওর কোন চিহ্ন দেখতে পাইনি।

কারণ আপনি তো অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন প্রফেসর! আস্থার সঙ্গে বলল হারমিওন। আপনি তো সময় মতো আসতে পারেননি আসল কথা শোনার

মিস গ্লেঞ্জার, মুখটা বন্ধ রাখ!

স্নেইপ, ধৈর্য রাখুন, বললেন ফাজ। মেয়েটি মানসিকভাবে বিধ্বস্ত, আমাদের এমন কিছু

হ্যারি এবং হারমিওন-এর সাথে আমি একা কথা বলতে চাই, বললেন ডাম্বলডোর। কর্নেলিয়াস, সেভেরাস, পপি–প্লিজ আমাদের একা থাকতে দিন।

হেড মাস্টার! বললেন মাদাম পমফ্রে। ওদের চিকিত্সা দরকার, বিশ্রাম দরকার

কিন্তু এই আলোচনাটা জরুরি, অপেক্ষা করার উপায় নেই, বললেন ডাম্বলডোর। আমি ব্যাপারটায় জোর দিচ্ছি।

ঠোঁট চেপে বেরিয়ে গেলেন মাদাম পমফ্রে, দড়াম করে দরজাটা লাগিয়ে দিলেন পেছনে। ওয়েস্ট কোটের ভেতর থেকে ঝুলে থাকা বড় একটা সোনালী ঘড়ি দেখলেন ফাজ।

এতক্ষণে নিশ্চয়ই ডিমেন্টাররা চলে এসেছে, বললেন তিনি। আমি যাই গিয়ে ওদের সঙ্গে দেখা করি। ডাম্বলডোর, ওপরতলায় আপনার সঙ্গে দেখা হবে।

হেঁটে দরজা পর্যন্ত গেলেন, দরজাটা মেলে ধরলেন স্নেইপ-এর জন্যে, কিন্তু নড়লেন না স্নেইপ।

নিশ্চয়ই আপনি ব্ল্যাক-এর গল্পের একটি শব্দও বিশ্বাস করেননি? ফিসফিস করে বললেন স্নেইপ, চোখ জোড়া স্থির হয়ে রয়েছে ডাম্বলডোরের চেহারায়।

আমি হ্যারি এবং হারমিওন-এর সঙ্গে একা কথা বলার ইচ্ছা প্রকাশ করেছি, ডাম্বলডোর পুনরাবৃত্তি করল।

ওর দিকে এক পা এগিয়ে গেলেন স্নেইপ।

ষোল বছর বয়সেই সাইরিয়াস ব্ল্যাক প্রমাণ করেছে যে সে খুন করতে পারে, এক নাগাড়ে বললেন স্নেইপ। আপনি নিশ্চয়ই সে কথা ভুলে যাননি? আপনি নিশ্চয়ই ভুলে যাননি যে একবার সে আমাকে খুন করতে চেয়েছিল?

সেভেরাস, আমার স্মৃতিশক্তি আগের মতোই রয়েছে, শান্ত স্বরে বললেন ডাম্বলডোর।

ঘুরে ফাজ-এর মেলে ধরা দরজাটা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন স্নেইপ। ওটা বন্ধ হয়ে গেল। হ্যারি এবং হারমিওন-এর দিকে ফিরলেন ডাম্বলডোর। এক সাথে কথা বলতে শুরু করল ওরা দুজন।

প্রফেসর, ব্ল্যাক সত্যি কথা বলছে–আমরা পেট্টিগ্রুকে দেখেছি

–প্রফেসর লুপিন যখন ওয়েরউলফ-এ রূপান্তরিত হলেন তখন সে পালিয়ে গেল

–ও একটা ইঁদুর

–পেট্টিগ্রুর সামনের থাবা, মানে আমি বলতে চাচ্ছি আঙুল, ও নিজেই ওটা কেটে ফেলেছিল–

–পেট্টিগ্রুই রনকে আক্রমণ করেছিল, সাইরিয়াস নয়

কিন্তু হাত তুলে ওদের ব্যাখ্যার বন্যা থামিয়ে দিলেন ডাম্বলডোর।

এখন তোমাদের শোনার পালা, আমাকে কথা বলায় বাধা দেবে না, কারণ হাতে সময় খুব কম, শান্ত স্বরে বললেন তিনি। তোমাদের দুজনের কথা ছাড়া ব্ল্যাক-এর কথার বিন্দুমাত্রও প্রমাণ নেই-এবং দুজন তের বছর বয়সের জাদুকরের কথা কারো কাছেই বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হবে না। এক রাস্তা ভর্তি লোক শপথ করে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বলেছে যে সাইরিয়াস পেট্টিগ্রুকে খুন করেছে। আমি নিজে মন্ত্রণালয়ে সাক্ষ্য দিয়েছি যে সাইরিয়াসই পটারদের সিক্রেট–কিপার ছিল।

প্রফেসর লুপিন আপনাকে বলতে পারবে। বলল হ্যারি, নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারল না সে।

এ মুহূর্তে প্রফেসর লুপিন গভীর জঙ্গলের ভেতর, কাউকেই কিছু বলার সামর্থ তার নেই। তার আবার মানুষে রূপান্তরিত হতে হতে, অনেক বেশি দেরি হয়ে যাবে, ততক্ষণে সাইরিয়াস-এর অবস্থা মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর হবে। তাছাড়া আমি আরও বলতে চাই আমাদের ওয়েরউলফকে এতবেশি অবিশ্বাস করা হয় যে, ওর সাক্ষ্য খুব বেশি কাজে আসবে না-এবং বিশেষ করে সে এবং সাইরিয়াস ছিল পুরনো বন্ধু

কিন্তু–

আমার কথা শোন হ্যারি। এরই মধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে, তুমি আমার কথা বুঝতে পারছ? তোমাকে বুঝতে হবে তোমাদের কথার চেয়ে প্রফেসর স্নেইপ এর বক্তব্য আরও বেশি বিশ্বাসযোগ্য।

তিনি সাইরিয়াসকে ঘৃণা করেন, বলল হারমিওন। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে কোন এক সময় সাইরিয়াস ওর সঙ্গে বোকার মতো মজা করতে গিয়েছিল

সাইরিয়াসও একেবারে ধোয়া তুলসি পাতা নয়। সেই স্থূলকায়া মহিলার উপর আক্রমণ–গ্রিফিন্ডর টাওয়ারে ছুরি নিয়ে ঢোকা–জীবন্ত অথবা মৃত পেটিকে ছাড়া সাইরিয়াস-এর দণ্ড পাল্টানোর কোন সম্ভাবনাই নেই।

কিন্তু আপনি তো আমাদের বিশ্বাস করেন।

হ্যাঁ, বিশ্বাস করি, ডাম্বলডোরের শান্তু স্বর। কিন্তু অন্যদেরকে সত্যটা দেখাবার মতো ক্ষমতা আমার নেই, অথবা ম্যাজিক মন্ত্রীর সিদ্ধান্ত পাল্টাবার ক্ষমতাও

গম্ভীর মুখটার দিকে তাকিয়ে হ্যারির মনে হলো ওর পায়ের তলার মাটি সব সরে গেছে। ওর একটা ধারণা অভ্যাসগতভাবেই তৈরি হয়েছিল যে ডাম্বলডোর সব সমস্যারই সমাধান করতে পারেন। ও আশা করেছিল যেন শূন্য থেকে ডাম্বলডোর বিস্ময়কর কোন একটা সমাধান বের করে নিয়ে আসবে। কিন্তু না তাদের শেষ ভরসাও আর থাকল না।

এখন আমাদের যেটা দরকার, ধীরে ধীরে বললেন ডাম্বলডোর, তার হালকা নীল চোখজোড়া হ্যারি আর হারমিওন-এর উপর ঘুরছে, সেটা হচ্ছে আরও সময়।

কিন্তু– হারমিওন বলতে শুরু করেছিল। এবং তারপর। বিস্ফোরিত হলো। ওহ!

