সাইফুল ইসলাম রাত এগারটার সময় এসে উপস্থিত। জহুর মশারি ফেলে ঘুমাবার আয়োজন করছিল। সাইফুল ইসলামকে দেখে অবাক হয়ে বেরিয়ে এল।
জহুর ভাই, আমি বলেছিলাম–আসব।
এত রাতে আসবেন ভাবি নি।
নান্টুর দোকানে চা খাচ্ছিলাম। এত রাত হয়েছে টের পাই নাই।
ব্যাপার কি?
সাইফুল ইসলাম ইতস্তত করতে লাগল। জহুর বলল, বসেন, ঐ বেঞ্চিটাতে বসেন।
সাইফুল ইসলাম বসল না। জহুর বলল, বলেন শুনি, কি ব্যাপার।
আপনি বুঝি বারান্দাতে ঘুমান?
হুঁ।
সাপখোপের ভয় আছে কিন্তু। সময়টা খারাপ।
জহুর সিগারেট ধরাল।
নিন, সিগারেট নিন।
সাইফুল ইসলাম সিগারেট নিল। মৃদুস্বরে বলল, সিগারেট খাওয়া আমি ছেড়ে দিয়েছি জহুর ভাই। খরচে পোষায় না। টাকাপয়সার খুব টানটানি আমার।
ছাড়তে পারলে তো ভালোই।
পুরাপুরি ছাড়তে পারি নাই। মাঝেমাঝে খাই।
জহুর বলল, কি বলতে এসেছেন, বলেন।
সাইফুল ইসলাম মৃদু স্বরে বলল, আসেন, রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে কথা বলি।
জহুর রাস্তায় নেমে এল। এতটুকু বাতাস নেই কোথাও। গাছের পাতা পর্যন্ত নড়ছে না। মেঘ-বৃষ্টি হবে এমন লক্ষণও নেই। ঝকঝক করছে আকাশ। সাইফুল ইসলাম চাপা গলায় বলল, মনটা খুব খারাপ জহুর ভাই। একটা মানুষ মেরে ফেলেছে, কিন্তু কেউ একটা কথা পর্যন্ত বলছে না।
কাকে মেরে ফেলেছে?
মনসুর। মনসুর আলি। পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।
সাইফুল ইসলাম রুমাল বের করে ঘাড় মুছতে লাগল। থেমে থেমে বলল, পরশু রাতে মনসুর আলিকে দেখলাম। মাথা নিচু করে কবরের পাশে বসে ছিল।
কাকে দেখলেন?
মনসুর আলিকো কালকেও দেখেছি।
আপনার কথা বুঝতে পারছি না।
কালকে গরমের জন্যে মাঠের মধ্যে বসে ছিলাম। তখন দেখলাম। পরিষ্কার দেখলাম। হাতে চটের একটা বস্তা ছিল।
জহুর দীর্ঘ সময় চুপ করে রইল। তারপর সিগারেট ধরাল।
নিন, আরেকটা সিগারেট নিন।
সাইফুল ইসলাম হাত বাড়িয়ে সিগারেট নিয়ে পকেটে রেখে দিল।
কাল সকালে নাশতার পরে খাব।
জহুর মৃদু স্বরে বলল, যান, বাড়িতে গিয়ে ঘুমান। সকালে কথা বলব।
আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেন নাই, না?
জহুর জবাব দিল না।
আপনি আমার সঙ্গে যদি আসেন তাহলে নিজের চোখে দেখবেন। আসেন জহুর ভাই।
আজকে আর যাব না কোথায়ও।
জহুর ভাই, একা-একা তো বাড়ি যেতে পারব না। ভয় লাগে। একটু এগিয়ে দেন।
জহুর হাঁটতে শুরু করল। সারা পথে আর কোনো কথাবার্তা হল না। কবরখানার পাশ দিয়ে যাবার সময় সাইফুল ইসলাম মৃদু স্বরে বলল, আজকে নাই।
জহুর বলল, এখন যেতে পারবেন একা-একা?
জ্বি।
যান, ঘুমিয়ে পড়েন গিয়ে। সকালে কথা বলব।
আমার সকালে ঘুম আসে না।
কী করেন এত রাত পর্যন্ত?
চিঠি লেখি।
রোজ চিঠি লেখেন?
সাইফুল ইসলাম ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
জহুর বাড়ি ফিরে দেখে দবির মিয়া বারান্দার বাতি জ্বালিয়ে গম্ভীর মুখে বসে আছে।
এত রাতে তুমি গিয়েছিলে কোথায়?