এখন মনোযোগ দিয়ে শোন, বললেন ডাম্বলডোর, খুব নিচু স্বরে কথা বলছেন তিনি কিন্তু খুব পরিষ্কারভাবে। প্রফেসর ফ্লিটউইক-এর সাততলার অফিস রুমে সাইরিয়াসকে তালা মেরে রাখা হয়েছে। পশ্চিমের টাওয়ার থেকে ডানদিকে তের নম্বর জানালা। যদি সবকিছু ঠিকঠাক করতে পার তবে আজ রাতে তোমরা দুটো নির্দোষ প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হবে। কিন্তু মনে রেখ, তোমরা দুজনেই। তোমাদেরকে কিছুতেই কেউ যেন দেখতে না পায়। মিস গ্রেঞ্জার আইনটা তুমি ভালো করেই জান–তুমি জান পরিণতি কি হতে পারে–তোমাদেরকে অবশ্যই কেউ যেন–দেখতে না পায়।

কি নিয়ে কথা হচ্ছে হ্যারি কিছুই বুঝতে পারছে না। ডাম্বলডোর দরজার কাছে গিয়ে পেছন ফিরে তাকাল।

আমি তোমাদেরকে বাইরে থেকে তালা মেরে যাচ্ছি। এখন– ঘড়ি দেখলেন তিনি, রাত বারটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। মিস গ্লেঞ্জার তিনবার ঘোরালেই চলবে, হওয়া উচিত। গুড লাক।

গুড লাক? পুনরাবৃত্তি করল হ্যারি, ডাম্বলডোর-এর পেছনের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। তিনবার ঘোরানো? কী বলছিলেন? আমাদেরকে কী করতে হবে?

কিন্তু জামাটার গলা নিয়ে অস্থিরভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে হারমিওন, ভেতর থেকে একটা অনেক লম্বা খুবই ভালো সোনার চেইন বের করে আনল।

হ্যারি, এখানে এসো, স্বরে ব্যাকুলতা, জলদি!

ওর দিকে সরে এলো হ্যারি, কিছুই বুঝতে পারছে না সে। চেইনটা হাতে ধরে আছে হারমিওন। ও দেখল ওতে ঝুলছে একটা চকচকে সময়–গ্লাস।

এই যে

চেইনটা এখন হ্যারির গলাতেও পরিয়ে দিল হারমিওন।

রেডি? রুদ্ধশ্বাসে বলল সে

আমরা কী করতে যাচ্ছি? হ্যারির প্রশ্ন, একেবারে বোকা বনে গেছে সে।

সময়–গ্লাসটাকে তিনবার উল্টোদিকে ঘোরালো হারমিওন।

অন্ধকার হাসপাতাল ওয়ার্ডটা হারিয়ে গেল। হ্যারির মনে হলো যেন উড়ছে সে, খুব দ্রুত, কিন্তু পেছন দিকে। ওর পাশ দিয়ে দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন রঙ এবং আকৃতির; কান ভোঁ ভোঁ করছে। চিৎকার করার চেষ্টা করল কিন্তু নিজের কানেই নিজের চিৎকার শুনতে পেলো না

এবং তারপর পায়ের নিচে শক্ত মাটির অনুভূতি পেল সে, সবকিছু আবার পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে

স্কুলের ঢোকার হলটায় দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সে হারমিওন-এর পাশে, সামনে খোলা দরজা দিয়ে মেঝের উপরে সোনালী সূর্যালোক পড়ছে। হারমিওন এর দিকে উভ্রান্তের মতো তাকাল সে, সময়–গ্লাসের চেইনটা তার ঘাড়ে কেটে বসে যাচ্ছে।

হারমিওন, কী–?

এই খানে! ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল হারমিওন হলের ভেতরে ঝাড়ু রাখার কাবার্ডের কাছে, ওটা খুলল সে, ওর ভেতরে ঠেলে ওকে ঢুকিয়ে দিল হ্যারিকে, নিজেও ওর পাশে গিয়ে বসল টেনে লাগিয়ে দিল দরজাটা।

কী–কেমন করে–হারমিওন, কী হচ্ছে?

সময় ধরে আমরা পেছন দিকে চলে গেছি, ফিসফিস করে বলল হারমিওন, অন্ধকারে হ্যারির গলা থেকে চেইনটা খুলে নিয়ে। তিন ঘণ্টা পেছনে।

নিজের পায়ে চিমটি কাটল হ্যারি। ব্যথা পেল, বোঝা গেল কোন দুঃস্বপ্ন দেখছে না সে।

কিন্তু

শশশ! শোন! কেউ একজন আসছেন। আমার মনে হচ্ছে–আমরাই আসছি!

 কাবার্ডের দরজায় কান লাগিয়ে শুনছে হারমিওন।

হল থেকে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে হ্যাঁ, আমরাই হ্যাগ্রিড-এর ওখানে যাচ্ছি।

তুমি কী বলতে চাচ্ছ, ফিসফিস করে বলল হ্যারি, আমরা এই কাবার্ডের মধ্যেও আছি আবার আমরাই ওই বাইরেও রয়েছি?

হ্যাঁ, বলল হারমিওন, তখনও কাবার্ডের দরজায় ওর কান পাতা। আমি নিশ্চিত ওটা আমরাই … তিনজনের বেশি লোকের আওয়াজ তো মনে হচ্ছে না। এবং আমরা ধীরে ধীরে হাঁটছি কারণ আমরা অদৃশ্য হওয়ার জামাটার নিচে রয়েছি।

থেমে গেল হারমিওন, তখনও মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করছে কিছু।

সামনের সিঁড়ি ধরে আমরা নামছি …।

উল্টানো একটা বালতির উপরে বসল হারমিওন, ওকে সাংঘাতিক রকমের উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে, অথচ হ্যারি কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইছে।

ওই সময়–গ্লাসটা তুমি পেলে কোথায়?

এটাকে বলা হয় টাইম–টার্নার, বলল হারমিওন, এবং এটা আমি পেয়েছি প্রফেসর ম্যাগগোনাগল-এর কাছ থেকে। সারা বছর ক্লাস করার সময় এটা আমি ব্যবহার করি। প্রফেসর ম্যাকগোনাগল আমাকে দিয়ে শপথ করিয়ে নিয়েছেন যেন এ ব্যাপারে আমাকে কাউকে কিছু না বলি। এটা পাওয়ার জন্য ম্যাজিক মন্ত্রণালয়ে তাকে অনেক তদবির করতে হয়েছে। বলতে হয়েছে আমি একজন আদর্শ ছাত্র, এবং আমার পড়াশোনা ছাড়া কখনই অন্য কোন কারণে এটা ব্যবহার করব না। আমি এটাকে ব্যবহার করে সময় পিছিয়ে নিয়েছি বহুবার, এবং এভাবেই একই সময়ে আমি অনেকগুলো ক্লাস করতে পেরেছি, এবার বুঝতে পেরেছো? কিন্তু

হ্যারি, ডাম্বলডোর আমাদের কাছে কি চাচ্ছেন। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। তিনি আমাদেরকে তিন ঘণ্টা পেছনে যেতে বললেন কেন? এটা কীভাবে সাইরিয়াসকে সাহায্য করতে পারবে?

ওর প্রায়ান্ধকার মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল হ্যারি।

এই সময়ের মধ্যে কিছু একটা ঘটেছিল, যেটা, উনি চাচ্ছেন আমরা যেন পরিবর্তন করে দেই, ধীরে ধীরে বলল হ্যারি। কী ঘটেছিল? তিন ঘন্টা আগে আমরা হ্যাগ্রিড-এর বাসার দিকে হেঁটে যাচ্ছিলাম।

এখনই তো তিন ঘন্টা আগের সময়, এবং আমরা হ্যাগ্রিড-এর বাসার দিকে হেঁটে যাচ্ছি, বলল হারমিওন। এই মাত্র আমরা শুনলাম আমাদের বেরিয়ে যাওয়ার শব্দ

ভ্রূ কুঁচকালো হ্যারি; মনে হচ্ছে সমস্ত মাথা এক সাথে করে মগজ থেকে বুদ্ধি বের করার চেষ্টা করছে সে।

 ডাম্বলডোর শুধু বলেছেন–শুধু বলেছেন আমরা একটির বেশি নির্দোষ জীবন বাঁচাতে পারি … বিদ্যুৎ চমকের মতো মাথায় এলো ব্যাপারটা। হারমিওন, আমরা। বাকবিককে বাঁচাতে যাচ্ছি!

কিন্তু–ওটা কীভাবে সাইরিয়াসকে সাহায্য করবে?

ডাম্বলডোর বলেছেন–শুধু বলেছেন জানালাটা কোথায়–ফ্লিটউইক-এর অফিসের জানালা! যেখানে ওরা সাইরিয়াসকে তালা মেরে আটকে রেখেছে। বাকবিককে ওই জানালা পর্যন্ত আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে ওকে রক্ষা করার জন্য! বাকবিক-এর পিঠে চড়ে পালিয়ে যেতে পারবে সাইরিয়াস–ওরা দুজনে এক সাথেই পালাতে পারবে?

হারমিওন-এর চেহারায় ভীতি দেখল হ্যারি।

কেউ দেখে ফেলার আগেই আমরা যদি ওটা করতে পারি, তাহলে সেটা হবে বিস্ময়কর জাদুর মতো!

বেশ, আমাদেরকে চেষ্টা তো করতে হবে, তাই না? বলল হ্যারি। উঠে গিয়ে কাবার্ডের গিয়ে কান ঠেকাল সে।

মনে হচ্ছে না ওখানে আর কেউ আছে এসো, যাওয়া যাক

কাবার্ডের দরজাটা খুলল হ্যারি। হলটা একেবারে শূন্য। দ্রুত এবং নিঃশব্দে কাবার্ড থেকে বেরিয়ে পাথরের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল ওরা। ছায়াগুলো দীর্ঘ হয়ে গেছে, নিষিদ্ধ বনে গাছের মাথাগুলো চকচক করছে সোনার মতো।

জানালা দিয়ে যদি কেউ বাইরে তাকায়–হারমিওন বলল, পেছনে প্রাসাদটার দিকে তাকিয়ে।

আমরা দৌড় লাগাব, দৃঢ় স্বরে বলল হ্যারি। সোজা বনের দিকে, ঠিক আছে? আমাদেরকে একটা গাছের পেছনে লুকোতে হবে, নজর রাখতে হবে।

ঠিক আছে, কিন্তু আমরা গ্রীন হাউজটার পাশ দিয়ে যাব! বলল হারমিওন, ঘন ঘন দম ফেলছে সে। হ্যাগ্রিড-এর সামনের দরজা থেকে আমাদের আড়াল থাকতে হবে, তা না হলে আমরা আমাদেরকেই দেখতে পাব! এতক্ষণে নিশ্চয়ই আমরা হ্যাগ্রিড-এর বাসার কাছে পৌঁছে গিয়েছিলাম!

হ্যারি তখনও মনে মনে ভাবছে কি বোঝাতে চাইছে হারমিওন, কিন্তু দৌড়টা সে ঠিকই দিল, পেছনে হারমিওন। সবজির বাগানের মধ্যে দিয়ে গ্রীন হাউজে পৌঁছাল, ওদের পেছনেই কয়েক মুহূর্তের জন্য থামল, আবার দৌড়াতে শুরু করল, যত দ্রুত পারে, হোমপিং উইলোটার পাশ দিয়ে সোজা বনের আশ্রয়ে

গাছের ছায়ায় নিশ্চিন্ত হয়ে হ্যারি ঘুরল, মুহূর্ত পরেই পাশে এসে থামল হারমিওন, হাঁপাচ্ছে সে।

ঠিক আছে, দম ফেলল সে, হ্যাগ্রিড-এর বাসার কাছে আমাদেরকে এখন যেতে হবে চুপি চুপি। কেউ যেন দেখতে না পায়…

গাছের ফাঁকে ফাঁকে নিঃশব্দে এগিয়ে চলল ওরা, তবে বনের একেবারে ধার ঘেষে। হ্যাগ্রিড-এর বাসার সামনে যখন ওদের দৃষ্টি পড়ল, দরজায় করাঘাতের শব্দ শুনতে পেল। দ্রুত একটা বড়সড় ওক গাছের আড়ালে সরে গেল ওরা, দুদিক থেকে উঁকি দিল। সামনের দরজায় এল হ্যাগ্রিড, কাঁপছে, ফ্যাকাশে, দেখছে দরজায় কে নক করল। এবার নিজের কণ্ঠস্বরই শুনতে পেল হ্যারি।

আমরা। আমরা অদৃশ্য হওয়ার জামাটা পড়ে রয়েছি। ভেতরে আসতে দাও, ওটা খুলতে পারব।

তোমাদের আসা উচিত হয়নি! ফিসফিস করে বলল হ্যাগ্রিড। পেছনে সরে গেল সে, দ্রুত দরজাটা বন্ধ করে দিল।

বোধহয় এটাই সবচেয়ে অদ্ভুত কাজ আমাদের, বলল হ্যারি।

আরেকটু সামনে যাওয়া যাক, ফিসফিস করে বলল হারমিওন। আমাদেরকে বাকবিক-এর কাছে যেতে হবে!

গাছের ফাঁকের মধ্য দিয়ে চুপিচুপি অগ্রসর হলো ওরা, ভীতসন্ত্রস্ত হিপোগ্রিফটাকে দেখতে পেল, হ্যাগ্রিড-এর কুমড়ো বাগানের বেড়ার সঙ্গে বাধা রয়েছে।

এখনই? ফিসফিস করে বলল হ্যারি।

না! বলল হারমিওন। এখন যদি আমরা ওকে চুরি করি, তাহলে কমিটির লোকেরা ভাববে হ্যাগ্রিডই ওকে ছেড়ে দিয়েছে! ওরা যে পর্যন্ত না ওকে দেখছে বাধা অবস্থায় সে পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে!

এর ফলে আমাদের ষাট সেকেন্ড সময় নষ্ট হবে, বলল হ্যারি। মনে হচ্ছে ব্যাপারটা যেন ক্রমেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

ঠিক সেই মুহূর্তে, হ্যাগ্রিড-এর কেবিনের ভেতর থেকে কাঁচ ভাঙার শব্দ পাওয়া গেল।

এই যে হ্যাগ্রিড দুধের জগটা ভাঙল, হারমিওন বলল ফিসফিস করে। মুহূর্ত পরেই আমি স্ক্যাবার্সকে পেয়ে যাব।

সত্যিই তাই, কয়েক মুহূর্ত পরেই, ওরা হারমিওন-এর বিস্মিত চিৎকার শুনতে পেল।

হারমিওন, হঠাৎ বলল হ্যারি, যদি–যদি আমরা দৌড়ে গিয়ে এখন পেট্টিগ্রুকে ধরে ফেলি

না! বলল হারমিওন, ভয় পেয়ে গেছে সে। বুঝতে পারছ না? আমরা জাদু আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণটা লঙ্ঘন করছি! কারোরই সময় বদলাবার অধিকার নেই, কারোরই! তুমি শুনেছো ডাম্বলডোরের কথা, যদি আমাদেরকে দেখা যায়

আমাদেরকে তো শুধু আমরা আর হ্যাগ্রিডই দেখতে পাব!

হ্যারি, তুমি কি মনে করো, তুমি যদি নিজেকে হ্যাগ্রিড-এর বাসায় ঢুকছো দেখতে পাও, তাহলে কী করবে? বলল হারমিওন।  

আমি–আমি, মনে হয় আমি পাগল হয়ে যাব, বলল হ্যারি, অথবা মনে হবে যেন কোন কালো জাদু চলছে–

ঠিক তাই! তুমি বুঝতে পারছ না, এমনকি তুমি হয়তো নিজেকেই আক্রমণ করে বসতে পার! প্রফেসর ম্যাকগোনাগল আমাকে বলেছেন জাদুকররা যখনই সময় নিয়ে ঘাটাঘাটি করে তখন অদ্ভুত সব অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটতে থাকে তাদের অনেকেই তাদের অতীতের অথবা ভবিষ্যতের নিজেকেই খুন করে ফেলেছে ভুল করে!

ঠিক আছে! বলল হ্যারি। এটা একটা ধারণা ছিল মাত্র, আমি ভেবেছিলাম

কনুই দিয়ে গুঁতো দিলো ওকে হারমিওন, প্রাসাদের দিকে আঙুল তুলে দেখাল। ভালো করে দেখার জন্য মাথাটা একটু সামনে বাড়াল হ্যারি। ডাম্বলডোর, ফাজ, বৃদ্ধ কমিটি মেম্বার এবং ঘাতক ম্যাকনেয়ার সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে।

আমরা এখনই বেরিয়ে আসব! বলল হারমিওন।

এবং নিশ্চিতভাবেই, কয়েক মুহূর্ত পর হ্যাগ্রিড-এর বাড়ির পেছনের দরজাটা খুলে গেল, হ্যারি দেখল রন, হারমিওন এবং সে নিজে হ্যাগ্রিড-এর সঙ্গে দরজা দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে আসছে। সন্দেহ নেই, এটা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত অনুভূতি, গাছের পেছনে লুকিয়ে থেকে নিজেকেই আবার সামনে কুমড়োর বাগানে দেখতে পাওয়া।

ঠিক আছে, বিকি, ভয়ের কিছু নেই সব ঠিক আছে  হ্যাগ্রিড বলল বাকবিককে উদ্দেশ্য করে। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে হ্যারি, রন এবং হারমিওনকে বলল, যাও, হাঁটতে শুরু কর।

হ্যাগ্রিড, আমরা তো—

আমরা ওদের বলব আসলে কি ঘটেছিল

ওরা ওকে মারতে পারবে না।

যাও! তোমাদের ছাড়াই ইতোমধ্যে আমি অনেক ঝামেলায় পড়েছি!