সাইফুল ইসলাম এসেছিল, ওর সঙ্গে একটু গিয়েছিলাম।
বিছানপত্র এইভাবে ফেলে রেখে গেছ? চোরের উপদ্ৰব।
জহুর চুপ করে রইল। দবির মিয়া রাগী স্বরে বলল, ঐ হারামজাদা সাইফুল ইসলাম ঘুরঘুর করছে কী জন্যে?
কি জানি দেখেছে।
দেখবে আবার কী? শালা চালবাজ। আমার সাথে ফাজলামি করে।
কী করেছে আপনার সাথে?
বলে বিনা পয়সায় গান শিখাবে। মিয়া তানসেন এসেছে। চড় দিয়ে দাঁত খুলে ফেলব।
জহুর ঘুমাবার আয়োজন করল। দবির মিয়া বাতি নিভিয়ে দিল, কিন্তু সেই রইল বাইরে। জহুর বলল, শুয়ে পড়েন গিয়ে দুলাভাই।
দবির মিয়া সিগারেট ধরাল। ক্লান্ত স্বরে বলল, রাতে বারান্দায় ঘুমানটা ঠিক না। সময় খারাপ।
জহুর চুপ করে রইল। দবির মিয়া সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ক্রমাগত কাশতে লাগল। জহুর বলল, দুলাভাই, আপনি কি কিছু বলবেন?
হুঁ।
জহুর মশারি থেকে মাথা বের করল।
ব্যাপার কি দুলাভাই?
আমার সময়টা ভালো যাচ্ছে না। দোকানে চুরি হয়েছে আরেক বার।
শুনেছি।
শুনে মানে, কার কাছ থেকে শুনেছ?
এত লুকানর কী আছে এর মধ্যে?
আছে, আছে, তুমি বুঝবে না।
থানার পেটাঘড়িতে বারটার ঘন্টা পড়ল। দবির মিয়া বলল, চৌধুরী সাহেব যে কাজটা দিতে চায়, সেই কাজটা তুমি নেও জহুর। পুরনো কথা ভুলে যাওয়াই ঠিক।
জহুর বিছানা থেকে বের হয়ে বেধির ওপর বসল। দবির মিয়া বলল, আমরা অনেক কিছু হজম করি। টিকে থাকার জন্য করতে হয়। কি, ঠিক না।?
জহুর জবাব দিল না। দবির দ্বিতীয় একটি সিগারেট ধরিয়ে ধীর স্বরে বলল, চৌধুরী সাহেব এখন মনে হয় কিছুটা লজ্জিত। তোমার খোঁজখবর করছে এই জন্যই। সুযোগটা নেওয়া দরকার, বুঝলে? আর ঐ যে একটা মেয়ের কথা বলেছিলেন, দেখলাম মেয়েটাকে। বেশ ভালো মেয়ে। ম্যাট্রিক সেকেণ্ড ডিভিশনে পাস করেছে। কলেজে আর ভৰ্তি হয় নাই। একটু খাটো, কিন্তু ফর্সা গায়ের রঙ। চুলও দেখলাম। চৌধুরী সাহেব বলেছেন বিয়ের খরচপাতি দেবেন।
তার সাথে আপনার আজকেই কথা হয়েছে?
হুঁ। টুনীরবিয়েরও একটা প্রস্তাব দিলেন। ছেলেরকাপড়ের ব্যবসা, সৈয়দংশ। গ্রামে দোতলা পাকা দালান।
চৌধুরী সাহেবের আত্মীয়?
না, তবে চেনা-জানা। মঙ্গলবার মেয়ে দেখতে আসবে।
ছেলের পড়াশুনা কেমন?
পড়াশুনা তেমন কিছু না। সব মিলিয়ে কি পাওয়া যায়। তবে ছেলে দেখতে। সুন্দর। লম্বা-চওড়া।
ভালোই তো।
ছেলের টাকা আছে। টাকাটা খুব দরকারী জিনিস। টাকা থাকলে সব কিছু হয়। যখন বয়স কম থাকে, তখন মনে হয় টাকাটা বড়ো কিছু না, কিন্তু যখন বয়স বেশি হয়, সত্যি কথাটা বোঝা যায়।
জহুর মৃদু স্বরে বলল, টুনীর সম্ভবত গান-বাজনার শখ।
দবির মিয়া উঠে পড়ল। জহুর অন্ধকারে বেঞ্চির ওপর অনেক রাত পর্যন্ত বসে রইল।