হ্যারি লক্ষ্য করলো কুমড়োর বাগানে হারমিওন ওর নিজের এবং রনের ওপর অদৃশ্য হওয়ার জামাটা ছড়িয়ে দিল।

জলদি চলে যাও, কোন কিছু শুনবার চেষ্টা করো না

হ্যাগ্রিড-এর সামনের দরজায় করাঘাত শোনা গেল। ঘাতকের দল উপস্থিত হয়েছে। ঘুরে কেবিনের উদ্দেশ্যে রওনা হলো হ্যাগ্রিড, পেছনের দরজাটা একটু ফাঁক করে রাখল। হ্যাগ্রিড খেয়াল করল বাগানের ঘাসগুলো জায়গায় জায়গায় সমান হয়ে যাচ্ছে, শুনতে পেল তিনজোড়া পায়ের সরে যাওয়ার আওয়াজ। সে, রন এবং হারমিওন চলে গেছে কিন্তু এখন গাছের পেছনে যে হ্যারি এবং হারমিওন লুকিয়ে রয়েছে ওরা কেবিনের ভেতরে যা ঘটছে সবই শুনতে পাচ্ছে।

পশুটা কোথায়? ম্যাকনায়ার-এর শীতল কণ্ঠ শোনা গেল।

বাইরে, বাইরে, কঁকিয়ে উঠল হ্যাগ্রিড।

হ্যাগ্রিড-এর জানালায় ম্যাকনায়ারকে দেখা দিতেই হ্যারি তার মাথাটা সরিয়ে নিল, বাকবিক-এর দিকে তাকিয়ে আছে সে। এরপর ফাজকে বলতে শুনল।

আমাদের–মানে তোমার কাছে সরকারি আদেশটা পড়ে শোনাতে হবে। হ্যাগ্রিড, ব্যাপারটা জলদি সেরে ফেলতে হবে। তারপর তোমাকে এবং ম্যাকনায়ারকে স্বাক্ষর করতে হবে আদেশটার উপরে। ম্যাকনায়ার, তোমাকেও শুনতে হবে আদেশটা, ওটাই নিয়ম

ম্যাকনায়ার-এর মুখটা জানলা থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। হয় এখনই, না হয় আর কখনই নয়।

এখানে অপেক্ষা কর, ফিসফিস করে হারমিওনকে বলল হ্যারি। আমি ওকে নিয়ে আসছি।

ফাজ-এর কণ্ঠস্বর আবার শোনা যেতে লাগল, গাছের পেছন থেকে দৌড় লাগাল হ্যারি, কুমড়োর মাঠের বেড়াটা পেরিয়ে বাকবিক-এর কাছে পৌঁছল।

কমিটি ফর ডিসপোজাল অফ ডেঞ্জারাস ক্রিয়েচার্স সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, হিফোগ্রিফ বাকবিক, এরপর থেকে দণ্ডিত হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে, ৬ জুনের সূর্যাস্তের সময় দণ্ডিতের প্রাণদণ্ডাদেশ কার্যকর।

চোখের পাতা যেন না পড়ে সে ব্যাপারে হ্যারি খুব সতর্ক থাকল, সরাসরি বিকবিক-এর ভয়ঙ্কর কমলা রঙের চোখের দিকে তাকাল, এবং তারপর বো করল। বাকবিককে বেধে রাখা রশিটা খুলতে গিয়ে হাত কেঁপে উঠল তার।

করা হবে দেহ থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে, প্রাণদণ্ডাদেশ কার্যকর করবে কমিটির নিযুক্ত ঘাতক, ওয়াল্ডেন ম্যাকনায়ার …

এসো বাকবিক, বিড়বিড় করে বলল হ্যারি, এসো না, আমরা তোমাকে সাহায্যই করছি। নীরবে কোন শব্দ নয়।

নিম্নোক্ত সাক্ষীদের উপস্থিতিতে। হ্যাগ্রিড, তুমি এখানে স্বাক্ষর করো

গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে রশিটাকে টানছে স্যরি, কিন্তু মাটিতে সামনের পা দাবিয়ে রেখেছে বাকবিক, নড়বে না সে।

বেশ, এখন ব্যাপারটা শেষ করে ফেলা উচিত, চলুন, কমিটির মেম্বারের গলার স্বর হ্যাগ্রিড-এর কেবিনের ভেতর থেকে শোনা গেল। হ্যাগ্রিড, আমার মনে হয় আপনি ভেতরে থাকলে বোধহয় ভালো করবেন

না, আমি–আমি ওর সঙ্গে থাকতে চাই আমি চাই না ও একা থাকুক

কেবিনের ভেতর থেকে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।

বাকবিক, নড়ছ না কেন! চাপা গলায় বলল হ্যারি।

গলার রশিটা ধরে আরও জোরে টানল সে। এবার হাঁটতে শুরু করল বাকবিক, পাখাগুলোকে বিরক্তিভরে ঘসছে। এখনো বন থেকে দশ ফিট দূরে ওরা,

হ্যাগ্রিড-এর পেছনের দরজা থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

এক সেকেন্ড, প্লিজ, ম্যাকনায়ার, ডাম্বলডোর-এর গলা শোনা গেল। আপনাকে তো স্বাক্ষর করতে হবে, পায়ের আওয়াজগুলো থেমে গেল। রশির উপর সমস্ত শক্তি ঢেলে দিল হ্যারি। বাকবিক আরেকটু দ্রুত হাঁটতে শুরু করল।

একটা গাছের পেছন থেকে হারমিওন-এর ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া চেহারাটা দেখা যাচ্ছে।

হ্যারি, হ্যারি! বলছে সে।

হ্যারি তখনও শুনতে পাচ্ছে কেবিনের ভেতর কথা বলছেন ডাম্বলডোর। দড়িটা ধরে আরেকবার টান দিল সে। এবার বাকবিক অসন্তুষ্ট হয়েই দ্রুত হাঁটতে শুরু করল। গাছগুলোর কাছে প্রায় পৌঁছে গেল ওরা

জলদি কর! চাপা আর্তনাদ করল হারমিওন, গাছ থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো সে, দড়িটা ধরল, টানতে লাগল জোরে। কাঁধের উপর দিয়ে পেছন দিকে তাকাল হ্যারি; ওরা এখন আর হ্যাগ্রিড-এর বাগানটা দেখতে পাচ্ছে না।

থাম! ফিসফিস করে হারমিওনকে বলল। ওরা আমাদের আওয়াজ শুনে ফেলতে পারে

হ্যাগ্রিড-এর কেবিনের পেছনের দরজা খুলে গেল দড়াম করে। জমে পাথর হয়ে গেল, হ্যারি, হারমিওন এবং বাকবিক; মনে হচ্ছে যেন হিফোগ্রিফটাও কান খাড়া করে শুনছে।

চারদিক নিস্তব্ধ। তারপর

কোথায় ওটা? কমিটি মেম্বারের তীক্ষ্ণ গলার স্বর শোনা গেল। পশুটা কোথায়?

এটা তো এখানেই বাধা ছিল! ঘাতকের গলার আওয়াজ। এইমাত্র তো আমি দেখলাম।

কি অসাধারণ, বললেন ডাম্বলডোর। তার গলায় যেন কৌতুক খেলা করছে।

বিকি! বলল হ্যাগ্রিড শুকনো গলায়।

যেন বাতাস কাটার শব্দ শোনা গেল, তারপরেই একটা ভোতা আওয়াজ। মনে হচ্ছে রাগে দুঃখে ঘাতক ম্যাকশায়ার কুড়ালটা ঘুরিয়ে বেড়ার ওপরই মেরেছেন। এরপরেই শোনা গেল একটা আর্তনাদ, এবার ওরা হ্যাগ্রিড-এর কান্না এবং তার প্রতিটি কথা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে।

চলে গেছে! চলে গেছে! ওর ভালো হোক, চলে গেছে সে! মনে হয় টেনে রশি ছিঁড়ে ফেলেছিল! বিকি, চালাক বিকি!

এখন রশিটা টানছে বাকৰিক, হ্যাগ্রিড-এর কাছে ফিরে যেতে চাচ্ছে। হ্যারি এবং হারমিওন আরও জোরে রশিটা আঁকড়ে ধরল, গোড়ালি বনের মাটিতে গেঁথে রাখল।

কেউ একজন রশিটা খুলে দিয়েছে! ক্রুদ্ধ গর্জন করল ঘাতক। বনটা খুঁজে দেখা দরকার

ম্যাকনায়ার, বাকবিককে যদি কেউ চুরি করে নিয়ে গিয়ে থাকে, তুমি কি মনে কর চোরটা ওকে হটিয়ে নিয়ে যাবে? বললেন ডাম্বলডোর, এখনও মনে হচ্ছে তিনি যেন কৌতুক করছেন। আকাশটা খোঁজ, যদি চাও হ্যাগ্রিড আমার এক কাপ চা হলেই চলবে, অথবা একটা বড় ব্র্যান্ডি।

নি–নিশ্চয়, প্রফেসর, বলল হ্যাগ্রিড, মনে হচ্ছে খুশিতে সে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। ভেতরে আসুন সবাই …।

কান খাড়া করে শুনছে হ্যারি আর হারমিওন। এখন ও পায়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে আবার, ঘাতকের গালাগাল শুনতে পাচ্ছে, দরজাটা খুললো বন্ধ হলো তারপরে সব নীরব।

এখন কী করণীয়? ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করল হ্যারি, চারদিক দেখে নিয়ে।

আমাদেরকে কিছুক্ষণ এখানে লুকিয়ে থাকতে হবে, বলল হারমিওন, মনে হচ্ছে ও যেন ভয়ে প্রচণ্ড নাড়া খেয়েছে। ওরা প্রাসাদে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত আমাদের এখানেই অপেক্ষা করতে হবে। তারপরে অপেক্ষা করতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না সাইরিয়াস-এর জানালা পর্যন্ত বাকবিককে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া নিরাপদ মনে হয়। কয়েক ঘন্টা পর অবশ্য সে আর উপরে থাকবে না ওহ, ব্যাপারটা খুবই কঠিন।

কাঁধের উপর দিয়ে বনের গভীরে তাকাল হারমিওন। সূর্য অস্ত যাচ্ছে।

আমাদেরকে এখনই রওনা হতে হবে, চিন্তা করতে করতে বলল হ্যারি। হোমপিং উইলোটাকে দেখতে হবে, তা না হলে বোঝা যাবে না কি ঘটছে।

ঠিক আছে, বাকবিক-এর দড়িটা শক্ত করে ধরে বলল হারমিওন। কিন্তু আমাদেরকে দৃষ্টির বাইরে থাকতে হবে, মনে আছে তো

বনের ধারে চলে এলো ওরা, চারদিকে গাঢ় অন্ধকার নেমে এসেছে, দূরে দেখা যাচ্ছে উইলো গাছটা।

ওই যে রন! হঠাৎ হ্যারি বলে উঠল।

মাঠের উপর দিয়ে একটা কালো আকৃতি দৌড়ে যাচ্ছে, নিস্তব্দ রাতে ওর চিত্তার প্রতিধ্বনি তুলছে।

ওর কাছ থেকে দূরে সর–দূরে সর হতাভাগা–স্ক্যাবার্স, এখানে এসো

এরপর তারা দেখল যেন শূন্য থেকে দুটো মনুষ্য আকৃতি বেরিয়ে এলো। হ্যারি দেখল সে আর হারমিওন রন-এর পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে। তারপরে দেখল রন ঝাঁপ দিল।

ধরেছি! দূর হ হতভাগা বিড়াল

ওই যে সাইরিয়াস! বলল হ্যারি। উইলোর গোড়া থেকে বিশাল আকৃতির কুকুরটা ছুটে আসছে। ওরা দেখল হ্যারির ওপর দিয়ে লাফ দিয়ে কুকুরটা রনকে ধরল

এখান থেকে ঘটনাটা আরও ভয়াবহ মনে হচ্ছে, তাই না? বলল হ্যারি। কুকুরটা রনকে উইলোর গোড়ার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। উফ–দেখ আমাকে গাছটা সজোরো মারল এবং তোমাকেও-এটা একটা অসম্ভব ভূতুড়ে ব্যাপার।

ক্যাচ ক্যাচ শব্দ তুলে ডালপালা ঝাপটাচ্ছে হোমপিং উইলো, নিচের দিকে ডালগুলো চাবুকের মতো বাড়ি মারছে, ওরা দেখতে পাচ্ছে নিজেদেরকে ছোটাছুটি করছে গাছের গোড়া পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য। এবং তারপর গাছটা যেন জমে স্থির হয়ে গেল।

ওই যে ক্রুকশ্যাংকস গাছের গোড়ার নটটা চেপে ধরেছে, বলল হারমিওন। এই যে আমরা যাচ্ছি … বিড়বিড় করল হ্যারি। আমরা ভেতরে চলে গেছি।

যে মুহূর্তে ওরা অদৃশ্য হলো গাছটা আবার নড়তে শুরু করল। কয়েক মুহূর্ত পর ওরা শুনতে পেল পায়ের শব্দ, কাছেই। ডাম্বলডোর, ম্যাকনায়ার, ফাজ এবং বৃদ্ধ কমিটি মেম্বার ফিরে যাচ্ছেন প্রাসাদে।

যে মুহূর্তে আমরা সুড়ঙ্গটার ভেতরে ঢুকলাম ঠিক তার পরেপরেই! বলল হারমিওন। ইস, যদি ডাম্বলডোর শুধু আমাদের সঙ্গে যেতেন।

তাহলে ম্যাকনায়ার এবং ফাজও যেতেন, তিক্ত স্বরে বলল হ্যারি। বাজি ধরে বলতে পারি ওই জায়গাতেই ফাজ ম্যাকনায়ারকে নির্দেশ দিতেন সাইরিয়াসকে খুন করার জন্য

ওরা দেখতে পাচ্ছে চারজন প্রাসাদের সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য পুরো দৃশ্যটা জনশূন্য হয়ে গেল। তারপর

এই যে আসছেন লুপিন বলল হ্যারি। আরেকটি আকতি তখন সিঁড়ি বেয়ে। নেমে উইলো গাছটার দিকে দ্রুত গতিতে যাচ্ছে। আকাশের দিকে তাকাল হ্যারি। চাঁদটা মেঘে পুরোপুরি ঢেকে আছে।

ওরা দেখল একটা ভাঙা ডাল দিয়ে উইলোর গোড়ায় নটটা চেপে ধরেছেন লুপিন। থেমে গেল গাছটা, এবার লুপিনও হারিয়ে গেল সুড়ঙ্গের ভেতর।

যদি তিনি শুধু অদৃশ্য হওয়ার জামাটা শুধু তুলে নিতেন, বলল হ্যারি। ওটা ওখানেই পড়ে রয়েছে …

ও ফিরল হারমিওন-এর দিকে।

আমি যদি এখন ছুটে গিয়ে ওটা তুলে আর্নি তাহলে স্নেইপ কখনই ওটা পেত এবং 

হ্যারি, আমাদেরকে কেউ দেখে ফেলুক এটা চলবে না!

তুমি এটা মেনে নিচ্ছ কীভাবে? তিক্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করল সে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা ঘটনাগুলো ঘটে যাচ্ছে? ইতস্তত করল সে। আমি গিয়ে জামাটা তুলে নিয়ে আসি!

হ্যারি, না!

হ্যারির কাপড়টা খামছে ধরল হারমিওন। ঠিক সেই সময় ওরা একটা গান শুনতে পেল। হ্যাগ্রিড, প্রাসাদের দিকে যাচ্ছে, সপ্তমে গলা চড়িয়ে গান গাচ্ছে, হাঁটছে একটু টলতে টলতে। ওর হাতে একটা বড় বোতল রয়েছে।

দেখেছ? হারমিওন ফিসফিস করল। দেখ, কি হয়ে যেতে পারত? আমাদেরকে অন্যের দৃষ্টির আড়ালে থাকতে হবে! না, না বাকবিক, না!

হিপোগ্রিফটা আবার হ্যাগ্রিড-এর কাছে যাওয়ার জন্যে পাগলের মতো চেষ্টা করছে। ওরা দুজনে মিলে অনেক কষ্টে ওটাকে আটকে রাখল। ধীরে ধীরে টলতে টলতে প্রাসাদে চলে গেল ত্যাগ্রিড়। বাকবিকও স্থির হলো। দুঃখে যেন ওর মাথাটা একপাশে হেলে পড়ল।

দুই মিনিট না যেতেই, প্রাসাদের দরজাটা আবার হাট করে খুলে গেল, রীতিমতো দৌড়ে আসছেন স্নেইপ, দৌড়াচ্ছেন উইলোটার দিকে।

স্নেইপ গিয়ে থামলেন গাছটার কাছে, দেখে হাত মুঠো করে ফেলল হ্যারি, স্নেইপ দেখছেন চারদিক। এবার আলখাল্লাটা পেলেন, তুলে ধরলেন চোখের সামনে।

তোমার নোংরা হাতটা দিয়ে ওটা ধরো না, চাপা গর্জন করল হ্যারি।

শশশ!

লুপিন যে ডালটা দিয়ে গাছটাকে থামিয়েছিল ওই ডালটাই তুলে নিলেন স্নেইপ, নটটার উপর চেপে ধরলেন এবং আলখাল্লাটা গায়ে দিয়ে ওদের চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

ও, তাহলে এই ব্যাপার, বলল হারমিওন শান্ত স্বরে। আমরা এখন সবাই নিচে আবার আমরা উপরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

বাকবিক-এর দড়িটা নিয়ে সবচেয়ে কাছের গাছটায় শক্ত করে বাধল সে, হাঁটু জড়িয়ে বসল শুকনো মাটির উপরে।

হ্যারি, একটা বিষয় আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না ডিমেন্টাররা সাইরিয়াসকে ধরল না কেন? আমার মনে পড়ছে ওদেরকে আসতে দেখেছিলাম, তারপর মনে হয় আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম ওরা সংখ্যায় এত বেশি ছিল অথচ

হ্যারিও বসে পড়ল পাশে। এবার ও যা দেখেছিল সেটা ব্যাখ্যা করে বলল; কিভাবে সবচেয়ে কাছের ডিমেন্টাররা হ্যারির মুখের উপরে নিজের মুখটা নামিয়ে এনেছিল, রূপালী একটা বিশাল আকৃতি হঠাৎ কোত্থেকে যেন ঘোড়ার মতো দৌড়ে এলো লেকের ওপর দিয়ে এবং ডিমেন্টারগুলোকে বাধ্য করল ফিরে যেতে।

হ্যারির কথা শেষ হতে হতে বিস্ময়ে হারমিওন-এর মুখ হা হয়ে গেল।

কিন্তু ওটা কী ছিল?

একটাই জিনিস হতে পারে যেটা ডিমেন্টারদের চলে যেতে বাধ্য করতে পারে, বলল হ্যারি। একটা সত্যিকারের পেট্রোনাস। শক্তিশালী পেট্রোনাস।

কিন্তু এটা বানালো কে?

হ্যারি কিছু বলল না। সে ভাবছিল লেকের অপর পাড়ে দেখা লোকটার কথা। লোকটা যে কে হতে পারে এটা সে ভাবতে পেরেছিল … কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব?

কিন্তু কিরকম দেখতে সেটা কী খেয়াল করেছিলে? বলল আগ্রহের সঙ্গে। কোন একজন শিক্ষক কী?

না, বলল হ্যারি। তিনি শিক্ষক ছিলেন না।

কিন্তু নিশ্চয়ই কোন মহা শক্তিধর জাদুকর ছিলেন, না হলে অতগুলো ডিমেন্টারকে তাড়িয়ে দেয়া পেট্রোনাসটা যদি অত উজ্জ্বলই ছিল, তাহলে ওই আলোয় তাকে কী দেখা যায়নি? তুমি দেখতে পাওনি?

হ্যাঁ, আমি তাকে দেখেছি, ধীরে ধীরে বলল হ্যারি। কিন্তু হয়তো ওটা আমার কল্পনা ছিল আমি হয়তো স্বচ্ছভাবে ভাবতে পারছিলাম না এর ঠিক পরেপরেই আমিও জ্ঞান হারিয়ে ফেলি 

তোমার কি মনে হয়, কে ছিল ও?

আমার মনে হয়– ঢোক গিলল হ্যারি, ও বুঝতে পারছে ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত মনে হবে। আমার মনে হয় ওটা আমার বাবা ছিলেন।

হারমিওন-এর দিকে তাকাল সে, দেখল মুখটা পুরোপুরি হা হয়ে গেছে ওর। ওর দিকে তাকিয়ে আছে সে, দৃষ্টিতে সতর্কতা এবং দয়ার মিশ্রণ।

হ্যারি, তোমার বাবা-মানে–তিনি তো মারা গেছেন, শান্ত স্বরে সে বলল।

আমি জানি, দ্রুত জবাব দিল হ্যারি।

তোমার কী মনে হয় ওটা তার ভূত ছিল?

আমি জানি না না তাকে দেখে সত্যিকারেরই …

তাহলে

হয়তো, কল্পনায় আমি দেখছিলাম, বলল হ্যারি। কিন্তু যদুর দেখেছি এবং মনে পড়ছে দেখতে একদম ওরই মতো আমার কাছে বাবার ছবি রয়েছে …

হারমিওন তখনও ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে, যেন ওর মাথার সুস্থতা নিয়ে ওর দুশ্চিন্তা রয়েছে।

আমি জানি কথাটা শুনে মনে হচ্ছে আমি পাগল হয়ে গেছি, সোজাসাপটা বলল হ্যারি। ঘুরে বাকবিককে দেখল, মাটিতে ঠোঁট ডুবিয়ে ওটা পোকামাকড় খুঁজছে। কিন্তু আসলে সে বাকবিককে দেখছিল না।

সে ভাবছিল তার বাবা, এবং তার তিন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কথা মুনি, ওয়ার্ম টেইল, প্যাডফুট এবং প্রংস আজ রাতে তাদের চারজনই কি আত্মপ্রকাশ করেছিলেন? সবাই ভেবেছিল যে ওয়ার্ম টেইল মারা গিয়েছে, আজ রাতে সেও দেখা দিয়েছে। তার বাবার দেখা দেয়াটা কী একেবারেই অসম্ভব?

লেকের ওপর দিয়ে সে কি কল্পনায় কিছু দেখছিল? আকৃতিটা অনেক দূরে ছিল, পরিষ্কারভাবে দেখতে পাওয়া তারপরেও সে নিশ্চিত ছিল, অন্তত এক মুহূর্তের জন্য, যখন সে জ্ঞান হারিয়েছে তার ঠিক আগে।

বাতাসে মাথার উপরে পাতাগুলো নড়ে উঠল। চাঁদ মেঘের নিচ থেকে কখনও বের হচ্ছে কখনও লুকোচ্ছে। উইলো গাছটার দিকে মুখ করে বসে রয়েছে হারমিওন, অপেক্ষা করছে।

এবং তারপর, অবশেষে, এক ঘণ্টা পর

এই যে বের হচ্ছি আমরা! ফিসফিস করে বলল হারমিওন।

সে আর হ্যারি উঠে দাঁড়াল। বাকবিকও ওর মাথা তুলল। ওরা দেখছে লুপিন, রন এবং পেট্টিগ্রু অস্বাভাবিকভাবে বেরিয়ে আসছে গাছের গোড়ার সুড়ঙ্গ থেকে। তারপর বের হলো হারমিওন তারপরে অজ্ঞান স্নেইপ, অদ্ভুতভাবে বাতাসে ভেসে ভেসে। তারপর হ্যারি এবং ব্ল্যাক। সবাই ওরা প্রাসাদের দিকে হাঁটতে শুরু করল।

হ্যারির হৃদপিণ্ডটা ধড়াস ধড়াস করছে। আকাশের দিকে তাকাল সে। এখন থেকে যেকোন মুহূর্তে, চাঁদের উপর থেকে মেঘটা সরে যাবে

হ্যারি, বিড় বিড় করল হারমিওন, যেন ওর ভাবনাটা টের পেয়ে গেছে সে। আমাদেরকে স্থির থাকতে হবে। দেখা গেলে চলবে না। এখন আমরা কিছুই করতে পারি না।

তাহলে, আমরা আবারও পেট্টিগ্রুকে পালাতে দেব  শান্ত স্বরে বলল হ্যারি।

অন্ধকারের মধ্যে একটা ইঁদুরকে তুমি কীভাবে খুঁজে বের করবে? দ্রুত বলল হারমিওন। আমাদের এখন কিছুই করবার নেই। আমরা ফিরে এসেছি সাইরিয়াসকে সাহায্য করার জন্য। আমাদের আর কোন কিছু করার কথা না!

ঠিক আছে!

চাঁদের উপর থেকে সরে গেল মেঘটা। ওরা দেখল মাঠের উপর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আকৃতিগুলো থমকে দাঁড়িয়েছে। তারপরে দেখল কি যেন নড়ে উঠল

ওই যে লুপিন, হারমিওন ফিসফিস করে বলল। রূপান্তরিত হচ্ছেন

হারমিওন! হঠাৎ বলে উঠল হ্যারি। আমাদেরকে তাড়াতাড়ি সরে পড়তে হবে!

না, আমাদের নড়া উচিত না, তোমাকে বার বার বলছি

না, ওইখানে গিয়ে কিছু করার জন্য নয়! কিন্তু রূপান্তরিত লুপিন তো দৌড়ে এই বনেই ঢুকবে, একেবারে সোজা আমাদের দিকে!

নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল হারমিওন-এর।

জলদি! চাপা আর্তনাদ করে উঠল সে, ছুটে গেল বাকবিক-এর বাঁধন খুলে দিতে। জলদি! আমরা কোথায় যাব? আমরা কোথায় লুকবো? যেকোন মুহূর্তে ডিমেন্টাররা চলে আসতে পারে

আবার হ্যাগ্রিড-এর ওখানে ফিরে যেতে হবে! বলল হ্যারি। ওখানে এখন কেউ নেই–জলদি চল!

দৌড় শুরু করল ওরা, যত জোরে পারে, পেছন পেছন ছুটছে বাকবিক। শুনতে পাচ্ছে ওরা পেছন থেকে ওয়েরউলফ-এর গর্জন।

কেবিনটা দেখা যাচ্ছে। থামল হ্যারি দরজার সামনে, টান মেরে খুলল ওটা, হারমিওন আর বাকবিক বাতাসের মতো উড়ে ওর পাশ দিয়ে কেবিনে ঢুকে পড়ল; ওদের পেছন পেছন নিজেকে একরকম ছুঁড়ে কেবিনে ফেলল হ্যারি, তারপর দরজাটা লাগিয়ে দিল। হ্যাগ্রিড-এর কুকুরটা বিকট শব্দে ঘেউ ঘেউ করে উঠল।

শশশ, ফ্যাং, আমরা, আমরা! বলল হারমিওন, ওটার কাছে গিয়ে আদর করে চুপ করালো ওটাকে। প্রায় মারা পড়েছিলাম আর কি! বলল সে হ্যারিকে।

হ্যাঁ

জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে হ্যারি। বাইরে কি ঘটছে এখান থেকে সেটা দেখা খুব কঠিন। হ্যাগ্রিড-এর ঘরের ভেতরে আবার আসতে পেরে বাকবিক মনে হয় মহাখুশি। আগুনের সামনে শুয়ে পড়ে, পাখাগুলো গুটিয়ে মনে হচ্ছে একটা ঘুম দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে।

এখন মনে হয় আমাদের বাইরেই যাওয়া উচিত, বলল হ্যারি। ওখানে কি ঘটছে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। আমরা বুঝতে পারব না কখন রওনা দিতে হবে

ওর মুখের দিকে তাকাল হারমিওন। ভাবে সন্দেহ।

আমি ওখানে যা ঘটছে তাতে কোনভাবেই নাক গলাব না, বলল হ্যারি দ্রুত। কিন্তু, কি হচ্ছে সেটা যদি দেখতে না পারি, তাহলে বুঝব কীভাবে কখন গিয়ে সাইরিয়াসকে উদ্ধার করতে হবে?

বেশ ঠিক আছে তাহলে বাকবিককে নিয়ে আমি এখানেই অপেক্ষা করব কিন্তু, সাবধানে থেক হ্যারি–বাইরে একটা ওয়েরউলফ রয়েছে–আরও রয়েছে ডিমেন্টাররা–

বাইরে বেরিয়ে কেবিনের ধার দিয়ে এগেলো হ্যারি। দূরে শোনা যাচ্ছে তীক্ষ্ণ কণ্ঠের চিৎকার। তার মানে ডিমেন্টাররা সাইরিয়াসকে প্রায় ঘিরে ফেলছে যেকোন মুহূর্তে সে আর হারমিওন দৌড়ে ওর কাছে যাবে।

লেকের দিকে তাকিয়ে রইল হ্যারি, বুকের ভেতরে হৃৎপিণ্ডটা ড্রাম বাজাচ্ছে। ওই পেট্রোনাসটা যেই পাঠিয়েছিল আবার যেকোন মুহূর্তে তিনি আসবেনই।

মুহূর্তে কয়েক ভাগের এক ভাগ সময়ের জন্য হ্যাগ্রিড-এর দরজার সামনে অনিশ্চিতভাবে দাঁড়িয়ে থাকল সে। তোমাকে যেন দেখা না যায়। কিন্তু সেও চায় না যে তাকে দেখা যাক। সে চায় দেখতে তাকে জানতে হবে।

এবং ওই যে ডিমেন্টাররা এসে পড়েছে। অন্ধকারের ভেতর থেকে চারদিকে থেকেই আসছে ওরা, লেকের উপর দিয়ে হ্যারি যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখান থেকে উল্টো দিকের পাড়ে যাচ্ছে ওরা

দৌড়াতে শুরু করল হ্যারি। মাথায় তখন বাবার কথা ছাড়া আর কোন চিন্তা নেই যদি তিনিই হন সত্যিই যদি তিনি হন তাকে সেটা জানতে হবে, বের করতে হবে।

লেকটা চলে আসছে ওর কাছে, আরও কাছে, কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না। অপর পাড়ে, দেখতে পাচ্ছে রূপার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঝিলিক–ও নিজে যে পেট্রোনাস তৈরি করেছিল সেই চেষ্টা।

পানির ধারে ছোট ছোট ঝোপ রয়েছে। একটার পেছনে হ্যারি গিয়ে লুকোলো, ওটার ভেতর থেকে দেখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। অপর পাড়ে, রূপার ঝিলিকগুলো যেন নিভে গেল। ওর ভেতরে উত্তেজনার জোয়ার বয়ে চলেছে। এখন থেকে যেকোন মুহূর্তে

এসো! বিড়বিড় করছে সে, তাকিয়ে রয়েছে অপলক। কোথায় তুমি? বাবা, এসো–

কিন্তু কেউ এলো না। লেক-এর অপর পাড়ে ডিমেন্টারদের বৃত্তের মাঝে দেখার জন্যে মাথা তুলল সে। ওদের একজন মাথার উপর থেকে কাপড়টা ফেলে দিচ্ছে। তার উদ্ধারকারী আসার মুহূর্ত উপস্থিত–কিন্তু এখন তো কেউ আসছে না সাহায্য করতে

এবং হঠাৎ তার মনে হলো–সে বুঝতে পেরেছে। সে তার বাবাকে দেখেনি সে তার নিজেকে দেখেছিল

ঝোপের আড়াল থেকে লাফিয়ে উঠল সে, জাদুর কাঠি বের করল।

এক্সপেক্টো পেট্রোনাম! চিৎকার করল সে।

জাদুর কাঠির মাথা থেকে আকৃতিহীন কুয়াশার মেঘ বেরিয়ে এলো না, কিন্তু বেরিয়ে এলো চোখ ধাঁধানো রূপালী একটা জন্তু। চোখ সরু করল সে, দেখার চেষ্টা করছে এটা কি। দেখতে ঠিক ঘোড়ার মতো। ওর কাছ থেকে দ্রুত দৌড়ে লেকের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে ওটা। ও দেখল মাথা নিচু করে ডিমেন্টারের দলটার দিকে ধেয়ে যাচ্ছে ওটা এখন কালো আকৃতির ডিমেন্টরদের বৃত্তের চারদিকে ওটা ছুটছে ঘুরছে, আর ডিমেন্টারগুলো আস্তে আস্তে পিছু হটছে, ছত্রভঙ্গ হয়ে যাচ্ছে, অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে … চলে গেছে ওরা।

পেট্রোনাসটা ঘুরে দাঁড়াল। এবার হ্যারির দিকে ফিরে আসছে পানির উপর দিয়ে। ওটা একটা ঘোড়া। কিন্তু রূপকথার ইউনিকর্ন নয়। ওটা একটা পুরুষ হরিণ। চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে … ওর দিকে ফিরে আসছে ….

তীরে এসে থামল ওটা, হ্যারির দিকে তাকিয়ে রয়েছে বড়বড় রূপালী চোখ দিয়ে, নরম মাটিতে ওটার খুরের কোন দাগ পড়ল না। ধীরে ধীরে ওটা সিংওয়ালা মাথাটা নোয়ালো। এখন বুঝতে পারল হ্যারি

প্রংস, ফিসফিস করল সে।

কিন্তু ওর কাঁপা কাঁপা আঙুলগুলো জটার দিকে বাড়িয়ে দিতেই ওটা অদৃশ্য হয়ে গেল।

ওখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে হ্যারি, তখনও হাত বাড়ানো। হৃৎপিণ্ডটা আবার লাফিয়ে উঠল, পেছনে খুরের শব্দ শুনতে পেয়েছে সে বিদ্যুৎ বেগে ঘুরে দাঁড়াল সে এবং দেখল হারমিওন ছুটে আসছে ওর দিকে সঙ্গে টেনে নিয়ে আসছে বাকবিককে।

কী করেছো তুমি? তীক্ষ্ণ স্বরে বলল সে। তুমি বলেছিলে শুধু বাইরে নজর রাখবে!

এই মাত্র আমি আমাদের সকলের জীবন বাঁচালাম  বলল হ্যারি। এই ঝোপের আড়ালে এসো–আমি সব ব্যাখ্যা করছি।

এই মাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো হা করে শুনল হারমিওন।

তোমাকে কেউ দেখে ফেলেনি তো?

হ্যাঁ, তুমি কী শুনছিলে না? আমিই আমাকে দেখেছি, কিন্তু আমি ভেবেছিলাম আমিই আমার বাবা! বুঝতে পেরেছো!

হ্যারি, আমি বিশ্বাস করতে পারছি না–তুমি একটা পেট্রোনাস তৈরি করে সমস্ত ডিমেন্টারদের তাড়িয়ে দিলে! ওটা, ওটা খুবই, খুবই উন্নতমানের ম্যাজিক

আমি জানতাম এইবার আমি করতে পারব, বলল হ্যারি, কারণ আমি ইতোমধ্যে তো করে ফেলেছি বোঝা যাচ্ছে কিছু? আমি জানি না–হ্যারি, স্নেইপ-এর দিকে তাকাও!

ঝোপের আড়াল থেকে অপর পাড়ে ওরা দেখল জ্ঞান ফিরে এসেছে স্নেইপ এর। জাদু করে স্ট্রেচার আনছেন উনি, হ্যারি, হারমিওন এবং ব্ল্যাককে ওগুলোর ওপর তুলছেন। চতুর্থ একটা স্ট্রেচার, নিশ্চয়ই রনকে বহন করছে, এরই মধ্যে বাতাসে ভাসছে। হাতে জাদুর কাঠি নিয়ে স্ট্রেচারগুলোসহ প্রাসাদের দিকে রওনা হলেন তিনি।

ঠিক, সময় হয়ে এসছে, বলল হারমিওন উদ্বেগের সঙ্গে, নিজের ঘড়িটা দেখল সে। আমাদের প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় রয়েছে, এরপর ডাম্বলডোর হাসপাতালের দরজায় তালা লাগিয়ে দেবেন। সাইরিয়াসকে উদ্ধার করে আমাদেরকে ওখানে ফিরে যেতে হবে কেউ কিছু বোঝার আগে

অপেক্ষা করছে ওরা। মেঘের আনাগোনা প্রতিফলিত হচ্ছে লেকে, ওদের পাশের ঝোপটার মধ্যে দিয়ে বাতাস ফিসফিস করে গেল। বিরক্ত হয়ে বাকবিক আবার পোকা খুঁজতে শুরু করল।

তোমার কী বিশ্বাস হয় যে ও এখনও ওখানেই রয়েছে? বলল হ্যারি, নিজের ঘড়িটা দেখে। প্রাসাদের দিকে তাকিয়ে পশ্চিম টাওয়ারের ডানদিকের জানলাগুলো গুনছে সে।

দেখ! ফিসফিস করল হারমিওন। ওটা কে আবার? আবার কে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে আসছে?

অন্ধকারে তাকিয়ে রয়েছে হ্যারি। লোকটা মাঠের উপর দিয়ে দ্রুত প্রাসাদে ঢোকার গেটের দিকে যাচ্ছে। ওর বেল্টে চকচক করছে কি যেন একটা।

ম্যাকনায়ার! বলল হ্যারি। ঘাতক! ও যাচ্ছে ডিমেন্টারদেরকে আনতে! হয়ে গেল, হারমিওন

বিকবিক-এর পিঠের উপরে হাত রাখল হারমিওন, হ্যারি ওকে তুলে দিল পিঠের উপরে। তারপর গাছের একটা ডালে পা রেখে নিজেও উঠে পড়ল হারমিওন-এর সামনে। বাকবিক-এর দড়িটা টান করে লাগাম-এর মতো বাধল।

রেডি? হারমিওনকে জিজ্ঞাসা করল। তুমি আমাকে ভালো করে ধরে রাখবে।

গোড়ালি দিয়ে বাকবিক-এর দুই পাশে খোঁচা দিল হ্যারি।

অন্ধকার আকাশে উড়ে গেল বাকবিক। হাঁটু দিয়ে ওর দুপাশে চেপে ধরে আছে হ্যারি, নিচে ওটার শক্তিশালী দুই পাখা উঠছে নামছে। হারমিওন শক্ত করে ধরে আছে হ্যারির কোমর ও শুনতে পাচ্ছে, বিড়বিড় করছে সে, ওহ, না–আমার এটা পছন্দ হচ্ছে না–ওহ, সত্যিই আমার পছন্দ হচ্ছে না।

খোঁচা মেরে বাকবিককে দ্রুত উড়িয়ে নিল হ্যারি। নিঃশব্দে ওরা উড়ছে প্রাসাদের উপর তলার দিকে বাঁদিকের রশিটা টেনে ধরল হ্যারি ঘোরালো বাকবিককে। পাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া জানালাগুলো গোনার চেষ্টা করছে সে

হোআ! বলল সে। লাগামটা টেনে ধরল সর্বশক্তি দিয়ে।

ধীরে ধীরে গতিমন্থর হয়ে এলো বাকবিক-এর। এবং ওরা নিজেদেরকে এক জায়গায় স্থির দেখতে পেল, অবশ্য উড়ন্ত অবস্থায় ওর পাখাটা উঠছে নামছে বলে কয়েক ফিট উপরে এবং নিচে ওঠানামা করছে ওরা।

এখানেই আছে সে! হ্যারি বলল, জানালার কাছে উড়ে গিয়ে। হাত বাড়িয়ে জানালার কাঁচে টোকা দিল হ্যারি।

মাথা তুলে তাকাল ব্ল্যাক। হ্যারি দেখল ওর চোয়াল ঝুলে পড়েছে। চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠল সে। দ্রুত চলে এলো জানালার পাশে, খোলার চেষ্টা করল ওটা, কিন্তু ওটা তালা লাগানো।

পেছনে সরে দাঁড়াও! হারমিওন বলল ওকে, নিজের জাদুর কাঠিটা বের করল, এক হাতে তখনও ধরে রয়েছে হ্যারিকে বলল

আলোহোমোরা!

খুলে গেল জানালাটা।

কীভাবে কীভাবে? দুর্বল স্বরে বলল ব্ল্যাক, তাকিয়ে রয়েছে হিপোগ্রিফটার দিকে।

উঠে পড়, জলদি–সময় নেই, বলল হ্যারি, বাকবিক-এর গলা জড়িয়ে ধরে রেখেছে শক্ত করে। এখান থেকে তোমাকে এখন বেরুতেই হবে–ডিমেন্টাররা আসছে। ম্যাকনায়ার ওদেরকে আনতে গেছে।

জানালার ফ্রেমে দুই হাত দিয়ে মাথা এবং কাঁধ বের করে আনল ব্ল্যাক। সৌভাগ্যক্রমে সে ছিল খুবই ক্ষীণ দেহী। মুহূর্তের মধ্যে বাকবিক-এর পিঠের উপরে এক পা দিয়ে হারমিওন-এর পেছনে উঠে পড়ল সে।

ঠিক আছে, বাকবিক এবার উপরে ওঠো! বলল হ্যারি লাগামটা টান দিয়ে। একেবারে টাওয়ারের মাথায়!

শক্তিশালী দুই পাখার এক ঝাপটায় আবার আকাশের দিকে উড়তে শুরু করল বাকবিক, উড়তে উড়তে একেবারে পশ্চিম টাওয়ারের মাথায়। নামল ওখানে, হ্যারি আর হারমিওন সঙ্গে সঙ্গে পিঠ থেকে নেমে পড়ল।

সাইরিয়াস, তুমি খুব দ্রুত এখান থেকে সরে পড়, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল হ্যারি। যেকোন মুহূর্তে ওরা ফ্লিটউইক-এর অফিসে পৌঁছে যাবে, দেখতে পাবে তুমি নেই।

টাওয়ারের ছাদে থাবা দিয়ে আঁচড় কাটার চেষ্টা করল বাকবিক, বিশাল মাথাটা নামল।

অন্য ছেলেটার কী হয়েছে? রন? বলল সাইরিয়াস ব্যগ্র কণ্ঠে।

ও ঠিক হয়ে যাবে-এখনও সে অজ্ঞান, কিন্তু মাদাম পমফ্রে বলেছেন তিনি ওকে সারিয়ে তুলতে পারবেন। যাও–জলদি!

কিন্তু ব্ল্যাক তখনও দেখছে হ্যারিকে।

কিভাবে যে ধন্যবাদ।

যাও! হ্যারি আর হারমিওন এক সাথে চিৎকার করে উঠল।

খোলা আকাশের দিকে বাকবিককে ঘুরিয়ে নিল ব্ল্যাক।

আবার আমাদের দেখা হবে, বলল সে। সত্যিই তুমি–সত্যিই হ্যারি তুমি তোমার বাবার সন্তান।

গোড়ালি দিয়ে বাকবিক-এর দুই পাশে চাপ দিল ব্ল্যাক। বিশাল পাখা দুটো নড়তে শুরু করতেই হ্যারি আর হারমিওন লাফ দিয়ে সরে গেল আকাশে উড়ল হিপোগ্রিফ সে আর তার আরোহী ছোট থেকে ছোট হতে হতে হ্যারি দেখার চেষ্টা করছে … তারপরে চাঁদটাকে ঢেকে দিল মেঘ চলে গেছে ওরা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *